কুফাতে উবায়দুল্লাহ
আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে দেখেছি যে যখন উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ বসরা থেকে কুফা যেতে চাইলো তখন শারীক বিন আওয়ার তার সাথে ছিলো। শিয়া মতবাদের প্রতি শারীকের শক্তিশালী আকর্ষণ ছিলো। সে সিফফীনের যুদ্ধে আম্মার বিন ইয়াসিরের সাথে ছিলো [‘
কামিল ’ , তাবারি] (হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের পক্ষে ও মুয়াবিয়ার বিপক্ষে) এবং মুয়াবিয়ার সাথে তার বিতর্ক সুপরিচিত ছিলো। যখন শারীক (উবায়দুল্লাহর সাথে) বসরা ছেড়ে এলো পথে সে পরিশ্রান্তও অসুবিধার ভান করলো। সে চেয়েছিলো উবায়দুল্লাহ তার সাথেই থেকে যাবে এবং এভাবে ইমাম হোসেইন (আ.) তার আগেই কুফায় পৌঁছে যাবেন , কিন্তু উবায়দুল্লাহ তার দিকে কোন মনোযোগ দিল না এবং এগিয়ে গেলো।
যখন শারীক কুফায় পৌঁছলো সে হানি বিন উরওয়াহর বাসায় থাকলো এবং তাকে অনবরত উৎসাহিত করতে লাগলো মুসলিম বিন আক্বীলকে এবং তার নেতৃত্বকে সমর্থন দেয়ার জন্য। শারীক অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং যেহেতু উবায়দুল্লাহ [কামিল , মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব] এবং অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিরা তাকে সম্মান করতো তাই সে তাকে একটি সংবাদ পাঠালো যে সে রাত্রে তাকে দেখতে আসবে। শারীক মুসলিমকে বললো ,“
আজ রাতে এ বদমাশ লোকটা আমাকে দেখতে আসবে এবং যখন সে বসবে তখন তুমি পিছন দিয়ে এসে তাকে হত্যা করবে। এরপর তুমি প্রাসাদে যাবে এবং নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিবে এবং কেউ তোমাকে বাধা দিবে না। আর যদি আমি এ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করি তাহলে আমি বসয়ায় যাবো এবং সেখানকার বিষয়গুলো তোমার জন্য সহজ করে দিবো। ”
[আবুল ফারাজের গ্রন্থে বলা হয়েছে] রাতে উবায়দুল্লাহ শারীককে দেখতে এলো। এর আগে শারীক মুসলিমকে বলেছিলো ,“
যখন ঐ লোক এখানে প্রবেশ করবে তাকে তোমার হাত থেকে পালিয়ে যেতে দিও না। ” হানি উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন ,“
আমি এতে মত দেই না যে উবায়দুল্লাহকে আমার বাড়িতে হত্যা করা হোক ” এবং এ চিন্তাকে অপছন্দ করলো। উবায়দুল্লাহ এলো এবং বসলো এবং শারীকের কাছে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে চাইলো এবং তাকে জিজ্ঞেস করলো তার কী অসুখ হয়েছে। যখন তাদের কথোপকথন দীর্ঘ হলো শারীক দেখলো যে কেউ বের হয়ে এলো না এবং আশঙ্কিত হলো যে উদ্দেশ্য সফল হবে না , তখন সে নিচের পঙ্ক্তিগুলো আবৃত্তি করলো।“
কেন সালমাকে উপহার দেয়ার কথা আগ বাড়িয়ে চিন্তা করছো , তাকে (সালমাকে) এবং যে তাকে দান করে , তার গলায় মৃত্যুর পেয়ালাকে ঢেলে দাও। ”
সে এটি দুবার এবং তিন বার বললো। উবায়দুল্লাহ তা শুনে বুঝতে পারলো না এবং বললো , সে প্রলাপ বকছে অসুস্থতার ঘোরে। হানি বললো ,“
হ্যাঁ , তা সত্যি , আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিন , সে এ অবস্থায় আছে গতকাল থেকে। ” উবায়দুল্লাহ উঠলো এবং চলে গেলো।
[তাবারির গ্রন্থে বলা হয়েছে] এছাড়া বলা হয় যে , উবায়দুল্লাহ তার পরামর্শক মেহরানকে সাথে নিয়ে এসেছিলো। যখন শারীক মুসলিমকে বলেছিলো যে সে যখন পানি চাইবে মুসলিম তখন আসবে এবং উবায়দুল্লাহকে আঘাত করবে। উবায়দুল্লাহ এলো এবং শারীকের কাছে তার বিছানায় বসলো এবং তার পরামর্শক মেহরান তার পিছনে তার মাথার কাছে দাড়ালো। শারীক পানি চাইলো এবং যখন কাজের মহিলা পানি আনছিলো তার দৃষ্টি পড়লো মুসলিমের ওপরে যে ওঁত পেতে ছিলো এবং সে সরে গেলো। সে আবার পানি চাইলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না এবং আবার সে তৃতীয় বারের মত পানি চাইলো এবং বললো ,“
আক্ষেপ তোমাদের জন্য! তোমরা আমাকে পানি দিচ্ছো না। আমাকে পানি দাও যদি এতে আমার মৃত্যুও হয়। ” মেহরান বুঝতে পারলো এবং সে উবায়দুল্লাহকে ইশারা করলো , এতে সে উঠে দাঁড়ালো চলে যাবার জন্য। শারীক বললো যে সে উবায়দুল্লাহর কাছে অসিয়ত করে যেতে চায় , সে উত্তর দিলো সে অন্য আরেক সময়ে আসবে এবং এরপর চলে গেলো। মেহরান তাকে দ্রুত নিয়ে চলে গেলো এবং বললো ,“
আল্লাহর শপথ , তারা আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। ”
উবায়দুল্লাহ বললো ,“
তারা এটি কিভাবে করতে পারে যখন আমি শারীককে সম্মান করি এবং তার প্রতি দয়া দেখাই এবং তাও আবার হানির বাড়িতে , যাকে আমার বাবা উপকার করেছে ?”
মেহরান বললো ,“
আমি যা বলছি তা সত্য। ”
[‘
কামিল ’ গ্রন্থে আছে] যখন উবায়দুল্লাহ চলে গেলো , মুসলিম লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং শারীক তাকে জিজ্ঞেস করলো উবায়দুল্লাহকে হত্যা করতে কী তাকে বাধা দিলো। মুসলিম বললেন , তা করতে আমাকে দুটো জিনিস বাধা দিলো। প্রথমত হানি চায় না যে উবায়দুল্লাহকে তার বাড়িতে হত্যা করা হোক এবং একটি হাদীসের জন্য যা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ,“
ইসলাম কাউকে বেখবর অবস্থায় হত্যা করতে নিষেধ করে এবং একজন বিশ্বাসী তা থেকে বিরত থাকে। ”
শারীক বললো ,“
তুমি যদি তাকে হত্যা করতে তাহলে তুমি প্রকৃতপক্ষে হত্যা করতে একজন সীমালঙ্ঘনকারী বদমাশ এবং একজন চতুর অবিশ্বাসীকে। ”
ইবনে নিমা বলেন , যখন উবায়দুল্লাহ চলে গেলো এবং মুসলিম শারীকের কাছে এলেন তরবারি হাতে নিয়ে , শারীক তাকে জিজ্ঞেস করলো কী তাকে কাজটি করতে বাধা দিলো। মুসলিম বললেন ,“
আমি যখন প্রায় বেয়িয়ে আসছি তখন হানির স্ত্রী আমাকে অনুরোধ করলো উবায়দুল্লাহকে তাদের বাড়িতে হত্যা না করতে এবং কাঁদতে শুরু করলো । তখন আমি আমার তরবারি ফেলে দিলাম এবং বসে পড়লাম। ” হানি বললেন ,“
ঐ মহিলার জন্য আক্ষেপ , সে নিজেকে এবং আমাকে হত্যা করেছে এবং আমি যা থেকে পালিয়েছি তা শেষ পর্যন্ত ঘটেছে। ”
[‘
কামিল ’ গ্রন্থে আছে] শারীক আরও তিন দিন বেঁচে ছিলো এবং এরপর মারা গেলো। উবায়দুল্লাহ তার জানাযার নামাযে ইমামতি করলো এবং পরে তাকে জানানো হলো যে শারীক তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। সে বললো ,“
আল্লাহর শপথ , আমি এখন থেকে আর কোন ইরাকীর জানাযায় ইমামতি করবো না এবং যদি (আমার পিতা) যিয়াদ তার পাশেই সমাহিত না হতো আমি অবশ্যই শারীকের লাশ কবর থেকে আবার উঠাতাম। ”
শারীকের মৃত্যুর পর উবায়দুল্লাহর পরামর্শক মা’
ক্বাল , যাকে তাদের ওপরে গোয়েন্দাগিরির জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিলো , তার সম্পদ দিয়ে মুসলিম বিন আওসাজার কাছে এলো। মুসলিম তাকে মুসলিম বিন আক্বীলের কাছে নিয়ে গেলো যিনি তার কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন। এরপর সে আবু সামামাহ সায়েদিকে ডাকলো , যে সব অর্থনৈতিক লেনদেন দেখাশোনা করতো , যেন সে তার কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে। আবু সামামাহ অস্ত্র কেনার দায়িত্বে ছিলো। সে ছিলো আরবদের মাঝে সাহসী হিসেবে সুপরিচিত এবং শিয়াদের মাঝে বিশিষ্টতার অধিকারী। [‘
কামিল ’ ] মা’
ক্বাল তাদের কাছে আসতে শুরু করলো । তাদের কথাবার্তা শুনলো এবং তাদের গোপন কথা জেনে উবায়দুল্লাহর কাছে জানাতে থাকলো। আর হানি নিজেকে অসুস্থ জানিয়ে উবায়দুল্লাহর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন।
উবায়দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আশআস এবং আসমা বিন খারেজা এবং আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদিকেও ডাকলো , যার কন্যা রুয়াইয়াহ হানির স্ত্রী ছিলো এবং তার সন্তান ইয়াহইয়ার মা ছিলো। উবায়দুল্লাহ হানির বিষয়ে এবং তাদের কাছ থেকে তার দূরে সরে থাকার খোঁজ খবর নিলো [‘
কামিল ’ ] এবং তাকে বলা হলো যে সে সুস্থ নয়। উবায়দুল্লাহ বললো ,“
আমি শুনেছি সে ভালো আছে এবং দরজায় বসে। যাও তার সাথে দেখা করো এবং তাকে বলো যা তার জন্য বাধ্যতামূলক তা এড়িয়ে না চলতে। ” তারা হানির কাছে এলো এবং বললো ,“
উবায়দুল্লাহ তোমার খোঁজ খবর নিয়েছে এবং বলেছে যে যদি তুমি অসুস্থ হও তিনি তোমাকে দেখতে আসবেন এবং লোকজন তাকে বলেছে যে তুমি প্রায়ই তোমার দরজায় বস। তিনি দৃঢ়ভাবে জানতে চান যে কেন তুমি নিজেকে তার কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছো অথচ সেনাপতি এ দূরত্ব বজায় রাখা ও অকৃতজ্ঞতাকে সহ্য করবেন না। তাই আমরা তোমাকে অনুরোধ করছি যে তুমি আমাদের সাথে চলো। ” তখন হানি তার পোষাক চাইলেন এবং তা পরলেন এবং খচ্চরের ওপরে চড়ে বসলেন ; আর যখন তিনি প্রাসাদে পৌঁছালেন তার হৃদয়ে একটি ভয় প্রবেশ করলো যে হয়তো আরও কোন সমস্যা হতে পারে।
হিসান বিন আল আসমা বিন খারেজাকে হানি বললেন ,“
হে ভাতিজা , আমি এ লোকটিকে ভয় পাচ্ছি , তুমি কী মনে কর ?”
সে বললো ,“
আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারণ আমি দেখছি না , তাই অন্তর থেকে ভয় দূর করুন।”
আসমা (অথবা হিসান বিন আল আসমা) ফাঁদ সম্পর্কে জানতো না কিন্তু মুহাম্মাদ বিন আল আশআস এ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতো। এরপর তারা হানিকে নিয়ে উবায়দুল্লাহর দরবারে প্রবেশ করলো। যখন উবায়দুল্লাহ হানিকে দেখলো [‘
ইরশাদ’
] সে বললো ,“
বিশ্বাসঘাতক তার নিজের পায়ে হেঁটেই প্রবেশ করেছে। ”
যখন হানিকে উবায়দুল্লাহর কাছে আনা হলো , শুরেইহ তার পাশেই বসা ছিলো এবং উবায়দুল্লাহ দুই লাইন কবিতা আবৃত্তি করলো ,“
আমি চাই সে বেঁচে থাকুক কিন্তু সে চায় আমাকে হত্যা করতে। ” [‘
কামিল ’ ] উবায়দুল্লাহ আগে হানির প্রতি দয়ালু ছিলো এবং তাই সে তাকে বললো কী ঘটেছে। উবায়দুল্লাহ বললো ,“
আক্ষেপ তোমার জন্য হানি , এ কোন ধরনের দুষ্কর্ম তোমার বাড়িতে ঘটছে আমিরুল মুমিনীনের (ইয়াযীদ) বিরুদ্ধে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ? তুমি মুসলিমকে এনেছো এবং তাকে তোমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছো এবং জনশক্তি ও অস্ত্র জড়ো করছো তার জন্য ; আর তুমি কি মনে কর যে আমি এগুলোর কোন খবর রাখি না ?”
হানি বললেন ,“
আমি কিছু করি নি। ” উবায়দুল্লাহ বললো যে সে তা করেছে। এরপর যখন তাদের তর্ক বাড়লো , সে তার পরামর্শক (মাকাল)-কে ডাকলো , যাকে সে গোয়েন্দা হিসাবে পাঠিয়েছিলো। সে এলো এবং হানির মুখোমুখি দাঁড়ালো। উবায়দুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলো সে তাকে চিনে কিনা , এতে সে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলো এবং হানি বুঝতে পারলেন সে উবায়দুল্লাহর গোয়েন্দা এবং সে তাদের সব খবর পৌঁছে দিয়েছে। যখন তিনি তার মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেন তিনি বললেন ,“
আমার কথা শোন এবং বিশ্বাস করো যে , আল্লাহর শপথ , আমি তোমার কাছে মিথ্যা বলছি না। আমি মুসলিমকে দাওয়াত করি নি এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমি জানতাম না , সে আমার বাসায় এলো এবং আমার অনুমতি চাইলো সেখানে থাকার জন্য এবং আমি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে লজ্জা অনুভব করলাম। এভাবে এর দায়িত্ব আমার উপর পড়ে যে আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি এবং এরপরে তুমি জান কী ঘটেছে এবং তুমি যদি চাও তাহলে আমি তোমার হাতে আনুগত্যের শপথ করবো এবং তোমার কাছে পণ জমা রাখবো এবং আমি শপথ করছি যে ফিরে গিয়ে আমি তাকে আমার বাড়ি থেকে বের করে দিবো এবং তোমার কাছে ফেরত আসবো। ”
উবায়দুল্লাহ বললো ,“
না আল্লাহর শপথ , তুমি যাবে না যতক্ষণ না তাকে (মুসলিম) আমার কাছে উপস্থিত কর। ”
হানি বললেন ,“
আমি আমার মেহমানকে তোমার কাছে আনবো না যেন তুমি তাকে হত্যা করতে পারো। ”
[‘
ইরশাদ ’ গ্রন্থে’
আছে] উবায়দুল্লাহ বললো ,“
আল্লাহর শপথ , তাকে আমার কাছে তোমাকে আনতেই হবে। ” হানি বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , আমি তা কখনোই করবো না।”
ইবনে নিমা বর্ণনা করেছেন যে হানি বলেছিলেন ,“
আল্লাহর শপথ , যদি সে আমার পায়ের তলায়ও থাকে আমি সেগুলো তুলবো না এবং তোমার হাতে তাকে তুলে দিবো না। ”
যখন তাদের তর্ক বিতর্ক বৃদ্ধি পেলো , মুসলিম বিন আমর বাহিলি (কুফায় সে ছাড়া বসরা বা সিরিয়ার কোন লোক ছিলো না) দেখলো যে হানি অনড় হয়ে গেছে , তখন সে উবায়দুল্লাহকে বললো তাকে একটু সময় দিতে যেন সে তার সাথে কথা বলতে পারে। সে হানিকে এক কোণায় নিয়ে গেলো যেখানে উবায়দুল্লাহ তাদের দেখতে পায় এবং বললো ,“
হে হানি , আমি তোমাকে আল্লাহর নামে অনুরোধ করছি নিজেকে হত্যা না করার জন্য এবং তোমার গোত্রকে কষ্টের ভিতর না ফেলার জন্য। এ লোকটি (মুসলিম বিন আক্বীল) তাদের চাচাতো ভাই এবং তারা তাকে হত্যা করবে না , না তাকে কোন কষ্ট দিবে। তাই তাকে উবায়দুল্লাহর কাছে তুলে দাও এবং এতে তোমার কোন লজ্জা বা শাস্তি হবে না। কারণ তুমি শুধু তাকে সেনাপতির কাছে তুলে দিচ্ছো। ” হানি বললেন ,“
আল্লাহর শপথ , এতে আমার জন্য রয়েছে লজ্জা ও অপমান। আমি আমার মেহমানকে তার হাতে তুলে দিবো না যখন আমার শক্তি আছে এবং আমার বাহুগুলো শক্তিশালী এবং আমার সাথে রয়েছে অগণিত সমর্থক এবং যদি আমি একাও হতাম এবং আমার কোন সাহায্যকারী নাও থাকতো আমি তাকে তার হাতে তুলে দিতাম না , বরং আমি মরবো তাকে সমর্থন দিতে গিয়ে। ” উবায়দুল্লাহ এ কথাগুলো শুনলো এবং আদেশ করলো তাকে তার কাছে নিয়ে আসতে। যখন হানিকে তারা আনলো সে বললো ,“
আল্লাহর শপথ , হয় তুমি তাকে আমার কাছে আনবে অথবা আমি তোমার মাথা কেটে ফেলবো। ” হানি উত্তর দিলেন ,“
তুমি যদি তা করো , আল্লাহর শপথ , বহু তরবারি খাপ থেকে খোলা হবে তোমার বাড়ির চারদিকে ।”
হানি ভেবেছিলেন যে তার গোত্রের লোকেরা তাকে সাহায্য করবে। উবায়দুল্লাহ বললো ,“
তুমি কি আমাকে তোমার গোত্রের তরবারিকে ভয় পেতে বলছো ?”
এরপর সে হানিকে আরও কাছে আনতে বললো। যখন তাকে আনা হলো , উবায়দুল্লাহ তার বেত দিয়ে তার নাকে , কপালে ও গালে আঘাত করতে থাকলো যতক্ষণ না তার নাক ভেঙ্গে গেলো এবং রক্ত গল গল করে বেরিয়ে আসলেন এবং তার জামা কাপড় ভিজিয়ে দিলো। তার কপালের এবং গালের গোশত তার দাড়িতে পড়লো এবং বেতটি ভেঙ্গে গেলো।
তাবারি বলেন যে , আসমা বিন খারেজাকে এবং মুহাম্মাদ বিন আশআসকে উবায়দুল্লাহ বললো হানিকে ডেকে আনতে। তারা বলেছিলো যে সে আসবে না যতক্ষণ না উবায়দুল্লাহ তাকে নিরাপত্তা দেয়। উবায়দুল্লাহ বলেছিলো ,“
তার কোন নিরাপত্তার প্রয়োজন নাই , কিন্তু সে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাকে আমার কাছে আনো এবং যদি তার জন্য আমি নিরাপত্তা দান না করলে সে তা করতে অস্বীকার করে , তাহলে তা করো। ” তারা হানির কাছে গেলো এবং তাকে জানালো , এতে সে উত্তর দিলো ,“
যদি সে আমাকে ধরতে পারে , সে অবশ্যই আমাকে হত্যা করবে। ” কিন্তু তারা তাকে অনুরোধ করলো এবং তাকে উবায়দুল্লাহর কাছে নিয়ে এলো। সে সময় উবায়দুল্লাহ মসজিদে ছিলো , শুক্রবারের খোতবা দিচ্ছিলো , যখন হানি এলো তার দুপাশের চুল দুকাঁধের দিকে ঝুলছিলো। যখন উবায়দুল্লাহ নামাযের ইমামতি শেষ করলো , সে হানিকে ইঙ্গিত করলো এবং সে তাকে অনুসরণ করলো প্রাসাদ পর্যন্ত , তারা সেখানে প্রবেশ করলো এবং হানি তাকে অভিবাদন জানালেন। উবায়দুল্লাহ বললো ,“
হে হানি , তুমি কি মনে করতে পারো যখন আমার বাবা (যিয়াদ) এ শহরে (কুফা) এসেছিলেন , তিনি এখানকার একজন শিয়াকেও বাদ দেন নি সবাইকে হত্যা না করা পর্যন্ত , শুধু তোমার বাবা ও হুজর ছাড়া এবং তুমি জানো হুজরের শেষ পর্যন্তকী হয়েছিলো। তিনি (যিয়াদ) তোমাদের প্রতি সব সময় কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং তিনি কুফায় সেনাপতিকে লিখেছিলেন যে সে যেন তোমাদের প্রতি সদয় থাকে। ” হানি উত্তর দিলেন যে তিনি তা মনে করতে পারেন। উবায়দুল্লাহ বললো ,“
এ অনুগ্রহগুলোর প্রতিদানে তুমি তোমার বাড়িতে এক ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছো আমাকে হত্যা করার জন্য ?”
হানি বললেন যে তিনি তা করেন নি। তখন উবায়দুল্লাহ সেই তামিমি গোত্রের পরামর্শককে সামনে আনতে বললো এবং হানি বুঝতে পারলেন যে ঐ ব্যক্তি উবায়দুল্লাহর গোয়েন্দা ছিলো এবং তার কাছে সংবাদ পৌঁছে দিয়েছে। হানি বললেন ,“
হে সেনাপতি , যে সংবাদ আপনার কাছে পৌঁছেছে তা অবশ্যই সত্য কিন্তু আমি আপনার সদয় ব্যবহার অস্বীকার করবো না। আপনার পরিবার নিরাপত্তায় থাকবে , আর আপনি যেখানে ইচ্ছা নিরাপত্তাসহ চলে যেতে পারেন। ”
মাসউদী বলেন যে , হানি উবায়দুল্লাহকে বললো ,“
আপনার বাবা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতি সদয় ছিলেন এবং কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন। আমি সম্পদশালী এবং আমি চাই আপনাকে (সে কারণে) প্রতিদান দিতে। তাই আপনি কি চান আমি আপনার জন্য কল্যাণকর প্রস্তাব দেই ?”
উবায়দুল্লাহ জিজ্ঞেস করলো তা কী। হানি বললো ,“
আপনি এবং আপনার পরিবার আপনাদের সব সামগ্রী এবং সম্পদ নিয়ে সিরিয়ায় চলে যান। কারণ একজন ব্যক্তি যে আপনার ও ইয়াযীদের চাইতে এ সম্মানের জন্য বেশী যোগ্য ও অধিকার রাখে তিনি এসেছেন। ”
তাবারি এবং ইবনে আসীর জাযারি বর্ণনা করেছেন যে , উবায়দুল্লাহ এ কথাগুলো শুনে মাথা নিচু করলো। তার পরামর্শক মেহরান , যে তার পিছনে দাঁড়িয়েছিলো , একটি কাঁটাযুক্ত লাঠি নিয়ে বললো ,“
কী লজ্জা ও অসম্মান যে একজন বেদুইন দাস আপনার রাজ্যে আপনাকেই নিরাপত্তা দিতে চাইছে!”
উবায়দুল্লাহ চিৎকার করলো যে হানিকে বন্দী করা হোক। মেহরান তার হাতের লাঠি ফেলে দিলো এবং হানির চুল ধরে তার চেহারাকে উবায়দুল্লাহর দিকে ফিরালো। উবায়দুল্লাহ লাঠিটি মাটি থেকে তুললো এবং হানির মুখে তা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো । লাঠির কাঁটাগুলো অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে আঘাত করার কারণে উড়ে যেতে লাগলো এবং পাশের দেয়ালে বিদ্ধ হলো। সে হানিকে এমন কঠিনভাবে আঘাত করলো যে তার নাক ও কপালের হাড় ভেঙ্গে গেলো।
ইবনে আসীর জাযারি বলেন যে , হানি তার হাত কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক সৈনিকের তরবারির দিকে বাড়িয়ে দিলে সে পিছনে সরে গেলো। যখন উবায়দুল্লাহ তা দেখলো , সে বললো ,“
তুমি বিদ্রোহ করেছো এবং এভাবে আমাদের জন্য তোমার রক্ত ঝরানো বৈধ করেছো। ”
[‘
ইরশাদ ’ গ্রন্থে আছে] উবায়দুল্লাহ তাকে গ্রেফতার করতে আদেশ দিল। হানিকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রাসাদের একটি ঘরে। তাকে বন্দী করে রাখা হলো। দরজায় তালা দেয়া হলো এবং উবায়দুল্লাহ তার উপর পাহারাদার নিয়োগ করলো।
[‘
কামিল ’ গ্রন্থে আছে] যখন আসমা বিন খারেজা তা দেখলো , সে উবায়দুল্লাহর দিকে ফিরে দাঁড়ালো এবং বললো ,“
হে ধোঁকাবাজ , হানিকে মুক্ত করে দাও , তুমি আমাদের কাছে শপথ করেছো তাকে রক্ষা করবে এবং যখন আমরা তাকে আনলাম তুমি তার চেহারাকে আহত করেছো। তার রক্ত ঝরিয়েছো এবং এখন তুমি তাকে হত্যা করতে চাও। ” উবায়দুল্লাহ তাকে মারধর করার আদেশ দিলো। তা করা হলো এবং তাকে চুপ করানো হলো। তারা তাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছেড়ে দিলো এবং সে বসে পড়লো। তখন মুহাম্মাদ বিন আল আশআস (যাকে আসমার সাথে হানিকে আনতে পাঠানো হয়েছিলো) বললো ,“
আমরা সেনাপতির আদেশের সাথে সম্পূর্ণভাবে একাত্ম , তা আমাদের জন্য লাভজনক হোক বা না হোক। ”
আমর বিন হাজ্জাজ (হানির শ্বশুর) সংবাদ পেলেন হানিকে হত্যা করা হয়েছে আর তাই সে মাযহাজ গোত্রকে সাথে নিয়ে এলো এবং প্রাসাদকে সবদিক থেকে ঘেরাও করে চিৎকার করে বললো ,“
আমি আমর বিন হাজ্জাজ এবং আমার সাথে আছে মাযহাজের সাহসী ও সম্মানিত লোকেরা। আমরা অবাধ্য হই নি , না দলত্যাগ করেছি। ” সে সময় শুরেইহ কাযী উবায়দুল্লাহর পাশে বসেছিলো এবং উবায়দুল্লাহ তাকে বললো হানির কাছে যেতে এবং খোঁজ নিতে এবং তাদের (আমর ও সাথীদের) বলতে যে , সে জীবিত আছে। যখন শুরেইহ গেলো হানি জিজ্ঞেস করলো ,“
হে মুসলমানরা , আমার সাহায্যে আসো , আমার গোত্রকে কি হত্যা করা হয়েছে ? কোথায় ধার্মিকরা এবং কোথায় আমার সাথীরা ? এ শত্রুএবং এক শত্রুর সন্তান কি আমাকে ভীত করবে ?”
যখন সে লোকদের কণ্ঠ শুনতে পেলো সে বললো ,“
আমি মনে করি এ কণ্ঠ আমার মাযহাজ গোত্রের (লোকজনের) কণ্ঠ এবং সম্মানিত মুসলমানদের কণ্ঠ এবং যদি তাদের দশ জনও এখানে প্রবেশ করে তাহলে অবশ্যই তারা আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবে। ” শুরেইহ , যার সাথে উবায়দুল্লাহর প্রহরীরা ছিলো , চলে গেলো এবং পরে বলেছিলো ,“
যদি উবায়দুল্লাহর প্রহরীরা আমার সাথে না থাকতো তাহলে অবশ্যই হানির খবর তাদের কাছে পৌঁছে দিতাম। ” শুরেইহ বাইরে বেরিয়ে এলো এবং বললো ,“
আমি তোমাদের বন্ধুকে নিজ চোখে দেখেছি , সে জীবিত আছে এবং তাকে হত্যা করা হয় নি। ” আমর ও তার সাথীরা বললো ,“
আলহামদুলিল্লাহ যে তাকে হত্যা করা হয় নি। ”
তাবারি বর্ণনা করেন যে , যখন শুরেইহ হানির কাছে এলো , সে বললো ,“
হে শুরেহই , দেখেছো তারা আমাকে কী করেছে। ” শুরেইহ বললো ,“
আমি দেখছি যে তুমি জীবিত আছো।”
হানি বললো ,“
এ দুরাবস্থার ভিতরে কি আমাকে জীবিত দেখাচ্ছে ? যাও আমার লোকজনকে বলো যে যদি তারা ফিরে যায় সে (উবায়দুল্লাহ) আমাকে অবশ্যই হত্যা করবে। ” শুরেইহ উবায়দুল্লাহর কাছে ফেরত গেলো এবং বললো ,“
আমি দেখলাম হানি জীবিত আছে কিন্তু নির্যাতনের চিহ্ন তার দেহে স্পষ্ট। ” উবায়দুল্লাহ বললো ,“
আমি মনে করি এটি যথাযথ যে একজন রাজা তার প্রজাকে নির্যাতন করবে ও শাস্তি দিবে। এ লোকগুলোর কাছে যাও এবং তাদের জানাও। ” শুরেইহ বাইরে এলো এবং উবায়দুল্লাহ মেহরানকে ইশারা করলো তার সাথে যেতে। শুরেইহ উচ্চ কণ্ঠে বললো ,“
কেন এ মিথ্যা হৈচৈ ও চিৎকার ? হানি জীবিত কিন্তু সেনাপতি তাকে শাস্তি দিয়েছেন যা তার জীবনের জন্য কোন ঝুকি নয়। তাই চলে যাও এবং নিজেদের জীবন এবং তোমাদের সাথীদের জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলো না। ” এ কথা শুনে তারা ফিরে গেলো।
শেইখ মুফীদ এবং অন্যরা বলেন যে , আব্দুল্লাহ বিন খাযিন বলেছেন , আমাকে মুসলিম বিন আক্বীল গোয়েন্দা হিসাবে প্রাসাদে নিয়োগ দিয়েছিলেন যেন তাকে জানাই হানির সাথে কী আচরণ করা হচ্ছে। যখন আমি দেখলাম যে তারা হানিকে মারধর করেছে এবং বন্দী করেছে আমি আমার ঘোড়ায় চড়লাম ও দ্রুত গেলাম মুসলিমকে এ বিষয়ে জানাতে এবং আমি বনি মুরাদের কিছু নারীকে দেখলাম তাদের নিজেদের মধ্যে চিৎকার করে বলতে ,“
হায় দুঃখ তার জন্য , হায় শোক তার জন্য। ” আমি মুসলিমের কাছে এলাম এবং যা ঘটেছে তাকে জানালাম। মুসলিম আমাকে যেতে বললেন এবং উচ্চ কণ্ঠে তার সমর্থকদের বলতে বললেন এবং তিনি আশে পাশের বাড়িগুলোতে চার হাজার মানুষ জড়ো করেছিলেন। আমি গেলাম এবং তাদের কাছে উচ্চ কণ্ঠে বললাম ,“
হে জাতির প্রতিরক্ষা বাহিনী , [কামিল] এটি ছিলো তখন তাদের শ্লোগান । তখন তারা পরস্পরকে জানালো এবং মুসলিমের কাছে জড়ো হলো।
জাযারি বলেন যে , মুসলিম কিনদাহ গোত্রের দায়িত্ব দেন আব্দুল্লাহ বিন আযীয কিনদিকে এবং তাকে বললেন তার সামনে হাঁটতে। এরপর তিনি বনি মাযহাজ ও আসাদ গোত্রের দায়িত্ব দিলেন মুসলিম বিন আওসাজা আসাদিকে , তামীম ও হামাদান গোত্রের দায়িত্ব দিলেন আবু সামামাহ সায়েদীর উপর , মদীনার (ব্যাটালিয়নের) দায়িত্ব দিলেন আব্বাস বিন জাদাহ জাদালেকে এবং রাজ প্রাসাদের দিকে রওনা দিলেন। যখন উবায়দুল্লাহর কাছে এ সংবাদ পৌঁছালো , সে প্রাসাদের ভিতরে লুকালো এবং এর দরজা বন্ধ করে দিলো। মুসলিম প্রাসাদকে সব দিক থেকে ঘিরে ফেললেন আর রাস্তাগুলো ও মসজিদ মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো এবং তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত জড়ো হতে লাগলো। পরিস্থিতি উবায়দুল্লাহর জন্য অস্থিরতার সৃষ্টি করলো। তার সাথে ত্রিশ জন প্রহরী এবং তার পরিবার ও সম্মানিত লোক ও পরামর্শকদের মাঝে বিশ জন ছাড়া কেউ ছিলো না। সম্মানিত ব্যক্তিরা রোমানদের বিল্ডিং দুটো সংযোগকারী দ্বিতীয় দরজা দিয়ে এসেছিলো এবং জনতা উবায়দুল্লাহ ও তার পিতাকে (যিয়াদকে) গালিগালাজ করছিলো। উবায়দুল্লাহ কাসীর বিন শিহাব হারিসিকে ডাকলো এবং তাকে আদেশ দিলো তার সাথে আরেকজনকে সাথে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে এবং মুসলিমকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য জনতাকে সতর্ক করতে। এছাড়া সে মুহাম্মাদ বিন আল আশআসকে যেতে বললো এবং বনি কিনদা ও হাদরামাওতের মধ্য থেকে তার সমর্থকদের সাথে নিয়ে একটি পতাকা মাটিতে গাড়তে বললো এবং উচ্চ কণ্ঠে বলতে বললো যে , এ পতাকার তলে যে আসবে সে নিরাপদ থাকবে। একইভাবে সে ক্বাক্বা বিন শাওর , শাবাস বিন রাব’
ঈ তামিমি , হাজ্জার বিন আবজার আজালি এবং শিমর বিন যিলজাওশান যাবাবিকেও একই কাজ করতে বললো। সে সর্দারদের ও সম্মানিতদের তার নিজের সাথে রাখলো , তাদের ছাড়া থাকতে চাইলো না যেহেতু তার সাথে খুব কম লোক ছিলো।
তারা বাইরে গেলো এবং জনতাকে তিরস্কার করতে লাগলো মুসলিম বিন আক্বীলকে সমর্থন দানের জন্য। এরপর উবায়দুল্লাহ সম্মানিত ব্যক্তিদের ও সর্দারদের বললো সেসব লোককে মিথ্যা অঙ্গীকারের মাধ্যমে ধোঁকা দিতে যারা তাদের প্রতি অনুগত ছিলো এবং তাদেরকে তিরস্কার করতে এবং সতর্ক করতে যারা তাদের প্রতি অবাধ্য হয়েছিলো। তারা তাই করলো যেভাবে তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো , এতই সফলতার সাথে যে যখন লোকজন তাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কথা শুনলো তখন তারা চলে যেতে শুরু করলো এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে নারীরা তাদের সন্তান ও ভাইদের কাছে আসতে শুরু করলো এবং তাদের ফিরে যেতে বলতে লাগলো এ বলে যে , অন্য যারা আছে তারাই কাজের (মুসলিমকে সাহায্য করার) জন্য যথেষ্ট। একইভাবে পুরুষরাও আসতে লাগলো (তাদের আত্মীয়দের নিয়ে যেতে) এবং জনতা চলে যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত মুসলিমের সাথে ছিলো ত্রিশ জন লোক।
যখন তিনি মসজিদে মাগরিবের নামায পড়লেন ত্রিশ জন লোক তাকে অনুসরণ করলো। এ পরিস্থিতি দেখে তিনি যখন বনি কিনদাহর দরজার দিকে ফিরলেন [ইরশাদ] মাত্র দশ জন তার সাথে রইলো দরজায় পৌঁছানো পর্যন্ত । কিন্তু তিনি দরজা দিয়ে বের হলেন কেউ তার সাথে ছিলো না। এরপর তিনি পিছন ফিরলেন এবং দেখলেন কেউ তার সাথে নেই যে তাকে পথ দেখাবে এবং তাদের বাসায় আশ্রয় দিবে অথবা শত্রুর হাত থেকে তাকে রক্ষা করবে। এ কারণে মুসলিম কুফার অলিতে গলিতে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে লাগলেন। [ইরশাদ]
মাসউদী বর্ণনা করেন যে , যখন মুসলিম তার ঘোড়া থেকে নেমে কুফার রাস্তায় ঘুরতে লাগলেন তিনি জানতেন না কোন দিকে তিনি যাচ্ছেন , যতক্ষণ পর্যন্তনা তিনি বনি জাবালার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেন , যা কিনদাহর একটি শাখা গোত্র। তিনি তাওআহ নামে এক মহিলার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন , যে ছিলো আশআস বিন ক্বায়েসের দাসী , যে তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলো এবং পরে উসাইদ হাযরামি তাকে বিয়ে করেছিলো এবং তার ঘরে বিলাল নামে একটি সন্তান হয়েছিলো। বিলাল কিছু লোকের সাথে বাইরে গিয়েছিলো এবং তাওআহ তার জন্য দরজায় বসে অপেক্ষা করছিলো। যখন মুসলিম তাকে দেখলেন , তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং একট পানির জন্য অনুরোধ করলেন। মহিলা তার জন্য পানি আনলো। পানি পান করে মুসলিম দরজায় বসে পড়লেন। যখন মহিলা পানির কাপটি ঘরে রেখে ফিরে এসে মুসলিমকে দেখলো এবং বললো ,“
হে আল্লাহর দাস , তুমি কি পানি পান করো নি ?”
মুসলিম“
হ্যাঁ ” বললেন , মহিলা বললো ,“
সুবহানাল্লাহ , হে আল্লাহর বান্দাহ , উঠো আল্লাহ যেন তোমাকে শক্তি দেন। এখন তোমার পরিবারের কাছে ফেরত যাও। কারণ আমার দরজায় তোমার বসে থাকা ঠিক নয়। না আমি তোমাকে তা করার জন্য অনুমতি দিচ্ছি। ” মুসলিম দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন ,“
হে আল্লাহর দাসী , এ শহরে না আছে আমার কোন বাড়ি , না আছে আমার গোত্র। আপনি ছিলেন উদার ও সদয়দের একজন। হয়তো বা ভবিষ্যতে আমি এর প্রতিদান আপনাকে দিতে পারবো ।”
মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করলো সে কী করতে পারে তার জন্য। মুসলিম বললেন ,“
আমি মুসলিম বিন আক্বীল , এ লোকগুলো আমাকে ধোঁকা দিয়েছে এবং জালিয়াতি করেছে এবং আমাকে নিরাপদ স্থান থেকে বের করে এনেছে। ” মহিলা (আশ্চর্য হয়ে) জিজ্ঞেস করলো সত্যিই সে মুসলিম বিন আক্বীল কিনা , তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। সে তখন তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে বললো এবং মুসলিম তা করলেন। মহিলা তাকে আলাদা একটি ঘর দিলো , যা সে নিজে ব্যবহার করতো না এবং তার জন্য দস্তরখান বিছিয়ে দিলো এবং খাওয়ার জন্য খাবার দিলো , কিন্তু মুসলিম খেতে পারলো না। হঠাৎ তাওআহর ছেলে ফিরে আসলো [‘
কামিল ’ ] এবং খেয়াল করলো যে তার মা ঐ ঘরে বার বার প্রবেশ করছে। সে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো ঐ ঘরে তার কী কাজ , সে যতই জিজ্ঞেস করলো সে উত্তর দিলো না। ছেলে তাকে জোর করলো এবং শেষ পর্যন্ত সে বলে দিলো তা গোপন রাখার এবং অন্য কাউকে বলবে না এ অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে আর তাই ছেলেটি চুপ করে রইলো।
আর উবায়দুল্লাহর বিষয়ে , যখন হৈচৈ ও চিৎকার থেমে গেলো সে তার সমর্থকদের বললো কেউ রয়ে গেছে কিনা দেখতে। তারা দেখলো কেউ নেই এবং তাকে তা জানালো। তখন উবায়দুল্লাহ মসজিদে এলো ইশার নামাযের আগে এবং তার সমর্থকদের মিম্বরের চারপাশ ঘিরে বসালো। এরপর সে আদেশ দিলো যে ঘোষণা করা হোক যে ,“
ইশার নামাযের জন্য উপস্থিত’
থাকবে না এমন প্রত্যেক সেনাপতি , গোত্রপতি এবং যোদ্ধার রক্ত আমাদের জন্য বৈধ। ” একারণে মসজিদ মানুষে ভরে গেলো এবং উবায়দুল্লাহ ইশার নামায পড়ালো। এরপর সে মিম্বরে উঠলো এবং আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললো ,“
আম্মা বা’
আদ , নিশ্চয়ই আক্বীলের ছেলে এক অজ্ঞ ও মূর্খ ব্যক্তি , এসেছে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিতে , যা তোমরা সবাই দেখেছো। যে তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিবে তার রক্ত আমাদের জন্য বৈধ হবে এবং আমরা তাকে অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করবো যে তাকে আমাদের কাছে ধরে আনবে। ” এরপর সে জনতাকে উপদেশ দিলো অনুগত থাকার জন্য এবং তার সাথে থাকার জন্য। এরপর সে হাসীন বিন নামীরকে আদেশ দিলো সব রাস্তা বন্ধ করে দিতে এবং বাড়িগুলো তল্লাশী করতে। হাসীন ছিলো পুলিশ বাহিনীর প্রধান এবং বনি তামীম গোত্রের।
আবুল ফারাজ বলেন যে , মুসলিমকে আশ্রয়দানকারী বৃদ্ধা মহিলা (তাওআহ)-এর ছেলে সকালে ঘুম থেকে উঠলো এবং আব্দুর রহমান বিন আল আশআসকে বললো যে মুসলিম তার বাড়িতে আছে তার মায়ের মেহমান হিসেবে। আব্দুর রহমান দ্রুত তার বাবা মুহাম্মাদ বিন আশআসের কাছে গেলো , যে সে সময় উবায়দুল্লাহর সাথে বসেছিলো। সে পুরো ঘটনাটি ফিসফিস করে তার (সৎ) বাবাকে বললো। উবায়দুল্লাহ জিজ্ঞেস করলো সে কী বলছে। মুহাম্মাদ বললো যে ,“
সে সংবাদ এনেছে যে , আক্বীলের সন্তান (মুসলিম) আমাদের বাড়িগুলোর একটিতে রয়েছে। ” উবায়দুল্লাহ তার লাঠি দিয়ে তার শরীরের পাশে গুতো দিয়ে বললো ,“
এখনই যাও এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। ”
আবু মাখনাফ বলেন যে , কুদামাহ বিন সা’
আদ বিন যায়েদাহ সাক্বাফি তার কাছে বর্ণনা করেছে যে , উবায়দুল্লাহ বনি ক্বায়েস গোত্র থেকে সত্তর জন লোককে পাঠালো আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস সালামির অধীনে মুহাম্মাদ বিন আল আশআসের সাথে এবং তারা সেই বাড়িতে এলো যেখানে মুসলিম ছিলেন।
‘
কামিল-ই-বাহাই ’ তে বর্ণিত আছে যে , যখন মুসলিম বিন আক্বীল ঘোড়ার ডাক শুনতে পেলেন , তিনি নামায দ্রুত শেষ করলেন। এরপর তিনি তার বর্ম পড়লেন এবং তাওআহ্কে বললেন ,“
নিশ্চয়ই আপনি আমার উপকার করেছেন এবং আমার প্রতি সদয় ছিলেন এবং আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শাফায়াত পাওয়ার অংশীদার হয়েছেন , যিনি মানুষ ও জিনের অভিভাবক। গত রাতে আমি আমার চাচা আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) কে স্বপ্নে দেখেছি , যিনি বললেন আগামীকাল আমি তার পাশে থাকবো। ”
‘
মাক্বাতিল ’ -এ আছে যে , যখন সকালের নামাযের সময় ঘনিয়ে এলো তাওআহ মুসলিমের জন্য পানি নিয়ে এলেন যেন সে অযু করতে পারে এবং বললো ,“
হে আমার অভিভাবক , আপনি কি কাল রাতে ঘুমান নি ?”
মুসলিম বললেন ,“
আমি কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়েছিলাম এবং আমার চাচা আমিরুল মুমিনীন (আলী আ.)-কে দেখলাম , আমাকে আদেশ করছেন দ্রুত এগোবার জন্য এবং দ্রুত শেষ করার জন্য , তাই এ থেকে আমি বুঝতে পেরেছি আজ আমার জীবনের শেষ দিন। ”
‘
কামিল-ই-বাহাই ’ তে আছে যে , যখন শত্রুসৈন্যরা তাওআহর বাড়িতে পৌঁছালো মুসলিম ভয় পেলেন তারা হয়তো তার (মহিলার) বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে এবং তাই তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং চুয়াল্লিশ জন শত্রুকে হত্যা করলেন।
সাইয়েদ ইবনে তাউস ও শেইখ জাফর ইবনে নিমা বলেন যে , মুসলিম তার বর্ম পড়লেন এবং তার ঘোড়ায় চড়লেন এবং তার তরবারি দিয়ে তাদের আঘাত করে তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
‘
মুসলিম বিন আক্বীল ঘোড়াতে চড়লেন ’ -এ বর্ণনা শুধু সাইয়েদ ইবনে তাউস এবং ইবনে নিমার কাছ থেকে এসেছে এবং আমি আর কাউকে তা বর্ণনা করতে দেখিনি কিন্তু বাকী সব বর্ণনা এর সত্যতা বহন করে। মাসউদী তার‘
মুরুজুয যাহাব ’ -এ বিশেষভাবে বর্ণনা করেছেন যে তাওআহর বাড়িতে প্রবেশের আগে মুসলিম তার ঘোড়ায় চড়েছিলেন এবং এরপর ঘোড়া থেকে নেমে কুফার রাস্তায় ঘুরছিলেন। তিনি জানতেন না কোন দিকে তিনি যাচ্ছেন যতক্ষণ পর্যন্তনা আশআস বিন ক্বায়েসের দাসীর বাড়িতে তিনি পৌঁছালেন এবং পানি চাইলেন। সে তাকে পানি পান করতে দিলো এবং জিজ্ঞেস করলো তিনি কে। মুসলিম তার কাছে নিজের পরিচয় দিলেন এবং সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো এবং তাকে তার মেহমান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো।
আবুল ফারাজ বলেন যে , যখন মুসলিম অনেক ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ ও লোকদের কণ্ঠ শুনতে পেলেন তিনি বুঝতে পারলেন তারা তার জন্য এসেছে এবং তিনি তার তরবারি খাপমুক্ত করলেন। লোকজন বাড়িতে প্রবেশ করলো এবং ছড়িয়ে গেলো। তা দেখে তিনি তাদের ভীষণভাবে আক্রমণ করলেন , যখন তারা এ অবস্থা দেখলো তারা দৌঁড়ে ছাদে উঠে গেলো এবং পাথর ও জ্বলন্ত লাকড়ি তার মাথায় ছুঁড়ে মারতে লাগলো। যখন মুসলিম এগুলো দেখলেন তিনি নিজেকে নিজে বললেন ,“
নিশ্চয়ই এ সংগ্রাম আক্বীলের সন্তানকে হত্যা করার জন্য। হে আমার সত্তা , অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাও। ” এরপর তিনি তার তরবারি তুলে তাদেরকে রাস্তায় মোকাবিলা করলেন।
মাসউদী এবং অন্যরা বলেছেন যে , যুদ্ধ চলতে লাগলো মুসলিম বিন আক্বীল ও বুকাইর বিন হুমরান আহমারির মাঝে , বুকাইর তার তরবারি দিয়ে মুসলিম বিন আক্বীলের মুখে আঘাত করলো , যা ওপরের ঠোঁট কেটে নিচের ঠোঁটের উপর পড়লো এবং তাও কেটে ফেললো। মুসলিম ভয়ানক আঘাত করলেন তার মাথার ওপরে এবং আরেকটি তার কাঁধের ওপরে যা তার পেট পর্যন্ত পৌঁছালো। মুসলিম নিচের যুদ্ধ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন ,
“
আমি শপথ করে বলছি , আমি শুধু নিহত হবো স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে। যদিও আমি মৃত্যুকে ভয়ানক বিষয় বলে ভাবি , প্রত্যেক ব্যক্তি একদিন এক খারাপের মুখোমুখি হবে। আমি আশঙ্কা করি যে আমাকে ধোঁকা দেয়া হবে এবং বিভ্রান্ত করা হবে। ”
যখন মুহাম্মাদ বিন আশআস তা শুনতে পেলো সে তার কাছে গেলো এবং বললো ,“
আমরা তোমাকে মিথ্যা বলবো না এবং ধোঁকাও দিবো না। ” এরপর সে মুসলিমকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলো। মুসলিম তার আশ্বাস গ্রহণ করলেন। তারা তাকে একটি খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাছে নিয়ে গেলো। যখন মুহাম্মাদ বিন আশআস মুসলিমকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলো তখন সে তার তরবারি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলো। একজন কবি মুহাম্মাদের (বিন আশআসের) এ কৌতুক সম্বন্ধে বলেছেন ,“
তুমি তোমার চাচাকে পরিত্যাগ করেছো এবং তাকে সাহায্য করাতে আলস্য করেছো। হায় , তুমি যদি সেখানে না থাকতে সে হয়তো একটি নিরাপদ স্থান অর্জন করতো। হায় , তুমি তাকে হত্যা করেছো যাকে মুহাম্মাদ (সা.) এর সন্তান পাঠিয়েছিলো , তুমি লজ্জাহীনভাবে তার তরবারি ও ঢাল তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে।
”
ওপরের কবিতাটি হুজর বিন আদির সম্বন্ধেও বলা হয়েছে যার সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করবো।
তিনি তাদের একচল্লিশ জনকে হত্যা করেছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আবু তালিব বলেন যে , যখন মুসলিম অনেক জনকে হত্যা করে ফেললেন এবং এ খবর উবায়দুল্লাহর কাছে পৌঁছে গেলো তখন সে মুহাম্মাদ বিন আল আশআসের কাছে একজনকে সংবাদ দিয়ে পাঠালো যে ,“
আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি একজনের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করতে) এবং আদেশ করেছি তাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে অথচ তোমার লোকদের মাঝে একটি গুরুতর ফাটল দেখা যাচ্ছে। তাহলে তোমার অবস্থা কী হবে যদি আমরা এর বদলে অন্য কারো কাছে পাঠাই ?”
মুহাম্মাদ উত্তর পাঠালো ,“
হে সেনাপতি , আপনি কি মনে করেন আপনি আমাদের পাঠিয়েছেন কুফার কোন সবজি বিক্রেতা অথবা বিদেশী শরণার্থীর বিরুদ্ধে ? আপনি কি জানেন না যে আপনি আমাদেরকে পাঠিয়েছেন এক ভয়ানক সিংহ ও এক তরবারির ওস্তাদ এবং বিখ্যাত যোদ্ধার বিরুদ্ধে যে সৃষ্টির সেরা ব্যক্তির পরিবার থেকে এসেছে ?”
। উবায়দুল্লাহ উত্তর পাঠালো ,“
তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দাও যতক্ষণ পর্যন্তনা তোমরা তার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারো। ”
কোন কোন বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে মুসলিম ছিলেন সিংহের মত এবং তার বাহুতে এত শক্তি ছিলো যে তিনি মানুষকে তার দুহাত তুলে ছাদের উপর ঢিল দিয়ে ফেলতে পারতেন।
সাইয়েদ ইবনে তাউস তার‘
মালহুফ ’ -এ লিখেছেন যে , যখন মুসলিম (আ.) অনেক ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনতে পেলেন , তিনি তার বর্ম পড়লেন এবং তার ঘোড়ায় চড়লেন। এরপর তিনি উবায়দুল্লাহর সৈন্যদলকে আক্রমণ করলেন এবং তাদের অনেককে হত্যা করলেন। মুহাম্মাদ বিন আল আশআস তাকে উচ্চ কণ্ঠে বললো ,“
হে মুসলিম , তোমার জন্য নিরাপত্তা আছে। ” যখন মুসলিম তা শুনলেন তিনি বললেন ,“
কিভাবে ধোঁকাবাজ ও খারাপ লোকদের অঙ্গীকারের উপর একজন নির্ভর করতে পারে ?”
এরপর তিনি তাদের দিকে ফিরলেন এবং যুদ্ধ শুরু করলেন হুমরান বিন মালিক খাসা’
মির কবিতা আবৃত্তি করে ,“
আমি শপথ করে বলছি , আমি শুধু নিহত হব স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে , যদিও আমি মৃত্যুকে ভয়ানক বিষয় বলে ভাবি , অথবা তা ঠাণ্ডাকে প্রচণ্ড তাপে পরিণত করে এবং সূর্যের রশ্মিকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে (চিরদিনের জন্য) । প্রত্যেক মানুষ একদিন এক খারাপের মুখোমুখি হবে , আমি আশঙ্কা করি যে আমাকে প্রতারিত করা হবে এবং বিভ্রান্ত করা হবে। ”
তখন সৈন্যরা হৈচৈ শুরু করলো এবং চিৎকার করে বললো ,“
কেউ তোমাকে মিথ্যা বলবে না এবং ধোঁকাও দিবে না। ” কিন্তু তিনি তাদের কথায় কোন কান দিলেন না। তখন সৈন্যদের এক বিরাট দল তাকে আক্রমণ করলো। তিনি তার শরীরে অনেকগুলো আঘাত পেলেন এবং একজন লোক পিছন দিক থেকে তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো। মুসলিম তার ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং তাকে গ্রেফতার করা হলো।
ইবনে শাহর আশোবের‘
মানাক্বিব ’ -এ লেখা হয়েছে যে মুসলিম বিন আক্বীল (আ.) তীর ও পাথরে এত গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন যে তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো এবং একটি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়েছিলেন। এরপর তিনি বললেন ,“
তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারছো যা একজন অবিশ্বাসীর প্রতি করা হয় অথচ আমি হচ্ছি নৈতিকতা সম্পন্ন নবীর পরিবারের সদস্য! নবীর পরিবারের প্রতি কি তোমাদের কোন শ্রদ্ধা নেই তার অধিকার থাকা সত্ত্বেও ?”
তখন মুহাম্মাদ বিন আল আশআস বললো ,“
নিজেকে হত্যা করো না , নিশ্চয়ই তুমি আমার নিরাপত্তায় আছো। ” মুসলিম বললেন ,“
আমি আত্মসমর্পণ করবো না তোমার হাতে বন্দী হওয়ার জন্য , যতক্ষণ আমার শক্তি আমার সাথে রয়েছে। আল্লাহর শপথ , তা কখনোই হবে না। ” এ বলে তিনি তাদের আক্রমণ করলেন এবং তারা দূরে পালিয়ে গেলো।
এরপর মুসলিম বললেন ,“
হে আল্লাহ! পিপাসা আমাকে মেরে ফেলছে। ” তখন তারা সব দিক থেকে তাকে আক্রমণ করলো এবং বুকাইর বিন হুমরান আহমারি তরবারির আঘাতে তার ওপরের ঠোঁট কেটে ফেললো। তখন মুসলিম তাকে তার বাঁকা তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন যা তার পেট চিরে ফেললো ও তাকে হত্যা করলো। তখন কেউ একজন তার পিছন দিক থেকে তাকে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করলো এবং তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন ; আর এভাবে তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন।
শেইখ মুফীদ , জাযারি এবং আবুল ফারাজ বলেন যে , মুসলিম সারা শরীরে আহত ছিলেন এবং যুদ্ধ করে ক্লান্ত ছিলেন। শব্দ করে শ্বাস নিতে নিতে তিনি একটি বাড়ির দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। মুহাম্মাদ বিন আল আশআস তার কাছে এলো এবং বললো যে সে তাকে নিরাপত্তা দিবে। মুসলিম জনতার দিকে ফিরলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তারা সবাই এর সাথে একমত কিনা এবং তারা উত্তরে হ্যাঁ বললো শুধুমাত্র উবায়দুল্লাহ (অথবা আব্দুল্লাহ) বিন আব্বাস সালামি ছাড়া , সে বললো ,“
এর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ” একথা বলে সে এক পাশে সরে দাঁড়ালো। মুসলিম উত্তর দিলেন ,“
আল্লাহর শপথ , যদি তোমরা আমাকে নিরাপত্তা না দাও আমি কখনোই আমার হাত তোমাদের হাতে দিবো না। ” তারা একটি খচ্চর আনলো এবং তাকে এর উপর উঠালো। তারা তাকে সব দিক থেকে ঘেরাও করলো এবং তার তরবারি নিয়ে নিলো। মুসলিম তখন খুব হতাশ হয়ে গেলেন , তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলো। তিনি বুঝতে পারলেন এ লোকগুলো তাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করবে এবং তাই তিনি বললেন ,“
এটি হচ্ছে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। ” মুহাম্মাদ বিন আল আশআস বললো ,“
আমি আশা করি তোমার জন্য কোন বিপদ হবে না। ” মুসলিম বললেন ,“
এটি কি শুধুই আশা ? তাহলে তোমার নিরাপত্তার অঙ্গীকার কোথায় ? নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর কাছে ফেরত যাবো। ”
এরপর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন এবং উবায়দুল্লাহ বিন আব্বাস সালামি বললো ,“
যে ব্যক্তি আশা করে যা তুমি আশা করেছো এবং সে যখন এ অবস্থায় আসে যার মধ্যে তুমি এখন আছো তার কাঁদা উচিত নয়। ” মুসলিম বললেন ,“
আমি আমার জন্য কাঁদছি না এবং না আমি ভয় পাই মৃত্যুকে , যদিও মৃত্যুর সাথে বন্ধুত্ব আমি করি না। কিন্তু আমি কাঁদছি আমার আত্মীয় স্বজনের জন্য এবং আমার পরিবারের লোকদের জন্য যারা এখানে শীঘ্রই এসে পৌঁছাবে এবং আমি কাঁদছি হোসেইন ও তার পরিবারের জন্য। ” এরপর মুসলিম মুহাম্মাদ বিন আল আশআস এর দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,“
আমি বিশ্বাস করি যে তুমি তোমার নিরাপত্তার অঙ্গীকার পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। ” এরপর তিনি চাইলেন যে একজন দূত পাঠানো হোক ইমাম হোসেইন (আ.) কে পরিস্থিতি জানিয়ে যেন তিনি এখানে না আসেন।
শেইখ মুফীদ বর্ণনা করেন যে , মুসলিম মুহাম্মাদ বিন আল আশআসকে বললেন ,“
হে আল্লাহর বান্দাহ , আমি যেন দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার নিরাপত্তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারবে না যা তুমি আমাকে দিয়েছো , তাই একটি ভালো কাজ করো। কাউকে ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে পাঠাও যে আমার কথা তার কাছে বর্ণনা করবে। কারণ আমি মনে করি তিনি আজ অথবা আগামীকাল এখানে আসার জন্য তার পরিবারসহ রওনা হবেন। দূত তার কাছে জানাবে যে তাকে মুসলিম বিন আক্বীল পাঠিয়েছে , যাকে তারা বন্দী করেছে এবং সে মনে করে আজকে সন্ধ্যার আগেই তাকে সম্ভবত হত্যা করা হবে। সে খবর পাঠাচ্ছে যে: আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক , আপনি আপনার পরিবার নিয়ে পিছন ফিরে যান। কুফার লোকদের সুযোগ দেবেন না আপনাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। এরাই হচ্ছে আপনার পিতার সাথীরা , যাদের সম্পর্কে আপনার পবিত্র পিতা (ইমাম আলী) চাইতেন যেন তিনি মারা যান এবং এভাবে তাদের কাছ থেকে মুক্তি পান। কুফার লোকেরা আপনার কাছে মিথ্যা বলেছে এবং যাকে মিথ্যা বলা হয়েছে তার কোন সিদ্ধান্তনেই। ” একথা শুনে মুহাম্মাদ বিন আল আশআস বললো ,“
আল্লাহর শপথ , আমি তোমার সংবাদ পৌঁছে দিবো। ”
জাফর বিন হুযাইফা থেকে আযদি বর্ণনা করেন যে , মুহাম্মাদ বিন আল আশআস আয়াস বিন আতাল তাইকে ডাকলো যে মালিক বিন আমর বিন সামামাহর সন্তান ছিলো। আয়াস ছিলো একজন কবি এবং মুহাম্মাদের বিশ্বস্ত , সে তাকে বললো ,“
ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে যাও এবং তাকে এই চিঠিটি দাও। ” এরপর সে বিষয়বস্তু লিখলো যা মুসলিম তাকে বলেছিলো এবং বললো ,“
এগুলো হচ্ছে তোমার ভ্রমণের রসদ এবং এগুলো হচ্ছে তোমার পরিবারের জন্য খরচ (তোমার অনুপস্থিতিতে) । ” আয়াস বললো ,“
আমার একটি উটের প্রয়োজন কারণ আমার উট দুর্বল হয়ে গেছে। ” মুহাম্মাদ বললো ,“
আমার এ জিন পরানো উটটি নাও এবং যাও। ” আয়াস চলে গেলো এবং চার রাত পরে ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে যুবালা হতে পৌঁছালো এবং তার কাছে সংবাদ পৌঁছে দিলো এবং মুসলিমের চিঠি হস্তান্তর করলো। তার কথা শোনার পর ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,
“
যা কিছু নির্ধারিত হয়ে আছে তা ঘটবে এবং আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের ও মানুষের দুষ্কর্মের মাঝে ফয়সালা করে দিবেন। ” মুসলিম বিন আকীল (আ.) যখন হানি বিন উরওয়াহর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন আঠারো হাজার লোক তার কাছে বাইয়াত করেছিলো। মুসলিম আবিস বিন শাবীব শাকিরিকে পাঠালেন একটি চিঠি দিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.) এর কাছে , যা ছিলো এরকম ,“
আম্মা বা’
আদ , যে পানির খোঁজে যায় সে তার পরিবারের কাছে এ সম্পর্কে মিথ্যা বলে না। কুফার জনগণের মধ্য থেকে আঠারো হাজার পুরুষ আমার কাছে আনুগত্যের শপথ করেছে। তাই আমার চিঠি পাওয়ার পর দ্রুত এগোন , কারণ সব মানুষ আপনার সাথে আছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইচ্ছা মুয়াবিয়ার সন্তানের সাথে নেই। সালাম। ”
ওপরের চিঠিটি উল্লেখিত হয়েছে‘
মুসীরুল আহযান ’ -এ , যা আবিস বিন আবি শাবীব শাকিরি এবং ক্বায়েস বিন মুসাহহির সায়দাউইর সাথে পাঠানো হয়েছিলো ,“
আম্মা বা’
আদ , যে পানির সন্ধানে যায় সে এ সম্পর্কে তার পরিবারের কাছে মিথ্যা বলে না। কুফার সব লোক আপনার পক্ষে এবং তাদের মধ্য থেকে আঠারো হাজার পুরুষ আমার কাছে আনুগত্যের শপথ করেছে। আমার চিঠি যখনই পড়বেন , দ্রুত আসবেন , সালাম ও আল্লাহর রহমত ও বরকত আপনার ওপরে।”