ভূমিকা
বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্।
এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে , কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থকেই ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে , যে সব ব্যক্তির নামে তা চালু আছে তা তাঁদের কাছ থেকে এসেছে। তেমনি ঐ সব ব্যক্তি যে নবী ছিলেন এটাও অকাট্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ , ঐ সব ব্যক্তির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় না এবং তাঁদের জীবনেতিহাস ও ঐ সব গ্রন্থের বিকৃত হওয়ার বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত সত্য। একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব এবং কোরআন মজীদকে যে একটি ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবী করে তিনিই রেখে গিয়েছেন , আর এ গ্রন্থটি যে তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছেন ঠিক সেভাবেই অবিকৃত রয়ে গেছে এটাও ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
বলা বাহুল্য যে , অমুসলিমরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী হিসেবে স্বীকার করে না , ফলতঃ স্বাভাবিকভাবেই তারা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলেও স্বীকার করে না , বরং এটিকে তাঁর রচিত গ্রন্থ বলে অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এ গ্রন্থটিকে যে তিনিই ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবী করে পেশ করেছেন এবং তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছেন হুবহু সেভাবেই অবিকৃতভাবে বর্তমান আছে তা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যে কোনো নিরপেক্ষ জ্ঞানগবেষকই স্বীকার করতে বাধ্য।
অবশ্য হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে গণ্যকারী মুসলমানদের জন্য কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে গণ্য করা একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং এটি যে , সংরক্ষিত তথা অবিকৃত আছে তা মেনে নেয়ার জন্য তাদের কাছে স্বয়ং কোরআন মজীদের দাবীই যথেষ্ট। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেছেন যে , তিনিই এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তিনিই এর সংরক্ষণকারী। মুসলমানদের জন্য কেবল এতোটুকু জানাই যথেষ্ট - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন মজীদ অবিকৃতরূপে আমাদের কাছে পৌঁছার জন্য অন্য কারো কাছেই ঋণী নয়।
তবে অবিকৃত বিচারবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী অমুসলিমদের কাছে কোরআন মজীদের প্রামাণ্যতা ও বিকৃতিহীনতা সম্পর্কে এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে , এ গ্রন্থটি অল্প অল্প করে দীর্ঘ তেইশ বছরে নাযিল হয়েছে এবং নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে , আর রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর বহু সংখ্যক ছ্বাহাবী (সহচর) সাথে সাথে এবং পরে তাঁদের কাছ থেকে শুনে আরো অসংখ্য ছ্বাহাবী তা মুখস্ত করেছেন। এভাবে তা বিকৃতির আশঙ্কা থেকে সংরক্ষিত থেকেছে। তাই সকল যুগেই সমগ্র মানবজাতির মধ্যে কোরআন মজীদের একটিমাত্র সংস্করণ বিদ্যমান ছিলো এবং রয়েছে।
বস্তুতঃ কোরআন মজীদের অন্যতম প্রধান পরিচয় হচ্ছে এই যে , এটি হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে প্রদত্ত স্থায়ী মু‘
জিযাহ্ অর্থাৎ তিনি যে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী ছিলেন তার প্রমাণ বহনকারী অবিনশ্বর অলৌকিক নিদর্শন যা এ বিশ্বজগত ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত প্রোজ্জ্বল মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় মানবকুলের সামনে দেদীপ্যমান হয়ে বিরাজমান থাকবে।
কোরআন মজীদের মু‘
জিযাহ্ (অলৌকিকতা)র বিভিন্ন দিক আছে। এ সব দিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এর ভাষার বিস্ময়কর প্রাঞ্জলতা ও প্রকাশক্ষমতার সূক্ষ্মতা সহকারে সংক্ষিপ্ত আয়তনে সীমাহীন জ্ঞানগর্ভতা ও বিষয়বস্তুর ব্যাপক বৈচিত্র্য। এ সব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কোরআন মজীদ তার বিরোধীদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে , তাদের পক্ষে সম্ভব হলে সবাই মিলে অন্ততঃ এর একটি ছোট সূরাহর সম মানের একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসুক। আজ পর্যন্ত এ চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করে নি। এছাড়া কোরআন মজীদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে ; এটাও এর ঐশী গ্রন্থ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ।
যা-ই হোক , মুসলমানরা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলেই জানে এবং প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই কোরআন মজীদের কপি রয়েছে , আর তারা সকলেই কম-বেশী কোরআন তেলাওয়াত্ করে এবং এ গ্রন্থকে সম্মান ও যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে। এমতাবস্থায় তাদের সামনে কোরআন মজীদকে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। হয়তোবা এ কারণেই অন্ততঃ বাংলা ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে ছোট-বড় হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হলেও কোরআন মজীদের পরিচয় সম্পর্কে স্বতন্ত্র কোনো গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে অন্ততঃ অত্র গ্রন্থকারের জানা নেই।
কোরআন মজীদের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া সম্ভব কেবল এটিকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে ও একে জীবনের নিত্যসঙ্গী করলে। অবশ্য সে নিত্যসঙ্গী হতে হবে সবাক তথা পদে পদে পথনির্দেশ প্রদানকারী , বোবা নিত্যসঙ্গী নয়। এ কথা এ কারণে বলছি যে , অধিকাংশ মুসলমানই কোরআন মজীদকে সযত্নে সংরক্ষণ করে এবং তেলাওয়াত করে বটে , তবে জানে না যে , তাতে কী বলা হয়েছে , আর তা জানে না বলেই তা মানা সম্ভব নয় , ফলতঃ এর অবস্থা হচ্ছে বোবা সঙ্গীর ন্যায় যার উচ্চারিত শব্দাবলী থেকে পথনির্দেশ পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে , এমনটা হওয়ার কারণ কী ? কোরআন মজীদের সাথে অন্ততঃ শিক্ষিত লোকদের এহেন আচরণ বিস্ময়ের সৃষ্টি না করে পারে না। এ আচরণ হচ্ছে দূর থেকে আগত এমন কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের ন্যায় - যার সম্পর্কে কেবল এতোটুকু জানা আছে যে , তিনি আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন মুরুব্বী , কিন্তু তাঁর যোগ্যতা ও গুণাবলী সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানা নেই। ফলে আমরা অনেক সময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাতের কাছে পাওয়া হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে জীবন বিসর্জন দেই , অথচ ঘরে বেড়াতে আসা ঐ শ্রদ্ধেয় মুরুব্বী হয়তো ঐ রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার , কিন্তু তা জানা ছিলো না বলে তাঁর কাছে সাহায্য চাই নি।
অবশ্য কোরআন মজীদকে এরূপ কোনো ডাক্তারের সাথে এমনকি সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে তুলনা করা হলেও তা হবে দুর্বল উপমা (مثال ناقص
) , কারণ , মানব প্রজাতির জন্য এমন কোনো সমস্যা ও জিজ্ঞাস্য নেই এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভব হবে না - যার সমাধান ও জবাব কোরআন মজীদে নেই। কারণ , কোরআন মজীদ নিজের অন্যতম পরিচয় দিয়েছে‘
সকল কিছুর বর্ণনা বা জ্ঞান’
(تبيانا لکل شيء
) বলে।
কোরআন মজীদের সাথে আমাদের এ আচরণের কারণ হচ্ছে আমরা এর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিচয়ের সাথেও পরিচিত নই। এ কারণেই আমরা একে তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট মনে করি , একে অনবরত‘
অধ্যয়ন’
করি না এবং এর কাছ থেকে সবাক নিত্যসঙ্গীর ন্যায় পদে পদে পথনির্দেশ গ্রহণ করি না। আফসোস্ , আমাদের ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলাম চর্চাকারীগণও হাজার হাজার ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়ন বা মানুষের রচিত হাজার হাজার পৃষ্ঠা আয়তনের বহু ফিক্ব্হী গ্রন্থ বা তাফসীর অধ্যয়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষ লক্ষ হাদীছ মুখস্ত করা ও সে জন্য গর্ব অনুভব করা সত্ত্বেও সরাসরি পুরো কোরআন মজীদ থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করতে জানেন না , এমনকি অনেকেই তা শুধু মূল ভাষায় পাঠ করে তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম নন। অথচ এটি হচ্ছে মানুষের কাছে আল্লাহ্ তা‘
আলার প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ এবং মুসলমানদের জন্য নাযিলকৃত একমাত্র গ্রন্থ - যে কারণে তিনি এ গ্রন্থে“
হে মানবকুল!”
বলে বার বার সম্বোধন করে এটির মূলমর্ম [তাওহীদ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ)-এর সত্যতা] মেনে নেয়ার জন্য সকল মানুষের প্রতি এবং আরো অনেক বেশী বার“
হে ঈমানদারগণ!”
বলে সম্বোধন করে এটি থেকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে পথনির্দেশ গ্রহণের জন্য ঈমানদারদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কোরআন মজীদের সাথে কী আচরণ করছি ? এ কারণেই , আমরা কোরআন মজীদকে সসম্মানে ও সশ্রদ্ধভাবে সর্বোচ্চ ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখা সত্ত্বেও এবং তেলাওয়াতের আগে-পরে যে কোনো সময় তাতে চুম্বন করে ও তাতে বুকে লাগিয়ে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা সত্ত্বেও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ক্বিয়ামতের দিনে আল্লাহ্ তা‘
আলার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন ; তিনি বলবেন:
)
ي
َا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا(
.
“
হে আমার রব!
অবশ্যই আমার লোকেরা এই কোরআনকে অপরিচিত-অবজ্ঞাত ও বর্জিত করে রেখেছিলো।”
(সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: 30)
অবশ্য অত্র গ্রন্থের উদ্দেশ্য কোরআন মজীদ থেকে মুসলমানদেরকে কী কী বিষয়ে পথনির্দেশ নিতে হবে তা উল্লেখ করা নয়। কারণ , আগেই উল্লেখ করেছি যে , ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব প্রজাতির জীবনে এমন কোনো সমস্যা ও প্রশ্ন নেই ও উদ্ভব হবে না যার সমাধান ও জবাব কোরআন মজীদে নেই। সুতরাং এ ধরনের বিষয়বস্তুর পরিচয় তুলে ধরতে গেলে তা হবে এক বিশাল গ্রন্থ। কিন্তু এরূপ কোনো গ্রন্থ রচিত হলেও তা রচনার পরবর্তী কালে আরো বহু সমস্যা ও প্রশ্নের উদ্ভব হবে এবং সে সব সমস্যা ও প্রশ্নের সমাধান ও জবাবের জন্য সরাসরি কোরআনের কাছেই যেতে হবে ; কোরআনের পরিচয়মূলক এ ধরনের গ্রন্থ কখনোই সরাসরি কোরআন থেকে পথনির্দেশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থেকে আমাদেরকে বেনিয়ায করবে না।
বরং বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কোরআন মজীদ সম্পর্কে বিদ্যমান কতক ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন - যে সব ভ্রান্ত ধারণার কারণে আমরা কোরআন মজীদকে বর্জিত করে রেখেছি , যদিও পুরো কোরআন মজীদের সাধারণ ও সুগভীর তাৎপর্য সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন না করলেও অন্ততঃ এর বাহ্যিক সাধারণ তাৎপর্য সরাসরি এ গ্রন্থ থেকে জেনে নেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয। কারণ , এ গ্রন্থে প্রতিটি মুসলমানকেই সম্বোধন করা হয়েছে।
এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি মূলতঃ একটি পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ - যাতে কেবল সর্বজনজ্ঞাত ও মশহূর তথ্যগুলো উল্লেখ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ কারণে , সূত্রভারাক্রান্ততা এড়ানো ও আয়তনকে সীমিত রাখার লক্ষ্যে কোরআন মজীদের সূরাহ্ ও আয়াত নম্বর ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যসমূহের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্থানে স্বতন্ত্রভাবে তথ্যসূত্রনির্দেশ করা হয় নি। অবশ্য গ্রন্থের শেষে সাধারণভাবে সহায়ক সূত্রসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মূল গ্রন্থে যে সব ব্যাখ্যামূলক পাদটীকা রয়েছে ইউনিকোডে রূপান্তরের পর সেগুলোকে মূল পাঠের ভিতরে সমন্বিত বা তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
অত্র গ্রন্থের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি খৃস্টীয় বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৈরী করা হয়েছিলো এবং পরে তা কম্পিউটার-কম্পোজও করা হয়েছিলো। একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তা 2004 খৃস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকাশের কথা ছিলো। কিন্তু প্রধানতঃ আর্থিক সমস্যার কারণে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। এর কয়েক বছর পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারটির হার্ড ডিস্ক্ ক্র্যাশ্ হয়ে যাওয়ায় গ্রন্থটির কম্পোজ পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে এর সর্বশেষ প্রুফ্ কপিটি রক্ষা পেয়েছিলো।
যেহেতু এ ধরনের গ্রন্থের জন্য প্রকাশক পাওয়া দুরূহ ব্যাপার এবং স্বয়ং গ্রন্থকারেরও তা প্রকাশ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য হয়ে উঠে নি , সেহেতু এটি এতো বছর যাবত এভাবেই ছিলো। অবশেষে , প্রধানতঃ অনলাইনের পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে পরিবেশনের লক্ষ্যে এটি নতুন করে কম্পোজে হাত দেই। কারণ , অন্ততঃ একজন পাঠক বা পাঠিকাও যদি এর বক্তব্য অধ্যয়ন করেন ও তা থেকে কোরআন মজীদের সঠিক পরিচয় লাভ করেন তাহলেও আমার শ্রম-সাধনা সার্থক হবে বলে মনে করি। অবশ্য নতুন করে কম্পোজ করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই পুরো গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে কিছুটা সংযোজন করা হয়েছে।
এ উপলক্ষ্যে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে , অত্র গ্রন্থকারের প্রণীত কোরআনের মু‘
জিযাহ্ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রাথমিক কম্পোজকৃত অবস্থায় রয়েছে - যার আয়তন আনুমানিক অত্র গ্রন্থের প্রায় দ্বিগুণ হবে ; আল্লাহ্ তা‘
আলা তাওফীক্ব্ দিলে ভবিষ্যতে তা-ও পাঠক-পাঠিকাদের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , স্বাভাবিকভাবেই অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা‘
আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ‘
আমরা’
শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই‘
আমরা’
ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা‘
আলা নিজের জন্য‘
আমরা’
ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ‘
আমরা’
এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য‘
আমি’
ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা‘
আলার জন্য‘
আমরা’
ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।
আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই এই যে , অমার অন্যান্য গ্রন্থ ও লেখার ন্যায় অত্র গ্রন্থেও যে সব আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সে সবের বেলায় বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্যতা ব্যাহতকরণ ব্যতীতই মূল আরবী-ফার্সী উচ্চারণ প্রতিফলিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে আমি পুনরায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে , যারা বা যে সব প্রতিষ্ঠান সচেতনভাবেই হোক বা অসচেতনতার কারণেই হোক বাংলা ভাষায় আরবী-ফার্সী শব্দের বানানে হস্তক্ষেপ করে এ সব শব্দকে মূল বানান ও উচ্চারণ থেকে অধিকতর দূরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন আমি তাঁদের সে মত ও প্রচেষ্টার বিরোধী , বরং নীতিগতভাবে , ভাষার ওপর প্রতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। এর বিপরীতে আমি মনে করি , ভাষাকে খরস্রোতা নদীর ন্যায় প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত-স্বাধীন থেকে স্বীয় গতিপথ বেছে নিয়ে চলতে দেয়া উচিত।
ভূমিকার সমাপ্তি পর্যায়ে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , আমার কনিষ্ঠ পুত্র ও কনিষ্ঠা কন্যা অত্র গ্রন্থের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ কম্পোজ করে দিয়েছে। নচেৎ এ গ্রন্থের পুনঃকম্পোজের কাজ এতো তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি এ জন্য তাদের কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি এবং আল্লাহ্ তা‘
আলার কাছে তাদের এ খেদমতের জন্য শুভ প্রতিদান প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।
আল্লাহ্ তা‘
আলা অত্র গ্রন্থকে এর পাঠক-পাঠিকাদের জন্য মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদের সঠিক পরিচয় জানার ক্ষেত্রে সহায়ক করে দিন , কোরআন মজীদ সম্পর্কে আমাদের মন-মস্তিষ্কে বিরাজমান ভ্রান্ত ধারণাসমূহের পর্দাগুলো অপসারিত করে দিন এবং পুরো কোরআন মজীদের তাৎপর্য সরাসরি ও সঠিকভাবে জানার জন্য আমাদেরকে আগ্রহী করে দিন ও তাওফীক্ব্ দান করুন। ফলতঃ অত্র গ্রন্থকে এর লেখক এবং প্রচার-প্রসারে সহায়তাকারী ও পাঠক-পাঠিকাদের জন্য ইহকালে হেদায়াতের সহায়ক ও পরকালে মুক্তির পাথেয় করে দিন। আমীন।
নূর হোসেন মজিদী