কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়16%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 22605 / ডাউনলোড: 3674
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

কোরআনের পরিচয়

নূর হোসেন মজিদী

ভূমিকা

বিসমিল্লাহির্ রাহমানির্ রাহীম্।

এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে , কোরআন মজীদ ছাড়া অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থকেই ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে , যে সব ব্যক্তির নামে তা চালু আছে তা তাঁদের কাছ থেকে এসেছে। তেমনি ঐ সব ব্যক্তি যে নবী ছিলেন এটাও অকাট্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ , ঐ সব ব্যক্তির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে অকাট্যভাবে প্রমাণ করা যায় না এবং তাঁদের জীবনেতিহাস ও ঐ সব গ্রন্থের বিকৃত হওয়ার বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত সত্য। একমাত্র হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব এবং কোরআন মজীদকে যে একটি ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবী করে তিনিই রেখে গিয়েছেন , আর এ গ্রন্থটি যে তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছেন ঠিক সেভাবেই অবিকৃত রয়ে গেছে এটাও ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য পদ্ধতিতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত।

বলা বাহুল্য যে , অমুসলিমরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী হিসেবে স্বীকার করে না , ফলতঃ স্বাভাবিকভাবেই তারা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলেও স্বীকার করে না , বরং এটিকে তাঁর রচিত গ্রন্থ বলে অভিহিত করে থাকে। কিন্তু এ গ্রন্থটিকে যে তিনিই ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবী করে পেশ করেছেন এবং তিনি যেভাবে রেখে গিয়েছেন হুবহু সেভাবেই অবিকৃতভাবে বর্তমান আছে তা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যে কোনো নিরপেক্ষ জ্ঞানগবেষকই স্বীকার করতে বাধ্য।

অবশ্য হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর মনোনীত নবী হিসেবে গণ্যকারী মুসলমানদের জন্য কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে গণ্য করা একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং এটি যে , সংরক্ষিত তথা অবিকৃত আছে তা মেনে নেয়ার জন্য তাদের কাছে স্বয়ং কোরআন মজীদের দাবীই যথেষ্ট। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেছেন যে , তিনিই এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তিনিই এর সংরক্ষণকারী। মুসলমানদের জন্য কেবল এতোটুকু জানাই যথেষ্ট - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন মজীদ অবিকৃতরূপে আমাদের কাছে পৌঁছার জন্য অন্য কারো কাছেই ঋণী নয়।

তবে অবিকৃত বিচারবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী অমুসলিমদের কাছে কোরআন মজীদের প্রামাণ্যতা ও বিকৃতিহীনতা সম্পর্কে এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে , এ গ্রন্থটি অল্প অল্প করে দীর্ঘ তেইশ বছরে নাযিল হয়েছে এবং নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে , আর রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর বহু সংখ্যক ছ্বাহাবী (সহচর) সাথে সাথে এবং পরে তাঁদের কাছ থেকে শুনে আরো অসংখ্য ছ্বাহাবী তা মুখস্ত করেছেন। এভাবে তা বিকৃতির আশঙ্কা থেকে সংরক্ষিত থেকেছে। তাই সকল যুগেই সমগ্র মানবজাতির মধ্যে কোরআন মজীদের একটিমাত্র সংস্করণ বিদ্যমান ছিলো এবং রয়েছে।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদের অন্যতম প্রধান পরিচয় হচ্ছে এই যে , এটি হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে প্রদত্ত স্থায়ী মু জিযাহ্ অর্থাৎ তিনি যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত নবী ছিলেন তার প্রমাণ বহনকারী অবিনশ্বর অলৌকিক নিদর্শন যা এ বিশ্বজগত ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত প্রোজ্জ্বল মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় মানবকুলের সামনে দেদীপ্যমান হয়ে বিরাজমান থাকবে।

কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ (অলৌকিকতা)র বিভিন্ন দিক আছে। এ সব দিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এর ভাষার বিস্ময়কর প্রাঞ্জলতা ও প্রকাশক্ষমতার সূক্ষ্মতা সহকারে সংক্ষিপ্ত আয়তনে সীমাহীন জ্ঞানগর্ভতা ও বিষয়বস্তুর ব্যাপক বৈচিত্র্য। এ সব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কোরআন মজীদ তার বিরোধীদেরকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে যে , তাদের পক্ষে সম্ভব হলে সবাই মিলে অন্ততঃ এর একটি ছোট সূরাহর সম মানের একটি সূরাহ্ রচনা করে নিয়ে আসুক। আজ পর্যন্ত এ চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করে নি। এছাড়া কোরআন মজীদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে ; এটাও এর ঐশী গ্রন্থ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ।

যা-ই হোক , মুসলমানরা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলেই জানে এবং প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই কোরআন মজীদের কপি রয়েছে , আর তারা সকলেই কম-বেশী কোরআন তেলাওয়াত্ করে এবং এ গ্রন্থকে সম্মান ও যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে। এমতাবস্থায় তাদের সামনে কোরআন মজীদকে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। হয়তোবা এ কারণেই অন্ততঃ বাংলা ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে ছোট-বড় হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হলেও কোরআন মজীদের পরিচয় সম্পর্কে স্বতন্ত্র কোনো গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে অন্ততঃ অত্র গ্রন্থকারের জানা নেই।

কোরআন মজীদের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া সম্ভব কেবল এটিকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে ও একে জীবনের নিত্যসঙ্গী করলে। অবশ্য সে নিত্যসঙ্গী হতে হবে সবাক তথা পদে পদে পথনির্দেশ প্রদানকারী , বোবা নিত্যসঙ্গী নয়। এ কথা এ কারণে বলছি যে , অধিকাংশ মুসলমানই কোরআন মজীদকে সযত্নে সংরক্ষণ করে এবং তেলাওয়াত করে বটে , তবে জানে না যে , তাতে কী বলা হয়েছে , আর তা জানে না বলেই তা মানা সম্ভব নয় , ফলতঃ এর অবস্থা হচ্ছে বোবা সঙ্গীর ন্যায় যার উচ্চারিত শব্দাবলী থেকে পথনির্দেশ পাওয়া সম্ভব নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে , এমনটা হওয়ার কারণ কী ? কোরআন মজীদের সাথে অন্ততঃ শিক্ষিত লোকদের এহেন আচরণ বিস্ময়ের সৃষ্টি না করে পারে না। এ আচরণ হচ্ছে দূর থেকে আগত এমন কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের ন্যায় - যার সম্পর্কে কেবল এতোটুকু জানা আছে যে , তিনি আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন মুরুব্বী , কিন্তু তাঁর যোগ্যতা ও গুণাবলী সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানা নেই। ফলে আমরা অনেক সময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাতের কাছে পাওয়া হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে জীবন বিসর্জন দেই , অথচ ঘরে বেড়াতে আসা ঐ শ্রদ্ধেয় মুরুব্বী হয়তো ঐ রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার , কিন্তু তা জানা ছিলো না বলে তাঁর কাছে সাহায্য চাই নি।

অবশ্য কোরআন মজীদকে এরূপ কোনো ডাক্তারের সাথে এমনকি সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে তুলনা করা হলেও তা হবে দুর্বল উপমা (مثال ناقص ) , কারণ , মানব প্রজাতির জন্য এমন কোনো সমস্যা ও জিজ্ঞাস্য নেই এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভব হবে না - যার সমাধান ও জবাব কোরআন মজীদে নেই। কারণ , কোরআন মজীদ নিজের অন্যতম পরিচয় দিয়েছে সকল কিছুর বর্ণনা বা জ্ঞান (تبيانا لکل شيء ) বলে।

কোরআন মজীদের সাথে আমাদের এ আচরণের কারণ হচ্ছে আমরা এর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিচয়ের সাথেও পরিচিত নই। এ কারণেই আমরা একে তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট মনে করি , একে অনবরত অধ্যয়ন করি না এবং এর কাছ থেকে সবাক নিত্যসঙ্গীর ন্যায় পদে পদে পথনির্দেশ গ্রহণ করি না। আফসোস্ , আমাদের ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলাম চর্চাকারীগণও হাজার হাজার ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়ন বা মানুষের রচিত হাজার হাজার পৃষ্ঠা আয়তনের বহু ফিক্ব্হী গ্রন্থ বা তাফসীর অধ্যয়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষ লক্ষ হাদীছ মুখস্ত করা ও সে জন্য গর্ব অনুভব করা সত্ত্বেও সরাসরি পুরো কোরআন মজীদ থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করতে জানেন না , এমনকি অনেকেই তা শুধু মূল ভাষায় পাঠ করে তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম নন। অথচ এটি হচ্ছে মানুষের কাছে আল্লাহ্ তা আলার প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ এবং মুসলমানদের জন্য নাযিলকৃত একমাত্র গ্রন্থ - যে কারণে তিনি এ গ্রন্থে হে মানবকুল! বলে বার বার সম্বোধন করে এটির মূলমর্ম [তাওহীদ , আখেরাত্ ও নবুওয়াতে মুহাম্মাদী (ছ্বাঃ)-এর সত্যতা] মেনে নেয়ার জন্য সকল মানুষের প্রতি এবং আরো অনেক বেশী বার হে ঈমানদারগণ! বলে সম্বোধন করে এটি থেকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে পথনির্দেশ গ্রহণের জন্য ঈমানদারদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কোরআন মজীদের সাথে কী আচরণ করছি ? এ কারণেই , আমরা কোরআন মজীদকে সসম্মানে ও সশ্রদ্ধভাবে সর্বোচ্চ ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখা সত্ত্বেও এবং তেলাওয়াতের আগে-পরে যে কোনো সময় তাতে চুম্বন করে ও তাতে বুকে লাগিয়ে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা সত্ত্বেও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ক্বিয়ামতের দিনে আল্লাহ্ তা আলার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন ; তিনি বলবেন:

) ي َا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا( .

হে আমার রব! অবশ্যই আমার লোকেরা এই কোরআনকে অপরিচিত-অবজ্ঞাত ও বর্জিত করে রেখেছিলো। (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৩০)

অবশ্য অত্র গ্রন্থের উদ্দেশ্য কোরআন মজীদ থেকে মুসলমানদেরকে কী কী বিষয়ে পথনির্দেশ নিতে হবে তা উল্লেখ করা নয়। কারণ , আগেই উল্লেখ করেছি যে , ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব প্রজাতির জীবনে এমন কোনো সমস্যা ও প্রশ্ন নেই ও উদ্ভব হবে না যার সমাধান ও জবাব কোরআন মজীদে নেই। সুতরাং এ ধরনের বিষয়বস্তুর পরিচয় তুলে ধরতে গেলে তা হবে এক বিশাল গ্রন্থ। কিন্তু এরূপ কোনো গ্রন্থ রচিত হলেও তা রচনার পরবর্তী কালে আরো বহু সমস্যা ও প্রশ্নের উদ্ভব হবে এবং সে সব সমস্যা ও প্রশ্নের সমাধান ও জবাবের জন্য সরাসরি কোরআনের কাছেই যেতে হবে ; কোরআনের পরিচয়মূলক এ ধরনের গ্রন্থ কখনোই সরাসরি কোরআন থেকে পথনির্দেশ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থেকে আমাদেরকে বেনিয়ায করবে না।

বরং বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কোরআন মজীদ সম্পর্কে বিদ্যমান কতক ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন - যে সব ভ্রান্ত ধারণার কারণে আমরা কোরআন মজীদকে বর্জিত করে রেখেছি , যদিও পুরো কোরআন মজীদের সাধারণ ও সুগভীর তাৎপর্য সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন না করলেও অন্ততঃ এর বাহ্যিক সাধারণ তাৎপর্য সরাসরি এ গ্রন্থ থেকে জেনে নেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয। কারণ , এ গ্রন্থে প্রতিটি মুসলমানকেই সম্বোধন করা হয়েছে।

এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি মূলতঃ একটি পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ - যাতে কেবল সর্বজনজ্ঞাত ও মশহূর তথ্যগুলো উল্লেখ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ কারণে , সূত্রভারাক্রান্ততা এড়ানো ও আয়তনকে সীমিত রাখার লক্ষ্যে কোরআন মজীদের সূরাহ্ ও আয়াত নম্বর ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যসমূহের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্থানে স্বতন্ত্রভাবে তথ্যসূত্রনির্দেশ করা হয় নি। অবশ্য গ্রন্থের শেষে সাধারণভাবে সহায়ক সূত্রসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মূল গ্রন্থে যে সব ব্যাখ্যামূলক পাদটীকা রয়েছে ইউনিকোডে রূপান্তরের পর সেগুলোকে মূল পাঠের ভিতরে সমন্বিত বা তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

অত্র গ্রন্থের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি খৃস্টীয় বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৈরী করা হয়েছিলো এবং পরে তা কম্পিউটার-কম্পোজও করা হয়েছিলো। একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তা ২০০৪ খৃস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রকাশের কথা ছিলো। কিন্তু প্রধানতঃ আর্থিক সমস্যার কারণে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। এর কয়েক বছর পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারটির হার্ড ডিস্ক্ ক্র্যাশ্ হয়ে যাওয়ায় গ্রন্থটির কম্পোজ পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে এর সর্বশেষ প্রুফ্ কপিটি রক্ষা পেয়েছিলো।

যেহেতু এ ধরনের গ্রন্থের জন্য প্রকাশক পাওয়া দুরূহ ব্যাপার এবং স্বয়ং গ্রন্থকারেরও তা প্রকাশ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য হয়ে উঠে নি , সেহেতু এটি এতো বছর যাবত এভাবেই ছিলো। অবশেষে , প্রধানতঃ অনলাইনের পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে পরিবেশনের লক্ষ্যে এটি নতুন করে কম্পোজে হাত দেই। কারণ , অন্ততঃ একজন পাঠক বা পাঠিকাও যদি এর বক্তব্য অধ্যয়ন করেন ও তা থেকে কোরআন মজীদের সঠিক পরিচয় লাভ করেন তাহলেও আমার শ্রম-সাধনা সার্থক হবে বলে মনে করি। অবশ্য নতুন করে কম্পোজ করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই পুরো গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে কিছুটা সংযোজন করা হয়েছে।

এ উপলক্ষ্যে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে , অত্র গ্রন্থকারের প্রণীত কোরআনের মু জিযাহ্ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রাথমিক কম্পোজকৃত অবস্থায় রয়েছে - যার আয়তন আনুমানিক অত্র গ্রন্থের প্রায় দ্বিগুণ হবে ; আল্লাহ্ তা আলা তাওফীক্ব্ দিলে ভবিষ্যতে তা-ও পাঠক-পাঠিকাদের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , স্বাভাবিকভাবেই অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই এই যে , অমার অন্যান্য গ্রন্থ ও লেখার ন্যায় অত্র গ্রন্থেও যে সব আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সে সবের বেলায় বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্যতা ব্যাহতকরণ ব্যতীতই মূল আরবী-ফার্সী উচ্চারণ প্রতিফলিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে আমি পুনরায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে , যারা বা যে সব প্রতিষ্ঠান সচেতনভাবেই হোক বা অসচেতনতার কারণেই হোক বাংলা ভাষায় আরবী-ফার্সী শব্দের বানানে হস্তক্ষেপ করে এ সব শব্দকে মূল বানান ও উচ্চারণ থেকে অধিকতর দূরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন আমি তাঁদের সে মত ও প্রচেষ্টার বিরোধী , বরং নীতিগতভাবে , ভাষার ওপর প্রতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের বিরোধী। এর বিপরীতে আমি মনে করি , ভাষাকে খরস্রোতা নদীর ন্যায় প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত-স্বাধীন থেকে স্বীয় গতিপথ বেছে নিয়ে চলতে দেয়া উচিত।

ভূমিকার সমাপ্তি পর্যায়ে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , আমার কনিষ্ঠ পুত্র ও কনিষ্ঠা কন্যা অত্র গ্রন্থের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ কম্পোজ করে দিয়েছে। নচেৎ এ গ্রন্থের পুনঃকম্পোজের কাজ এতো তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি এ জন্য তাদের কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি এবং আল্লাহ্ তা আলার কাছে তাদের এ খেদমতের জন্য শুভ প্রতিদান প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।

আল্লাহ্ তা আলা অত্র গ্রন্থকে এর পাঠক-পাঠিকাদের জন্য মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদের সঠিক পরিচয় জানার ক্ষেত্রে সহায়ক করে দিন , কোরআন মজীদ সম্পর্কে আমাদের মন-মস্তিষ্কে বিরাজমান ভ্রান্ত ধারণাসমূহের পর্দাগুলো অপসারিত করে দিন এবং পুরো কোরআন মজীদের তাৎপর্য সরাসরি ও সঠিকভাবে জানার জন্য আমাদেরকে আগ্রহী করে দিন ও তাওফীক্ব্ দান করুন। ফলতঃ অত্র গ্রন্থকে এর লেখক এবং প্রচার-প্রসারে সহায়তাকারী ও পাঠক-পাঠিকাদের জন্য ইহকালে হেদায়াতের সহায়ক ও পরকালে মুক্তির পাথেয় করে দিন। আমীন।

নূর হোসেন মজিদী

কোরআনের পরিচয়

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

) إ ِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ(

নিঃসন্দেহে এ কোরআন সেদিকেই পথপ্রদর্শন করে যা সর্বাধিক সুপ্রতিষ্ঠিত। (সূরাহ্ আল্-ইসরা / বানী ইসরাঈল্: ৯)

কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা আলার কিতাব - এটাই তো কোরআনের পরিচয়। তবে এ হচ্ছে কোরআন মজীদের সংক্ষিপ্ততম সাধারণ পরিচয়। আর এর বিশেষ পরিচয় হচ্ছে কোরআন মজীদের পরিপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও এর বিষয়বস্তু তথা এতে নিহিত জ্ঞানের পরিধি সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা। কিন্তু এর সংক্ষিপ্ততম সাধারণ পরিচয় অর্থাৎ কোরআন মজীদ যে আল্লাহ্ তা আলার কিতাব - এ পরিচয় কেবল মুসলমানদের নিকটই গ্রহণযোগ্য ; অমুসলমানরা এটা মানে না , আর এটাই স্বাভাবিক।

অমুসলমানদের মধ্যকার অনেক জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিত-গবেষক কোরআন মজীদের সীমাহীন জ্ঞানভাণ্ডার হবার কথা স্বীকার করেছেন , কিন্তু এটি যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ গ্রন্থ সে কথা স্বীকার করেন নি। তাঁরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন , তাঁর উত্তম নৈতিক চরিত্র , আচার-আচরণ ও গুণাবলী , যোগ্যতা , সাফল্য ও অগাধ জ্ঞানের কথা স্বীকার করেছেন , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ হতে মনোনীত নবী হিসেবে তাঁকে স্বীকার করেন নি। তাঁরা তাঁকে মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং কোরআন মজীদকে তাঁর রচিত গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করে এ গ্রন্থকেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এভাবে তাঁদের সমস্ত প্রশংসা লোকদেরকে সে উদ্দেশ্যের বিপরীত দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজে সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যে উদ্দেশ্যে তাঁকে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিলো এবং কোরআন মজীদ নাযিল হয়েছিলো। অথচ কী দুর্ভাগ্য যে , মুসলমানদের অন্ততঃ একটি শিক্ষিত অংশকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদকে প্রদত্ত ঐ সব অমুসলিম জ্ঞানী-গুণীর সার্টিফিকেট্ সোৎসাহে প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় , যে উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কে নবী হিসেবে পাঠানো হয় এবং কোরআন মজীদ নাযিল হয় সে উদ্দেশ্য-লক্ষ্য হাছ্বিলের জন্য কোরআন মজীদ যে আল্লাহর কিতাব এবং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) এ কিতাব যে অবস্থায় রেখে গিয়েছেন ঠিক সে অবস্থায়ই যে কোনো ধরনের হ্রাস-বৃদ্ধি ও পরিবর্তন তথা বিকৃতি থেকে সংরক্ষিতভাবে বিদ্যমান আছে তা প্রমাণ করা অপরিহার্য। আর এটা প্রমাণ করা মানে কোরআনের বিকৃতিহীনতা প্রশ্নে মুসলমানদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অন্ধ বিশ্বাস নয়। বরং এ জন্য সর্বজনগ্রহণযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা যারূরী ; এমন প্রমাণ চাই কোরআন মজীদের আল্লাহর কিতাব হওয়ার দাবী প্রত্যাখ্যানকারীদের পক্ষে যা খণ্ডন করা সম্ভব হবে না , তেমনি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত যে সব ভ্রান্ত ধারণা কোরআনের অবিকৃত থাকার সত্যতাকে দুর্বল করে ফেলে এবং কোরআন-বিরোধীদের দ্বারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলোরও অবসান ঘটাবে। আর কেবল তখনই কোরআনের সঠিক পরিচয় জানা সম্ভব হবে।

সুতরাং প্রথমে এ বিষয়টি সমগ্র মানবজাতির কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য বিচারবুদ্ধিজাত ( আক্ব্লী) দলীল দ্বারা প্রমাণ করতে হবে এবং এর পরে কোরআন মজীদের পরিচিতির অন্যান্য দিকের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে কাবিহ

পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদআত নিন্দনীয় (অপছন্দনীয়) একটি বিষয় এবং তা শরীয়তের বিধান মতে হারামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বিদআতকে হাসান (পছন্দনীয়) ও কাবিহ (অপছন্দনীয়) এ দু ভাগে ভাগ করা সঠিক নয়। কিন্তু আহলে সুন্নাতের আলেমদের মতে বিদআত হাসান কাবিহ এ দু ভাগে বিভক্ত।২৪

বিদআতকে বৈধ ও অবৈধ অর্থাৎ পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় এরূপ বিভাজনের কোন বৈধতা নেই। কারণ বিদআত হলো এমন বিষয় যার কোন শরীয়তগত ভিত্তি নেই অর্থাৎ এমন কোন বিধান সৃষ্টি করা যার উৎস কোরআন ও সুন্নাতে খুঁজে পাওয়া যায় না,তা-ই বিদআত। তাই এরূপ বিধান নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় ও হারাম বলে গণ্য।

কোন বিষয় বা কর্মে মোবাহের কর্মগত বিধান

(যে ক্ষেত্রে শরীয়ত কোন বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করে নি সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়টি বৈধ হওয়ার সার্বিত নীতি)

উসূলশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, কোন বিষয় বা কর্মের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো বৈধতার নীতি অর্থাৎ যদি কোন বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে বৈধতার অথবা স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি কার্যকর হবে। যাকে উসূলশাস্ত্রের পরিভাষায় আসালাতুল হিল্লিয়াত (বৈধতার সর্বজনীন নীতি) অথবা আসালাতুল জাওয়ায বলা হয়। স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি (আসালাতুল বারায়াত) হতেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এ নীতি মতে যে বিষয়ে শরীয়তের প্রবর্তক করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়কে বর্ণনা করেন নি সে বিষয়টি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলে গণ্য অর্থাৎ সেক্ষেত্রে শরীয়তের অনুসারীদের স্বাধীনতা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন :

( قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّ‌مًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ‌ فَإِنَّهُ رِ‌جْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ‌ اللَّـهِ )

আপনি বলে দিন ; যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্য যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস-এটা অপবিত্র ও অবৈধ-অথবা যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয় সে কারণে। ২৫

ড. ইউসুফ কারদ্বাভী বলেছেন, ইসলাম সর্বপ্রথম যে নীতি প্রবর্তন করেছে তা হলো সকল বস্তু ও কল্যাণকর বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈধতার সর্বজনীন নীতি এবং যে বিষয়গুলো শরীয়তের প্রবর্তক সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেন নি,তার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা হতে মুক্তির নীতি। ২৬

রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসৃত নীতিও সুন্নাত বলে গণ্য এবং তা শরীয়তের নীতি নির্ধারক।

এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোকে ওয়াহাবীরা এজন্য বিদআত বলে থাকে যে,তারা রাসূলের আহলে বাইতের সুন্নাতকে শরীয়তের জন্য নীতি নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। অথচ সহীহ হাদীসসমূহে তাদের অনুসৃত কর্ম ও নীতিও শরীয়তের নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ঘোষিত হয়েছে। এখানে আমরা এরূপ কয়েকটি দলিলে প্রতি ইশারা করছি।

১। আয়াতে তাত্বহীর

মহান আল্লাহ বলেছেন :

( إِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا )

নিশ্চয় আল্লাহ চান হে ( নবীর) আহলে বাইত! তোমাদের হতে সকল অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। ২৭

সহীহ মুসলিম হযরত আয়েশা সূত্রে বর্ণনা করেছে যে,একদিন সকালে মহানবী (সা.) গৃহ হতে বের হলেন এবং তখন তাঁর কাঁধে সেলাইবিহীন বিশেষ চাদর ছিল। (অতঃপর যখন তিনি বসলেন) তখন হাসান ইবনে আলী এসে ঐ চাদরের ভিতর প্রবেশ করল,তারপর হুসাইন তাতে প্রবেশ করল,তারপর ফাতেমা আসলে তাঁকেও চাদরে আবৃত করলেন,অতঃপর আলী আসলে তাঁকেও তাতে আবৃত করলেন। তাঁরা সকলে প্রবেশ করলে রাসূল এ আয়াতটি পাঠ করলেন,২৮

( إِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا )

আয়াতটির লক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

প্রথমত আয়াতটিতে ((إنّما )) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা দ্বারা বিধানকে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর জন্য সীমিত করা হয় এবং এটি সীমিতকরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যকরণশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের (আহলে বাইতের) জন্য নির্দিষ্ট ঘোষিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনি) অন্তর্ভুক্ত যার কোন ব্যত্যয় হয় না,إنّما أمره اذا أراد شیئاً أن یقول له کن فیکن কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন বলেন : হও ,অতঃপর তা হয়ে যায়।

আয়াতটিতে (আয়াতে তাত্বহীরে) আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনী) প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,কেননা তা শরীয়তের বিধানগত ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাশরীয়ী) অন্তর্ভুক্ত হলে যাতে বান্দার স্বাধীনতা রয়েছে সকল বান্দাই তার অন্তর্ভুক্ত হতো ও এরূপ পবিত্রতার আকাঙ্ক্ষা সবার জন্য প্রযোজ্য হতো। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে আহলে বাইতকে উল্লেখ মূল্যহীন হয়ে পড়ত। অর্থাৎ এ আয়াতে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার প্রতিফলনের কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত আয়াতটিতে যেرجس বা অপবিত্রতার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এমন অপবিত্রতা যা বস্তুর প্রতি অন্যদের ঘৃণার উদ্রেক করে। তাই কোরআনرجس শব্দটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় অপবিত্রতার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছে। যেমন :

( أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ‌ فَإِنَّهُ رِ‌جْسٌ)

অথবা শুকরের মাংস,নিশ্চয়ই তা অপবিত্র এবং

( وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَ‌ضٌ فَزَادَتْهُمْ رِ‌جْسًا إِلَىٰ رِ‌جْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُ‌ونَ )

এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি ( সন্দেহ ও কপটতার) রয়েছে তা তাদের অপবিত্রতার উপর অপবিত্রতা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। (সূরা তওবা: ১২৫)

 এর বিপরীতে পবিত্রতাও বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় বিষয়ে হতে পারে। আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেছেন: রিজস বা অপবিত্রতা হলো এমন আত্মিক অনুভূতি ও প্রভাব যা বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত বিশ্বাস এবং নিকৃষ্ট কর্ম হতে উদ্ভূত। আলোচ্য আয়াতেرجس শব্দটির পূর্বেال এসেছে যা আলিফ ওয়া লামে জিন্স’নামে অভিহিত তা সকল প্রকৃতির অপবিত্রতাকে শামিল করে। তাই আয়াতে আত্মিক অপবিত্রতা অর্থাৎ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বা কর্মের ক্ষেত্রে ভুলের কারণ হতে পারে এমন সকল অপবিত্রতা হতেও মুক্তি ও পবিত্রতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এবং এরূপ পবিত্রতা কেবল ঐশী নিষ্পাপত্বের (স্রষ্টা প্রদত্ত পবিত্রতার) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য অর্থাৎ ব্যক্তির মধ্যে এমন আত্মিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যা তাকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অসৎ কর্ম হতে নিবৃত রাখে। ২৯

যে বিশিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার অধীনে সকল প্রকার ত্রুটি ও পাপ-পঙ্কিলতা হতে মুক্ত ঘোষিত হয়েছেন,নিঃসন্দেহে তাঁরা নিষ্পাপ ও পবিত্র এবং যে কোন পবিত্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তির কর্ম ও নীতি আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে হওয়ায় সুন্নাত ও সকলের জন্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য। তাই আল্লাহর নবীর আহলে বাইতের সদস্যদের অনুসৃত নীতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ও প্রামাণ্য দলিল বলে গণ্য।

২। হাদীসে সাকালাইন

তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)-কে বিদায় হজ্জ্বের সময় উটের পিঠে বসে বক্তব্য দিতে দেখলাম ও তাঁকে বলতে শুনলাম :

হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধর,তাহলে কখনোই বিভ্রান্ত হবে না : আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। ৩০

হাদীসটি হতে বিভিন্নভাবে মহানবীর আহলে বাইতের নিষ্পাপত্ব প্রমাণ করা যায়। হাদীসটিতে কোরআন ও আহলে বাইতকে একত্রে উল্লেখ করে উভয়কে আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে। তাই কোরআন যেরূপ সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে,আহলে বাইতও সেরূপ সকল ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে।

বারজাখের জীবন

(মৃত্যু ও পুনরুত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন জীবন)

ওয়াহাবীদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যের  একটি বিষয় হলো বারজাখ বা মৃত্যু পরবর্তী কবরের জীবন। আল্লাহর আউলিয়ার (ওলীদের) রুহ হতে সাহায্য চাওয়া,তাঁদের মৃত্যুর পর  তাঁদের উসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট চাওয়া (তাওয়াসসুল) ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য মুসলমানের সাথে ওয়াহাবীদের মতপার্থক্য উপরিউক্ত মতভিন্নতারই ফলশ্রুতিতেই ঘটেছে। অন্যান্য সকল মুসলমানই বিশ্বাস রাখেন দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ বারজাখে মানুষের,বিশেষত আল্লাহর ওলীদের বিশেষ জীবন রয়েছে। কিন্তু ওহাবিগণ মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবনে,এমনকি আল্লাহর ওলীদের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়া,তাঁদেরকে মাধ্যম বা উসিলা হিসেবে গ্রহণকে জায়েয মনে করে না,বরং এক প্রকার শিরক বলে বিশ্বাস করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর ওলীদের প্রতি (মৃত্যুর পরে) আহ্বানকে পাথরের ন্যায় প্রাণহীন বস্তুর প্রতি আহ্বান মনে করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর ওলিগণ মৃত্যুর পর অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন না এবং পৃথিবীর উপর তাঁদের কোন প্রভবই নেই। আমরা এখন এ বিশ্বাস নিয়ে মৌলিক আলোচনা করব।

 

ওয়াহাবীদের ফতোয়াসমূহ

১। বিন বায বলেছেন, দ্বীনের অপরিহার্য ও স্বীকৃত বিশ্বাসসমূহ এবং শরীয়তী দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত যে,আল্লাহর রাসূল (সা.) সকল স্থানে বিদ্যমান নন বরং তাঁর দেহ (মোবারক) মদীনায় রয়েছে তবে তাঁর রুহ বেহেশ্তে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে  রয়েছে।৩১

তিনি অন্যত্র বলেছেন, আহলে সুন্নাতের এক বৃহৎ অংশ মৃত্যুর পর কবরের জীবনে  (বারজাখী জীবনে) বিশ্বাসী । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,কবরে শায়িতরা গাইব বা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন অথবা পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে খবর পান বরং এ বিষয়গুলো হতে তাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন।

একই গ্রন্থে অন্য স্থানে তিনি বলেছেন, মহানবী (সা.) তাঁকে সালামকারী ব্যক্তিকে দেখতে পান- এ কথাটির আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কোরআন ও হাদীসে এর সপক্ষে কোন দলিল নেই। রাসূল (সা.) দুনিয়াবাসীর এবং পৃথিবীর উপর যা কিছু ঘটছে সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানেন না। কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে এ পৃথিবীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।৩২

২। বিশিষ্ট ওহাবী হাদীসবিদ নাসিরউদ্দিন আলবানী তাঁর আল আয়াতুল বাইয়্যেনাহ্ আলা আদামে সিমায়েল আসওয়াত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, আলোচ্য বিষয়টির গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের জানানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আশা করি কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট হয়েছে,বিশেষত যারা সবসময় অজ্ঞতার অন্ধকারে বাস করে তাদের জন্য নিমোক্ত বিষয়সমূহ,যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা,নবিগণ,আল্লাহর ওলী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের  রুহের নিকট মুক্তি কামনা করা,এরূপ ধারণা ও বিশ্বাস রাখা যে,তাঁরা তাদের কথা শুনতে পারছেন ইত্যাদি বিষয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হবে।

মানুষ রুহ ও দেহের সমন্বয়ে সৃষ্ট

    কালামবিদগণ মানুষকে দুই সত্তার সমন্বয় বলে বিশ্বাস করেন,যথা রুহ (আত্মা) ও দেহ। এই দুইয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে তাঁরা বেশ কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এখানে  আমরা তার কয়েকটি উল্লেখ করছি :

১। প্রত্যেক মানুষই নিজ কর্মকে এক বাস্তব অস্তিত্বসম্পন্ন সত্তার সাথে সম্পর্কিত করে যাকে আমি বলে অভিহিত করে থাকে এবং দাবী করে আমি অমুক কাজটি করেছি, আমি অমুককে মেরেছি ইত্যাদি। এই আমি সত্তাটি কি? এটি কি মানবের সেই সত্তা নয় যাকে রুহ বা আত্মা নামে অভিহিত করা হয়,অনুরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে এক বাস্তব সত্তার সাথে সম্পকির্ত করে বলে,আমার হৃদয়,আমার উদর,আমার পদযুগল ইত্যাদি। এই আমি সত্তাটি কি রুহ বা নাফ্স ব্যতীত অন্য কিছু?

২। প্রত্যেক মানুষ এই অনুভূতিটি ধারণ করে যে,তার ব্যক্তিত্ব ও সত্তা সময়ের পরিবর্তনে অপরিবর্তিত রয়েছে যাতে কোনরূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয় না,অথচ তার দেহে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই অপরিবর্তিত সত্তাই কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়?

৩। কখনো কখনো মানুষ সবকিছু,এমনকি তার দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কেও অসচেতন হয়ে যায়;কিন্তু সে মুহূর্তেও সে তার আমি সত্তা সম্পর্কে অসচেতন নয়। এটি কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়? ফখরুদ্দীন রাজী বলেছেন, কখনো কখনো আমি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন,অথচ আমার দৈহিক সত্তা সম্পর্কে অবচেতন থাকি। আমার ঐ আত্মসচেতনতাই আমার আত্মা ও নাফ্স। ৩৩

পবিত্র কোরআনও এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে :

( يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ  ارْ‌جِعِي إِلَىٰ رَ‌بِّكِ رَ‌اضِيَةً مَّرْ‌ضِيَّةً  فَادْخُلِي فِي عِبَادِي  وَادْخُلِي جَنَّتِي )

হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর এমন অবস্থায় যে, তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; আমার বিশেষ বান্দাদের (নৈকট্যপ্রাপ্ত) অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার বেহেশ্তে প্রবেশ কর। ৩৪   

অন্যত্র  বলেছেন  :

( فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ  وَأَنتُمْ حِينَئِذٍ تَنظُرُ‌ونَ )

অতঃপর যখন তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তোমরা ( তার শিয়রে দাঁড়িয়ে) তা প্রত্যক্ষ কর। (সূরা ওয়াকেয়া :৮৩-৮৪)

পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার পরও জীবনের অব্যাহত থাকা

পবিত্র কোরআনের আয়াত হতে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে,মানুষের মৃত্যু তার জীবনের শেষ নয়,বরং সে অন্য এক জীবনে প্রবেশ করে ও স্থানান্তরিত হয়। মানুষ মৃত্যুর পর বস্তুগত জগতের  ঊর্ধ্বে এক নতুন জগতে অধিকতর বিস্তৃত জীবন লাভ করে। যেমন :

১। মহান আল্লাহ বলেছেন :

( اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْ‌سِلُ الْأُخْرَ‌ىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُ‌ونَ )

আল্লাহ মৃত্যুর সময় প্রাণকে পূর্ণরূপে হরণ করেন এবং (তার প্রাণকে)যে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে ও মৃত্যুবরণ করে নি। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত হয়েছে তার প্রাণকে আবদ্ধ রাখেন এবং অন্যান্যদেরকে (প্রাণ)নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফিরিয়ে দেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী (আল্লাহর ক্ষমতার) রয়েছে। ৩৫

২। অন্যত্র বলা হয়েছে :

( وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَ‌بِّهِمْ يُرْ‌زَقُونَ )

যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে জীবিকাপ্রাপ্ত। ৩৬

অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়,বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।

মহান আল্লাহ বলেছেন :

( وَمَن يُطِعِ اللَّـهَ وَالرَّ‌سُولَ فَأُولَـٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّـهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـٰئِكَ رَ‌فِيقًا )

যারা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সকল ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবিগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী! ৩৭

যদি শহীদগণ আল্লাহর নিকট জীবিত থাকেন ও জীবিকা লাভ করেন তবে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে-যেহেতু রাসূল নিজেও তাঁর আনীত নির্দেশের আনুগত্যকারী,সেহেতু তিনিও এর অন্তর্ভুক্ত-সেও শহীদদের সাথে থাকবে,কারণ উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী শহীদদের সঙ্গে থাকবে বলা হয়েছে। যদি শহীদরা মৃত্যুর পর আল্লাহর নিকট জীবিত থাকে তবে তারাও আল্লাহর নিকট জীবিত রয়েছে ও বারজাখী জীবনের অধিকারী। যদি বিন বাযের মতো কেউ বলেন, তাঁরা আল্লাহর নিকট বেহেশ্তে রয়েছেন এবং এই পৃথিবীর কোন খবর রাখেন না ,এর জবাবে বলব, আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেছেন :

( وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ )

তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ৩৮

( فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّـهِ )

তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকেই তিনি আছেন। ৩৯

( نَحْنُ أَقْرَ‌بُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِ‌يدِ )

আমরা তার শাহরগ হতেও তার নিকটবর্তী। ৪০

যদি আল্লাহ সকল স্থানে সকলের সাথে থাকেন তবে যেহেতু শহীদগণ তাঁর নিকটে অবস্থান করছেন তাঁরাও তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত হিসেবে সকল স্থানের উপর পূর্ণ দৃষ্টি লাভ করেছেন এবং অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর অলী ও অনুগত সৎকর্মশীল বান্দারাও তদ্রুপ। কোরআন বলছে :

( يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ‌ )

তিনি ( আল্লাহ) চক্ষুসমূহের বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্তরসমূহ যা গোপন করে সে সম্পর্কে অবহিত। ৪১

যে সর্বজ্ঞ আল্লাহ সবকিছু জানেন তিনিই তাদেরকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেন। তিনিই তাঁর রাসূলকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।

( عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ‌ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا  إِلَّا مَنِ ارْ‌تَضَىٰ مِن رَّ‌سُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَ‌صَدًا )

 

তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী এবং তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রপশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। ৪২

বিভিন্ন হাদীসেও এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। বদর যুদ্ধের পর মহানবী (সা.) যখন মুশরিকদের মৃতদেহগুলো একটি গর্তে নিক্ষেপ করলেন তখন সেই মৃত মুশরিকদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা আল্লাহর রাসূলের মন্দ প্রতিবেশী ছিলে,তাকে তোমরা তার গৃহ হতে বহিষ্কার ও তাকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হও নি বরং তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলে। আমাকে আমার প্রতিপালক যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সত্য পেয়েছি। এক ব্যক্তি মহানবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি কিরূপে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাগুলোর সাথে কথা বলছেন? মহানবী তাকে বললেন, তুমি তাদের হতে অধিক শুনতে পাও না। ৪৩

আনাস ইবনে মালিক মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন, যখন কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর কবরে শুইয়ে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যায়,তখন সে তাদের পদধ্বনি শুনতে পায়। ৪৪

 মুত্তাকী হিন্দী স্বীয় সূত্রে নবী করিম (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত না করে যায়,তাকে মৃতদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে না। বলা হলো : হে আল্লাহর রাসূল! মৃতরা কি কথা বলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ,তারা পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করে। ৪৫

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে কাবিহ

পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদআত নিন্দনীয় (অপছন্দনীয়) একটি বিষয় এবং তা শরীয়তের বিধান মতে হারামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বিদআতকে হাসান (পছন্দনীয়) ও কাবিহ (অপছন্দনীয়) এ দু ভাগে ভাগ করা সঠিক নয়। কিন্তু আহলে সুন্নাতের আলেমদের মতে বিদআত হাসান কাবিহ এ দু ভাগে বিভক্ত।২৪

বিদআতকে বৈধ ও অবৈধ অর্থাৎ পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় এরূপ বিভাজনের কোন বৈধতা নেই। কারণ বিদআত হলো এমন বিষয় যার কোন শরীয়তগত ভিত্তি নেই অর্থাৎ এমন কোন বিধান সৃষ্টি করা যার উৎস কোরআন ও সুন্নাতে খুঁজে পাওয়া যায় না,তা-ই বিদআত। তাই এরূপ বিধান নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় ও হারাম বলে গণ্য।

কোন বিষয় বা কর্মে মোবাহের কর্মগত বিধান

(যে ক্ষেত্রে শরীয়ত কোন বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করে নি সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়টি বৈধ হওয়ার সার্বিত নীতি)

উসূলশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, কোন বিষয় বা কর্মের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো বৈধতার নীতি অর্থাৎ যদি কোন বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে বৈধতার অথবা স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি কার্যকর হবে। যাকে উসূলশাস্ত্রের পরিভাষায় আসালাতুল হিল্লিয়াত (বৈধতার সর্বজনীন নীতি) অথবা আসালাতুল জাওয়ায বলা হয়। স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি (আসালাতুল বারায়াত) হতেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এ নীতি মতে যে বিষয়ে শরীয়তের প্রবর্তক করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়কে বর্ণনা করেন নি সে বিষয়টি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলে গণ্য অর্থাৎ সেক্ষেত্রে শরীয়তের অনুসারীদের স্বাধীনতা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন :

( قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّ‌مًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ‌ فَإِنَّهُ رِ‌جْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ‌ اللَّـهِ )

আপনি বলে দিন ; যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্য যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস-এটা অপবিত্র ও অবৈধ-অথবা যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয় সে কারণে। ২৫

ড. ইউসুফ কারদ্বাভী বলেছেন, ইসলাম সর্বপ্রথম যে নীতি প্রবর্তন করেছে তা হলো সকল বস্তু ও কল্যাণকর বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈধতার সর্বজনীন নীতি এবং যে বিষয়গুলো শরীয়তের প্রবর্তক সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেন নি,তার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা হতে মুক্তির নীতি। ২৬

রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসৃত নীতিও সুন্নাত বলে গণ্য এবং তা শরীয়তের নীতি নির্ধারক।

এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোকে ওয়াহাবীরা এজন্য বিদআত বলে থাকে যে,তারা রাসূলের আহলে বাইতের সুন্নাতকে শরীয়তের জন্য নীতি নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। অথচ সহীহ হাদীসসমূহে তাদের অনুসৃত কর্ম ও নীতিও শরীয়তের নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ঘোষিত হয়েছে। এখানে আমরা এরূপ কয়েকটি দলিলে প্রতি ইশারা করছি।

১। আয়াতে তাত্বহীর

মহান আল্লাহ বলেছেন :

( إِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا )

নিশ্চয় আল্লাহ চান হে ( নবীর) আহলে বাইত! তোমাদের হতে সকল অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। ২৭

সহীহ মুসলিম হযরত আয়েশা সূত্রে বর্ণনা করেছে যে,একদিন সকালে মহানবী (সা.) গৃহ হতে বের হলেন এবং তখন তাঁর কাঁধে সেলাইবিহীন বিশেষ চাদর ছিল। (অতঃপর যখন তিনি বসলেন) তখন হাসান ইবনে আলী এসে ঐ চাদরের ভিতর প্রবেশ করল,তারপর হুসাইন তাতে প্রবেশ করল,তারপর ফাতেমা আসলে তাঁকেও চাদরে আবৃত করলেন,অতঃপর আলী আসলে তাঁকেও তাতে আবৃত করলেন। তাঁরা সকলে প্রবেশ করলে রাসূল এ আয়াতটি পাঠ করলেন,২৮

( إِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا )

আয়াতটির লক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

প্রথমত আয়াতটিতে ((إنّما )) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা দ্বারা বিধানকে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর জন্য সীমিত করা হয় এবং এটি সীমিতকরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যকরণশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের (আহলে বাইতের) জন্য নির্দিষ্ট ঘোষিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনি) অন্তর্ভুক্ত যার কোন ব্যত্যয় হয় না,إنّما أمره اذا أراد شیئاً أن یقول له کن فیکن কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন বলেন : হও ,অতঃপর তা হয়ে যায়।

আয়াতটিতে (আয়াতে তাত্বহীরে) আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনী) প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,কেননা তা শরীয়তের বিধানগত ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাশরীয়ী) অন্তর্ভুক্ত হলে যাতে বান্দার স্বাধীনতা রয়েছে সকল বান্দাই তার অন্তর্ভুক্ত হতো ও এরূপ পবিত্রতার আকাঙ্ক্ষা সবার জন্য প্রযোজ্য হতো। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে আহলে বাইতকে উল্লেখ মূল্যহীন হয়ে পড়ত। অর্থাৎ এ আয়াতে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার প্রতিফলনের কথা বলা হয়েছে।

তৃতীয়ত আয়াতটিতে যেرجس বা অপবিত্রতার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এমন অপবিত্রতা যা বস্তুর প্রতি অন্যদের ঘৃণার উদ্রেক করে। তাই কোরআনرجس শব্দটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় অপবিত্রতার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছে। যেমন :

( أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ‌ فَإِنَّهُ رِ‌جْسٌ)

অথবা শুকরের মাংস,নিশ্চয়ই তা অপবিত্র এবং

( وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَ‌ضٌ فَزَادَتْهُمْ رِ‌جْسًا إِلَىٰ رِ‌جْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُ‌ونَ )

এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি ( সন্দেহ ও কপটতার) রয়েছে তা তাদের অপবিত্রতার উপর অপবিত্রতা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। (সূরা তওবা: ১২৫)

 এর বিপরীতে পবিত্রতাও বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় বিষয়ে হতে পারে। আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেছেন: রিজস বা অপবিত্রতা হলো এমন আত্মিক অনুভূতি ও প্রভাব যা বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত বিশ্বাস এবং নিকৃষ্ট কর্ম হতে উদ্ভূত। আলোচ্য আয়াতেرجس শব্দটির পূর্বেال এসেছে যা আলিফ ওয়া লামে জিন্স’নামে অভিহিত তা সকল প্রকৃতির অপবিত্রতাকে শামিল করে। তাই আয়াতে আত্মিক অপবিত্রতা অর্থাৎ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বা কর্মের ক্ষেত্রে ভুলের কারণ হতে পারে এমন সকল অপবিত্রতা হতেও মুক্তি ও পবিত্রতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এবং এরূপ পবিত্রতা কেবল ঐশী নিষ্পাপত্বের (স্রষ্টা প্রদত্ত পবিত্রতার) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য অর্থাৎ ব্যক্তির মধ্যে এমন আত্মিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যা তাকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অসৎ কর্ম হতে নিবৃত রাখে। ২৯

যে বিশিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার অধীনে সকল প্রকার ত্রুটি ও পাপ-পঙ্কিলতা হতে মুক্ত ঘোষিত হয়েছেন,নিঃসন্দেহে তাঁরা নিষ্পাপ ও পবিত্র এবং যে কোন পবিত্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তির কর্ম ও নীতি আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে হওয়ায় সুন্নাত ও সকলের জন্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য। তাই আল্লাহর নবীর আহলে বাইতের সদস্যদের অনুসৃত নীতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ও প্রামাণ্য দলিল বলে গণ্য।

২। হাদীসে সাকালাইন

তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)-কে বিদায় হজ্জ্বের সময় উটের পিঠে বসে বক্তব্য দিতে দেখলাম ও তাঁকে বলতে শুনলাম :

হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধর,তাহলে কখনোই বিভ্রান্ত হবে না : আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। ৩০

হাদীসটি হতে বিভিন্নভাবে মহানবীর আহলে বাইতের নিষ্পাপত্ব প্রমাণ করা যায়। হাদীসটিতে কোরআন ও আহলে বাইতকে একত্রে উল্লেখ করে উভয়কে আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে। তাই কোরআন যেরূপ সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে,আহলে বাইতও সেরূপ সকল ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে।

বারজাখের জীবন

(মৃত্যু ও পুনরুত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন জীবন)

ওয়াহাবীদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যের  একটি বিষয় হলো বারজাখ বা মৃত্যু পরবর্তী কবরের জীবন। আল্লাহর আউলিয়ার (ওলীদের) রুহ হতে সাহায্য চাওয়া,তাঁদের মৃত্যুর পর  তাঁদের উসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট চাওয়া (তাওয়াসসুল) ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য মুসলমানের সাথে ওয়াহাবীদের মতপার্থক্য উপরিউক্ত মতভিন্নতারই ফলশ্রুতিতেই ঘটেছে। অন্যান্য সকল মুসলমানই বিশ্বাস রাখেন দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ বারজাখে মানুষের,বিশেষত আল্লাহর ওলীদের বিশেষ জীবন রয়েছে। কিন্তু ওহাবিগণ মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবনে,এমনকি আল্লাহর ওলীদের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়া,তাঁদেরকে মাধ্যম বা উসিলা হিসেবে গ্রহণকে জায়েয মনে করে না,বরং এক প্রকার শিরক বলে বিশ্বাস করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর ওলীদের প্রতি (মৃত্যুর পরে) আহ্বানকে পাথরের ন্যায় প্রাণহীন বস্তুর প্রতি আহ্বান মনে করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর ওলিগণ মৃত্যুর পর অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন না এবং পৃথিবীর উপর তাঁদের কোন প্রভবই নেই। আমরা এখন এ বিশ্বাস নিয়ে মৌলিক আলোচনা করব।

 

ওয়াহাবীদের ফতোয়াসমূহ

১। বিন বায বলেছেন, দ্বীনের অপরিহার্য ও স্বীকৃত বিশ্বাসসমূহ এবং শরীয়তী দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত যে,আল্লাহর রাসূল (সা.) সকল স্থানে বিদ্যমান নন বরং তাঁর দেহ (মোবারক) মদীনায় রয়েছে তবে তাঁর রুহ বেহেশ্তে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে  রয়েছে।৩১

তিনি অন্যত্র বলেছেন, আহলে সুন্নাতের এক বৃহৎ অংশ মৃত্যুর পর কবরের জীবনে  (বারজাখী জীবনে) বিশ্বাসী । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,কবরে শায়িতরা গাইব বা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন অথবা পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে খবর পান বরং এ বিষয়গুলো হতে তাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন।

একই গ্রন্থে অন্য স্থানে তিনি বলেছেন, মহানবী (সা.) তাঁকে সালামকারী ব্যক্তিকে দেখতে পান- এ কথাটির আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কোরআন ও হাদীসে এর সপক্ষে কোন দলিল নেই। রাসূল (সা.) দুনিয়াবাসীর এবং পৃথিবীর উপর যা কিছু ঘটছে সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানেন না। কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে এ পৃথিবীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।৩২

২। বিশিষ্ট ওহাবী হাদীসবিদ নাসিরউদ্দিন আলবানী তাঁর আল আয়াতুল বাইয়্যেনাহ্ আলা আদামে সিমায়েল আসওয়াত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, আলোচ্য বিষয়টির গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের জানানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আশা করি কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট হয়েছে,বিশেষত যারা সবসময় অজ্ঞতার অন্ধকারে বাস করে তাদের জন্য নিমোক্ত বিষয়সমূহ,যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা,নবিগণ,আল্লাহর ওলী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের  রুহের নিকট মুক্তি কামনা করা,এরূপ ধারণা ও বিশ্বাস রাখা যে,তাঁরা তাদের কথা শুনতে পারছেন ইত্যাদি বিষয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হবে।

মানুষ রুহ ও দেহের সমন্বয়ে সৃষ্ট

    কালামবিদগণ মানুষকে দুই সত্তার সমন্বয় বলে বিশ্বাস করেন,যথা রুহ (আত্মা) ও দেহ। এই দুইয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে তাঁরা বেশ কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এখানে  আমরা তার কয়েকটি উল্লেখ করছি :

১। প্রত্যেক মানুষই নিজ কর্মকে এক বাস্তব অস্তিত্বসম্পন্ন সত্তার সাথে সম্পর্কিত করে যাকে আমি বলে অভিহিত করে থাকে এবং দাবী করে আমি অমুক কাজটি করেছি, আমি অমুককে মেরেছি ইত্যাদি। এই আমি সত্তাটি কি? এটি কি মানবের সেই সত্তা নয় যাকে রুহ বা আত্মা নামে অভিহিত করা হয়,অনুরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে এক বাস্তব সত্তার সাথে সম্পকির্ত করে বলে,আমার হৃদয়,আমার উদর,আমার পদযুগল ইত্যাদি। এই আমি সত্তাটি কি রুহ বা নাফ্স ব্যতীত অন্য কিছু?

২। প্রত্যেক মানুষ এই অনুভূতিটি ধারণ করে যে,তার ব্যক্তিত্ব ও সত্তা সময়ের পরিবর্তনে অপরিবর্তিত রয়েছে যাতে কোনরূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয় না,অথচ তার দেহে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই অপরিবর্তিত সত্তাই কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়?

৩। কখনো কখনো মানুষ সবকিছু,এমনকি তার দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কেও অসচেতন হয়ে যায়;কিন্তু সে মুহূর্তেও সে তার আমি সত্তা সম্পর্কে অসচেতন নয়। এটি কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়? ফখরুদ্দীন রাজী বলেছেন, কখনো কখনো আমি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন,অথচ আমার দৈহিক সত্তা সম্পর্কে অবচেতন থাকি। আমার ঐ আত্মসচেতনতাই আমার আত্মা ও নাফ্স। ৩৩

পবিত্র কোরআনও এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে :

( يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ  ارْ‌جِعِي إِلَىٰ رَ‌بِّكِ رَ‌اضِيَةً مَّرْ‌ضِيَّةً  فَادْخُلِي فِي عِبَادِي  وَادْخُلِي جَنَّتِي )

হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর এমন অবস্থায় যে, তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; আমার বিশেষ বান্দাদের (নৈকট্যপ্রাপ্ত) অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার বেহেশ্তে প্রবেশ কর। ৩৪   

অন্যত্র  বলেছেন  :

( فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ  وَأَنتُمْ حِينَئِذٍ تَنظُرُ‌ونَ )

অতঃপর যখন তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তোমরা ( তার শিয়রে দাঁড়িয়ে) তা প্রত্যক্ষ কর। (সূরা ওয়াকেয়া :৮৩-৮৪)

পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার পরও জীবনের অব্যাহত থাকা

পবিত্র কোরআনের আয়াত হতে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে,মানুষের মৃত্যু তার জীবনের শেষ নয়,বরং সে অন্য এক জীবনে প্রবেশ করে ও স্থানান্তরিত হয়। মানুষ মৃত্যুর পর বস্তুগত জগতের  ঊর্ধ্বে এক নতুন জগতে অধিকতর বিস্তৃত জীবন লাভ করে। যেমন :

১। মহান আল্লাহ বলেছেন :

( اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْ‌سِلُ الْأُخْرَ‌ىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُ‌ونَ )

আল্লাহ মৃত্যুর সময় প্রাণকে পূর্ণরূপে হরণ করেন এবং (তার প্রাণকে)যে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে ও মৃত্যুবরণ করে নি। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত হয়েছে তার প্রাণকে আবদ্ধ রাখেন এবং অন্যান্যদেরকে (প্রাণ)নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফিরিয়ে দেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী (আল্লাহর ক্ষমতার) রয়েছে। ৩৫

২। অন্যত্র বলা হয়েছে :

( وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَ‌بِّهِمْ يُرْ‌زَقُونَ )

যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে জীবিকাপ্রাপ্ত। ৩৬

অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়,বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।

মহান আল্লাহ বলেছেন :

( وَمَن يُطِعِ اللَّـهَ وَالرَّ‌سُولَ فَأُولَـٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّـهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـٰئِكَ رَ‌فِيقًا )

যারা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সকল ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবিগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী! ৩৭

যদি শহীদগণ আল্লাহর নিকট জীবিত থাকেন ও জীবিকা লাভ করেন তবে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে-যেহেতু রাসূল নিজেও তাঁর আনীত নির্দেশের আনুগত্যকারী,সেহেতু তিনিও এর অন্তর্ভুক্ত-সেও শহীদদের সাথে থাকবে,কারণ উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী শহীদদের সঙ্গে থাকবে বলা হয়েছে। যদি শহীদরা মৃত্যুর পর আল্লাহর নিকট জীবিত থাকে তবে তারাও আল্লাহর নিকট জীবিত রয়েছে ও বারজাখী জীবনের অধিকারী। যদি বিন বাযের মতো কেউ বলেন, তাঁরা আল্লাহর নিকট বেহেশ্তে রয়েছেন এবং এই পৃথিবীর কোন খবর রাখেন না ,এর জবাবে বলব, আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেছেন :

( وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ )

তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ৩৮

( فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّـهِ )

তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকেই তিনি আছেন। ৩৯

( نَحْنُ أَقْرَ‌بُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِ‌يدِ )

আমরা তার শাহরগ হতেও তার নিকটবর্তী। ৪০

যদি আল্লাহ সকল স্থানে সকলের সাথে থাকেন তবে যেহেতু শহীদগণ তাঁর নিকটে অবস্থান করছেন তাঁরাও তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত হিসেবে সকল স্থানের উপর পূর্ণ দৃষ্টি লাভ করেছেন এবং অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর অলী ও অনুগত সৎকর্মশীল বান্দারাও তদ্রুপ। কোরআন বলছে :

( يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ‌ )

তিনি ( আল্লাহ) চক্ষুসমূহের বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্তরসমূহ যা গোপন করে সে সম্পর্কে অবহিত। ৪১

যে সর্বজ্ঞ আল্লাহ সবকিছু জানেন তিনিই তাদেরকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেন। তিনিই তাঁর রাসূলকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।

( عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ‌ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا  إِلَّا مَنِ ارْ‌تَضَىٰ مِن رَّ‌سُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَ‌صَدًا )

 

তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী এবং তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রপশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। ৪২

বিভিন্ন হাদীসেও এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। বদর যুদ্ধের পর মহানবী (সা.) যখন মুশরিকদের মৃতদেহগুলো একটি গর্তে নিক্ষেপ করলেন তখন সেই মৃত মুশরিকদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা আল্লাহর রাসূলের মন্দ প্রতিবেশী ছিলে,তাকে তোমরা তার গৃহ হতে বহিষ্কার ও তাকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হও নি বরং তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলে। আমাকে আমার প্রতিপালক যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সত্য পেয়েছি। এক ব্যক্তি মহানবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি কিরূপে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাগুলোর সাথে কথা বলছেন? মহানবী তাকে বললেন, তুমি তাদের হতে অধিক শুনতে পাও না। ৪৩

আনাস ইবনে মালিক মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন, যখন কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর কবরে শুইয়ে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যায়,তখন সে তাদের পদধ্বনি শুনতে পায়। ৪৪

 মুত্তাকী হিন্দী স্বীয় সূত্রে নবী করিম (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত না করে যায়,তাকে মৃতদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে না। বলা হলো : হে আল্লাহর রাসূল! মৃতরা কি কথা বলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ,তারা পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করে। ৪৫


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18