কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়16%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 22625 / ডাউনলোড: 3684
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।


1

2

3

4

5

কোরআন মজীদে নাসেখ্ ও মানসূখ্

কোরআন মজীদের বিধিবিধানে স্ববিরোধিতার অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীরা কোরআন মজীদের ঐশী কিতাব না হওয়ার দাবী করে এ গ্রন্থের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সম্ভবতঃ সর্বাধিক গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে এ গ্রন্থে বিভিন্ন স্ববিরোধী আহ্কামের উপস্থিতি। তাদের দাবী , কোরআনে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে একই বিষয়ে একাধিক হুকুম রয়েছে - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন আল্লাহর কিতাব নয়।

এ অভিযোগটির বিশেষ গুরুত্ব এখানে যে , কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য অভিযোগ খণ্ডনে অনেক ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ও মুফাসসিরে কোরআন এগিয়ে এলেও এবং অভিযোগগুলো অকাট্যভাবে খণ্ডন করলেও এ অভিযোগটি খণ্ডনে কদাচিৎ কেউ এগিয়ে এসেছেন। বরং দু একজন ব্যতিরেকে প্রায় সকল মুফাসসির ও ইসলাম-বিশেষজ্ঞই প্রকারান্তরে এ অভিযোগের যথার্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন।

কোরআন মজীদে এমন কতক আয়াত রয়েছে যাতে দেখা যায় যে , দৃশ্যতঃ একটি আয়াতে কোনো বিষয়ে একটি হুকুম নাযিল্ হয়েছে , কিন্তু অপর একটি আয়াতে একই বিষয়ে তা থেকে ভিন্ন হুকুম নাযিল্ হয়েছে। ওলামা ও মুফাসসিরীনে কোরআন এ ধরনের হুকুমসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়ে নাসেখ্ ও মানসূখ্ -এর প্রবক্তা হয়েছেন। তাঁরা দাবী করেছেন যে , এ ধরনের হুকুমগুলোর মধ্যে একটি হুকুম দ্বারা অন্যটি মানসূখ্ বা রদ্ হয়েছে। এর ভিত্তিতে তাঁরা , তাঁদের দৃষ্টিতে , বহাল থাকা হুকুমটিকে নাসেখ্ (রহিতকারী) ও রদ্ হয়ে যাওয়া হুকুমটিকে মানসূখ্ (রহিতকৃত) হিসেবে অভিহিত করেছেন।

কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ আসমানী কিতাব - স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা যা হেফাযতের অর্থাৎ অবিকৃত রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ; এটা আমাদের ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে কোরআন মজীদে আহ্কামের ক্ষেত্রে দৃশ্যতঃ যে সব স্ববিরোধিতা রয়েছে সে সম্পর্কে ওলামা ও মুফাসসিরীনে কোরআনের এ ব্যাখ্যা মুসলমানরা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ জবাব কোরআন-বিরোধীদের আপত্তিকে খণ্ডন করতে সক্ষম হয় নি।

বিষয়টির এহেন গুরুত্ব বিবেচনায় এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

নাসেখ্-মানসূখের ভিত্তি ও প্রকরণ

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , স্বয়ং কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে আয়াত মানসূখ্ করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি কোনো আয়াতকে তার চেয়ে অধিকতর উত্তম বা তার অনুরূপ (আয়াত্) আনয়ন ব্যতীত রহিত করে দেই না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১০৬)

ইতিপূর্বে আমরা আমাদের আলোচনায় বলেছি যে , এ আয়াতে মূলতঃ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের পাঠ রহিতকরণ ও অনেক বিধান রহিতকরণ বা পরিবর্তনকরণের বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু দু একজন ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকল মুফাসসির্ ও ইসলামী মনীষীই এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছেন এবং এ আয়াতের লক্ষ্য কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে নাসেখ্ ও মানসূখ্ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে দুই ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ কার্যকর হয়েছে :

এক ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ হচ্ছে এই যে , এক সময় কোনো হুকুম সম্বলিত কোনো আয়াত নাযিল্ হয়েছে , কিন্তু পরে তার তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হয়ে গিয়েছে , ফলে কোরআন মজীদের লিখিত পাঠে আর তা বর্তমান নেই , কিন্তু তার হুকুম বহাল রয়ে গিয়েছে। আরেক ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ হচ্ছে এই যে , এক সময় কোনো বিষয়ে একটি হুকুম সম্বলিত আয়াত নাযিল্ হয়েছে , পরে একই বিষয়ে ভিন্ন হুকুম সম্বলিত অন্য আয়াত নাযিল্ হয়েছে এবং এর ফলে প্রথমোক্ত আয়াতটির হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে , কিন্তু তার তেলাওয়াত্ বহাল রয়েছে।

অন্যদিকে ব্যতিক্রম হিসেবে যে দু একজন মুফাসসির্ ও ইসলাম-গবেষক উপরোক্ত মতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের না কোনো আয়াতের পাঠ (তেলাওয়াত্) রহিত হয়েছে , না কোনো আয়াতের হুকুম রহিত হয়েছে। বিশেষ করে কোনো আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের মত হচ্ছে এই যে , কোরআন নাযিল্ সমাপ্ত হবার পর থেকে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত বিশ্বের মুসলমানদের নিকট যে অভিন্ন কোরআন মজীদ রয়েছে তার বাইরে কোনো কিছু কোরআনের আয়াত হিসেবে কখনোই নাযিল্ হয় নি , অতএব , এরূপ কোনো আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

অন্যদিকে যারা কোরআন মজীদের আয়াতের তেলাওয়াত্ বা হুকুম মানসূখ্ হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা বেশ কিছু সংখ্যক আয়াতের হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করেন। ফলে যারা সংশ্লিষ্ট হুকুমগুলোকে মানসূখ্ গণ্য করেনে না তাঁদের ও এদের মধ্যে ঐ সব আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণ ও শর ঈ হুকুম বয়ানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যায়। আর বিষয়টি যেহেতু কেবল চিন্তা ও আক্বীদাহর সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বরং বাস্তব আচরণ ও আমলের সাথে জড়িত সেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে গভীর ও যথাসম্ভব বিস্তারিত পর্যালোচনা করে নির্ভুল উপসংহারে উপনীত হওয়া অপরিহার্য প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

আয়াত্ ও আহ্কামের নাসখের সম্ভাব্যতা

আয়াত্ ও আহ্কামের মানসূখ্ হওয়ার সম্ভাব্যতার বিষয়টি দু 'টি পর্যায়ে আলোচনার দাবী রাখে। প্রথমতঃ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাবার পর থেকে শুরু করে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল আয়াত্ ও আহ্কাম্ আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে কোরআন মজীদও শামিল রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ বিশেষভাবে কোরআন মজীদ আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের মত হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত আয়াত্ ও আহ্কাম্ মানসূখ্ বা রহিত হওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে এই যে , আয়াত্ ও আহ্কাম্ রহিতকরণ বা তাতে পরিবর্তন সাধন আয়াত্ নাযিলকারী ও বিধানদাতার দুর্বলতার পরিচায়ক। কারণ , তা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও ভ্রান্তি নির্দেশ করে। আর আল্লাহ্ তা আলা এ ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা আলার আয়াত্ ও আহ্কামের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁদের ধারণার অস্পষ্টতার ওপর তাঁদের এ যুক্তি প্রতিষ্ঠিত।

আল্লাহ্ তা আলা যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির নিকট যে ওয়াহী নাযিল্ করেছেন তা মানুষের ভাষায়ই নাযিল্ করেছেন। ফলে আল্লাহ্ তা আলার নিকট তাঁর ওয়াহী সমুন্নততম ভাবসমৃদ্ধ হলেও মানুষের নিকট অবতরণের ক্ষেত্রে তা সংশ্লিষ্ট ভাষার সীমাবদ্ধতার দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাষার প্রকাশক্ষমতার মধ্যে যেমন পার্থক্য দেখা যায় তেমনি একই ভাষার বিকাশেরও বিভিন্ন স্তর দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , আল্লাহ্ তা আলার ওয়াহী , আয়াত্ বা কিতাব মানুষের কাছে পৌঁছলে যে নাযিল্ হওয়া অর্থাৎ অবতরণ করা বা নীচে নামা বলা হয় তার মানে বস্তুগত অর্থে উঁচু স্থান থেকে নীচু জায়গায় নেমে আসা নয় , বরং এ অবতরণ গুণগত , ভাবগত ও তাৎপর্যগত। অর্থাৎ পরম প্রমুক্ত অসীম সত্তা আল্লাহ্ তা আলার ভাব যখন সসীম সত্তা বিশিষ্ট মানুষের অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের (আঃ) নিকট পৌঁছে তখন তা স্বাভাবিকভাবেই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতার বৈশিষ্ট্য লাভ করে এবং যখন তা মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা হয় তখন তা আরো সীমাবদ্ধতা লাভ করে। এ ক্ষেত্রে মানগত ও তাৎপর্যগত যে অবনতি ঘটে তা-ই হচ্ছে নুযূল্ (অবতরণ)।

এমতাবস্থায় একই ভাষায় খোদায়ী ওয়াহী ভাষাটির বিকাশের প্রাথমিক স্তরে নাযিল্ হওয়ার পর তার বিকাশের উন্নততর স্তরে পুনরায় নাযিল্ হওয়া ও পূর্ববর্তী সংস্করণ রহিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ , ভাষার প্রকাশক্ষমতার উন্নততর স্তরে এসেও প্রাথমিক স্তরের ভাষায় খোদায়ী আয়াত্ বা কিতাব বিদ্যমান থাকলে তার ভাষাগত নিম্নমান মানুষের মনে আল্লাহ্ তা আলার প্রকাশক্ষমতা সম্বন্ধে অথবা সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের ওয়াহী হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে একই কারণে উন্নততম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষার বিকাশের চরমতম পর্যায়ে সে ভাষায় খোদায়ী ওয়াহী বা কিতাব নাযিল্ হওয়ার পর ঐশী কিতাবের অন্যান্য ভাষায় নাযিলকৃত পূর্ববর্তী সংস্করণসমূহ রহিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

এ ধরনের নাসখ (রহিতকরণ) দুইভাবে হতে পারে : পূর্ববর্তী আয়াত্ ও কিতাব সমূহে বিকৃতি সাধিত হওয়া বা মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তথা মানবিক গতিধারায় অথবা পরবর্তীতে নাযিলকৃত আয়াত্ বা কিতাবের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে অথবা উভয় পন্থায়। আমরা প্রথম পন্থাটিকে প্রাকৃতিক পন্থা নামে অভিহিত করতে পারি।

দ্বিতীয় পন্থায় রহিতকরণের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তা হচ্ছে , পরবর্তীতে নাযিলকৃত ওয়াহীকে 'ওয়াহী ' বলে যাদের অন্তরে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে তারা পূর্ববর্তী ওয়াহীকে মানসূখ্ (রহিত) বলে মানবেন না। অতএব , এ ক্ষেত্রে প্রথম পন্থাই হচ্ছে নিশ্চিতভাবে কার্যকর পন্থা। আর এটা অকাট্য সত্য যে , প্রথম পন্থায় কোরআন মজীদের পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহ রহিত হয়ে গেছে। কারণ , নিশ্চিতভাবেই ঐ সব কিতাব মূল ভাষায় বর্তমান নেই ; বিদ্যমান (অনূদিত বা ভাষান্তরিত) প্রতিটি কিতাবেই ব্যাপকভাবে বিকৃতি প্রবেশ করেছে ও প্রতিটিরই একাধিক সংস্করণ আছে। এমনকি যে সব নবী-রাসূলের ( আঃ) নামে ঐ সব কিতাব প্রচলিত আছে তাঁরাই যে ঐ সব কিতাব উপস্থাপন করেছিলেন এটা প্রত্যয় উৎপাদনকারী মানবিক পন্থায় প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ সংশ্লিষ্ট নবীর ( আঃ) সময় থেকে মুতাওয়াতির্ সূত্রে তা বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অ্যদিকে কোরআন মজীদ যে ঐ সব নবী-রাসূলের ( আঃ) নিকট সংশ্লিষ্ট কিতাব সমূহ নাযিল্ হওয়ার কথা বলেছে তাকে এ ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে পেশ করা যাবে না। কারণ , তা মানবিক দলীল নয়। এ দলীলকে দলীল হিসাবে ব্যবহার করতে হলে কোরআন মজীদকে আল্লাহ্ তা আলার কিতাব হিসাবে স্বীকার করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে ঐ সব কিতাবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও কোরআন মজীদের বক্তব্য মেনে নিতে হবে। অতএব , দেখা যাচ্ছে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ মানসূখ্ হয়েছে প্রাকৃতিকভাবেই এবং কোরআন মজীদও তা মানসূখ্ হবার কথা বলেছে।

অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ উভয় পন্থায়ই মানসূখ্ হয়েছে।

এবার আসা যাক আহ্কাম্ প্রসঙ্গে।

ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের দাবী হচ্ছে , যেহেতু বিধানদাতা তাঁর দুর্বলতার বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই বিধানে পরিবর্তন করেন , অতএব , খোদায়ী বিধানে পরিবর্তন হতে পারে না। (তাঁদের এ যুক্তি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে পূর্বতন কিতাব সমূহ রহিত হলেও নতুন কিতাবে পূর্বতন বিধানসমূহই অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।)

তাঁদের পক্ষ থেকে এ যুক্তি উপস্থাপনের কারণ হচ্ছে , তাঁরা বিভিন্ন ধরনের বিধানের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টিদানে ব্যর্থ হয়েছেন।

সকল আহ্কাম্ বা বিধিবিধানকে আমরা এক বিবেচনায় দুই ভাগে ভাগ করতে পারি : অপরিহার্য ও আপেক্ষিক। অপরিহার্য বিধিবিধান হচ্ছে মানুষের সৃষ্টি-প্রকৃতির দাবী , অতএব , তাতে পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। নৈতিক বিধিবিধান এবং মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক বা নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর এমন খাদ্যবস্তু ও কাজকে হারামকরণ এ পর্যায়ভুক্ত।

অন্যদিকে যে সব বিধিবিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক কারণ বিদ্যমান নেই , বরং বিধানদাতার ইচ্ছাই তার একমাত্র নিয়ামক সে সব বিধিবিধানকে আমরা সামগ্রিকভাবে আপেক্ষিক বিধিবিধান বলে অভিহিত করতে পারি। এর মধ্যে কতগুলো বিধিবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে আনুগত্য পরীক্ষা করা। ইবাদত-বন্দেগীর বিধিবিধান এ পর্যায়ের। এর কোনো অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই , বরং বিধানদাতা যে কোনো হুকুম জারী করে বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করতে পারেন। তাই তিনি চাইলে পূর্ববর্তী হুকুম রহিত করে নতুন হুকুম জারী করতে পারেন।

এ পর্যায়ের অন্যান্য বিধিবিধানের লক্ষ্য হচ্ছে পার্থিব জীবনে মানুষের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা। এতে স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্রভেদে সর্বোচ্চ কল্যাণের মানদণ্ড বিভিন্ন হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে বিধানদাতার পক্ষ থেকে তিন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করা যায় : হয় তিনি মানবজাতির সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিধান শুরুতেই প্রদান করবেন , অথবা প্রতিটি নতুন পরিস্থিতি উদ্ভবের সাথে সাথে নতুন বিধান পাঠাবেন ও যে বিধানের পরিস্থিতি বিলুপ্ত হয়েছে সে বিধান বিলোপ করবেন , অথবা এমন কিছু মূলনীতি ও পথনির্দেশ প্রদান করবেন যার ভিত্তিতে মানুষ স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্রভেদে প্রয়োজনীয় বিধান উদ্ঘাটন করবে।

আমরা সামান্য চিন্তা করলেই বুঝতে পারি যে , প্রথম প্রক্রিয়াটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল অবস্থার সকল মানুষের জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রের বিস্তারিত বিধান প্রণয়ন করা হলে তা হতো এতোই ব্যাপক যে , বিশেষ করে প্রাথমিক যুগের মানুষের পক্ষে তার মধ্য থেকে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বিধানসমূহ খুঁজে বের করা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি যুক্তিসঙ্গত হলেও মানবসভ্যতার বিকাশ , মানবজাতির ব্যাপক বিস্তৃতি ও জীবনযাত্রার জটিলতার যুগে এ প্রক্রিয়া মানুষের জন্য তেমন একটা উপযোগী হতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে সর্বক্ষণ বহু নবীর মাধ্যমে নতুন নতুন বিধান জারী ও পুরনো বিধান রহিতকরণের বিষয়টি এতোই ব্যাপক আকার ধারণ করতো যে , তাতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়তো। তাছাড়া নবীকে নবী হিসাবে চিনতে পারা-নাপারা ও স্বীকার করা-নাকরার ভিত্তিতে এ জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতো। অন্যদিকে মানবজাতি প্রথম দিকে জ্ঞান ও সভ্যতার বিচারে যে পর্যায়ে ছিলো তাতে তাদের পক্ষে তৃতীয় প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হওয়া অর্থাৎ মূলনীতি ও পথনির্দেশের সহায়তায় বিস্তারিত বিধান উদঘাটন করা সম্ভব ছিলো না।

এমতাবস্থায় যা স্বাভাবিক তা হচ্ছে , (১) মানবজাতির বিকাশ-বিস্তারের একটি পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিকট এবং প্রয়োজনে যুগে যুগে বিস্তারিত বিধিবিধিান প্রেরণ , পুনঃপ্রেরণ এবং তাতে প্রয়োজনীয় রদবদল ও সংশোধন , (২) অতঃপর মানবজাতির বিকাশের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে স্থায়ীভাবে কতক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান প্রদান যাতে মানুষের বিভিন্ন অবস্থার বিবেচনা থাকবে এবং কতক ক্ষেত্রে মূলনীতি ও পথনির্দেশ প্রদান - যার ভিত্তিতে স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্র বিবেচনায় বিস্তারিত বিধান উদঘাটন করা হবে।

বিভিন্ন ধর্ম , ধর্মগ্রন্থ ও নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই , প্রকৃত পক্ষে এরূপই হয়েছে। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) আগমন ঘটেছে। তাঁদের মাধ্যমে অপরিবর্তনীয় বিধিবিধানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জাতির জন্য বিস্তারিত আপেক্ষিক বিধিবিধানও নাযিল্ হয়েছিলো , তবে তার কার্যকারিতা ছিলো সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) এর মাধ্যমে চিরস্থায়ী বিধিবিধান নাযিল্ হয় - যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর ও অপরিবর্তিত থাকবে। তবে পূর্ববর্তী বিধিবিধানের সাথে এ সব বিধিবিধানের বৈশিষ্ট্যগত প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এই যে , এতে একদিকে যেমন বিস্তারিত বিধিবিধানে মানুষের বিভিন্ন অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে , অন্যদিকে মানবজীবনের অনেকগুলো বিরাট ক্ষেত্রের জন্য বিস্তারিত বিধানের পরিবর্তে মূলনীতি ও দিকনির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

আমাদের এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , সাময়িকভাবে বিধিবিধান জারী করা এবং পরে তা রহিত করে স্থায়ী বিধিবিধান জারী করায় মহান বিধানদাতার প্রজ্ঞা ও বান্দাহদের প্রতি তাঁর কল্যাণেচ্ছারই প্রকাশ ঘটেছে।

এখানে আরো দু টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের প্রামাণ্যতাই যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় এবং কার্যতঃ যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই ঐ সব কিতাব মানসূখ্ হয়ে গেছে সেখানে ঐ সব কিতাবের বর্তমান বিকৃত সংস্করণসমূহে যে সব বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো যে মূল কিতাবের বিধান এবং তা পরিবর্তিত , বিকৃত ও সংযোজিত নয় - তার নিশ্চয়তা কোথায় ? এমতাবস্থায় কোরআনের বিধানের সাথে তার যে পার্থক্য তা কি পূর্ববর্তী বিধানের রহিতকরণনির্দেশক , নাকি বিকৃতিনির্দেশক সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে পূর্ববর্তী কতক বিধান যে রহিত করা হয়েছে তা কোরআন মজীদ থেকেই জানা যায়। আর তা যে সম্ভব এবং বিধানদাতার প্রজ্ঞার পরিচায়ক তা আমরা প্রমাণ করেছি।

দ্বিতীয়তঃ খোদায়ী বিধান পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের নিকট বিদ্যমান বর্তমান গ্রন্থাবলীতেও রয়েছে। যেমন : বাইবেলের পুরাতন নিয়ম -এর গণনা পুস্তক -এর ৪র্থ অধ্যায়ের ১-৩ নং পদে লেভী-বংশীয়দের মধ্যকার তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্কদের জন্য সমাগম তাঁবুতে সেবাকর্ম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু একই পুস্তকের ৮ম অধ্যায়ের ২৩-২৫ নং পদে এ কাজের জন্য ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধরনের আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং , ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের পক্ষে নাসখ্ অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

অতএব , কোরআন মজীদ নাযিলের পর্যায়ে পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ মানসূখ্ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই মানবতার কল্যাণ নিহিত ছিলো। তাই আল্লাহ্ তা আলা ঐ সব কিতাব মানসূখ্ হওয়ার ব্যাপারে আহলে কিতাবের আপত্তির জবাবে এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি অধিকতর উত্তম বা অনুরূপ কিছু পেশ না করে কোনো আয়াৎকে রহিত করি না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১০৬)

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের বক্তব্যসমূহ সমমানে বা অধিকতর উত্তম মানে কোরআন মজীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যে সব বিধিবিধান ও দিকনির্দেশ তাতে ছিলো না অথচ বর্তমানে বা ভবিষ্যতে প্রয়োজন তা-ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে এমন অনেক বক্তব্য রয়েছে যা সংক্ষেপেও কোরআন মজীদে স্থান পায় নি ; এর কি ব্যাখ্যা থাকতে পারে ? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে এ সত্যটি স্মরণ করতে হবে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের কোনোটিই নাযিলকালীনরূপে অবিকৃতভাবে বিদ্যমান নেই।

ঐ সব কিতাবের প্রায় সবগুলোতেই আল্লাহর কালামের সাথে সংশ্লিষ্ট নবী-রাসূলের ( আঃ) কথা ও কাজের বর্ণনা এবং গ্রন্থসংকলকদের নিজেদের বক্তব্য যোগ করা হযেছে। ঐ সব গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে যে কারো নিকটই তা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে । বস্তুতঃ কোরআন মজীদ যে অর্থে আল্লাহর কিতাব সে অর্থে ঐ সব কিতাবকে কিছুতেই আল্লাহর কিতাব বলা চলে না , বরং ঐ সব কিতাবকে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনীগ্রন্থের সাথে তুলনা করা চলে যা অ-নবী লেখক কর্তৃক রচিত , তবে তাতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কোরআন মজীদের কিছু আয়াত্ ও কিছু হাদীছ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কোরআন মজীদ যখন নাসখের কথা বলেছে তখন মূল কিতাবের কথাই বলেছে এবং নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী মূল কিতাবসমূহের চিরস্থায়ী গুরুত্বের অধিকারী সব বক্তব্যই কোরআন মজীদে স্থান পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ করা যেতে পারে যে , কোরআন মজীদ ভুলিয়ে দেয়া র কথা বলে প্রাকৃতিক পন্থায় নাসখের কথা বলেছে। একই সাথে সরাসরি নাসখ্ -এর কথা বলা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ হারিয়ে গেলেও (ব্যাপক বিকৃতি অর্থে) সে সব কিতাবের ব্যাপক বিকৃতির কারণে ঐ সব আয়াতের কার্যকারিতা অব্যাহত রাখার পরিবর্তে অনুরূপ বা তার চেয়ে উত্তম নতুন আয়াত্ পেশ করার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত ছিলো।

ইসলাম পূর্ব নারীগণ

ইসলামের ইতিহাসে ঈমানদার , সাহসী , জুলুম বিরোধী অনেক নারী ছিলেন , যাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই ছিল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত এবং আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের চেতনাপূর্ণ তাদের সংখ্যা অনেক কিন্তু আমরা এখানে এরূপ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করব :

1- হাযবিল নাজ্জারের (কাঠ মিস্ত্রি) স্ত্রী : এই মহিলার ঘটনাটি হচ্ছে হযরত মুসা (আ.) এর সময়কার । সে হযরত মুসা (আ.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করে । ঘটনা বশত: সে ফেরাউনের প্রাসাদে তার কন্যার পরিচর্যার কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় । একদিন ফিরআউনের কন্যার চুল চিরুণী দিয়ে আচড়ে দেয়ার সময় তার হাত থেকে চিরুনিটি পড়ে যায় , যেহেতু সে সব সময় আল্লাহর যিকির করতো তাই চিরুনিটি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সে বলে উঠল : ইয়া আল্লাহ্! ফেরাউনের কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে , তোমার ইয়া আল্লাহ বলার উদ্দেশ্য কি আমার বাবা ?

সে বলল : না , বরং আমি এমন কাউকে উপাসনা করি যিনি তোমার বাবাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবার ধ্বংসও করবেন ।

মেয়ে তার বাবাকে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করলে ফেরাউন তাকে ডেকে পাঠালো । সে উপস্থিত হলে তাকে বলল : আমি যে খোদা এটা তুমি বিশ্বাস কর না ?

সে বলল : না , কখনই নয়! আমি প্রকৃত আল্লাহকে ছেড়ে তোমার উপাসনা করবো না ।

ফেরাউন এই কথায় অত্যন্ত রাগান্বিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল আগুনের চুল্লী তৈরী করার এবং তা লাল রং ধারণ করলে ঐ মহিলার সব সন্তানকে আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলে দিতে । মহিলার সব সন্তানকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল । শুধুমাত্র একটি দুধের শিশু তার কোলে অবশিষ্ট ছিল । জল্লাদ তার কোল থেকে ঐ দুধের শিশুটিকেও ছিনিয়ে নিয়ে বলল : তুই যদি মুসার দ্বীনকে অনুসরণ না করিস তাহলে তোর বাচ্চাকে বাচিয়ে রাখবো । দুধের শিশুটির অন্তর ধক-ধক করতে শুরু করলো । মহিলাটি বাহ্যিকভাবে এ কথা স্বীকার করে বলতে চাইল যে , ঠিক আছে কিন্তু হঠাৎ দুধের শিশুটি কথা বলে উঠলো । সে তার মাকে বলল : ধৈর্য ধারণ কর , তুমি সত্যের পথে আছো ।

মহিলাটি তাই করল । অবশেষে ঐ দুধের বাচ্চাটিকেও পুড়িয়ে মারা হল । তারপর তাকেও তারা পুড়িয়ে মারলো । এভাবেই এক সাহসী ও মু মিন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিল বাতিলের কাছে মাথা নত করেনি , বরং বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ।

নবী (সা.) বলেন : মি ’ রাজের রাতে একটি স্থান থেকে আকর্ষণীয় এক সুগন্ধ আমার নাকে আসছিল , আমি জিব্রাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম যে , এই সুবাস কোথা থেকে আসছে ? জিব্রাঈল আমাকে উত্তরে বলল : এই গন্ধ হাযবিলের স্ত্রী ও তার সন্তানদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহের থেকে আসছে , যা এই পৃথিবীর সমান্তরাল মহাশূন্যে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে । আর ঐ স্থান থেকে এই সুগন্ধ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত আসতে থাকবে ।34

2- হযরত ইব্রাহীম খালিলুল্লাহ্ (আ.)-এর মা :

এই ঘটনাটি অনেকটা উপরোল্লিখিত ঘটনার মতই । নমরুদ তার অধীনস্থ জ্যোতিষীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে , একটি শিশু জন্মলাভ করে তাকে ধ্বংস করবে । এ কারণে সে (বর্ণনামতে) 77 হাজার থেকে এক লক্ষ শিশুকে হত্যা করে । এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইব্রাহীমের (আ.) আত্মত্যাগী মা বিরলভাবে নিজেকে নমরুদের লোক-লস্কর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন । তিনি প্রসব বেদনা শুরু হলে ঋতুস্রাবের বাহানায় (কারণ তখন নিয়ম ছিল যে , কোন মহিলার ঋতুস্রাব হলে তাকে শহরের বাইরে চলে যেতে হত) শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শহর থেকে অনেক দুরে একটি পাহাড়ের গুহা খুঁজে পেলেন । সেখানেই ইব্রাহীম (আ.) ভুমিষ্ট হন । ক্লান্তিহীন পরিশ্রমী এই মা 13 বছর ধরে নমরুদের লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে , কখনো রাতে আবার কখনো প্রত্যুষে সকালে পাহাড়ের ঐ গুহার মধ্যে যেতেন তার সন্তানের সাথে দেখা করতে । এ সময় তিনি গায়েবীভাবেও সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন । যেহেতু তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করেছিলেন সেহেতু আল্লাহও তাকে সাহায্য করেছেন । অবশেষে 13 বছর পরে ইব্রাহীম (আ.) খোদায়ী বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হয়ে সমাজে ফিরে এলেন এবং আস্তে আস্তে মূর্তিপুজকদের সাথে মুকাবিলা করতে শুরু করলেন । আর দিনের পর দিন তিনি সফলকাম হতে থাকলেন ।35

3- হযরত আইয়্যুবের স্ত্রী :

রুহামাহ (রাহিমাহ্) ছিলেন হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী এবং হযরত শোয়াইবের কন্যা । তিনি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন । তার সকল সন্তান বাড়ীর ছাদের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় , বাগ-বাগিচা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় , সমস্ত সম্পত্তি এবং গৃহপালিত প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায় । এত কিছুর পরে হযরত আইয়্যূব এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন । এমন পরিস্থিতিতে সবাই তাকে সান্তনা দেয়ার বদলে অপমান করলো এই বলে যে , নিঃশ্চয়ই তোমরা গোনাহ্গার ছিলে তাই আল্লাহ তোমাদেরকে এরূপ সাজা দিয়েছেন । সকলেই হযরত আইয়্যূবের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল । আর সে কারণেই তিনি শহর ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন । অতপর আল্লাহ্ তাদেরকে উত্তম সন্তান দান করেন এবং অবস্থা পুর্বের পর্যায়ে ফিরে যায় ।36

হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী আমাদেরকে যে শিক্ষা দেন তা হচ্ছে নিম্নরূপ :

প্রথমত : আল্লাহর নবিগণও বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে পারেন ।

দ্বিতীয়ত : মু ’ মিনদের চেষ্টা করা উচিৎ এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈয ধরে সফলতার সাথে তা থেকে বেরিয়ে আসার ।

তৃতীয়ত : উত্তম স্ত্রী সেই যে , কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তার স্বামীকে একা ত্যাগ করে না । আর হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী ছিলেন তেমনই এক নারী । কারণ তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তার স্বামীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেন নি বরং সকল সময় তার পাশে পাশে থেকেছেন এবং এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করেছেন । যদিও পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে হালাল রুটি- রুজীর জন্য কষ্ট করা এবং পরিবারে স্বাচ্ছন্দ আনয়ন করা ।

ইসলাম পূর্ব ইতিহাসে আরো অনেক নারীই ছিলেন যেমন : হযরত শোয়াইবের কন্যাগণ , হযরত মুসা (আ.)-এর মা ও বোন , হযরত মারিয়াম (আ.) , আসিয়া , হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মা হাজার , নবী (সা.) -এর মা আমেনা , নবী (সা.) -এর দুধ মাতা হালিমা ও আরো অনেকে যাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি ।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের নারীগণ

1- হযরত খাদিজা (আ.) : হযরত খাদিজাহ্ (আ.) প্রথম পর্যায়ে খৃষ্টান ছিলেন । যেহেতু তিনি খৃষ্টানদের বিভিন্ন গ্রন্থে নবী পাক (সা.) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং অতি নিকট থেকে ঐ মহামানবকে দেখেছিলেন । তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই মহান নারী আল্লাহ তা ’ য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সমস্ত সম্পত্তি নবীর (সা.) হাতে সমর্পন করেছিলেন । নবী (সা.) ঐ বিশাল সম্পদকে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে খরচ করেন । হযরত খাদিজাহ্ এ সম্পর্কে বলেন : আমার সম্পত্তি থেকে শুধূমাত্র দু ’ টি ভেড়ার চামড়া অবশিষ্ট ছিল , দিনের বেলা তার উপর ভেড়ার খাবার দিতাম এবং রাতে তা বিছিয়ে শুতাম ।

তিনি শুধুমাত্র তার সম্পদকেই দ্বীনের রাস্তায় দান করেননি বরং নবীকে (সা.) জীবন দিয়েও সাহায্য করেছিলেন । তিনি রাসূলের (সা.) শত দুঃখের সাথি ও সান্ত্বনাদানকারী ছিলেন । তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের চারজন শ্রেষ্ঠ রমনীর একজন (যারা বেহেশ্তী নারী হিসেবে পরিচিত) । রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনই হযরত খাদিজার ভালবাসা ও ত্যাগের কথা ভুলেন নি । আর যখনই তার কথা স্মরণ করতেন তখনই তার উপর দুরুদ পড়তেন ।

2 - প্রথম শহীদ নারী সুমাইয়্যা : সুমাইয়্যা , ইয়াসিরের স্ত্রী ছিলেন । তিনি এবং তার স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বলে তাদেরকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল এবং শত্রুপক্ষ তাদেরকে শহীদ করেছিল । তারা সুমাইয়্যাকে বলেছিল : যদি তুমি নবীর (সা.) উপর ঈমান আনা থেকে বিরত না হও তবে তোমার দুই পায়ে দড়ি বেঁধে দুই উটের সাথে বেধে দিব এবং উট দু ’ টিকে দুই দিকে তাড়িয়ে দিব , ফলে তোমার শরীর দু ’ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে ।

সুমাইয়্যা তাদের কথায় ভয় না পাওয়ায় তারা তাদের উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করলো । তারা শুধু তাকেই নয় বরং তার স্বামীকেও হত্যা করলো । আম্মার ইয়াসির এই দুই মহান ব্যক্তির সন্তান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । অবশেষে তিনিও সিফ্ফিনের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর সৈন্য দলের পক্ষ হয়ে মুয়া ’ বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন ।37

3 - অন্যান্য নারীগণ : অন্যান্য মহিলাগণ যেমন , লুবাইনিহ্ , যিন্নিরিহ্ , নাহদিয়াহ্ , গাযযিয়াহ্ ও এরূপ আরো অনেকে যাদের নাম ইতিহাসে উল্লেখও হয় নি , ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার ফলে শত্রুর অত্যাচারে শহীদ হন ।38

4- ফাতিমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী (আ.)-এর মা) : ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য এই মর্যাদাই যথেষ্ট যে , তিনি পবিত্র কা ’ বা গৃহের মধ্যে আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.) -এর মত সন্তানকে জন্মদান করেছেন । কোন মহিলাই এ মর্যাদা পায় নি এবং পাবেও না ।

যখনই নবী (সা.) ক্লান্ত থাকতেন ফাতিমা বিনতে আসাদের বাড়ীতে আসতেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

যখন তিনি এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন তখন নবী (সা.) কাঁদতে কাঁদতে মৃত দেহের পাশে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন : আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশ্তবাসী করুন , তিনি শুধু আলীর মাতাই ছিলেন না বরং আমারও মা (সা.) ছিলেন । রাসূলে খোদা নিজের মাথার পাগড়ি ও আলখেল্লা খুলে দিয়েছিলেন তার কাফন করার জন্য । তার জানাজার নামাযে চল্লিশটি তাকবির বলেছিলেন । তারপর তিনি তার কবরে নেমে কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেন এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসানকে (আ.) অনুরূপ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন ।

আম্মার নবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন : কারো জন্যেই তো আপনি এরূপ করেন নি , ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য কেন এরূপ করলেন ?!

রাসূল (সা.) বললেন : তার জন্য এমনটা করাই উত্তম ছিল । কেননা তিনি নিজের সন্তানকে পেট ভরে খেতে না দিয়ে আমার পেট ভরাতেন । তার সন্তানদেরকে খালি পায়ে রাখতেন কিন্তু আমার পায়ে জুতা পরিয়ে দিতেন ।

আম্মার পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : কেন তার নামাযে চল্লিশবার তাকবির দিলেন ?

তিনি বললেন : তার জানাজার নামাযে ফেরেশতাগণ চল্লিশ কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিল তাই তাদের প্রত্যেকটি সারির জন্য একটি করে তাকবির বলেছি ।

আর এই যে , আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়েছি তাঁকে কাফন করার জন্য এটার কারণ এই যে , একদিন তাঁর সাথে আমি কিয়ামতের দিনে মানুষের বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে কথা বলছিলাম , তিনি এ কথা শুনে চিৎকার করে উঠেছিলেন এবং কিয়ামাতের দিনে বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন । তাই আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়ে তাকে কাফন করিয়েছি , যাতে করে কিয়ামতের দিনে তিনি বস্ত্রহীন না থাকেন আর তা যেন পচে না যায় । যেহেতু তিনি কবরের প্রশ্নের ব্যাপারে অনেক ভয় পেতেন তাই আমি তাকে কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ তার মধ্যে অবস্থান করেছি । আর এই অবস্থানের ফলে আল্লাহ তার কবরকে বেহেশ্তের একটি অংশে পরিণত করছেন এবং তার কবর এখন বেহেশতের বাগানে পরিণত হয়েছে ।39

5 - চার শহীদের জননী , খানিসা : তিনি একজন অভিজ্ঞ ইসলাম প্রচারক ছিলেন । তিনি তার গোত্রের সকলকে ইসলামের পথে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যদেরকেও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতেন । 14 হিজরীতে সংঘটিত কাদিসিয়া যুদ্ধে তিনি তার সন্তানদেরকে ঐ যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন । তার সন্তানদের মধ্যে চারজন শহীদ হয় । তিনি তার সন্তানদের শহীদ হওয়াতে বলেন : আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া , কেননা তিনি তাদের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন । আরো বলেন : আমার আশা এটাই যে , আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাকেও তাঁর রহমত ও কৃপা দান করে ধন্য করবেন (অর্থাৎ তাকে শহীদ হওয়ার তৌফিক দান করবেন) ।40

6 - চার শহীদের জননী , উম্মুল বানিন : উম্মুল বানিন ছিলেন ইমাম আলী (আ.)-এর একজন আল্লাহ্ প্রেমিক স্ত্রী । তিনি তার চারজন সন্তান যথাক্রমে : হযরত আব্বাস , আব্দুল্লাহ্ , জা ’ ফার ও উসমান , কারবালায় তাদের ভাই ও নেতা ইমাম হুসাইনের সাথে শাহাদাত বরণ করেন ।

যখন বাশির মদীনায় ফিরে এসে কারবালার ঘটনাকে মসজিদে নববীতে বর্ণনা করছিল তখন উম্মুল বানিন উপস্থিতদের মধ্যে থেকে সামনে (আ.) এসে বললেন : হে বাশির! আমাকে শুধু ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বল । আর আমার চার সন্তান খোলা আকাশের নিচে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না , কেননা আমি তাদেরকে ইমাম হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করেছি । যখন তিনি বাশিরের মুখে ইমাম হুসাইনের উদ্দেশ্যে শহীদ হয়ে যাওয়ার কথা শুনলেন তখন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে ।

ইমাম হুসাইনের প্রতি তাঁর এই ভালবাসাই তাঁকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়েছে , কেননা তিনি সন্তানদেরকে তাঁর নেতা ও দ্বীনের ইমামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন ।41

7- হযরত যয়নাব (আ.) আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি :

হযরত যয়নাবের মত এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কথা বলতে অক্ষম । কেননা তিনি হযরত ফাতিমার (আ.) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন , আর আলী (আ.)-এর মত পিতা ও ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইনের মত ভাই যার ছিল । তবে আমরা এখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ।

যে সমস্যা ও কষ্ট তার উপর এসেছিল তা যদি কোন পাহাড়ের উপর আসতো তবে পাহাড় ঐ সমস্যা ও কষ্টের ভারে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যেত । এই ধরনের এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্বকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ।

ক)- নিজের ইমাম বা নেতাকে সাহায্য করা :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাকে প্রাণপণে সাহায্য করেছিলেন । ইমাম হুসাইনকে তিনি এত অধিক ভালবাসতেন যে , যখন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জা ’ ফর তাইয়ার তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে , আমি একটি শর্তে এ বিয়েতে রাজী হব তা হচ্ছে আমার ভাই হুসাইন যখনই কোন সফরে যাবে আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে । যেহেতু আবদুল্লাহ্ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন ভক্ত ছিল তাই সে এ কথা মেনে নিল । হযরত যয়নাব (আ.) ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পরে , অসুস্থ ইমাম সাজ্জাদের সেবা-শুশ্রুষা করেন । আর যতবারই শত্রুপক্ষ ইমাম সাজ্জাদকে (আ.) হত্যা করতে এসেছিল ততবারই তিনি তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এবং শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে চাও তবে প্রথমে আমাকে হত্যা কর ।

সাধারণত যে পুরুষ ও নারীই বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে কথা বলেছে তারাই কষ্ট , লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হয়েছে । যেমন : হযরত মারিয়ামকে ঈসা (আ.)-এর জন্য ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় , হযরত আসিয়া হযরত মূসা (আ.)-কে সাহায্য করতে গিয়ে এবং তাঁর উপর ঈমান আনাতে ফিরাউনের অত্যাচারের শিকার হয়ে শহীদ হন ।

হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মূসা (আ.)-কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের মাতাদের কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছিল । রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত খাদিজাহ (আ.)কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন । ইমাম আলী (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কথা বলার কারণে হযরত ফাতিমাকে (আ.) দরজা ও দেয়ালের মধ্যে পিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে । তদ্রূপ ইমাম হুসাইন -কে সাহায্য করতে গিয়ে 55 বছর বয়সে হযরত যয়নাবকেও নিদারুণ কষ্টের শিকার হতে হয়েছে ।

খ)- শহীদদের সন্তানদেরকে দেখা-শুনা করা :

হযরত যয়নাব (আ.) কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে , অভিভাবকহীন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে দেখা-শুনা করতেন । তিনি নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন । যেহেতু বাচ্চারা তাদের পিতার জন্য কান্নাকাটি করতো , তাই তিনি তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় আদর করতেন এবং সান্ত্বনা দিতেন । আর এ দায়িত্বটি তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করেছিলেন ।

গ)- ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে , তিনি যেখানেই যেতেন এবং যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কারবালার শহীদদের বার্তা পৌঁছে দিতেন এবং জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতেন । যদি হযরত যয়নাব না থাকতেন তবে ইসলামের শত্রুরা কারবালার ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতো । তিনি নিজের চেষ্টায় কারবালার জালিম ও অত্যাচারীদের মুখোষ উম্মোচন করেন । আর এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ চূড়ান্তে পৌঁছায় । যদি তাঁর উৎসর্গতা ও সাহসিকতা না থাকতো তাহলে শত্রুরা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -কে হত্যা করতো এবং ইসলামের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত । প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুর বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন আর হযরত যয়নাব (আ.) ঐ কিয়ামের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ।

ঘ)- হযরত যয়নাবের সাহসিকতা :

ফাসেক , অভিশপ্ত , মদখোর ও লম্পট ইবনে যিয়াদ তার প্রাসাদে বসে ছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.) -এর কাটা মাথাটি তার সামনে রাখা ছিল । সে হযরত যয়নাবকে (আ.) বলল : তোমার ভাইয়ের সাথে আল্লাহ্ যা করলেন তা কেমন দেখলে ? তিনি জবাবে বললেন

ﻣﺎﺭﺍﻳﺖ ﺍﻻ جمیلا আমি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু দেখি নি ।42 কেননা নবীর বংশধর এমন এক পরিবার যাদের জন্য আল্লাহ শাহাদাতকে মর্যাদা স্বরূপ করেছেন । আর তাঁরা স্বেচ্ছায়ই এ পথকে বেছে নিয়েছেন ।

হযরত যয়নাব এই কথার মাধ্যমে ইবনে যিয়াদকে এমনভাবে অপমান করলেন যে , যাতে করে সে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ।

হযরত যয়নাব (আ.) শামে (সিরিযায়) ইয়াযিদের প্রাসাদে তাকে দারুণভাবে অপমান করলেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : তুমি মনে করছো যে , আমাদেরকে বন্দী করে তোমার সম্মান বেড়েছে , তা নয় তারপর বললেন : আমি তোমাকে অনেক নীচ ও হীন মনে করি ।43

তিনি এই কথাটি ইয়াযিদকে এমন এক সময় বললেন যখন তাঁর এবং অন্যান্য বন্দীদের নিহত হওয়ার আশংকা ছিল । এমন কথা একজন নারীর পক্ষে ইয়াযিদের মত জালিম , অত্যাচারী , মদখোর , লম্পট লোকের সামনে কথা বলা কোন সহজ ব্যাপার নয় । হযরত যায়নাব তাকে এত বড় কথা বলার অর্থ এই যে , তিনি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই ।

ঙ)- হযরত যয়নাবের ইবাদত :

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনায় তার 6 জন ভাই যথা : ইমাম হুসাইন (আ.) , আব্বাস , জা ’ ফার , উসমান , আবদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ শহীদ হয়ে যাওয়া ছাড়াও তার দুই সন্তন আউন ও মুহাম্মদ এবং তার ভাইয়ের সন্তানগণ যথা : আলী আকবার , কাসিম , আবদুল্লাহ সহ চাচাত ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । আর এদিকে ছোট ছোট শিশুরা উমর ইবনে সা ’ দ ও তার মত অপবিত্র লোকদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং যে কোন সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শহীদ হওয়ার আশংকা ছিল এরূপ কঠিন মুসিবতের সময়ও অর্থাৎ মুহররমের 10 তারিখের দিবাগত রাতেও তিনি তাহাজ্জুতের নামায আদায় করেন ।

ইসলাম পূর্ব নারীগণ

ইসলামের ইতিহাসে ঈমানদার , সাহসী , জুলুম বিরোধী অনেক নারী ছিলেন , যাদের সম্পূর্ণ জীবনটাই ছিল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত এবং আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের চেতনাপূর্ণ তাদের সংখ্যা অনেক কিন্তু আমরা এখানে এরূপ কয়েকজনের কথা উল্লেখ করব :

1- হাযবিল নাজ্জারের (কাঠ মিস্ত্রি) স্ত্রী : এই মহিলার ঘটনাটি হচ্ছে হযরত মুসা (আ.) এর সময়কার । সে হযরত মুসা (আ.)-এর উপর ঈমান আনয়ন করে । ঘটনা বশত: সে ফেরাউনের প্রাসাদে তার কন্যার পরিচর্যার কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হয় । একদিন ফিরআউনের কন্যার চুল চিরুণী দিয়ে আচড়ে দেয়ার সময় তার হাত থেকে চিরুনিটি পড়ে যায় , যেহেতু সে সব সময় আল্লাহর যিকির করতো তাই চিরুনিটি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সে বলে উঠল : ইয়া আল্লাহ্! ফেরাউনের কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করলো যে , তোমার ইয়া আল্লাহ বলার উদ্দেশ্য কি আমার বাবা ?

সে বলল : না , বরং আমি এমন কাউকে উপাসনা করি যিনি তোমার বাবাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে আবার ধ্বংসও করবেন ।

মেয়ে তার বাবাকে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করলে ফেরাউন তাকে ডেকে পাঠালো । সে উপস্থিত হলে তাকে বলল : আমি যে খোদা এটা তুমি বিশ্বাস কর না ?

সে বলল : না , কখনই নয়! আমি প্রকৃত আল্লাহকে ছেড়ে তোমার উপাসনা করবো না ।

ফেরাউন এই কথায় অত্যন্ত রাগান্বিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল আগুনের চুল্লী তৈরী করার এবং তা লাল রং ধারণ করলে ঐ মহিলার সব সন্তানকে আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলে দিতে । মহিলার সব সন্তানকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল । শুধুমাত্র একটি দুধের শিশু তার কোলে অবশিষ্ট ছিল । জল্লাদ তার কোল থেকে ঐ দুধের শিশুটিকেও ছিনিয়ে নিয়ে বলল : তুই যদি মুসার দ্বীনকে অনুসরণ না করিস তাহলে তোর বাচ্চাকে বাচিয়ে রাখবো । দুধের শিশুটির অন্তর ধক-ধক করতে শুরু করলো । মহিলাটি বাহ্যিকভাবে এ কথা স্বীকার করে বলতে চাইল যে , ঠিক আছে কিন্তু হঠাৎ দুধের শিশুটি কথা বলে উঠলো । সে তার মাকে বলল : ধৈর্য ধারণ কর , তুমি সত্যের পথে আছো ।

মহিলাটি তাই করল । অবশেষে ঐ দুধের বাচ্চাটিকেও পুড়িয়ে মারা হল । তারপর তাকেও তারা পুড়িয়ে মারলো । এভাবেই এক সাহসী ও মু মিন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিল বাতিলের কাছে মাথা নত করেনি , বরং বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে ।

নবী (সা.) বলেন : মি ’ রাজের রাতে একটি স্থান থেকে আকর্ষণীয় এক সুগন্ধ আমার নাকে আসছিল , আমি জিব্রাঈলকে (আ.) জিজ্ঞাসা করলাম যে , এই সুবাস কোথা থেকে আসছে ? জিব্রাঈল আমাকে উত্তরে বলল : এই গন্ধ হাযবিলের স্ত্রী ও তার সন্তানদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দেহের থেকে আসছে , যা এই পৃথিবীর সমান্তরাল মহাশূন্যে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে । আর ঐ স্থান থেকে এই সুগন্ধ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত আসতে থাকবে ।34

2- হযরত ইব্রাহীম খালিলুল্লাহ্ (আ.)-এর মা :

এই ঘটনাটি অনেকটা উপরোল্লিখিত ঘটনার মতই । নমরুদ তার অধীনস্থ জ্যোতিষীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে , একটি শিশু জন্মলাভ করে তাকে ধ্বংস করবে । এ কারণে সে (বর্ণনামতে) 77 হাজার থেকে এক লক্ষ শিশুকে হত্যা করে । এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে ইব্রাহীমের (আ.) আত্মত্যাগী মা বিরলভাবে নিজেকে নমরুদের লোক-লস্কর থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন । তিনি প্রসব বেদনা শুরু হলে ঋতুস্রাবের বাহানায় (কারণ তখন নিয়ম ছিল যে , কোন মহিলার ঋতুস্রাব হলে তাকে শহরের বাইরে চলে যেতে হত) শহর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শহর থেকে অনেক দুরে একটি পাহাড়ের গুহা খুঁজে পেলেন । সেখানেই ইব্রাহীম (আ.) ভুমিষ্ট হন । ক্লান্তিহীন পরিশ্রমী এই মা 13 বছর ধরে নমরুদের লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে , কখনো রাতে আবার কখনো প্রত্যুষে সকালে পাহাড়ের ঐ গুহার মধ্যে যেতেন তার সন্তানের সাথে দেখা করতে । এ সময় তিনি গায়েবীভাবেও সাহায্যপ্রাপ্ত হতেন । যেহেতু তিনি আল্লাহর উপর নির্ভর করেছিলেন সেহেতু আল্লাহও তাকে সাহায্য করেছেন । অবশেষে 13 বছর পরে ইব্রাহীম (আ.) খোদায়ী বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হয়ে সমাজে ফিরে এলেন এবং আস্তে আস্তে মূর্তিপুজকদের সাথে মুকাবিলা করতে শুরু করলেন । আর দিনের পর দিন তিনি সফলকাম হতে থাকলেন ।35

3- হযরত আইয়্যুবের স্ত্রী :

রুহামাহ (রাহিমাহ্) ছিলেন হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী এবং হযরত শোয়াইবের কন্যা । তিনি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন । তার সকল সন্তান বাড়ীর ছাদের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় , বাগ-বাগিচা আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় , সমস্ত সম্পত্তি এবং গৃহপালিত প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায় । এত কিছুর পরে হযরত আইয়্যূব এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন । এমন পরিস্থিতিতে সবাই তাকে সান্তনা দেয়ার বদলে অপমান করলো এই বলে যে , নিঃশ্চয়ই তোমরা গোনাহ্গার ছিলে তাই আল্লাহ তোমাদেরকে এরূপ সাজা দিয়েছেন । সকলেই হযরত আইয়্যূবের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল । আর সে কারণেই তিনি শহর ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন । অতপর আল্লাহ্ তাদেরকে উত্তম সন্তান দান করেন এবং অবস্থা পুর্বের পর্যায়ে ফিরে যায় ।36

হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী আমাদেরকে যে শিক্ষা দেন তা হচ্ছে নিম্নরূপ :

প্রথমত : আল্লাহর নবিগণও বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে পারেন ।

দ্বিতীয়ত : মু ’ মিনদের চেষ্টা করা উচিৎ এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈয ধরে সফলতার সাথে তা থেকে বেরিয়ে আসার ।

তৃতীয়ত : উত্তম স্ত্রী সেই যে , কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তার স্বামীকে একা ত্যাগ করে না । আর হযরত আইয়্যূবের স্ত্রী ছিলেন তেমনই এক নারী । কারণ তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তার স্বামীকে কোন প্রকার দোষারোপ করেন নি বরং সকল সময় তার পাশে পাশে থেকেছেন এবং এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করেছেন । যদিও পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে হালাল রুটি- রুজীর জন্য কষ্ট করা এবং পরিবারে স্বাচ্ছন্দ আনয়ন করা ।

ইসলাম পূর্ব ইতিহাসে আরো অনেক নারীই ছিলেন যেমন : হযরত শোয়াইবের কন্যাগণ , হযরত মুসা (আ.)-এর মা ও বোন , হযরত মারিয়াম (আ.) , আসিয়া , হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মা হাজার , নবী (সা.) -এর মা আমেনা , নবী (সা.) -এর দুধ মাতা হালিমা ও আরো অনেকে যাদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি ।

ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের নারীগণ

1- হযরত খাদিজা (আ.) : হযরত খাদিজাহ্ (আ.) প্রথম পর্যায়ে খৃষ্টান ছিলেন । যেহেতু তিনি খৃষ্টানদের বিভিন্ন গ্রন্থে নবী পাক (সা.) সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং অতি নিকট থেকে ঐ মহামানবকে দেখেছিলেন । তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । এই মহান নারী আল্লাহ তা ’ য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সমস্ত সম্পত্তি নবীর (সা.) হাতে সমর্পন করেছিলেন । নবী (সা.) ঐ বিশাল সম্পদকে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে খরচ করেন । হযরত খাদিজাহ্ এ সম্পর্কে বলেন : আমার সম্পত্তি থেকে শুধূমাত্র দু ’ টি ভেড়ার চামড়া অবশিষ্ট ছিল , দিনের বেলা তার উপর ভেড়ার খাবার দিতাম এবং রাতে তা বিছিয়ে শুতাম ।

তিনি শুধুমাত্র তার সম্পদকেই দ্বীনের রাস্তায় দান করেননি বরং নবীকে (সা.) জীবন দিয়েও সাহায্য করেছিলেন । তিনি রাসূলের (সা.) শত দুঃখের সাথি ও সান্ত্বনাদানকারী ছিলেন । তিনি হচ্ছেন ইতিহাসের চারজন শ্রেষ্ঠ রমনীর একজন (যারা বেহেশ্তী নারী হিসেবে পরিচিত) । রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনই হযরত খাদিজার ভালবাসা ও ত্যাগের কথা ভুলেন নি । আর যখনই তার কথা স্মরণ করতেন তখনই তার উপর দুরুদ পড়তেন ।

2 - প্রথম শহীদ নারী সুমাইয়্যা : সুমাইয়্যা , ইয়াসিরের স্ত্রী ছিলেন । তিনি এবং তার স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বলে তাদেরকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল এবং শত্রুপক্ষ তাদেরকে শহীদ করেছিল । তারা সুমাইয়্যাকে বলেছিল : যদি তুমি নবীর (সা.) উপর ঈমান আনা থেকে বিরত না হও তবে তোমার দুই পায়ে দড়ি বেঁধে দুই উটের সাথে বেধে দিব এবং উট দু ’ টিকে দুই দিকে তাড়িয়ে দিব , ফলে তোমার শরীর দু ’ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে ।

সুমাইয়্যা তাদের কথায় ভয় না পাওয়ায় তারা তাদের উক্ত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করলো । তারা শুধু তাকেই নয় বরং তার স্বামীকেও হত্যা করলো । আম্মার ইয়াসির এই দুই মহান ব্যক্তির সন্তান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলামের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । অবশেষে তিনিও সিফ্ফিনের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর সৈন্য দলের পক্ষ হয়ে মুয়া ’ বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন ।37

3 - অন্যান্য নারীগণ : অন্যান্য মহিলাগণ যেমন , লুবাইনিহ্ , যিন্নিরিহ্ , নাহদিয়াহ্ , গাযযিয়াহ্ ও এরূপ আরো অনেকে যাদের নাম ইতিহাসে উল্লেখও হয় নি , ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার ফলে শত্রুর অত্যাচারে শহীদ হন ।38

4- ফাতিমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী (আ.)-এর মা) : ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য এই মর্যাদাই যথেষ্ট যে , তিনি পবিত্র কা ’ বা গৃহের মধ্যে আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.) -এর মত সন্তানকে জন্মদান করেছেন । কোন মহিলাই এ মর্যাদা পায় নি এবং পাবেও না ।

যখনই নবী (সা.) ক্লান্ত থাকতেন ফাতিমা বিনতে আসাদের বাড়ীতে আসতেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

যখন তিনি এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন তখন নবী (সা.) কাঁদতে কাঁদতে মৃত দেহের পাশে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন : আল্লাহ্ তাঁকে বেহেশ্তবাসী করুন , তিনি শুধু আলীর মাতাই ছিলেন না বরং আমারও মা (সা.) ছিলেন । রাসূলে খোদা নিজের মাথার পাগড়ি ও আলখেল্লা খুলে দিয়েছিলেন তার কাফন করার জন্য । তার জানাজার নামাযে চল্লিশটি তাকবির বলেছিলেন । তারপর তিনি তার কবরে নেমে কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেন এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসানকে (আ.) অনুরূপ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন ।

আম্মার নবীকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন : কারো জন্যেই তো আপনি এরূপ করেন নি , ফাতিমা বিনতে আসাদের জন্য কেন এরূপ করলেন ?!

রাসূল (সা.) বললেন : তার জন্য এমনটা করাই উত্তম ছিল । কেননা তিনি নিজের সন্তানকে পেট ভরে খেতে না দিয়ে আমার পেট ভরাতেন । তার সন্তানদেরকে খালি পায়ে রাখতেন কিন্তু আমার পায়ে জুতা পরিয়ে দিতেন ।

আম্মার পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : কেন তার নামাযে চল্লিশবার তাকবির দিলেন ?

তিনি বললেন : তার জানাজার নামাযে ফেরেশতাগণ চল্লিশ কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিল তাই তাদের প্রত্যেকটি সারির জন্য একটি করে তাকবির বলেছি ।

আর এই যে , আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়েছি তাঁকে কাফন করার জন্য এটার কারণ এই যে , একদিন তাঁর সাথে আমি কিয়ামতের দিনে মানুষের বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে কথা বলছিলাম , তিনি এ কথা শুনে চিৎকার করে উঠেছিলেন এবং কিয়ামাতের দিনে বস্ত্রহীন থাকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন । তাই আমার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আলখেল্লা দিয়ে তাকে কাফন করিয়েছি , যাতে করে কিয়ামতের দিনে তিনি বস্ত্রহীন না থাকেন আর তা যেন পচে না যায় । যেহেতু তিনি কবরের প্রশ্নের ব্যাপারে অনেক ভয় পেতেন তাই আমি তাকে কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ তার মধ্যে অবস্থান করেছি । আর এই অবস্থানের ফলে আল্লাহ তার কবরকে বেহেশ্তের একটি অংশে পরিণত করছেন এবং তার কবর এখন বেহেশতের বাগানে পরিণত হয়েছে ।39

5 - চার শহীদের জননী , খানিসা : তিনি একজন অভিজ্ঞ ইসলাম প্রচারক ছিলেন । তিনি তার গোত্রের সকলকে ইসলামের পথে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যদেরকেও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতেন । 14 হিজরীতে সংঘটিত কাদিসিয়া যুদ্ধে তিনি তার সন্তানদেরকে ঐ যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন । তার সন্তানদের মধ্যে চারজন শহীদ হয় । তিনি তার সন্তানদের শহীদ হওয়াতে বলেন : আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া , কেননা তিনি তাদের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে আমাকে সম্মানিত করেছেন । আরো বলেন : আমার আশা এটাই যে , আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাকেও তাঁর রহমত ও কৃপা দান করে ধন্য করবেন (অর্থাৎ তাকে শহীদ হওয়ার তৌফিক দান করবেন) ।40

6 - চার শহীদের জননী , উম্মুল বানিন : উম্মুল বানিন ছিলেন ইমাম আলী (আ.)-এর একজন আল্লাহ্ প্রেমিক স্ত্রী । তিনি তার চারজন সন্তান যথাক্রমে : হযরত আব্বাস , আব্দুল্লাহ্ , জা ’ ফার ও উসমান , কারবালায় তাদের ভাই ও নেতা ইমাম হুসাইনের সাথে শাহাদাত বরণ করেন ।

যখন বাশির মদীনায় ফিরে এসে কারবালার ঘটনাকে মসজিদে নববীতে বর্ণনা করছিল তখন উম্মুল বানিন উপস্থিতদের মধ্যে থেকে সামনে (আ.) এসে বললেন : হে বাশির! আমাকে শুধু ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বল । আর আমার চার সন্তান খোলা আকাশের নিচে ঘোড়ার পায়ের তলে পিষ্ট হয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না , কেননা আমি তাদেরকে ইমাম হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করেছি । যখন তিনি বাশিরের মুখে ইমাম হুসাইনের উদ্দেশ্যে শহীদ হয়ে যাওয়ার কথা শুনলেন তখন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আমার অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে ।

ইমাম হুসাইনের প্রতি তাঁর এই ভালবাসাই তাঁকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়েছে , কেননা তিনি সন্তানদেরকে তাঁর নেতা ও দ্বীনের ইমামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন ।41

7- হযরত যয়নাব (আ.) আত্মত্যাগ,ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি :

হযরত যয়নাবের মত এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমরা কথা বলতে অক্ষম । কেননা তিনি হযরত ফাতিমার (আ.) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন , আর আলী (আ.)-এর মত পিতা ও ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইনের মত ভাই যার ছিল । তবে আমরা এখানে আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব তাই উল্লেখ করার চেষ্টা করবো ।

যে সমস্যা ও কষ্ট তার উপর এসেছিল তা যদি কোন পাহাড়ের উপর আসতো তবে পাহাড় ঐ সমস্যা ও কষ্টের ভারে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যেত । এই ধরনের এক মহিয়সী নারীর ব্যক্তিত্বকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ।

ক)- নিজের ইমাম বা নেতাকে সাহায্য করা :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি তাকে প্রাণপণে সাহায্য করেছিলেন । ইমাম হুসাইনকে তিনি এত অধিক ভালবাসতেন যে , যখন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জা ’ ফর তাইয়ার তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে , আমি একটি শর্তে এ বিয়েতে রাজী হব তা হচ্ছে আমার ভাই হুসাইন যখনই কোন সফরে যাবে আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে । যেহেতু আবদুল্লাহ্ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন ভক্ত ছিল তাই সে এ কথা মেনে নিল । হযরত যয়নাব (আ.) ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পরে , অসুস্থ ইমাম সাজ্জাদের সেবা-শুশ্রুষা করেন । আর যতবারই শত্রুপক্ষ ইমাম সাজ্জাদকে (আ.) হত্যা করতে এসেছিল ততবারই তিনি তাঁকে আগলে রেখেছিলেন এবং শত্রুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে চাও তবে প্রথমে আমাকে হত্যা কর ।

সাধারণত যে পুরুষ ও নারীই বেলায়াত ও ইমামতের পক্ষে কথা বলেছে তারাই কষ্ট , লাঞ্ছনা ও অপবাদের শিকার হয়েছে । যেমন : হযরত মারিয়ামকে ঈসা (আ.)-এর জন্য ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় , হযরত আসিয়া হযরত মূসা (আ.)-কে সাহায্য করতে গিয়ে এবং তাঁর উপর ঈমান আনাতে ফিরাউনের অত্যাচারের শিকার হয়ে শহীদ হন ।

হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মূসা (আ.)-কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের মাতাদের কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছিল । রাসূল (সা.) কে সাহায্য করতে গিয়ে হযরত খাদিজাহ (আ.)কতই না কষ্ট পেয়েছিলেন । ইমাম আলী (আ.)-এর ইমামতের পক্ষে কথা বলার কারণে হযরত ফাতিমাকে (আ.) দরজা ও দেয়ালের মধ্যে পিষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে । তদ্রূপ ইমাম হুসাইন -কে সাহায্য করতে গিয়ে 55 বছর বয়সে হযরত যয়নাবকেও নিদারুণ কষ্টের শিকার হতে হয়েছে ।

খ)- শহীদদের সন্তানদেরকে দেখা-শুনা করা :

হযরত যয়নাব (আ.) কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পরে , অভিভাবকহীন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে দেখা-শুনা করতেন । তিনি নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন । যেহেতু বাচ্চারা তাদের পিতার জন্য কান্নাকাটি করতো , তাই তিনি তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় আদর করতেন এবং সান্ত্বনা দিতেন । আর এ দায়িত্বটি তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করেছিলেন ।

গ)- ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর :

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে , তিনি যেখানেই যেতেন এবং যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কারবালার শহীদদের বার্তা পৌঁছে দিতেন এবং জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতেন । যদি হযরত যয়নাব না থাকতেন তবে ইসলামের শত্রুরা কারবালার ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতো । তিনি নিজের চেষ্টায় কারবালার জালিম ও অত্যাচারীদের মুখোষ উম্মোচন করেন । আর এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ চূড়ান্তে পৌঁছায় । যদি তাঁর উৎসর্গতা ও সাহসিকতা না থাকতো তাহলে শত্রুরা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -কে হত্যা করতো এবং ইসলামের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিত । প্রকৃতপক্ষে ইমাম হুসাইন (আ.) শত্রুর বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন আর হযরত যয়নাব (আ.) ঐ কিয়ামের ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন ।

ঘ)- হযরত যয়নাবের সাহসিকতা :

ফাসেক , অভিশপ্ত , মদখোর ও লম্পট ইবনে যিয়াদ তার প্রাসাদে বসে ছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.) -এর কাটা মাথাটি তার সামনে রাখা ছিল । সে হযরত যয়নাবকে (আ.) বলল : তোমার ভাইয়ের সাথে আল্লাহ্ যা করলেন তা কেমন দেখলে ? তিনি জবাবে বললেন

ﻣﺎﺭﺍﻳﺖ ﺍﻻ جمیلا আমি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু দেখি নি ।42 কেননা নবীর বংশধর এমন এক পরিবার যাদের জন্য আল্লাহ শাহাদাতকে মর্যাদা স্বরূপ করেছেন । আর তাঁরা স্বেচ্ছায়ই এ পথকে বেছে নিয়েছেন ।

হযরত যয়নাব এই কথার মাধ্যমে ইবনে যিয়াদকে এমনভাবে অপমান করলেন যে , যাতে করে সে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় ।

হযরত যয়নাব (আ.) শামে (সিরিযায়) ইয়াযিদের প্রাসাদে তাকে দারুণভাবে অপমান করলেন । তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন : তুমি মনে করছো যে , আমাদেরকে বন্দী করে তোমার সম্মান বেড়েছে , তা নয় তারপর বললেন : আমি তোমাকে অনেক নীচ ও হীন মনে করি ।43

তিনি এই কথাটি ইয়াযিদকে এমন এক সময় বললেন যখন তাঁর এবং অন্যান্য বন্দীদের নিহত হওয়ার আশংকা ছিল । এমন কথা একজন নারীর পক্ষে ইয়াযিদের মত জালিম , অত্যাচারী , মদখোর , লম্পট লোকের সামনে কথা বলা কোন সহজ ব্যাপার নয় । হযরত যায়নাব তাকে এত বড় কথা বলার অর্থ এই যে , তিনি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই ।

ঙ)- হযরত যয়নাবের ইবাদত :

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনায় তার 6 জন ভাই যথা : ইমাম হুসাইন (আ.) , আব্বাস , জা ’ ফার , উসমান , আবদুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ শহীদ হয়ে যাওয়া ছাড়াও তার দুই সন্তন আউন ও মুহাম্মদ এবং তার ভাইয়ের সন্তানগণ যথা : আলী আকবার , কাসিম , আবদুল্লাহ সহ চাচাত ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন । আর এদিকে ছোট ছোট শিশুরা উমর ইবনে সা ’ দ ও তার মত অপবিত্র লোকদের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং যে কোন সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শহীদ হওয়ার আশংকা ছিল এরূপ কঠিন মুসিবতের সময়ও অর্থাৎ মুহররমের 10 তারিখের দিবাগত রাতেও তিনি তাহাজ্জুতের নামায আদায় করেন ।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18