কোরআনের আয়াত্ মানসূখ্ হওয়া সম্ভব কি ?
আমরা আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে , ওলামায়ে ইসলামের বিরাট অংশ মনে করেন যে , কোরআন মজীদের আয়াত্ (অর্থাৎ আয়াতের তেলাওয়াত্ বা হুকুম বা উভয়ই) মানসূখ্ হওয়া সম্ভব। তাঁরা এ মতের সপক্ষে যে দলীল উপস্থাপন করেন তা হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লিখিত আয়াত্ :
)
م
َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(
“
আমি অধিকতর উত্তম বা অনুরূপ কিছু পেশ না করে কোনো আয়াতকে রহিত করি না বা ভুলিয়ে দেই না।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ :
106)
কিন্তু আমাদের মত হচ্ছে এই যে , এ আয়াতে পূর্ববর্তী কিতাব্ সমূহ মানসূখ্ হওয়া প্রসঙ্গে আহলে কিতাবের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে ; এতে কোরআন মজীদের কোনো আয়াত্ মানসূখ্ হবার কথা বলা হয় নি। এর পূর্ববর্তী আয়াত্ ও পরবর্তী কয়েক আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়লেই তা সুস্পষ্ট ধরা পড়বে। এরশাদ হয়েছে :
“
আহলে কিতাবের মধ্যকার যারা কাফের হয়ে গিয়েছে তারা ও মোশরেকরা পসন্দ করে না যে , তোমাদের ওপরে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কোনো কল্যাণ নাযিল্ হোক। আর আল্লাহ্ তো যাকে ইচ্ছা করেন স্বীয় রহমত প্রদান করেন। আর আল্লাহ্ অনুগ্রহের অধিকারী ও পরম সুমহান। বস্তুতঃ আমি অধিকতর উত্তম বা অনুরূপ কিছু পেশ না করে কোনো আয়াত্ রহিত করি না বা ভুলিয়ে দিই না। তুমি কি জানো না আল্লাহ্ সব কিছুরই ওপর ক্ষমতাবান ? তুমি কি জানো না আসমান সমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই ? আর আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের জন্য কোনো অভিভাবক বা অপরাজেয় শক্তি নেই। তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সে ধরনের প্রশ্ন করতে চাও ইতিপূর্বে যেভাবে মূসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো ? আর যে ঈমানের বিনিময়ে কুফরী গ্রহণ করে সে তো গোমরাহীর পথে নিকৃষ্টতম পর্যায়ে উপনীত হলো। আহলে কিতাবের নিকট সত্য সমুদ্ভাসিত থাকার পরেও তাদের অনেকেই হিংসাবশতঃ কামনা করে যে , তোমাদের ঈমান আনার পরেও যদি তোমাদেরকে কুফরীতে ফিরিয়ে নিতে পারত! অতএব , আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গৃহীত হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে ক্ষমা করো ও তাদের সাথে বিবাদ এড়িয়ে চলো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 105-109)
এ আয়াত্ সমূহ থেকে সুস্পষ্ট যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা এখানে আহলে কিতাবের পক্ষ হতে মু’
মিনদেরকে ইসলাম থেকে কুফরীতে ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। এই অপচেষ্টার প্রক্রিয়া কী ছিলো ? এখানে সুস্পষ্ট যে , তারা অপযুক্তির আশ্রয় নিয়ে কোরআনের ওপর মুসলমানদের ঈমানে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করতো। তাদের অন্যতম অপযুক্তি ছিলো এই যে , কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সত্যতা স্বীকার করেছে , অন্যদিকে সে সব কিতাবের পঠন-পাঠন ও ব্যবহার-অনুসরণ রহিত করে দিয়েছে ; এটা কি সম্ভব যে , আল্লাহর কিতাব্ আল্লাহ্ তা‘
আলারই নাযিলকৃত অন্য কিতাবকে রহিত করে দেবে ? পূর্ববর্তী নবীদের সময় তো এমনটি হয় নি। অতএব , এই ব্যক্তি [হযরত মুহাম্মদ (ছ্বাঃ)] আল্লাহর নবী হতে পারেন না এবং এই কিতাব্ (কোরআন মজীদ) আল্লাহর কিতাব্ হতে পারে না।
এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে তাদের সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার জন্য পূর্ববর্তী কিতাব্ সমূহ রহিত করার যৌক্তিকতা বর্ণনা করা প্রয়োজন ছিলো। অন্যথায় আগে ও পরে আহলে কিতাবের হিংসা ও অপচেষ্টার কথা বলতে গিয়ে মাঝখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোরআনের এক আয়াত্ দ্বারা অন্য আয়াত্ মানসূখ্ করার কথা উল্লেখ করা হলে তা নেহায়েতই বেখাপ্পা ঠেকতো যা কোরআন মজীদ সম্পর্কে চিন্তা করা যায় না।
এখানে ধারণা হতে পারে যে , আহলে কিতাব্ হয়তো কোরআন মজীদের এক আয়াত্ দ্বারা অন্য আয়াত্ রহিতকরণকেই যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো এবং কোরআন মজীদ তাদের সে যুক্তি খণ্ডন করেছে।
এ ধারণা এ কারণে ঠিক নয় যে , কোরআন মজীদ যেখানে পূর্ববর্তী সকল কিতাবকেই মানসূখ্ করে দিয়েছে সেখানে তারা সে বিষয় নিয়ে বিতর্ক না করে কোরআনের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিতর্ক করবে ; এটা অস্বাভাবিক।
দ্বিতীয়তঃ সত্যি সত্যিই যদি কোরআনের কোনো আয়াত্ মানসূখ্ হতো তাহলে তা আহলে কিতাবের বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টার জন্য সহায়ক হতো। কারণ , মানবিক বিচারবুদ্ধি শত শত বছর পূর্বে মানবসভ্যতার প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ে নাযিল্ হওয়া এবং পরে মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাওয়া বিকৃত গ্রন্থ রহিতকরণের যৌক্তিকতা যতো সহজে মেনে নিতে পারে , স্বল্প সময় পূর্বে নাযিলকৃত অবিকৃত আয়াত্ বা তার হুকুম রহিত হওয়ার যৌক্তিকতা ততো সহজে মেনে নিতে পারে না। এরূপ হলে আহলে কিতাবের লোকেরা বলতে পারতো যে , এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে যে কিতাবের হুকুমের দুর্বলতা বা ভুল ধরা পড়লো এবং তা রহিত করে নতুন হুকুম জারী করতে হলো , তা কি করে আল্লাহর কালাম হয় ? এ ক্ষেত্রে 'অধিকতর উত্তম বা অনুরূপ আয়াত্ ' নাযিলের যুক্তি যথেষ্ট হতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে বলা যেতো : মাত্র কয়েক মাস বা কয়েক বছরের ব্যবধানে পরিবর্তন না করে প্রথমেই চূড়ান্ত হুকুম নাযিল্ করলে ক্ষতি কী ছিলো ?
নিঃসন্দেহে কোরআন মজীদের আয়াত্ বা তার হুকুম মানসূখ্ হলে আহলে কিতাবের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি সহজ হতো। যারা কোরআন মজীদের এক আয়াত্ দ্বারা আরেক আয়াতের হুকুম মানসূখ্ হতে পারে বলে মনে করেন (বস্তুতঃ দু’
একটি বাদে সবগুলো দৃষ্টান্তই এ পর্যায়ের) তাঁরা দু’
টি আয়াতের হুকুমকে পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে করেই এ ধারণায় উপনীত হয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে তাঁরা সংশ্লিষ্ট দুই আয়াতের পারস্পরিক সম্পর্ক সঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণেই এ ধরনের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। নচেৎ কোরআন মজীদে কোনো স্ববিরোধিতা নেই , না তথ্যমূলক আয়াতে , না নির্দেশমূলক আয়াতে।
আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন :
“
তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না ?
তা (কোরআন) যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে এসে থাকতো (বা অন্য কারো রচিত হতো) তাহলে তাতে অনেক অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হতো।”
(সূরাহ্ আন্-নিসা’
: 82)
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগে কোরআন-বিরোধীরা কোরআনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করলেও স্ববিরোধিতা বা অসামঞ্জস্যের দাবী উপস্থাপন করে নি। ওলামায়ে ইসলামের একাংশ কোরআন মজীদের যে সব আয়াতের হুকুমকে পরস্পরবিরোধী বা অসামঞ্জস্যশীল মনে করে নাসেখ্-মানসূখের কথা বলেছেন সে সব আয়াতকে যদি নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় পরস্পরবিরোধী বা অসামঞ্জস্যশীল মনে করা হতো তাহলে এ নিয়ে ইসলামের দুশমনরা দারুণ হৈচৈ সৃষ্টি করতো এবং তা ইতিহাসে , সীরাতে ও হাদীছে লিপিবদ্ধ থাকতো। এমনকি সে ক্ষেত্রে নাসেখ্-মানসূখের ব্যাখ্যা ইসলাম-বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে পারতো না।
তাছাড়া নাসেখ্-মানসূখের উল্লেখ সম্বলিত আয়াতে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)‘
আয়াত্’
মানসূখ্ করার কথা বলা হয়েছে , আয়াত্ বহাল রেখে তার হুকুম মানসূখ্ করার কথা বলা হয় নি। এমতাবস্থায় কোরআন মজীদের যে সব আয়াতের হুকুমকে পরস্পরবিরোধী মনে করা হচ্ছে এ আয়াতের দ্বারা তার ব্যাখ্যা করা বা দু’
টি কথিত পরস্পরবিরোধী আয়াতের একটির হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় কথিত পরস্পরবিরোধী আয়াতের উভয়টিরই পাঠ বহাল রাখা আল্লাহ্ তা‘
আলার হিকমত (পরম প্রজ্ঞা) ও ঘোষণার (সূরাহ্ আন্-নিসা’
: 82) পরিপন্থী হতো। অতএব , নিঃসন্দেহে এসব আয়াতে পরস্পরবিরোধিতা নেই এবং নাসেখ্-মানসূখের কোনো ব্যাপার নেই।
কোরআন মজীদে নাসেখ্-মানসূখের প্রবক্তাগণের দাবী হচ্ছে এই যে , মানসূখ্ হুকুমগুলো সাময়িক প্রয়োজনে নাযিল্ হয়েছিলো , তাই পরে স্থায়ী হুকুম নাযিল্ করে তা মানসূখ্ করা হয়। এই সাময়িক প্রয়োজনের যুক্তি সঠিক হলে সে ক্ষেত্রে খোদায়ী হিকমতের দাবী অনুযায়ী ঐসব হুকুম কোরআন মজীদের আয়াতরূপে নাযিল্ না হয়ে ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাতলূ রূপে নযিল হয়ে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে জারী হতে পারতো এবং সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হুকুমের গুরুত্ব মোটেই হ্রাস পেতো না। কারণ , নামায আদায়ের নিয়মাবলী সহ এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমনকি ক্বিবলাহর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও প্রথমে ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাতলূ-র মাধ্যমে বায়তুল্ মাক্বদেসকে সাময়িকভাবে ক্বিবলাহ্ নির্ধারণ করা হয় এবং পরে কোরআন মজীদের আয়াত নাযিলের মাধ্যমে কা‘
বাহকে স্থায়ীভাবে ক্বিবলাহ্ নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
এছাড়া আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেছেন :
)
و
َمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا(
“
রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং যা কিছু থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।”
(সূরাহ্ আল্-হাশর্ :
7)
এ আয়াত্ শুধু পার্থিব সম্পদ প্রসঙ্গেই প্রযোজ্য নয় , নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর যে কোনো আদেশ-নিষেধই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া আল্লাহ্ তা‘
আলা যে নবী করীম (ছ্বাঃ)-কে বহু শর‘
ঈ বিধান প্রণয়নের এখতিয়ার দেন অর্থাৎ ওয়াহীয়ে গ্বায়রে মাতলূ-র সাহায্যে তাঁর মাধ্যমে বহু বিধান পেশ করেন , অন্য আয়াতে তার প্রমাণ আছে। আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন :
)
و
َيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ(
“
আর তিনি (রাসূল) তাদের জন্য পবিত্র জিনিসগুলোকে হালাল করে দেন এবং নোংরা-অপবিত্র জিনিসগুলোকে তাদের জন্য হারাম করে দেন।”
(সূরাহ্ আল্-আ 'রাফ :
157)
অতএব , কথিত সাময়িক বিধানগুলো কোরআনের আয়াত্ ছাড়াই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে জারী হতে কোনো বাধা ছিলো না। বরং এটাই উত্তম হতো। অথবা সংশ্লিষ্ট আয়াতের হুকুমটাই এমনভাবে বর্ণিত হতো যাতে প্রমাণিত হতো যে , তা সাময়িক। অথবা হুকুম বাতিলের সাথে সাথে আয়াতটিও তুলে নেয়াই হতো অধিকতর উত্তম। সবচেয়ে ভালো হতো আয়াতটি সংশ্লিষ্ট সকলের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যে হুকুম সাময়িক তার ক্ষেত্রে নাসখ্ কথাটি আদৌ প্রযোজ্য নয়। কারণ সংশ্লিষ্ট হুকুমের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নিজ থেকেই তার কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায়। অতঃপর তার হুকুম রহিত করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সংশ্লিষ্ট হুকুম যে সাময়িক সে ব্যাপারে অবশ্যই সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকতে হবে।
বস্তুতঃ নাসখ্ কেবল এমন হুকুমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে যাতে স্থায়ী হুকুমের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান এবং সাময়িক হবার কোনো নিদর্শন দৃশ্যমান নয়। যেমন : পূর্ববর্তী শরী‘
আত্ সমূহে বর্ণিত‘
ইবাদতের প্রক্রিয়া , ক্বিবলাহ ও আরো কতক বিষয় সংক্রান্ত বিধান। কোরআন মজীদের কোনো বিধানের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘
আলার কিতাবের সর্বশেষ ও পূর্ণতম সংস্করণ - যাতে সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ শরী‘
আহ অন্তর্ভুক্ত। অতএব , তাতে কোনো বিধান দৃশ্যতঃ স্থায়ী বিধানরূপে নাযিল্ হবার পর তা মানসূখ্ হওয়া খোদায়ী প্রজ্ঞার পরিপন্থী। কারণ , এর ফলে কেউ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নবী হওয়া ও কোরআন মজীদের আল্লাহর কিতাব্ হবার ব্যাপারে সংশয়ে পতিত হলে তার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘
আলার হুজ্জাত্ পূর্ণ হবে না। অতএব , কোরআন মজীদে এ ধরনের মানসূখের কোনো ব্যাপার নেই।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করতে হয় যে , কোরআন মজীদে নাসেখ্-মানসূখের প্রবক্তাগণের ধারণার ভিত্তি হচ্ছে কথিত স্ববিরোধিতা [হযরত রাসূলুল্লাহ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় কাফেররা যার কথা বলে নি] ও কতক হাদীছ - যা খবরে ওয়াহেদ পর্যায়ের , মুতাওয়াতির্ পর্যায়ের নয়।
স্ববিরোধিতার ধারণার ভ্রান্তি আমরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছি। হাদীছ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , যেহেতু কোরআন মজীদ হচ্ছে মানব জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুতাওয়াতির্ গ্রন্থ , সেহেতু খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ দ্বারা তো নয়ই , বরং সাধারণ মুতাওয়াতির্ পর্যায়ের হাদীছ দ্বারাও তার হুকুম মানসূখ্ হতে পারে না। কেবল কোরআন মজীদের কোনো আয়াতে অন্য আয়াতের হুকুম মানসূখ্ হবার কথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন শব্দে ও ভাষায় উল্লেখ থাকলেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। কিন্তু কোরআন মজীদে এমন কথা কোনো আয়াতে উল্লেখ করা হয় নি।
এবার আমরা হুকুম বহাল রেখে আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ করার ধারণার প্রতি দৃষ্টি দেবো।
কোরআন মজীদের কোনো আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হওয়া অর্থাৎ তা কোরআনের আয়াত্ হিসেবে গণ্য হবে অথচ গ্রন্থে (মুছ্বহাফ্-এ) থাকবে না এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ , সে ক্ষেত্রে মানতে হবে যে , আমাদের নিকট যে কোরআন রয়েছে তা অসম্পূর্ণ। কিন্তু সর্বসম্মত মত এবং স্বয়ং কোরআন মজীদেরও ঘোষণা হচ্ছে এই যে , কোরআন মজীদ সম্পূর্ণ গ্রন্থ।
কথিত তেলাওয়াত্-রহিত আয়াত্ সম্পর্কে বলা হতে পারে যে , সংশ্লিষ্ট আয়াত্ প্রথমে কোরআন মজীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো , পরে তা আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ হতে কোরআন থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ , কোনো কথার কোরআন মজীদের আয়াত্ হওয়ার মানেই হচ্ছে এই যে , কোরআন মজীদ ভাষার আবরণে লোকদের সামনে নাযিল্ হবার পূর্বেই তা লাওহে মাহ্ফুযে সংরক্ষিত ছিলো। এমতাবস্থায় তা থেকে কোনো আয়াত্ পরবর্তীকালে বাদ দেয়ার কথা ধারণা করা চলে না। কারণ , কথিত আয়াত্ যদি কোরআনের আয়াতরূপে সংরক্ষিত থেকে থাকবে তো তা কোরআন থেকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। আর যদি তা বাদ দেয়া সম্ভব হয় তাহলে তা আদৌ সংরক্ষিত ছিলো না। অতএব , তা কোরআনের আয়াত্ ছিলো না।
তাছাড়া আয়াত্ বহাল রেখে হুকুম রহিতকরণ যতোখানি অস্বাভাবিক , হুকুম বহাল রেখে আয়াত্ (তেলাওয়াত) রহিতকরণ তার তুলনায় বহু গুণ বেশী অস্বাভাবিক। এমতাবস্থায় রজম (বিবাহিত ব্যাভিচারীকে প্রস্তারাঘাতের শাস্তিদান) সংক্রান্ত হাদীছসমূহ নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। এতে যদি রজম-এর শাস্তি কার্যকর করার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় (এবং তা হবে) তাহলে বুঝতে হবে , এ শাস্তি ইসলামী হুকুমতের প্রধান হিসেবে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক রাষ্ট্রীয় দণ্ডবিধি হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিলো। কারণ , ইসলামী হুকুমাতের প্রধান হিসেবে হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর এরূপ বা অন্য কোনো শাস্তি নির্ধারণ ও কার্যকর করার পূর্ণ এখতিয়ার ছিলো।
মোদ্দা কথা , কোরআন মজীদের কোনো আয়াতের - তা তথ্যমূলকই হাক বা আদেশমূলকই হোক - তেলাওয়াত্ রহিত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।