কথিত পরস্পরবিরোধী আহ্কাম্
আমরা প্রমাণ করেছি যে , কোরআন মজীদের কোনো আয়াতের হুকুম রহিত হওয়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , কোরআন মজীদ যে আল্লাহর কিতাব্ - এ সত্য ইসলামের মৌল নীতিমালা (উছূলে‘
আক্বাএদ্)-এর অন্যতম বিষয়। কোরআন মজীদের আল্লাহর কিতাব্ হওয়া ও নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর আল্লাহর নবী হওয়া পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বিষয়। তাই কোরআন মজীদ আল্লাহর কিতাব্ - এ ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টির পরে এর একেকটি আয়াত্ নিয়ে তা আল্লাহর আয়াত্ কিনা সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ নেই। একইভাবে কোরআনের একেকটি হুকুমবাচক আয়াত্ নিয়ে সংশ্লিষ্ট হুকুমটি কার্যকর আছে কিনা বা দু 'টি আয়াতের হুকুমের মধ্যে পারস্পরিক সাংঘর্ষিকতা আছে কিনা এ ব্যাপারে চিন্তা করার অবকাশ নেই , যদি না কোনো হুকুমের সাময়িক হবার ব্যাপারে স্বয়ং কোরআন মজীদেরই অন্য কোনো আয়াতে অকাট্য নিদর্শন থাকে। এরূপ চিন্তা ঈমানের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। বরং কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা‘
আলার নাযিলকৃত সর্বশেষ , পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত কিতাব - এ মর্মে ঈমান পোষণ করার মানেই হচ্ছে এর সকল আয়াতকে সংশ্লিষ্ট বিন্যাসসহ আল্লাহর আয়াতরূপে গণ্য করা এবং এর সকল হুকুমকেই বহাল গণ্য করা।
এমতাবস্থায় কোরআন মজীদ অধ্যয়ন করতে গিয়ে কোথাও দুই আয়াতের হুকুমের মধ্যে দৃশ্যতঃ সাংঘর্ষিকতা আছে বলে দেখা গেলে বুঝতে হবে , আমাদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আয়াতের সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব হয় নি। এমতাবস্থায় স্বীয় কোরআন-অনুধাবনক্ষমতাকে শানিত করে সংশ্লিষ্ট আয়াতদ্বয়ের তাৎপর্য নতুন করে অনুধাবনের চেষ্টা করতে হবে।
কোরআন মজীদের তাৎপর্য সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতির (مقدمات
) প্রয়োজন সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অত্র প্রবন্ধের আওতাভুক্ত নয় , বরং তা স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। এখানে শুধু এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট (ইতিপূর্বেও যে সম্পর্কে আভাস দেয়া হয়েছে) যে , কোরআন মজীদের আয়াতসমূহ যেমন পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয় , বরং একটি সামগ্রিক বক্তব্য (গ্রন্থ) , তেমনি কোরআনে বর্ণিত হুকুমসমূহ একটি সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের বিভিন্ন অংশ। কোরআন মজীদের বিভিন্ন হুকুমের মধ্যে যেমন নীতিগত দিকনির্দেশনা আছে , তেমনি আছে মৌলিক বিধান। এছাড়া একদিকে যেমন সাধারণ বিধান আছে , তেমনি আছে বিশেষ বিধান এবং সাধারণ বিধানের অবস্থা থেকে ব্যতিক্রম অবস্থার বিধান। এছাড়া আছে পরীক্ষার জন্য নাযিলকৃত আদেশ ও সাময়িক কার্যকর আদেশ - যা সুস্পষ্ট নিদর্শন দ্বারা বুঝা যায়। এছাড়া আদেশের পাশাপাশি রয়েছে নছ্বীহত্ যা মেনে চলাই উত্তম , কিন্তু তাকে অবশ্য পালনীয় বিধানরূপে নির্ধারণ করা হয় নি। দৃশ্যতঃ দু’
টি আয়াতের হুকুমের মধ্যে সাংঘর্ষিকতা দেখা গেলে তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে দেখা যাবে , দু’
টি হুকুমের মধ্যে উপরোক্ত কোনো না কোনোরূপে সমন্বয় রয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে যে , কেবল‘
সমন্বয় অসম্ভব’
এমন দু’
টি হুকুমকেই পরস্পরবিরোধী গণ্য করা যায় এবং কেবল এরূপ ক্ষেত্রেই একটি হুকুম মানসূখ্ হবার কথা ধারণা করা যায়। কিন্তু কোরআন মজীদে এমন কোনো পরস্পরবিরোধী হুকুম নেই। অতএব , কোনো হুকুম মানসূখ্ হয় নি।
এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , কোনো বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যে হুকুম দেয়া হয় তার অর্থ হচ্ছে , কেবল ঐ অবস্থা বা পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সে ক্ষেত্রে এটাই হুকুম। এমতাবস্থায় , আর কখনোই যদি ঐ পরিস্থিতি বা অবস্থার উদ্ভব হবার সুযোগ বা সম্ভাবনা না থাকে তথাপি ঐ হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করা যাবে না। কারণ , মূলতঃই হুকুমটি শর্তযুক্ত অর্থাৎ শর্ত বিদ্যমান থাকলে বা দেখা দিলেই ঐ হুকুম কার্যকর হবে ; শর্ত বিদ্যমান না থাকলে‘
মানসূখ্’
কথাটি আদৌ প্রযোজ্য হতে পারে না। বরং এ ধরনের হুকুম শর্ত থাকা সত্ত্বেও 'আর প্রযোজ্য হবে না ' মর্মে নতুন আদেশ জারী হলে কেবল তখনই প্রথম হুকুমটি মানসূখ্ বলে গণ্য হবে।
কোরআন মজীদের যে সব আয়াতের হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করা হয় উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন করে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে তার কোনোটিই মানসূখ্ হয় নি। বস্তুতঃ এ কারণেই যারা কোরআনের আয়াতের হুকুম মানসূখযোগ্য বলে মনে করেন তাঁরা কথিত মানসূখ্ হুকুম-সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ যিনি যতোটি হুকুমকে অন্য হুকুমের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করেছেন এবং কোনোভাবেই সমন্বয় খুঁজে বের করতে পারেন নি তিনি এরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কথিত 'সাংঘর্ষিক হুকুমদ্বয় বা হুকুম সমূহের ' একটিকে বহাল গণ্য করে অপরটি বা অপরগুলোকে মানসূখ্ গণ্য করেছেন। এভাবেই কথিত মানসূখ্ হুকুম-সংখ্যার ব্যাপারে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। কোরআন মজীদের কোনো হুকুম যে মানসূখযোগ্য নয় এ মতানৈক্যও তার অন্যতম প্রমাণ।
এবার আমরা দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যাপকভাবে 'মানসূখ্ গণ্যকৃত ' কয়েকটি হুকুম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে প্রমাণ করবো যে , এ সব হুকুম মানসূখ্ হয় নি।
1 ) মদ সংক্রান্ত হুকুম
বলা হয় যে , ইসলামী শরী‘
আতে প্রথমে মদ হারাম ছিলো না , পরে ধাপে ধাপে তা হারাম করা হয় এবং সর্বশেষ হুকুমের দ্বারা পূর্ববর্তী হুকুমকে মানসূখ্ করা হয়। বলা হয় , প্রথমে মদের অপকারিতা তুলে ধরে আয়াত্ নাযিল্ হয়। এ আয়াতটি হচ্ছে :
)
ي
َسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا(
“
(হে রাসূল!)
তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। (তাদেরকে) বলে দিন , এতদুভয়ের মধ্যে বিরাট গুনাহ এবং মানুষের জন্য উপকারিতা রয়েছে। আর এতদুভয়ের গুনাহ উভয়ের উপকারিতার চেয়ে বড় (বা বেশী)।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 219)
বলা হয় , এতে মদ হারাম করা হয় নি , তবে মাকরূহ বলে তুলে ধরা হয়। এরপর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায আদায়ে নিষেধ করা হয়। এতদসংক্রান্ত আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
)
ي
َا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصَّلاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ(
“
হে ঈমানদারগণ!
তোমরা এমন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের কাছে যেয়ো না যে , তোমরা জানো না তোমরা কি বলছো।”
(সূরাহ্ আন্-নিসা’
: 43)
বলা হয় , এ আয়াতের দ্বারা মদপানে অভ্যস্ত মুসলমানদের মদপানের মাত্রাকে সীমিত করে আনা হয়। এরপর মদ হারাম করার আয়াত্ নাযিল্ করা হয়। এ আয়াত্ হচ্ছে :
“
হে ঈমানদারগণ!
নিঃসন্দেহে মদ , জুয়া , প্রতিমা ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ হচ্ছে শয়তানের অপকৃষ্ট কর্ম , অতএব , এগুলো বর্জন করো , তাহলে আশা করা যায় যে , তোমরা সাফল্য লাভ করবে।”
(সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্ : 90)
এ ব্যাপারে কোনো কোনো মতে , উল্লিখিত দ্বিতীয় আয়াতটি প্রথমে ও প্রথম আয়াতটি দ্বিতীয় বারে নাযিল্ হয়েছে। তবে উভয় অবস্থায়ই ধরে নেয়া হয়েছে যে , মদ প্রথমে মোবাহ ছিলো , তারপর তা মাকরূহ ও পরে হারাম করা হয়। ফলে মাকরূহর হুকুম দ্বারা মোবাহর হুকুম ও হারামের হুকুম দ্বারা মাকরূহর হুকুম মানসূখ্ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে হাদীছও বর্ণনা করা হয় যাতে বলা হয়েছে যে , ছ্বাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকে মদ খেতেন এবং প্রথম বা দ্বিতীয় আয়াত্ নাযিল্ হবার পর তাঁদের বেশীরভাগই মদ্যপান ছেড়ে দেন। অতঃপর স্বল্পসংখ্যক ছ্বাহাবী সীমিত পরিমাণে ও এমন সময়ে মদ খেতেন যাতে নামাযের সময় হবার আগেই নেশা কেটে যায়। অতঃপর মদ হারামের আয়াত্ নাযিল্ হয় এবং যারা মদ পানরত অবস্থায় এ আয়াতের কথা জানতে পারেন তাঁরা তখনই মদ ছেড়ে দেন ও মদের পাত্র ভেঙ্গে ফেলেন , এমনকি কেউ কেউ গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে পেটের মধ্যকার মদও ফেলে দেন।
কিন্তু এ দৃষ্টান্ত নাসেখ্-মানসূখের খুবই দুর্বল দৃষ্টান্ত। কারণ , উক্ত আয়াত্ সমূহের কোনোটিতে বা অন্য কোনো আয়াতেই মদ খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় নি। অতএব , কোনো আয়াতের হুকুম মানসূখ্ হবার প্রশ্ন ওঠে না। যে আয়াতে মদের গুনাহ ও উপকারিতার কথা বলা হয়েছে তা একটি তথ্যমূলক আয়াত্ , হুকুমমূলক নয় , অতএব , তার হুকুম মানসূখ্ হবার প্রশ্ন ওঠে না।
আর সূরাহ্ নিসা 'র 43 নং আয়াতকে নেশাগ্রস্ততা সম্পর্কিত বলে ধরে নেয়া হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। কারণ ,سُكَارَى
বলতে এমন এক অবস্থা বুঝায় যখন মানুষ পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে না এবং তার বিচারবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি সঠিকভাবে কাজ করে না। এ অবস্থা কেবল নেশাখোরীর কারণে হয় না ; নেশাখোরীর কারণেও হতে পারে , অন্য কারণেও হতে পারে। যেমন : কোনো রোগ বা ভাইরাসের আক্রমণের কারণে , নিদ্রাহীনতা বা অতি পরিশ্রমজনিত ঘুম-ঘুম ভাবের কারণেও হতে পারে। অবশ্য এর মাত্রায় কম-বেশী হতে পারে। তবে এ ধরনের অবস্থা যদি এমন পর্যায়ের হয় যে , ব্যক্তি কী বলছে তা নিজেই জানে না , সে অবস্থায় নামায আদায়ের চেষ্টা করতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি এ অবস্থায় নামায আদায় করলেও তা নামাযরূপে গণ্য হবে না। কারণ ,‘
ইবাদতের কাজসমূহ সচেতন-সজ্ঞানভাবে সম্পাদন করতে হয়।
অভিন্ন শব্দমূল (سکر
) থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী কোরআন মজীদে নেশাগ্রস্ততা ছাড়াও অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে :
“
আর আমি যদি তাদের সামনে আসমানের কোনো দরযাহ্ও উন্মুক্ত করে দেই - যা দিয়ে তারা ওপরে আরোহণ করবে তাহলেও তারা অবশ্যই বলবে :
নিঃসন্দেহে আমাদের দৃষ্টিসমূহ আচ্ছন্ন হয়েছে
, বরং আমরা এক জাদুগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।”
(সূরাহ্ আল্-হিজর : 15)
এছাড়া মৃত্যুকালীন আচ্ছন্নতা অর্থেও অভিন্ন শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
)
و
َجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ(
“
আর সত্যি সত্যিই মৃত্যুর আচ্ছন্নতা এসে গিয়েছে।”
(সূরাহ্ ক্বাফ্ :
19)
যারা সংজ্ঞা থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাদের মৃত্যুপূর্ব আচ্ছন্নতার অবস্থা অনেকেই প্রত্যক্ষ করে থাকবেন। আসন্ন মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মানুষের সামনে যখন আলমে বারযাখের দরযাহ্ উন্মুক্ত হয়ে যায় অথচ পার্থিব জগতের সাথেও তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি তখন এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়। নিঃসন্দেহে মানুষের মৃত্যুপূর্ব এ আচ্ছন্নতাকে কেউ নেশাগ্রস্ততা নামে অভিহিত করবে না।
যা-ই হোক , সূরাহ্ আন্-নিসা’
র 43 নং আয়াতে উল্লিখিতسُكَارَى
শব্দ থেকে নেশাগ্রস্ততার অর্থ গ্রহণ এবং তার ভিত্তিতে‘
প্রথমে মদ মোবাহ ছিলো , কেবল নামাযের সময় নেশাগ্রস্ত থাকতে নিষেধ করা হয়েছিলো”
- এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এ বিশ্লেষণ ছাড়াই তত্ত্বগতভাবেই বলা যায় যে , ইসলামে কখনোই মদ বৈধ ছিলো না ; থাকতে পারে না। কারণ মদ হারাম হওয়ার বিধানটি ঐ ধরনের শর‘
ঈ বিধানের অন্তর্গত যা সংশ্লিষ্ট বস্তুর ও মানুষের সৃষ্টিপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয়। তাই মদ উৎপাদিত হওয়ার দিন থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর শরী‘
আতে মদ হারাম হতে বাধ্য। কারণ , যে খাদ্য বা পানীয় মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক , নৈতিক , চারিত্রিক বা আত্মিক ক্ষতির কারণ আল্লাহর শরী‘
আতে তা কখনোই অনুমোদিত থাকতে পারে না (জীবন বাঁচানোর ন্যায় ব্যতিক্রমী প্রয়োজন ব্যতীত)।
তাছাড়া তাওরাতে সুস্পষ্ট ভাষায় মদ হারাম করা হয়েছে। অতএব , পূর্ববর্তী নবীদের শরী‘
আতে যেখানে মদ হারাম ছিলো সেখানে হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর শরী‘
আতে প্রথমে মদ বৈধ ছিলো , পরে হারাম করা হয় - এটা হতেই পারে না। কারণ , তাহলে ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতরা হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী যুক্তি দাঁড় করাতে পারতো। তারা বলতে পারতো ,‘
যে ব্যক্তি মদের মত ঘৃণ্য নাপাক বস্তুকে বৈধ গণ্য করে এবং তার অনুসারীরা তা পান করে , সে ব্যক্তি কী করে নবী হতে পারে ?’
আর লোকদের কাছে , এমনকি স্বয়ং মদ্যপায়ীদের কাছেও এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু এ ধরনের কোনো যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিলো বলে কোনো সূত্র থেকেই জানা যায় না।
বস্তুতঃ এটা মনে করা একটা ভ্রান্ত ধারণা যে , যখন কোনো বস্তু বা কাজ হারাম বলে ঘোষণা করে অথবা তা খেতে বা করতে নিষেধ করে আয়াত্ নাযিল্ হয় কেবল তখন থেকেই তা হারাম হয় এবং তার পূর্বে তা বৈধ ছিলো। এ ধারণা ঠিক হলে বলতে হবে , ব্যাভিচার , সমকামিতা , নরহত্যা , ওযনে কম দেয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে আয়াত্ নাযিল্ হবার পূর্বে ঐ সব কাজ জায়েয ছিলো ; নিঃসন্দেহে তা জায়েয ছিলো না।
বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে , যে সব বস্তু বা কাজ হারাম হওয়া অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় - যার হারাম হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিক নয় , তা সব নবী-রাসূলের (‘
আঃ) শরী‘
আতে সব সময়ই হারাম ছিলো। তাই নিঃসন্দেহে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর শরী‘
আতেও তা শুরু থেকেই হারাম ছিলো এবং নিঃসন্দেহে তাঁর অনুসারীগণ এ থেকে বিরত থাকতেন বা তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে এ সব থেকে বিরত রাখতেন। কারণ এ ছিলো তাঁর অন্যতম দায়িত্ব। আল্লাহ্ তা‘
আলা তাঁর এ দায়িত্ব সম্বন্ধেই এরশাদ করেছেন :
)
و
َيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ(
“
আর তিনি (রাসূল) তাদের জন্য পবিত্র জিনিসগুলোকে হালাল করে দেন এবং নোংরা-অপবিত্র জিনিসগুলোকে তাদের জন্য হারাম করে দেন।”
(সূরাহ্ আল্-আ 'রাফ্ :
157)
অবশ্য আল্লাহ্ তা‘
আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অন্তরে‘
ইলমে হুযূরী আকারে কোরআন মজীদের যে পরিপূর্ণ ভাব ও তাৎপর্য নাযিল্ করেন তার আলোকেই তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। পরে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ ভাষার আবরণে নাযিল্ হয়।
যা-ই হোক , আলোচ্য তিনটি আয়াতের একটিতে মদের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে ও তা পরিত্যাগ করতে বলা হযেছে , একটিতে মদপায়ীদের যুক্তিকে খণ্ডন করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে , তার ক্ষতি উপকারের চেয়ে বেশী (অতএব , তা পানের অনুমতি দেয়া চলে না) এবং অপর আয়াতটিতে একটি বিশেষ অবস্থায় নামায না পড়ার কথা বলা হয়েছে - নেশাগ্রস্ততা যে অবস্থা সৃষ্টি হবার অন্যতম কারণ , একমাত্র কারণ নয়। আর যেহেতু মদপান সব সময়ই হারাম ছিলো সেহেতু এ আয়াতের লক্ষ্য অন্যান্য কারণ থেকে উদ্ভুত উক্ত অবস্থা।
অতএব , এখানে নাসেখ্-মানসূখের কোনো ব্যাপার নেই।
2 ) মীরাছ্ সংক্রান্ত বিধান ও ওয়াছ্বীয়াত্
আল্লাহ্ তা‘
আলা কোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন :
“
তোমাদের ওপর বিধিবদ্ধ করে দেয়া হল যে , তোমাদের মধ্যে যখন কারো সামনে মৃত্যু উপস্থিত হবে তখন তার যদি ধনসম্পদ থাকে তাহলে সে যেন তার পিতা-মাতা ও আপনজনদের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে ওয়াছ্বীয়াত্ করে ; এ হচ্ছে মুত্তাক্বীদের ওপর আরোপিত হক্ব্।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ :
180)
আল্লাহ্ তা‘
আলা আরো এরশাদ করেছেন :
)
و
َالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لأزْوَاجِهِمْ مَتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ مِنْ مَعْرُوفٍ(
“
আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের রেখে মৃত্যুবরণ করে তারা যেন তাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে ওয়াছ্বীয়াত্ করে যায় যাতে তাদেরকে (বাড়ীঘর থেকে) বহিষ্কার না করে এক বছর পর্যন্ত ভরণ-পোষণ দেয়া হয়। অতঃপর তারা যদি (বাড়ীঘর ছেড়ে) চলে যায় তো সে ক্ষেত্রে তারা প্রচলিত নিয়মে (বা উত্তম বিবেচনায়) নিজেদের ব্যাপারে যা করেছে তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই।”
(সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ :
240)
[আয়াতের ভাষা থেকে যা বুঝা যায় তাতে বহিষ্কার না করার নির্দেশটি এক বছরের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে , আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্যও হতে পারে (যদি না সে নিজেই চলে যায়)। এখানে ভরণপোষণের মেয়াদ হিসেবে এক বছরের কথা উল্লেখ করার পরে বহিষ্কার না করার কথা উল্লেখ করা থেকে মনে হয় যে , এর সাথে এক বছরের শর্ত যুক্ত নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে , পরিবারপ্রধান পরিবারের সদস্যদেরকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যে সব দ্রব্যাদি ও সম্পদ প্রদান করে , যেমন : অলঙ্কারাদি , কাপড়-চোপড় , আসবাবপত্র ইত্যাদি , সে সব মীরাছ হিসেবে বণ্টনযোগ্য নয় , বরং তা ব্যবহারকারীর সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। তেমনি স্বত্ব ত্যাগ না করে শুধু ব্যবহারের জন্য কোনো সম্পদ দেয়া হলে ব্যক্তি যতোদিন তা ব্যবহার করবে ততোদিন তার কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়া যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে বসবাস ও ব্যবহারে ঘর বা কক্ষ (যা ভাড়া দিয়ে অর্থোপার্জন করা হয় না) হয় ব্যক্তিগত সম্পদ বলে গণ্য হবে , নয়তো ব্যবহারের অধিকারপ্রাপ্ত সম্পদ বলে গণ্য হবে। এতদুভয়ের কোনো অবস্থায়ই ব্যক্তিকে সেখান থেকে বহিষ্কার করে ঐ গৃহ বা কক্ষকে মীরাছভুক্ত গণ্য করা যাবে না , বরং সে ঐ গৃহ বা কক্ষ পরিত্যাগ করলে কেবল তখনই তা মৃত ব্যক্তির মীরাছরূপে গণ্য হবে। হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর বিবিগণের ব্যবহৃত ঘরসমূহকে তাঁর মীরাছে পরিণত করার কথা জানা যায় না।]
বলা হয় যে , মীরাছ সংক্রান্ত বিধান নাযিল্ হওয়ার পরে এ উভয় আয়াতের হুকুম মানসূখ্ হয়ে গেছে।
কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ , মীরাছ্ সংক্রান্ত আয়াতেও ওয়াছ্বীয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরাহ্ নিসা’
র 11 ও 12 নং আয়াতে কয়েক বার বলা হয়েছে যে , কৃত ওয়াছ্বীয়াত্ বা ঋণ থাকলে তা আদায়ের পরে(
بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ
)
নির্ধারিত হারে মীরাছ বণ্টন করতে হবে। এখানে ওয়াছ্বীয়াত্ ও ঋণের কথা যেভাবে বলা হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্ট যে , তা কেবল মীরাছ বণ্টনের পূর্বশর্তই নয় , বরংوَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا
থেকে বুঝা যায় যে , ওয়াছ্বীয়াত্ অবশ্যই থাকবে , কিন্তুأَوْ دَيْنٍ
থেকে বুঝা যায় যে , ঋণ না-ও থাকতে পারে।
কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে নাসেখ্-মানসূখের প্রবক্তাদের মতে মীরাছের আয়াতে যে ওয়াছ্বীয়াতের কথা বলা হয়েছে তদনুযায়ী মুমুর্ষু ব্যক্তি ওয়াছ্বীয়াত্ করে গেলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের জন্য তা তার রেখে যাওয়া মোট সম্পদের সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত আদায় করা ফরয , কিন্তু মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য এরূপ ওয়াছ্বীয়াত্ করা ফরয নয়। কারণ , তাঁদের মতে , মীরাছের আয়াত্ নাযিল্ হবার মাধ্যমে ওয়াছ্বীয়াত্ ফরয হবার হুকুম মানসূখ্ হয়ে গিয়েছে ; অতঃপর ওয়াছ্বীয়াত্ করা মুস্তাহাব্।
তাঁদের এ দাবীর পক্ষে কোনো অকাট্য দলীল নেই। অন্যদিকে ওয়াছ্বীয়াতের হুকুমের সাথে মীরাছের হুকুমের কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। কারণ , ওয়াছ্বীয়াতের হুকুমে সমস্ত সম্পদের ব্যাপারে ওয়াছ্বীয়াত্ করা বাধতামূলক করা হয় নি , অন্যদিকে মীরাছের হুকুমে ওয়াছ্বীয়াত্ পূরণ ও ঋণ শোধের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা-ই বণ্টন করতে বলা হয়েছে।
নাসেখ্-মানসূখের প্রবক্তাগণ আরো মনে করেন যে , ওয়াছ্বীয়াত্ - তাঁদের মতে যা করা মুস্তাহাব - ওয়ারিশদের জন্য করা যাবে না। কারণ , তারা তো মীরাছই পাচ্ছে। এ-ও তাঁদের যুক্তি যে , যেহেতু উভয় হুকুমই ঘনিষ্ঠ জনদের জন্য সেহেতু ওয়াছ্বীয়াতের হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করতে হবে। তাঁদের এ দাবীর পক্ষেও কোনো অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলীল নেই। মানুষের সীমিত জ্ঞানের যুক্তি দ্বারা আল্লাহর নির্ধারিত ফরয (পিতা-মাতা ও আপনজনদের জন্য ওয়াছ্বীয়াত্) মানসূখ্ গণ্য করা যেতে পারে না। তাছাড়া এ যুক্তি যে খুবই দুর্বল তা সামান্য চিন্তা করলেই সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কারণ মৃত ব্যক্তির‘
উপার্জনে অক্ষম’
বৃদ্ধ পিতা-মাতা তার সম্পদে যে নির্ধারিত অংশ পাবেন তা তাঁদের জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে। তেমনি তার একটি ছেলে দুর্বল , অক্ষম বা বিকলাঙ্গ হতে পারে , তার একটি কন্যা অবিবাহিতা থাকতে পারে অথবা এক বা একাধিক সন্তানের পড়াশুনার ব্যয়ভার বহনের প্রয়োজন থাকতে পারে। এমতাবস্থায় তাদেরকে শুধু মীরাছের অংশের ওপর নির্ভরশীল রেখে যাওয়া মানুষের স্বাভাবিক বিবেকবোধের পরিপন্থী এবং যা বিবেকসম্মত ইসলাম তাতে বাধা দেয় না।
অন্যদিকে মুমূর্ষু ব্যক্তির কোনো পুত্র বা কন্যা তার পূর্বেই মারা গিয়ে থাকলে এবং তার বা তাদের সন্তান থাকলে তারা ঐ মুমূর্ষু ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার মীরাছ পাবে না। এমতাবস্থায় তার উচিত তাদের জন্য ওয়াছ্বীয়াত করা ; তা না করা বিবেকবিরোধী হবে। কিন্তু ওয়াছ্বীয়াত্ করা যদি ফরয না হয় , মুস্তাহাব হয় , সে ক্ষেত্রে মুমূর্ষু ব্যক্তি ওয়াছ্বীয়াত্ করার ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। ফলে তার ঐ সব নাতি-নাত্নী একেবারেই বঞ্চিত হবে এবং দুর্বল-অক্ষম পিতা-মাতা বা এ ধরনের কোনো সন্তান থাকলে তারা তার আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হবে।
এমতাবস্থায় মুমূর্ষু ব্যক্তি ওয়াছ্বীয়াত্ করাকে ফরয জানলে মৃত্যুশয্যার কষ্ট উপেক্ষা করে ওয়াছ্বীয়াত্ করবে , অন্যথায় , এ ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে পড়বে। আমরা বাস্তবেও দেখতে পাই , যারা ওয়াছ্বীয়াত্ করাকে মুস্তাহাব গণ্য করে তাদের মধ্যে হাজারে একজনও পাওয়া যায় না যে মৃত্যুশয্যায় ওয়াছ্বীয়াত্ করে।
এ প্রসঙ্গে প্রথমোক্ত আয়াতে ওয়াছ্বীয়াতের সাধারণ হুকুমের পর দ্বিতীয়োক্ত আয়াতে স্ত্রীদের ব্যাপারে এক বছরের ভরণপোষণ প্রদান ও বাড়ীঘর থেকে বহিস্কার না করার জন্য ওয়াছ্বীয়াত্ করতে বলা হয়েছে। মৃত ব্যক্তির কোনো স্ত্রীর স্বীয় পরলোকগত স্বামীর প্রতি মহব্বত এতো বেশী হতে পারে যে ,‘
ইদ্দত্কাল পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নতুন স্বামী গ্রহণের জন্যে তার মন প্রস্তুত না-ও হতে পারে। এমতাবস্থায় সে স্বামীর সাথে যে গৃহে বসবাস করতো তাতে থাকতে চাইলে অবশ্যই তাকে থাকতে দেয়া উচিত। অন্যদিকে মৃত স্বামীর ধনসম্পদে সে যে উত্তরাধিকার পাবে তা থেকে লব্ধ আয় তার ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে। এমতাবস্থায় মৃত স্বামীর গৃহে বসবাস করলে সে সর্বোচ্চ এক বছরের ভরণপোষণের নিশ্চয়তা পাচ্ছে। অতঃপর তার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার নিজের বা নতুন স্বামী গ্রহণ করে থাকলে তার। আল্লাহ্ তা‘
আলার বিধানে যে মানুষের মনস্তাত্বিক প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখা হয়েছে এ আয়াতের হুকুম তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
কোরআন মজীদে যেখানে ওয়াছ্বীয়াতের জন্য সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং মীরাছ বণ্টনকে ওয়াছ্বীয়াত্ আদায়ের শর্তাধীন করা হয়েছে , আর তার কল্যাণকারিতা যেখানে এতো বেশী সেখানে অকাট্য দলীল ছাড়া এ হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করার কোনোই বৈধতা নেই।
3 ) ব্যভিচার ও অশ্লীলতার শাস্তি
কোরআন মজীদের এরশাদ হয়েছে :
“
তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা অশ্লীল কর্মে লিপ্ত হয় তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন ব্যক্তির সাক্ষ্য নাও এবং যদি তারা সাক্ষ্য দেয় তাহলে ঐ নারীদেরকে বাড়ীতে আবদ্ধ করে রাখো যে পর্যন্ত না তারা মারা যায় অথবা আল্লাহ্ তাদের জন্য কোনো পথ বের করে দেন। আর তোমাদের মধ্যে যে দু’
জন (পুরুষ) তা (অশ্লীল কাজ) করবে তাদেরকে নির্যাতন করো। অতঃপর তারা যদি তাওবাহ করে ও সংশোধিত হয় তাহলে তাদের থেকে বিরত থাকো (আর নির্যাতন করো না)। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তাওবাহ কবূলকারী ও দয়াবান।”
(সূরাহ্ আন্-নিসা’
: 15-16)
[অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ মনে করে যে , এখানে একই অপরাধে পুরুষের তুলনায় নারীকে কঠোরতর শাস্তি দানের বিধান দেয়া হয়েছে অর্থাৎ পুরুষকে যেখানে প্রহার করতে বলা হয়েছে সেখানে নারীকে মৃত্যুর শাস্তি দেয়া হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে , এখানে পুরুষের তুলনায় নারীকে লঘু শাস্তি দেয়া হয়েছে। কারণ কিছু লোকের ভুল ধারণার বিপরীতে , এখানে কুকর্মকারী নারীকে ঘরে আবদ্ধ রেখে না খাইয়ে মেরে ফেলার কথা বলা হয় নি , বরং তাকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত ঘরে আটকে রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিম নারীরা সমাজে স্বাধীনভাবে বিচরণের যে অধিকার ভোগ করেন কুকর্মকারী নারীকে তা থেকে বঞ্চিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা সামান্য চিন্তা করলেই এ নির্দেশের কল্যাণ বুঝতে পারি। কারণ , তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিলে সে অন্য নারীদেরকে কলুষিত করার ও একই পথে টেনে নেয়ার অপচেষ্টা চালাবে। অবশ্য আয়াতে আমৃত্যু গৃহবন্দিত্বকে তাদের জন্য অনিবার্য ভাগ্যলিপিও করে দেয়া হয় নি।“
অথবা আল্লাহ্ তাদের জন্য কোনো পথ বের করে দেন”
বলে সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আয়াতে যদিও সুস্পষ্টভাবে বলা হয় নি তথাপি নারীতে নারীতে কুকর্ম সাধারণতঃ এমন নারীই করতে পারে যে , স্বামীর সুরক্ষার অধিকারী নয় (অবিবাহিতা অথবা বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা - যে‘
ইদ্দতের পরে নতুন স্বামী গ্রহণ করে নি)। অন্যদিকে যে নারী এ ধরনের কুকর্মে অভ্যস্ত তা জানার পরে সাধারণতঃ কোনো পুরুষ তাকে বিবাহ করতে আগ্রহী হয় না। এতদসত্ত্বেও যদি কোনো পুরুষ তাকে বিবাহ করতে আগ্রহী হয় এবং সে-ও স্বামী গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে প্রস্তুত হয় তাহলে তার গৃহবন্দিত্বের অবসান ঘটবে।]
নাসেখ্-মানসূখের প্রবক্তাদের মতে , উল্লিখিত আয়াত্ দু’
টি ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কিত এবং এতেفاحشة
(অশ্লীল কাজ) বলতেزنا
(ব্যাভিচার) বুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতে , প্রথম আয়াতে ব্যাভিচারে লিপ্ত নারীদের জন্য ঘরে আটকে রাখার বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে সে হুকুম মানসূখ্ করে ব্যাভিচারে লিপ্ত নারী-পুরুষ উভয়কে নির্যাতন করার হুকুম দেয়া হয়েছে , পরে বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাতের শাস্তি নাযিল্ হলে উপরোক্ত দ্বিতীয় আয়াতের হুকুমও মানসূখ্ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এখানে নাসেখ্-মানসূখের কোনো ব্যাপারই নেই। কারণفاحشة
বা অশ্লীল কাজ বলতে কেবল একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যকার ব্যভিচার বুঝায় না , বরং তাতে ব্যভিচার ছাড়া অন্যান্য অশ্লীল কাজও অন্তর্ভুক্ত - যা দু’
জন নারী বা দু’
জন পুরুষের মধ্যেও সংঘটিত হতে পারে। উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে এ ধরনের অশ্লীল কাজের কথা বলা হয়েছে , ব্যভিচারের কথা বলা হয় নি।
ওপরে প্রথমোক্ত আয়াতে যে কেবল নারীদের কথা বলা হয়েছে সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কারণ , তাতে স্ত্রীবাচক সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ ব্যবহার ছাড়াও সুস্পষ্ট ভাষায়من نسائکم
(তোমাদের নারীদের মধ্য থেকে) উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় আয়াতে দু’
জন পুরুষের কথা বলা হয়েছে ;الذان
সর্বনাম থেকে এটাই প্রমাণিত। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে বুঝাতে চাইলে বহুবচন ব্যবহৃত হতো। কারণ , বহুবচনে পুরুষবাচকالذين
সর্বনামে নারীকেও অন্তর্ভুক্ত বুঝানো যায় , কিন্তু দ্বিবচনে পুরুষবাচকالذان
সর্বনামে শুধু দু’
জন পুরুষকে বুঝানো হয়।
অতএব , দেখা যাচ্ছে , এ আয়াত্ দু’
টিতে ব্যভিচারের শাস্তির বিধান দেয়া হয় নি , তাই ব্যভিচারের শাস্তির বিধান দ্বারা এ দুই আয়াতের হুকুম মানসূখ্ হবার প্রশ্নই ওঠে না।
আমরা এখানে কথিত নাসেখ্-মানসূখের ব্যাপারে দৃষ্টান্ত হিসেবে বহুলভাবে উল্লেখকৃত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। এভাবে , আরো কোনো আয়াতের হুকুম অন্য কোনো আয়াতে বর্ণিত হুকুমের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হলে সেগুলো নিয়েও গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হলে দেখা যাবে সে সবের মধ্য থেকে কোনো হুকুমই মানসূখ্ হয় নি। বরং কোরআন মজীদের প্রতিটি হুকুমই স্বমহিমায় বহাল আছে।
আল্লাহ্ তা‘
আলা আমাদেরকে কোরআন মজীদের সকল আহ্কাম্ থেকে কল্যাণ লাভের তাওফীক্ব্ দিন। আমীন।।
[কৃতজ্ঞতা :
অত্র প্রবন্ধ রচনায় আল্লামা সাইয়েদ আবুল্ ক্বাসেম খুয়ী (রহ্ঃ) রচিত
البيان فی تفسير
القرآن
গ্রন্থের নাসেখ্-মানসূখ্ সংক্রান্ত অধ্যায় থেকে যথেষ্ট সহায়তা নেয়া হয়েছে।]