কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়11%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 22611 / ডাউনলোড: 3675
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।


1

2

3

4

5

6

7

8

কোরআনের ভাষাগত রূপ আল্লাহর

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াতের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য আদেশ আসার পূর্বেও তিনি আসমান-যমীনের নিগূঢ় সত্য অবলোকন করতেন। এর বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব , অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে , এ নিগূঢ় সত্যের প্রত্যক্ষকরণ তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিলো। কিন্তু তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত করা হলো এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো , তখন তাঁর জন্য বড় সমস্যা ছিলো এই যে , যে মহাসত্য ( ইল্মে হুযূরী রূপে অবস্তুগত কোরআন মজীদ) তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো - যা কোনো কালির হরফে লেখা কিতাব্ ছিলো না (সম্ভবতঃ এ কারণেই - লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত কিতাব্ পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো না বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে নিরক্ষর রেখেছিলেন) , তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল ( আঃ) ভাষার আবরণে পর্যায়ক্রমে এ মহাসত্যকে তাঁর মুখে জারী করেন।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মুখে এ কোরআন ভাষার আবরণে জারী হলো বটে , কিন্তু এর ভাষা তাঁর নিজের নয়। বিশেষ করে তিনি তৎকালীন আরবের কোনো কবি , সাহিত্যিক , বাগ্মী , বা অলঙ্কারবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না ; এমনকি তিনি লিখতে-পড়তেও জানতেন না। অতএব , মানুষের সকল ভাষার মধ্যে প্রকাশক্ষমতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ভাষা আরবী ভাষার এ শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের ভাষা ও বক্তব্য তাঁর নিজের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ গ্রন্থ যার পক্ষ থেকে তাঁর হৃদয়পটে নাযিল্ হয়েছিলো তথা প্রবেশ করেছিলো তিনি স্বয়ং একে সম্ভাব্য সর্বোত্তমরূপে মানুষের বোধগম্য ভাষায় পরিবর্তিত করে হযরত জিবরাঈল ( আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে ও মন-মগযে গ্রথিত করে দেন এবং তাঁর মুখে অন্যদের নিকট প্রকাশ করেন।

কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে যে সত্য প্রবেশ করেছিলো এবং তিনি যে সত্য অহরহ প্রত্যক্ষ করছিলেন এভাবে মানুষের ভাষার আবরণে প্রকাশের মাধ্যমে কি সে সত্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব ছিলো ? বস্তুতঃ শ্রবণ কখনোই প্রত্যক্ষকরণের - শুধু চক্ষু দ্বারা নয় , পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষকরণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। অভিজ্ঞতার বিবরণ পাঠে কোনোদিনই অভিজ্ঞতা হাছ্বিল্ হয় না।

তাছাড়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ , আরবী ভাষা মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী ভাষা হলেও তা মানুষের ভাষা বৈ নয়। মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিষয়াদির জন্যে কোনো ভাষায়ই যথোপযুক্ত শব্দাবলী ও প্রকাশকৌশল থাকতে পারে না , তা সে ভাষা যতোই না প্রায় সীমাহীন প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী হোক। এমতাবস্থায় , মানুষের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জগতের সত্যসমূহকে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের শব্দাবলী ও পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করে মোটামুটি এজমালীভাবে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , ভাষার আবরণে যে কোরআন মজীদ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হলো তা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের একটি পর্যায়গত ও মাত্রাগত অবতরিত রূপ বৈ নয়। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের দ্বিতীয় দফা নাযিল্ বা মানগত অবতরণ। কোরআন মজীদের এ পর্যায়গত বা মানগত অবতরণ ঘটে সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে ।

নুযূলের আরো পর্যায়

কিন্তু কোরআন মজীদের নুযূল বা গুণগত অবতরণ এখানেই শেষ নয়। আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর আরো নুযূল দেখতে পাই - যা অবশ্য প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে নুযূল্ -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।

বস্তুতঃ কোনো কিছুকেই তার স্থান , কাল ও প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো বক্তার বক্তব্য বিভিন্নভাবে শোনা যায় , যেমন : সরাসরি বক্তার সামনে বসে শোনা হয় , বা তার রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায় , বা সরাসরি শুনেছে এমন কোনো শ্রোতার কাছ থেকে হুবহু শোনা যায় , অথবা মুদ্রিত আকারে পড়া যায়। এর প্রতিটির প্রভাব শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকার ওপর স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে , বক্তা এবং তাঁর বক্তব্যের শ্রোতা বা পাঠকের মাঝে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে বক্তা ও লেখক থেকে শ্রোতা ও পাঠকের স্থানগত ও কালগত ব্যবধান যতো বেশী হবে বক্তব্যের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ততোই মাত্রাগত অবনতি ঘটবে। অতএব , এ-ও এক ধরনের নুযূল বা অবতরণ তথা মানগত অবনয়ন বটে , যদিও ঐতিহ্যিকভাবে কোরআন বিশেষজ্ঞগণ এ জন্য নুযূল্ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা , কোরআন মজীদের নুযূলের এ ধরনের পর্যায়সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পর্যায় থেকে অনেক নীচে বিধায় তা বাঞ্ছিত পর্যায় নয়। সুতরাং কোরআনকে সঠিকভাবে তথা আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত বাঞ্ছিত পর্যায়ে অনুধাবনের জন্য এবং সে লক্ষ্যে স্বীয় অনুধাবনক্ষমতার কাম্য পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো বক্তার বক্তব্যের তাৎপর্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণের উপায় কী ? নিঃসন্দেহে এর উপায় হচ্ছে , জ্ঞানগতভাবে শ্রোতাকে বা পাঠককে স্থান , কাল , ভাষা ও পরিবেশগত ব্যবধান সমূহ অতিক্রম করে বক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট শ্রোতার পর্যায়ে এবং গুণগতভাবে যতো বেশী সম্ভব বক্তার কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। এ কারণেই , সে যুগের যে সব যথোপযুক্ত ব্যক্তি কোরআন মজীদকে সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে শুনে অনুধাবন করেন সেভাবে বোঝার জন্য এ যুগের মানুষকে অনেক কিছু অধ্যয়ন করে জ্ঞানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থান-কালে উপনীত হতে হবে এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় বুঝতে হলে আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে সব ছ্বাহাবী তাঁর সর্বাধিক কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন এ সব দিক থেকে শ্রোতা বা পাঠককে তাঁদের স্তরে উন্নীত হতে হবে।

অন্যদিকে কোনো অনারব ব্যক্তিকে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই তৎকালীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের ওপর সে যুগের কবি-সাহিত্যিক-বাগ্মীদের সমপর্যায়ের দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। কোরআন মজীদের পাঠক-পাঠিকা এ সব ক্ষেত্রে যেদিক থেকেই যতোখানি পশ্চাদপদ হবেন সেদিক থেকেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য তাঁর নিকট পর্যায়গত দিক থেকে ততোখানি নিম্নতর মাত্রায় প্রকাশিত হবে। এ-ও এক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ , তবে তা বাঞ্ছিত মাত্রা ও পর্যায়ের অবতরণ নয়।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ নীচের উদাহরণটি প্রযোজ্য হতে পারে :

অঙ্কশাস্ত্রের একজন ডক্টরেট , একজন মাস্টার ডিগ্রীধারী , একজন গ্রাজুয়েট , একজন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী - এদের প্রত্যেকেই অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাদের অঙ্কজ্ঞানের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডক্টরেটের জ্ঞানের তুলনায় মাস্টার ডিগ্রীধারীর জ্ঞান নিম্নতর ....। অথবা অন্যভাবে বলা যায় , ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে অঙ্কজ্ঞান দিয়েছেন - যা লাভ করে ঐ ছাত্র মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছেন তা মাত্রাগত দিক থেকে ঐ শিক্ষকের সমপর্যায়ের অঙ্কজ্ঞান নয় , বরং পর্যায়গত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী পর্যন্ত ক্রমেই নীচে নেমে এসেছে।

এ ব্যাপারে সম্ভবতঃ নিম্নোক্ত উপমাটি অধিকতর উপযোগী :

মানব প্রজাতির ইতিহাসের জ্ঞান বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। কোনো ইতিহাসবিশারদের জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে যতো বেশী হবে ও গুণগত দিক থেকে যতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হবে তাঁর জ্ঞান ততো উচ্চতর স্তরের এবং যার জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার বিচারে যতো কম হবে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান অপেক্ষাকৃত ততো নিম্নতর স্তরের হবে।

আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে , কোনো জাতির বা সমগ্র মানব প্রজাতির ভাগ্য নির্ধারণে কেবল বড় বড় ব্যক্তিত্ব ও বড় বড় ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয় , বরং একান্তই মামূলী ধরনের মানুষের দৈনন্দিন অরাজনৈতিক কাজ ও ছোট ছোট ঘটনাও ইতিহাসের বড় ধরনের গতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

শুধু মানুষের ভূমিকা নয় , ইতর প্রাণীর ভূমিকা , এমনকি জড় বস্তুর অবস্থাও এ ব্যাপারে প্রভাবশালী হতে পারে। ইতিহাসে এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। পাথরে আঘাত লেগে ঘোড়ার পা ভেঙ্গে গিয়ে সেনাপতি বা রাজার পড়ে গিয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। লেডি যোশেফাইনের দুর্ব্যবহার জনিত মানসিক অশান্তি নেপোলিয়ান বোনাপার্টির যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো বলে জানা যায়। এমনকি বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার প্রতিক্রিয়াও যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে , ফিলিপাইনে একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর ফলে বাংলাদেশে ঝড় হতে পারে। অতএব , কোনো সাধারণ মানুষকে , এমনকি কোনো ইতর প্রাণীকে একটি পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের কারণ হতে পারে। সুতরাং মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে যিনি মানব প্রজাতির সূচনা থেকে শুরু করে মানুষ , প্রাণীকুল , উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ; এরূপ জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই রয়েছে।

এবার এমন একজন কাল্পনিক ইতিহাসবিদের কথা ধরা যাক যিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন এবং বর্তমান যুগে জ্ঞান আহরণের যে সব অত্যুন্নত উপায়-উপকরণ আছে (যেমন : কৃত্রিম উপগ্রহ , ইন্টারনেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি) শুরু থেকেই তিনি সে সবের অধিকারী , তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়রূপে বেশী। কিন্তু বলা বাহুল্য যে , এরূপ ইতিহাসজ্ঞানী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি জড় পদার্থের ভিতর ও বাইরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। অতএব , মানবপ্রজাতির গোটা ইতিহাস সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের তুলনায় তাঁর জ্ঞান হবে খুবই নিম্ন মানের , যদিও আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে উঁচু মানের।

এখন এ ধরনের কাল্পনিক ইতিহাস বিজ্ঞানী যদি আমাদের যুগের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জ্ঞান দিতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ বছরে আহরিত জ্ঞান তাঁকে হুবহু প্রদান করা সম্ভব হবে না , বরং সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন করে এ জ্ঞান দিতে হবে। ধরুন একাধারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় না করে কেবল প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে প্রথমোক্ত ব্যক্তির তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। এভাবে এ জ্ঞান পর্যায়ক্রমে সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন হয়ে একটি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে মানবপ্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান দেয়া হয় তার অবস্থা চিন্তা করুন। এভাবে প্রতিটি স্তরেই একটি বিষয়ের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পরিমাণগত , মানগত ও গুণগত দিক থেকে নীচে নেমে আসছে ; একেই বলে জ্ঞানের নুযূল্ ঘটা।

কোরআন মজীদের জ্ঞান স্থানগত , কালগত ও গ্রহণকারীর মানগত দিক থেকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে যতো দূরে এসেছে ততোই তার মান নীচে নেমেছে। এভাবে তার বিভিন্ন স্তরের অবতরণ বা নিম্নগমন (নুযূল) ঘটেছে। আর , আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন জ্ঞানে এবং আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানগত ও মানগত দিক থেকে নিজেকে যতোই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবেন ততোই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কোরআন-জ্ঞান ও তাঁর কোরআন-জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। শুধু তা-ই নয় , পরবর্তীকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হওয়ার ফলে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মজলিসে হাযির থেকে কোরআন শ্রবণকারীদেরও অনেকের তুলনায় ঐ ব্যক্তির কোরআন-জ্ঞান বেশী হবে। অবশ্য যারা আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে ইল্হামের অধিকারী হয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছেন - তা তাঁরা যে যুগেরই হোন না কেন , তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্

একই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , কোরআন বিষয়ক পণ্ডিতগণ ও মুফাসসিরগণের অনেকের অভিমত অনুযায়ী , কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য ও সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম যাহেরী তাৎপর্য হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে সর্বজনীনভাবে কোরআন মজীদ থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হতো তা-ই। কিন্তু কোরআন মজীদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ থেকে আরো বহু বাহ্যিক তাৎপর্য বেরিয়ে এসেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে সব তাৎপর্য এমনই বিস্ময়কর যা অতীতে কল্পনাও করা যেতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ২৬১ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।

বলা বাহুল্য যে , এ আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে যা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য (যাহের্) থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যেই একটি তথ্য ও একটি ভবিষ্যদ্বাণীও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।

উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উপমা দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন খেজুর ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর পিছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে ; হয়তো বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে , তবে অন্ততঃ উপরোক্ত তথ্য বা ভবিষ্যদ্বাণী যে তার অন্যতম উদ্দেশ্য তাতে সন্দেহ নেই ।

অবশ্য কোরআন মজীদের নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাগণ উক্ত আয়াতের প্রথম যাহের্ বা প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিকট হয়তো এটি এ আয়াতের একমাত্র বাহ্যিক তাৎপর্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে , এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যে শুধু আল্লাহর পথে দানের শুভ প্রতিফলই বর্ণনা করা হয় নি , বরং একটি বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্য ও ভবিষ্যদ্বাণীও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক কোরআন-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও মুফাসসির মনে করেন।

একইভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন : সমগ্র কোরআন মজীদের অন্যতম বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিলোক অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিলোক এবং এর সকল কর্মকাণ্ড। কোরআন মজীদ তার নিজের ভাষায়تبيانا لکل شيء (সকল কিছুর সুবর্ণনা) - এ থেকে তা-ই বুঝা যায়। কারণ ,کل شيء (প্রতিটি জিনিস) বলতে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাকী থাকে না।

অবশ্য এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের অবস্থা এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে ও কোরআন মজীদ নাযিল্-কালে যা কিছু অনিবার্যভাবে ও শর্তাধীনে ঘটিতব্য ছিলো তার সবই তাতে নিহিত ছিলো ও রয়েছে , আর ঘটিতব্যগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে ও অবশ্যই ঘটবে। এ কারণেই লাওহে মাহ্ফূয্ তথা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কিতাবুম্ মুবীন (সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ)। আর আমাদের কাছে যে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন রয়েছে তা হচ্ছে উক্ত কোরআনেরই নুযূলপ্রাপ্ত (অবতরণকৃত তথা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে আসা) রূপ।

কোরআন মজীদের আরেক বাত্বেন হলেন স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)। কারণ , তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত রূপ। রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর জীবন কেমন ছিলো ? -এ প্রশ্নের জবাবে বলা হলো : তোমরা কি কোরআন পড়ো নি ? এর মানে শুধু এ নয় যে , কোরআন পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর চরিত্র ও জীবনধারা জানা যাবে , বরং এর মানে হচ্ছে সমগ্র কোরআন মজীদে তিনি প্রতিফলিত। ফলে যিনি কোরআন মজীদের সাথে পরিচিত হলেন তিনি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সাথেই পরিচিত হলেন এবং কোরআন মজীদকে যতোটুকু জানলেন স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ততোটুকু জানতে পারলেন।

অবশ্য কারো যেন এরূপ ধারণা না হয় যে , হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দৈনন্দিন পার্থিব জীবন অর্থাৎ তিনি কোনদিন কখন কী খেলেন , কখন ঘুমালেন , কখন কোথায় গেলেন ইত্যাদি কোরআন মজীদের গভীর অধ্যয়ন থেকে বিস্তারিত ও পুরোপুরি জানা যাবে। কারণ , মানুষকে এ সব বিষয় জানানো ঐশী কালামের উদ্দেশ্য হতে পারে না , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে ছোট-বড় এবং গ্রহণীয়-বর্জনীয় যা কিছু শিক্ষণীয় ছিলো তার সবই কোরআন মজীদ থেকে জানা যাবে। আর হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) , অন্যান্য নবী-রাসূল ( আঃ) , এমনকি কাফের-মোশরেবকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ঘটনা কোরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে সবে নিহিত শিক্ষা পৌঁছে দেয়া।

লাওহে মাহফূযে ও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদে সকল কিছুর বর্ণনা এভাবেই নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও কোরআন মজীদের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকে সকল কিছু খুটিনাটি সহ সব কিছুই , প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি কর্ম , এমনকি যার মধ্যে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় কিছু নেই তা সহ , আল্লাহর জ্ঞানে প্রতিফলিত। কিন্তু কোরআন মজীদে অর্থাৎ লাওহে মাহফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় কেবল করণীয় ও বর্জনীয় এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি-অবনতিতে প্রভাব বিস্তারক বিষয়াদির জ্ঞান ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী নিহিত রাখা হয়েছে বলে মনে হয় (নিশ্চিত জ্ঞান স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার কাছে)।

কোরআন মজীদের গভীরতম বাত্বেন্ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা। কারণ , কোরআন মজীদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। অতএব , তাঁর পক্ষে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বরং কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর কাজের মাধ্যমে তাঁকে জানা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কাজের সাথে যিনি যতো বেশী পরিচিত তিনি ততো বেশী মাত্রায় স্বয়ং আল্লাহ তা আলার সাথে পরিচিত।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সৃষ্টি , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সৃষ্টি ও লাওহে মাহফূযে বা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যার নুযূলপ্রাপ্ত বা মানের অবতরণকৃত রূপ হচ্ছে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন।

অতএব , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার মহান সত্তার অস্তিত্বের তাজাল্লী - তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। অর্থাৎ কোরআন মজীদে যা কিছু আছে তার সব কিছু মিলে এক মহাসত্যের সাক্ষ্য বহন করছে , সে মহাসত্য হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা।

কোরআন মজীদে নাসেখ্ ও মানসূখ্

কোরআন মজীদের বিধিবিধানে স্ববিরোধিতার অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীরা কোরআন মজীদের ঐশী কিতাব না হওয়ার দাবী করে এ গ্রন্থের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সম্ভবতঃ সর্বাধিক গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে এ গ্রন্থে বিভিন্ন স্ববিরোধী আহ্কামের উপস্থিতি। তাদের দাবী , কোরআনে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে একই বিষয়ে একাধিক হুকুম রয়েছে - যা থেকে প্রমাণিত হয় যে , কোরআন আল্লাহর কিতাব নয়।

এ অভিযোগটির বিশেষ গুরুত্ব এখানে যে , কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য অভিযোগ খণ্ডনে অনেক ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ও মুফাসসিরে কোরআন এগিয়ে এলেও এবং অভিযোগগুলো অকাট্যভাবে খণ্ডন করলেও এ অভিযোগটি খণ্ডনে কদাচিৎ কেউ এগিয়ে এসেছেন। বরং দু একজন ব্যতিরেকে প্রায় সকল মুফাসসির ও ইসলাম-বিশেষজ্ঞই প্রকারান্তরে এ অভিযোগের যথার্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন।

কোরআন মজীদে এমন কতক আয়াত রয়েছে যাতে দেখা যায় যে , দৃশ্যতঃ একটি আয়াতে কোনো বিষয়ে একটি হুকুম নাযিল্ হয়েছে , কিন্তু অপর একটি আয়াতে একই বিষয়ে তা থেকে ভিন্ন হুকুম নাযিল্ হয়েছে। ওলামা ও মুফাসসিরীনে কোরআন এ ধরনের হুকুমসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়ে নাসেখ্ ও মানসূখ্ -এর প্রবক্তা হয়েছেন। তাঁরা দাবী করেছেন যে , এ ধরনের হুকুমগুলোর মধ্যে একটি হুকুম দ্বারা অন্যটি মানসূখ্ বা রদ্ হয়েছে। এর ভিত্তিতে তাঁরা , তাঁদের দৃষ্টিতে , বহাল থাকা হুকুমটিকে নাসেখ্ (রহিতকারী) ও রদ্ হয়ে যাওয়া হুকুমটিকে মানসূখ্ (রহিতকৃত) হিসেবে অভিহিত করেছেন।

কোরআন মজীদ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ আসমানী কিতাব - স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা যা হেফাযতের অর্থাৎ অবিকৃত রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ; এটা আমাদের ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে কোরআন মজীদে আহ্কামের ক্ষেত্রে দৃশ্যতঃ যে সব স্ববিরোধিতা রয়েছে সে সম্পর্কে ওলামা ও মুফাসসিরীনে কোরআনের এ ব্যাখ্যা মুসলমানরা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ জবাব কোরআন-বিরোধীদের আপত্তিকে খণ্ডন করতে সক্ষম হয় নি।

বিষয়টির এহেন গুরুত্ব বিবেচনায় এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

নাসেখ্-মানসূখের ভিত্তি ও প্রকরণ

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , স্বয়ং কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে আয়াত মানসূখ্ করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি কোনো আয়াতকে তার চেয়ে অধিকতর উত্তম বা তার অনুরূপ (আয়াত্) আনয়ন ব্যতীত রহিত করে দেই না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)

ইতিপূর্বে আমরা আমাদের আলোচনায় বলেছি যে , এ আয়াতে মূলতঃ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের পাঠ রহিতকরণ ও অনেক বিধান রহিতকরণ বা পরিবর্তনকরণের বিরুদ্ধে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু দু একজন ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকল মুফাসসির্ ও ইসলামী মনীষীই এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছেন এবং এ আয়াতের লক্ষ্য কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে নাসেখ্ ও মানসূখ্ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের অভ্যন্তরে দুই ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ কার্যকর হয়েছে :

এক ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ হচ্ছে এই যে , এক সময় কোনো হুকুম সম্বলিত কোনো আয়াত নাযিল্ হয়েছে , কিন্তু পরে তার তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হয়ে গিয়েছে , ফলে কোরআন মজীদের লিখিত পাঠে আর তা বর্তমান নেই , কিন্তু তার হুকুম বহাল রয়ে গিয়েছে। আরেক ধরনের নাসেখ্ ও মানসূখ্ হচ্ছে এই যে , এক সময় কোনো বিষয়ে একটি হুকুম সম্বলিত আয়াত নাযিল্ হয়েছে , পরে একই বিষয়ে ভিন্ন হুকুম সম্বলিত অন্য আয়াত নাযিল্ হয়েছে এবং এর ফলে প্রথমোক্ত আয়াতটির হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে , কিন্তু তার তেলাওয়াত্ বহাল রয়েছে।

অন্যদিকে ব্যতিক্রম হিসেবে যে দু একজন মুফাসসির্ ও ইসলাম-গবেষক উপরোক্ত মতের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের না কোনো আয়াতের পাঠ (তেলাওয়াত্) রহিত হয়েছে , না কোনো আয়াতের হুকুম রহিত হয়েছে। বিশেষ করে কোনো আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের মত হচ্ছে এই যে , কোরআন নাযিল্ সমাপ্ত হবার পর থেকে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত বিশ্বের মুসলমানদের নিকট যে অভিন্ন কোরআন মজীদ রয়েছে তার বাইরে কোনো কিছু কোরআনের আয়াত হিসেবে কখনোই নাযিল্ হয় নি , অতএব , এরূপ কোনো আয়াতের তেলাওয়াত্ মানসূখ্ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

অন্যদিকে যারা কোরআন মজীদের আয়াতের তেলাওয়াত্ বা হুকুম মানসূখ্ হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা বেশ কিছু সংখ্যক আয়াতের হুকুমকে মানসূখ্ গণ্য করেন। ফলে যারা সংশ্লিষ্ট হুকুমগুলোকে মানসূখ্ গণ্য করেনে না তাঁদের ও এদের মধ্যে ঐ সব আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণ ও শর ঈ হুকুম বয়ানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যায়। আর বিষয়টি যেহেতু কেবল চিন্তা ও আক্বীদাহর সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বরং বাস্তব আচরণ ও আমলের সাথে জড়িত সেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে গভীর ও যথাসম্ভব বিস্তারিত পর্যালোচনা করে নির্ভুল উপসংহারে উপনীত হওয়া অপরিহার্য প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

আয়াত্ ও আহ্কামের নাসখের সম্ভাব্যতা

আয়াত্ ও আহ্কামের মানসূখ্ হওয়ার সম্ভাব্যতার বিষয়টি দু 'টি পর্যায়ে আলোচনার দাবী রাখে। প্রথমতঃ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাবার পর থেকে শুরু করে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল আয়াত্ ও আহ্কাম্ আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে কোরআন মজীদও শামিল রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ বিশেষভাবে কোরআন মজীদ আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।

প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের মত হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত আয়াত্ ও আহ্কাম্ মানসূখ্ বা রহিত হওয়া সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে এই যে , আয়াত্ ও আহ্কাম্ রহিতকরণ বা তাতে পরিবর্তন সাধন আয়াত্ নাযিলকারী ও বিধানদাতার দুর্বলতার পরিচায়ক। কারণ , তা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও ভ্রান্তি নির্দেশ করে। আর আল্লাহ্ তা আলা এ ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত।

বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা আলার আয়াত্ ও আহ্কামের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁদের ধারণার অস্পষ্টতার ওপর তাঁদের এ যুক্তি প্রতিষ্ঠিত।

আল্লাহ্ তা আলা যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির নিকট যে ওয়াহী নাযিল্ করেছেন তা মানুষের ভাষায়ই নাযিল্ করেছেন। ফলে আল্লাহ্ তা আলার নিকট তাঁর ওয়াহী সমুন্নততম ভাবসমৃদ্ধ হলেও মানুষের নিকট অবতরণের ক্ষেত্রে তা সংশ্লিষ্ট ভাষার সীমাবদ্ধতার দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাষার প্রকাশক্ষমতার মধ্যে যেমন পার্থক্য দেখা যায় তেমনি একই ভাষার বিকাশেরও বিভিন্ন স্তর দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , আল্লাহ্ তা আলার ওয়াহী , আয়াত্ বা কিতাব মানুষের কাছে পৌঁছলে যে নাযিল্ হওয়া অর্থাৎ অবতরণ করা বা নীচে নামা বলা হয় তার মানে বস্তুগত অর্থে উঁচু স্থান থেকে নীচু জায়গায় নেমে আসা নয় , বরং এ অবতরণ গুণগত , ভাবগত ও তাৎপর্যগত। অর্থাৎ পরম প্রমুক্ত অসীম সত্তা আল্লাহ্ তা আলার ভাব যখন সসীম সত্তা বিশিষ্ট মানুষের অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের (আঃ) নিকট পৌঁছে তখন তা স্বাভাবিকভাবেই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতার বৈশিষ্ট্য লাভ করে এবং যখন তা মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা হয় তখন তা আরো সীমাবদ্ধতা লাভ করে। এ ক্ষেত্রে মানগত ও তাৎপর্যগত যে অবনতি ঘটে তা-ই হচ্ছে নুযূল্ (অবতরণ)।

এমতাবস্থায় একই ভাষায় খোদায়ী ওয়াহী ভাষাটির বিকাশের প্রাথমিক স্তরে নাযিল্ হওয়ার পর তার বিকাশের উন্নততর স্তরে পুনরায় নাযিল্ হওয়া ও পূর্ববর্তী সংস্করণ রহিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ , ভাষার প্রকাশক্ষমতার উন্নততর স্তরে এসেও প্রাথমিক স্তরের ভাষায় খোদায়ী আয়াত্ বা কিতাব বিদ্যমান থাকলে তার ভাষাগত নিম্নমান মানুষের মনে আল্লাহ্ তা আলার প্রকাশক্ষমতা সম্বন্ধে অথবা সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের ওয়াহী হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে একই কারণে উন্নততম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষার বিকাশের চরমতম পর্যায়ে সে ভাষায় খোদায়ী ওয়াহী বা কিতাব নাযিল্ হওয়ার পর ঐশী কিতাবের অন্যান্য ভাষায় নাযিলকৃত পূর্ববর্তী সংস্করণসমূহ রহিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

এ ধরনের নাসখ (রহিতকরণ) দুইভাবে হতে পারে : পূর্ববর্তী আয়াত্ ও কিতাব সমূহে বিকৃতি সাধিত হওয়া বা মূল ভাষা থেকে হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তথা মানবিক গতিধারায় অথবা পরবর্তীতে নাযিলকৃত আয়াত্ বা কিতাবের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে অথবা উভয় পন্থায়। আমরা প্রথম পন্থাটিকে প্রাকৃতিক পন্থা নামে অভিহিত করতে পারি।

দ্বিতীয় পন্থায় রহিতকরণের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তা হচ্ছে , পরবর্তীতে নাযিলকৃত ওয়াহীকে 'ওয়াহী ' বলে যাদের অন্তরে প্রত্যয় সৃষ্টি না হবে তারা পূর্ববর্তী ওয়াহীকে মানসূখ্ (রহিত) বলে মানবেন না। অতএব , এ ক্ষেত্রে প্রথম পন্থাই হচ্ছে নিশ্চিতভাবে কার্যকর পন্থা। আর এটা অকাট্য সত্য যে , প্রথম পন্থায় কোরআন মজীদের পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহ রহিত হয়ে গেছে। কারণ , নিশ্চিতভাবেই ঐ সব কিতাব মূল ভাষায় বর্তমান নেই ; বিদ্যমান (অনূদিত বা ভাষান্তরিত) প্রতিটি কিতাবেই ব্যাপকভাবে বিকৃতি প্রবেশ করেছে ও প্রতিটিরই একাধিক সংস্করণ আছে। এমনকি যে সব নবী-রাসূলের ( আঃ) নামে ঐ সব কিতাব প্রচলিত আছে তাঁরাই যে ঐ সব কিতাব উপস্থাপন করেছিলেন এটা প্রত্যয় উৎপাদনকারী মানবিক পন্থায় প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ সংশ্লিষ্ট নবীর ( আঃ) সময় থেকে মুতাওয়াতির্ সূত্রে তা বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অ্যদিকে কোরআন মজীদ যে ঐ সব নবী-রাসূলের ( আঃ) নিকট সংশ্লিষ্ট কিতাব সমূহ নাযিল্ হওয়ার কথা বলেছে তাকে এ ক্ষেত্রে দলীল হিসাবে পেশ করা যাবে না। কারণ , তা মানবিক দলীল নয়। এ দলীলকে দলীল হিসাবে ব্যবহার করতে হলে কোরআন মজীদকে আল্লাহ্ তা আলার কিতাব হিসাবে স্বীকার করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে ঐ সব কিতাবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও কোরআন মজীদের বক্তব্য মেনে নিতে হবে। অতএব , দেখা যাচ্ছে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ মানসূখ্ হয়েছে প্রাকৃতিকভাবেই এবং কোরআন মজীদও তা মানসূখ্ হবার কথা বলেছে।

অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ উভয় পন্থায়ই মানসূখ্ হয়েছে।

এবার আসা যাক আহ্কাম্ প্রসঙ্গে।

ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের দাবী হচ্ছে , যেহেতু বিধানদাতা তাঁর দুর্বলতার বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই বিধানে পরিবর্তন করেন , অতএব , খোদায়ী বিধানে পরিবর্তন হতে পারে না। (তাঁদের এ যুক্তি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে পূর্বতন কিতাব সমূহ রহিত হলেও নতুন কিতাবে পূর্বতন বিধানসমূহই অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।)

তাঁদের পক্ষ থেকে এ যুক্তি উপস্থাপনের কারণ হচ্ছে , তাঁরা বিভিন্ন ধরনের বিধানের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টিদানে ব্যর্থ হয়েছেন।

সকল আহ্কাম্ বা বিধিবিধানকে আমরা এক বিবেচনায় দুই ভাগে ভাগ করতে পারি : অপরিহার্য ও আপেক্ষিক। অপরিহার্য বিধিবিধান হচ্ছে মানুষের সৃষ্টি-প্রকৃতির দাবী , অতএব , তাতে পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। নৈতিক বিধিবিধান এবং মানুষের জন্য শারীরিক , মানসিক বা নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর এমন খাদ্যবস্তু ও কাজকে হারামকরণ এ পর্যায়ভুক্ত।

অন্যদিকে যে সব বিধিবিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক কারণ বিদ্যমান নেই , বরং বিধানদাতার ইচ্ছাই তার একমাত্র নিয়ামক সে সব বিধিবিধানকে আমরা সামগ্রিকভাবে আপেক্ষিক বিধিবিধান বলে অভিহিত করতে পারি। এর মধ্যে কতগুলো বিধিবিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে আনুগত্য পরীক্ষা করা। ইবাদত-বন্দেগীর বিধিবিধান এ পর্যায়ের। এর কোনো অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক মানদণ্ড নেই , বরং বিধানদাতা যে কোনো হুকুম জারী করে বান্দাহর আনুগত্য পরীক্ষা করতে পারেন। তাই তিনি চাইলে পূর্ববর্তী হুকুম রহিত করে নতুন হুকুম জারী করতে পারেন।

এ পর্যায়ের অন্যান্য বিধিবিধানের লক্ষ্য হচ্ছে পার্থিব জীবনে মানুষের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা। এতে স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্রভেদে সর্বোচ্চ কল্যাণের মানদণ্ড বিভিন্ন হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে বিধানদাতার পক্ষ থেকে তিন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করা যায় : হয় তিনি মানবজাতির সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিধান শুরুতেই প্রদান করবেন , অথবা প্রতিটি নতুন পরিস্থিতি উদ্ভবের সাথে সাথে নতুন বিধান পাঠাবেন ও যে বিধানের পরিস্থিতি বিলুপ্ত হয়েছে সে বিধান বিলোপ করবেন , অথবা এমন কিছু মূলনীতি ও পথনির্দেশ প্রদান করবেন যার ভিত্তিতে মানুষ স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্রভেদে প্রয়োজনীয় বিধান উদ্ঘাটন করবে।

আমরা সামান্য চিন্তা করলেই বুঝতে পারি যে , প্রথম প্রক্রিয়াটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল অবস্থার সকল মানুষের জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রের বিস্তারিত বিধান প্রণয়ন করা হলে তা হতো এতোই ব্যাপক যে , বিশেষ করে প্রাথমিক যুগের মানুষের পক্ষে তার মধ্য থেকে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বিধানসমূহ খুঁজে বের করা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি যুক্তিসঙ্গত হলেও মানবসভ্যতার বিকাশ , মানবজাতির ব্যাপক বিস্তৃতি ও জীবনযাত্রার জটিলতার যুগে এ প্রক্রিয়া মানুষের জন্য তেমন একটা উপযোগী হতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে সর্বক্ষণ বহু নবীর মাধ্যমে নতুন নতুন বিধান জারী ও পুরনো বিধান রহিতকরণের বিষয়টি এতোই ব্যাপক আকার ধারণ করতো যে , তাতে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়তো। তাছাড়া নবীকে নবী হিসাবে চিনতে পারা-নাপারা ও স্বীকার করা-নাকরার ভিত্তিতে এ জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতো। অন্যদিকে মানবজাতি প্রথম দিকে জ্ঞান ও সভ্যতার বিচারে যে পর্যায়ে ছিলো তাতে তাদের পক্ষে তৃতীয় প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হওয়া অর্থাৎ মূলনীতি ও পথনির্দেশের সহায়তায় বিস্তারিত বিধান উদঘাটন করা সম্ভব ছিলো না।

এমতাবস্থায় যা স্বাভাবিক তা হচ্ছে , (1) মানবজাতির বিকাশ-বিস্তারের একটি পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিকট এবং প্রয়োজনে যুগে যুগে বিস্তারিত বিধিবিধিান প্রেরণ , পুনঃপ্রেরণ এবং তাতে প্রয়োজনীয় রদবদল ও সংশোধন , (2) অতঃপর মানবজাতির বিকাশের একটি সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে স্থায়ীভাবে কতক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান প্রদান যাতে মানুষের বিভিন্ন অবস্থার বিবেচনা থাকবে এবং কতক ক্ষেত্রে মূলনীতি ও পথনির্দেশ প্রদান - যার ভিত্তিতে স্থান , কাল , পরিস্থিতি ও পাত্র বিবেচনায় বিস্তারিত বিধান উদঘাটন করা হবে।

বিভিন্ন ধর্ম , ধর্মগ্রন্থ ও নবী-রাসূলগণের ( আঃ) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই , প্রকৃত পক্ষে এরূপই হয়েছে। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে নবী-রাসূলগণের ( আঃ) আগমন ঘটেছে। তাঁদের মাধ্যমে অপরিবর্তনীয় বিধিবিধানের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জাতির জন্য বিস্তারিত আপেক্ষিক বিধিবিধানও নাযিল্ হয়েছিলো , তবে তার কার্যকারিতা ছিলো সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) এর মাধ্যমে চিরস্থায়ী বিধিবিধান নাযিল্ হয় - যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কার্যকর ও অপরিবর্তিত থাকবে। তবে পূর্ববর্তী বিধিবিধানের সাথে এ সব বিধিবিধানের বৈশিষ্ট্যগত প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এই যে , এতে একদিকে যেমন বিস্তারিত বিধিবিধানে মানুষের বিভিন্ন অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে , অন্যদিকে মানবজীবনের অনেকগুলো বিরাট ক্ষেত্রের জন্য বিস্তারিত বিধানের পরিবর্তে মূলনীতি ও দিকনির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

আমাদের এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , সাময়িকভাবে বিধিবিধান জারী করা এবং পরে তা রহিত করে স্থায়ী বিধিবিধান জারী করায় মহান বিধানদাতার প্রজ্ঞা ও বান্দাহদের প্রতি তাঁর কল্যাণেচ্ছারই প্রকাশ ঘটেছে।

এখানে আরো দু টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের প্রামাণ্যতাই যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় এবং কার্যতঃ যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই ঐ সব কিতাব মানসূখ্ হয়ে গেছে সেখানে ঐ সব কিতাবের বর্তমান বিকৃত সংস্করণসমূহে যে সব বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো যে মূল কিতাবের বিধান এবং তা পরিবর্তিত , বিকৃত ও সংযোজিত নয় - তার নিশ্চয়তা কোথায় ? এমতাবস্থায় কোরআনের বিধানের সাথে তার যে পার্থক্য তা কি পূর্ববর্তী বিধানের রহিতকরণনির্দেশক , নাকি বিকৃতিনির্দেশক সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে পূর্ববর্তী কতক বিধান যে রহিত করা হয়েছে তা কোরআন মজীদ থেকেই জানা যায়। আর তা যে সম্ভব এবং বিধানদাতার প্রজ্ঞার পরিচায়ক তা আমরা প্রমাণ করেছি।

দ্বিতীয়তঃ খোদায়ী বিধান পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের নিকট বিদ্যমান বর্তমান গ্রন্থাবলীতেও রয়েছে। যেমন : বাইবেলের পুরাতন নিয়ম -এর গণনা পুস্তক -এর 4র্থ অধ্যায়ের 1-3 নং পদে লেভী-বংশীয়দের মধ্যকার তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্কদের জন্য সমাগম তাঁবুতে সেবাকর্ম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু একই পুস্তকের 8ম অধ্যায়ের 23-25 নং পদে এ কাজের জন্য 25 থেকে 50 বছর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধরনের আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। সুতরাং , ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের পক্ষে নাসখ্ অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

অতএব , কোরআন মজীদ নাযিলের পর্যায়ে পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ মানসূখ্ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই মানবতার কল্যাণ নিহিত ছিলো। তাই আল্লাহ্ তা আলা ঐ সব কিতাব মানসূখ্ হওয়ার ব্যাপারে আহলে কিতাবের আপত্তির জবাবে এরশাদ করেন :

) م َا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا(

আমি অধিকতর উত্তম বা অনুরূপ কিছু পেশ না করে কোনো আয়াৎকে রহিত করি না বা ভুলিয়ে দেই না। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 106)

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের বক্তব্যসমূহ সমমানে বা অধিকতর উত্তম মানে কোরআন মজীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং যে সব বিধিবিধান ও দিকনির্দেশ তাতে ছিলো না অথচ বর্তমানে বা ভবিষ্যতে প্রয়োজন তা-ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে এমন অনেক বক্তব্য রয়েছে যা সংক্ষেপেও কোরআন মজীদে স্থান পায় নি ; এর কি ব্যাখ্যা থাকতে পারে ? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে এ সত্যটি স্মরণ করতে হবে যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের কোনোটিই নাযিলকালীনরূপে অবিকৃতভাবে বিদ্যমান নেই।

ঐ সব কিতাবের প্রায় সবগুলোতেই আল্লাহর কালামের সাথে সংশ্লিষ্ট নবী-রাসূলের ( আঃ) কথা ও কাজের বর্ণনা এবং গ্রন্থসংকলকদের নিজেদের বক্তব্য যোগ করা হযেছে। ঐ সব গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে যে কারো নিকটই তা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে । বস্তুতঃ কোরআন মজীদ যে অর্থে আল্লাহর কিতাব সে অর্থে ঐ সব কিতাবকে কিছুতেই আল্লাহর কিতাব বলা চলে না , বরং ঐ সব কিতাবকে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনীগ্রন্থের সাথে তুলনা করা চলে যা অ-নবী লেখক কর্তৃক রচিত , তবে তাতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কোরআন মজীদের কিছু আয়াত্ ও কিছু হাদীছ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কোরআন মজীদ যখন নাসখের কথা বলেছে তখন মূল কিতাবের কথাই বলেছে এবং নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী মূল কিতাবসমূহের চিরস্থায়ী গুরুত্বের অধিকারী সব বক্তব্যই কোরআন মজীদে স্থান পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ করা যেতে পারে যে , কোরআন মজীদ ভুলিয়ে দেয়া র কথা বলে প্রাকৃতিক পন্থায় নাসখের কথা বলেছে। একই সাথে সরাসরি নাসখ্ -এর কথা বলা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে , পূর্ববর্তী কিতাব সমূহ হারিয়ে গেলেও (ব্যাপক বিকৃতি অর্থে) সে সব কিতাবের ব্যাপক বিকৃতির কারণে ঐ সব আয়াতের কার্যকারিতা অব্যাহত রাখার পরিবর্তে অনুরূপ বা তার চেয়ে উত্তম নতুন আয়াত্ পেশ করার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত ছিলো।


11

12

13

14

15

16

17

18