কোরআন মজীদের ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা
ঐশী গ্রন্থ হিসেবে দাবীকৃত সকল গ্রন্থের মধ্যে একমাত্র কোরআন মজীদেরই ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা রয়েছে। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)ই যে ঐশী কিতাব হিসেবে দাবী করে এ কিতাব মানুষের সামনে পেশ করেছেন - এ বিষয়ে কোনোরূপ ঐতিহাসিক বিতর্ক বা সংশয় নেই।
যে সব (অমুসলিম) পণ্ডিত-গবেষক হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে আল্লাহর নবী বলে মনে করেন না , বরং বিরল প্রতিভাধর মহাজ্ঞানী বলে মনে করেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে করেন না ; তাঁরা এ মহাগ্রন্থকে স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক রচিত বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই যে , বর্তমানে প্রচলিত কোরআন মজীদই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কিতাব ; এ কিতাব পরবর্তীকালে কেউ রচনা করে তাঁর ওপর নাযিলকৃত কিতাব বলে চালিয়ে দেয় নি। তাছাড়া সারা দুনিয়ায় এ গ্রন্থের একটিই মাত্র সংস্করণ প্রচলিত আছে। কোথাও যদি কোনো মুদ্রণে কোনোরূপ সামান্যতম ছাপার ভুলও ঘটে , তো সাথে সাথে কেউ না কেউ সে ভুল নির্দেশ করেন এবং পূর্ব থেকে চলে আসা মুছ্ব্হাফ্ (কোরআন মজীদের কপি)-এর সাথে মিলিয়ে নিয়ে তা সংশোধন করে নেয়া হয়।
সর্বসম্মত মত অনুযায়ী , কোরআন মজীদ দীর্ঘ তেইশ বছরে অল্প অল্প করে নাযিল হয় এবং যখন যতোটুকু নাযিল হয় সাথে সাথেই তা লিপিবদ্ধ ও সমকালীন বহু মুসলমান কর্তৃক মুখস্ত করা হয়। কিন্তু যে ধারাক্রমে তা নাযিল হয় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশক্রমে তা থেকে ভিন্ন এক বিন্যাসে গ্রন্থাবদ্ধ ও মুখস্ত করা হয়। যখনই কোনো সূরাহ্ বা আয়াত নাযিল্ হয় তখনই তিনি তাঁর ওয়াহী লেখকদেরকে ও অন্যান্য ছ্বাহাবীকে জানিয়ে দেন যে এ সূরাহ্ বা আয়াতের অবস্থান ইতিপূর্বে নাযিলকৃত কোন্ সূরাহ্ বা কোন্ আয়াতের আগে বা পরে হবে।
কোরআন মজীদ এ বিন্যাসেই লেখা হয় , ছ্বাহাবীগণ মুখস্ত করেন এবং হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) ও তাঁর ছ্বাহাবীগণ তেলাওয়াত্ করেন। এভাবে দীর্ঘ তেইশ বছরে এ কাজ সমাপ্ত হয়। হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের প্রায় তিন মাস আগে বিদায় হজ্বের সময় কোরআন মজীদের সর্বশেষ আয়াত নাযিল হয় এবং সাথে সাথেই পুরো কোরআন মজীদ লিখিতভাবে ও শত শত হাফেয্ ছ্বাহাবীর স্মৃতিতে অভিন্ন বিন্যাসে গ্রন্থাকারে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়।
কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণের কাজ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতী যিন্দেগীর শুরুতেই মক্কাহ্ নগরীতেই শুরু হয়। তখন ছ্বাহাবীদের মধ্যে যারা লেখাপড়া জানতেন তাঁরা যখনই কোরআন মজীদের কোনো সূরাহ্ বা আয়াত নাযিল হতো তখনই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশিত অবস্থান অনুযায়ী লিখে রাখতেন। ফলে এর বিন্যাসে মুহূর্তের জন্যও কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি , কেবল ধীরে ধীরে এর আয়তনই বৃদ্ধি পেয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মক্কাহ্ নগরীতে থাকাকালেই যে ছ্বাহাবীগণ লিখিত কোরআন পাঠ করতেন এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য ও দৃষ্টান্তও রয়েছে।
হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) মক্কাহ্ থেকে মদীনায় হিজরত করার পর স্বাভাবিকভাবেই কোরআন মজীদের আয়তন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর সেই সাথে সেখানে কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণ ও মুখস্তকরণের কার্যক্রম ব্যাপকবিস্তৃত রূপ লাভ করে। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) তাঁর ছ্বাহাবীদেরকে লিখন-পঠন শিক্ষা দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ; এমনকি ছ্বাহাবীদেরকে লিখন-পঠন শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে তিনি যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করে দেয়ার কার্যক্রমও গ্রহণ করেন। আর এভাবে যে সব ছ্বাহাবী লেখাপড়া শিক্ষা করেন তাঁদের এ অক্ষরজ্ঞান কাজে লাগাবার প্রধান ক্ষেত্র , বরং বলা চলে যে , একমাত্র ক্ষেত্র ছিলো কোরআন মজীদ কপিকরণ ও তা থেকে দেখে দেখে পাঠকরণ। এই সাথে মুখস্তকরণের কার্যক্রম অধিকতর ব্যাপকভাবে চলতে থাকে।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবদ্দশায় যারা কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধকরণের কাজ করতেন তাঁদেরকে“
কাতেবে ওয়াহী”
বলা হতো ; বিভিন্ন সূত্রে এ ধরনের 45 জন কাতেবে ওয়াহী ছ্বাহাবীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর জীবদ্দশায়ই পুরো কোরআন মুখস্ত করেছিলেন এমন 23 জন ছ্বাহাবীর নাম উল্লেখ আছে।
ফলতঃ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের পর কিছুদিনের মধ্যেই পুরো কোরআন মুখস্তকারী ছ্বাহাবীর সংখ্যা শত শত জনে দাঁড়ায়। অতঃপর পুরো কোরআন মুখস্তকারীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে এবং তৃতীয় খলীফাহর যুগ পর্যন্ত পুরো কোরআন মুখস্তকারী (হাফেযে কোরআন)-এর সংখ্যা হাজার হাজারে উপনীত হয়।
এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে , রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) যে পুরো কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখে গিয়েছিলেন এ ব্যাপারে কোনোরূপ দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। এমতাবস্থায় তাঁর রেখে যাওয়া মুছ্বহাফ্ (কোরআনের কপি) , ছ্বাহাবীগণের অনেকের লিখিত ব্যক্তিগত মুছ্বহাফ্ এবং তাঁর জীবদ্দশায় পুরো কোরআন মুখস্তকারী হাফেযগণের হেফয মিলিয়ে পুরো কোরআন মজীদ তাঁর ইন্তেকালের পরে সাথে সাথে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুতাওয়াতির্ সূত্রে পরবর্তী লোকদের কাছে কাছে পৌঁছে যায় - যে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। শুধু তা-ই নয় , রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) ইন্তেকাল-পরবর্তী লোকদের কাছে তাঁর রেখে যাওয়া পুরো কোরআন নির্ভুলভাবে পৌঁছার ব্যাপারে ছ্বাহাবীদের মধ্যে যে মতৈক্য (ইজমা‘
) ছিলো - এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ করার মতোও কোনো অকাট্য তথ্য পাওয়া যায় না। এ ইজমা‘
র কারণেই , খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পুরো কোরআন মুখস্তকারী হাজার হাজার হাফেযে কোরআন গড়ে ওঠেন , অথচ কোরআনের পাঠ ( text) সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে সামান্যতমও মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় নি।