কোরআনের মুতাওয়াতির্ হওয়া প্রশ্নে সংশয় উপস্থাপন
কোরআন মজীদকে সংকলিত ও গ্রন্থাবদ্ধ করণ সংক্রান্ত হাদীছ সমূহকে বক্তব্যের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় এবং এ দুই ধরনের হাদীছের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা রয়েছে। এক ধরনের হাদীছের বক্তব্য হচ্ছে তা-ই যা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে , কোরআন নাযিল্ হওয়ার সূচনাকাল থেকেই হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কতক ছ্বাহাবীকে নাযিলকৃত আয়াত ও সূরাহ্ সমূহ লিপিবদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন এবং নতুন নাযিলকৃত সূরাহ্ ও আয়াতসমূহ পূর্বে নাযিলকৃত সূরাহ্ ও আয়াতসমূহের মধ্যে কোথায় স্থান দেয়া হবে অর্থাৎ কোন্ সূরাহ্ বা আয়াতের আগে ও কোন্ সূরাহ্ বা আয়াতের পরে স্থান দিতে হবে তা তিনি নিজেই বলে দিতেন। ফলে এভাবেই কোরআন মজীদ বর্তমান বিন্যাসে লিপিবদ্ধ করা হয়। এভাবে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জন্য কোরআন মজীদের একটি কপি (মুছ্বহাফ্) প্রস্তুত করা হয় যেটিকে বর্তমানকালীন পরিভাষায়‘
সরকারী কপি’
বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কোরআন মজীদ যে এভাবে সংকলিত ও গ্রন্থাবদ্ধ হয় সে ব্যাপারে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মতৈক্য ছিলো।
দ্বিতীয় ধরনের হাদীছগুলোর বক্তব্য এর সাথে সাংঘর্ষিক। কতক স্বল্পসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত (খব্রে ওয়াহেদ্) হাদীছ অনুযায়ী - যা রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের দুই শতাধিক বছর পরে সংকলিত হয় - হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের কিছুদিন পরে প্রথম খলীফাহ্ হযরত আবূ বকরের নির্দেশে ছ্বাহাবী যায়দ বিন্ ছ্বাবেত্ কোরআন মজীদ সংকলন করেন। বলা হয় যে , ছ্বাহাবীদের যার কাছে যে সব লিখিত বা মুখস্তকৃত আয়াত ও সূরাহ্ ছিলো তা ঐ ছ্বাহাবীর কাছে নিয়ে আসতে বলা হয় এবং যে কারো আনীত সূরাহ্ বা আয়াতের গ্রহণযোগ্যতার জন্য কমপক্ষে দু’
জন সাক্ষী নিয়ে আসার শর্তারোপ করা হয়।
বলা হয় যে , এ শর্তারোপের ফলে কতক ছ্বাহাবী কর্তৃক কোরআন মজীদের আয়াত হিসেবে দাবী করে উপস্থাপিত কতক বক্তব্য নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ বিতর্কে শেষ পর্যন্ত , দু’
জন সাক্ষী হাযির না করে আয়াত হিসেবে দাবী করে আনীত বক্তব্যসমূহ কোরআন মজীদের সংকলনে বাদ পড়ে যায় । এ থেকে সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে , এর ফলে কতক প্রকৃত আয়াতও বাদ পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। তেমনি এ ধরনের রেওয়াইয়াত্-ও আছে যাতে বলা হয়েছে যে , কোরআন মজীদের শেষ দু’
টি সূরাহ্ (সূরাহ্ আল্-ফালাক্ব্ ও সূরাহ্ আন্-নাস্) কোরআন মজীদের অংশ কিনা এ ব্যাপারে কোনো কোনো ছ্বাহাবীর সন্দেহ ছিলো। দাবী করা হয়েছে যে , একজন বিখ্যাত ছ্বাহাবী বলতেন যে , এ দু’
টি সূরাহ্ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওপর কোরআন মজীদের অংশ হিসেবে নয় , বরং ব্যক্তিগতভাবে পঠনীয় দো‘
আ হিসেবে নাযিল হয়েছিলো। এছাড়া কোনো কোনো ছ্বাহাবীর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে যে , অমুক সূরাহ্টি গ্রন্থাবদ্ধ কোরআনে যে আয়তনের রয়েছে রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে তার আয়তন এর চেয়ে অনেক বড় ছিলো।
এ সব হাদীছের ভিত্তিতে ইসলামের দুশমনরা , বিশেষ করে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণের অনেকে কোরআন মজীদে বিকৃতি নেই জেনেও মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সংকলনকালে কোরআনে কম-বেশী হয়েছে বলে দাবী করে থাকেন।
এ সব হাদীছ যে সম্পূর্ণ মিথ্যা তা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী যে কোনো লোকের কাছে সাদা দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। কারণ , একদিকে কোরআন মজীদ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত গ্রন্থ - যা ইসলাম বিরোধী পণ্ডিতরা-ও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা কোরআন মজীদকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করেন না , কিন্তু কতক ব্যতিক্রম বাদে তাঁদের সকলেই স্বীকার করেন যে , কোরআন মজীদ নবী করীম (ছ্বাঃ) যেভাবে রেখে গিয়েছেন ঠিক সেভাবেই আছে। ইসলামের পুরো ইতিহাসে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে এ গ্রন্থের একটিমাত্র সংস্করণ থাকাও এরই প্রমাণ বহন করছে।
অন্যদিকে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে প্রাথমিক যুগ থেকেই এ ব্যাপারে মতৈক্য রয়েছে যে , স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ) নিজ তত্ত্বাবধানে কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করার জন্য কতক ছ্বাহাবীকে কাতেবে ওয়াহী (ওয়াহী লিপিবদ্ধকারী) নিয়োজিত করেছিলেন এবং তাঁরা তাঁর উপস্থিতিতেই প্রতিটি সূরাহ্ ও আয়াত লিপিবদ্ধ করে তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী এ গ্রন্থের যথাস্থানে স্থান দিয়েছিলেন। এভাবে তাঁর জীবদ্দশায়ই কোরআন মজীদের একটি সরকারী কপি তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়াও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে পুরো কোরআন লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং অনেকে মুখস্ত করেছিলেন।
এ ব্যাপারেও ইসলামী উম্মাহর মধ্যে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই মতৈক্য রয়েছে যে , নবী করীম (ছ্বাঃ) নিয়মিতই সংশ্লিষ্ট সময় পর্যন্ত নাযিল হওয়া কোরআন মজীদ সংশ্লিষ্ট বিন্যাস অনুযায়ী তেলাওয়াত করতেন। ফলে তাঁর ইন্তেকালের পূর্বেই পুরো কোরআন মজীদের একটিমাত্র অভিন্ন পাঠ ও হুবহু অনুরূপ লিপিবদ্ধ বেশ কিছুসংখ্যক কপি বিদ্যমান ছিলো - যার মধ্যে তাঁর নিজ তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধকৃত সরকারী কপি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু যে সব খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছে প্রথম খলীফাহর শাসনামলে কোরআন সংকলন ও গ্রন্থাবদ্ধ করা হয় বলে দাবী করা হয়েছে সে সব হাদীছে এর কোনো উল্লেখই নেই। কারণ , তা উল্লেখ করা হলে কথিত একজন ছ্বাহাবীর দ্বারা কোরআন সংকলন ও গ্রন্থাবদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও উপযোগিতাই থাকে না। কারণ , স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের সরকারী কপির এবং তাঁর জীবদ্দশায় কতক ছ্বাহাবীর লিখিত কপিসমূহ ও কতক ছ্বাহাবীর মুখস্তকৃত অভিন্ন কোরআন থাকা অবস্থায় প্রথম খলীফাহর পক্ষে নতুন করে কোরআন সংকলনের উদ্যোগ নেয়ার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন আদৌ সম্ভব ছিলো না। নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপিকে উপেক্ষা করে এভাবে নতুন করে কোরআন সংকলনের উদ্যোগ নিলে , বিশেষ করে মাত্র দু’
জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কোরআনের আয়াত প্রমাণের শর্ত রাখা হলে তাঁর বিরুদ্ধে দস্তুরমতো কোরআন ও রাসূলের (‘
আঃ) প্রতি অবমাননার অভিযোগ উঠতো এবং তাঁকে উৎখাত ও হত্যার জন্য একটি মোক্ষম কারণ তৈরী হয়ে যেতো। কিন্তু কোনো সূত্রেই প্রথম খলীফাহর বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার কথা পাওয়া যায় না।
সূতরাং এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই যে , প্রথম খলীফাহর শাসনামলে কোরআন মজীদ নতুন করে সংকলনের কোনো ঘটনাই সংঘটিত হয় নি। বরং এতদসংক্রান্ত যতো হাদীছ আছে তার সবগুলোই মিথ্যা। মূলতঃ ছ্বাহাবীদের নামে বর্ণিত এ সব খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ হাদীছ-সংকলকগণ কর্তৃক সংকলিত করার সময় পর্যন্ত দুই শতাধিক বছরকালের মধ্যে অনেকগুলো স্তর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এ সব স্তরের মধ্যে যে কোনো স্তরে এ সব হাদীছ মিথ্যা রচনা করে রচনাকারীরা তাদের পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে এগুলো শুনেছে বলে মিথ্যা দাবী করে বর্ণনার ধারাক্রম ছ্বাহাবীদের পর্যন্ত পৌঁছিয়েছিলো।
অন্যদিকে কতক বর্ণনা রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের কতক মুনাফিক্ব্ কর্তৃকও দেয়া হয়ে থাকতে পারে - যারা বাহ্যতঃ ঈমানের ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে শামিল হয়ে গিয়েছিলো এবং নিজেদেরকে ছ্বাহাবী হিসেবে পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) কাছ থেকে আরো কিছু আয়াত শুনেছিলো বলে দাবী করেছিলো।
হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক নিজ তত্ত্বাবধানে লিপিবদ্ধকৃত কোরআন মজীদের কপি বর্তমান থাকা সত্ত্বেও প্রথম খলীফাহ্ কর্তৃক কোরআন সংকলন ও লিপিবদ্ধ করানোর যৌক্তিকতা কী ? এ প্রশ্নের জবাবে অনেকে বলেন যে , যেহেতু নবী করীম (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদের যে কপি লিখিয়ে রেখে যান তা তৎকালে কাগয দুর্লভ ছিলো বিধায় কাগযের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার্য বিভিন্ন আকার ও উপাদানের বস্তুতে লেখা হয়েছিলো। এগুলো ইট , পাথর , চামড়া , হাড্ডি ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর ওপর লেখা ছিলো। এ কারণে , ব্যবহারের সুবিধার কথা চিন্তা করে কোরআন মজীদ অভিন্ন উপাদান ও আকারের উন্নততর বস্তুর ওপরে লেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বস্তুতঃ এ ধরনের ব্যাখ্যা হচ্ছে এক ধরনের খোঁড়া যুক্তি। কারণ , ব্যবহারের সুবিধার কথা চিন্তা করে কোরআন মজীদ অভিন্ন উপাদান ও আকারের উন্নততর বস্তুর ওপরে লেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকলে সে জন্য নতুন করে লোকদের কাছ থেকে দু’
জন সাক্ষীর সাক্ষ্য সহ আয়াত আহবানের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। সে ক্ষেত্রে নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকে এক বা একাধিক লিপিকারের দ্বারা অভিন্ন উপাদান ও আকারের উন্নততর বস্তুর ওপরে এক বা একাধিক কপি লেখানোই যথেষ্ট ছিলো।
মোট কথা , প্রথম খলীফাহর শাসনামলে কোরআন মজীদ নতুন করে সংকলন ও লিপিবদ্ধকরণের দাবী মিথ্যা কল্পকাহিনী বৈ নয়।
প্রথম খলীফাহর শাসনামলে কোরআন মজীদ সংকলনের ধারণাটি একটি বহুলপ্রচারিত বিষয় এবং এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুদীর্ঘলালিত বিশ্বাস পরিত্যাগ করা অনেকের পক্ষেই কঠিন অনুভূত হতে পারে । এ ধারণার সপক্ষে বহু হাদীছ রয়েছে। কিন্তু এ হাদীছগুলোর সবই খবরে ওয়াহেদ্ পর্যায়ের। আর খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ্ ছ্বহীহ্ হওয়ার ব্যাপারে‘
আক্ব্ল্ , কোরআন মজীদ , মুতাওয়াতির্ হাদীছ ও ইসলামের প্রথম যুগ থেকে চলে আসা উম্মাহর মতৈক্যের বিষয়গুলোর কোনোটিরই বরখেলাফ না হওয়ার শর্তে কেবল গৌণ (মুস্তাহাব্ ও মাকরূহ্) ব্যাপারে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এবং ফরয নয় এমন‘
ইলমী ক্ষেত্রে ইয়াক্বীন্ সৃষ্টিকারী হতে পারে।
সুতরাং উপরোক্ত শর্তে কোরআন মজীদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ সহায়ক হতে পারে , কিন্তু কোরআন প্রমাণের ক্ষেত্রে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে না। কারণ , তা কোরআন মজীদের ভিত্তির ওপর দুর্বলতা আরোপ করে তথা তা কোরআন মজীদের ওপর সংশয় আরোপের সমার্থক। আর কোরআন মজীদ যেহেতু সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ বর্ণনা সেহেতু কোরআন মজীদের অকাট্যতা ও নির্ভুলতা এবং সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে সংশয় বা দুর্বলতা আরোপ হতে পারে এমন বক্তব্য সম্বলিত কোনো বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং এ ধরনের বক্তব্য যদি ছ্বাহাবীদের নামে , এমনকি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নামেও বর্ণিত হয় তো নিঃসন্দেহে তা পরবর্তীকালে মিথ্যা রচনা করে তাঁর বা তাঁদের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
যারা এ সব হাদীছকে প্রত্যাখ্যানে দ্বিধান্বিত তাঁদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের পিছনে দু’
টি কারণ নিহিত বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , প্রথমতঃ বর্ণিত ঘটনাটি প্রথম খলীফাহর শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তেমনি এ কাজকে প্রথম খলীফাহর ও যে ছ্বাহাবীর নাম কোরআন মজীদের সংকলক হিসেবে উল্লেখ করা হয় হয় (যায়েদ্ বিন্ ছাবেত্) তাঁর মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। দ্বিতীয়তঃ বহু বিখ্যাত হাদীছ সংকলন ও তাফসীর গ্রন্থে এ সব হাদীছ উদ্ধৃত হয়েছে। এ সব হাদীছকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করলে তা তাঁদের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার হানি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা জাগতে পারে।
কিন্তু এ ধরনের আশঙ্কা পুরোপুরি অমূলক। কারণ , কোরআন মজীদকে সংকলিত ও গ্রন্থাবদ্ধকরণের কথিত ঘটনা বাদ দিলেও সংশ্লিষ্ট ছ্বাহাবীদের গুরুত্ব ও গুরত্বপূর্ণ অবস্থানের তেমন একটা হেরফের হবে না। অন্যদিকে যে সব মুফাসসির ও হাদীছ-সংকলক সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও এতদসংশ্লিষ্ট হাদীছ সমূহ বর্ণনা করেছেন তাঁদের প্রত্যেকে আরো শত শত ঘটনা ও হাজার হাজার হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এ থেকে দু’
একটি ঘটনা ও এতদসংশ্লিষ্ট হাদীছ সমূহ প্রত্যাখ্যাত হলে তাতে তাঁদের মর্যাদা খুব একটা হ্রাস পাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া তাঁদের কেউই ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতার উর্ধে ছিলেন না এবং তাঁরা নিজেরাও নিজেদেরকে ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতার উর্ধে বলে দাবী করেন নি । তাই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করা সত্ত্বেও তাঁদের সংকলিত হাদীছগ্রন্থ সমূহে ও তাঁদের লিখিত তাফসীরগ্রন্থ সমূহে কিছু অসত্য ঘটনা এবং জাল , বিকৃত ও দুর্বল হাদীছ স্থানলাভ করা অসম্ভব নয়। এ কারণে তাঁদের মেধাপ্রতিভা , নিষ্ঠা ও ইখলাছ্ব সম্বন্ধে সন্দেহ হবার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাত ও সংশ্লিষ্ট হাদীছ-সংকলন সমূহের সংকলনকালের মধ্যে কালগত ব্যবধানের (কমপক্ষে দু’
শ’
বছরের) কারণে এ ধরনের ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
তবে এ প্রসঙ্গে অনেকের কাছে অবাঞ্ছিত মনে হলেও‘
ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। তা হচ্ছে: হাদীছ সংকলকগণও এ সত্যটি স্বীকার করেন যে , রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাত ও হাদীছ সংকলনের মধ্যবর্তী সুদীর্ঘকালীন ব্যবধানে অসংখ্য মিথ্যা হাদীছ তৈরী হয়। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব মানদণ্ডে বিচার করে অনেক হাদীছকে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং যেগুলোকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন সেগুলোকে নিজ নিজ সংকলনে স্থান দিয়েছেন।
কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে , তাঁরা নিজেরা ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতার উর্ধে ছিলেন না। ফলে তাঁদের হাদীছ পরীক্ষার মানদণ্ড পুরোপুরি নিখুঁত ও নির্ভুল ছিলো না। বিশেষ করে তাঁরা বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতার ওপরে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু দীর্ঘ দুই শতাধিক বছরের সবগুলো স্তরের সকল বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে অকাট্য জ্ঞানে উপনীত হওয়া সম্ভব ছিলো না।
অন্যদিকে প্রচলিত সংজ্ঞায় ছ্বাহাবীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর সময়কার মুনাফিক্বদেরকেও শামিল করা হয় (কোরআন মজীদের উক্তি অনুযায়ী যাদের সংখ্যা ছিলো অনেক এবং তিনি নিজেও যাদের অনেকের নেফাক্বের কথা জানতেন না) , আর অন্ধ ভক্তিবশতঃ ছ্বাহাবীদের আমলের প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার ফলে মুনাফিক্বদেরকে প্রকৃত ছ্বাহাবী থেকে পৃথক করা হয় নি। ফলে বর্ণনাকারীদের যে কোনো স্তরে মিথ্যা হাদীছ রচনা অসম্ভব ছিলো না।
এছাড়া হাদীছ সংকলকগণ মূলতঃ সংগ্রাহক ছিলেন , জ্ঞানগবেষক ছিলেন না। এ কারণেই তাঁরা ছ্বাহাবী স্তরে কম সূত্রে বর্ণিত (খবরে ওয়াহেদ) হাদীছ পরীক্ষার ক্ষেত্রে অকাট্য চার দলীল অর্থাৎ‘
আক্বল্ , কোরআন , মুতাওয়াতির্ হাদীছ এবং উম্মাহর অভিন্ন আচরণ ও মতের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তের প্রতি দৃষ্টি দিতে ব্যর্থ হন। তাই সংকলকদের দ্বারা ছ্বহীহ্ হিসেবে চিহ্নিত হাদীছ সমূহের মধ্যে অনেক জাল হাদীছ থেকে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
বস্তুতঃ বিচারবুদ্ধির রায় এবং কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে নীতিগতভাবেই উপরোক্ত চার দলীলের যে কোনোটির সাথে সাংঘর্ষিক বা কোরআন মজীদের নির্ভুলতায় সংশয় আরোপকারী যে কোনো বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। কারণ , অকাট্য দলীলের মোকাবিলায় এ ধরনের দুর্বলতাযুক্ত দলীল সর্বজনীন বিচারবুদ্ধি কখনোই গ্রহণ করে না। তাছাড়া এ সব হাদীছ কেবল ইসলামের দুশমনদের দ্বারা কোরআন মজীদ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে না , বরং এ সব হাদীছের মধ্যে বহু স্ববিরোধিতা রয়েছে এবং এগুলোর মোকাবিলায় এমন কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয় যার জবাব এ সব হাদীছ থেকে পাওয়া যায় না।
মোদ্দা কথা , সর্বজনস্বীকৃত মতের দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কোরআন মজীদকে বর্তমান বিন্যাসে লিখিয়েছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিকে ছ্বাহাবীদের সামনে পুরো কোরআন মজীদ উক্ত বিন্যাস অনুযায়ী তেলাওয়াত করেছেন। সুতরাং অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে , কোরআন মজীদ তাঁর ইন্তেকালের পূর্বেই পুরোপুরি ও সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত হয়েছিলো , ছড়ানো-ছিটানো বা অবিন্যস্ত ছিলা না। আর গ্রন্থাবদ্ধকরণ বলতে পুরোটা সুবিন্যস্তভাবে লিপিবদ্ধকরণকেই বুঝায়। সুতরাং প্রথম খলীফাহর নির্দেশে কোরআন মজীদ নতুন করে গ্রন্থাবদ্ধকরণের প্রশ্নই ওঠে না।
আসলেই , এটা কী করে সম্ভব যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কর্তৃক কোরআন মজীদ লিপিবদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করানো সম্বন্ধে প্রথম খলীফাহ্ সহ শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীদের জানা থাকবে না এবং নতুন করে কোরআন সংকলনের উদ্যোগ নেয়ার পর তা বিরোধিতার সম্মুখীন হবে না ?
অবশ্য একটি সম্ভাবনা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারতো , তা হচ্ছে , প্রথম খলীফাহ্ হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের কপি থেকে নিজের জন্য একটি সহজব্যবহার্য কপি করাতে পারতেন এবং এ কাজে ছ্বাহাবী যায়দ বিন্ ছাবেত্ অথবা অন্য এক বা একাধিক ছ্বাহাবীকে লিপিকার নিয়োজিত করতে পারতেন। কিন্তু বর্ণিত হাদীছসমূহে এমন কোনো কথা বলা হয় নি , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ) কর্তৃক কোরআন বিন্যস্ত ও লিপিবদ্ধকরণ তথা গ্রন্থাবদ্ধ করানোর কথা বেমালূম্ ভুলে গিয়ে কোরআন মজীদকে প্রথম বারের মতো সংগ্রহ ও গ্রন্থাবদ্ধকরণের দাবী করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মানবিক বিচারবুদ্ধি সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যে অকাট্য উপসংহারে উপনীত হয় তা হচ্ছে , প্রথম দুই খলীফাহর আমলে কোরআন মজীদের যে সব কপি তৈরী হয়েছিলো তার মধ্য থেকে কতক কপি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকে এবং কতক কপি যে সব ছ্বাহাবীর কাছে পুরো কোরআনের কপি ছিলো তাঁদের কপি থেকে অনুলিখন করা হয়েছিলো। এছাড়াও অনেকে পুরো কোরআনের হাফেযগণের কাছ থেকে শুনে কপি করে থাকবেন। অবশেষে তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত‘
উছ্মানের নির্দেশে সরকারীভাবে কোরআন মজীদের বেশ কিছু সংখ্যক কপি করা হয় - যার অনুলিপি বর্তমানে আমাদের হাতে রয়েছে ; এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , এ সব কপি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকেই অনুলিপি করা হয়ে থাকবে।
যে সব হাদীছকে হাতিয়ার বানিয়ে ইসলামের দুশমনরা কোরআন মজীদের অবিকৃত থাকার ব্যাপারে সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে সেগুলোকে ছ্বহীহ্ গণ্য করা এবং গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা এক আত্মঘাতী কর্মনীতি বৈ নয়। বিশেষ করে এ ধরনের গোঁজামিলের ব্যাখ্যা কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধি ও মুক্ত বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তাছাড়া এ সংক্রান্ত হাদীছের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে বিতর্ক ছিলো এবং রয়েছে। এগুলোর যথার্থতা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারে মুফাসসিরীন , মুজতাহিদীন ও ওলামায়ে মুতাক্বাদ্দিমীনের মধ্যে মতপার্থক্য ছিলো। এমতাবস্থায় এগুলোকে ছ্বহীহ্ বলে দাবী করে গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়ে ব্যাখ্যা করলে কোরআন-বিরোধীরা তথা ইসলামের দুশমনরা এ সব হাদীছের“
ছ্বহীহ্”
সার্টিফিকেটকে গ্রহণ করে কোরআনের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে , কিন্তু এগুলোর গোঁজামিলের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করবে না। এভাবে তারা কোরআন মজীদের অকাট্যতা ও নির্ভুলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কোরআন মজীদের ওপর মুসলমানদের ঈমানকে বিনষ্ট করে দেবে। সুতরাং এ ধরনের হাদীছের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করা কোরআন মজীদের ভিত্তিকে ধ্বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করার নামান্তর।
সুতরাং , বিচারবুদ্ধির রায় অনুযায়ী , মানব জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত মহাগ্রন্থ কোরআন মজীদের অবিকৃত ও সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশংয় সৃষ্টি করে এমন যে কোনো হাদীছকে মিথ্যা গণ্য করে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এ প্রত্যাখ্যানের জন্য এগুলোর কোরআন-বিরাধী হওয়াই যথেষ্ট ; এ সব হাদীছকে অন্য কোনো মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার আদৌ প্রয়োজন নেই ; এ ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে করাও কোরআন মজীদের ওপরে ঈমানে দুর্বলতার পরিচায়ক।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে , কোরআন মজীদের ঐশিতা এবং এর অকাট্যতা হচ্ছে ইসলামের উছূলে‘
আক্বাএদের তিনটি বিষয়ের অন্যতম। কারণ , অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাও‘
আত্ দিতে হলে কেবল সমগ্র মানবপ্রজাতির কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন মানদণ্ড বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)-এর মানদণ্ডেই দিতে হবে। আর তাওহীদ ও আখেরাত হচ্ছে এমন বিষয় যা যে কারো কাছে প্রমাণের জন্য কেবল‘
আক্বলী দলীলই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে কোনো নবীকে নবী হিসেবে চিনতে পারার জন্য সকলের কাছে‘
আক্বলী দলীল যথেষ্ট নয়। কারণ , কোনো ব্যক্তি যে সব তথ্য পর্যালোচনা করে একজন নবীকে নবী হিসেবে গ্রহণ করবে সে সব তথ্য তার কাছে নির্ভুলভাবে ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে পৌঁছার ব্যাপারটি স্থানগত , কালগত ও অন্যান্য কারণে সব সময় প্রত্যয় (ইয়াক্বীন্) সৃষ্টিকারী পর্যায়ের না-ও হতে পারে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘
আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল (ছ্বাঃ)কে এমন একটি মৃ‘
জিযাহ্ দিয়ে প্রেরণ করেন যার ই‘
জায্ (মু’
জিযাহর গুণ) ক্বিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। এ মু‘
জিযাহ্ হচ্ছে এর যে কোনো সূরাহর সাথে তুলনীয় একটি সূরাহ্ রচনা করে আনা। সুতরাং কেউ যদি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর জীবনচরিতের ব্যাপারে মিথ্যাবাদীদের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ও তথাপি কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জ তাকে কোরআনকে ঐশী গ্রন্থ বলে মানতে বাধ্য করতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে কোরআনের প্রতি ঈমানের কারণেই সে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতে ঈমান পোষণ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং প্রকারান্তরে ইসলামের উছূলে‘
আক্বাএদের তিনটি বিষয় হচ্ছে তাওহীদ , আখেরাত্ ও কোরআন মজীদ। তাই কোরআনের পরিচয়ের জন্য কেবল‘
আক্বলী দলীলই যথেষ্ট ; এ জন্য খবরে ওয়াহেদ্ বর্ণনাকে আদৌ আলোচনায় স্থান দেয়া যাবে না।