মুছ্বহাফে‘
উছমান্ চাপিয়ে দেয়ায় বিকৃতির সন্দেহ
কোরআন-বিরোধীরা তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত’
উছমান্ কর্তৃক কোরআন মজীদের অভিন্ন কপি - যা“
মুছ্বহাফে‘
ঊছ্মান্”
নামে পরিচিত - প্রচারের পদক্ষেপ গ্রহণকে বাহানা করে কোরআন মজীদে বিকৃতি ঘটে থাকতে পারে বলে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
সর্বজনগ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মুছ্বহাফে‘
ঊছ্মান্ প্রচারের ঘটনাটি ছিলো নিম্নরূপ:
হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের সরকারী কপি [ভিত্তিহীন তথ্য অনুযায়ী ছ্বাহাবী যায়েদ্ বিন্ ছাবেত্ কর্তৃক সংকলিত ও লিপিবদ্ধকৃত সরকারী কপি] থেকে এবং বিভিন্ন ছ্বাহাবী কর্তৃক লিপিবদ্ধকৃত ব্যক্তিগত কপি থেকে , সেই সাথে কোরআনের হাফেযগণের কাছ থেকে শুনে ব্যাপকভাবে কপি করা হয়। এভাবে কোরআন মজীদের বিপুল সংখ্যক কপি আরব উপদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকায় ও এর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের হাতে থাকা কতক কপিতে কিছু ছোটখাট ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে তাঁর পক্ষ থেকে আরব গোত্রসমূহকে স্থানীয় উচ্চারণে কোরআন পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। পরে অনেকে শ্রুতি থেকে স্থানীয় উচ্চারণেই কোরআন লিপিবদ্ধ করেন। এর ফলে অর্থের ক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিবর্তন না ঘটলেও কিছু কিছু শব্দের বানানে পার্থক্য ঘটে এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত উচ্চারণেও পার্থক্য দেখা যায়। এ সব উচ্চারণপার্থক্যকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়া-বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় এ ধরনের উচ্চারণপার্থক্য দূর করে কোরআন মজীদের অভিন্ন উচ্চারণ নিশ্চিতকরণ ও আঞ্চলিক উচ্চারণ বর্জিত করার লক্ষ্যে তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত’
উছমান্ শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তাঁদের সহায়তায় কোরআন মজীদের মূল সরকারী কপি থেকে কয়েকটি অনুলিপি তৈরী করিয়ে ইসলামী জাহানের সকল প্রশাসনিক কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন এবং সকলকে তাঁদের কাছে রক্ষিত কোরআন মজীদের নিজ নিজ কপির লিপি সরকারী কপির সাথে মিলিয়ে নিয়ে সংশোধন করার নির্দেশ দেন এবং সংশোধনযোগ্য নয় এমন বেশী বা বড় ধরনের ত্রুটিপূর্ণ কপিগুলো সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা হয়।
এভাবে কোরআন মজীদের ত্রুটিপূর্ণ কপিসমূহের ধ্বংসসাধন এবং সকলকে নিজ নিজ কপিকে সরকারী কপির অনুরূপ করে সংশোধন করতে বাধ্য করার বিষয়টিকে বাহানা করে অনেক পরবর্তীকালে ইসলামের দুশমনরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। তারা বুঝাতে চায় যে
,
খলীফাহ্
‘
উছ্মানের এ পদক্ষেপের পূর্বে কোরআন মজীদের অভিন্ন পাঠ
( text)ছিলো না
,
সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে
,
হযরত রাসূলে আকরাম
(
ছ্বাঃ
)
কোরআন মজীদের কোনো অভিন্ন লিখিত কপি রেখে যান নি। দ্বিতীয় যে কথাটি তারা বুঝাতে চায় তা হচ্ছে
,
খলীফাহ্
’
উছমান্ কর্তৃক প্রচারিত কপি কোরআনের তৎকালে প্রচলিত বিভিন্ন পাঠ সম্বলিত কপিসমূহের মধ্যকার একটি কপি মাত্র এবং সেটি যে
,
কোরআনের নির্ভুলতম কপি ছিলো তার কোনো প্রমাণ নেই
,
সুতরাং কোরআনে বিকৃতির শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। তারা তৃতীয় যে ধারণাটি তৈরী করতে চায় তা হচ্ছে
,
খলীফাহ্
’
উছমান্ কোরআন মজীদের অভিন্ন কপি চাপিয়ে দেয়ার আগে তাতে রদবদল করিয়ে থাকতে পারেন এবং এ কারণেই অর্থাৎ এ রদবদলকে চিরতরে চাপা দেয়ার লক্ষ্যে এর সাথে মিলবিহীন কপিগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেন।
বলা বাহুল্য যে , ইসলামের দুশমনদের , বিশেষ করে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে বড় করে তুলে ধরার পিছনে অজ্ঞতা নয় , বরং অসদুদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল। কারণ , তাদের ভালোই জানা ছিলো এবং আছে যে , খলীফাহ্’
উছমান্ কর্তৃক কোরআন মজীদে কোনো পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন ছিলো না এবং তা সম্ভবও ছিলো না। কারণ , এতে কোনোরূপ পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালালে তা তাঁর জন্য গুরুতর রকমের বিপজ্জনক ব্যাপার হতো। কারণ , এটা সর্বজনস্বীকৃত যে , ছ্বাহাবীগণ কোরআন মজীদকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসতেন। সেহেতু কোরআন মজীদের সরকারী কপি করার সময় কপিকারকগণ এতে মূল কপি থেকে পরিবর্তন সাধনে কিছুতেই সম্মত হতেন না , বরং তাঁরা খলীফাহর আদেশ অমান্য করতেন।
দ্বিতীয়তঃ এর পরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে , কোনো না কোনো কারণে কতক কপিকারক এ কাজে (কোরআনে রদবদল সাধনে) সহযোগিতা করেছিলেন তো সে ক্ষেত্রে যে সব ছ্বাহাবী স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে কোরআন মজীদের কপি করেছিলেন এবং তাঁদের কপি থেকে যারা কপি করেছিলেন তাঁরা কিছুতেই খলীফাহর এ ধরনের কোনো উদ্যোগকে নীরবে হযম করতেন না ; অবশ্যই তাঁরা কোরআনের খাতিরে কথিত এ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন এবং খলীফাহ্ তা না মানলে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন , এমনকি তাঁকে ও তাঁর লিপিকারদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করতেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে বিদ্রোহ তো দূরের কথা , প্রতিবাদের কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো বলেও জানা যায় না।
তৃতীয়তঃ যে সব শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবী রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) জীবদ্দশায় পুরো কোরআন লিপিবদ্ধ করেছিলেন [যেমন: হযরত‘
আলী (‘
আঃ)] তাঁদের কারো ব্যক্তিগত কপি খলীফাহ্‘
উছ্মানের সরকারী কপির সাথে মিলিয়ে সংশোধনের কোনো ঘটনা জানা যায় না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , এ সব কপি ও খলীফাহর সরকারী কপিার মধ্যে কোনোই পার্থক্য ছিলো না। সুতরাং খলীফাহর সরকারী কপিগুলো ছিলো হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশে লিপিবদ্ধকৃত কপির হুবহু অনুলিপি।
চতুর্থতঃ খলীফাহ্‘
উছ্মানের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর সাথে অনেক শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীর বিরোধ তৈরী হয়। সুতরাং খলীফাহর নির্দেশে কোরআন মজীদে পরিবর্তন সাধন করা হলে নিঃসন্দেহে তাঁরা এ কারণে খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। বিশেষ করে বীরত্ব , সাহসিকতা ও আপোসহীনতার জন্য সর্বজনখ্যাত হযরত‘
আলী (‘
আঃ) - কৌশলে যাকে তৃতীয় খলীফাহর পদ থেকে বঞ্চিত করে হযরত‘
উছ্মানকে খলীফাহ্ করা হয়েছিলো - কিছুতেই এ কাজ নীরবে হযম করতেন না।
কিন্তু কোরআন বিকৃত করার অভিযোগে খলীফাহর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন বলে কোনো সূত্রেই উল্লেখ করা হয় নি। এমনকি পরবর্তীকালে যারা তৃতীয় খলীফাহর বিরুদ্ধ প্রশাসনিক অযোগ্যতা ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করেন তাঁরাও তাঁর বিরুদ্ধে কোরআন মজীদে রদবদল সাধনের অভিযোগ তোলেন নি। নিঃসন্দেহে“
মুছ্বহাফে’
উছমান্”
নামে পরিচিত কোরআন মজীদের সরকারীভাবে প্রচারিত কপিতে সামান্যতম বিকৃতি বা রদবদল ঘটলেও বিদ্রোহীরা এটাকেই খলীফাহ্‘
উছ্মানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে তুলে ধরতেন , কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। বরং ছ্বাহাবীদের সকলেই কোরআন মজীদের এ সরকারী কপি প্রচারে সহযোগিতা করেন।
পঞ্চমতঃ তৃতীয় খলীফাহর দ্বারা কোরআনে বিকৃতি সাধিত হয়ে থাকলে হযরত‘
আলী (‘
আঃ) জনগণ কর্তৃক খলীফাহ্ নির্বাচিত হবার পর অবশ্যই সর্বত্র থেকে“
মুছ্বহাফে’
উছমান্”
ও তার অনুলিপিসমূহ সংগ্রহ করে ধ্বংস করে দিতেন এবং তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে কোরআনের যে কপি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার অনুলিপি প্রচার করতেন। কিন্তু তিনি এমন কিছু করেন নি।
সুতরাং এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে“
মুছ্বহাফে’
উছমান্”
ছিলো স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের হুবহু অনুলিপি।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , যে কোনো গ্রন্থই ব্যাপকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে হাতে কপি করতে গিয়ে কিছু লোকের কপিতে কিছু ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে সর্বজনস্বীকৃত তথ্য অনুযায়ী তৎকালে শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে নবী করীম (ছ্বাঃ) লোকদেরকে স্থানীয় উচ্চারণে কোরআন মজীদ পাঠ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং পরে তার শ্রুতি অনুসরণে যখন অনেকে তা লিপিবদ্ধ করেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকে কিছু পার্থক্য , বিশেষতঃ স্থানীয় উচ্চারণ অনুসরণজাত বানানের পার্থক্য ঘটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। এ কারণেই পরবর্তীকালে এ থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে এবং স্থায়ীভাবে কোরআন মজীদের কপির বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা বিধানের পদক্ষেপ নেয়া হয় তথা কোরআনের সকল কপিকে মূল কপির অনুবর্তী করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। আর ছ্বাহাবীগণ যেহেতু কোরআন মজীদের বিশুদ্ধতা রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন সেহেতু তাঁরা এর সরকারী কপির প্রচার এবং ত্রুটিপূর্ণ কপির সংশোধন ও প্রয়োজনে ধ্বংসসাধনের পদক্ষেপকে কেবল সমর্থনই করেন নি , বরং এর বস্তবায়নে সহায়তা করেন।