কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়0%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 21824
ডাউনলোড: 3383

কোরআনের পরিচয়
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 21824 / ডাউনলোড: 3383
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

মুছ্বহাফে উছমান্ চাপিয়ে দেয়ায় বিকৃতির সন্দেহ

কোরআন-বিরোধীরা তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত উছমান্ কর্তৃক কোরআন মজীদের অভিন্ন কপি - যা মুছ্বহাফে ঊছ্মান্ নামে পরিচিত - প্রচারের পদক্ষেপ গ্রহণকে বাহানা করে কোরআন মজীদে বিকৃতি ঘটে থাকতে পারে বলে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

সর্বজনগ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মুছ্বহাফে ঊছ্মান্ প্রচারের ঘটনাটি ছিলো নিম্নরূপ:

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের সরকারী কপি [ভিত্তিহীন তথ্য অনুযায়ী ছ্বাহাবী যায়েদ্ বিন্ ছাবেত্ কর্তৃক সংকলিত ও লিপিবদ্ধকৃত সরকারী কপি] থেকে এবং বিভিন্ন ছ্বাহাবী কর্তৃক লিপিবদ্ধকৃত ব্যক্তিগত কপি থেকে , সেই সাথে কোরআনের হাফেযগণের কাছ থেকে শুনে ব্যাপকভাবে কপি করা হয়। এভাবে কোরআন মজীদের বিপুল সংখ্যক কপি আরব উপদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকায় ও এর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের হাতে থাকা কতক কপিতে কিছু ছোটখাট ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে তাঁর পক্ষ থেকে আরব গোত্রসমূহকে স্থানীয় উচ্চারণে কোরআন পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। পরে অনেকে শ্রুতি থেকে স্থানীয় উচ্চারণেই কোরআন লিপিবদ্ধ করেন। এর ফলে অর্থের ক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিবর্তন না ঘটলেও কিছু কিছু শব্দের বানানে পার্থক্য ঘটে এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত উচ্চারণেও পার্থক্য দেখা যায়। এ সব উচ্চারণপার্থক্যকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে ঝগড়া-বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় এ ধরনের উচ্চারণপার্থক্য দূর করে কোরআন মজীদের অভিন্ন উচ্চারণ নিশ্চিতকরণ ও আঞ্চলিক উচ্চারণ বর্জিত করার লক্ষ্যে তৃতীয় খলীফাহ্ হযরত উছমান্ শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তাঁদের সহায়তায় কোরআন মজীদের মূল সরকারী কপি থেকে কয়েকটি অনুলিপি তৈরী করিয়ে ইসলামী জাহানের সকল প্রশাসনিক কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন এবং সকলকে তাঁদের কাছে রক্ষিত কোরআন মজীদের নিজ নিজ কপির লিপি সরকারী কপির সাথে মিলিয়ে নিয়ে সংশোধন করার নির্দেশ দেন এবং সংশোধনযোগ্য নয় এমন বেশী বা বড় ধরনের ত্রুটিপূর্ণ কপিগুলো সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা হয়।

এভাবে কোরআন মজীদের ত্রুটিপূর্ণ কপিসমূহের ধ্বংসসাধন এবং সকলকে নিজ নিজ কপিকে সরকারী কপির অনুরূপ করে সংশোধন করতে বাধ্য করার বিষয়টিকে বাহানা করে অনেক পরবর্তীকালে ইসলামের দুশমনরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। তারা বুঝাতে চায় যে , খলীফাহ্ উছ্মানের এ পদক্ষেপের পূর্বে কোরআন মজীদের অভিন্ন পাঠ ( text)ছিলো না , সুতরাং এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , হযরত রাসূলে আকরাম ( ছ্বাঃ ) কোরআন মজীদের কোনো অভিন্ন লিখিত কপি রেখে যান নি। দ্বিতীয় যে কথাটি তারা বুঝাতে চায় তা হচ্ছে , খলীফাহ্ উছমান্ কর্তৃক প্রচারিত কপি কোরআনের তৎকালে প্রচলিত বিভিন্ন পাঠ সম্বলিত কপিসমূহের মধ্যকার একটি কপি মাত্র এবং সেটি যে , কোরআনের নির্ভুলতম কপি ছিলো তার কোনো প্রমাণ নেই , সুতরাং কোরআনে বিকৃতির শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। তারা তৃতীয় যে ধারণাটি তৈরী করতে চায় তা হচ্ছে , খলীফাহ্ উছমান্ কোরআন মজীদের অভিন্ন কপি চাপিয়ে দেয়ার আগে তাতে রদবদল করিয়ে থাকতে পারেন এবং এ কারণেই অর্থাৎ এ রদবদলকে চিরতরে চাপা দেয়ার লক্ষ্যে এর সাথে মিলবিহীন কপিগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেন।

বলা বাহুল্য যে , ইসলামের দুশমনদের , বিশেষ করে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের পক্ষ থেকে এ বিষয়টিকে বড় করে তুলে ধরার পিছনে অজ্ঞতা নয় , বরং অসদুদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল। কারণ , তাদের ভালোই জানা ছিলো এবং আছে যে , খলীফাহ্ উছমান্ কর্তৃক কোরআন মজীদে কোনো পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন ছিলো না এবং তা সম্ভবও ছিলো না। কারণ , এতে কোনোরূপ পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালালে তা তাঁর জন্য গুরুতর রকমের বিপজ্জনক ব্যাপার হতো। কারণ , এটা সর্বজনস্বীকৃত যে , ছ্বাহাবীগণ কোরআন মজীদকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসতেন। সেহেতু কোরআন মজীদের সরকারী কপি করার সময় কপিকারকগণ এতে মূল কপি থেকে পরিবর্তন সাধনে কিছুতেই সম্মত হতেন না , বরং তাঁরা খলীফাহর আদেশ অমান্য করতেন।

দ্বিতীয়তঃ এর পরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে , কোনো না কোনো কারণে কতক কপিকারক এ কাজে (কোরআনে রদবদল সাধনে) সহযোগিতা করেছিলেন তো সে ক্ষেত্রে যে সব ছ্বাহাবী স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে কোরআন মজীদের কপি করেছিলেন এবং তাঁদের কপি থেকে যারা কপি করেছিলেন তাঁরা কিছুতেই খলীফাহর এ ধরনের কোনো উদ্যোগকে নীরবে হযম করতেন না ; অবশ্যই তাঁরা কোরআনের খাতিরে কথিত এ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেন এবং খলীফাহ্ তা না মানলে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন , এমনকি তাঁকে ও তাঁর লিপিকারদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করতেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে বিদ্রোহ তো দূরের কথা , প্রতিবাদের কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো বলেও জানা যায় না।

তৃতীয়তঃ যে সব শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবী রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) জীবদ্দশায় পুরো কোরআন লিপিবদ্ধ করেছিলেন [যেমন: হযরত আলী ( আঃ)] তাঁদের কারো ব্যক্তিগত কপি খলীফাহ্ উছ্মানের সরকারী কপির সাথে মিলিয়ে সংশোধনের কোনো ঘটনা জানা যায় না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , এ সব কপি ও খলীফাহর সরকারী কপিার মধ্যে কোনোই পার্থক্য ছিলো না। সুতরাং খলীফাহর সরকারী কপিগুলো ছিলো হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নির্দেশে লিপিবদ্ধকৃত কপির হুবহু অনুলিপি।

চতুর্থতঃ খলীফাহ্ উছ্মানের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর সাথে অনেক শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীর বিরোধ তৈরী হয়। সুতরাং খলীফাহর নির্দেশে কোরআন মজীদে পরিবর্তন সাধন করা হলে নিঃসন্দেহে তাঁরা এ কারণে খলীফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন। বিশেষ করে বীরত্ব , সাহসিকতা ও আপোসহীনতার জন্য সর্বজনখ্যাত হযরত আলী ( আঃ) - কৌশলে যাকে তৃতীয় খলীফাহর পদ থেকে বঞ্চিত করে হযরত উছ্মানকে খলীফাহ্ করা হয়েছিলো - কিছুতেই এ কাজ নীরবে হযম করতেন না।

কিন্তু কোরআন বিকৃত করার অভিযোগে খলীফাহর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন বলে কোনো সূত্রেই উল্লেখ করা হয় নি। এমনকি পরবর্তীকালে যারা তৃতীয় খলীফাহর বিরুদ্ধ প্রশাসনিক অযোগ্যতা ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক শীর্ষস্থানীয় ছ্বাহাবীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করেন তাঁরাও তাঁর বিরুদ্ধে কোরআন মজীদে রদবদল সাধনের অভিযোগ তোলেন নি। নিঃসন্দেহে মুছ্বহাফে উছমান্ নামে পরিচিত কোরআন মজীদের সরকারীভাবে প্রচারিত কপিতে সামান্যতম বিকৃতি বা রদবদল ঘটলেও বিদ্রোহীরা এটাকেই খলীফাহ্ উছ্মানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে তুলে ধরতেন , কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। বরং ছ্বাহাবীদের সকলেই কোরআন মজীদের এ সরকারী কপি প্রচারে সহযোগিতা করেন।

পঞ্চমতঃ তৃতীয় খলীফাহর দ্বারা কোরআনে বিকৃতি সাধিত হয়ে থাকলে হযরত আলী ( আঃ) জনগণ কর্তৃক খলীফাহ্ নির্বাচিত হবার পর অবশ্যই সর্বত্র থেকে মুছ্বহাফে উছমান্ ও তার অনুলিপিসমূহ সংগ্রহ করে ধ্বংস করে দিতেন এবং তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে কোরআনের যে কপি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার অনুলিপি প্রচার করতেন। কিন্তু তিনি এমন কিছু করেন নি।

সুতরাং এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে মুছ্বহাফে উছমান্ ছিলো স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কোরআন মজীদের হুবহু অনুলিপি।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , যে কোনো গ্রন্থই ব্যাপকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে হাতে কপি করতে গিয়ে কিছু লোকের কপিতে কিছু ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে সর্বজনস্বীকৃত তথ্য অনুযায়ী তৎকালে শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে নবী করীম (ছ্বাঃ) লোকদেরকে স্থানীয় উচ্চারণে কোরআন মজীদ পাঠ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং পরে তার শ্রুতি অনুসরণে যখন অনেকে তা লিপিবদ্ধ করেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর রেখে যাওয়া কপি থেকে কিছু পার্থক্য , বিশেষতঃ স্থানীয় উচ্চারণ অনুসরণজাত বানানের পার্থক্য ঘটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। এ কারণেই পরবর্তীকালে এ থেকে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে এবং স্থায়ীভাবে কোরআন মজীদের কপির বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা বিধানের পদক্ষেপ নেয়া হয় তথা কোরআনের সকল কপিকে মূল কপির অনুবর্তী করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। আর ছ্বাহাবীগণ যেহেতু কোরআন মজীদের বিশুদ্ধতা রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন সেহেতু তাঁরা এর সরকারী কপির প্রচার এবং ত্রুটিপূর্ণ কপির সংশোধন ও প্রয়োজনে ধ্বংসসাধনের পদক্ষেপকে কেবল সমর্থনই করেন নি , বরং এর বস্তবায়নে সহায়তা করেন।

নোকতাহ্ ও ই রাব্ সংযোজন মানে কি পরিবর্তন ?

এটা অনস্বীকার্য যে , কোরআন মজীদ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুতাওয়াতির্ সূত্রে বর্ণিত ঐশী গ্রন্থ - যা থেকে কেবল এ গ্রন্থের রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কর্তৃক পেশকৃত গ্রন্থ হওয়াই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় না , বরং এ গ্রন্থ যে , সামান্যতম পরিবর্তন - এমনকি একটি বর্ণেরও পরিবর্তন - ছাড়াই আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা-ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত। মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমানের দাবী এবং স্বয়ং কোরআন মজীদের বিভিন্ন উক্তি থেকেও প্রমাণিত যে , এ কোরআন আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে লাওহে মাহ্ফূয্ (সংরক্ষিত ফলক) নামক এক অবস্তুগত (মুজাররাদ্) সৃষ্টিতে যেভাবে সংরক্ষিত আছে মানুষের মাঝে প্রচলিত কোরআন হুবহু তারই লিখিত রূপ।

তবে বর্তমানে আমাদের মধ্যে কোরআন মজীদের যে লেখ্যরূপ প্রচলিত আছে তাতে মূল কোরআনের সাথে অতিরিক্ত চারটি জিনিস সংযোজিত হয়েছে - যা মূলতঃ পঠন-পাঠনের সুবিধার্থে , বিশেষ করে অনারবদের পঠন-পাঠনের সুবিধার্থে সংযোজন করা হয়েছে। এ চারটি জিনিস হচ্ছে: (ক) সূরাহ্ সমূহের লিখিত নাম এবং নাযিলের স্থান (মাক্কী-মাদানী) উল্লেখ , (খ) কতক বর্ণে নোকতাহ্ সংযোজন , (গ) বর্ণসমূহে হারাকাত চিহ্ন যোগ , বিশেষতঃ কতক শব্দের শেষ বর্ণে হারাকাত চিহ্ন - যা ই রাব্ চিহ্ন হিসেবে পরিচিত , এবং (ঘ) কতক যতিচিহ্ন ও পাঠসৌন্দর্যের লক্ষ্যে বিভিন্ন সাঙ্কেতিক চিহ্ন যোগ। আর এ চারটি জিনিস যে পরবর্তীকালে সংযোজন করা হয় এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোনোরূপ দ্বিমত নেই এবং এ ব্যাপারেও দ্বিমত নেই যে , এগুলো কোরআন মজীদের বক্তব্যে ও তাৎপর্যে সামান্যতম পরিবর্তন সাধন তো করেই নি , বরং একে সুরক্ষিত করেছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও কোরআন মজীদের সাথে ভালোভাবে পরিচয় নেই অন্তরে ব্যাধিগ্রস্ত এমন কতক লোক এগুলো সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলে এবং বলতে চায় যে , যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে কোরআন মজীদে এগুলো ছিলো না সেহেতু এ কাজগুলো কোরআনে এক ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছে।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , মূলের সাথে যে কোনো সংযোজনকে যখন স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং সংযোজন হতে মূলকেও আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় তখন তাকে বিকৃতি বলা চলে না। এটা অনেকটা তাফসীর লেখার ন্যায়। মূল কোরআনের পাশে বা নীচে যখন তার ব্যাখ্যা ও তাফসীর লেখা হয় তখন কেউ বলে না যে , এর দ্বারা মূল কোরআনের পাঠে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। কারণ , যে কেউ চাইলেই ব্যাখ্যা ও তাফসীরকে মূল কোরআন থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করতে পারে।

সূরাহ সমূহের শুরুতে সূরাহ গুলোর নাম যোগ করা হয় বিভিন্ন সূরাহকে পরস্পর থেকে আলাদা করার লক্ষ্যে। এ নামগুলো হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) থেকে বর্ণিত , কিন্তু এগুলো কোরআন মজীদের পাঠের অংশ নয়। এ কারণে কেউই কোরআন তেলাওয়াত্ করার সময় এ নামগুলো তেলাওয়াত্ করেন না। এ নামগুলো লেখার সুবিধা হচ্ছে এই যে , যেহেতু কোরআন মজীদে 114টি সূরাহ্ রয়েছে সেহেতু যাদের পুরো কোরআন মুখস্ত নেই তাদের পক্ষে কোরআন মজীদের কোনো আয়াত ও সূরাহর নাম শুনেই সংশ্লিষ্ট সূরাহ্ ও আয়াতকে খুঁজে বের করতে পারার সম্ভাবনা কম। কারণ , সূরাহ্গুলোর নাম একেকটি সূরাহর পুরো বক্তব্যের প্রতিনিধিত্ব করে না , বরং নামগুলো সূরাহকে চিহ্নিত করার মাধ্যম মাত্র। সূতরাং ব্যবহারিক সুবিধার জন্য সূরাহর নাম সংযোজনকে - যা তেলাওয়াত্ করা হয় না - কিছুতেই কোরআনে পরিবর্তন বলে গণ্য করা যায় না।

নোকতাহ্ , হারাকাত্ ও ই রাব্ চিহ্ন সংযোজন করা হয় মূলতঃ অনারব মুসলমানদের নির্ভুল তেলাওয়াতের সুবিধার্থে। কারণ , মূল আরবী ভাষায় কতক হরফের উচ্চারণ শব্দভেদে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আরবদের জন্য এতে সমস্যা হতো না। কারণ , তারা জন্মগতভাবে আরবী ভাষার পরিবেশে গড়ে ওঠার ফলে বুঝতে পারতো যে হরফটি কোন্ শব্দে কী রকম উচ্চারিত হবে। উদাহরণস্বরূপ , মূল আরবী অনুযায়ী সীন্ (س ) হরফটি কোনো কোনো শব্দে বাংলা দন্ত্য স-এর মতো এবং কোনো কোনো শব্দে বাংলা তালব্য শ-এর মতো উচ্চারিত হয়। কিন্তু অনারবদের পক্ষে এর দু ধরনের উচ্চারণস্থান নির্ণয় করা সম্ভব ছিলো না বিধায় তাদের উচ্চারণে কতক ক্ষেত্রে ভুলের আশঙ্কা দেখা দেয়। এ কারণে যে সব ক্ষেত্রে সীন্ (س ) হরফটির উচ্চারণ তালব্য শ-এর মতো হবে সে সব ক্ষেত্রে এ হরফের ওপরে তিনটি নোকতাহ্ যোগ করা হয়্। ফলে এ হরফটির একটি নতুন রূপ দাঁড়ায়ش । আরবরা সীন্ -এর এ ধরনের দু রকম লেখ্যরূপের মধ্যে প্রথমটিকে বলতো সীনে মু রাবাহ্ (سين معربة ) অর্থাৎ আরবীকৃত সীন্ এবং দ্বিতীয়টিকে বলতো সীনে মু জামাহ্ (سين معجمة ) অর্থাৎ“‘ আজামীকৃত/ অনারবকৃত সীন্ । কিন্তু অনারবরা সহজায়নের জন্য উচ্চারণ অনুসরণে এ দু টি হরফের নামকরণ করে যথাক্রমে সীন্ শীন

হারাকাত্ ও ই রাব্ চিহ্নগুলোও অনারবদের সঠিক উচ্চারণের স্বার্থে সংযোজন করা হয়। কারণ , মূল আরবী ভাষায় স্বরচিহ্নের লিখিত রূপ ছিলো না ; আরবরা অভ্যাসগত কারণে বুঝতে পারতো কোন্ শব্দের কোথায় কোন্ স্বরচিহ্ন উচ্চারিত হবে। অন্যদিকে আরবী ভাষায় বেশীর ভাগ শব্দেরই শেষ হরফে কোনো সুনির্দিষ্ট স্বরচিহ্ন থাকে না , বরং বাক্যমধ্যে শব্দের ভূমিকা অনুযায়ী তার শেষের স্বরচিহ্ন উচ্চারিত হয় ; এ ধরনের পরিবর্তিত উচ্চারণ নির্দেশক ক্ষেত্রে স্বরচিহ্নকে ই রাব্ বলা হয়। আরবরা অভ্যাসগত কারণে নির্ভুলভাবে এ সব স্বরচিহ্ন সহ বাক্যমধ্যে শব্দ উচ্চারণ করতো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অনারবরা এ ক্ষেত্রে ভুল করতো। এ কারণেই কোরআন মজীদে হারাকাত্ ও ই রাব্-চিহ্ন যোগ করা হয়। (উল্লেখ্য , এখনো আরবরা সাধারণ লেখালেখিতে , যেমন: সাহিত্য ও অন্যান্য গ্রন্থে এবং সংবাদপত্রে) হারাকাত্ ও ই রাব্-চিহ্ন ব্যবহার করে না , যদি না একান্ত ব্যতিক্রমী কোনো ক্ষেত্রে এবং অনারব শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে।

[এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা অত্যন্ত মশহূর। তা হচ্ছে কোরআন মজীদে হারাকাত্ ও ই রাব্-চিহ্ন সংযোজনের আগে জনৈক অনারব কোরআন মজীদের আয়াত -أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ অবশ্যই আল্লাহ্ মুশরিকদের থেকে নিঃসম্পর্ক এবং তাঁর রাসূল-ও (নিঃসম্পর্ক)। - এর শেষাংশেরرَسُولُه ُ (রাসূলুহ্)-কেرَسُولِه ُ (রাসূলিহ্) পড়ছিলেন। ফলে আযাতটির অর্থ দাঁড়ায়: অবশ্যই আল্লাহ্ মুশরিকদের থেকে নিঃসম্পর্ক এবং তাঁর রাসূল থেকেও (নিঃসম্পর্ক)। এ কারণে কোরআন মজীদের কপিতে হারাকাত্ ও ই রাব্-চিহ্ন যোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে বিশ্বের কোনো কোনো প্রাচীন গ্রন্থাগারে ও জাদুঘরে কোরআন মজীদের হারাকাত্ ও ই রাব্-চিহ্ন ব্যবহার পূর্ববর্তী কপি , এমনকি নোকতাহ্ বিহীন কপিও সংরক্ষিত আছে।]

মোদ্দা কথা , সুস্থ বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো লোকের পক্ষে এ সংযোজনগুলোকে কোরআন মজীদে বিকৃতি বা পরিবর্তন বলে গণ্য করতে পারেন না।

অনুরূপভাবে সূরাহ্ সমূহের মাক্কী বা মাদানী হওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে কোরআন মজীদের গবেষণামূলক ব্যবহারের সুবিধার্থে - যা পাঠ করা হয় না এবং এ নিয়ে মতপার্থক্য নেই। সুতরাং এগুলো বিকৃতি বা পরিবর্তন প্রমাণ করে না। একইভাবে আয়াতসংখ্যা উল্লেখ এবং আয়াত-নম্বর ও রুকূ -নম্বর যোগ , পারা ও মঞ্জিল নির্দেশ ইত্যাদি যোগের বিষয়টিও একই ধরনের সুবিধার্থে - যা পাঠ করা হয় না এবং এগুলো বিকৃতি নির্দেশক নয়। অন্যদিকে দীর্ঘ মাদ্দ্ ও কতক পাঠচিহ্ন পাঠসৌন্দর্য বা অনারবদের নির্ভুল পাঠের স্বার্থে যোগ করা হয়েছে।