কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়0%

কোরআনের পরিচয় লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

কোরআনের পরিচয়

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 21846
ডাউনলোড: 3387

কোরআনের পরিচয়
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 33 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 21846 / ডাউনলোড: 3387
সাইজ সাইজ সাইজ
কোরআনের পরিচয়

কোরআনের পরিচয়

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

অত্র গ্রন্থে কোরআন মজীদের বেশ কিছু আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ সব আয়াতের মধ্যে এমন আয়াতও রয়েছে যাতে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য উত্তম পুরুষে বহুবচন অর্থাৎ আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে নিজের জন্য এক বচন অর্থেই আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা কোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা ব্যবহার করায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি তথা একে বহু ঈশ্বরবাদের সপক্ষে প্রমাণ বলে দাবী করে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

কোরআনে স্ববিরোধিতা থাকার অভিযোগ

কোরআন-বিরোধীদের দাবী এই যে , কোরআনের কিছু বক্তব্য ও হুকুমের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা রয়েছে।

কোরআন-বিরোধীদের এ দাবী বড়ই বিস্ময়কর। কারণ , প্রকৃতই যদি কোরআন মজীদে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতা থাকতো তাহলে কোরআন নাযিলের যুগের ইসলামের দুশমনরা তাকে কোরআনের ঐশী কিতাব হবার দাবীর বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতো না। কারণ , কোরআন মজীদ স্বয়ং তাতে স্ববিরোধিতা না থাকার বিষয়টিকে এর ঐশী গ্রন্থ হবার অন্যতম প্রমাণ হিসেবে দাবী করেছে। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

তারা কি কোরআন সম্বন্ধে চিন্তা করে না ? তা যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে এসে থাকতো তাহলে অবশ্যই তাতে বহু স্ববিরোধিতা পাওয়া যেতো। (সূরাহ্ আন্-নিসা : 82)

এ ঘোষণার পর কাফেররা যদি কোরআন মজীদে কোনো স্ববিরোধিতা পেতো তাহলে তারা এ নিয়ে সমগ্র আরব উপদ্বীপে কোরআন-বিরোধী প্রচারের ঝড় তুলতো এবং সকলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হতো যে , কোরআন আল্লাহর কিতাব হওয়ার ও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবী হওয়ার দাবী মিথ্যা। আর তারা তা আরবের বাইরেও ছড়িয়ে দিতো। কিন্তু এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা কোনো সূত্রেই বর্ণিত হয় নি।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও অনেক পরবর্তীকালে কতক কোরআন-বিরোধী লোক , বিশেষ করে কতক খৃস্টান পণ্ডিত ও পশ্চিমা প্রাচ্যবিদের পক্ষ থেকে কোরআন মজীদে কিছু স্ববিরোধিতা দেখাবার চেষ্টা করা হয়।

[অত্র গ্রন্থের অত্র উপ-অধ্যায়টি আল্লামাহ্ সাইয়েদ আবূল্ ক্বাসেম্ খূয়ী (রহ্ঃ) প্রণীত আল্-বায়ান্ ফী তাফ্সিরিল্ ক্বুরআন্ গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা হয়েছে যা মূলতঃ অত্র গ্রন্থকারের প্রণীত কোরআনের মু জিযাহ্ গ্রন্থের অংশবিশেষ। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব দৃষ্টে এ অংশটি এখানেও যোগ করা হলো।]

তাদের দাবী অনুযায়ী কোরআনে কম পক্ষে দু টি বিষয়ে স্ববিরোধী কথা রয়েছে যা কোরআনের ওয়াহী হওয়াকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। তা হচ্ছে :

(1) কোরআনের উক্তি অনুযায়ী হযরত যাকারিয়া (আঃ) আল্লাহর কাছে পুত্রসন্তান কামনা করে দো আ করেন। আল্লাহ্ তাঁর দো আ কবূল্ করেন এবং দো আ কবূল্ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে তাঁকে জানান যে ,তিনি তিনদিন লোকদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবেন না। এ কথা বুঝাতে গিয়ে কোরআন এক জায়গায় উল্লেখ করেছে :

) ق َالَ آيَتُكَ أَلا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلاثَةَ أَيَّامٍ إِلا رَمْزًا(

তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমার নিদর্শন এই যে , তুমি তিন দিন প্রতীকী ভাষায় ব্যতীত লোকদের সাথে কথা বলবে না। (সূরাহ্ আালে ইমরান : 41)

[অত্র আয়াতে উল্লিখিতرمز শব্দের অর্থ অনেকেই করেছেন আকার-ইঙ্গিত অর্থাৎ তিনি মুখে কথা বলতে পারেন নি , বরং যাকে যা কিছু বলার তা ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছেন। এ অর্থ গ্রহণ সঠিক বলে মনে হয় না , কারণ , মুখে কথা বলতে না পারাটা সকলের কাছে অসুস্থতার লক্ষণ। এমতাবস্থায় তা আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে তাঁর নবীকে প্রদত্ত মু জিযাহ্ (آية ) হিসেবে গণ্য হতে পারে না। বস্তুতঃرمز শব্দের অর্থ আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা । তবে এর মানে হাতের বা শারীরিক আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা নয় , বরং আকার-ইঙ্গিত বা ইশারা র ভাষা তথা রহস্যজনক ও প্রতীকী ভাষা যা বোঝার জন্য অনেক বেশী মাথা ঘামাতে হয়। এ ধরনের কথাবার্তা যে কোনো ব্যক্তির জন্য মর্যাদা বা গুরুত্বের পরিচায়ক। এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তি সব সময় যে ধরনের ভাষায় কথাবার্তা বলেন তার পরিবর্তে তিনি হঠাৎ করে আকার-ইঙ্গিতবাচক বা রহস্যময় ভাষায় কথা বলা শুরু করলে সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায় যে , এটা তাঁর পক্ষে কী করে সম্ভব হলো! ফলে তাঁর মর্যাদা বা গুরুত্ব অনেক বেশী বেড়ে যায়। বিশেষ করে যে সব লোক ইঙ্গিতবাচক ভাষায় কথা বলতে সুদক্ষ তাঁরাও সারা দিনে হয়তো কয়েক বার এ ধরনের কথা বলেন ; অনবরত এ ধরনের ভাষায় কথা বলা তাঁদের পক্ষেও সম্ভব নয়। কিন্তু হযরত যাকারিয়া (আঃ) তিন দিন এ ধরনের ইঙ্গিতবাচক বা প্রতীকী ভাষায় কথা বলেছেন। অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা তাঁর যবানে এ ধরনের কথা জারী করে দেন - যা ছিলো একটি মু জিযাহ্ (آية ) । অত্র আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরে যে আয়াত উদ্ধৃত হচ্ছে (সূরাহ্ মারইয়াম : 10) তাতেও তিনি স্বাভাবিক কথা বা একভাবে কথা বলবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে মনে হয় , তিনি এক এক সময় এক এক ধরনের বাকভঙ্গিতে ইঙ্গিতবাচক কথা বলেছিলেন। এছাড়া সূরাহ্ মারইয়াম-এর 10 নং আয়াতে এর উল্লেখের পর পরই (11 নং আয়াতে) তাঁকে , লোকদেরকে সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা (তাসবীহ্) করার জন্য নির্দেশ সম্বলিত ওয়াহী জানিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়ার কথা বলা হয়েছে যা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে , ঐ তিন দিনের জন্য তাঁর কথা বলার ক্ষমতা স্থগিত হয়ে যায় নি।]

কিন্তু অন্যত্র একই প্রসঙ্গে উক্ত আয়াতের বিপরীতে তিনি তিন রাত লোকদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে :

তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমার নিদর্শন এই যে , তুমি তিন রাত স্বাভাবিক (বা একভাবে) কথা বলবে না। (সূরাহ্ মারইয়াম : 10)

আপত্তিকারীদের কথা হচ্ছে , উপরোক্ত দু টি আয়াত পরস্পর বিরোধী। কারণ , দো আ কবুল হওয়ার নিদর্শন হিসেবে একটিতে তিন দিন এবং অপরটিতে তিন রাত স্বাভাবিক কথা না বলার উল্লেখ করা হয়েছে।

এ অভিযোগ আদৌ ঠিক নয় ; অভিযোগকারীরা সম্ভবতঃ এ বিষয়ে সচেতন নন যে , আরবী ভাষায়يوم শব্দটি কখনো কখনো দিন অর্থাৎ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় বুঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং সে ক্ষেত্রে তার বিপরীত অর্থ তথা রাত্রি অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় বুঝাতেليل শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

তিনি তাদের ( আদ জাতির) ওপর সাত রাত ও আট দিনের জন্য তাকে (প্রবল বায়ু প্রবাহকে) বলবৎ করে দিলেন। (সূরাহ্ আল্-হাক্ব্ক্বাহ্ : 7)

এ আয়াতেيومليل পরস্পরের বিপরীত অর্থে ব্যহৃত হয়েছে।

কিন্তু আরবী ভাষায় কখনো কখনোيوم বলতে পুরো দিন ও রাত বুঝানো হয় । যেমন , কোরআন মজীদ এরশাদ হয়েছে :

আর তোমরা তিন দিনের জন্য (অর্থাৎ তিন দিন ও তিন রাত্রির জন্য) তোমাদের বাড়ীঘরে অবস্থানের সুবিধা ভোগ করে নাও। (সূরাহ্ হূদ : 65)

অনুরূপভাবেليل শব্দটি কখনো কখনো সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

শপথ রাত্রির যখন তা (সব কিছুকে অন্ধকারে) আবৃত করে নেয়। (সূরাহ্ আল্-লাইল্ : 1)

তেমনি ওপরে যেমন উদ্ধৃত করা হয়েছে :

তিনি তাদের ( আদ জাতির) ওপর সাত রাত ও আট দিনের জন্য তাকে (প্রবল বায়ু প্রবাহকে) বলবৎ করে দিলেন। (সূরাহ্ আল্-হাক্ব্ক্বাহ্ : 7)

কিন্তু কখনো কখনোليل শব্দটি পুরো দিন-রাত্রি বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

আর আমি যখন মূসাকে চল্লিশ রাত্রির জন্য (অর্থাৎ পর পর চল্লিশ দিন-রাত্রির জন্য) প্রতিশ্রুতি দিলাম। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : 51)

বস্তুতঃ পুরো দিন-রাত বুঝাবার জন্য শুধুيوم বা শুধুليل ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আরবী ভাষায় ভুরি ভুরি রয়েছে ; কোরআন মজীদেও এর আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে।

উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে , হযরত যাকারিয়া ( আঃ)-এর দো আ কবুল হওয়া সংক্রান্ত উক্ত দু টি আয়াতের মধ্যে প্রথমটিতে পুরো দিন-রাত্রি বুঝাতেليل ব্যবহৃত হয়েছে এবং একইভাবে দ্বিতীয়টিতে পুরো দিন-রাত্রি বুঝাতেيوم ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব , উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে স্ববিরোধিতা তো নেই-ই , বরং আয়াতদ্বয় পরস্পরের ব্যাখ্যাকারী।

উল্লেখ্য , উভয় আয়াতেই যদি শুধুيوم অর্থে ব্যবহৃত হতো তাহলে কারো পক্ষে তিন দিন ও তিন রাত্রি এবং কারো পক্ষে শুধু তিন দিন (রাত্রি নয়) অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকতো। অনুরূপভাবে উভয় আয়াতে যদি শুধুليل ব্যবহৃত হতো তাহলে কারো পক্ষে তিন দিন ও তিন রাত্রি এবং কারো পক্ষে শুধু তিন রাত্রি (দিন নয়) অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকতো। এমতাবস্থায় দুই আয়াতে দুই শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আর কোনো মতপার্থক্যের সুযোগ থাকলো না।

উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে যারা স্ববিরোধিতা কল্পনা করেছে তারাيوم কে শুধু সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অর্থে এবং অনুরূপভাবেليل কে শুধু সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অর্থে গ্রহণ করেছে। অথচ উভয় শব্দেরই এতদভিন্ন অন্য অর্থও রয়েছে। তা হচ্ছে , উভয় শব্দেরই অন্যতম অর্থ পুরো দিন-রাত্রি

[অন্য অনেক ভাষায়ই দিন রাত শব্দদ্বয়ের এ ধরনের ব্যবহার প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষায় দিন বলতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় এবং দিন - রাত চব্বিশ ঘণ্টা উভয়ই বুঝানো হয়। ফার্সী ভাষায়روز ( দিন ) ওشب ( রাত )- এর ব্যবহার আরবী ভাষার অনুরূপ। যেমন , বলা হয় :دو شب آنجا بوديم - আমরা দুই রাত ( অর্থাৎ দুই দিন - রাত ) সেখানে ছিলাম। ইংরেজী ভাষায়ও এ ধরনের প্রচলন রয়েছে। যেমন , বলা হয় : Hotel fare per night 100 dollar. - হোটেল - ভাড়া প্রতি রাত ( অর্থাৎ প্রতি দিন - রাত ) একশ ডলার। এখানে শুধু রাতের ভাড়া বুঝানো উদ্দেশ্য নয় , বরং দিন - রাত চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়া বুঝানোই উদ্দেশ্য। ]

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে , অন্যান্য ভাষার ন্যায় আরবী ভাষায়ও দিন রাত -এর আরো অর্থ রয়েছে। তা হচ্ছে , বহুলব্যবহৃত অর্থে এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কে দিন , সন্ধ্যা , রাত , ও প্রত্যুষ - এ কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই রাত বলা হয় না , বরং অন্ধকার ঘনিয়ে এলে রাত শুরু হয় এবং প্রত্যুষ (ছুব্হে ছ্বাদেক্ব্) হওয়া পর্যন্ত রাত থাকে বলে গণ্য করা হয় , তেমনি সূর্য দিগন্তের ওপরে উদিত হবার আগে চারদিক পুরোপুরি ফর্সা হয়ে গেলেই দিন বলা হয়।

অতএব , উক্ত দুই আয়াতের মধ্যে স্ববিরোধিতার কল্পনা যে ভিত্তিহীন তা বলাই বাহুল্য।

এখানে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে , উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকলে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর যুগের ইসলাম-বিরোধী আরবরা একে পুঁজি করে কোরআনের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতো। কিন্তু শব্দদ্বয়ের অর্থ সম্পর্কে অবগত থাকায় তারা প্রতিবাদ করে নি। এ থেকে আরো সুস্পষ্ট যে , আরবী ভাষায় যথাযথ জ্ঞান ছাড়াই বিরোধীরা কোরআন মজীদের বিরুদ্ধে হাস্যকর আপত্তি তুলেছে।

(2) তারা বলে : কোরআনে দ্বিতীয় যে স্ববিরোধিতা রয়েছে তা হচ্ছে , কোরআন কখনোবা মানুষের কাজের দায়-দায়িত্ব মানুষের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে অর্থাৎ মানুষ স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের বলে কাজ করে থাকে বলে উল্লেখ করেছে।

[এ বিষয়ে অত্র গ্রন্থকারের অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম গ্রন্থেও আলোচনা করা হয়েছে।]

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেনঃ

অতঃপর যে চায় সে ঈমান আনবে এবং যে চায় কাফের হবে। (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্ : 29)

আবার কোথাও কোথাও কোরআন সমস্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার আল্লাহর হাতে সমর্পণ করেছে। এমনকি মানুষের কাজকর্মকেও আল্লাহর প্রতি আরোপ করেছে। যেমন , বলেছে :

তোমরা ইচ্ছা করবে না আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। (সূরাহ্ আল্-ইনসান্/ আদ্-দাহর : 30)

তাদের কথা : সাধারণভাবে বলা যায় যে , কোরআনে কতোগুলো আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহর বান্দাহদেরকে তাদের কাজের ব্যাপারে এখতিয়ারের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে , অন্যদিকে অপর কতগুলো আয়াতে মানুষকে এখতিয়ার বিহীন রূপে তুলে ধরা হয়েছে এবং সমস্ত কাজ আল্লাহর প্রতি আরোপ করা হয়েছে। কোরআনের এ দুই ধরনের আয়াতের মধ্যে সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা বর্তমান - যা কোনো ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব নয়।

এর জবাবে বলবো : কোরআন মজীদে যে কোথাও কোথাও বান্দাহদের কাজকে তাদের নিজেদের ওপর আরোপ করা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও যে তা আল্লাহর প্রতি আরোপ করা হয়েছে - উভয়ই স্ব স্ব স্থানে সঠিক এবং এতদুভয়ের মধ্যে কোনোরূপ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব নেই। কারণ ,

প্রতিটি মানুষই স্ব স্ব সহজাত অনুভূতি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা এ সত্য অনুভব করে যে , সে কতোগুলো কাজ করার জন্য শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী এবং স্বাধীনভাবে ঐ সব কাজ করতে বা করা থেকে বিরত থাকতে সক্ষম। এ হচ্ছে এমন বিষয় মানবিক প্রকৃতি ও বিচারবুদ্ধি যার সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। এ ব্যাপারে কেউ সামান্যতম সন্দেহও পোষণ করতে পারে না। এ কারণে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানবান লোকই দুষ্কৃতিকারীকে তিরস্কার ও শাস্তি প্রদান করেন। এটাই প্রমাণ করে যে , মানুষ স্বীয় কাজকর্মে স্বাধীনতা ও এখতিয়ারের অধিকারী এবং কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য তাকে বাধ্য করা হয় না।

অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই লক্ষ্য করে থাকে যে , সাধারণভাবে পথ চলার সময় তার যে গতি তার সাথে উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাবার ক্ষেত্রে তার গতিতে পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য থেকে সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে , প্রথমোক্ত গতির ক্ষেত্রে সে স্বাধীন ও এখতিয়ার সম্পন্ন , কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত গতির ক্ষেত্রে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য।

বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আরো লক্ষ্য করে যে , যদিও সে কতোগুলো কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে স্বাধীন ; সে চাইলে স্বেচ্ছায় সে কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে এবং চাইলে স্বেচ্ছায় সে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকতে পারে , তথাপি তার এখতিয়ারাধীন এ সব কাজের অধিকাংশ পটভূমি বা পূর্বশর্তসমূহ তার এখতিয়ারের বাইরে। যেমন : মানুষের কাজের পটভূমি , তার আয়ুষ্কাল , তার অনুভূতি ও অনুধাবন ক্ষমতা , তার ঐ কাজের প্রতি আগ্রহ , তার অভ্যন্তরীণ চাহিদাসমূহের কোনো একটির জন্য কাজটি অনুকূল হওয়া এবং সবশেষে কাজটি সম্পাদনের শক্তি ও ক্ষমতা।

বলা বাহুল্য যে , মানুষের কাজের এই পটভূমিসমূহ তার এখতিয়ারের গণ্ডির বাইরে এবং এই পটভূমিসমূহের স্রষ্টা হচ্ছেন সেই মহাশক্তি যিনি স্বয়ং মানুষেরই স্রষ্টা।

অতএব , এ বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের কাজকর্মকে একই সাথে যেমন মানুষের প্রতি আরোপ করা চলে , তেমনি তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতিও আরোপ করা চলে যিনি এ কাজসমূহের সমস্ত পটভূমি সৃষ্টি করেছেন।

দ্বিতীয়তঃ বিচারবুদ্ধির রায় এই যে , সৃষ্টিকর্তা সমস্ত সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করার পর নিজেকে কাজ থেকে গুটিয়ে নেন নি বা অবসর গ্রহণ করেন নি এবং সৃষ্টিলোকের পরিচালনা থেকেও হাত গুটিয়ে নেন নি , বরং সৃষ্টিলোকের অস্তিত্ব টিকে থাকা ও অব্যাহত থাকার বিষয়টি তাদের সৃষ্টির ন্যায়ই সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও ইচ্ছার মুখাপেক্ষী। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে সৃষ্টিলোকের পক্ষে এমনকি মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকা সম্ভব নয়।

সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রাণশীল ও প্রাণহীন নির্বিশেষে সৃষ্টিলোকের সৃষ্টিনিচয়ের সম্পর্ক একজন নির্মাতার সাথে তার নির্মিত ভবনের সম্পর্কের ন্যায় নয় যেখানে ভবনটি শুধু তার অস্তিত্বলাভের ক্ষেত্রে এর নির্মাতা ও শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল , কিন্তু অস্তিত্ব লাভের পরে তাদের থেকে মুখাপেক্ষিতাহীন এবং এমনকি নির্মাতা ও শ্রমিকদের বিলয় ঘটলেও ভবনটি তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখতে পারে। তেমনি এ সম্পর্ক একজন গ্রন্থকারের সাথে তাঁর রচিত গ্রন্থের সম্পর্কের ন্যায়ও নয় , যেখানে গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রেই শুধু গ্রন্থকারের অস্তিত্বের প্রয়োজন , কিন্তু রচিত হয়ে যাবার পর গ্রন্থটির টিকে থাকা ও অস্তিত্ব অব্যাহত থাকার জন্য গ্রন্থকার , তাঁর হস্তাক্ষর ও তাঁর লিখনকর্মের আদৌ প্রয়োজন নেই।

কিন্তু সৃষ্টিজগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক যদিও সমস্ত রকমের উপমার উর্ধে তথাপি অনুধাবনের সুবিধার্থে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তা হচ্ছে : সৃষ্টিজগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক বৈদ্যুতিক বাতির আলোর সাথে বিদ্যুতের সম্পর্কের ন্যায়। বৈদ্যুতিক বাতি ঠিক ততোক্ষণই আলো বিতরণ করতে পারে যতোক্ষণ তারের মাধ্যমে বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত এসে বাতিতে পৌঁছে। বস্তুতঃ বাতি তার আলোর জন্য প্রতিটি মুহূর্তেই বিদ্যুতকেন্দ্রের মুখাপেক্ষী ; যে মুহূর্তে বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া দেয়া হবে , ঠিক সে মুহূর্তেই বাতি নিভে যাবে এবং আলোর স্থানে অন্ধকার আধিপত্য বিস্তার করবে।

ঠিক এভাবেই সমগ্র সৃষ্টিজগত স্বীয় অস্তিত্বলাভ , স্থিতি ও অব্যাহত থাকার জন্য তার মহান উৎসের মুখাপেক্ষী এবং প্রতিটি সৃষ্টিই তার মহান উৎসের মনোযোগ (توجه ) ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী। প্রতিটি সৃষ্টিই প্রতিটি মুহূর্তেই সে মহান উৎসের সীমাহীন দয়া ও করুণায় পরিবেষ্টিত হয়ে আছে ; মুহূর্তের জন্যও যদি এ দয়া ও করুণার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে সমগ্র সৃষ্টিনিচয় সাথে সাথেই অনস্তিত্বে পর্যবসিত হবে এবং সৃষ্টিলোকের আলো হারিয়ে যাবে।

অতএব , দেখা যাচ্ছে , বান্দাহদের কাজ জাবর্ ও এখতিয়ারের মধ্যবর্তী একটি অবস্থার অধিকারী এবং মানুষ এ দুই দিকেরই সুবিধা পাচ্ছে।

جبر মানে বাধ্য করা । এটি কালাম্ শাস্ত্রের একটি বিশেষ পরিভাষা। যারাجبر -এ বিশ্বাসী তারা সৃষ্টিকুলের সমস্ত কাজ স্রষ্টার প্রতি আরোপ করে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রধান মত হচ্ছে : (1) সৃষ্টির শুরুতে বা সৃষ্টিপরিকল্পনার মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা ভবিষ্যতের সব কিছু খুটিনাটি সহ নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তদনুযায়ী সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে চলেছে। (2) প্রতি মুহূর্তে স্রষ্টা যা চান তার দ্বারা তা-ই করিয়ে নেন। (3) প্রতিটি মানুষ (এবং অন্যান্য প্রাণীও) মাতৃগর্ভে আসার পর সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করে দেন। (4) প্রতি বছর একবার সৃষ্টিকর্তা গোটা সৃষ্টিকুলের , বিশেষতঃ মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করে দেন। [এ সব বিষয় নিয়ে অত্র লেখকের অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম গ্রন্থে বিচারবুদ্ধি ও কোরআন মজীদের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।]

মানুষ কোনো কাজ সম্পাদন করা বা না করার ক্ষেত্রে স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতার ব্যবহারে পুরোপুরি স্বাধীন। কিন্তু তার এই শক্তি ও ক্ষমতা এবং কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের পটভূমি ও পূর্বশর্ত (مقدمات ) তার নিজের নয় , বরং এগুলো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হয়েছে। এ সব কিছুর অস্তিত্বলাভের ব্যাপারে যেমন মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতি মুখাপেক্ষী , তেমনি এ সবের স্থিতি ও অব্যাহত থাকার ব্যাপারেও সে প্রতি মুহূর্তেই তাঁরই দয়া-অনুগ্রহ ও মনোযোগের মুখাপেক্ষী। সুতরাং মানুষ যে কাজই সম্পাদন করেছে এক হিসেবে তা তার নিজের প্রতি আরোপযোগ্য , আরেক হিসেবে তা আল্লাহ্ তা আলার প্রতি আরোপযোগ্য।

কোরআন মজীদের উক্ত আয়াত সমূহেও এ সত্যই তুলে ধরা হয়েছে। এ সব আয়াতে বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে , স্বীয় কাজকর্মের ওপরে মানুষের শক্তি-ক্ষমতা ও এখতিয়ারের নিয়ন্ত্রণ তার কাজকর্মের ওপর খোদায়ী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ , তিনিও মানুষের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি রাখেন এবং মানুষের কাজকর্মে তাঁরও ভূমিকা রয়েছে।

বস্তুতঃ একেই বলা হয়امر بين الامرين (দু টি অবস্থার মাঝামাঝি একটি অবস্থা)। [মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে চৈন্তিক দিক থেকে বিভিন্ন মত এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মতের একটি সংমিশ্রিত রূপ বিরাজ করলেও বিশেষ করে আমলের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে , তারা মানুষের কাজকর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে অবচেতনভাবে হলেও এ আক্বীদাহ্ই পোষণ করে।] আহলে বাইতের ইমামগণ ( আঃ)ও এ বিষয়টির ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন এবং এ তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে জাবর্ তাফ্ভীয্ - এ উভয় তত্ত্বকে বাতিল প্রমাণ করে দিয়েছেন।

[تفويض (অর্পণ) হচ্ছে কালাম্ শাস্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। এর মানে হচ্ছে , মানুষকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে ; সৃষ্টিকর্তা তার কাজকর্ম মোটেই নিয়ন্ত্রণ করেন না। একেاختيار (নির্বাচন/ বেছে নেয়া) তত্ত্বও বলা হয়। মু তাযিলাহ্ র্ফিক্বাহ্ এ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলো।]

এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী বিধায় আমরা এখানে আরো একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠক-পাঠিকাদের সামনে সহজবোধ্য করে তোলার প্রয়াস পাবো :

এমন এক ব্যক্তির কথা মনে করুন যার হাত দু টি অকেজো , ফলে সে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া করতে এবং তা দ্বারা কাজকর্ম করতে পারে না। কিন্তু একজন চিকিৎসক একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে তার হাত দু টিকে সচল ও সক্ষম করে দিলেন। ডাক্তার যখনই তার হাতে উক্ত যন্ত্র থেকে বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহ করেন তখন সে ইচ্ছা করলে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম করতে পারে এবং না চাইলে কিছু না করেও থাকতে পারে । কিন্তু যখনই ডাক্তার তার হাতের সাথে উক্ত যন্ত্রের সংযোগ ছিন্ন করে দেন বা তাতে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেন তখন সে অক্ষম অবস্থায় ফিরে আসে এবং ইচ্ছা করলেও সে তার হাত দু টি নাড়াচাড়া করতে পারে না।

এখন পরীক্ষা ও গবেষণার লক্ষ্যে ডাক্তার রোগীর হাত দু টির সাথে উক্ত যন্ত্রটির সংযোগ প্রদান করলেন এবং রোগীও স্বীয় ইচ্ছা ও এখতিয়ার অনুযায়ী তার হাত দু টি নাড়াচাড়া ও তা ব্যবহার করে কাজকর্ম করতে শুরু করলো। তার এ কাজকর্ম নির্বাচন ও তার শুভাশুভ পরিণতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ডাক্তারের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ , ডাক্তার তাকে এ সব কাজ করতে বা না করতে বাধ্য করে নি। বরং ডাক্তার যে কাজ করলেন তা হচ্ছে , তিনি রোগীকে কাজ করার শক্তি সরবরাহ করলেন এবং রোগীর পসন্দ মতো যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করলেন।

এখন এ ব্যক্তির হাত নাড়াচাড়া করা ও তা দ্বারা কাজকর্ম করাকে আমরাامر بين الامرين -এর দৃষ্টান্ত রূপে গণ্য করতে পারি। কারণ , তার এভাবে হাত নাড়াচাড়া ও কাজকর্ম করার বিষয়টি উক্ত যন্ত্র থেকে বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল , আর এ বিদ্যুত-তরঙ্গ সরবরাহের বিষয়টি পুরোপুরি ডাক্তারের এখতিয়ারাধীন। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তির হাত নাড়াচাড়া ও কাজকর্ম করাকে পুরাপুরিভাবে ডাক্তারের প্রতিও আরোপ করা চলে না। কারণ , ডাক্তার তাকে শুধু শক্তি সরবরাহ করেছেন , কিন্তু হাত নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম রোগী স্বেচ্ছায় সম্পাদন করেছে ; রোগী চাইলে হাত নাড়াচাড়া ও তা দিয়ে কাজকর্ম করা থেকে বিরতও থাকতে পারতো।

উপরোক্ত ক্ষেত্রে কাজকর্মের কর্তা রোগী একদিকে যেমন স্বীয় এখতিয়ারের বলে কাজকর্ম সম্পাদন করেছে এবং জাবর্ বা যান্ত্রিকতার শিকার হয় নি , তেমনি তার কাজকর্মের পুরো এখতিয়ারও তাকে প্রদান করা হয় নি , বরং সর্বক্ষণই তাকে অন্যত্র থেকে শক্তি ও সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে।

এটাই হচ্ছেلا جبر و لا تفويض بل امر بين الامرين - না জাবর্ , না তাফভীয্ , বরং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। মানুষের সমস্ত কাজকর্ম এ অবস্থার মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়ে থাকে। একদিকে যেমন মানুষ স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে , অন্যদিকে আল্লাহ্ তা আলা যার পটভূমি বা পূর্বশর্তাবলী তৈরী করে দেন তথা তিনি যা ইচ্ছা করেন তার বাইরে সে কোনো কিছু করতে বা করার ইচ্ছা করতে পারে না।

এতদসংক্রান্ত সমস্ত আয়াতের এটাই লক্ষ্য। অর্থাৎ কোরআন মজীদ একদিকে মানুষের জন্য এখতিয়ার প্রমাণ করে জাবর্-এ বিশ্বাসীদের চিন্তাধারার অসারতা প্রমাণ করেছে , অন্যদিকে মানুষের কাজকর্মকে আল্লাহর প্রতি আরোপ করে তাফ্ভীয্-এর প্রবক্তাদের অভিমতকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে।