অনুবাদকের কথা
মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত
,
মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী
,
তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ
-
সংঘাত
,
মারামারি
,
আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে
Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী
(
আ
.)-
এর মর্যাদা যে শিয়া
-
সুন্নী
নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।
ঐতিহাসিকভাবে হযরত আলী (আ.) এবং মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের মর্যাদায় বর্ণিত অসংখ্য হাদীস আজ আমাদের মাঝে অপরিচিত হয়ে রয়েছে । অথচ তার মধ্যে এমন অনেক হাদীস রয়েছে যা সনদের (সূত্রের) দিক থেকে নির্ভরযোগ্যই শুধু নয় এমনকি বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দৃষ্টিতে মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে। গাদীরের হাদীস তার অন্যতম।
উপরিউক্ত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হওয়া এবং বারংবার মহান রাসূলের (সা.) পবিত্র মুখে উচ্চারিত হওয়ার কারণে এগুলোর বিষয়বস্তুর গুরুত্বও খুবই বেশী। কারণ পবিত্র কোরআন রাসূল (সা.) সম্পর্কে বলেছেঃ
)
و
َمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ(
অর্থাৎ তিনি নিজের প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছু বলেন না বরং যা বলেন তা আল্লাহর ওহী বৈ কিছু না যা তার উপর অবতীর্ণ হয়।
সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন হাদীসগুলি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মানব জাতির জন্য সর্বশেষ নবী এবং হেদায়াতকারী হিসেবে তার থেকে বর্ণিত এরূপ হাদীস এর বিষয়বস্তুর গুরুত্বকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ উম্মতের হেদায়াত প্রাস্থি ও সঠিক পথে অবিচল থাকার ক্ষেত্রে এ হাদীসগুলোর গুরুত্ব অসীম। গাদীরের হাদীস এমন একটি হাদীস যা বর্ণনা সূত্রের দৃষ্টিতে মুতাওয়াতির এবং এর বিষয়বস্তুর সমর্থক হাদীসসমূহও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুতাওয়াতির অথবা মাশহুর বা মুস্তাফিজের পর্যায়ে রয়েছে ।
বিশেষতঃ এ হাদীসটি মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষদিনগুলোতে বর্ণিত হাদীসের একটি যা বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে বিশেষ আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এ হাদীসটির বর্ণনার প্রেক্ষাপট এবং রাসূলের (সা.) জীবনের শেষ হজ্জে তা বর্ণিত হওয়ার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় এ হাদীসটি অন্য সকল হাদীসের এমনকি পবিত্র কোরআনের বাণীসমূহের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার রূপরেখা দান করেছে। বিশেষতঃ এ হাদীসটি বর্ণিত হওয়া এবং রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াত বা অভিভাবকত্ব ঘোষণা করার পর পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত অর্থাৎ সূরা মায়েদা’
র 3নং আয়াতের নিম্নোক্ত অংশঃ
)
ال
ْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(
অর্থাৎ আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীনের বিরুদ্ধাচারণে হত্যাশ হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর না , শুধু আমাকে ভয় কর। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।
থেকে বোঝা যায় বেলায়াতের বিষয়টির সঙ্গে কাফেরদের নিরাশ হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। সেই সাথে দ্বীনের পূর্ণতা , নেয়ামতের সম্পূর্ণ হওয়া এবং ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বলে স্বীকৃতি পাওয়া এ সকল বিষয়ই বেলায়াতের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ সেই দ্বীনই পূর্ণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও যে দ্বীনের জন্য নির্দিষ্ট তা হল বেলায়াত যার অন্তর্ভূক্ত।
ঐশী বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়া জাহেলিয়াতের শামিল। যেমনটি হাদীসে এসেছে যে ,
من مات و لم یعرف امام زمانه مات میتة جاهلیه
অর্থাৎ যে তার যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যু বরণ করল তার মৃত্যু ঠিক ঐ ব্যক্তির মত যে জাহেলী যুগে মৃত্যু বরণ করেছে।
এ হাদীস থেকে যেমনি যুগের ইমামকে চেনার গুরুত্বটি বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায় মুসলমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করার বিষয়টি নিভর করছে বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে মেনে নেওয়ার বিষয়ের উপর।
বিষয়টির গুরুত্ব এতটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ হাদীসটিতে বর্ণিত-
من کنت مولاه فعلی مولاه
‘
মাওলা’
অংশটির ভিন্নরূপ ব্যাখ্যার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তারা দাবী করেছে“
মাওলা”
শব্দটি এ হাদীসে বন্ধু অর্থে এসেছে। অথচ এ অর্থ হাদীসের বর্ণনার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কেউ কেউ হাদীসটি জায়িফ (দূর্বল) অথবা জাল বলে বর্ণনার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। যদিও হাদীসটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহাবী , তাবেয়ীন এবং হাদীসবেত্তারা বহুল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লামা আমিনী 110 জন বিশিষ্ট সাহাবী ও 84 জন তাবেয়ী’
র নাম উল্লেখ করেছেন যারা গাদীরের সর্বজন বিদিত হাদীসটি সরাসরি রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীসটি শিয়া আলেমদের নিকটই শুধু নয় সুন্নী মুহাদ্দিসদের নিকটও মুতাওয়াতির ও অকাট্য বলে প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হুসাইন আমিনী তার‘
আল গাদীর’
গ্রন্থে (11 খণ্ডে রচিত) এ বিষয়টি সনদ ও দলিলসহ উভয় মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ করেছেন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে , হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতের বিষয়ে এতটা অকাট্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী ও গোড়া আলেম এ বিষয়টিকে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করার প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা যারা সত্য ও বাস্তবের অনুসন্ধিৎসু আমাদের কর্তব্য হল প্রকৃত সত্যকে সমাজের নিকট স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। আর সে কারণেই এ বইটি অনুবাদের জন্য আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তি সাহস করেছে।
লেখক এই গ্রন্থে বেলায়াতের বিষয়টি অতি সুন্দর , স্পষ্ট ও বিভিন্ন প্রমাণাদির মাধ্যমে অত্যন্ত প্রঞ্জল ভাষায় পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন। তাই আসুন আমরা এই গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে চিনে জাহেলী যুগের ন্যায় মৃত্যু বরণ করা থেকে নিস্কৃতি লাভ করি।
অনুবাদসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বইটি ত্রুটিমুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য চেষ্টা- প্রচেষ্টা করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে যারাই স্বীয় মেধা ও শ্রম ব্যয় করে সাহায়্য-সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং তাদের পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট কামনা করছি। সুপ্রিয় পাঠক মহোদয় তারপরেও যদি কোথাও কোন ত্রুটি আপনাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পরে তা আমাদেরকে অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।
আশাকরি , এ সামান্য প্রচেষ্টা আপনাদের উপকারে আসবে। এ বই থেকে যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হন তাহলেই আমরা আমাদেরকে কৃতার্থ বলে মনে করবো।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন