আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর15%

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর লেখক:
: মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26626 / ডাউনলোড: 5086
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে

গাদীর

ভাষান্তর:

মুহাদ্দিস এম , এ , রহমান (কামিল)

মূল:

মুহাম্মদ রেজা জাব্বারান।

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখকঃ মুহাম্মদ রেজা জাব্বারান।

ভাষান্তরঃ মুহাদ্দিস এম , এ , রহমান (কামিল)

সম্পাদনাঃ আবুল কাসেম , আলী মুর্তাযা

প্রকাশকঃ জামেয়াতুল মোস্তাফা আল-আলামিয়্যাহ

কম্পোজঃ এস , এ , শাম্মী

প্রথম প্রকাশঃ ২০০৯ইং

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে

অনুবাদকের কথা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

ঐতিহাসিকভাবে হযরত আলী (আ.) এবং মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের মর্যাদায় বর্ণিত অসংখ্য হাদীস আজ আমাদের মাঝে অপরিচিত হয়ে রয়েছে । অথচ তার মধ্যে এমন অনেক হাদীস রয়েছে যা সনদের (সূত্রের) দিক থেকে নির্ভরযোগ্যই শুধু নয় এমনকি বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দৃষ্টিতে মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে। গাদীরের হাদীস তার অন্যতম।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হওয়া এবং বারংবার মহান রাসূলের (সা.) পবিত্র মুখে উচ্চারিত হওয়ার কারণে এগুলোর বিষয়বস্তুর গুরুত্বও খুবই বেশী। কারণ পবিত্র কোরআন রাসূল (সা.) সম্পর্কে বলেছেঃ

) و َمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ(

অর্থাৎ তিনি নিজের প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছু বলেন না বরং যা বলেন তা আল্লাহর ওহী বৈ কিছু না যা তার উপর অবতীর্ণ হয়।

সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন হাদীসগুলি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মানব জাতির জন্য সর্বশেষ নবী এবং হেদায়াতকারী হিসেবে তার থেকে বর্ণিত এরূপ হাদীস এর বিষয়বস্তুর গুরুত্বকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ উম্মতের হেদায়াত প্রাস্থি ও সঠিক পথে অবিচল থাকার ক্ষেত্রে এ হাদীসগুলোর গুরুত্ব অসীম। গাদীরের হাদীস এমন একটি হাদীস যা বর্ণনা সূত্রের দৃষ্টিতে মুতাওয়াতির এবং এর বিষয়বস্তুর সমর্থক হাদীসসমূহও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুতাওয়াতির অথবা মাশহুর বা মুস্তাফিজের পর্যায়ে রয়েছে ।

বিশেষতঃ এ হাদীসটি মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষদিনগুলোতে বর্ণিত হাদীসের একটি যা বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে বিশেষ আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় এ হাদীসটির বর্ণনার প্রেক্ষাপট এবং রাসূলের (সা.) জীবনের শেষ হজ্জে তা বর্ণিত হওয়ার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় এ হাদীসটি অন্য সকল হাদীসের এমনকি পবিত্র কোরআনের বাণীসমূহের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার রূপরেখা দান করেছে। বিশেষতঃ এ হাদীসটি বর্ণিত হওয়া এবং রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াত বা অভিভাবকত্ব ঘোষণা করার পর পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত অর্থাৎ সূরা মায়েদা র ৩নং আয়াতের নিম্নোক্ত অংশঃ

) ال ْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ কাফিরগণ তোমাদের দ্বীনের বিরুদ্ধাচারণে হত্যাশ হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর না , শুধু আমাকে ভয় কর। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।

থেকে বোঝা যায় বেলায়াতের বিষয়টির সঙ্গে কাফেরদের নিরাশ হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। সেই সাথে দ্বীনের পূর্ণতা , নেয়ামতের সম্পূর্ণ হওয়া এবং ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বলে স্বীকৃতি পাওয়া এ সকল বিষয়ই বেলায়াতের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ সেই দ্বীনই পূর্ণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও যে দ্বীনের জন্য নির্দিষ্ট তা হল বেলায়াত যার অন্তর্ভূক্ত।

ঐশী বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে স্বীকৃতি না দেয়া জাহেলিয়াতের শামিল। যেমনটি হাদীসে এসেছে যে ,

من مات و لم یعرف امام زمانه مات میتة جاهلیه

অর্থাৎ যে তার যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যু বরণ করল তার মৃত্যু ঠিক ঐ ব্যক্তির মত যে জাহেলী যুগে মৃত্যু বরণ করেছে।

এ হাদীস থেকে যেমনি যুগের ইমামকে চেনার গুরুত্বটি বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায় মুসলমান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করার বিষয়টি নিভর করছে বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে মেনে নেওয়ার বিষয়ের উপর।

বিষয়টির গুরুত্ব এতটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ হাদীসটিতে বর্ণিত-

من کنت مولاه فعلی مولاه

মাওলা অংশটির ভিন্নরূপ ব্যাখ্যার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তারা দাবী করেছে মাওলা শব্দটি এ হাদীসে বন্ধু অর্থে এসেছে। অথচ এ অর্থ হাদীসের বর্ণনার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কেউ কেউ হাদীসটি জায়িফ (দূর্বল) অথবা জাল বলে বর্ণনার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। যদিও হাদীসটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহাবী , তাবেয়ীন এবং হাদীসবেত্তারা বহুল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লামা আমিনী ১১০ জন বিশিষ্ট সাহাবী ও ৮৪ জন তাবেয়ী র নাম উল্লেখ করেছেন যারা গাদীরের সর্বজন বিদিত হাদীসটি সরাসরি রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন।

এ হাদীসটি শিয়া আলেমদের নিকটই শুধু নয় সুন্নী মুহাদ্দিসদের নিকটও মুতাওয়াতির ও অকাট্য বলে প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হুসাইন আমিনী তার আল গাদীর গ্রন্থে (১১ খণ্ডে রচিত) এ বিষয়টি সনদ ও দলিলসহ উভয় মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ করেছেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে , হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতের বিষয়ে এতটা অকাট্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী ও গোড়া আলেম এ বিষয়টিকে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করার প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা যারা সত্য ও বাস্তবের অনুসন্ধিৎসু আমাদের কর্তব্য হল প্রকৃত সত্যকে সমাজের নিকট স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। আর সে কারণেই এ বইটি অনুবাদের জন্য আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তি সাহস করেছে।

লেখক এই গ্রন্থে বেলায়াতের বিষয়টি অতি সুন্দর , স্পষ্ট ও বিভিন্ন প্রমাণাদির মাধ্যমে অত্যন্ত প্রঞ্জল ভাষায় পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন। তাই আসুন আমরা এই গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব বেলায়াতের অধিকারী ব্যক্তিকে চিনে জাহেলী যুগের ন্যায় মৃত্যু বরণ করা থেকে নিস্কৃতি লাভ করি।

অনুবাদসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বইটি ত্রুটিমুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য চেষ্টা- প্রচেষ্টা করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে যারাই স্বীয় মেধা ও শ্রম ব্যয় করে সাহায়্য-সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং তাদের পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট কামনা করছি। সুপ্রিয় পাঠক মহোদয় তারপরেও যদি কোথাও কোন ত্রুটি আপনাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পরে তা আমাদেরকে অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।

আশাকরি , এ সামান্য প্রচেষ্টা আপনাদের উপকারে আসবে। এ বই থেকে যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হন তাহলেই আমরা আমাদেরকে কৃতার্থ বলে মনে করবো।

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন

মুখবন্ধ

নিঃসন্দেহে রাসূল (সাঃ) এর পরে আলী ইবনে আবী তালিব (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব এমনই এক মহামূল্যবান ব্যক্তিত্ব যা এই বিশ্বজগতকে স্বীয় অস্তিত্বের মাধ্যমে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে।

তার স্বর্ণোজ্জল ব্যক্তিত্ব মনুষ্যজগতের সুউচ্চস্তরে এমনভাবে কিরন দিচ্ছে যা যুগ যুগ ধরে মানবজাতির জ্ঞান-গরিমাকে বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে।

ঐ পবিত্র ও মহান ঐশী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেতে সকল বিবেকবান ব্যক্তির চেতনাকেই উৎসাহিত করে কিন্তু এটা এমনই পথ যেটা প্রেমের কদম ব্যতীত অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

তার সম্পর্কে যা কিছু বলা ও লেখা হয়েছে , প্রকৃতার্থে শুধুই আমাদের জানা বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমিত , তার যে পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব আছে ঠিক সে পর্যায়ের নয়।

যদিও এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গাদীর দিবসকে ঈদ হিসেবে প্রমাণিত করা ও এই দিবসের কিছু আচার-অনুষ্ঠান বর্ণনা করা , কিন্তু উক্ত আলোচনার বাইরেও কিছু অধ্যায় ঐ ব্যক্তির (আলীর) ব্যক্তিত্বকে ব্যাখ্যার জন্য আলোচনা করেছি এবং রাসূলের (সা.) পাক-পবিত্র বাণীর আয়নাতে আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) সৌন্দর্যপূর্ণ উজ্জলষ্ঠ চেহারাকে দেখার চেষ্টা করেছি। আশাকরি , আমরা ও পাঠকবৃন্দ সকলেরই উক্ত গ্রন্থ থেকে আত্মার খোরাক জোগান দিয়ে কিছুটা হলেও আমাদের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে পারবো।

পরিশেষে কিছু বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক বলে মনে করছি , তা হচ্ছে- এই বইয়ের অধিকাংশ আলোচনাই আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ও বিশ্বস্ত গ্রন্থ হতে সংগৃহীত। আর প্রত্যেকটি হাদীস বা ঘটনার ক্ষেত্রে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটির মূল গ্রন্থের , খণ্ডের , লেখকের বা অনুবাদকের , প্রকাশনীর এবং প্রকাশস্থল ও তারিখসহ নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে (উল্লেখিত কিছু কিছু বিষয় এ বই-এর শেষের দিকে গ্রন্থ পরিচিতিতে আলোচনা করা হয়েছে)।

এছাড়া অতি সামান্য কিছু বিষয় বা ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যেটা আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করার কারণে বাধ্য হয়েছি শিয়া মাযহাবের বিশ্বস্ত কিছু গ্রন্থাদির আশ্রয় নিতে এবং সে গ্রন্থগু্লোকেও আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদির মত সুক্ষভাবে পরিচয় করা হয়েছে। কিছু কিছু হাদীস বা ঘটনার ক্ষেত্রে অল্পসংখ্যক মূল গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি কারণ , আমাদের বইয়ের পরিধি খুব কম। আর এর অর্থ এটা নয় যে , এই হাদীস বা ঘটনাগুলি আর অন্য কোন গ্রন্থে নেই।

আর সদা-সর্বদা চেষ্টা করেছি হাদীস বা ঘটনাগুলোকে হুবহু তুলে ধরার জন্য ,প্রয়োজনের ক্ষেত্রে উক্ত হাদীসের বা ঘটনার নিম্নে কিছু ব্যাখ্যা বা কিছু কথা সংযোজন করেছি।

আশাকরি , গাদীরের মহাসমুদ্র হতে এই বিন্দুমাত্র আলোচনায় উপকৃত হবেন।

প্রথম অধ্যায়

গাদীরের ঘটনা

ঈদ

আভিধানিকগণ ঈদ কে আওদ মূলধাতু হতে গৃহীত হয়েছে বলে মনে করেন। আর আওদ এর অর্থ হচ্ছে প্রত্যাবর্তন। সুতরাং প্রত্যেক ঈদকে তার প্রত্যাবর্তনের কারণেই উৎযাপন করা হয়ে থাকে ।

প্রতিটি ঘূর্ণায়মান গতিশীল বস্তুই প্রত্যাবর্তনের পথে নিম্ন পরিক্রমা শেষ করে ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং তখন তার ঊর্ধ্বযাত্রা শুরু হয়। প্রকৃতিতেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করি এবং নববর্ষকে প্রকৃতির শীতল দেহে নতুন প্রাণ সঞ্চারণের কারণে স্বাগত জানাই। প্রকৃতির সেই শীতল দেহ যা হেমন্তের আগমনে সুপ্ত ও শীতের তীব্রতায় এতটা নিশ্চিহ্ন হওয়ার দ্বার প্রান্তে পৌছে ছিল যেন অস্তিত্বে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল তা বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাসের পদচারণায় নতুনভাবে জেগে উঠে ও ঊর্ধ্বগমন শুরু করে। এই প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। তবে তা শুধুমাত্র সেই মতাদর্শের জন্য চুড়ান্ত লক্ষ্য বলে পরিগণিত হয় যা প্রকৃতি জগতের বস্তুগত দিকটিকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে থাকে ।

এখন যদি এই আদর্শকে এমন একটি মতাদর্শের উপর প্রয়োগ করতে চাই যা সমগ্র বিশ্বকে মানুষের অস্তিত্বের ভূমিকা এবং তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে আল্লাহর ইবাদত বলে মনে করে তাহলে অবশ্যই তার ঈদকে মানুষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিত জীবনের মহা প্রত্যাবর্তন হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এ ধরনের মতাদর্শে মানুষের নববর্ষ এমনই এক দিন যেদিন সে তার নিজের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে ও তার হারানো জিনিসকে সে ফিরে পায় ; এটা এমনই দিন , যে দিনে বস্তু জগতের নীচতা থেকে মুক্ত হয়ে (বস্তু আসক্তির পর্দা ভেদ করে) অবস্তু ঐশী জগতের দিকে ঊর্ধ্বযাত্রা শুরু করে । এ দিন মানুষ তার অভ্যন্তরীণ পবিত্র সত্তার উপর পড়া ধুলার আবরণকে সরিয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ লাভ করে।

পবিত্র রমজান মাস এমনই এক সময় , যে সময়ে সাধক রোজাদার রিপুর তাড়নার বিরুদ্ধে পতিরোধ গড়ে তোলার তৌফিক অর্জন করে ও আল্লাহর প্রতি ভালবাসার যে আগুন পার্থিবতার (বস্তুগত কামনার) বরফের মাঝে নির্বাপিত হয়েছিল পুনরায় তাকে জ্বলন্ত করে তোলে। সতর্ক হয়ে যায় যেন এ ভালবাসায় তার সমস্ত অস্তিত্বই উত্তপ্ত হয় ও তার অস্তিত্ব থেকে সকল প্রকার কুলষতা দূর হয়ে যায় তার হৃদয় থেকে নিখাদ নির্ভেজাল ইবাদতের দ্যুতি ছড়ায় এবং এর মাধ্যমে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধিত হয়। আর তখনই হয় তার জন্য ঈদুল ফিতর।

হজ্জও তেমনি একটি সুযোগ , হাজীগণ বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার পর সফল হয় জবেহ র স্থানে তার বন্ধু নয় এমন কারো গলায় ছুরি চালাতে ও তার বন্দী আত্মাকে মুক্ত করে মনুষ্যত্বের পথে ঊর্ধ্বালোকের দিকে অগ্রসর হয়ে ইবাদতের উচ্চতর স্তরে পৌছার। আর তখনই তার জন্য ঈদুল আযহা।

এখানেই ঈদ এবং অন্যান্য উৎসবের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে লক্ষ্য করা যায়।

উৎসব পালন আনন্দের জন্য একটি অজুহাত মাত্র। কিন্তু ঈদ হচ্ছে মানুষের পূনঃর্জীবনকে স্বাগত জানানো। এটাও একটা প্রমাণ যে , আনন্দ উৎসবের বিপরীত ঈদ হচ্ছে ধর্মীয় বিষয় এবং ইসলামী ঈদসমূহ দ্বীনের একটি অংশ।

সুতরাং ইসলামী ঈদের হাকিকাত বা বাস্তবতা হচ্ছে- দ্বিতীয় বার জীবন লাভ করা ও তা নির্ধারণের দায়িত্ব পবিত্র শরীয়াত বা ধর্মের উপর।

আমরা বিশ্বাসী যে , গাদীর দিবসটি প্রকৃত ইসলামী ঈদসমূহের বৈশিষ্ট্যের সাথে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ তেমনি ইসলামী আইন প্রণেতা মহান রাসূলও (সা.) এটাকে ঈদ হিসেবে মুসলিম উম্মতের নিকট তুলে ধরেছেন।

অত্র গ্রন্থটি উপরিউক্ত দু দিক থেকে গাদীরের ঈদকে প্রমাণের পাশাপাশি এই ঈদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানকে বর্ণনা করেছে।

এই বিবরণগুলির বিভিন্ন অধ্যায় পাঠ করে এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছি যে , ঈদে গাদীর দিবসটি ইসলামের মহান ঈদসমূহের একটি , যেটাকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঈদ বলা যেতে পারে এবং যদি পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখি তাহলে উপলদ্ধি করতে পারবো যে , এটা মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ঈদ।

গাদীর

আভিধানিক অর্থে গাদীর বলতে: ক্ষুদ্র জলাশয় , পুকুর বা ডোবাকে বুঝানো হয়। ঐ সকল গর্ত যেগুলি মরুভূমিতে অপেক্ষায় থাকে যে , কখন বৃষ্টি হবে আর নিজেকে সেই বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ করবে এবং তাকে পরিস্কার ও স্বচ্ছ করে দিবে যাতে মরুভূমির তৃষ্ণার্ত পথিকদেরকে এই সর্বদা বিস্তৃত দস্তরখান হতে পরিমাণ মত মহা মূল্যবান নেয়ামত বা অনুগ্রহ দ্বারা আপ্যায়ণ করতে পারে ও তাদের শুষ্ক মশককে পূর্ণ করে দিতে পারে , এমন ধরনের গর্তকে গাদীর বলা হয়।

গাদীরে খুম

যে সকল পথিক মদীনা হতে মক্কার দিকে যাত্রা করে , তাদের পথটির দূরত্ব হল পাচশ কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশী। এই পথিকগণ ২৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রান্ত করার পর যে স্থানে উপস্থিত হয় , সে স্থানটির নাম হচ্ছে রাগেব রাগেব জোহফা র নিকটবর্তী একটি ছোট শহর

আর জোহফা হচ্ছে- হজ্জের পাচটি মিকাত বা ইহরাম বাধার স্থানসমূহের মধ্যে একটি ; যেখানে শামের (সিরিয়ার) হাজীগণ ও যারা জেদ্দা থেকে মক্কায় যায় , তারা উক্ত স্থানে মোহরিম হয় বা ইহরাম বাধে। জোহফা হতে মক্কার দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার ও রাগেব পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার । সেখানে একটি জলাশয় ছিল যার পানি দুর্গন্ধ , বিষাক্ত ও পথিকদের জন্য ব্যবহার অনোপযোগী এবং কাফেলা বা পথিকরা সেখানে দাড়াতো না। বলা হয়ে থাকে সে কারণেই খুম নামকরণ করা হয়েছে। কারণ , খুম ঐ সমস্ত নষ্ট জিনিসকে বলা হয়ে থাকে যা দুর্গন্ধযুক্ত। তাই পাখির খাচাকেও এ কারণেই খুম বলা হয়ে থাকে ।

বিদায় হজ্জের একটি বিবরণ

হিজরী দশম বছর সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। আরবের সকল গোত্রই মুসলিম আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল , রাসূল (সা.)-এর রেসালাতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। মূর্তি ও মূর্তি পূজার কোন চিহ্নই তাদের কোন গোত্রের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না। রেসালাতের কর্ণধারের পরিশ্রম আজ ফলদায়ক হয়েছে এবং তার সুস্বাদু ফলকে উৎপাদনশীল করেছে। উপাস্যের সিংহাসন থেকে মূর্তি গুলোর পতন ঘটেছে ও পবিত্র বাণী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বিস্তৃত আরব উপদ্বীপে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

মানুষের মধ্যে এখন পার্থক্যকে শুধুমাত্র তাদের আন্তরিক ঈমানের পর্যায় ও ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতার ভিত্তিতে। মহান রাসূল (সা.) -যিনি প্রায় 23টি (তেইশটি) বছর ধরে প্রচহু জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন ও এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এক মূহুর্তের জন্যেও তার কর্তব্য ও রেসালাতের প্রচার কার্যে অবহেলা করেন নি- তিনি কখনোই দূর্বলতা অনুভব করেন নি , এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে , অতিশীঘ্রই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে এবং মহান প্রভূর সাথে সাক্ষাত করতে হবে। তাই পূর্বের মতই নিরলশ চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মত দীস্থিমান হয় ও ইসলামী আইন-কানুন শিক্ষা লাভ করে। অতি সামান্যই ইসলামী বিধি-বিধান অবশিষ্ট আছে যা এখনও প্রচারের ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত সময় আসেনি। ফরজ হজ্জ হচ্ছে তার একটি। তিনি তখনও সুযোগ পান নি যে , মুসলমানদেরকে নামাজের ন্যায় হজ্জের শিক্ষা দিবেন। তাই এখনই একমাত্র ও শেষ সময়।

সাধারণ ঘোষণা করা হল যে , রাসূল (সা.) হজ্জ করতে যাবেন। বিভিন্ন গোত্রের মানুষেরা মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং তিনি (সা.) জিলক্বদ মাসের 6 দিন (ছয় দিন) অবশিষ্ট থাকতে বৃহস্পতিবার4 অথবা চার দিন অবশিষ্ট থাকতে শনিবারে , আবু দুজানাকে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত করে5 তাঁর সমস্ত স্ত্রীগণ ও পরিবারবর্গসহ সঙ্গীদের নিয়ে যাত্রা করলেন6 তিনি একশ টি উট7 কোরবানীর জন্য সাথে নিয়ে মদীনা হতে যাত্রা করেছিলেন।

ঐ সময় মদীনায় রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। যারফলে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই এই বরকতময় সফর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।8 তারপরেও হাজার হাজার লোক রাসূল (সা.)-এর সহযাত্রী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তার সহযাত্রীর সংখ্যা চল্লিশ হাজার , সত্তর হাজার , নব্বই হাজার , একলক্ষ চৌদ্দ হাজার , একলক্ষ বিশ হাজার , একলক্ষ চব্বিশ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন।9 কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি আরো বলা যেতে পারে যে , আসলে এত পরিমাণ জনগণ তার সহযাত্রী হয়েছিলেন যে , তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কারো সাধ্য ছিল না।10 তাও আবার তারা শুধু ঐ সকল ব্যক্তিই ছিলেন যারা মদীনা হতে এসেছিলেন। তবে হাজীদের সংখ্যা এর মধ্যেই সীমিত ছিল না। কেননা , মক্কার ও তার আশেপাশের অধিবাসীগণ এবং যারা ইয়েমেন থেকে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর সাথে এসেছেন তারাও উক্ত হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাসূল (সা.) গোসল করলেন ও পবিত্র দেহ মোবারকে তেল মালিশ করলেন , সুগন্ধি লাগালেন এবং চুলগেুলোকে চিরুণী দিয়ে আচড়ে পরিপাটি করলেন।11 অতঃপর মদীনা হতে বের হলেন। মদীনা হতে বের হওয়ার সময় তার শরীরে মাত্র দু টি কাপড় ছিল যার একটি ছিল কাধের উপর রাখা আর অপরটি ছিল কোমরে বাধা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন , যখন জিল হুলাইফা তে পৌছালেন তখন ইহরাম বাধলেন।12 অতঃপর আবারও পূর্বের ন্যায় পথ চলতে শুরু করলেন এবং জিলহজ্জ মাসের চার তারিখ মঙ্গলবারে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বনী শাইবা র ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে (কাবা ঘরে) প্রবেশ করলেন ,13 তাওয়াফ করলেন , তাওয়াফের নামাজ পড়লেন , সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করলেন এবং নিয়মানুযায়ী ওমরার কর্মাদি সম্পাদন করলেন।14 যারা নিজেদের সাথে কোরবানীর পশু নিয়ে আসেননি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন- তারা যেন চুল কেটে ইহরাম খুলে ফেলে।15 তিনি (সা.) যেহেতু কোরবানীর পশু নিয়ে এসেছিলেন তাই ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন যতক্ষন পর্যন্ত না মীনা তে কোরবানী করেন।16 আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) যেহেতু রাসূল (সা.)-এর হজ্জে যাওয়ার কথা ইতিপূর্বেই অবগত হয়েছিলেন তাই তিনিও ইয়েমেন থেকে 37টি (সাইত্রিশটি) কোরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছিলেন ও ইয়েমেনের অধিবাসীদের মিকাতে ঐ একই নিয়্যতেই , যে নিয়্যতে রাসূল (সা.) ইহরাম বেধেছিলেন , ইহরাম বাধলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ন্যায় সাফা ও মারওয়া সাঈ করার পর ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন।17

রাসূল (সা.) জিলহজ্জ মাসের 8ম (অষ্টম) দিনে মীনা হয়ে আরাফা র ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন যাতে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শুরু করতে পারেন। 9ম (নবম) দিনের সূর্য়যাদয় পর্যন্ত মীনা তেই ছিলেন। অতঃপর আরাফায় পৌছে স্বীয় তাবুতে অবস্থান নিলেন।

আরাফায় মুসলমানদের আড়ম্বরপূর্ণ জন সমাবেশে প্রাঞ্জল ভাষায় খুতবা পাঠ করলেন। তার এই খুতবাতে মুসলমানদেরকে ভ্রাতৃত্বের প্রতি ও পরস্পরের প্রতি সম্মানের কথা তুলে ধরলেন ; ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগের সমস্ত আইন-কানুনকে বাতিল ঘোষণা করলেন এবং স্বীয় রেসালাতের সমাপ্তির কথাও ব্যক্ত করলেন।18 9ম (নবম) দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। যখন সূর্য অস্তমিত হল ও অন্ধকার নেমে আসল তখন মুজদালাফা র উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।19 তিনি সেখানেই রাত্রি যাপন করার পর দশম দিনের প্রত্যুশে মীনা র দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মীনা র নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে হজ্জ শেষ করলেন এবং এভাবেই হজ্জের বিধি-নিষেধগুলি মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিলেন।

এই হজ্জকে হাজ্জাতুল বিদা , হাজ্জাতুল ইসলাম , হাজ্জাতুল বালাগ , হাজ্জাতুল কামাল ও হাজ্জাতুত তামাম বলা হয়ে থাকে ।20 হজ্জের অনুষ্ঠান সমাপনীর পর তিনি মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন। যখন রাগেব নামক স্থানে পৌছালেন , (যে স্থানটিকে গাদীরে খুম বলা হত) হযরত জিব্রাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং তার নিকট ঐশীবাণী এভাবে পাঠ করলেন-21

) ي َا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ(

হে রাসূল! প্রচার করুন আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন , তাহলে আপনি তার রেসালাতের কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে (একদল) মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।22

আল্লাহর এই বাণী এমন এক নির্দেশ যা রাসূল (সা.)-এর উপর গুরুদায়িত্ব হিসেবে অর্পন করা হয়েছে ; এমনই এক ঘোষণা যে , কেউ যেন এ সম্পর্কে অনবগত না থাকে , আর যদি তিনি এমনটা না করেন তাহলে যেন এমন যে , তিনি দ্বীনের কোন কাজই সম্পাদন করেননি। সুতরাং এই বাণী প্রচারের জন্য উক্ত স্থানই ও উক্ত সময়ই সর্বোত্তম ; যেখানে মিশর , ইরাক , মদীনা ও অন্যান্য সকল স্থানের অধিবাসীদের পরস্পরের পথ আলাদা হওয়ার স্থান। আর সকল হাজীগণ অনন্যোপায় হয়ে এই পথই পাড়ি দিয়ে থাকেন। গাদীরের খুম নামক স্থানটিই একমাত্র স্থান ছিল যেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীটি সমস্ত হাজীদের কর্ণ কুহরে পৌছানো সম্ভবপর।

তাই সকলকে সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হল। তিনি বললেন অগ্রগামীদের ফিরে আসতে বল আর পশ্চাৎপদদের জন্য প্রতীক্ষা কর।23 হেজাজের উত্তপ্ত মরুতে জনগণের ঘটেছিল এক মহা সমাবেশ। দিনটিতে ছিল প্রচহু গরম ও এলাকাটির তাপ্রমাত্রাও ছিল অত্যন্ত বেশী ; এত গরম ছিল যে , সেখানকার পুরুষরা তাদের স্বীয় বস্ত্রের অর্ধাংশ দিয়েছিলেন মাথায় আর অর্ধাশ দিয়েছিলেন প্রায়র নীচে।24 সকলের মনে একই প্রশ্ন ছিল যে , কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে যে , এরকম প্রচহু গরমের মধ্যে বা বাহ্যিক দিক থেকে অনুপোযুক্ত জায়গায় রাসূল (সা.) আমাদেরকে স্বস্থানে অবস্থানের নির্দেশ দিলেন ? তাপামাত্রা এত উচ্চ মাত্রায় পৌছেছিল যে , হাজীদেরকে অস্থির করে ফেলছিল।

তিনি নির্দেশ দিলেন- যেন বয়োবৃদ্ধদেরকে বৃক্ষতলে নিয়ে যাওয়া হয় আর উটের জিনগু্লোকে যেন একটার উপর অপরটা রেখ মঞ্চ বানানো হয়। সুউচ্চ মঞ্চ তৈরী করা হল। প্রায় দুপুরের সময় যখন হাজীগণ ঐ মরুভূমিতে একত্রিত হয়েছিল , তিনি মঞ্চে আরোহন করলেন এবং এভাবে একটি বক্তব্য প্রদান করলেনঃ

সকল প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য । আমরা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি , তার প্রতি ঈমান আনয়ন করি , তার প্রতিই ভরসা করি এবং নাফসের তাড়না ও অসৎ আচরণের জন্য চাই তাঁর নিকট আশ্রয় ; তিনি এমনই প্রভূ যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই আর যাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেন তার কোন পথভ্রষ্টকারী নেই । আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রভূ নেই ও মুহাম্মদ তারই প্রেরিত বান্দা অতঃপরঃ

হে উপস্থিত জনতা ; সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা আমাকে অবগত করেছেন যে , কোন নবীই তার পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেকের বেশী বয়স ধরে জীবন যাপন করে নি এবং অচিরেই আমাকেও চিরস্থায়ী আবাসের দিকে আহবান করা হবে , আর আমিও তার আহবানে সাড়া দিব। এটা বাস্তব যে , আমাকে ও তোমাদের সবাইকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। তখন তোমরা কি জবাব দিবে ?

সকলেই বললেনঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের নিকট পৌছিয়েছেন ও উপদেশ দান করেছেন এবং চেষ্টা- প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি করেননি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন।

তিনি বললেনঃ তোমরা কি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছ যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত বান্দা , তার প্রতিশ্রুত বেহেশত , দোযখ ও মৃত্যু সত্য এবং নিঃসন্দেহে পুনরুত্থান সংঘটিত হবে ও আল্লাহ তায়ালা সকল মৃত বক্তিদেরকে জীবিত করবেন ?

সকলেই বললেনঃ হ্যা , আমরা এ সকল বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি।

তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। 25

অতঃপর বললেনঃ হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ?

তারা বললেনঃ হ্যা।

তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাউসারে উপস্থিত হব আর তোমরা হাউজের পার্শ্বে আমার নিকট উপস্থিত হবে ; ঐ হাউজটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে সানআ হতে বুসরা র দৈর্ঘ্যের সমান এবং সেখানে রয়েছে রৌপ্য পানপাত্র ও এর সংখ্যা নক্ষত্রের সমান। এখন দেখতে চাই যে , আমার পরে তোমরা আমার এই দু টি মহামূল্যবান বস্তুর সাথে কেমন আচরণ কর।

উপস্থিত জনগণের মধ্য হতে একজন বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! ঐ দু টি মহা মূল্যবান বস্তু কি ?

তিনি বললেনঃ ঐ দু টি বস্তু হচ্ছে- একটি সবচেয়ে বড় যা আল্লাহর কিতাব (কোরআন)। যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্তটি তোমাদের হাতে ; তাই এটাকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে যাতে পথভ্রষ্ট না হও। আর অপরটি হচ্ছে- ইতরাত বা আমার নিকটাত্মীয়। মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তায়ালা আমাকে জানিয়েছেন যে , এ দু টি বস্তু কিয়ামতের দিনে হাউজে কাউসারে আমার নিকট না পৌছা পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। আর আমিও আল্লাহর নিকট এটাই কামনা করেছিলাম। সুতরাং তোমরা তাদের অগ্রবর্তী হবে না , হলে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পশ্চাতে পড়ে থাকবে না , তাহলেও ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর আলীর হাত ধরে উচু করলেন। আর এমনভাবে উচু করলেন যে , তাদের দু জনেরই শুভ্র বগল দেখা যাচ্ছিলো এবং সেখানকার সকলেই আলীকে চিনতে পারলো।

তখন তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! মু মিনদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম এবং তাদের উপর প্রাধান্য রাখে ?

সকলেই বললোঃ আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

তিনি বললেনঃ আল্লাহ আমার মাওলা ও অভিভাবক , আমি মু মিনদের মাওলা ও অভিভাবক। আর আমি মু মিনদের উপর তাদের চেয়ে প্রধান্য রাখি। সুতরাং আমি যাদের মাওলা ও অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা ও অভিভাবক। 26

এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন।

অতঃপর বললেনঃ হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে ;27 তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে , তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে নিঃসঙ্গ করে28 এবং সত্যকে সর্বদা আলীর সাথে রাখ সে (আলী) যে দিকেই থাক না কেন। 29

হে লোকসকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা এই বাণীটি অবশ্যই অনুপস্থিতদের নিকট পৌছিয়ে দিবে।30

রাসূল (সা.)-এর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর জিব্রাইল (আ.) দ্বিতীয়বার অবতীর্ণ হলেন এবং তাকে এই বাণীটি পৌছে দিলেনঃ

) ال ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও নেয়ামত বা অনুগ্রহকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-3)31

রাসূল (সা.) এই আনন্দদায়ক বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর আনন্দিত হলেন এবং বললেন- আল্লাহ মহান! কেননা দ্বীন পরিপূর্ণ ও নেয়ামত বা অনুগ্রহ সম্পূর্ণ এবং মহান প্রভূ আমার রেসালাতের বা নবুয়্যতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।32

অভিনন্দন অনুষ্ঠান

রাসূল (সা.) তার বক্তব্য শেষ করার পর মঞ্চ থেকে নেমে আসলেন ও একটি তাবুতে বসলেন এবং বললেনঃ আলীও যেন অপর এক তাবুতে বসে। অতঃপর নির্দেশ দিলেন , সকল সাহাবীগণ যেন আমিরুল মু মিনীনের সাক্ষাতে যায় এবং বেলায়াতের মর্যাদার জন্য তাকে অভিনন্দন জানায়।

ইতিহাস গ্রন্থ রওজাতুস সাফা এর লেখক গাদীরের ঘটনা উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ রাসূল (সা.) এর নির্দেশ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট তাবুতে বসলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন যেন পর্যায়ক্রমে সকলেই আলীর তাবুতে যায় ও তাকে অভিনন্দন জানায়। যখন সবাই এই কাজটি সম্পন্ন করলেন , উম্মাহাত (এর উদ্দেশ্য রাসূলের (সা.) স্ত্রীগণ অর্থাৎ উম্মাহাতুল মু মিনীন অর্থাৎ উম্মতের জননী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।) আলীর নিকট গেলেন এবং তাকে অভিনন্দন জানালেন।33

হাবিবুস সীয়ার নামক ইতিহাস গ্রন্থে গাদীরের হাদীস বর্ণনার পর এরূপে এসেছে যে , অতঃপর আমিরুল মু মিনীন আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু অর্থাৎ মূর্তির সমীপে তার শির কখনো নত হয়নি) রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের ভিত্তিতে এক তাবুতে বসলেন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাকে অভিবাদন জানাতে পারে , বিশেষ করে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের কণর্ধারকে বললেন-

بخ بخ یا بنابی طالب اصبحت مولای و مولی کل مؤمن و مؤمنة

অর্থাৎ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।34

তারপর উম্মাহাতুল মু মিনীন রাসূল (সা.)-এর ইঙ্গিতে আমিরুল মু মিনীনের তাবুতে গেলেন এবং তাকে অভিবাদন জানালেন। বিশিষ্ট শিয়া মুফাসসীর ও মুহাদ্দিস মরহুম তাবারসী তার ইলামুল ওয়ারা নামক গ্রন্থে ও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।35

সকল সাহাবীগণ আবার রাসূল (সা.)-এর হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করলেন এবং সেই সাথে আলী (আ.)-এর সাথেও বাইয়াত বা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। সর্ব প্রথম যে ব্যক্তিবর্গ রাসূল (সা.)-এর ও আলী (আ.)-এর হাতে হাত রেখেছিলেন তারা ছিলেন আবু বকর , উমর , উসমান , তালহা ও জোবায়ের।36 ইতিপূর্বেও তুলে ধরেছি যে , অভিনন্দনের জন্য হযরত উমর যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন , তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেনঃ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।37 আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ মুহাদ্দিস বা হাদীসবেত্তাগণ এই ঘটনাটি ঐ সকল সাহাবীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং উমরের কন্ঠে এই বাক্যটি শুনেছিলেন। যেমন- যারা এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে- ইবনে আব্বাস , আবু হোরায়রা , বুরাআ ইবনে আযিব , যায়েদ ইবনে আরকাম , সা আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস , আবু সাঈদ খুদরী এবং আনাস ইবনে মালিকের নাম উল্লেখযোগ্য ।

আল্লামা আমিনী তার আল-গাদীর নামক গ্রন্থে 60 জন (ষাটজন) আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন যারা স্বীয় গ্রন্থে উক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন।38 আবার অনেকেই এটাকে আবু বকরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।

যখন অভিনন্দন অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘটল তখন হাসসান্ বিন সাবিত নামক একজন কবি , যিনি স্বীয় যুগে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন , তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমতি প্রার্থনা করছি যে , আপনার উপস্থিতিতে আলীর উদ্দেশ্যে কবিতার ক টি লাইন পাঠ করবো।

তিনি (রাসূল)বললেনঃ আল্লাহর নামে শুরু কর।

অতঃপর হাসসান্ উচু স্থানে উঠে পাঠ করতে লাগলেনঃ মুসলমানদের রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে উচ্চস্বরে তাদেরকে ডাকলেন , কতটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে , আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এভাবে আহবান করছেন।

তিনি বললেনঃ তোমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক এবং রাসূল কে ?

সেখানকার সকলেই নির্দ্বিধায় বললেনঃ আপনার আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং আপনি আমাদের রাসূল ও আমাদের মধ্যে এমন একজনকেও পাবেন না , যে বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) নির্দেশের ক্ষেত্রে আপনার অবাধ্য হবে ও বিরোধিতা করবে।

তখন আলীকে বললেনঃ হে আলী উঠে দাড়াও! কারণ , আমি তোমাকে আমার পরে ইমামত ও নেতৃত্বের জন্য নির্বাচন করেছি।

অতএব আমি যাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক , এই আলীও অনুরূপ তাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং তোমরা তার সঠিক অনুসারী হও এবং তাকে ভালবাস।

এবং সেখানে দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ! আলীর বন্ধু্কে তোমার বন্ধু মনে কর এবং যে আলীর সাথে শত্রুতা করবে তুমিও তার সাথে শত্রুতা কর।39

গাদীর দিবসে বেলায়াতের মুকুট পরানো

বাইয়াত বা অঙ্গীকার অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল।40 যেহেতু সবাই মহান খেলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে জেনে গেছেন ও রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধিও নির্বাচন হয়ে গেছে এবং জনগণও তার সাথে পরিচিতি লাভ করেছেন ও তার হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করেছেন , তাই এখনই উপযুক্ত সময় হচ্ছে রাজ মুকুট পড়ানোর মত অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। রাসূল (সা.) আমিরুল মু মিনীন আলীকে (আ.) ডাকলেন ও স্বীয় পাগড়ীটি , যার নাম ছিল সাহাব তার মাথায় পরালেন এবং প্রান্তটি তার গ্রীবা পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে বললেনঃ

یا علی العمائم تیجان العرب

অর্থাৎ হে আলী! পাগড়ী হচ্ছে আরবদের মুকুট।41

অতঃপর তিনি তার সুন্নাতানুসারে পাগড়ী পড়ানো হয়েছে কি-না তা নিরীক্ষণ করার জন্য বললেনঃ আমার দিকে মুখ ফিরে দাড়াও। তিনি দাড়ালেন। তিনি বললেনঃ এবার ঘুরে দাড়াও। তিনি ঘুরে দাড়ালেন।42

এমতাবস্থায় সাহাবীদের দিকে মুখ ফিরে বললেনঃ যে সকল ফেরেশতা বদর ও হুনায়নের যুদ্ধের দিন আমাকে সাহায্য করতে এসেছিল তারা ঠিক এইভাবেই পাগড়ী পরেছিল।43

তিনি আরো বলেনঃ পাগড়ী হচ্ছে ইসলামের নিদর্শন।44 পাগড়ী এমনই চিহ্ন যা মুসলমানদেরকে মুশরিক হতে পৃথক করে।45 তিনি বলেছেনঃ ফেরেশতা ঠিক এরূপে আমার নিকট আসে।46

এভাবেই গাদীরের ঘটনার সমাপ্তি ঘটলো এবং হাজীগণ প্রত্যেকেই স্বীয় অঞ্চলের বা দেশের পথ ধরে সেখান থেকে জাজিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা বেলায়াত বা শাসন কর্তৃত্বের হাদীসটি সমস্ত মুসলমানের কানে পৌছে দিয়েছেন।

এখন যেহেতু সংক্ষিপ্তাকারে গাদীরের বীরত্বগাথা ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা জানলাম তারপরেও দু টি কথা উল্লেখ করা দরকারঃ

ক. ইতিহাসের দৃষ্টিতে গাদীরের ঘটনার সত্যতা ;

খ. গাদীর দিবসে প্রদত্ত রাসূল (সা.)-এর ভাষণের তাৎপর্য।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13