আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর23%

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর লেখক:
: মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25702 / ডাউনলোড: 4813
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাদীরের ঘটনার সত্যতা

গাদীর একটি ঝর্ণাধারা যা হতে নির্মল স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল ইসলাম প্রস্ফুটিত হয়েছে। যে ব্যক্তি এই প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে নিল সে যেন তার জীবনকে এই নির্মল প্রকৃত সত্যের ঝর্ণায় স্নান করিয়ে নিল ও মহান নির্ভেজাল ইসলামে নিজের স্থান করে নিল। আর যে ব্যক্তি কোন ওজর , আপত্তি ও বাহানা দেখিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল বা না শুনার ভান করল তার কপালে দূরের ঘন্টার আওয়াজ ব্যতীত কিছুই জুটবে না।

শুধুমাত্র গাদীরই প্রথম পদক্ষেপ নয় যে , রাসূল (সা.) তার প্রতিনিধিকে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়েছেন। তিনি বহুবার অনেক অনুষ্ঠানে তার ভাষণে বিভিন্নভাবে এই সত্যতার কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে পরবর্তী নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। যারা তার নিকট আসা- যাওয়া করত তারা এই ইসলামী রাষ্ট্রের উল্লিখিত ঘটনা থেকে বেখবর ছিল না , তারা জানতেন যে , আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী খলিফা ও তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় এবং সবার চেয়ে নিকটবর্তী সাহাবী।

খেলাফতের বিষয়টি এমন ছিল না যে , দশম হিজরী পর্যন্ত নিরব নিস্তব্ধ ছিল। রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধি সেদিনই নির্ধারিত হয়েছে যেদিন মক্কাতে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে।৪৭

তার পর বিশেষ করে হিজরতের পরের বছরগুলিতে এই বিষয়টি এতপরিমাণ পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে , মদীনায় প্রায় সকলেই এর সাথে পরিচিত ছিল। সকলেই মানযিলাতে র হাদীস যা তিনি তাবুকের যুদ্ধের সময় বলেছিলেন , রাইয়াতে র হাদীস যা তিনি আলী (আ.) সম্পর্কে খন্দকের যুদ্ধের সময় বলেছিলেন , তাইর -এর হাদীস৪৮ শুনেছিলেন। সাকালাইন৪৯ - এর হাদীসটি বারংবার তাদের নিকট পঠিত হয়েছে , আয়াত সমূহের নাজিল বা অবতীর্ণ যেমন- মোয়াদ্দাত৫০ -এর আয়াত , মোবাহেলা এর আয়াত৫১ ও বেলায়াত -এর আয়াত৫২ কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল আমিরুল মু মিনীনের ব্যক্তিত্বের সূর্য দ্বীপ্তময় হয়ে দেখা দেয়ার জন্যে।

এ সকল কারণেই গাদীরের হাদীসের প্রসিদ্ধি লাভ ছিল ন্যায় সঙ্গত। যত হাদীস এ সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সবই সহীহ , প্রসিদ্ধ এবং কিছু কিছু মোতাওয়াতির বা বিশ্বস্ত । কিন্তু গাদীরের হাদীস তাওয়াতুরের (বর্ণনার বাহুল্যের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার) সীমাও অতিক্রম করেছে।

মরহুম আলামলু হুদা সাইয়্যেদ মরতাজা এ সম্পর্কে বলেছেনঃ

যে ব্যক্তি এর (গাদীরের হাদীসের) সত্যতার দলিল-প্রমাণ চায় , সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় , যে ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর প্রসিদ্ধ যুদ্ধসমুহের অবস্থা সম্পর্কিত হাদীসেরও সত্যতার প্রমাণ চায় এবং ঠিক ঐরূপ যেমন- বলা যেতে পারে সে প্রকৃতার্থে বিদায় হজ্জের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। কারণ , এগুলো সবই প্রসিদ্ধতার দিক থেকে সম পর্যাযের।

কেননা , সকল শিয়া আলেমই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীস বিশারদরাও দলিল সহকারে তা বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিকগণ ও জীবনী লেখকগণও যেভাবে প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে থাকেন , ঠিক ঐরূপে এটাকে লিপিবদ্ধ করেছেন , প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা নির্দিষ্ট সূত্র ছাড়াই বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবেত্তাগণ ইহাকে হাদীসের সমষ্টিতে সহীহ হিসেবে সন্নিবেশিত করেছেন। এ হাদীসটি এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা অন্য কোন হাদীসের নেই। কেননা আখবর বা হাদীস দু ধরনেরঃ

এক ধরনের হাদীস আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন সূত্রের প্রয়োজন হয় না। যেমন- বদর , খায়বার , জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধের সংবাদ ও সকল প্রসিদ্ধ ঘটনাসমূহ যেগুলো বিশেষ সূত্র ছাড়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে বর্ণিত হয়েছে এবং মানুষ ঐ বিষয়ে অবহিত।

দ্বিতীয় প্রকার আখবর বা হাদীসের ক্ষেত্রে সনদের বা দলিলের দিক থেকে বর্ণনা সূত্রের অবিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন হয়। যেমন- যে সকল হাদীস শরীয়তের বিধি-বিধান সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে।

গাদীরের হাদীস দু ভাবেই বর্ণিত হয়েছে ; অর্থাৎ বস্তুতঃপক্ষে প্রসিদ্ধির দিক থেকে সর্বজন বিদিত হওয়া ছাড়াও বর্ণনা সূত্রের অবিচ্ছিন্নতার দিক থেকেও পূর্ণতার অধিকারী।

এছাড়াও যে সকল হাদীস শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে সবগুলোই খবরে ওয়াহেদ বা বর্ণনাকারীর সংখ্যা অতি নগণ্য , কিন্তু গাদীরের হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা অত্যধিক।৫৩

আমরা এই পুস্তকে ঐ সকল হাদীস বর্ণনাকারী সবার নাম উল্লেখ করতে চাই না। কারণ , এখানে তার স্থান সংকুলানও হবে না আর তার প্রয়োজনও নেই। মরহুম আল্লামা আমিনী উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীর জীবন ধারার ক্রমানুসারে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি শতাব্দীক্রমে গাদীরের হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যারা এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী তাদেরকে মূল্যবান গ্রন্থ আল-গাদীর পাঠ করার সুপারিশ করছি।৫৪

রাসূল (সা.)-এর সাহাবীগণের মধ্যে ১১০ জন সাহাবী

তাবেয়ীদের মধ্যে ৮৪ জন

২য় হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ৫৬ জন

৩য় হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ৯২ জন

৪র্থ হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ৪৩ জন

৫ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ২৪ জন

৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ২০ জন

৭ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ২১ জন

৮ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১৮ জন

৯ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১৬ জন

১০ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১৪ জন

১১তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১২ জন

১২তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১৩ জন

১৩তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১২ জন

১৪তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে ১৯ জন

এই হাদীসটি আহমাদ ইবনে হাম্বাল ৪০টি সনদসহ , ইবনে জারীর তাবারী ৭০-এর কিছু বেশী সনদসহ , জাজারী মাকাররী ৮০টি সনদসহ , ইবনে উকদা ১১৫টি সনদসহ , আবু সা দ মাসউদ সাজেসতানী ১২০টি সনদসহ এবং আবু বকর জা বী ১২৫টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন।৫৫ ইবনে হাজার তার সাওয়ায়েক নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে , এই হাদীসটি রাসূল (সা.) এর ৩০জন সাহাবী হতে বর্ণিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশ সনদ সহীহ অথবা হাসান।৫৬

ইবনে মাগাজেলী তার মানাকেব গ্রন্থে লিখেছেনঃ

গাদীরের হাদীসটি এত বিশুদ্ধ যে , রাসূল (সা.)-এর প্রায় ১০০জন সাহাবী , যাদের মধ্যে আশারা মোবাশশারাগণও্ (শ্রেষ্ঠ দশজন সাহাবী) রয়েছেন , তারা সরাসরি রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে তা বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি দৃঢ় ও কোন প্রকার আপত্তিকর কিছু নেই। আর এটা এমনই এক মর্যাদা যার একমাত্র অধিকারী হচ্ছেন আলী , অনে কেউ এই মর্যাদার ক্ষেত্রে তার অংশীদার নয়।৫৭

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস একজন ইমামীয়া শিয়া আলেম , তিনি তার ইকবালুল আমাল গ্রন্থে লিখেছেনঃ

আবু সা দ মাসউদ ইবনে নাসির সাজেসতানী একজন সুন্নী আলেম তিনি ১৭ খণ্ডের একটি বই লিখেছেন যার নাম আদ দিরায়া ফি হাদিসিল বিলায়াহ । উক্ত গ্রন্থে তিনি এই হাদীসটি ১২০ জন সাহাবী হতে বর্ণনা করেছেন।

মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী তার আর-রদ্দু আলাল হারকুসিয়্যাহ গ্রন্থে বেলায়াতের হাদীসটি ৭৫টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

আবুল কাসেম আব্দুল্লাহ হাসকানী এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম হচ্ছে- দায়াউল হুদা ইলা আদায়ি হাক্কিল উলাত

আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে সাঈদ উকদাহ , তিনিও হাদীসুল বিলায়াহ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং উক্ত হাদীসটি ১৫০টি সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাবীর (বর্ণনাকারীর) নাম উল্লেখ করার পর লিখেছেন যে , শুধুমাত্র তাবারীর বইটি ব্যতীত এ বিষয়ে সমস্ত বই আমার লাইব্রেরীতে বিদ্যমান আছে ; বিশেষ করে ইবনে উকদাহ -এর গ্রন্থ হতে তার জীবদ্দশায়ই (৩৩০ হিজরীতে) আমি বর্ণনা করেছিলাম।৫৮

সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- দ্বিতীয় শতাব্দীর পর- যে সময় থেকে মাযহাব সমূহের সীমা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে তৎপরবর্তী- এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের একজনও শিয়া ছিলেন না। শিয়াদের মাঝেও এমন আলেম খুব কমই পাওয়া যাবে যারা গাদীরের হাদীসটি বিভিন্ন উৎস বা সূত্রসহ বর্ণনা করেন নি।

গাদীরের হাদীসের গুরুত্ব এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে , বিশ্বের অনেক আলেমই , এ সম্পর্কে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আল্লামা আমিনী তার রচিত গ্রন্থ আল-গাদীর এ উল্লেখ করেছেন , তার সময়কাল পর্যন্ত প্রসিদ্ধ অনেক আলেম গাদীরের হাদীসটির বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বহুল সূত্রে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণের জন্য স্বতন্ত্র ভাবে ২৬টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।৫৯

উক্ত ঘটনাটি সবার নিকট এতটা স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য ছিল যে , আহলে বাইত বা নবী পরিবারের সদস্যগণ ও তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্নভাবে হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। হাদীসের মধ্যে পাওয়া যায় যে , রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদেরকে শপথ দিয়ে বলতেন যে , তোমাদের কি স্মরণ নেই রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে বলেছিলেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা , তারাও শপথ করে বলতেন যে , তাদের সেই ঘটনা স্মরণ আছে।৬০

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে , গাদীরের হাদীস সত্য যেটা অস্বীকার করার মত কোন সুযোগ নেই এবং হাতে গোণা ক জন আলেম নামধারী মূর্খ ব্যক্তি যারা কখনোই পারবে না গাদীরের হাদীসের সত্যতাকে ঢাকতে- কারণ দিবালোকের ন্যায় সত্যকে আবৃত করা কখনই সম্ভব নয়- অপপ্রয়াস চালায় ঢাকার জন্য। সে সব কারণেই ইমাম আলী (আ.) গ্রন্থের লেখক আব্দুল ফাত্তাহ আব্দুল মাকসুদ মিশরী , আল-গাদীর গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেনঃ

গাদীরের হাদীস নিঃসন্দেহে , এমনই এক বাস্তব ও বিশুদ্ধ হাদীস যা শতচেষ্টা করলেও প্রতাখ্যান করা সম্ভব নয় ; তা দিবালোকের ন্যায় পোজ্জ্বল ও দ্বীপ্তিময়। রাসূল (সা.)-এর অন্তঃকরণে বিদ্যমান ঐশী সত্যের স্ফুরণ হতে যা উৎসারিত হয়েছে ; যার মাধ্যমে তার কাছে প্রশিক্ষিত তার এই ভ্রাতা ও মনোনীত ব্যক্তির মর্যাদা উম্মতের মাঝে প্রকাশ পায়।৬১

কোরআনের ভাষাগত রূপ আল্লাহর

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াতের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য আদেশ আসার পূর্বেও তিনি আসমান-যমীনের নিগূঢ় সত্য অবলোকন করতেন। এর বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব , অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে , এ নিগূঢ় সত্যের প্রত্যক্ষকরণ তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিলো। কিন্তু তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত করা হলো এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো , তখন তাঁর জন্য বড় সমস্যা ছিলো এই যে , যে মহাসত্য ( ইলমে হুযূরী রূপে অবস্তুগত কোরআন মজীদ) তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো - যা কোনো কালির হরফে লেখা কিতাব্ ছিলো না (সম্ভবতঃ এ কারণেই - লাওহে মাহ্ফূযে সংরক্ষিত কিতাব্ পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো না বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে নিরক্ষর রেখেছিলেন) , তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল ( আঃ) ভাষার আবরণে পর্যায়ক্রমে এ মহাসত্যকে তাঁর মুখে জারী করেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মুখে এ কোরআন ভাষার আবরণে জারী হলো বটে , কিন্তু এর ভাষা তাঁর নিজের নয়। বিশেষ করে তিনি তৎকালীন আরবের কোনো কবি , সাহিত্যিক , বাগ্মী , বা অলঙ্কারবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না ; এমনকি তিনি লিখতে-পড়তেও জানতেন না। অতএব , মানুষের সকল ভাষার মধ্যে প্রকাশক্ষমতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ভাষা আরবী ভাষার এ শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের ভাষা ও বক্তব্য তাঁর নিজের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ গ্রন্থ যার পক্ষ থেকে তাঁর হৃদয়পটে নাযিল্ হয়েছিলো তথা প্রবেশ করেছিলো তিনি স্বয়ং একে সম্ভাব্য সর্বোত্তমরূপে মানুষের বোধগম্য ভাষায় পরিবর্তিত করে হযরত জিবরাঈল ( আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে ও মন-মগযে গ্রথিত করে দেন এবং তাঁর মুখে অন্যদের নিকট প্রকাশ করেন।

কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে যে সত্য প্রবেশ করেছিলো এবং তিনি যে সত্য অহরহ প্রত্যক্ষ করছিলেন এভাবে মানুষের ভাষার আবরণে প্রকাশের মাধ্যমে কি সে সত্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব ছিলো ? বস্তুতঃ শ্রবণ কখনোই প্রত্যক্ষকরণের - শুধু চক্ষু দ্বারা নয় , পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষকরণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। অভিজ্ঞতার বিবরণ পাঠে কোনোদিনই অভিজ্ঞতা হাছ্বিল হয় না।

তাছাড়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ , আরবী ভাষা মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী ভাষা হলেও তা মানুষের ভাষা বৈ নয়। মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিষয়াদির জন্যে কোনো ভাষায়ই যথোপযুক্ত শব্দাবলী ও প্রকাশকৌশল থাকতে পারে না , তা সে ভাষা যতোই না প্রায় সীমাহীন প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী হোক। এমতাবস্থায় , মানুষের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জগতের সত্যসমূহকে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের শব্দাবলী ও পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করে মোটামুটি এজমালীভাবে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , ভাষার আবরণে যে কোরআন মজীদ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হলো তা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের একটি পর্যায়গত ও মাত্রাগত অবতরিত রূপ বৈ নয়। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের দ্বিতীয় দফা নাযিল্ বা মানগত অবতরণ। কোরআন মজীদের এ পর্যায়গত বা মানগত অবতরণ ঘটে সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে ।

নুযূলের আরো পর্যায়

কিন্তু কোরআন মজীদের নুযূল বা গুণগত অবতরণ এখানেই শেষ নয়। আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর আরো নুযূল দেখতে পাই - যা অবশ্য প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে নুযূল্ -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।

বস্তুতঃ কোনো কিছুকেই তার স্থান , কাল ও প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো বক্তার বক্তব্য বিভিন্নভাবে শোনা যায় , যেমন : সরাসরি বক্তার সামনে বসে শোনা হয় , বা তার রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায় , বা সরাসরি শুনেছে এমন কোনো শ্রোতার কাছ থেকে হুবহু শোনা যায় , অথবা মুদ্রিত আকারে পড়া যায়। এর প্রতিটির প্রভাব শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকার ওপর স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে , বক্তা এবং তাঁর বক্তব্যের শ্রোতা বা পাঠকের মাঝে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে বক্তা ও লেখক থেকে শ্রোতা ও পাঠকের স্থানগত ও কালগত ব্যবধান যতো বেশী হবে বক্তব্যের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ততোই মাত্রাগত অবনতি ঘটবে। অতএব , এ-ও এক ধরনের নুযূল বা অবতরণ তথা মানগত অবনয়ন বটে , যদিও ঐতিহ্যিকভাবে কোরআন বিশেষজ্ঞগণ এ জন্য নুযূল্ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা , কোরআন মজীদের নুযূলের এ ধরনের পর্যায়সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পর্যায় থেকে অনেক নীচে বিধায় তা বাঞ্ছিত পর্যায় নয়। সুতরাং কোরআনকে সঠিকভাবে তথা আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত বাঞ্ছিত পর্যায়ে অনুধাবনের জন্য এবং সে লক্ষ্যে স্বীয় অনুধাবনক্ষমতার কাম্য পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো বক্তার বক্তব্যের তাৎপর্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণের উপায় কী ? নিঃসন্দেহে এর উপায় হচ্ছে , জ্ঞানগতভাবে শ্রোতাকে বা পাঠককে স্থান , কাল , ভাষা ও পরিবেশগত ব্যবধান সমূহ অতিক্রম করে বক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট শ্রোতার পর্যায়ে এবং গুণগতভাবে যতো বেশী সম্ভব বক্তার কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। এ কারণেই , সে যুগের যে সব যথোপযুক্ত ব্যক্তি কোরআন মজীদকে সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে শুনে অনুধাবন করেন সেভাবে বোঝার জন্য এ যুগের মানুষকে অনেক কিছু অধ্যয়ন করে জ্ঞানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থান-কালে উপনীত হতে হবে এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় বুঝতে হলে আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে সব ছ্বাহাবী তাঁর সর্বাধিক কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন এ সব দিক থেকে শ্রোতা বা পাঠককে তাঁদের স্তরে উন্নীত হতে হবে।

অন্যদিকে কোনো অনারব ব্যক্তিকে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই তৎকালীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের ওপর সে যুগের কবি-সাহিত্যিক-বাগ্মীদের সমপর্যায়ের দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। কোরআন মজীদের পাঠক-পাঠিকা এ সব ক্ষেত্রে যেদিক থেকেই যতোখানি পশ্চাদপদ হবেন সেদিক থেকেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য তাঁর নিকট পর্যায়গত দিক থেকে ততোখানি নিম্নতর মাত্রায় প্রকাশিত হবে। এ-ও এক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ , তবে তা বাঞ্ছিত মাত্রা ও পর্যায়ের অবতরণ নয়।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ নীচের উদাহরণটি প্রযোজ্য হতে পারে :

অঙ্কশাস্ত্রের একজন ডক্টরেট , একজন মাস্টার ডিগ্রীধারী , একজন গ্রাজুয়েট , একজন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী - এদের প্রত্যেকেই অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাঁদের অঙ্কজ্ঞানের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডক্টরেটের জ্ঞানের তুলনায় মাস্টার ডিগ্রীধারীর জ্ঞান নিম্নতর ....। অথবা অন্যভাবে বলা যায় , ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে অঙ্কজ্ঞান দিয়েছেন - যা লাভ করে ঐ ছাত্র মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছেন তা মাত্রাগত দিক থেকে ঐ শিক্ষকের সমপর্যায়ের অঙ্কজ্ঞান নয় , বরং পর্যায়গত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী পর্যন্ত ক্রমেই নীচে নেমে এসেছে।

এ ব্যাপারে সম্ভবতঃ নিম্নোক্ত উপমাটি অধিকতর উপযোগী :

মানব প্রজাতির ইতিহাসের জ্ঞান বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। কোনো ইতিহাসবিশারদের জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে যতো বেশী হবে ও গুণগত দিক থেকে যতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হবে তাঁর জ্ঞান ততো উচ্চতর স্তরের এবং যার জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার বিচারে যতো কম হবে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান অপেক্ষাকৃত ততো নিম্নতর স্তরের হবে।

আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে , কোনো জাতির বা সমগ্র মানব প্রজাতির ভাগ্য নির্ধারণে কেবল বড় বড় ব্যক্তিত্ব ও বড় বড় ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয় , বরং একান্তই মামূলী ধরনের মানুষের দৈনন্দিন অরাজনৈতিক কাজ ও ছোট ছোট ঘটনাও ইতিহাসের বড় ধরনের গতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

শুধু মানুষের ভূমিকা নয় , ইতর প্রাণীর ভূমিকা , এমনকি জড় বস্তুর অবস্থাও এ ব্যাপারে প্রভাবশালী হতে পারে। ইতিহাসে এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। পাথরে আঘাত লেগে ঘোড়ার পা ভেঙ্গে গিয়ে সেনাপতি বা রাজার পড়ে গিয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। লেডি যোশেফাইনের দুর্ব্যবহার জনিত মানসিক অশান্তি নেপোলিয়ান বোনাপার্টির যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো বলে জানা যায়। এমনকি বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার প্রতিক্রিয়াও যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে , ফিলিপাইনে একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর ফলে বাংলাদেশে ঝড় হতে পারে। অতএব , কোনো সাধারণ মানুষকে , এমনকি কোনো ইতর প্রাণীকে একটি পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের কারণ হতে পারে। সুতরাং মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে যিনি মানব প্রজাতির সূচনা থেকে শুরু করে মানুষ , প্রাণীকুল , উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ; এরূপ জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই রয়েছে।

এবার এমন একজন কাল্পনিক ইতিহাসবিদের কথা ধরা যাক যিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন এবং বর্তমান যুগে জ্ঞান আহরণের যে সব অত্যুন্নত উপায়-উপকরণ আছে (যেমন : কৃত্রিম উপগ্রহ , ইন্টারনেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি) শুরু থেকেই তিনি সে সবের অধিকারী , তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়রূপে বেশী। কিন্তু বলা বাহুল্য যে , এরূপ ইতিহাসজ্ঞানী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি জড় পদার্থের ভিতর ও বাইরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। অতএব , মানবপ্রজাতির গোটা ইতিহাস সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের তুলনায় তাঁর জ্ঞান হবে খুবই নিম্ন মানের , যদিও আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে উঁচু মানের।

এখন এ ধরনের কাল্পনিক ইতিহাসবিজ্ঞানী যদি আমাদের যুগের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জ্ঞান দিতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ বছরে আহরিত জ্ঞান তাঁকে হুবহু প্রদান করা সম্ভব হবে না , বরং সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন করে এ জ্ঞান দিতে হবে। ধরুন একাধারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় না করে কেবল প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে প্রথমোক্ত ব্যক্তির তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। এভাবে এ জ্ঞান পর্যায়ক্রমে সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন হয়ে একটি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে মানবপ্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান দেয়া হয় তার অবস্থা চিন্তা করুন। এভাবে প্রতিটি স্তরেই একটি বিষয়ের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পরিমাণগত , মানগত ও গুণগত দিক থেকে নীচে নেমে আসছে ; একেই বলে জ্ঞানের নুযূল্ ঘটা।

কোরআন মজীদের জ্ঞান স্থানগত , কালগত ও গ্রহণকারীর মানগত দিক থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে যতো দূরে এসেছে ততোই তার মান নীচে নেমেছে। এভাবে তার বিভিন্ন স্তরের অবতরণ বা নিম্নগমন (নুযূল) ঘটেছে। আর , আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন জ্ঞানে এবং আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানগত ও মানগত দিক থেকে নিজেকে যতোই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবেন ততোই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কোরআন-জ্ঞান ও তাঁর কোরআন-জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। শুধু তা-ই নয় , পরবর্তীকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হওয়ার ফলে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মজলিসে হাযির থেকে কোরআন শ্রবণকারীদেরও অনেকের তুলনায় ঐ ব্যক্তির কোরআন-জ্ঞান বেশী হবে। অবশ্য যারা আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে ইলহামের অধিকারী হয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছেন - তা তাঁরা যে যুগেরই হোন না কেন , তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্

একই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , কোরআন বিষয়ক পণ্ডিতগণ ও মুফাসসিরগণের অনেকের অভিমত অনুযায়ী , কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য ও সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম যাহেরী তাৎপর্য হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে সর্বজনীনভাবে কোরআন মজীদ থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হতো তা-ই। কিন্তু কোরআন মজীদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ থেকে আরো বহু বাহ্যিক তাৎপর্য বেরিয়ে এসেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে সব তাৎপর্য এমনই বিস্ময়কর যা অতীতে কল্পনাও করা যেতো না। উদাহরণস্বরূপ , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 261 নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) مثل الذين ينفقون اموالهم فی سبيل الله کمثل حبة انبتت سبع سنابل فی کل سنبلة مائة حبة. و الله يضاعف لمن يشاء. و الله واسع عليم( .

যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।

বলা বাহুল্য যে , এ আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে যা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য (যাহের্) থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যেই একটি তথ্য ও একটি ভবিষ্যদ্বাণীও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।

উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উপমা দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন খেজুর ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর পিছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে ; হয়তো বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে , তবে অন্ততঃ উপরোক্ত তথ্য বা ভবিষ্যদ্বাণী যে তার অন্যতম উদ্দেশ্য তাতে সন্দেহ নেই ।

অবশ্য কোরআন মজীদের নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাগণ উক্ত আয়াতের প্রথম যাহের্ বা প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিকট হয়তো এটি এ আয়াতের একমাত্র বাহ্যিক তাৎপর্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে , এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যে শুধু আল্লাহর পথে দানের শুভ প্রতিফলই বর্ণনা করা হয় নি , বরং একটি বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্য ও ভবিষ্যদ্বাণীও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক কোরআন-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও মুফাসসির মনে করেন।

একইভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন : সমগ্র কোরআন মজীদের অন্যতম বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিলোক অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিলোক এবং এর সকল কর্মকাণ্ড। কোরআন মজীদ তার নিজের ভাষায়تبيانا لکل شيء (সকল কিছুর সুবর্ণনা) - এ থেকে তা-ই বুঝা যায়। কারণ ,کل شيء (প্রতিটি জিনিস) বলতে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাকী থাকে না।

অবশ্য এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের অবস্থা এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে ও কোরআন মজীদ নাযিল্-কালে যা কিছু অনিবার্যভাবে ও শর্তাধীনে ঘটিতব্য ছিলো তার সবই তাতে নিহিত ছিলো ও রয়েছে , আর ঘটিতব্যগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে ও অবশ্যই ঘটবে। এ কারণেই লাওহে মাহ্ফূয্ তথা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কিতাবুম্ মুবীন (সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ)। আর আমাদের কাছে যে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন রয়েছে তা হচ্ছে উক্ত কোরআনেরই নুযূলপ্রাপ্ত (অবতরণকৃত তথা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে আসা) রূপ।

কোরআন মজীদের আরেক বাত্বেন হলেন স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)। কারণ , তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত রূপ। এর মানে শুধু এ নয় যে , কোরআন পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর চরিত্র ও জীবনধারা জানা যাবে , বরং এর মানে হচ্ছে , সমগ্র কোরআন মজীদে তিনি প্রতিফলিত। ফলে যিনি কোরআন মজীদের সাথে পরিচিত হলেন তিনি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সাথেই পরিচিত হলেন এবং কোরআন মজীদকে যতোটুকু জানলেন স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ততোটুকু জানতে পারলেন।

অবশ্য কারো যেন এরূপ ধারণা না হয় যে , হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দৈনন্দিন পার্থিব জীবন অর্থাৎ তিনি কোনদিন কখন কী খেলেন , কখন ঘুমালেন , কখন কোথায় গেলেন ইত্যাদি কোরআন মজীদের গভীর অধ্যয়ন থেকে বিস্তারিত ও পুরোপুরি জানা যাবে। কারণ , মানুষকে এ সব বিষয় জানানো ঐশী কালামের উদ্দেশ্য হতে পারে না , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে ছোট-বড় এবং গ্রহণীয়-বর্জনীয় যা কিছু শিক্ষণীয় ছিলো তার সবই কোরআন মজীদ থেকে জানা যাবে। আর হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) , অন্যান্য নবী-রাসূল ( আঃ) , এমনকি কাফের-মোশরেবকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ঘটনা কোরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে সবে নিহিত শিক্ষা পৌঁছে দেয়া।

লাওহে মাহ্ফূযে ও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদে সকল কিছুর বর্ণনা এভাবেই নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও কোরআন মজীদের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকে সকল কিছু খুটিনাটি সহ সব কিছুই , প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি কর্ম , এমনকি যার মধ্যে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় কিছু নেই তা সহ , আল্লাহর জ্ঞানে প্রতিফলিত। কিন্তু কোরআন মজীদে অর্থাৎ লাওহে মাহ্ফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় কেবল করণীয় ও বর্জনীয় এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি-অবনতিতে প্রভাব বিস্তারক বিষয়াদির জ্ঞান ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী নিহিত রাখা হয়েছে বলে মনে হয় (নিশ্চিত জ্ঞান স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার কাছে)।

কোরআন মজীদের গভীরতম বাত্বেন্ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা। কারণ , কোরআন মজীদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। অতএব , তাঁর পক্ষে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বরং কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর কাজের মাধ্যমে তাঁকে জানা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কাজের সাথে যিনি যতো বেশী পরিচিত তিনি ততো বেশী মাত্রায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার সাথে পরিচিত।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সৃষ্টির মাধ্যমে , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির মাধ্যমে ও লাওহে মাহ্ফূযে বা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যার নুযূলপ্রাপ্ত বা মানের অবতরণকৃত রূপ হচ্ছে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন।

অতএব , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার মহান সত্তার অস্তিত্বের তাজাল্লী - তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। অর্থাৎ কোরআন মজীদে যা কিছু আছে তার সব কিছু মিলে এক মহাসত্যের সাক্ষ্য বহন করছে , সে মহাসত্য হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা।

কোরআনের ভাষাগত রূপ আল্লাহর

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াতের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য আদেশ আসার পূর্বেও তিনি আসমান-যমীনের নিগূঢ় সত্য অবলোকন করতেন। এর বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব , অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে , এ নিগূঢ় সত্যের প্রত্যক্ষকরণ তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিলো। কিন্তু তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত করা হলো এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো , তখন তাঁর জন্য বড় সমস্যা ছিলো এই যে , যে মহাসত্য ( ইলমে হুযূরী রূপে অবস্তুগত কোরআন মজীদ) তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো - যা কোনো কালির হরফে লেখা কিতাব্ ছিলো না (সম্ভবতঃ এ কারণেই - লাওহে মাহ্ফূযে সংরক্ষিত কিতাব্ পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো না বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে নিরক্ষর রেখেছিলেন) , তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল ( আঃ) ভাষার আবরণে পর্যায়ক্রমে এ মহাসত্যকে তাঁর মুখে জারী করেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মুখে এ কোরআন ভাষার আবরণে জারী হলো বটে , কিন্তু এর ভাষা তাঁর নিজের নয়। বিশেষ করে তিনি তৎকালীন আরবের কোনো কবি , সাহিত্যিক , বাগ্মী , বা অলঙ্কারবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না ; এমনকি তিনি লিখতে-পড়তেও জানতেন না। অতএব , মানুষের সকল ভাষার মধ্যে প্রকাশক্ষমতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ভাষা আরবী ভাষার এ শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের ভাষা ও বক্তব্য তাঁর নিজের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ গ্রন্থ যার পক্ষ থেকে তাঁর হৃদয়পটে নাযিল্ হয়েছিলো তথা প্রবেশ করেছিলো তিনি স্বয়ং একে সম্ভাব্য সর্বোত্তমরূপে মানুষের বোধগম্য ভাষায় পরিবর্তিত করে হযরত জিবরাঈল ( আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে ও মন-মগযে গ্রথিত করে দেন এবং তাঁর মুখে অন্যদের নিকট প্রকাশ করেন।

কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে যে সত্য প্রবেশ করেছিলো এবং তিনি যে সত্য অহরহ প্রত্যক্ষ করছিলেন এভাবে মানুষের ভাষার আবরণে প্রকাশের মাধ্যমে কি সে সত্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব ছিলো ? বস্তুতঃ শ্রবণ কখনোই প্রত্যক্ষকরণের - শুধু চক্ষু দ্বারা নয় , পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষকরণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। অভিজ্ঞতার বিবরণ পাঠে কোনোদিনই অভিজ্ঞতা হাছ্বিল হয় না।

তাছাড়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ , আরবী ভাষা মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী ভাষা হলেও তা মানুষের ভাষা বৈ নয়। মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিষয়াদির জন্যে কোনো ভাষায়ই যথোপযুক্ত শব্দাবলী ও প্রকাশকৌশল থাকতে পারে না , তা সে ভাষা যতোই না প্রায় সীমাহীন প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী হোক। এমতাবস্থায় , মানুষের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জগতের সত্যসমূহকে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের শব্দাবলী ও পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করে মোটামুটি এজমালীভাবে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , ভাষার আবরণে যে কোরআন মজীদ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হলো তা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের একটি পর্যায়গত ও মাত্রাগত অবতরিত রূপ বৈ নয়। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের দ্বিতীয় দফা নাযিল্ বা মানগত অবতরণ। কোরআন মজীদের এ পর্যায়গত বা মানগত অবতরণ ঘটে সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে ।

নুযূলের আরো পর্যায়

কিন্তু কোরআন মজীদের নুযূল বা গুণগত অবতরণ এখানেই শেষ নয়। আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর আরো নুযূল দেখতে পাই - যা অবশ্য প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে নুযূল্ -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।

বস্তুতঃ কোনো কিছুকেই তার স্থান , কাল ও প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো বক্তার বক্তব্য বিভিন্নভাবে শোনা যায় , যেমন : সরাসরি বক্তার সামনে বসে শোনা হয় , বা তার রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায় , বা সরাসরি শুনেছে এমন কোনো শ্রোতার কাছ থেকে হুবহু শোনা যায় , অথবা মুদ্রিত আকারে পড়া যায়। এর প্রতিটির প্রভাব শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকার ওপর স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে , বক্তা এবং তাঁর বক্তব্যের শ্রোতা বা পাঠকের মাঝে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে বক্তা ও লেখক থেকে শ্রোতা ও পাঠকের স্থানগত ও কালগত ব্যবধান যতো বেশী হবে বক্তব্যের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ততোই মাত্রাগত অবনতি ঘটবে। অতএব , এ-ও এক ধরনের নুযূল বা অবতরণ তথা মানগত অবনয়ন বটে , যদিও ঐতিহ্যিকভাবে কোরআন বিশেষজ্ঞগণ এ জন্য নুযূল্ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা , কোরআন মজীদের নুযূলের এ ধরনের পর্যায়সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পর্যায় থেকে অনেক নীচে বিধায় তা বাঞ্ছিত পর্যায় নয়। সুতরাং কোরআনকে সঠিকভাবে তথা আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত বাঞ্ছিত পর্যায়ে অনুধাবনের জন্য এবং সে লক্ষ্যে স্বীয় অনুধাবনক্ষমতার কাম্য পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো বক্তার বক্তব্যের তাৎপর্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণের উপায় কী ? নিঃসন্দেহে এর উপায় হচ্ছে , জ্ঞানগতভাবে শ্রোতাকে বা পাঠককে স্থান , কাল , ভাষা ও পরিবেশগত ব্যবধান সমূহ অতিক্রম করে বক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট শ্রোতার পর্যায়ে এবং গুণগতভাবে যতো বেশী সম্ভব বক্তার কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। এ কারণেই , সে যুগের যে সব যথোপযুক্ত ব্যক্তি কোরআন মজীদকে সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে শুনে অনুধাবন করেন সেভাবে বোঝার জন্য এ যুগের মানুষকে অনেক কিছু অধ্যয়ন করে জ্ঞানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থান-কালে উপনীত হতে হবে এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় বুঝতে হলে আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে সব ছ্বাহাবী তাঁর সর্বাধিক কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন এ সব দিক থেকে শ্রোতা বা পাঠককে তাঁদের স্তরে উন্নীত হতে হবে।

অন্যদিকে কোনো অনারব ব্যক্তিকে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই তৎকালীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের ওপর সে যুগের কবি-সাহিত্যিক-বাগ্মীদের সমপর্যায়ের দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। কোরআন মজীদের পাঠক-পাঠিকা এ সব ক্ষেত্রে যেদিক থেকেই যতোখানি পশ্চাদপদ হবেন সেদিক থেকেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য তাঁর নিকট পর্যায়গত দিক থেকে ততোখানি নিম্নতর মাত্রায় প্রকাশিত হবে। এ-ও এক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ , তবে তা বাঞ্ছিত মাত্রা ও পর্যায়ের অবতরণ নয়।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ নীচের উদাহরণটি প্রযোজ্য হতে পারে :

অঙ্কশাস্ত্রের একজন ডক্টরেট , একজন মাস্টার ডিগ্রীধারী , একজন গ্রাজুয়েট , একজন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী - এদের প্রত্যেকেই অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাঁদের অঙ্কজ্ঞানের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডক্টরেটের জ্ঞানের তুলনায় মাস্টার ডিগ্রীধারীর জ্ঞান নিম্নতর ....। অথবা অন্যভাবে বলা যায় , ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে অঙ্কজ্ঞান দিয়েছেন - যা লাভ করে ঐ ছাত্র মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছেন তা মাত্রাগত দিক থেকে ঐ শিক্ষকের সমপর্যায়ের অঙ্কজ্ঞান নয় , বরং পর্যায়গত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী পর্যন্ত ক্রমেই নীচে নেমে এসেছে।

এ ব্যাপারে সম্ভবতঃ নিম্নোক্ত উপমাটি অধিকতর উপযোগী :

মানব প্রজাতির ইতিহাসের জ্ঞান বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। কোনো ইতিহাসবিশারদের জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে যতো বেশী হবে ও গুণগত দিক থেকে যতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হবে তাঁর জ্ঞান ততো উচ্চতর স্তরের এবং যার জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার বিচারে যতো কম হবে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান অপেক্ষাকৃত ততো নিম্নতর স্তরের হবে।

আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে , কোনো জাতির বা সমগ্র মানব প্রজাতির ভাগ্য নির্ধারণে কেবল বড় বড় ব্যক্তিত্ব ও বড় বড় ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয় , বরং একান্তই মামূলী ধরনের মানুষের দৈনন্দিন অরাজনৈতিক কাজ ও ছোট ছোট ঘটনাও ইতিহাসের বড় ধরনের গতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

শুধু মানুষের ভূমিকা নয় , ইতর প্রাণীর ভূমিকা , এমনকি জড় বস্তুর অবস্থাও এ ব্যাপারে প্রভাবশালী হতে পারে। ইতিহাসে এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। পাথরে আঘাত লেগে ঘোড়ার পা ভেঙ্গে গিয়ে সেনাপতি বা রাজার পড়ে গিয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। লেডি যোশেফাইনের দুর্ব্যবহার জনিত মানসিক অশান্তি নেপোলিয়ান বোনাপার্টির যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো বলে জানা যায়। এমনকি বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার প্রতিক্রিয়াও যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে , ফিলিপাইনে একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর ফলে বাংলাদেশে ঝড় হতে পারে। অতএব , কোনো সাধারণ মানুষকে , এমনকি কোনো ইতর প্রাণীকে একটি পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের কারণ হতে পারে। সুতরাং মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে যিনি মানব প্রজাতির সূচনা থেকে শুরু করে মানুষ , প্রাণীকুল , উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ; এরূপ জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই রয়েছে।

এবার এমন একজন কাল্পনিক ইতিহাসবিদের কথা ধরা যাক যিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন এবং বর্তমান যুগে জ্ঞান আহরণের যে সব অত্যুন্নত উপায়-উপকরণ আছে (যেমন : কৃত্রিম উপগ্রহ , ইন্টারনেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি) শুরু থেকেই তিনি সে সবের অধিকারী , তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়রূপে বেশী। কিন্তু বলা বাহুল্য যে , এরূপ ইতিহাসজ্ঞানী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি জড় পদার্থের ভিতর ও বাইরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। অতএব , মানবপ্রজাতির গোটা ইতিহাস সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের তুলনায় তাঁর জ্ঞান হবে খুবই নিম্ন মানের , যদিও আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে উঁচু মানের।

এখন এ ধরনের কাল্পনিক ইতিহাসবিজ্ঞানী যদি আমাদের যুগের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জ্ঞান দিতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ বছরে আহরিত জ্ঞান তাঁকে হুবহু প্রদান করা সম্ভব হবে না , বরং সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন করে এ জ্ঞান দিতে হবে। ধরুন একাধারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় না করে কেবল প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে প্রথমোক্ত ব্যক্তির তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। এভাবে এ জ্ঞান পর্যায়ক্রমে সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন হয়ে একটি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে মানবপ্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান দেয়া হয় তার অবস্থা চিন্তা করুন। এভাবে প্রতিটি স্তরেই একটি বিষয়ের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পরিমাণগত , মানগত ও গুণগত দিক থেকে নীচে নেমে আসছে ; একেই বলে জ্ঞানের নুযূল্ ঘটা।

কোরআন মজীদের জ্ঞান স্থানগত , কালগত ও গ্রহণকারীর মানগত দিক থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে যতো দূরে এসেছে ততোই তার মান নীচে নেমেছে। এভাবে তার বিভিন্ন স্তরের অবতরণ বা নিম্নগমন (নুযূল) ঘটেছে। আর , আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন জ্ঞানে এবং আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানগত ও মানগত দিক থেকে নিজেকে যতোই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবেন ততোই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কোরআন-জ্ঞান ও তাঁর কোরআন-জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। শুধু তা-ই নয় , পরবর্তীকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হওয়ার ফলে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মজলিসে হাযির থেকে কোরআন শ্রবণকারীদেরও অনেকের তুলনায় ঐ ব্যক্তির কোরআন-জ্ঞান বেশী হবে। অবশ্য যারা আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে ইলহামের অধিকারী হয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছেন - তা তাঁরা যে যুগেরই হোন না কেন , তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্

একই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , কোরআন বিষয়ক পণ্ডিতগণ ও মুফাসসিরগণের অনেকের অভিমত অনুযায়ী , কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য ও সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম যাহেরী তাৎপর্য হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে সর্বজনীনভাবে কোরআন মজীদ থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হতো তা-ই। কিন্তু কোরআন মজীদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ থেকে আরো বহু বাহ্যিক তাৎপর্য বেরিয়ে এসেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে সব তাৎপর্য এমনই বিস্ময়কর যা অতীতে কল্পনাও করা যেতো না। উদাহরণস্বরূপ , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 261 নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) مثل الذين ينفقون اموالهم فی سبيل الله کمثل حبة انبتت سبع سنابل فی کل سنبلة مائة حبة. و الله يضاعف لمن يشاء. و الله واسع عليم( .

যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।

বলা বাহুল্য যে , এ আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে যা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য (যাহের্) থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যেই একটি তথ্য ও একটি ভবিষ্যদ্বাণীও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।

উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উপমা দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন খেজুর ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর পিছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে ; হয়তো বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে , তবে অন্ততঃ উপরোক্ত তথ্য বা ভবিষ্যদ্বাণী যে তার অন্যতম উদ্দেশ্য তাতে সন্দেহ নেই ।

অবশ্য কোরআন মজীদের নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাগণ উক্ত আয়াতের প্রথম যাহের্ বা প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিকট হয়তো এটি এ আয়াতের একমাত্র বাহ্যিক তাৎপর্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে , এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যে শুধু আল্লাহর পথে দানের শুভ প্রতিফলই বর্ণনা করা হয় নি , বরং একটি বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্য ও ভবিষ্যদ্বাণীও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক কোরআন-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও মুফাসসির মনে করেন।

একইভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন : সমগ্র কোরআন মজীদের অন্যতম বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিলোক অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিলোক এবং এর সকল কর্মকাণ্ড। কোরআন মজীদ তার নিজের ভাষায়تبيانا لکل شيء (সকল কিছুর সুবর্ণনা) - এ থেকে তা-ই বুঝা যায়। কারণ ,کل شيء (প্রতিটি জিনিস) বলতে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাকী থাকে না।

অবশ্য এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের অবস্থা এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে ও কোরআন মজীদ নাযিল্-কালে যা কিছু অনিবার্যভাবে ও শর্তাধীনে ঘটিতব্য ছিলো তার সবই তাতে নিহিত ছিলো ও রয়েছে , আর ঘটিতব্যগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে ও অবশ্যই ঘটবে। এ কারণেই লাওহে মাহ্ফূয্ তথা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কিতাবুম্ মুবীন (সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ)। আর আমাদের কাছে যে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন রয়েছে তা হচ্ছে উক্ত কোরআনেরই নুযূলপ্রাপ্ত (অবতরণকৃত তথা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে আসা) রূপ।

কোরআন মজীদের আরেক বাত্বেন হলেন স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)। কারণ , তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত রূপ। এর মানে শুধু এ নয় যে , কোরআন পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর চরিত্র ও জীবনধারা জানা যাবে , বরং এর মানে হচ্ছে , সমগ্র কোরআন মজীদে তিনি প্রতিফলিত। ফলে যিনি কোরআন মজীদের সাথে পরিচিত হলেন তিনি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সাথেই পরিচিত হলেন এবং কোরআন মজীদকে যতোটুকু জানলেন স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ততোটুকু জানতে পারলেন।

অবশ্য কারো যেন এরূপ ধারণা না হয় যে , হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দৈনন্দিন পার্থিব জীবন অর্থাৎ তিনি কোনদিন কখন কী খেলেন , কখন ঘুমালেন , কখন কোথায় গেলেন ইত্যাদি কোরআন মজীদের গভীর অধ্যয়ন থেকে বিস্তারিত ও পুরোপুরি জানা যাবে। কারণ , মানুষকে এ সব বিষয় জানানো ঐশী কালামের উদ্দেশ্য হতে পারে না , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে ছোট-বড় এবং গ্রহণীয়-বর্জনীয় যা কিছু শিক্ষণীয় ছিলো তার সবই কোরআন মজীদ থেকে জানা যাবে। আর হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) , অন্যান্য নবী-রাসূল ( আঃ) , এমনকি কাফের-মোশরেবকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ঘটনা কোরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে সবে নিহিত শিক্ষা পৌঁছে দেয়া।

লাওহে মাহ্ফূযে ও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদে সকল কিছুর বর্ণনা এভাবেই নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও কোরআন মজীদের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকে সকল কিছু খুটিনাটি সহ সব কিছুই , প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি কর্ম , এমনকি যার মধ্যে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় কিছু নেই তা সহ , আল্লাহর জ্ঞানে প্রতিফলিত। কিন্তু কোরআন মজীদে অর্থাৎ লাওহে মাহ্ফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় কেবল করণীয় ও বর্জনীয় এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি-অবনতিতে প্রভাব বিস্তারক বিষয়াদির জ্ঞান ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী নিহিত রাখা হয়েছে বলে মনে হয় (নিশ্চিত জ্ঞান স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার কাছে)।

কোরআন মজীদের গভীরতম বাত্বেন্ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা। কারণ , কোরআন মজীদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। অতএব , তাঁর পক্ষে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বরং কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর কাজের মাধ্যমে তাঁকে জানা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কাজের সাথে যিনি যতো বেশী পরিচিত তিনি ততো বেশী মাত্রায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার সাথে পরিচিত।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সৃষ্টির মাধ্যমে , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির মাধ্যমে ও লাওহে মাহ্ফূযে বা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যার নুযূলপ্রাপ্ত বা মানের অবতরণকৃত রূপ হচ্ছে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন।

অতএব , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার মহান সত্তার অস্তিত্বের তাজাল্লী - তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। অর্থাৎ কোরআন মজীদে যা কিছু আছে তার সব কিছু মিলে এক মহাসত্যের সাক্ষ্য বহন করছে , সে মহাসত্য হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13