ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গাদীরের ঘটনার সত্যতা
গাদীর একটি ঝর্ণাধারা যা হতে নির্মল স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল ইসলাম প্রস্ফুটিত হয়েছে। যে ব্যক্তি এই প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে নিল সে যেন তার জীবনকে এই নির্মল প্রকৃত সত্যের ঝর্ণায় স্নান করিয়ে নিল ও মহান নির্ভেজাল ইসলামে নিজের স্থান করে নিল। আর যে ব্যক্তি কোন ওজর , আপত্তি ও বাহানা দেখিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল বা না শুনার ভান করল তার কপালে দূরের ঘন্টার আওয়াজ ব্যতীত কিছুই জুটবে না।
শুধুমাত্র গাদীরই প্রথম পদক্ষেপ নয় যে , রাসূল (সা.) তার প্রতিনিধিকে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়েছেন। তিনি বহুবার অনেক অনুষ্ঠানে তার ভাষণে বিভিন্নভাবে এই সত্যতার কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং তাকে পরবর্তী নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। যারা তার নিকট আসা- যাওয়া করত তারা এই ইসলামী রাষ্ট্রের উল্লিখিত ঘটনা থেকে বেখবর ছিল না , তারা জানতেন যে , আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী খলিফা ও তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় এবং সবার চেয়ে নিকটবর্তী সাহাবী।
খেলাফতের বিষয়টি এমন ছিল না যে , দশম হিজরী পর্যন্ত নিরব নিস্তব্ধ ছিল। রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধি সেদিনই নির্ধারিত হয়েছে যেদিন মক্কাতে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে।
তার পর বিশেষ করে হিজরতের পরের বছরগুলিতে এই বিষয়টি এতপরিমাণ পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে , মদীনায় প্রায় সকলেই এর সাথে পরিচিত ছিল। সকলেই“
মানযিলাতে”
র হাদীস যা তিনি তাবুকের যুদ্ধের সময় বলেছিলেন ,“
রাইয়াতে”
র হাদীস যা তিনি আলী (আ.) সম্পর্কে খন্দকের যুদ্ধের সময় বলেছিলেন ,“
তাইর”
-এর হাদীস
শুনেছিলেন। সাকালাইন
- এর হাদীসটি বারংবার তাদের নিকট পঠিত হয়েছে , আয়াত সমূহের নাজিল বা অবতীর্ণ যেমন- মোয়াদ্দাত
-এর আয়াত , মোবাহেলা এর আয়াত
ও বেলায়াত -এর আয়াত
কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল আমিরুল মু’
মিনীনের ব্যক্তিত্বের সূর্য দ্বীপ্তময় হয়ে দেখা দেয়ার জন্যে।
এ সকল কারণেই গাদীরের হাদীসের প্রসিদ্ধি লাভ ছিল ন্যায় সঙ্গত। যত হাদীস এ সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সবই সহীহ , প্রসিদ্ধ এবং কিছু কিছু মোতাওয়াতির বা বিশ্বস্ত । কিন্তু গাদীরের হাদীস তাওয়াতুরের (বর্ণনার বাহুল্যের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার) সীমাও অতিক্রম করেছে।
মরহুম আলামলু হুদা সাইয়্যেদ মরতাজা এ সম্পর্কে বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি এর (গাদীরের হাদীসের) সত্যতার দলিল-প্রমাণ চায় , সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় , যে ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর প্রসিদ্ধ যুদ্ধসমুহের অবস্থা সম্পর্কিত হাদীসেরও সত্যতার প্রমাণ চায় এবং ঠিক ঐরূপ যেমন- বলা যেতে পারে সে প্রকৃতার্থে বিদায় হজ্জের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। কারণ , এগুলো সবই প্রসিদ্ধতার দিক থেকে সম পর্যাযের।
কেননা , সকল শিয়া আলেমই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীস বিশারদরাও দলিল সহকারে তা বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিকগণ ও জীবনী লেখকগণও যেভাবে প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে থাকেন , ঠিক ঐরূপে এটাকে লিপিবদ্ধ করেছেন , প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা নির্দিষ্ট সূত্র ছাড়াই বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবেত্তাগণ ইহাকে হাদীসের সমষ্টিতে সহীহ হিসেবে সন্নিবেশিত করেছেন। এ হাদীসটি এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা অন্য কোন হাদীসের নেই। কেননা‘
আখবর’
বা হাদীস দু’
ধরনেরঃ
এক ধরনের হাদীস আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন সূত্রের প্রয়োজন হয় না। যেমন- বদর , খায়বার , জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধের সংবাদ ও সকল প্রসিদ্ধ ঘটনাসমূহ যেগুলো বিশেষ সূত্র ছাড়ায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখে মুখে বর্ণিত হয়েছে এবং মানুষ ঐ বিষয়ে অবহিত।
দ্বিতীয় প্রকার‘
আখবর’
বা হাদীসের ক্ষেত্রে সনদের বা দলিলের দিক থেকে বর্ণনা সূত্রের অবিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন হয়। যেমন- যে সকল হাদীস শরীয়তের বিধি-বিধান সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে।
গাদীরের হাদীস দু’
ভাবেই বর্ণিত হয়েছে ; অর্থাৎ বস্তুতঃপক্ষে প্রসিদ্ধির দিক থেকে সর্বজন বিদিত হওয়া ছাড়াও বর্ণনা সূত্রের অবিচ্ছিন্নতার দিক থেকেও পূর্ণতার অধিকারী।
এছাড়াও যে সকল হাদীস শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে সবগুলোই খবরে ওয়াহেদ বা বর্ণনাকারীর সংখ্যা অতি নগণ্য , কিন্তু গাদীরের হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা অত্যধিক।
আমরা এই পুস্তকে ঐ সকল হাদীস বর্ণনাকারী সবার নাম উল্লেখ করতে চাই না। কারণ , এখানে তার স্থান সংকুলানও হবে না আর তার প্রয়োজনও নেই। মরহুম আল্লামা আমিনী উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীর জীবন ধারার ক্রমানুসারে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি শতাব্দীক্রমে গাদীরের হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যারা এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী তাদেরকে মূল্যবান গ্রন্থ আল-গাদীর”
পাঠ করার সুপারিশ করছি।
রাসূল (সা.)-এর সাহাবীগণের মধ্যে 110 জন সাহাবী
তাবেয়ীদের মধ্যে 84 জন
2য় হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 56 জন
3য় হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 92 জন
4র্থ হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 43 জন
5ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 24 জন
6ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 20 জন
7ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 21 জন
8ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 18 জন
9ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 16 জন
10ম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 14 জন
11তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 12 জন
12তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 13 জন
13তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 12 জন
14তম হিজরী শতাব্দীর আলেমদের মধ্যে 19 জন
এই হাদীসটি আহমাদ ইবনে হাম্বাল 40টি সনদসহ , ইবনে জারীর তাবারী 70-এর কিছু বেশী সনদসহ , জাজারী মাকাররী 80টি সনদসহ , ইবনে উকদা 115টি সনদসহ , আবু সা’
দ মাসউদ সাজেসতানী 120টি সনদসহ এবং আবু বকর জা’
বী 125টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন।
ইবনে হাজার তার“
সাওয়ায়েক”
নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে , এই হাদীসটি রাসূল (সা.) এর 30জন সাহাবী হতে বর্ণিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশ সনদ সহীহ অথবা হাসান।
ইবনে মাগাজেলী তার“
মানাকেব”
গ্রন্থে লিখেছেনঃ
গাদীরের হাদীসটি এত বিশুদ্ধ যে , রাসূল (সা.)-এর প্রায় 100জন সাহাবী , যাদের মধ্যে আশারা মোবাশশারাগণও্ (শ্রেষ্ঠ দশজন সাহাবী) রয়েছেন , তারা সরাসরি রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে তা বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি দৃঢ় ও কোন প্রকার আপত্তিকর কিছু নেই। আর এটা এমনই এক মর্যাদা যার একমাত্র অধিকারী হচ্ছেন আলী , অনে কেউ এই মর্যাদার ক্ষেত্রে তার অংশীদার নয়।
সাইয়্যেদ ইবনে তাউস একজন ইমামীয়া শিয়া আলেম , তিনি তার“
ইকবালুল আমাল”
গ্রন্থে লিখেছেনঃ
আবু সা’
দ মাসউদ ইবনে নাসির সাজেসতানী একজন সুন্নী আলেম তিনি 17 খণ্ডের একটি বই লিখেছেন যার নাম“
আদ দিরায়া ফি হাদিসিল বিলায়াহ”
। উক্ত গ্রন্থে তিনি এই হাদীসটি 120 জন সাহাবী হতে বর্ণনা করেছেন।
মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী তার“
আর-রদ্দু আলাল হারকুসিয়্যাহ”
গ্রন্থে বেলায়াতের হাদীসটি 75টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
আবুল কাসেম আব্দুল্লাহ হাসকানী এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম হচ্ছে-“
দায়াউল হুদা ইলা আদায়ি হাক্কিল উলাত”
।
আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে সাঈদ উকদাহ , তিনিও“
হাদীসুল বিলায়াহ”
নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং উক্ত হাদীসটি 150টি সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাবীর (বর্ণনাকারীর) নাম উল্লেখ করার পর লিখেছেন যে , শুধুমাত্র তাবারীর বইটি ব্যতীত এ বিষয়ে সমস্ত বই আমার লাইব্রেরীতে বিদ্যমান আছে ; বিশেষ করে ইবনে উকদাহ -এর গ্রন্থ হতে তার জীবদ্দশায়ই (330 হিজরীতে) আমি বর্ণনা করেছিলাম।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- দ্বিতীয় শতাব্দীর পর- যে সময় থেকে মাযহাব সমূহের সীমা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে তৎপরবর্তী- এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের একজনও শিয়া ছিলেন না। শিয়াদের মাঝেও এমন আলেম খুব কমই পাওয়া যাবে যারা গাদীরের হাদীসটি বিভিন্ন উৎস বা সূত্রসহ বর্ণনা করেন নি।
গাদীরের হাদীসের গুরুত্ব এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে , বিশ্বের অনেক আলেমই , এ সম্পর্কে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আল্লামা আমিনী তার রচিত গ্রন্থ‘
আল-গাদীর’
এ উল্লেখ করেছেন , তার সময়কাল পর্যন্ত প্রসিদ্ধ অনেক আলেম গাদীরের হাদীসটির বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বহুল সূত্রে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণের জন্য স্বতন্ত্র ভাবে 26টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
উক্ত ঘটনাটি সবার নিকট এতটা স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য ছিল যে , আহলে বাইত বা নবী পরিবারের সদস্যগণ ও তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্নভাবে হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। হাদীসের মধ্যে পাওয়া যায় যে , রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদেরকে শপথ দিয়ে বলতেন যে , তোমাদের কি স্মরণ নেই রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে বলেছিলেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা , তারাও শপথ করে বলতেন যে , তাদের সেই ঘটনা স্মরণ আছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে , গাদীরের হাদীস সত্য যেটা অস্বীকার করার মত কোন সুযোগ নেই এবং হাতে গোণা ক’
জন আলেম নামধারী মূর্খ ব্যক্তি যারা কখনোই পারবে না গাদীরের হাদীসের সত্যতাকে ঢাকতে- কারণ দিবালোকের ন্যায় সত্যকে আবৃত করা কখনই সম্ভব নয়- অপপ্রয়াস চালায় ঢাকার জন্য। সে সব কারণেই“
ইমাম আলী (আ.)”
গ্রন্থের লেখক আব্দুল ফাত্তাহ আব্দুল মাকসুদ মিশরী ,“
আল-গাদীর”
গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেনঃ
গাদীরের হাদীস নিঃসন্দেহে , এমনই এক বাস্তব ও বিশুদ্ধ হাদীস যা শতচেষ্টা করলেও প্রতাখ্যান করা সম্ভব নয় ; তা দিবালোকের ন্যায় পোজ্জ্বল ও দ্বীপ্তিময়। রাসূল (সা.)-এর অন্তঃকরণে বিদ্যমান ঐশী সত্যের স্ফুরণ হতে যা উৎসারিত হয়েছে ; যার মাধ্যমে তার কাছে প্রশিক্ষিত তার এই ভ্রাতা ও মনোনীত ব্যক্তির মর্যাদা উম্মতের মাঝে প্রকাশ পায়।