গাদীরের হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ
গাদীরের হাদীসে যে বাক্যটি দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে ও গাদীরের ঘটনার বাস্তব তাৎপর্য যার ভিতর নিহিত সেটা হচ্ছে- রাসূল (সা.) বলেছেনঃ
من کنت مولاه فعلی مولاه
‘
অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা , এই আলীও তাদের মাওলা’
।
যারা এই হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা“
মাওলা”
শব্দটি“
আওলা”
বা অধিকারের ক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভকারী অর্থে ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তি যিনি সহজ ভাষায় বলা যায় অভিভাবকত্ব , নেতৃত্ব দান ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। উক্তধারায় এই হাদীসের অর্থ দাড়ায়“
আমি যাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান এই আলীও তাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান”
। সুতরাং যারা রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের অনুগত , শুধুমাত্র তারাই আলীর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বকে স্বীকার ও তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।
এ পর্যায়ে অবশ্যই জানা দরকার যে , আরবী ভাষাতে“
মাওলা”
শব্দের অর্থ কি ঠিক এভাবে ব্যবহৃত হয়েছে না কি অন্যভাবে ? আবার যদি মেনেও নিই যে , এই একই অর্থেই আরবী ভাষাতেও“
মাওলা”
শব্দের ব্যবহার হয়েছে , তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- এই খুতবাতেও (বক্তব্যেও) কি সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে ? না-কি ভিন্ন অর্থে।
মরহুম আল্লামা আমিনী 42 জন প্রসিদ্ধ মুফাসসীর ও আভিধানিক আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন , যাদের মধ্যে 27 জনই বলেছেন যে ,“
মাওলা”
এর অর্থ“
আওলা”
বা প্রধান। বাকী 15 জন বলেছেন-“
আওলা”
হচ্ছে-“
মাওলা”
শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে একটি অর্থ।
কিন্তু উক্ত হাদীসে কি“
মাওলা”
শব্দ ঐ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে আমাদেরকে দেখতে হবে যে , কোন্ প্রেক্ষাপটে ও কোন্ স্থানে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। খুতবাটিকে স্থান , কাল ও পাত্রভেদে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , ঐ বাক্যটিতে ব্যবহৃত“
মাওলা”
শব্দের অর্থটি নিঃসন্দেহে“
আওলা”
অর্থাৎ প্রধান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।
কেননা রাসূল (সা.)-এর মত ব্যক্তি যিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী পূর্ণাঙ্গ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং আসমানী দূত ,ঐ রকম একটি দিনে , যে দিনের তাপ্রমাত্রা এত বেশী ছিল যে , সেখানকার মাটিগুলো যেন উত্তপ্ত গলিত লৌহের মত উপস্থিত শ্রোতাদের পদযুগলকে পোড়াচ্ছিল এবং সূর্যের উত্তপ্ত কিরণ যেন তাদের মাথার মগজকে টগবগ করে ফুটাচ্ছিল , উত্তপ্ত মরুভূমির চরম প্রতিকূল সেই পরিবেশে
এমন অবস্থা ছিল যেন , মাটিতে মাংস ফেললে তা কাবাবে পরিণত হবে।
ঐ স্থানটি ছিল এমনি এক এলাকায় যেখানে কোন কাফেলা বা পথযাত্রীই যাত্রা বিরতি দেয় না , কিন্তু রাসূল (সা.) সেখানে হাজার হাজার হাজীকে দাড়ঁ করিয়ে রেখেছেন , অগ্রগামীদের প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন ও অপেক্ষায় ছিলেন যাতে পশ্চাৎগামীরা উপস্থিত হয় এবং দিনের সর্বাধিক তাপমাত্রার সময় চাচ্ছেন ভাষণ দিতে। তাছাড়াও তিনি কয়েকবার জনগণের নিকট প্রশ্ন করলেন যাতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন হয় যে , তারা তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কি না এবং সর্বশেষে আলীকে (আ.) তাদের সামনে তুলে ধরলেন ও নাম এবং বংশ পরিচয়সহ তাকে পরিচয় করালেন এবং বললেনঃ“
আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা”
। অতঃপর সকলকে দায়িত্ব দিয়ে বললেন যেন , তারা এই বার্তাটি অনুপস্থিতদের কর্ণগোচর করে। তারপর সবাইকে নির্দেশ দিলেন যে , তার নিকট যেন বাইয়াত (শপথ গ্রহণ) করে ও তাকে স্বাদর-সম্ভাষণ জানায় এবং স্বীয় পাগড়ী মোবারকটি তার মাথায় পরালেন ও বললেনঃ“
পাগড়ী হচ্ছে আরবের তাজ বা মকুট”
আর সাহাবীদের বললেনঃ বদর যুদ্ধের দিন যে সকল ফেরেশতা আমার সাহায্যার্থে এসেছিল তারা ঠিক এরূপ পাগড়ীই পরে এসেছিল।
এখন যদি আমরা ধরেও নিই যে , হাদীসটি কোন প্রকার ইশারা-ইঙ্গিত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই কারো নিকট পৌছানো হয় এবং সে নিরপেক্ষভাবে হাদীসটিকে পর্যালোচনা করে , তাহলেও এই হাদীসের অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে যে , হাদীসটির অর্থ এ সম্পর্কে অনবগতদের কথার বিপরীত অর্থই প্রকাশ করে অর্থাৎ হাদীসটির অর্থ এটা নয় যে রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেনঃ“
আমি যাদের বন্ধু এই আলীও তাদের বন্ধু”
অথবা“
আমি যাদের সাথী এই আলীও তাদের সাথী!”
কেননা , বন্ধু ও সাথীর ক্ষেত্রে বাইয়াত বা শপথের প্রয়োজন পড়ে না , পাগড়ী বা মুকুট পরানোর দরকার হয় না , মোটকথা এত গুরুত্ব দেওয়ার কোন কারণই নেই যে , ঐরূপ পরিস্থিতিতে ও ঐরূপ ভূমিকাসহ ঘোষণা দিতে হবে।
এসব দলিলের উপর ভিত্তি করেই মরহুম সেবতে ইবনে জাওজী যিনি আহলে সুন্নাতের একজন আলেম , এ সম্পর্কে একটি বিশাল আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে , উক্ত হাদীসে“
মাওলা”
শব্দের অর্থ“
আওলা”
বা প্রধান।
ইবনে তালহা তার“
মাতালিবুস সুউল”
গ্রন্থে লিখেছেনঃ
হযরত রাসূল (সা.)“
মাওলা”
শব্দের যে অর্থই নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন , আলীর জন্যেও ঠিক একই অর্থই প্রয়াগ করেছেন। আর এটা একটা উচ্চ মর্যাদা যা রাসূল (সা.) বিশেষ করে আলীর জন্য ব্যবহার করেছেন।
উল্লিখিত ফলাফলটি ঐ একই ফলাফল যা রাসূল (সা.)-এর খুতবার প্রতিটি বাক্যে তার প্রমাণ বহন করে ও ঐ একই জিনিস যা , একলক্ষ বিশ হাজার প্রকৃত আরবীভাষী দ্বিধা-দ্বন্দহীনভাবে রাসূল (সা.)-এর বাণী থেকে তা অনুধাবন করেছিলেন। আর তাই হাসসান্ উঠে দাড়িয়ে আলী (আ.)-এর শানে কবিতা আবৃতি করেছিলেন এবং রাসূলও (সা.) তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে যারাই এ ঘটনা শুনেছে তারা সবাই একই রকম বিষয় অনুধাবন করেছে যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আভিধানিকগণ এবং আলেমগণও ঠিক ঐ একই রকম বিষয়বস্তু অনুধাবন করেছেন। আর শত শত আরবী কবি ও অন্যান্য কবিগণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে আলীকে নির্ধারণ করেছেন। আর সে কারণেই গাদীর দিবসকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।
হযরত আলী (আ.) তার প্রকাশ্য খেলাফতকালে কুফা শহরে অনেকবার এই হাদীসটি উল্লেখ করে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদেরকে কসম দিতেন যাতে যা কিছু এ সম্পর্কে তাদের স্মরণে আছে যেন তার সাক্ষ্য প্রদান করে তাও আবার ঐ ঘটনার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যখন রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছিল আর যারা জীবিত ছিল তারাও ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং কুফাও ছিল সে সময়ে সাহাবীদের প্রাণকেন্দ্র মদীনা হতে অনেক দূরে এবং তিনিও কোন পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীতই বা কোন ভূমিকা ছাড়াই তাদের নিকট সাক্ষ্য চেয়েছিলেন। তারাও কোন ধরনের অজুহাত দেখানো ছাড়াই আমিরুল মু’
মিনীন আলী (আ.)-এর কথার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। বর্ণনাকারীগণ সাক্ষীদের যে সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন তা একেক জনের বর্ণনা একেক রকম , কোন কোন বর্ণনা মতে 5 অথবা 6 জন
অন্য এক বর্ণনায় 9 জন
আর এক বর্ণনায় 12 জন
অপর এক বর্ণনায় 12 জন বদরী সাহাবী
অন্য এক বর্ণনায় 13 জন
অপর এক বর্ণনায় 16 জন
এক বর্ণনায় 18 জন
এক বর্ণনায় 30 জন
এক বর্ণনায় একদল লোক
এক বর্ণনায় 10 জনেরও বেশী
এক বর্ণনায় কিছু সংখ্যক
এক বর্ণনায় কয়েক দল লোক
এবং এক বর্ণনায় 17 জন
ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে , গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ
من کنت مولاه فعلی مولاه
অর্থাৎ“
আমি যাদের মাওলা বা নেতা এই আলীও তাদের মাওলা বা নেতা”
।
অনুরূপভাবে আহলে বাইত (নবীর পরিবার) ও তাদের সাথীগণ এবং অনুসারীগণও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। মরহুম আল্লামা আমিনী এ ধরনের 22টি প্রমাণ উপস্থাপনের ঘটনা তুলে ধরেছেন , সেগুলি থেকে এখানে আমরা কয়েকটির উল্লেখ করছি।
1. উম্মুল আয়েম্মা (ইমামগণের মাতা) , ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন
“
আপনারা কি ভুলে গেছেন যে , রাসূল (সা.)
গাদীর দিবসে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক”
।
2. ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেছেন
যখন হাসান মুজতবা (আ.) মোয়াবিয়া’
র সাথে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন , তখন একটি বক্তব্য রেখে ছিলেন। উক্ত বক্তব্যের কিছু অংশ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছঃ
“
এই উম্মত আমার পিতামহ রাসূল (সা.)
হতে শুনেছে যে , তিনি বলেছেনঃ প্রত্যেক জাতিই যেন তাদের নিজেদের মধ্য হতে সেই ব্যক্তিকেই তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করে , যে হবে তাদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী ও সর্বোত্তম। তারা ক্রমাগত অধপতিত হবে যদি না তারা তাদের মাঝে যে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি , তাকে প্রাধান্য দেয়। তারা আরো শুনেছে যে , তিনি (সা.) আমার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ“
তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক ঐরূপ যেমন মূসার (আ.) সাথে হারুনের (আ.) সম্পর্ক ছিল ; পার্থক্য শুধু এতটুকু যে , (মুসা ও হারুন উভয় নবী ছিল কিন্ত) আমার পরে আর কোন নবী নাই।”
আরো শুনেছে যে , গাদীরে খুমে আমার পিতার হাত ধরে তিনি (সা.) বলেছেনঃ“
আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক , এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে।”
সে সময় উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন যেন তারা অনুপস্থিতদের কাছে এই খবরটি পৌছে দেয়।
3. হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন
সিফফিনের যুদ্ধে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) যখন আমর ইবনে আস-এর মুখোমুখি হলেন , তখন তিনি বলেছিলেনঃ
আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে , আমি যেন‘
নাকিসীন’
দের (চুক্তি ভঙ্গকারীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি , আর আমি তার নির্দেশানুযায়ী তা করেছি। তিনি আরো বলেছেনঃ তুমি‘
কাসিতীন’
দের (বিদ্রোহীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে , আর তোমরাই হলে রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত সেই বিদ্রোহী তাই তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব এবং জানিনা‘
মারিকীন’
দের (দ্বীন ত্যাগীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধেও সফল হব কি-না। এই নির্বংশ! তুমি কি জাননা রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেনঃ
من کنت مولاه فعلی مولاه اللهم وال من والاه و عاد من عاداه ؟
অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! আলীকে যারা ভালবাসে তুমি তাদেরকে ভালবাস আর আলীর সাথে যারা শত্রুতা করে তুমিও তাদের সাথে শত্রুতা কর। আমার অভিভাবক আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) অতঃপর আলী। কিন্ত তোমার তো কোন মাওলা বা অভিভাবকই নেই।
আমর ইবনে আস উত্তরে বললঃ এই আবা ইয়াকজান! কেন আমাকে ভৎসনা করছো আমি তো তোমাকে ভৎসনা করিনি।
4. আসবাগ ইবনে নাবাতা’
গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন
সিফফিনের যুদ্ধে আমিরুল মু’
মিনীন আলী (আ.) একটি পত্র লিখেছিলেন এবং আসবাগ ইবনে নাবাতা’
কে দায়িত্বভার দিয়ে বলেছিলেন যেন পত্রটি মোয়াবিয়ার নিকট পৌছে দেয়। আসবাগ যখন মোয়াবিয়ার দরবারে উপস্থিত হল দেখল সৈনিকের এক বিশাল দল বিশেষ করে রাসূল (সা.)-এর দুইজন সাহাবী আবু হোরায়রা ও আবু দারদা সেখানে উপস্থিত আছে। আসবাগ বর্ণনা করেছেন যে , মোয়াবিয়া পত্রটি পাঠ করার পর বললঃ“
আলী কেন উসমানের হত্যাকারীদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে না”
। আমি বললামঃ“
এই মোয়াবিয়া! উসমানের রক্তের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ো না ; তুমি আসলে ক্ষমতার ও শক্তির প্রত্যাশী। তুমি যদি উসমানকে সাহায্যই করতে চাইতে তাহলে তার জীবদ্দশায়ই তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তুমি যেহেতু তার রক্তকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে তাই এতটাই বিলম্ব করেছিলে যাতে সে নিহত হয়”
। এই কথা শুনার পর মোয়াবিয়ার যেন টনক নড়ে গেল। আর আমিও যেহেতু চাচ্ছিলাম যে একটু বেশী উত্তেজিত হউক , সে কারণেই আবু হোরায়রাকেও আবার জিজ্ঞেস করলামঃ“
এই রাসূল (সা.)-এর সাহাবী! তোমাকে এক আল্লাহর , যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জ্ঞানের অধিকারী এবং তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদের (সা.) কসম দিচ্ছি- তুমি কি গাদীর দিবসে সেখানে উপস্থিত ছিলে না ?
সে বললঃ হা , আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম”
।
বললামঃ“
ঐ দিন আলী সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে কি শুনেছিলে ?”
বললঃ আমি শুনেছিলাম তিনি বলেছিলেন যে আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে , তুমি তার সাথে শত্রুতা কর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে , তাকে তুমি ত্যাগ কর যে আলীকে ত্যাগ করে”
।
বললামঃ এই আবু হোরায়রা! তাহলে কেন তুমি তার শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব আর তার বন্ধু্দের সাথে শত্রুতা করছো ?
আবু হোরায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললঃ“
উন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”
।
অর্থাৎ আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং তার নিকট প্রত্যাবর্তনন করবো।
এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে , বিখ্যাত ব্যক্তিগণ , যারা এই হাদীসের সাথে যথার্থ আমল না করে আমিরুল মু’
মিনীন আলী (আ.)-এর বিরোধিতা করতো , তাদের নিকট সাধারণ জনগন গাদীরের এই হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করতেন ; তার মধ্যে একটি হচ্ছেঃ
5. দারামী’
র এক মহিলার প্রমাণ স্বরূপ উত্থাপিত গাদীরের হাদীস
সে ছিল দারামের অধিবাসী আলী (আ.)-এর অনুসারীদের মধ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যে মদীনার হুজুন এলাকায় বসবাস করতো। আর সে কারণেই তাকে দারামীয়া হুজনীয়া বলা হত। তার এই উপনামের প্রসিদ্ধতার কারণে তার প্রকৃত নাম ইতিহাসে উল্লেখ হয়নি। হজ্জের সময় মোয়াবিয়া তাকে ডেকে বললঃ তুমি কি জান কেন তোমাকে ডেকেছি ?
বললঃ“
সুবহানাল্লাহ! (আল্লাহ মহা পবিত্র) আমি অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী নই”
(অদৃশ্যের বিষয়ে কিছু জানিনা)
বললঃ“
আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম যে , তুমি কেন আলীকে ভালবাস আর আমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ কর ? তার শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছ অথচ আমার সাথে শত্রুতা কর ?”
বললঃ“
যদি সম্ভব হয় আমাকে এরূপ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষমা কর”
(বাধ্য কর না)
বললঃ না , তোমাকে ক্ষমা করবো না। (তোমাকে বলতেই হবে)
বললঃ এ রকমই যখন তাহলে শোন! আলীকে ভালবাসি কারণ , তিনি দেশের নাগরিকদের সাথে ন্যায় সঙ্গত আচরণ করতেন ও বাইতুল মাল (সরকারী সম্পদ) সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করতেন। তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করি কারণ , যে ব্যক্তি খেলাফতের ক্ষেত্রে তোমার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত ছিল তুমি তার সাথে যুদ্ধ করেছ ও যেটা তোমার অধিকার নয় , সেটা দাবী করেছ। আলীর শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছি কারণ , আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন এবং তিনি ছিলেন গরীব-দুঃখীদের বন্ধু ও দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানকারী। আর তোমার সাথে শত্রুতা করি কারণ , তুমি মানুষের রক্ত ঝরিয়েছ ও বিবাদ সৃষ্টি করেছ , বিচারকার্যে অন্যায় করেছ এবং নাফসের চাহিদা মোতাবেক হুকুম প্রদান করেছ।
6. এক অজ্ঞাত যুবক গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন
আবু হোরায়রা কুফার মসজিদে প্রবেশ করল। আর প্রবেশ করার সাথে সাথে জনগণ তার চারিপাশে ঘিরে বসলো এবং সবাই তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো। এমন সময় এক যুবক দাড়িয়ে বললঃ তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি! তুমি কি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছ যে , তিনি বলেছেনঃ“
আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ তাকে তুমি ভালবাস যে তাকে ভালবাসে ও তার সাথে শত্রুতা কর যে তার সাথে শত্রুতা করে ?”
আবু হোরায়রা বললঃ“
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আমি স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে ঠিক এভাবেই শুনেছি।”
অনুরূপভাবে ইসলামের ইতিহাসেও দেখা যায় যে , যারা আলী (আ.)- এর বিপরীতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছিল তারা আলী (আ.)-এর সাথে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও গাদীরের হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতেন। যেমনঃ
7. আমর ইবনে আস গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন
সকলেরই জানে যে , আমর ইবনে আস , আলীর একজন ঘোর শত্রু ছিল , সে- ই মোয়াবিয়াকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বুদ্ধি দিয়েছিল এবং আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইন্ধন যুগিয়েছিল । স্বীয় চক্রান্তের মাধ্যমে তাকে নির্ঘাত পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ও বিচারের বিষয়টি উত্থাপন করে শামের (সিরিয়ার) সৈন্যদেরকে শক্তি যুগিয়েছিল এবং কুফার সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। আর সেখানেই খারিজীদের (দ্বীন ত্যাগীদের) বীজ বপিত হয়েছিল আর তার এসব সহযোগিতার কারণেই সে মোয়াবিয়ার নিকট থেকে পুরস্কার স্বরূপ মিশরের শাসনভার পেয়েছিল।
মোয়াবিয়া তার হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করার পূর্বে তার নিকট সাহায্য কামনা করে একটি পত্র লিখেছিল। তাতে লিখেছিলঃ“
আলী ছিল উসমান হত্যার কারণ , আর আমি হলাম উসমানের খলিফা”
।
আমর তার প্রত্যুত্তরে লিখেছিলঃ
তোমার পত্রটি পাঠ করলাম ও বুঝলাম। তবে তুমি চাচ্ছ যে , আমি দ্বীন ত্যাগ করে তোমার সাথে পথভ্রষ্টতার উপত্যকায় প্রবেশ করি ও তোমাকে তোমার ঐ ভ্রান্ত পথে সাহায্য করি এবং আমিরুল মু’
মিনীন আলীর বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করি। কিন্তু তিনি হচ্ছেন রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা , অভিভাবক , প্রতিনিধি ও ওয়ারিশ। তিনি রাসূল (সা.)-এর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর তার অঙ্গীকারগুলো রক্ষা করেছেন। তিনি তার জামাতা , বিশ্বের নারীদের নেত্রীর স্বামী , বেহেশতেরর যুবকদের সরদার হাসান ও হোসাইনের পিতা। এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারলাম না।
কিন্তু তুমি যে দাবি করেছ উসমানের প্রতিনিধি আর উসমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তুমি হয়েছ পদচ্যুত আর তোমার খেলাফত হয়েছে নিশ্চিহ্ন ও আরো বলেছঃ আমিরুল মু’
মিনীন আলী , উসমানকে হত্যার জন্য সাহাবীদেরকে উস্কানি দিয়েছে , এটা মিথ্যা ও অপবাদ। তোমার জন্য দুঃখ হয় এই মোয়াবিয়া! তুমি কি জান না আবুল হাসান (আলী) আল্লাহর পথে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে দিয়েছিল ও রাসূল (সা.)-এর বিছানায় ঘুমিয়েছিল এবং রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।
8. উমর ইবনে আব্দল আজিজ গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন
ইয়াজিদ ইবনে উমর নামক একজন বলেছেনঃ আমি শামে (সিরিয়াতে) ছিলাম , উমর ইবনে আব্দুল আজিজ কিছু সম্পদ বন্টন করছিল , আমিও আমার অংশ নেওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম , যখন আমার পালা আসল , বললঃ তুমি কোন্ বংশের ? আমি বললামঃ কোরাঈশ বংশের। বললঃ কোন্ গোষ্ঠীর ? বললামঃ বনী-হাশিম গোষ্ঠীর। বললঃ কোন্ পরিবারের ? বললামঃ আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। বললঃ কোন্ আলীর ? আমি উত্তর দিই নি। তখন উমর ইবনে আব্দুল আজিজ তার বুকে হাত রেখে বললঃ আল্লাহর কসম! আমিও আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। একদল লোক আমাকে বলেছে যে , রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ“
আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।”
তখন সে তার সহকারীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললঃ এ রকম লোককে তুমি কি পরিমাণ দিয়ে থাক ? বললঃ একশ’
থেকে দুইশ’
দিরহাম। বললেনঃ তাকে তুমি 50 দিনার দাও।
কারণ , সে হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতে বিশ্বাসী তথা তার অনুসারী। আমাকে বললঃ তুমি তোমার শহরে ফিরে যাও , তোমার প্রাপ্য তুমি সেখানেই পাবে।
9. আব্বাসীয় খলিফা মামুনও গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন
প্রসঙ্গক্রমে মামুন ও বিচারপতি ইসহাক ইবনে ইব্রাহিমের মাঝে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মর্যাদা নিয়ে সে যুগে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল , তখন মামুন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ তুমি কি শাসন কর্তৃত্বের (বেলায়াতের) হাদীসটি বর্ণনা কর ? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ করি। মামুন বললঃ হাদীসটা পাঠ কর। ইয়াহহিয়া হাদীসটি পাঠ করল।
মামুন জিজ্ঞেস করলঃ তোমার দৃষ্টিতে এই হাদীসটি কি আবু বকর ও উমরের উপর আলীর প্রতি কোন দায়িত্ব অর্পন করে ? না-কি করে না ?
ইসহাক বললঃ বলা হয় যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি ঐ সময় বলেছিলেন যখন আলী ও যাইদ ইবনে হারিসের মধ্যে এক মতপার্থক্যকে দেখা দিয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর সাথে আলীর আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা যাইদ অস্বীকার করেছিল ; আর এই কারণেই রাসূল (সা.) বলেছিলেনঃ“
আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা...।”
মামুন বললঃ এই হাদীসটি কি রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বলেন নি ?
ইসহাক বললঃ হ্যাঁ ।
মামুন বললঃ যাইদ ইবনে হারিসা গাদীরের পূর্বেই শহীদ হয়েছিলেন। তুমি কিভাবে এটা মেনে নিলে যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি তার কারণেই বলেছেন ? আমাকে বল যদি তোমার পনের বছরের ছেলে মানুষকে বলে যে , হে জনগণ! আপনারা জেনে নিন যে , যাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে , আমার চাচাতো ভাই-এর সাথেও তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তুমি কি তাকে বলবে না যে , যে বিষয়টা সবার জানা ও কারো কাছে যেটা অস্পষ্ট নয় , কেন তুমি সেই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করছো ?
বললঃ কেন , অবশ্যই তাকে বলবো।
মামুন বললঃ এই ইসহাক! যে বিষয়টি তুমি তোমার পনের বছরের ছেলের ক্ষেত্রে মেনে নিচ্ছ না , তাহলে কিভাবে ঐ একই বিষয় রাসূল (সা.)- এর ক্ষেত্রে মেনে নিলে ? আক্ষেপ হয় তোমাদের উপর , কেন তোমরা তোমাদের ফকীহদের (ফিকাহবিদদের) পূজারী বা ইবাদত কর ?
যেমনভাবে পরিলক্ষিত হল তাতে সকল আলোচনাই ছিল হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত সম্পর্কে কথোপকথোনের কেন্দ্র বিন্দু। প্রমাণ উপস্থাপনকারীগণ এই হাদীস দ্বারা , আলী (আ.)-এর খেলাফতকে প্রমাণ করেছেন। আর বক্তাগণও কখনো বলেননি যে , এই হাদীসে“
মাওলা”
শব্দটি নেতা বা অভিভাবক ব্যতীত অন্যকিছু। যদি উক্ত হাদীসে আলী (আ.)-এর নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য কোন অর্থ থাকতো , তাহলে আবু হোরায়রা এভাবে বিনীত হয়ে জনাব আসবাগ ইবনে নাবাতার সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো না ও লজ্জিত হত না এবং আমর ইবনে আস , আম্মারের কাছে নিরুপায় হয়ে আত্ম সমর্পন করতো না।
সুতরাং যদি কেউ যে কোন অভিসন্ধির কারণে গাদীরের হাদীসের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে তাহলে সে শুধু সত্যকেই গোপন করেনি বরং রাসূল (সা.)-এর হাদীসকেও বিকৃত করেছে এবং আব্বাসীয় খলিফা মামুনের ভাষায় অর্থ বিকৃতকারীরা রাসূল (সা.)-এর উপর এমন কিছু আরোপ করেছে যা এক পনের বছরের ছেলের উপরও আরোপ করা যায় না।