আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর15%

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর লেখক:
: মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 26661 / ডাউনলোড: 5104
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।


1

2

পঞ্চম অধ্যায়

মহানবীর (সা.) বিশেষ কিছু আচরণ

রাসূল (সা.)-এর বিশেষ কিছু আচরণ গাদীরের হাদীসকে বুঝতে যে সকল উপাদান আমাদেরকে সাহায্য করে থাকে তার মধ্যে একটি উপাদান হচ্ছে আলী (আ.)-এর সাথে রাসূল (সা.)- এর আচরণ। এই মাপকাঠির ভিত্তিতে যদি রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর সাথে অন্য কোন সাহাবীর মত এমন কি যদি কোন একজন নিকটাতাত্মীয়র মতও আচরণ করতেন এবং এ ক্ষেত্রে তার সাথে বিশেষ আচরণ না করতেন তবে গাদীরের হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝার জন্য রাসূল (সা.)-এর আচরণ থেকে কিছুই প্রমাণ করা যেত না। কিন্তু আমরা দেখি যে , আলী (আ.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর আচরণ ও অন্যান্য সাহাবীগণের সাথে আচরণের মধ্যে পার্থক্যকে আছে , যার প্রতি সামান্য একটু যদি লক্ষ্য করি তাহলেই এ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারব যে , আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টিতে অন্যান্য সকল মুসলমানদের থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি (সা.) তার সারাটি জীবন বিশেষ করে তার নবুয়্যতি জীবনে সর্বদা এই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন যে , তাকে (আলীকে) যেন সর্ববৃহৎ ও মহান কাজের জন্য গড়ে তুলতে পারেন এবং সকল মুসলমানকে তার মর্যাদাসমূহের সাথে পরিচিত করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর প্রত্যেকটি আচরণই গাদীরের হাদীসকেই সমর্থন করে। সামগ্রিকভাবে আলী (আ.)-এর প্রতি তার এ ধরনের আচরণ এক ও অভিন্ন এক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে। রাসূল (সা.) তার এই আচরণ দ্বারা এই বিষয়টি বুঝাতে চেয়েছেন যে , আলী (আ.) অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা ও এমন এক ব্যক্তি যে রাসূল (সা.)-এর অনুরূপ ও আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টির অধিকারী হিসেবে ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব ও মুসলমানদের পথ প্রদর্শনের জন্য উপযুক্ত। আমরা এ অধ্যায়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে আলী (আ.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর কিছু আচরণ তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

১. দরজাসমূহ বন্ধকরণ

মসজিদে নববী , মদীনায় এমন স্থানে নির্মান করা হয়েছিল যে , সেখানের অধিবাসীদের বাড়ি-ঘর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। এ কারণে সকলের যাতায়াতের পথ ছিল মসজিদের ভিতর দিয়ে। মসজিদ নির্মানের পর বেশ কিছুদিন যাবৎ লোকজন মসজিদের ভিতর দিয়েই চলাচল করত। হযরত আলী (আ.)-এর বাসাটিও সেখানেই ছিল।

অনেকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল (সা.) সমস্ত দরজাসমূহ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন শুধু মাত্র আলী (আ.)-এর দরজা ব্যতীত। একদল লোক এ ধরনের বৈষম্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে প্রকাশ্য এবং গোপনে আপত্তি ও প্রতিবাদ করতে লাগলো। রাসূল (সা.) তাদের উত্তরে বললেনঃ আমি নির্দেশ দিয়েছি যে , আলীর দরজা ব্যতীত সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হোক , কিন্তু কেউ কেউ তোমাদের মধ্য হতে আপত্তি তুলেছে , আল্লাহর শপথ ; আমি (স্বেচ্ছায়) না কোন দরজা বন্ধ করেছি , না কোন দরজা খুলেছি বরং আমি নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার বাস্তবায়ন করেছি।৩০৮ অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেছেনঃ আমি সেটাকে উম্মুক্ত করিনি বরং আল্লাহই তা উম্মুক্ত করেছেন।৩০৯ এই হাদীসটি ইবনে আসাকির বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হতেও এভাবে বর্ণনা করেছেন।৩১০ জুয়াইনী , ফারায়েদ-এ লিখেছেন সাদ্দুল আবওয়াব (দরজা বন্ধের) হাদীসটি প্রায় ৩০ জন (ত্রিশ জন) সাহাবী বর্ণনা করেছেন।৩১১

২. বিশেষ মনোযোগ

মহান সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে , আলী (আ.)-এর সাথে রাসূল (সা.)-এর এমনই এক সম্পর্ক ছিল , যা অন্য কারো সাথেই ছিল না।৩১২ স্বয়ং হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণিত আছে যে , আমি যখনই প্রশ্ন করতাম উত্তর পেতাম যখন নিশ্চুপ থাকতাম তিনি নিজেই আমাকে সবকিছু বলতেন।৩১৩

৩. চুপিসারে আল্লাহর সাথে কথা বলা

তায়েফের যুদ্ধের দিন রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) নিয়ে নির্জনে গিয়ে চুপিসারে আস্তে করে কথা বলেছিলেন , সাহাবীগণের মধ্য হতে কয়েকজন বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনারা দীর্ঘক্ষণ ধরে চুপি চুপি কথা বললেন... তিনি বললেনঃ আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি বরং আল্লাহ স্বয়ং তার সাথে চুপিসারে কথা বলছিলেন।৩১৪

৪. আমিরুল মু মিনীন উপাধি

রাসূল (সা.)-এর সাহাবী বুরাইদা আসলামী (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ আমরা সাতজন ছিলাম , যার মধ্যে আমি ছিলাম তরুন। রাসূল (সা.) আমাদেরকে বললেনঃ আলীকে সালাম দাও এবং বল , শান্তি বর্ষিত হোক আপনার উপর হে আমিরুল মু মিনীন।৩১৫

৫. সূরা বারায়াতের (তওবার) প্রচার

রাসূল (সা.) আবু বকরকে নির্দেশ দিলেন যেন সে হজ্জের মৌসুমে হাজীদের মাঝে সূরা বারায়াত (তওবা) প্রচার করে। অতঃপর আলীকে পাঠালেন যাতে আবু বকরের নিকট থেকে সূরাটি নিয়ে স্বয়ং নিজেই পাঠ করে। তিনি বললেনঃ এই সূরাটি আমার পরিবারের সদস্য ব্যতীত অন্য কেউ যেন প্রচার ও পাঠ না করে।৩১৬ অন্যত্র বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেছেনঃ আমার বাণীকে স্বয়ং আমি অথবা আলী ব্যতীত অন্য কেউ যেন না পৌছায়।৩১৭

৬. আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সেনাপতি

যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ প্রাচীন নিয়মে চলছিল ও আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র তখনও রণক্ষেত্রে প্রবেশ করেনি সে সময় সৈন্যদলের অবস্থা নির্দেশক একটি পতাকা বহন করা হত যার নাম ছিল লাওয়া । এই লাওয়া উড্ডীয়মান থাকার অর্থই ছিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার আছে আর উড্ডীয়মান না থাকার অর্থ হচ্ছে সৈন্য বাহিনীর বিপর্যয় ঘটেছে। এ কারণেই মৌল পতাকাটি ঐ ব্যক্তি রণক্ষেত্রে বহন করতেন যিনি উচ্চ মান-মর্যাদার অধিকারী , যিনি দূর্দান্ত সাহসী ও দৃঢ়। কাফেরদের বিরুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর সকল যুদ্ধের মৌলিক পতাকা বা লাওয়া হযরত আলী ইবনে আবী তালিবের হাতে ছিল।৩১৮ হাদীস অনুযায়ী বর্ণিত আছে যে , যখনই রাসূলকে (সা.) প্রশ্ন করা হত , হাশরের দিন কে আপনার লাওয়া বহন করবে ? তিনি বলতেনঃ তিনিই বহন করবেন যিনি দুনিয়াতে তা বহন করেন , অর্থাৎ আলী ইবনে আবী তালিব।৩১৯

৭. হযরত ফাতিমা যাহরার (সা. আ.) সাথে বিবাহ

হযরত ফাতিমার (সা. আ.) সাথে পরিণয়ের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর প্রস্তাবে রাসূল (সা.)-এর ইতিবাচক জবাবও রাসূল (সা.)-এর সাথে আলী (আ.)-এর বিশেষ সম্পর্কের পরিচয় বহন করে। অথচ ইতিপূর্বে বিশিষ্ট সাহাবাদের অনেকেই ফাতিমার (সা.আ.) বিবাহের বিষয়ে তার মহান পিতার নিকট প্রস্তাব পেশ করেছিলেন কিন্তু তাতে তিনি কোন সাড়া দেননি এর বিপরীতে যখনই আলী (আ.) তার নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করলেন কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ ইতিবাচক জবাব দিলেন।৩২০ কিছু কিছু বর্ণনার ভিত্তিতে৩২১ আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসার পূর্বেই যখন একদল সাহাবী তার নিকট আলী (আ.)-এর সঙ্গে হযরত ফাতিমা (সা.)-এর বিবাহের বিষয়টি উত্থাপন করেন তখন তিনি কোনরূপ বিলম্ব ছাড়া তাদের সামনেই বিবাহের খুতবা পড়া শুরু করেন ও বললেনঃ আল্লাহ আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন যে , ফাতিমার বিবাহ যেন আলীর সাথে দেই।৩২২

ষষ্ঠ অধ্যায়

গাদীরের আচার-অনুষ্ঠান

অতীতে মুসলমানদের মধ্যে ঈদে গাদীর

যদি ঈদের অর্থ মানুষের জীবনের মহান স্মরণীয় ঘটনার প্রত্যাবর্তন হয়ে থাকে তাহলে ইসলামী সংস্কৃতির মাপকাঠিতে গাদীর দিবস এ মর্যাদার যোগ্য যে , সাধারণভাবে মানবজাতি এবং বিশেষ করে মুসলমানরা সর্ববৃহৎ ঈদ হিসেবে দিনটি উৎযাপন করবে। কেননা মানুষের জীবনে সর্ববৃহৎ ঘটনা এই দিনেই সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু হাদীসের ভাষ্যনুযায়ী জানি যে , এই দিনেই দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

সকল ঐশী দ্বীন ছিল ইসলামের ভূমিকা স্বরূপ , আর ইসলাম গাদীর দিবসে পরিপূর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালাও এ ধর্মকে মানুষের জন্য নির্বাচন করেছেন।

) ال ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমি আমার নেয়ামত (অনুগ্রহ) সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ (মনোনীত) করলাম। ৩২৩

কোন ঘটনাই দ্বীন পূর্ণ হওয়ার ঘটনার মত মানুষের জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। আর সে কারণেই কোন দিবসই গাদীর দিবসের মত আনন্দ-উৎসব করার ক্ষেত্রে সমতুল্য নয়। আর ঠিক এই দলিলের ভিত্তিতেই রাসূল (সা.) স্বয়ং এই দিনকে ঈদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং মুসলমানদেরকে বলেছেন তাকে (সা.) যেন অভিবাদন জানানো হয়।

তিনি বলেছেনঃ

هنئونی , هنئونی ان اللّه تعالی خصنی بالنبوه و خص اهل بیتی بالامامه

অর্থাৎ আমাকে অভিবাদন জানাও , আমাকে অভিবাদন জানাও মহান আল্লাহ আমাকে নবুয়্যতের আর আমার পরিবারবর্গকে ইমামতের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন।৩২৪ তিনি আরো বলেনঃ

یوم الغدیر افضل اعیاد امتی و هو الیوم الذی امرنی اللّه تعالی ذکره بنصب اخی علی بن ابیطالب علما لا متی یهتدون به من بعدی و هو الیوم الذی اکمل اللّه فیه الدین و اتم علی امتی فیه النعمه و رضی لهم الا سلام دینا

অর্থাৎ গাদীর দিবসটি আমার উম্মতের জন্য সর্ববৃহৎ ঈদগুলির অন্যতম। তা এমন একটি দিন , যে দিনে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দান করেছেন যে , আমার ভাই আলীকে যেন আমার উম্মতের নিশান বা নিদর্শন হিসেবে নিয়োগ দান করি যাতে আমার পরে সে যেন এই পথকে অব্যাহত রাখে এবং ঐ দিন এমনই দিন , যে দিনে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনকে পূর্ণতা ও তার নেয়ামতকে আমার উম্মতের জন্য সম্পূর্ণ করেছেন আর ইসলাম তাদের দ্বীন হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। ৩২৫

অতএব , ইসলামী ঈদ হিসেবে গাদীর দিবসের প্রতি মনোযোগ রাসূল (সা.)-এর সময় হতেই ছিল। রাসূলই (সা.) এই দিনকে ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন , তিনিই প্রকৃত পক্ষে এই ঈদের পতিষ্ঠাতা। রাসূল (সা.)-এর পরে ইমামগণও এই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতেন। আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) কোন এক শুক্রবার দিনে , যে দিনটি গাদীর দিবসও ছিল সেদিন তিনি একটি খুতবা পাঠ করেন। যে খুতবায় বলেনঃ

আল্লাহ তোমাদেরকে রহমত দান করুন। আজ তোমাদের পরিবারের জন্য তোমরা উদার হস্তে খরচ কর , তোমাদের ভ্রাতাদের প্রতি তোমরা সদয় হও , এই নেয়ামত যা আল্লাহ তোমাদেরকে প্রদান করেছেন তার জন্য তার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। ঐক্যবদ্ধ থাক যাতে আল্লাহ তোমাদেরকে বিক্ষিপ্ত অবস্থা হতে একত্রিত করতে পারেন। একে অন্যের পতি সদাচারী ও সদয় হও যাতে আল্লাহ এই সদাচরণ ও দয়ার কারণে তোমাদের সমাজের উপর কল্যাণ দান করেন। তাই এই ঈদের সওয়াব বা প্রতিদান অন্যান্য ঈদের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। তার প্রেরিত নেয়ামত হতে একে অপরকে উপহার প্রদান কর। এই দিনের কল্যাণকর কাজ তোমাদের ধন-সম্পদকে বৃদ্ধি করবে ও তোমাদের আয়ু বৃদ্ধি করবে। এই দিনে তোমাদের দয়া-অনুগ্রহ আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহকে আকৃষ্ট করবে। ৩২৬

আমরা জানি যে , আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর শাসনামলে অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন যারা এই কথাগুলি শ্রবণ করেছিলেন। যদি এই ঈদ তাদের নিকট সুনিশ্চিত না হত তাহলে তারা অবশ্যই প্রতিবাদ করতেন।

অতএব , আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর সময়কাল হতে যতদিন হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন ততদিন পর্যন্ত এবং সকল ইমামই এই দিনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার বিষয় থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে , তারাঁ সকলেই এই দিনকে ঈদ হিসেবেই জানতেন এবং সম্মানের সাথে তা উদযাপন করতেন। এই দিনে তারাও রোজা রাখতেন এবং সাহাবী ও আত্মীয়-স্বজনকেও রোজা রাখতে বলতেন।

সিকাতুল ইসলাম কুলাইনী , তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কাফী তে সালেম হতে বর্ণনা করেছেন , তিনি বলেনঃ আমি ইমাম সাদিককে (আ.) জিজ্ঞেস করলামঃ মুসলমানদের জন্য জুম আ , ফিতর ও আযহা ব্যতীত অন্য কোন ঈদ আছে কি ?

বললেনঃ হ্যাঁ , সবচেয়ে বড় ঈদ।

বললামঃ সেটা কোন্ দিন ?

বললেনঃ যে দিন আল্লাহর রাসূল (সা.) আমিরুল মু মিনীন আলীকে (আ.) অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন ও বলেছিলেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه

অর্থাৎ আমি যাদের অভিভাবক এই আলীও তাদের অভিভাবক।৩২৭

হাসান ইবনে রাশেদ থেকেও বর্ণিত হয়েছে যে , তিনি বলেন- ইমাম সাদিক (আ.) কে জিজ্ঞাসা করলামঃ

আমার প্রাণ আপনার জন্য উৎসর্গিত। মুসলমানদের ঈদুল ফিতর ও আযহা ছাড়াও কি ঈদ আছে ? বললেনঃ হা আছে। যেটা ঐ দু টার চেয়েও বড় ও সম্মানের। বললামঃ সেটা কোন্ দিন ? বললেনঃ যেদিন আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) অভিভাবকত্বের পদলাভ করেন। বললামঃ আপনার জন্য আমি উৎসর্গিত। উক্ত দিনে আমাদের করণীয় কি ? বললেনঃ রোজা রাখ , রাসূল (সা.)-এর উপর ও তার পরিবারবর্গের উপর বেশি বেশি দূরদ পাঠ কর এবং যারা তাদের উপর জুলুম-অত্যাচার করেছে তাদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ ও ব্যক্ত কর। আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণ তাদের স্থলাভিষিক্তদেরক নির্দেশ দিতেন যে , স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের দিনকে যেন ঈদ হিসাবে উদযাপন করা হয়। বললামঃ যে এই দিনে রোজা রাখবে তার পুরস্কার কি ? বললেনঃ তার পুরস্কার ৬০ মাস রোজা রাখার পুরস্কারের সমান।৩২৮

অনুরূপভাবে ফুরাত ইবনে ইব্রাহিম তার তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট প্রশ্ন করা হলঃ মুসলমানদের কি ফিতর , আযহা , জুমআ র দিন ও আরাফার দিন ব্যতীত অন্য কোন উত্তম ঈদের দিন আছে ?

বললেনঃ হ্যাঁ , ঐগুলির চেয়ে উত্তম , বড় ও আল্লাহর নিকট ঐগুলির চেয়েও সম্মানিত আর ঐ দিনটি হচ্ছে সেই দিন যেদিন আল্লাহ তার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন এবং তার রাসূল (সা.)-এর উপর এভাবে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন যে ,

) ال ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমি আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।

বর্ণনাকারী বললেনঃ সেটা কোন্ দিন ?

বললেনঃ বনী ইসরাঈলের নবীগণ সর্বদা স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন্ করতেন। আর মুসলমানদের ঈদ হচ্ছে সেদিন যেদিন রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) অভিভাবক বা স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করেছেন। আর এ উপলক্ষে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন ও তার নেয়ামতকে মু মিনদের জন্য সম্পূর্ণ করেছেন।৩২৯

অনুরূপভাবে বলেনঃ এই দিবসটি হচ্ছে ইবাদত , নামাজ , আনন্দ-উৎসব ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। কারণ , এই দিনে আল্লাহ আমাদের অভিভাবকত্বের নেয়ামত তোমাদেরকে দান করেছেন। আমি চাই যে , তোমরা এই দিনে রোজা রাখ।৩৩০

ফাইয়াজ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে উমর তুসী হতে বর্ণিত আছে যে , গাদীর দিবসে আমি ইমাম রেযার (আ.) নিকট উপস্থিত হলাম , দেখলাম যে তিনি তার কিছু সংখ্যক সঙ্গ-সাথিকে ইফতারের জন্য বাড়িতে বসিয়ে রেখেছেন এবং পোশাক-পরিচ্ছদ এমনকি জুতা ও আংটি যেগুলো তাদেরকে উপহার দিয়েছেন , সেগুলো তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তার বাড়িতে ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেন ভিন্ন রকম পরিবেশ বিরাজ করছে। তার কর্মচারীবৃন্দকে দেখলাম তারা নতুন নতুন জিনিস পরিধান করেছে এবং বিগত দিনের ব্যবহৃত জিনিসগুলোকেও পাল্টে নতুন করা হয়েছে আর ইমাম রেযা (আ.) উক্ত দিনের মর্যাদা সম্পর্কে তাদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন।৩৩১

আলোচ্য বিষয়টি ইতিহাসেও বর্ণনা করা হয়েছে যে , মুসলমানগণ যুগ যুগ ধরে এই দিনটিকে ঈদ হিসেবে পালন করে আসছেন।

আবু রাইহান বিরুনী তার রচিত গ্রন্থ আল আসারুল বাকিয়্যাহ তে লিখেছেনঃ

জিলহজ্জ মাসের ১৮ তারিখে , ঈদে গাদীরে খুম আর ঐ নামটি এমন এক স্থানের নাম যেখানে রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের পর অবস্থান করেছিলেন এবং উটের জিনগুলোকে একত্র করে তার উপর উঠে আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) হাত ধরে বলেছিলেনঃ আমি যাদের অভিভাবক এই আলীও তাদের অভিভাবক।৩৩২

এবং মাসউদী তার গ্রন্থ আত্ তানবিহ ওয়াল আশরাফ এ লিখেছেনঃ আলী (আ.)-এর সন্তানগণ ও তার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) এই দিনটিকে মহান দিবস হিসেবে গণ্য করে।৩৩৩

এবং ইবনে তালহা শাফেয়ী তার গ্রন্থ মাতালেবুস সুউল এ লিখেছেনঃ এই দিনটিকে গাদীরে খুম দিবস নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং এই দিনে ঈদ উৎসব পালন করা হয়। যেহেতু সে সময়টি এমনই সময়ছিল যে সময়ে রাসূল (সা.) তাকে উচ্চ সম্মানে ভূষিত করেন এবং সকল মানুষের মধ্য হতে তাকেই কেবল এই সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত করেন।৩৩৪

সালাবী তার সিমারুল কুলুব গ্রন্থে লিখেছেনঃ গাদীরের রাতটি ঐ রাত যে রাতের পরের দিন রাসূল (সা.) গাদীরে খুমে উটের জিনের উপর উঠে খুতবা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه اللهم و ال من والاه و عاد من عاداه من نصره و اخذل من خذله

অর্থাৎ আমি যাদের অভিভাবক এই আলীও তাদের অভিভাবক হে আল্লাহ! যারা তাকে ভালবাসে তাকে তুমি ভালবাস আর যারা তার সাথে শত্রুতা করে তার সাথে শত্রুতা কর ও যারা তাকে সাহায্য করে তাকে সাহায্য কর এবং যারা তাকে লাঞ্চিত করে তুমি তাকে লাঞ্চিত কর। শিয়াগণ এই রাতকে অনেক মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করে এবং ইবাদতের মাধ্যমে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।৩৩৫

অনুরূপভাবে ইবনে খাল্লাকান মুসতানসারের ছেলে মুসতাআলী ফাতেমীর জীবনী অধ্যায়ে লিখেছেনঃ

ঈদে গাদীরের দিনে অর্থাৎ ১৮ই জিলহজ্জে ৪৮৭ হিজরীতে জনগণ তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ (অঙ্গীকারাবদ্ধ) করেছেন।৩৩৬

এবং মুসতানসার ফাতেমীর জীবনী অধ্যায়ে লিখেছেনঃ সে বুধবার দিবাগত রাতে যখন ৪৮৭ হিজরীর জিলহজ্জ মাস শেষ হতে বার দিন বাকী ছিল তখন ইন্তেকাল করে। আর ঐ রাতটি ছিল ঈদে গাদীরের রাত অর্থাৎ ১৮ই জিলহজ্জ বা ঈদে গাদীরে খুম।৩৩৭

যেমনভাবে আমরা হাদীসসমূহ ও ঐতিহাসিকদের বিবরণে লক্ষ্য করলাম যে , গাদীর দিবসটি রাসূল (সা.)-এর জীবনের শেষ বছরে অর্থাৎ যে বছরে আলীকে (আ.) খেলাফতে অধিষ্টিত করেন সেই বছরেই ঈদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং সেই বছর ও সেই মরুভূমি থেকে যুগ যুগ ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মুসলমানদের মাঝে এবং ইসলামী দেশসমূহে এই ঈদ জীবন্ত হয়ে রয়েছে।

ইতিহাসের দৃষ্টিতে , এই দিনটি ইমাম সাদিকের (শাহাদাত ১৪৮ হিঃ) যুগে , ইমাম রেযার (শাহাদাত-২০৩ হিঃ) যুগে , ইমাম মাহদী (আ.)-এর গুপ্তকালীন অন্তর্ধানের (গায়বাতে ছোগরা) যুগ অর্থাৎ যে সময় ফুরাত ইবনে ইব্রাহিম কুফী ও কুলাইনী রাজী জন্ম নিয়েছিলেন সে যুগে , মাসউদীর (মৃত্যুঃ ৩৪৫হিঃ) যুগে , সালাবী নিশাবুরীরু (মৃত্যুঃ ৪২৯হিঃ) যুগে , আবু রাইহান বিরুনীর (মৃত্যুঃ ৪৩০হিঃ) যুগে , ইবনে তালহা শাফেয়ীর (মৃত্যু ৬৫৪ হিঃ) যুগে এবং ইবনে খাল্লাকানের (মৃত্যুঃ ৬৮১ হিঃ) যুগে ঈদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।

ভৌগলিক বিস্তৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রাচ্যে অর্থাৎ মধ্য এশিয়ার যে অঞ্চলে আবু রাইহান জন্মলাভ করেছিলেন , নিশাবুর যেখানে সালাবী জন্মলাভ করেছিলেন , এই সব স্থান হতে রেই যেখানে কুলাইনী জন্মলাভ করেছিলেন এবং শায়িত আছেন , বাগদাদ যেখানে মাসউদী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ও বড় হয়েছিলেন , হালাব যেখানে ইবনে তালহা জীবন যাপন করেছেন ও মৃত্যু বরণ করেছেন এবং মিশর যেখানে ইবনে খাল্লাকান জীবন অতিবাহিত করেন এবং ইহলোক ত্যাগ করেন এ সকল স্থানের জনগণ এই ঈদ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিলেন এবং তাকে ঈদ হিসেবেই পালন করতেন। এটা এমনি এক অবস্থায় যে , যদি মনেও করি এই মহান ব্যক্তিগণ প্রত্যেকেই তাদের স্বীয় এলাকায় অবস্থান করে এ বিষয়ে খবর প্রদান করেছেন , তারপরেও আমরা জানি যে , তাদের মধ্যে অনেকেই যেমন- মাসউদী ও বিরুনী বেশীরভাগ মুসলিম দেশ সফর করেছেন। দ্বিতীয়তঃ তাদের লিখিত বিভিন্ন রচনাদিতে এই দিনটিকে তারা মুসলমানদের ঈদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ঈদে গাদীরের আমলসমূহ ও তার নিয়মাবলী

কোন জাতির মাঝে ঈদের উৎপত্তি লাভের মৌলিক উপাদান হচ্ছে- এমন কোন ঘটনা যা সেই জাতির জন্য আনন্দদায়ক ও সৌভাগ্যপূর্ণ , যা নির্দিষ্ট কোন এক সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে এবং সেটি আগে ও পরের ঘটনাবলী হতে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট হয়ে থাকে আর তখন থেকেই মানুষ ঐ দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে নামকরণ করে থাকে এবং যুগ যুগ ধরে ঐ দিনকে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হিসেবে সম্মান করে।

ইসলামী সংস্কৃতিতে এই ধরনের মৌলিক উপাদানকে নেয়ামত নামকরণ করা হয়ে থাকে ও প্রত্যেকটি জ্ঞানবান ব্যক্তিই নিজেকে কর্তব্যপরায়ণ বলে মনে করে যে , এই নেয়ামত দাতার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে। আর এ সকল কারণেই দ্বীন-ইসলামের নিয়মাবলীর মধ্যে একটি হচ্ছে- এই ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে বিশেষ ইবাদত-বন্দেগী করা যা মানুষকে অধিকতর আল্লাহর (নেয়ামত দাতার) নিকটবর্তী করে।

ঈদে গাদীরের দিনেও ঠিক অন্যান্য ঈদের দিনের মতই বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী ও বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই মহান ঈদের ক্ষেত্রে দু টি বিশেষ নিয়মাবলীর কথা উল্লিখিত আছেঃ

১. এই দিনের আদব বা নিয়মাবলী সংখ্যাগত ও গুণগত দিক থেকে ইসলামের অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে অধিক গুরুত্বের অধিকারী। এমন কি বলা যেতে পারে: ঈদে গাদীরের আমল সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে , সকল কল্যাণকর কাজের সমষ্টি , একটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ব্যবস্থার সামগ্রিক রূপ।

২. পবিত্র ও নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) থেকে যে সমস্ত হাদীস আমাদের নিকট পৌছেছে সে অনুযায়ী গাদীরের প্রত্যেকটি আমল বা কর্মেরই বিশেষ উচ্চ মর্যাদা ও মূল্য রয়েছে। আর সে জন্যই এর পুরস্কারও হবে সর্বোচ্চ ধরনের।

সুতরাং গাদীর দিবস , এমন এক মূল্যবান ধর্মীয় অনুষ্ঠান যার মর্যাদা রক্ষা করা একান্ত জরুরী। আর এই দিনের সম্মান বা মর্যাদা রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে- এই দিনের আদব ও নিয়ম-কানুনগুলি ঠিক সেভাবে মেনে চলা যেভাবে আহলে বাইত (আ.) নির্দিষ্ট করেছেন এবং মেনে চলতেন।

গাদীরের হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ

গাদীরের হাদীসে যে বাক্যটি দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে ও গাদীরের ঘটনার বাস্তব তাৎপর্য যার ভিতর নিহিত সেটা হচ্ছে- রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা , এই আলীও তাদের মাওলা

যারা এই হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা মাওলা শব্দটি আওলা বা অধিকারের ক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভকারী অর্থে ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তি যিনি সহজ ভাষায় বলা যায় অভিভাবকত্ব , নেতৃত্ব দান ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। উক্তধারায় এই হাদীসের অর্থ দাড়ায় আমি যাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান এই আলীও তাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান । সুতরাং যারা রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের অনুগত , শুধুমাত্র তারাই আলীর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বকে স্বীকার ও তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।

এ পর্যায়ে অবশ্যই জানা দরকার যে , আরবী ভাষাতে মাওলা শব্দের অর্থ কি ঠিক এভাবে ব্যবহৃত হয়েছে না কি অন্যভাবে ? আবার যদি মেনেও নিই যে , এই একই অর্থেই আরবী ভাষাতেও মাওলা শব্দের ব্যবহার হয়েছে , তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- এই খুতবাতেও (বক্তব্যেও) কি সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে ? না-কি ভিন্ন অর্থে।

মরহুম আল্লামা আমিনী 42 জন প্রসিদ্ধ মুফাসসীর ও আভিধানিক আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন , যাদের মধ্যে 27 জনই বলেছেন যে , মাওলা এর অর্থ আওলা বা প্রধান। বাকী 15 জন বলেছেন- আওলা হচ্ছে- মাওলা শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে একটি অর্থ।62

কিন্তু উক্ত হাদীসে কি মাওলা শব্দ ঐ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে আমাদেরকে দেখতে হবে যে , কোন্ প্রেক্ষাপটে ও কোন্ স্থানে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। খুতবাটিকে স্থান , কাল ও পাত্রভেদে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , ঐ বাক্যটিতে ব্যবহৃত মাওলা শব্দের অর্থটি নিঃসন্দেহে আওলা অর্থাৎ প্রধান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

কেননা রাসূল (সা.)-এর মত ব্যক্তি যিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী পূর্ণাঙ্গ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং আসমানী দূত ,ঐ রকম একটি দিনে , যে দিনের তাপ্রমাত্রা এত বেশী ছিল যে , সেখানকার মাটিগুলো যেন উত্তপ্ত গলিত লৌহের মত উপস্থিত শ্রোতাদের পদযুগলকে পোড়াচ্ছিল এবং সূর্যের উত্তপ্ত কিরণ যেন তাদের মাথার মগজকে টগবগ করে ফুটাচ্ছিল , উত্তপ্ত মরুভূমির চরম প্রতিকূল সেই পরিবেশে63 এমন অবস্থা ছিল যেন , মাটিতে মাংস ফেললে তা কাবাবে পরিণত হবে।64 ঐ স্থানটি ছিল এমনি এক এলাকায় যেখানে কোন কাফেলা বা পথযাত্রীই যাত্রা বিরতি দেয় না , কিন্তু রাসূল (সা.) সেখানে হাজার হাজার হাজীকে দাড়ঁ করিয়ে রেখেছেন , অগ্রগামীদের প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন ও অপেক্ষায় ছিলেন যাতে পশ্চাৎগামীরা উপস্থিত হয় এবং দিনের সর্বাধিক তাপমাত্রার সময় চাচ্ছেন ভাষণ দিতে। তাছাড়াও তিনি কয়েকবার জনগণের নিকট প্রশ্ন করলেন যাতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন হয় যে , তারা তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কি না এবং সর্বশেষে আলীকে (আ.) তাদের সামনে তুলে ধরলেন ও নাম এবং বংশ পরিচয়সহ তাকে পরিচয় করালেন এবং বললেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা । অতঃপর সকলকে দায়িত্ব দিয়ে বললেন যেন , তারা এই বার্তাটি অনুপস্থিতদের কর্ণগোচর করে। তারপর সবাইকে নির্দেশ দিলেন যে , তার নিকট যেন বাইয়াত (শপথ গ্রহণ) করে ও তাকে স্বাদর-সম্ভাষণ জানায় এবং স্বীয় পাগড়ী মোবারকটি তার মাথায় পরালেন ও বললেনঃ পাগড়ী হচ্ছে আরবের তাজ বা মকুট আর সাহাবীদের বললেনঃ বদর যুদ্ধের দিন যে সকল ফেরেশতা আমার সাহায্যার্থে এসেছিল তারা ঠিক এরূপ পাগড়ীই পরে এসেছিল।

এখন যদি আমরা ধরেও নিই যে , হাদীসটি কোন প্রকার ইশারা-ইঙ্গিত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই কারো নিকট পৌছানো হয় এবং সে নিরপেক্ষভাবে হাদীসটিকে পর্যালোচনা করে , তাহলেও এই হাদীসের অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে যে , হাদীসটির অর্থ এ সম্পর্কে অনবগতদের কথার বিপরীত অর্থই প্রকাশ করে অর্থাৎ হাদীসটির অর্থ এটা নয় যে রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেনঃ আমি যাদের বন্ধু এই আলীও তাদের বন্ধু অথবা আমি যাদের সাথী এই আলীও তাদের সাথী! কেননা , বন্ধু ও সাথীর ক্ষেত্রে বাইয়াত বা শপথের প্রয়োজন পড়ে না , পাগড়ী বা মুকুট পরানোর দরকার হয় না , মোটকথা এত গুরুত্ব দেওয়ার কোন কারণই নেই যে , ঐরূপ পরিস্থিতিতে ও ঐরূপ ভূমিকাসহ ঘোষণা দিতে হবে।

এসব দলিলের উপর ভিত্তি করেই মরহুম সেবতে ইবনে জাওজী যিনি আহলে সুন্নাতের একজন আলেম , এ সম্পর্কে একটি বিশাল আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে , উক্ত হাদীসে মাওলা শব্দের অর্থ আওলা বা প্রধান।65

ইবনে তালহা তার মাতালিবুস সুউল গ্রন্থে লিখেছেনঃ

হযরত রাসূল (সা.) মাওলা শব্দের যে অর্থই নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন , আলীর জন্যেও ঠিক একই অর্থই প্রয়াগ করেছেন। আর এটা একটা উচ্চ মর্যাদা যা রাসূল (সা.) বিশেষ করে আলীর জন্য ব্যবহার করেছেন।66

উল্লিখিত ফলাফলটি ঐ একই ফলাফল যা রাসূল (সা.)-এর খুতবার প্রতিটি বাক্যে তার প্রমাণ বহন করে ও ঐ একই জিনিস যা , একলক্ষ বিশ হাজার প্রকৃত আরবীভাষী দ্বিধা-দ্বন্দহীনভাবে রাসূল (সা.)-এর বাণী থেকে তা অনুধাবন করেছিলেন। আর তাই হাসসান্ উঠে দাড়িয়ে আলী (আ.)-এর শানে কবিতা আবৃতি করেছিলেন এবং রাসূলও (সা.) তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে যারাই এ ঘটনা শুনেছে তারা সবাই একই রকম বিষয় অনুধাবন করেছে যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আভিধানিকগণ এবং আলেমগণও ঠিক ঐ একই রকম বিষয়বস্তু অনুধাবন করেছেন। আর শত শত আরবী কবি ও অন্যান্য কবিগণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে আলীকে নির্ধারণ করেছেন। আর সে কারণেই গাদীর দিবসকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।

হযরত আলী (আ.) তার প্রকাশ্য খেলাফতকালে কুফা শহরে অনেকবার এই হাদীসটি উল্লেখ করে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদেরকে কসম দিতেন যাতে যা কিছু এ সম্পর্কে তাদের স্মরণে আছে যেন তার সাক্ষ্য প্রদান করে তাও আবার ঐ ঘটনার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যখন রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছিল আর যারা জীবিত ছিল তারাও ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং কুফাও ছিল সে সময়ে সাহাবীদের প্রাণকেন্দ্র মদীনা হতে অনেক দূরে এবং তিনিও কোন পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীতই বা কোন ভূমিকা ছাড়াই তাদের নিকট সাক্ষ্য চেয়েছিলেন। তারাও কোন ধরনের অজুহাত দেখানো ছাড়াই আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর কথার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। বর্ণনাকারীগণ সাক্ষীদের যে সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন তা একেক জনের বর্ণনা একেক রকম , কোন কোন বর্ণনা মতে 5 অথবা 6 জন67 অন্য এক বর্ণনায় 9 জন68 আর এক বর্ণনায় 12 জন69 অপর এক বর্ণনায় 12 জন বদরী সাহাবী70 অন্য এক বর্ণনায় 13 জন71 অপর এক বর্ণনায় 16 জন72 এক বর্ণনায় 18 জন73 এক বর্ণনায় 30 জন74 এক বর্ণনায় একদল লোক75 এক বর্ণনায় 10 জনেরও বেশী76 এক বর্ণনায় কিছু সংখ্যক77 এক বর্ণনায় কয়েক দল লোক78 এবং এক বর্ণনায় 17 জন79 ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে , গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা বা নেতা এই আলীও তাদের মাওলা বা নেতা

অনুরূপভাবে আহলে বাইত (নবীর পরিবার) ও তাদের সাথীগণ এবং অনুসারীগণও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। মরহুম আল্লামা আমিনী এ ধরনের 22টি প্রমাণ উপস্থাপনের ঘটনা তুলে ধরেছেন , সেগুলি থেকে এখানে আমরা কয়েকটির উল্লেখ করছি।

1. উম্মুল আয়েম্মা (ইমামগণের মাতা) , ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

আপনারা কি ভুলে গেছেন যে , রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক80

2. ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেছেন

যখন হাসান মুজতবা (আ.) মোয়াবিয়া র সাথে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন , তখন একটি বক্তব্য রেখে ছিলেন। উক্ত বক্তব্যের কিছু অংশ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছঃ

এই উম্মত আমার পিতামহ রাসূল (সা.) হতে শুনেছে যে , তিনি বলেছেনঃ প্রত্যেক জাতিই যেন তাদের নিজেদের মধ্য হতে সেই ব্যক্তিকেই তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করে , যে হবে তাদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী ও সর্বোত্তম। তারা ক্রমাগত অধপতিত হবে যদি না তারা তাদের মাঝে যে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি , তাকে প্রাধান্য দেয়। তারা আরো শুনেছে যে , তিনি (সা.) আমার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক ঐরূপ যেমন মূসার (আ.) সাথে হারুনের (আ.) সম্পর্ক ছিল ; পার্থক্য শুধু এতটুকু যে , (মুসা ও হারুন উভয় নবী ছিল কিন্ত) আমার পরে আর কোন নবী নাই। আরো শুনেছে যে , গাদীরে খুমে আমার পিতার হাত ধরে তিনি (সা.) বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক , এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। সে সময় উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন যেন তারা অনুপস্থিতদের কাছে এই খবরটি পৌছে দেয়।81

3. হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সিফফিনের যুদ্ধে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) যখন আমর ইবনে আস-এর মুখোমুখি হলেন , তখন তিনি বলেছিলেনঃ

আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে , আমি যেন নাকিসীন দের (চুক্তি ভঙ্গকারীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি , আর আমি তার নির্দেশানুযায়ী তা করেছি। তিনি আরো বলেছেনঃ তুমি কাসিতীন দের (বিদ্রোহীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে , আর তোমরাই হলে রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত সেই বিদ্রোহী তাই তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব এবং জানিনা মারিকীন দের (দ্বীন ত্যাগীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধেও সফল হব কি-না। এই নির্বংশ! তুমি কি জাননা রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه اللهم وال من والاه و عاد من عاداه ؟

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! আলীকে যারা ভালবাসে তুমি তাদেরকে ভালবাস আর আলীর সাথে যারা শত্রুতা করে তুমিও তাদের সাথে শত্রুতা কর। আমার অভিভাবক আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) অতঃপর আলী। কিন্ত তোমার তো কোন মাওলা বা অভিভাবকই নেই।

আমর ইবনে আস উত্তরে বললঃ এই আবা ইয়াকজান! কেন আমাকে ভৎসনা করছো আমি তো তোমাকে ভৎসনা করিনি।82

4. আসবাগ ইবনে নাবাতা গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সিফফিনের যুদ্ধে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) একটি পত্র লিখেছিলেন এবং আসবাগ ইবনে নাবাতা কে দায়িত্বভার দিয়ে বলেছিলেন যেন পত্রটি মোয়াবিয়ার নিকট পৌছে দেয়। আসবাগ যখন মোয়াবিয়ার দরবারে উপস্থিত হল দেখল সৈনিকের এক বিশাল দল বিশেষ করে রাসূল (সা.)-এর দুইজন সাহাবী আবু হোরায়রা ও আবু দারদা সেখানে উপস্থিত আছে। আসবাগ বর্ণনা করেছেন যে , মোয়াবিয়া পত্রটি পাঠ করার পর বললঃ আলী কেন উসমানের হত্যাকারীদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে না । আমি বললামঃ এই মোয়াবিয়া! উসমানের রক্তের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ো না ; তুমি আসলে ক্ষমতার ও শক্তির প্রত্যাশী। তুমি যদি উসমানকে সাহায্যই করতে চাইতে তাহলে তার জীবদ্দশায়ই তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তুমি যেহেতু তার রক্তকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে তাই এতটাই বিলম্ব করেছিলে যাতে সে নিহত হয় । এই কথা শুনার পর মোয়াবিয়ার যেন টনক নড়ে গেল। আর আমিও যেহেতু চাচ্ছিলাম যে একটু বেশী উত্তেজিত হউক , সে কারণেই আবু হোরায়রাকেও আবার জিজ্ঞেস করলামঃ এই রাসূল (সা.)-এর সাহাবী! তোমাকে এক আল্লাহর , যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জ্ঞানের অধিকারী এবং তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদের (সা.) কসম দিচ্ছি- তুমি কি গাদীর দিবসে সেখানে উপস্থিত ছিলে না ?

সে বললঃ হা , আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম

বললামঃ ঐ দিন আলী সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে কি শুনেছিলে ? বললঃ আমি শুনেছিলাম তিনি বলেছিলেন যে আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে , তুমি তার সাথে শত্রুতা কর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে , তাকে তুমি ত্যাগ কর যে আলীকে ত্যাগ করে

বললামঃ এই আবু হোরায়রা! তাহলে কেন তুমি তার শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব আর তার বন্ধু্দের সাথে শত্রুতা করছো ?

আবু হোরায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললঃ উন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন83 অর্থাৎ আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং তার নিকট প্রত্যাবর্তনন করবো।

এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে , বিখ্যাত ব্যক্তিগণ , যারা এই হাদীসের সাথে যথার্থ আমল না করে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর বিরোধিতা করতো , তাদের নিকট সাধারণ জনগন গাদীরের এই হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করতেন ; তার মধ্যে একটি হচ্ছেঃ

5. দারামী র এক মহিলার প্রমাণ স্বরূপ উত্থাপিত গাদীরের হাদীস

সে ছিল দারামের অধিবাসী আলী (আ.)-এর অনুসারীদের মধ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যে মদীনার হুজুন এলাকায় বসবাস করতো। আর সে কারণেই তাকে দারামীয়া হুজনীয়া বলা হত। তার এই উপনামের প্রসিদ্ধতার কারণে তার প্রকৃত নাম ইতিহাসে উল্লেখ হয়নি। হজ্জের সময় মোয়াবিয়া তাকে ডেকে বললঃ তুমি কি জান কেন তোমাকে ডেকেছি ?

বললঃ সুবহানাল্লাহ! (আল্লাহ মহা পবিত্র) আমি অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী নই (অদৃশ্যের বিষয়ে কিছু জানিনা)

বললঃ আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম যে , তুমি কেন আলীকে ভালবাস আর আমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ কর ? তার শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছ অথচ আমার সাথে শত্রুতা কর ?

বললঃ যদি সম্ভব হয় আমাকে এরূপ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষমা কর (বাধ্য কর না)

বললঃ না , তোমাকে ক্ষমা করবো না। (তোমাকে বলতেই হবে)

বললঃ এ রকমই যখন তাহলে শোন! আলীকে ভালবাসি কারণ , তিনি দেশের নাগরিকদের সাথে ন্যায় সঙ্গত আচরণ করতেন ও বাইতুল মাল (সরকারী সম্পদ) সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করতেন। তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করি কারণ , যে ব্যক্তি খেলাফতের ক্ষেত্রে তোমার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত ছিল তুমি তার সাথে যুদ্ধ করেছ ও যেটা তোমার অধিকার নয় , সেটা দাবী করেছ। আলীর শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছি কারণ , আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন এবং তিনি ছিলেন গরীব-দুঃখীদের বন্ধু ও দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানকারী। আর তোমার সাথে শত্রুতা করি কারণ , তুমি মানুষের রক্ত ঝরিয়েছ ও বিবাদ সৃষ্টি করেছ , বিচারকার্যে অন্যায় করেছ এবং নাফসের চাহিদা মোতাবেক হুকুম প্রদান করেছ।84

6. এক অজ্ঞাত যুবক গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন

আবু হোরায়রা কুফার মসজিদে প্রবেশ করল। আর প্রবেশ করার সাথে সাথে জনগণ তার চারিপাশে ঘিরে বসলো এবং সবাই তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো। এমন সময় এক যুবক দাড়িয়ে বললঃ তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি! তুমি কি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছ যে , তিনি বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ তাকে তুমি ভালবাস যে তাকে ভালবাসে ও তার সাথে শত্রুতা কর যে তার সাথে শত্রুতা করে ?

আবু হোরায়রা বললঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আমি স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে ঠিক এভাবেই শুনেছি। 85

অনুরূপভাবে ইসলামের ইতিহাসেও দেখা যায় যে , যারা আলী (আ.)- এর বিপরীতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছিল তারা আলী (আ.)-এর সাথে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও গাদীরের হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতেন। যেমনঃ

7. আমর ইবনে আস গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সকলেরই জানে যে , আমর ইবনে আস , আলীর একজন ঘোর শত্রু ছিল , সে- ই মোয়াবিয়াকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বুদ্ধি দিয়েছিল এবং আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইন্ধন যুগিয়েছিল । স্বীয় চক্রান্তের মাধ্যমে তাকে নির্ঘাত পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ও বিচারের বিষয়টি উত্থাপন করে শামের (সিরিয়ার) সৈন্যদেরকে শক্তি যুগিয়েছিল এবং কুফার সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। আর সেখানেই খারিজীদের (দ্বীন ত্যাগীদের) বীজ বপিত হয়েছিল আর তার এসব সহযোগিতার কারণেই সে মোয়াবিয়ার নিকট থেকে পুরস্কার স্বরূপ মিশরের শাসনভার পেয়েছিল।

মোয়াবিয়া তার হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করার পূর্বে তার নিকট সাহায্য কামনা করে একটি পত্র লিখেছিল। তাতে লিখেছিলঃ আলী ছিল উসমান হত্যার কারণ , আর আমি হলাম উসমানের খলিফা

আমর তার প্রত্যুত্তরে লিখেছিলঃ

তোমার পত্রটি পাঠ করলাম ও বুঝলাম। তবে তুমি চাচ্ছ যে , আমি দ্বীন ত্যাগ করে তোমার সাথে পথভ্রষ্টতার উপত্যকায় প্রবেশ করি ও তোমাকে তোমার ঐ ভ্রান্ত পথে সাহায্য করি এবং আমিরুল মু মিনীন আলীর বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করি। কিন্তু তিনি হচ্ছেন রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা , অভিভাবক , প্রতিনিধি ও ওয়ারিশ। তিনি রাসূল (সা.)-এর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর তার অঙ্গীকারগুলো রক্ষা করেছেন। তিনি তার জামাতা , বিশ্বের নারীদের নেত্রীর স্বামী , বেহেশতেরর যুবকদের সরদার হাসান ও হোসাইনের পিতা। এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারলাম না।

কিন্তু তুমি যে দাবি করেছ উসমানের প্রতিনিধি আর উসমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তুমি হয়েছ পদচ্যুত আর তোমার খেলাফত হয়েছে নিশ্চিহ্ন ও আরো বলেছঃ আমিরুল মু মিনীন আলী , উসমানকে হত্যার জন্য সাহাবীদেরকে উস্কানি দিয়েছে , এটা মিথ্যা ও অপবাদ। তোমার জন্য দুঃখ হয় এই মোয়াবিয়া! তুমি কি জান না আবুল হাসান (আলী) আল্লাহর পথে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে দিয়েছিল ও রাসূল (সা.)-এর বিছানায় ঘুমিয়েছিল এবং রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।86

8. উমর ইবনে আব্দল আজিজ গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন

ইয়াজিদ ইবনে উমর নামক একজন বলেছেনঃ আমি শামে (সিরিয়াতে) ছিলাম , উমর ইবনে আব্দুল আজিজ কিছু সম্পদ বন্টন করছিল , আমিও আমার অংশ নেওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম , যখন আমার পালা আসল , বললঃ তুমি কোন্ বংশের ? আমি বললামঃ কোরাঈশ বংশের। বললঃ কোন্ গোষ্ঠীর ? বললামঃ বনী-হাশিম গোষ্ঠীর। বললঃ কোন্ পরিবারের ? বললামঃ আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। বললঃ কোন্ আলীর ? আমি উত্তর দিই নি। তখন উমর ইবনে আব্দুল আজিজ তার বুকে হাত রেখে বললঃ আল্লাহর কসম! আমিও আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। একদল লোক আমাকে বলেছে যে , রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।

তখন সে তার সহকারীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললঃ এ রকম লোককে তুমি কি পরিমাণ দিয়ে থাক ? বললঃ একশ থেকে দুইশ দিরহাম। বললেনঃ তাকে তুমি 50 দিনার দাও।87 কারণ , সে হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতে বিশ্বাসী তথা তার অনুসারী। আমাকে বললঃ তুমি তোমার শহরে ফিরে যাও , তোমার প্রাপ্য তুমি সেখানেই পাবে।88

9. আব্বাসীয় খলিফা মামুনও গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

প্রসঙ্গক্রমে মামুন ও বিচারপতি ইসহাক ইবনে ইব্রাহিমের মাঝে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মর্যাদা নিয়ে সে যুগে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল , তখন মামুন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ তুমি কি শাসন কর্তৃত্বের (বেলায়াতের) হাদীসটি বর্ণনা কর ? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ করি। মামুন বললঃ হাদীসটা পাঠ কর। ইয়াহহিয়া হাদীসটি পাঠ করল।

মামুন জিজ্ঞেস করলঃ তোমার দৃষ্টিতে এই হাদীসটি কি আবু বকর ও উমরের উপর আলীর প্রতি কোন দায়িত্ব অর্পন করে ? না-কি করে না ?

ইসহাক বললঃ বলা হয় যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি ঐ সময় বলেছিলেন যখন আলী ও যাইদ ইবনে হারিসের মধ্যে এক মতপার্থক্যকে দেখা দিয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর সাথে আলীর আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা যাইদ অস্বীকার করেছিল ; আর এই কারণেই রাসূল (সা.) বলেছিলেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা...। মামুন বললঃ এই হাদীসটি কি রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বলেন নি ?

ইসহাক বললঃ হ্যাঁ ।

মামুন বললঃ যাইদ ইবনে হারিসা গাদীরের পূর্বেই শহীদ হয়েছিলেন। তুমি কিভাবে এটা মেনে নিলে যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি তার কারণেই বলেছেন ? আমাকে বল যদি তোমার পনের বছরের ছেলে মানুষকে বলে যে , হে জনগণ! আপনারা জেনে নিন যে , যাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে , আমার চাচাতো ভাই-এর সাথেও তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তুমি কি তাকে বলবে না যে , যে বিষয়টা সবার জানা ও কারো কাছে যেটা অস্পষ্ট নয় , কেন তুমি সেই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করছো ?

বললঃ কেন , অবশ্যই তাকে বলবো।

মামুন বললঃ এই ইসহাক! যে বিষয়টি তুমি তোমার পনের বছরের ছেলের ক্ষেত্রে মেনে নিচ্ছ না , তাহলে কিভাবে ঐ একই বিষয় রাসূল (সা.)- এর ক্ষেত্রে মেনে নিলে ? আক্ষেপ হয় তোমাদের উপর , কেন তোমরা তোমাদের ফকীহদের (ফিকাহবিদদের) পূজারী বা ইবাদত কর ?89

যেমনভাবে পরিলক্ষিত হল তাতে সকল আলোচনাই ছিল হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত সম্পর্কে কথোপকথোনের কেন্দ্র বিন্দু। প্রমাণ উপস্থাপনকারীগণ এই হাদীস দ্বারা , আলী (আ.)-এর খেলাফতকে প্রমাণ করেছেন। আর বক্তাগণও কখনো বলেননি যে , এই হাদীসে মাওলা শব্দটি নেতা বা অভিভাবক ব্যতীত অন্যকিছু। যদি উক্ত হাদীসে আলী (আ.)-এর নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য কোন অর্থ থাকতো , তাহলে আবু হোরায়রা এভাবে বিনীত হয়ে জনাব আসবাগ ইবনে নাবাতার সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো না ও লজ্জিত হত না এবং আমর ইবনে আস , আম্মারের কাছে নিরুপায় হয়ে আত্ম সমর্পন করতো না।

সুতরাং যদি কেউ যে কোন অভিসন্ধির কারণে গাদীরের হাদীসের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে তাহলে সে শুধু সত্যকেই গোপন করেনি বরং রাসূল (সা.)-এর হাদীসকেও বিকৃত করেছে এবং আব্বাসীয় খলিফা মামুনের ভাষায় অর্থ বিকৃতকারীরা রাসূল (সা.)-এর উপর এমন কিছু আরোপ করেছে যা এক পনের বছরের ছেলের উপরও আরোপ করা যায় না।

দ্বিতীয় অধ্যায়


5

6

7

8

9

10

11

12

13