ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
জ্ঞানতত্ত্ব
( Epistemology -علم المعرفة/ نظرة المعرفة/ شناخت شناسی
)হচ্ছে এমন একটি মানবিক বিজ্ঞান যা স্বয়ং
‘
জ্ঞান
’
নিয়ে চর্চা করে। অর্থাৎ জ্ঞান বলতে কী বুঝায়
,
জ্ঞানের বিভিন্ন প্রকরণ
,
জ্ঞানের উৎসসমূহ
,
জ্ঞান আহরণের মাধ্যমসমূহ ও তার নির্ভরযোগ্যতা যাচাই
,
সঠিক জ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ ও তা দূরীকরণের পন্থা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে , ইসলামের সাথে জ্ঞানতত্ত্বের সম্পর্ক কী ?
ইসলাম হচ্ছে জ্ঞানের ধর্ম ; বরং একমাত্র ইসলামই জ্ঞানের ধর্ম। কোরআন মজীদের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে:اِقراء
-‘
পড়ো।’
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলা মানুষের কাছ থেকে সর্বপ্রথম যা দাবী করলেন তা হচ্ছে , মানুষ পড়বে - জ্ঞান অর্জন করবে। কিন্তু এ জ্ঞান হতে হবে নির্ভুল জ্ঞান। কারণ , জ্ঞানে যদি বড় ধরনের ভুল থাকে তাহলে সে জ্ঞান অজ্ঞতা বা অজ্ঞানতার চেয়েও অধিকতর অবাঞ্ছিত এবং সে জ্ঞান কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী নিয়ে আসে।
বস্তুতঃ ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞান মানুষকে এমনভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারে যে , তার পক্ষে আর সুপথে ফিরে আসার সুযোগ ও সম্ভাবনা লাভের পথ খোলা না-ও থাকতে পারে। এ বিষয়টি কোরআন মজীদেও সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:
)
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلا تَذَكَّرُونَ(
.
“
(হে রাসূল!) তাহলে আপনি কি তাকে দেখেছেন যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে স্বীয় ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ্ জ্ঞানের ওপরে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন , আর তার (অন্তরের) শ্রবণশক্তি ও ক্বলবের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন , আর তার (অন্তরের) দর্শনশক্তির ওপর আবরণ তৈরী করে দিয়েছেন ? অতঃপর আল্লাহর পরে আর কে তাকে পথ দেখাবে ? অতঃপর তোমরা কি (এ থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করবে না ?’
(সূরাহ্ আল্-জাছিয়াহ্: 23)
এভাবে জ্ঞান যাদের পথভ্রষ্টতার কারণ তাদের কতকের পরিচয় আল্লাহ্ তা‘
আলা পরবর্তী আয়াতেই পেশ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
)
وَقَالُوا مَا هِيَ إِلا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا يَظُنُّونَ(
“
আর তারা বলে: আমাদের এ পার্থিব জীবন ছাড়া আর কী আছে ? আমরা মৃত্যুবরণ করি , আর জীবিত থাকি এবং মহাকাল ব্যতীত কোনো কিছু আমাদেরকে ধ্বংস করে না। (আসলে এ ব্যাপারে) তাদের (প্রকৃত) জ্ঞান নেই ; তারা তো কেবল ধারণা-বিশ্বাস পোষণ করে মাত্র।”
(সূরাহ্ আল্-জাছিয়াহ্: 24)
এ যুগেও অনেক তথাকথিত জ্ঞানী ও দার্শনিক এ ধরনের মত পোষণ করেন। বলা বাহুল্য যে , তাঁদের এ সব মতামত অকাট্য জ্ঞান ভিত্তিক নয় , বরং এগুলো তাঁদের ধারণা বা বিশ্বাস মাত্র। অতএব , কোনো জ্ঞান নির্ভুল ও অকাট্য কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। জ্ঞানতত্ত্ব এ প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করে থাকে।
অবশ্য কেউ হয়তো বলতে পারেন যে , নির্ভুল জ্ঞান ও পথনির্দেশের জন্য আল্লাহ্ তা‘
আলার কিতাব কোরআন মজীদের দ্বারস্থ হওয়াই যথেষ্ট , অতঃপর আর জ্ঞানতত্ত্বের সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
তিনটি কারণে এ যুক্তি অর্থাৎ জ্ঞানতত্ত্বের মুখাপেক্ষিতা প্রয়োজন না হওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।প্রথমতঃ
জন্মসূত্রে যারা মুসলমান আল্লাহ্ তা
‘
আলা কোরআন মজীদকে কেবল তাদের হেদায়াতের জন্যই নাযিল করেন নি। (বস্তুতঃ যখন কোরআন মজীদ নাযিল শুরু হয় তখন এবং তার পরেও বহু বছর যাবত কোনো জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলো না।) বরং সমস্ত মানুষের সামনে উপস্থাপন ও গ্রহণের জন্য তাদের প্রতি আহবান জানানোর লক্ষ্যেই কোরআন মজীদ নাযিল করা হয়েছে। অতএব , যাদের সামনে কোরআন মজীদের দাও‘
আত পেশ করা হবে তাদের ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞানের ভ্রান্তি ও ত্রুটি চিহ্নিত ও খণ্ডন করার যোগ্যতা অর্জন করা মুসলমানদের জন্য , বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী জ্ঞানগবেষকদের জন্য অপরিহার্য।
দ্বিতীয়তঃ
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দার্শনিকতার নামে এমন বহু বিভ্রান্তিকর ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে যার মুখোমুখি হলে খুব কম লোকের পক্ষেই তুখোড় অপযুক্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে সে সবের ভ্রান্তি বুঝতে পারা সম্ভব হয়। ফলে অনেকে , এমনকি কোরআন মজীদকে একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরেছিলো এমন অনেক লোকও পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। এভাবে অনেকের ঈমান হুমকির সম্মুখীন হয়।
তৃতীয়তঃ
কোরআন মজীদের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বহু বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা যায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে এ মতপার্থক্য অত্যন্ত গুরুতর হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ , নবী-রাসূলগণ (আঃ)-এর পক্ষে পাপকাজ সম্পাদন করা সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে এবং এ মতপার্থক্যের উৎস কোরআন মজীদের এতদসংশ্লিষ্ট আয়াত সমূহের তাৎপর্য গ্রহণে মতপার্থক্য। আর শোষোক্ত ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের জন্য যে সব কারণ দায়ী তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্ঞানের সঠিক সংজ্ঞা এবং সঠিক জ্ঞান ও ভুল জ্ঞান চিহ্নিত করার মানদণ্ডের সাথে অনেকেরই পরিচয় না থাকা। এ পরিচয় অর্জনে সহায়তা করাই জ্ঞানতত্ত্বের কাজ।
শুধু ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণই নন
,
যে কোনো শাস্ত্রের জ্ঞানচর্চাকারীদের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি (
مقدمات
) হিসেবে মানবিক বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখার সাথে ভালোভাবে পরিচয় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। সেগুলো হচ্ছে : যুক্তিবিজ্ঞান
,
জ্ঞানতত্ত্ব
,
দর্শন ও তাৎপর্যবিজ্ঞান এবং সেই সাথে যে ভাষার তথ্যসূত্রাদি ব্যবহার করা হবে (উৎস ভাষা -
source language-
زبان مبدء
)
ও যে ভাষায় লেখা হবে (লক্ষ্য ভাষা -
target language-
زبان مقصد
)
এবং তার ওপরে ব্যাকরণের ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান সহ দক্ষতা।
বক্ষ্যমাণ পুস্তকটি মূলতঃ জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে অত্যন্ত সংক্ষেপে কিছুটা ধারণা দেয়ার লক্ষ্য একটি ছোট বৈঠকের জন্য প্রবন্ধ আকারে লেখা হয়েছিলো। পরে এটি অধিকতর সংক্ষিপ্ত আকারে সাপ্তাহিক রোববার-এ প্রকাশিত হয়েছিলো। এরপর কয়েক বছর আগে (2010-এর শেষার্ধে) একটি লেখক-সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কোর্সের ক্লাস নিতে গিয়ে সেখানকার শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা দিতে গিয়ে অনেক দিন আগেকার এ প্রবন্ধটি খুঁজে বের করি এবং কম্পিউটারে কম্পোজ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেই। কম্পোজ করতে গিয়ে এটিকে কিছুটা পরিমার্জন ও সামান্য সম্প্রসারণ করেছি।
জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে যথেষ্ট জানার আছে এবং লেখক , সাংবাদিক ও জ্ঞানগবেষকদের জন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। এ পুস্তকে এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা দেয়া হয়েছে মাত্র। আশা করি এ পুস্তক পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে অধিকতর অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আর তাহলেই অত্র পুস্তকের সফলতা।
গ্রন্থটি থেকে যদি পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যকার একজনও উপকৃত হন তাহলেই লেখকের পরিশ্রম সার্থক হবে। যদিও জ্ঞানতত্ত্বের সাথে পরিচিতি সকল ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষকের জন্যই অপরিহার্য , তবে ইসলামী জ্ঞানচর্চাকারীদের জন্য অনেক বেশী অপরিহার্য এবং কেবল এ কারণেই অত্র বিষয়ে লিখতে উদ্যোগী হই। তাই আল্লাহ্ তা‘
আলার কাছে প্রার্থনা , তিনি অত্র গ্রন্থ থেকে এর সকল পাঠক-পাঠিকাকে উপকৃত হবার তাওফীক্ব দিন এবং এটিকে এর লেখক , পাঠক-পাঠিকা এবং প্রচার-প্রসারে সহায়তাকারী সকলের পরকালীন নাজাতের জন্য সহায়ক হিসেবে কবূল্ করে নিন।
বিনীত
নূর হোসেন মজিদী