বিচারবুদ্ধিজাত জ্ঞান
বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্) হচ্ছে মানুষের বস্তুগত শরীরকে আশ্রয় করে অবস্থানরত একটি অবস্তুগত শক্তি। বিচারবুদ্ধি হচ্ছে স্বয়ং জ্ঞানের উৎস , অন্যান্য তথ্য-আহরণ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির পর্যালোচনা ও সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী তথা জ্ঞানের উৎপাদনকারী এবং তথ্য-আহরণ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভুলত্রুটি নির্ণয়কারী।
বিচারবুদ্ধি স্বীয় অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী ; এজন্য সে অন্য কোনো তথ্য-আহরণ মাধ্যমের দ্বারস্থ নয়। বিচারবুদ্ধি জ্ঞানের অস্তিত্বও অবগত - যা কোনো বস্তুগত বিষয় নয়। বিচারবুদ্ধি এমন অনেক অকাট্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তথ্যাদি অবগত হতে পারে যা ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে। যেমন: বিচারবুদ্ধি এ বিশ্বজগতের অস্তিত্বের পিছনে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা করতে ও প্রত্যয়ে উপনীত হতে সক্ষম যদিও কোনো ইন্দ্রিয়েই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রতিফলিত হয় না (অর্থাৎ ব্যক্তি চোখ দ্বারা স্রষ্টাকে দেখে নি , কান দ্বারা স্রষ্টার কথা শোনে নি , হাত দ্বারা তাঁকে স্পর্শ করে নি , ...)। তেমনি বিচারবুদ্ধি কোনো বস্তুর সাহায্য ছাড়াই সংখ্যার ধারণা করতে পারে , একমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক অস্তিত্ব (যা অবস্তুগত) সম্বন্ধে এবং অবস্তুগত ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব সম্বন্ধেও ধারণা করতে পারে। সে কল্পনা করতে পারে এবং কল্পনায় অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি সে বস্তুগত সৃষ্টিতে রূপান্তর সাধনের পরিকল্পনা করতে পারে অর্থাৎ বাস্তবে রূপান্তর সাধনের পূর্বে সে কল্পনায় রূপান্তর সাধনের কাজ করে থাকে। আর এ সবের কোনোটিই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান নয় যদিও এসব ক্ষেত্রে সে ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি থেকে সাহায্য নিয়ে থাকতে পারে।
অতএব , বিচারবুদ্ধি হচ্ছে একটি স্বাধীন জ্ঞানমাধ্যম ও জ্ঞান-উৎস।
অনেকে (বস্তুবাদীরা) বিচারবুদ্ধির অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করে এবং দাবী করে যে , যে সব কাজকে বিচারবুদ্ধির কাজ বলে দাবী করা হয় তা আসলে মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মাত্র। কিন্তু তাদের এ দাবী এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মস্তিষ্কের জ্ঞানকোষগুলো বস্তুগত উপাদানে তৈরী এবং তা প্রাপ্ত তথ্যাদি সঞ্চয় করে মাত্র ; এসব তথ্যের পর্যালোচনা , সমন্বয় সাধন , সংশোধন ও তা থেকে নতুন তথ্যে তথা উপসংহারে উপনীত হওয়ার জন্য অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র হস্তক্ষেপকারী উপাদান অপরিহার্য। আর বস্তুজগতের বাইরের বিষয়ে তো নিজে নিজেই মস্তিষ্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ , এরূপ ক্ষেত্রে কোনোরূপ ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যের প্রভাব থাকে না। অতএব , এ ক্ষেত্রে একটি অবস্তুগত শক্তির প্রভাব বা হস্তক্ষেপ অপরিহার্য ; তা-ই হচ্ছে বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)।
তাছাড়া বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একমুখী অর্থাৎ‘
হ্যা’
বা‘
না’
হয়ে থাকে এবং প্রতিক্রিয়াটি টিকে থাকে বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা সন্দেহ-সংশয়ের বা বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় অনেক বিষয়েই উপসংহার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হই ; এ ধরনের অবস্থা বিচারবুদ্ধির অস্তিত্বই প্রমাণ করে।
এছাড়া সৌন্দর্যচেতনা , শিল্পকলা , সাহিত্য ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপেই বিচারবুদ্ধি ও অন্যান্য অবস্তুগত অভ্যন্তরীণ শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ , একটি ছোটগল্প রচনা , গল্পটির সংক্ষেপণের প্রয়োজন অনুভব করা ও সংক্ষেপণের কাজ আঞ্জাম দেয়া ইন্দ্রিয়নিচয়ের কাজ নয় , বিচারবুদ্ধির কাজ।
যাই হোক , মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধি এক অবস্তুগত অভ্যন্তরীণ শক্তি। অবশ্য তার প্রধান কর্মক্ষেত্র মস্তিষ্ক। তবে বিচারবুদ্ধিকে মস্তিষ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা ঠিক হবে না।
বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে , তা অন্যান্য তথ্যসংগ্রহ মাধ্যম কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সে সবের ভুল নির্ণয় ও নিরসন করতে পারে। বিচারবুদ্ধি বুঝতে পারে , চোখ সূর্যকে ছোট দেখলেও আসলে সূর্য অত ছোট নয় ; একই পানি দুই হাতে গরম ও ঠাণ্ডা অনুভূত হলেও আসলে ঐ পানির তাপমাত্রা একটিই , দু’
টি নয় , বরং দুই হাত ইতিপূর্বে দুই ধরনের তাপমাত্রায় ছিলো বলেই এরূপ অনুভব করছে ; গত রাতের জীবন বাস্তব বা বস্তুগত জগতের অভিজ্ঞতা ছিলো , কিন্তু গত রাতের স্বপ্ন বস্তুগত জগতের অভিজ্ঞতা ছিলো না , যদিও দু’
টি অভিজ্ঞতার একটিও এখন বর্তমান নেই ; ....।
অবশ্য বিচারবুদ্ধিও ভুল করতে পারে এবং ভুল উপসংহারে উপনীত হতে পারে। তবে বিচারবুদ্ধি পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে স্বীয় ভুল চিহ্নিত করে তা সংশোধন করতে পারে। কিন্তু ইান্দ্রিয়নিচয়ের সে ক্ষমতা নেই। যেমন: কোনো যান্ত্রিক উপকরণের সাহায্য গ্রহণ ছাড়াই খোলা চোখ একই জায়গা থেকে সূর্যকে লক্ষ বার দেখলেও ছোটই দেখতে পাবে।