জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম28%

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 9311 / ডাউনলোড: 3470
সাইজ সাইজ সাইজ
জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে যথেষ্ট জানার আছে এবং লেখক , সাংবাদিক ও জ্ঞানগবেষকদের জন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। এ পুস্তকে এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা দেয়া হয়েছে মাত্র। আশা করি এ পুস্তক পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে অধিকতর অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আর তাহলেই অত্র পুস্তকের সফলতা।

অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান

মানুষের মধ্যে আরেকটি জ্ঞানমাধ্যম রয়েছে , তা হচ্ছে তার অন্তঃকরণ (قلب ) । এর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে অন্তঃকরণজাত বা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান (علم قلبی ) বলা যেতে পারে । বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যে পার্থক্য এখানে যে , বিচারবুদ্ধি প্রত্যক্ষ (ইন্দ্রিয়বহির্ভূত) অভিজ্ঞতা থেকে (যেমন: স্বীয় অস্তিত্ব সম্বন্ধে) অথবা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানে উপনীত হয় , কিন্তু অন্তঃকরণের জ্ঞান এমন যা এরূপ কার্যকারণ ছাড়াই অন্তঃকরণে উদ্ভূত হয়। যেমন: যথাযথ চিন্তাগবেষণা ছাড়াই কারো মনে কোনো প্রশ্নের জবাব বা কোনো সমস্যার সমাধান ভেসে উঠলো । তেমনি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ব ধারণা ছাড়াই তাকে প্রথম বারের মতো দেখা মাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জেগে উঠতে পারে এবং পরে তা যথার্থ বলে প্রমাণিত হতে পারে। অবশ্য ইন্দ্রিয়লব্ধ পূর্বাহ্নিক তথ্য বা বিচারবুদ্ধির প্রভাবেও এ ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে , তবে এ সবের প্রভাব ছাড়াও , দৃশ্যতঃ কোনো কারণ ছাড়াও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্ত ধরনের অনুভূতি অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান , যদিও প্রথমোক্ত ও দ্বিতীয়োক্ত উভয় ধরনের জ্ঞানেরই শারীরিক প্রতিক্রিয়ার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে হৃদপিণ্ড।

কারো প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জাগ্রত হওয়ার বিষয়টি সহজাত প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসেবে একে সহজাত জ্ঞান বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে সহজাত জ্ঞান থেকে পার্থক্য এই যে , মানুষের মূল অনুভূতিগুলো সহজাত , কিন্তু তার প্রয়োগক্ষেত্র তথা কা রা এগুলোর উপযুক্ত সে সংক্রান্ত জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্যাদি বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে থাকে এবং কেবল এর পরেই ঐ সব অনুভূতি সে সব পাত্রের দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু তা যদি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্য ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই , দৃশ্যতঃ বিনা কারণেই ঘটে , যেমন: একজন লোককে প্রথম বারের মতো দেখেই মনে হলো লোকটি বিপজ্জনক , তাহলে তা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান।

বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যকার পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের একটি দিক হেচ্ছ এই যে , বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের উদয় , বিচারবিশ্লেষণ ও উপসংহার যেখানে মস্তিষ্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেখানে অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান অন্তঃকরণ থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয় , যদিও পরে বিচারবুদ্ধি সে সব নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে পারে এবং সে সবকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন , তা হচ্ছে , অনেকে শরীরের হৃদপিণ্ডকেই ক্বালব্ বলে মনে করেন। যদিও আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ডকেও ক্বালব্ বলা হয় , কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় (ক্বালব্) কোনো বস্তুগত অঙ্গ নয় , যদিও উভয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। অনেক ভাষায়ই যেমন এক শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় , আরবী ভাষায়ও তদ্রূপ ব্যবহারের প্রচলন আছে। আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ড এবং অন্তঃকরণ বা হৃদয় উভয় অর্থেই ক্বালব্ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে অন্তঃকরণ বা হৃদয়ের অনুভূতি হৃদপিণ্ডে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে বিধায় অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এ উভয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় হচ্ছে মানবসত্তায় নিহিত একটি অবস্তুগত জ্ঞানকেন্দ্র , আর হৃদপিণ্ডের মূল কাজ হচ্ছে রক্ত পরিশোধন ও সঞ্চালন।

যা-ই হোক , ক্বালব্ -এর জ্ঞান দুই ধরনের। ইতিপূর্বে যেমন ইঙ্গিত করা হয়েছে , এর এক ধরনের জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বিচারবুদ্ধির আওতাধীন জগতের সাথে যোগসূত্র থাকে। অর্থাৎ এ দুই জগতের কোনো তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়ে তা বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই অন্তরে স্থানান্তরিত হতে এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্তরে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে যা পরে সেখান থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়। যেমন: একজন মানুষকে দেখামাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভয় বা ঘৃণা জাগ্রত হতে পারে যদিও দৃশ্যতঃ তার মধ্যে তাকে ভয় বা ঘৃণা করার মতো কোনো কারণ দেখা যায় না এবং বিচারবুদ্ধি তাকে ভয় বা ঘৃণা করার সপক্ষে রায় দেয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি ও বিচারবুদ্ধির ফয়সালার বিপরীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও তার ভিত্তিতে কোনো কাজ করে বা কোনো কাজ পরিহার করে কেবল এ কারণে যে , মন বলছে , এ কাজটি করা উচিত অথবা করা উচিত নয়।

ক্ষেত্রবিশেষে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত বিষয় এমন হতে পারে যে , সে ব্যাপারে সঠিক ফয়সালায় উপনীত হবার পথে স্থানগত , কালগত , পরিবেশগত বা পরিস্থিতিগত বাধা থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ক্বালব্ ব্যক্তিকে পথপ্রদর্শন করতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তির পক্ষে অভিজ্ঞতা হাসিল , গবেষণা ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই কেবল অন্তরের অনুভূতির ভিত্তিতে কোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হতে পারে।

মানুষের শরীরের বস্তুগত অঙ্গ হৃদপিণ্ড ছাড়াও যে তার মধ্যে অন্তঃকরণ বা হৃদয় নামক একটি অবস্তুগত শক্তি রয়েছে কোরআন মজীদের আয়াত থেকে তার সন্ধান পাওয়া যায়। আল্লাহ্ তা আলা অতীতের বহু শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর এরশাদ করেছেন:

) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْب(

নিঃসন্দেহে এতে তার জন্য উপদেশ রয়েছে যে ব্যক্তি ক্বালব্-এর অধিকারী। (সূরাহ্ ক্বাফ্: ৩৭)

বলা বাহুল্য যে , এখানে শরীরের বস্তুগত হৃদপিণ্ডের কথা বলা হয় নি , কারণ , তা প্রত্যেকেরই রয়েছে যা না থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের কারণ সম্বন্ধে গবেষণা করলে বহু প্রাকৃতিক , বস্তুগত , রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু নির্মল অন্তঃকরণের অধিকারী ব্যক্তি এ ধরনের প্রতিটি জাতির পাপাচারের ক্ষেত্রে সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার পর ধ্বংস হবার ঘটনা অবহিত হয়ে অনুভব করতে পারেন যে , এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার এক অমোঘ বিধান , যদিও তা প্রাকৃতিক বা মানবিক কার্যকারণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

ক্বালবের দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান হচ্ছে এমন যার সাথে ইন্দ্রিয়লব্ধ বা বিচারবুদ্ধিজাত তথ্যের কোনোরূপ যোগসূত্র নেই। বরং বস্তুগত ও বিচারবুদ্ধিগত কার্যকারণের সংযোগ ছাড়াই অন্তঃকরণে বা হৃদয়ে কোনো তথ্য জাগ্রত হয় এবং তাতে প্রত্যয়ও সৃষ্টি হয়। ওয়াহী ও ইলহাম্ এ পর্যায়ের জ্ঞান। এ ক্ষেত্রে তা শব্দ ও বাক্যের সাহায্যে তৈরী বাণী , কোনো স্থির বা চলমান দৃশ্য , অথবা উভয়ই হতে পারে যা নবী-রাসূলগণ (আঃ) পেয়েছিলেন। আল্লাহর কোনো কোনো ওয়ালীও এরূপ বাণী লাভ করেন , যেমন: হযরত মূসা (আঃ)-এর মাতা লাভ করেছিলেন।

অন্যদিকে অন্তঃকরণে ভেসে ওঠা দৃশ্য বা অকাট্য তথ্য আকারেও কোনো জ্ঞান কেউ পেতে পারেন এবং তা অকাট্য প্রত্যয় উৎপাদক হয়ে থাকে। নবী-রাসূলগণ (আঃ) ও আল্লাহর ওয়ালীগণ ছাড়াও যে কোনো লোকই এ ধরনের জ্ঞান লাভ করতে পারে (যেমন অনেক বিজ্ঞানী লাভ করেন)। এমনকি নাস্তিক ব্যক্তির জন্যও এরূপ জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব নয়।

বাণীর আকারে হলে এরূপ জ্ঞানকে পঠনযোগ্য ওয়াহী (وحی متلوء )বলা হয় , আর বাণী আকারে না হলে এরূপ জ্ঞানকে পঠন - অযোগ্য ওয়াহী (وحی غير متلوء ) বা প্রেরণা (الهام - ইলহাম্) বা প্রত্যক্ষ অনুভূতি (intuition) বলা হয়।

বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান

ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানকে সহজাত , ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান - এ চার ভাগে ভাগ করার পাশাপাশি বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বা উদ্ধৃত জ্ঞান (علم نقلی ) নামেও একটি বিভাগ নির্দেশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত যে জ্ঞান বর্ণনাসূত্রে (লেখা ও কথা নির্বিশেষে) অবগত হয় তাকেই বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত বা উদ্ধৃত জ্ঞান বলা হয়। এ ধরনের জ্ঞান যদি বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান হয় এবং যথাযথভাবে স্থানান্তরিত হয় অর্থাৎ বর্ণনা ও গ্রহণ যথাযথ হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জ্ঞান একই পর্যায়ের হবে। তবে বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের ক্ষেত্রেই এটা যথাযথভাবে হওয়া সম্ভব। অন্তঃকরণে উদ্ভূত কোনো কোনো জ্ঞানের যথাযথ স্থানান্তর ও যার কাছে স্থানান্তরিত হয় তার পক্ষে তা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অবস্তুগত সমুন্নত সত্তা ও জগতসমূহ সংক্রান্ত জ্ঞান এ পর্যায়ের।

অন্যদিকে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের বিষয়টি ভিন্ন ধরনের। প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়নিচয় দ্বারা যে তথ্য আহরণ করে , বা প্রচলিত কথায় , যে জ্ঞান অর্জন করে , তা হুবহু অন্যের মাঝে স্থানান্তরিত করতে পারে না , কেবল এ সংক্রান্ত একটা প্রতীকী ধারণা স্থানান্তরিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ , কোনো ব্যক্তি যখন একটি সুন্দর দৃশ্য দেখার পর তা অন্যের নিকট মুখে বা লিখে বর্ণনা করে তখন তার পক্ষে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতাকে হুবহু নিজের অভিজ্ঞতা প্রদান করা সম্ভব হয় না ; প্রতীকী শব্দাবলীর সাহায্যে ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। অবশ্য বর্ণনা যত নিখুঁত হবে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার পক্ষে স্বীয় কল্পনানেত্রে ততটাই কাছাকাছি দৃশ্য রচনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু কখনোই তা বক্তার বা লেখকের দেখা দৃশ্যের হুবহু অনুরূপ হবে না। এমনকি তার ভিডিও-চিত্র প্রদর্শন করা হলেও ভিডিও-দর্শনকারীর জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর ন্যায় হুবহু জ্ঞান অর্জিত হবে না। কারণ , সংশ্লিষ্ট চলমান দৃশ্যাবলী ও শব্দ ( sound) ছাড়াও সেখানকার পরিবেশগত অনেক বিষয় , ধরুন বাতাসের স্পর্শ ইত্যাদি অনেক কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় শামিল থাকে যা চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থাকে।

তেমনি একটি সুর , কোনো বস্তুর স্বাদ , কোনো কিছুর ঘ্রাণ ও কোনো বস্তুর স্পর্শের অনুভূতি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলো মৌখিক বা লিখিত বর্ণনা , এমনকি রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও হুবহু পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার কাছে স্থানান্তরিত করা সম্ভবপর হয় না , কেবল এ সংক্রান্ত ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। যদিও লেখ্য বা মৌখিক বর্ণনার তুলনায় রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের সাহায্যে প্রদত্ত ধারণা বাস্তবতার অধিকতর কাছিাকাছি হয়ে থাকে , কিন্তু তা হুবহু অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অনুভূতির ন্যায় হয় না। আর পরীক্ষাগারে হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান দেয়া হয় মূলতঃ তা আর উদ্ধৃত জ্ঞান থাকে না , বরং জ্ঞান গ্রহণকারীর জন্যও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হয় , যদিও অন্য একজন তাকে সাহায্য করেছে বা ইতিপূর্বে সে অন্যের কাছ থেকে যে উদ্ধৃত জ্ঞান পেয়েছে তা থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিয়েছে।

ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দু টি শর্ত বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। প্রথমতঃ গ্রহীতার সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় অর্থাৎ তার যে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অন্যের ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্যাদি তার মধ্যে স্থানান্তরিত করা হবে সে ইন্দ্রিয়টি অক্ষত ও অবিকৃত থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ গ্রহীতার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বর্ণনার বিষয়বস্তুর অনুরূপ বিষয়বস্তু বা তার কাছাকাছি বিষয় সম্পর্কে পূর্বাহ্নিক ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকতে হবে। কেবল তাহলেই গ্রহীতার পক্ষে স্বীয় অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে অন্যের অভিজ্ঞতাভুক্ত বিষয় সম্পর্কে কোনো না কোনো পর্যায়ের ধারণা লাভ করা সম্ভব , অন্যথায় নয়। যেমন: চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে বর্ণনার দ্বারা একটি দৃশ্য সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব। ধরুন , যে ব্যক্তি তাজমহল দেখে নি তাকে বর্ণনার দ্বারা তাজমহল সম্পর্কে তাজমহল-দর্শকের অনুরূপ ধারণা দেয়া সম্ভব নয় , তবে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব । অবশ্য বর্ণনার সাথে সাথে ছবি দেখানো হলে দর্শক-শ্রোতার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান উন্নততর ও অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অধিকতর কাছাকাছি হবে। আর রঙিন ছবি ও ভিডিও-চিত্রের সাহায্যে পর্যায়ক্রমে অধিকতর উন্নত স্তরের ধারণা দেয়া ও তার এ সংক্রান্ত জ্ঞানকে অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর জ্ঞানস্তরের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও তার জ্ঞান হুবহু তাজমহল-পরিদর্শনকারীর এতদসংক্রান্ত জ্ঞানের অনুরূপ হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তির চোখ নেই তাকে , বিশেষতঃ জন্মান্ধকে তাজমহলের সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোনো ধারণাই দেয়া সম্ভব হবে না।

অন্যান্য ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও এটা সত্য।

অবশ্য বর্ণিত সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরী পটভূমিকার কারণে ব্যক্তি বর্ণনাকারীর অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উদ্যোগী হতে পারে। যেমন: সে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখতে যেতে পারে , সমুদ্রের শো-শো শব্দ শোনার জন্য সমুদ্রে যেতে পারে , যে নতুন ফলের প্রশংসা সে শুনেছে তা সংগ্রহ করে খেয়ে দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান আর বর্ণনাসূত্রে লব্ধ জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না , বরং ইন্দ্রিয়লব্ধ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হলো।

অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান

জ্ঞানকে অন্য এক বিবেচনায় দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বিচারবুদ্ধি দ্বারা আয়ত্তযোগ্য জ্ঞান (علم تعقلی ) ও অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । সহজাত জ্ঞান , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান , অভিজ্ঞতালব্ধ বা পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান এবং অনেক উদ্ধৃত জ্ঞানই প্রথমোক্ত ধরনের জ্ঞানের মধ্যে শামিল। আর দ্বিতীয়োক্ত ধরনের জ্ঞান যদিও পুরোপুরিভাবে বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার বহির্ভূত নয় , তবে তা সর্বজনীন নয়। তাই এ জ্ঞান যার আছে তাঁর কাছ থেকে অন্ধভাবে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। উদাহরণস্বরূপ , লাওহে মাহফূযের কথা ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোরআন মজীদের তথ্য মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ , সংশ্লিষ্ট তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করা বিচারবুদ্ধির আওতাবহির্ভূত ব্যাপার।

এ পরিভাষা দু টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা পরিবর্তিত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তা হচ্ছে , যে তথ্য কেবল বিশেষজ্ঞদের পক্ষেই জানা সম্ভব তা তাঁদের জন্য বিচারবুদ্ধির আয়ত্তাধীন জ্ঞান (علم تعقلی ) এবং সাধারণ মানুষদের জন্য অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । কারণ , এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞের কথা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের কথা চোখ বুঁজে মেনে নেয়ার আগে স্বীয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশেষজ্ঞকে অর্থাৎ প্রকৃতই তিনি বিশেষজ্ঞ , নাকি বিশেষজ্ঞ হবার মিথ্যা দাবীদার তা পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ মিথ্যা বলবেন না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে বা প্রত্যয়ে উপনীত হতে হবে। যেমন: আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চিকিৎসকের কাছে যাই , তবে বিচারবুদ্ধি নির্দেশিত বিভিন্ন পন্থায় , যেমন: চিকিৎসাক্ষেত্রে খ্যাতি , সার্টিফিকেট , সরকারী নিবন্ধন ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হই যে , ঐ ব্যক্তি চিকিৎসক হবার মিথ্যা দাবী করছেন না ; এ কারণেই নিশ্চিন্ত মনে তাঁর কাছে যাই।

অন্যদিকে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির ধারণযোগ্য বিষয়ে অন্যের কথা মেনে নেয়া এবং বিশেষজ্ঞ হবার দাবীদার ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিচার বা অনুসন্ধান পূর্বক নিশ্চিত না হয়েই তার কথা মেনে নেয়া বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নিন্দনীয় কাজ। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষজ্ঞত্বের দাবীদার ব্যক্তির কাছ থেকে যে ধারণা লাভ করে তাকে নেতিবাচক ও নিন্দনীয় অর্থেتعبد বা অন্ধ বিশ্বাস বলা হয়। বস্তুতঃ এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না।

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে জ্ঞানমাধ্যম

সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য বিচারবুদ্ধির পর্যালোচনায় যে জ্ঞানমাধ্যমগুলোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে: সহজাত প্রবণতা , বিচারবুদ্ধি , ইন্দ্রিয়নিচয় ও অন্তঃকরণ বা হৃদয় (قلب ) । এ মাধ্যমগুলো এমন যে , এগুলোকে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই জ্ঞানমাধ্যমরূপে স্বীকার করতে বাধ্য , অবশ্য কেউ গোঁয়ার্তুমি করে বা অন্ধভাবে এর মধ্য থেকে কোনোটিকে অস্বীকার করতে চাইলে সে কথা স্বতন্ত্র এবং তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমরা কোরআন মজীদেও জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে এগুলোর উল্লেখ দেখতে পাই।

উৎসভিত্তিক বিভাগ

জ্ঞানবিভাগের দৃষ্টিকোণসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে উৎসভিত্তিক দৃষ্টিকোণ।

মানুষের জ্ঞানের দু টি উৎস চিন্তা করা যায়: অভ্যন্তরীণ উৎস ও বাইরের উৎস। অভ্যন্তরীণ উৎস মানে স্বয়ং তার সত্তা অর্থাৎ যে জ্ঞান তার সত্তায় নিহিত থাকে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভূত হয় সে জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বয়ং তার সত্তাকেই গণ্য করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে বলার উদ্দেশ্য এই যে , তার সত্তায় নিহিত জ্ঞান অন্য কোনো সত্তা থেকে নিহিত রাখা হয়ে থাকতে পারে বা উদ্ভূত করা হয়ে থাকতে পারে ( থাকতে পারে যুক্তির খাতিরে বলা হয়েছে , আসলে রাখা হয়েছে উদ্ভূত করা হয়েছে )। অর্থাৎ দৃশ্যতঃ এ ধরনের জ্ঞান তার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উৎসারিত। অন্য কথায় , সে বাহ্যিক তথ্যমাধ্যম , যেমন: ইন্দ্রিয়নিচয়ের সাহায্য ছাড়াই এ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে। এ ধরনের কোনো কোনো জ্ঞান জন্মের পর থেকে স্বতঃপ্রকাশিত হয় অর্থাৎ তার সত্তায় নিহিত থাকে , যেমন: ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্ঞান। আবার কোনো জ্ঞান তার মধ্যে সম্ভাবনা আকারে সুপ্ত থাকে যা উপযুক্ত সময়ে ও পরিবেশে তার মধ্যে জাগ্রত হয় , যেমন: যৌনক্ষুধার জ্ঞান। এছাড়া কোনো কোনো জ্ঞান সরাসরি তার মধ্যে অন্য কোনো অপার্থিব উৎস থেকে সঞ্চারিত হতে পারে , যেমন: ওয়াহী , ইলহাম , যথাযথ চিন্তা-গবেষণা ছাড়াই অন্তরে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যের উদ্ভব ইত্যাদি।

এর বিপরীতে রয়েছে তার সত্তার বাইরে অবস্থিত জ্ঞানসূত্রসমূহ ; প্রাকৃতিক জগত সহ তার সত্তাবহির্ভূত যত কিছু থেকে সে জ্ঞান লাভ করে তার সব কিছুই বাইরের জ্ঞানসূত্র।

প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক বিভাগ

জ্ঞানকে তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: উপস্থিত জ্ঞান বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান (علم حضوری ) ও অর্জনীয় জ্ঞান (علم حصولی ) । প্রত্যক্ষ জ্ঞান হচ্ছে তা-ই কোনো রকম মাধ্যম ছাড়াই যে জ্ঞান ব্যক্তির সত্তায় বিদ্যমান থাকে। প্রত্যক্ষ জ্ঞান কয়েক ধরনের হতে পারে: (1) সত্তায় সরাসরি বিদ্যমান জ্ঞান , যেমন: ব্যক্তির নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান , স্বীয় উৎস বা সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা রূপ জ্ঞান , ক্ষুধাতৃষ্ণা সংক্রান্ত জ্ঞান , যৌনক্ষুধার জ্ঞান ইত্যাদি যাকে সহজাত জ্ঞান (علم فطری )ও বলা যেতে পারে। (2) ব্যক্তির ধারণা-কল্পনাজাত অবস্তুগত অস্তিত্ব সমূহ সংক্রান্ত জ্ঞান এবং (3) ওয়াহী ও ইলহাম জাতীয় জ্ঞান যা বাইরের অপার্থিব উৎস থেকে ব্যক্তির সত্তায় জাগ্রত হওয়ার পর স্থিতিলাভ করে।

অর্জনীয় জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়নিচয় ও অন্যান্য তথ্যমাধ্যম বা জ্ঞানমাধ্যমের সাহায্যে বাইরের উৎস থেকে অর্জিত জ্ঞান বা চিন্তা-গবেষণার মাধমে উদ্ঘাটিত জ্ঞান।

অর্জনীয় জ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুসমূহের সরাসরি প্রত্যক্ষণ বা সরাসরি অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত হতে পারে , অথবা লেখ্য ও কথনীয় ভাষা , ছবি , আকার-ইঙ্গিত ইত্যাদি প্রতীকের সাহায্যে হতে পারে।

জ্ঞানকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যভাবেও ভাগ করা যেতে পারে। যেমন: (1) সহজাত জ্ঞান (علم فطری ) , (2) প্রত্যক্ষ জ্ঞান (علم حضوری ) ও (3) অর্জনীয় জ্ঞান (علم حصولی ) । এ ধরনের বিভাগে জ্ঞানের অধিকারীর সত্তা এবং তার বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা সমূহ সংক্রান্ত জ্ঞানকে সহজাত জ্ঞান , এর বহির্ভূত বিষয়াদি সংক্রান্ত অনর্জিত জ্ঞান তথা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদিকে ও তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচারবুদ্ধি কর্তৃক গৃহীত উপসংহারকে অর্জনীয় জ্ঞান -এর পর্যায়ে ফেলা হয়। তেমনি সহজাত জ্ঞানকেও অনেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করেন। এর কারণ , সহজাত জ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যক্তির সত্তার মধ্যে প্রকাশিত হবার পর সদা বিদ্যমান থাকে।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান

ইতিমধ্যেই যেমন আভাস দেয়া হয়েছে , প্রত্যক্ষ জ্ঞান (علم حضوری ) হচ্ছে জ্ঞানের অধিকারী বা জ্ঞানী (عالم )-এর সত্তায় নিহিত অনর্জিত জ্ঞান এবং সে জ্ঞানের বিষয়বস্তু বা জ্ঞাত বিষয় (معلوم ) হচ্ছে স্বয়ং সেই সত্তা এবং তার বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা সমূহ। অর্থাৎ এখানে জ্ঞানী , জ্ঞান ও জ্ঞাত অভিন্ন। বস্তুতঃ সমস্ত রকমের জ্ঞানের মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষ জ্ঞানের যথার্থতা সম্বন্ধে যে কারো পক্ষেই শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

এখানে জ্ঞানীর সত্তার বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা সমূহ সম্পর্কে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে , বাইরে থেকে প্রাপ্ত বা অর্জিত জ্ঞান এবং তার সত্তায় উৎপাদিত জ্ঞান (বিচারবুদ্ধির উদ্ভাবন ও ধারণা-কল্পনা নির্বিশেষে) যখন জ্ঞানীর সত্তায় স্থিতিলাভ করে তখন তা তার সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায় এবং জ্ঞানী অন্য কোনো মাধ্যম ব্যতীতই সে সম্পর্কে অবহিত থাকে। এ কারণে তা-ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্যতম হয়ে যায়। অর্থাৎ এ ধরনের জ্ঞানকে যখন লাভ করার পন্থা ও উৎসের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় তখন তা প্রাপ্ত বা অর্জিত জ্ঞান , আর যখন বিদ্যমানতার ভিত্তিতে দেখা হয় তখন তা প্রত্যক্ষ জ্ঞান। অন্যদিকে জ্ঞানী যখন তার সত্তায় নিহিত এ জ্ঞানের সাহায্যে জ্ঞানের মূল বিষয়বস্তুর প্রতি মনোযোগ দেয় তখন তা প্রাপ্ত বা অর্জিত জ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হয় , আর যখন স্বয়ং জ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেয় অর্থাৎ তার সত্তায় নিহিত ঐ সব বিষয়বস্তুর অবস্তুগত রূপের দিকে মনোযোগ দেয় তখন তা প্রত্যক্ষ জ্ঞান।

এ বিষয়টি সম্বন্ধে একটি চমৎকার উপমা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে: আমরা যখন একটি আয়নার দিকে এ উদ্দেশ্যে তাকাই যে , তার আকার-আকৃতি ও আয়তন এবং তার বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রত্যক্ষ করবো অর্থাৎ তা পুরোপুরি ঠিকঠাক আছে কিনা , নাকি তাতে কোনো ত্রুটি আছে , আয়নাটির প্রতি এভাবে তাকানোর সাথে আয়নাটিতে চেহারা বা তাতে প্রতিফলিত অন্য কোনো দৃশ্য দেখার উদ্দেশ্যে তার দিকে তাকানোর পার্থক্য আছে। প্রথম ক্ষেত্রে আয়নাটিই লক্ষ্য এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আয়নাটি লক্ষ্য নয় , মাধ্যম মাত্র। অনুরূপভাবে জ্ঞানীর সত্তার বাইরের যে কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানীর জ্ঞান তার সত্তার অংশ হিসেবে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্থাৎ তা নিজেই একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় ও সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য এবং বাইরের সেই বিষয়বস্তুর প্রতি মনোযোগের মাধ্যম হিসেবে তা অর্জিত জ্ঞান।

মাধ্যম যখন বিষয়বস্তু

ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে , অভিন্ন বিষয় অভিন্ন জ্ঞানীর জন্য কখনো জ্ঞানের মাধ্যম ও কখনো জ্ঞাত বিষয় হতে পারে। এ কথাটি জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যবহৃত প্রতীক সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। লেখ্য ও কথনীয় ভাষা , এতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বর্ণ , চিহ্ন ও ধ্বনি এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের চিত্র , চলচ্চিত্র , অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি এ সবের বাইরে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুগত ও অবস্তুগত বিষয়বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যম হতে পারে , আবার স্বয়ং এগুলো সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করা হতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে এ সব প্রতীক হচ্ছে জ্ঞানার্জনের মাধ্যম বা প্রতীক এবং দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রে আর এগুলো জ্ঞানার্জনের মাধ্যম বা প্রতীক নয় , বরং স্বয়ং জ্ঞানের বিষয়বস্তু বা জ্ঞাত

স্বতঃপ্রকাশিত ও তাত্ত্বিক জ্ঞান

আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: (1) স্বতঃপ্রকাশিত জ্ঞান (علم بدیهی ) ও (2) তাত্ত্বিক জ্ঞান (علم نظری ) ।

স্বতঃপ্রকাশিত জ্ঞান হচ্ছে এমন জ্ঞান যা মানুষের সত্তার কাছে নিজে নিজেই ধরা পড়ে এবং যা যুক্তিতর্ক ও দলীল দ্বারা প্রমাণের মুখাপেক্ষী নয়। যেমন: অভিন্ন স্থান ও কালে একটি বস্তু আছে এবং নেই - এটা হওয়া অসম্ভব। তেমনি: যে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে , তার অস্তিত্বদানকারী রয়েছে। অনুরূপভাবে , ব্যক্তির কাছে তার নিজের অস্তিত্বের সত্যতা কোনোরূপ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। স্বতঃপ্রকাশিত জ্ঞানের উপমা দিতে গিয়ে বলা হয়: সূর্যের উদয়ই সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ ; এ জন্য অন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

তাত্ত্বিক জ্ঞান হচ্ছে তা-ই যা যুক্তিতর্ক , দলীল-প্রমাণ বা বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা অপরিহার্য। তাত্ত্বিক জ্ঞান দুই ধরনের। এক ধরনের তাত্ত্বিক জ্ঞান হচ্ছে বস্তুধর্মের বহির্ভূত বিষয়াদির জ্ঞান অর্থাৎ অবস্তুগত জগতের ও মানবিক বিষয়াদির জ্ঞান যার বিপরীতে রয়েছে বস্তুবিজ্ঞানের জ্ঞান। দর্শন , আক্বায়েদ , সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি এ ধরনের তাত্ত্বিক জ্ঞান। আর দ্বিতীয় ধরনের তাত্ত্বিক জ্ঞান হচ্ছে বস্তুধর্ম সম্পর্কে হাতেকলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে কেবল অধ্যয়ন বা শ্রবণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। এ শেষোক্ত ধরনের জ্ঞান সম্পর্কে কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভবপর। যেমন: পানি 100 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ফুটতে থাকে - এটি একটি তত্ত্ব যা পরীক্ষাগারে বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই কেবল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

জ্ঞানর মাধ্যমভিত্তিক প্রকরণ:

মানুষ যে সব মাধ্যমের বদৌলতে জ্ঞানের অধিকারী হয় সাধারণতঃ তার ভিত্তিতেই জ্ঞানের প্রকরণ নির্ধারণ করা হয়। আমরা এখন জ্ঞান আহরণের মাধ্যমসমূহ ও তার ভিত্তিতে জ্ঞানের প্রকরণসমূহের দিকে দৃষ্টি দেবো।

মানুষ চারটি মাধ্যম থেকে জ্ঞান লাভ করে এবং এর ভিত্তিতে জ্ঞানকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এ চারটি জ্ঞানমাধ্যম হচ্ছে: স্বভাব-প্রকৃতি (فطرة - ফিতরাত্) , ইন্দ্রিয়নিচয় , বিচারবুদ্ধি (عقل - আক্বল্) ও অন্তঃকরণ (قلب - ক্বালব্)। এ চার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে যথাক্রমে স্বভাবজাত বা সহজাত জ্ঞান , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান , বিচারবুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান নামে অভিহিত করা যেতে পারে।

সহজাত জ্ঞান

সহজাত বা স্বভাবজাত জ্ঞান হচ্ছে ঐ সব জ্ঞান মানুষ জন্মগতভাবেই যার অধিকারী হয়। যেমন: ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্ঞান , শারীরিক আরাম ও কষ্টের জ্ঞান ইত্যাদি। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীও সহজাত জ্ঞানের অধিকারী। বরং অন্যান্য প্রাণীর সহজাত জ্ঞানের আওতা মানুষের সহজাত জ্ঞানের আওতার চেয়ে ব্যাপকতর।

সহজাত জ্ঞান দুই ধরনের। এক ধরনের জ্ঞান ব্যক্তির সত্তায় কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াই জাগ্রত হয়। যেমন: শরীরে খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজন হলেই ব্যক্তি নিজে নিজেই তা বুঝতে পারে। এ ধরনের জ্ঞানকে ভিন্ন এক বিবেচনায় প্রত্যক্ষ জ্ঞান (علم حضوری - ইলমে হুযূরী)ও বলা যেতে পারে।

আরেক ধরনের জ্ঞান মানুষের সত্তায় সম্ভাবনা আকারে বিদ্যমান থাকে যা তার কাছে যথা সময়ে ও উপযুক্ত পরিবেশে প্রকাশ পায়। যেমন: যৌনতার জ্ঞান - যা শিশুর মধ্যে সম্ভাবনা আকারে নিহিত থাকে এবং বয়সের একটি সুনির্দিষ্ট স্তর পার হবার পর নিজ থেকেই ক্রমান্বয়ে তার মধ্যে এ জ্ঞান জন্ম নেয়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , যৌনতার জ্ঞান ও যৌন ক্ষুধার জ্ঞান এক পর্যায়ের নয়। যৌন ক্ষুধার জ্ঞান ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতোই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কিন্তু যৌন ক্ষুধার বয়সে উপনীত হবার অব্যবহিত পূর্ববর্তী একটি ক্রান্তিকালে যৌনতা সম্বন্ধে নিজ থেকেই যে ধারণা ও আগ্রহ গড়ে ওঠে তা এতদসংক্রান্ত সম্ভাবনার বিকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান

চক্ষু , কর্ণ , নাসিকা , জিহবা ও ত্বক - এই পাঁচটি শারীরিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তা-ই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান (علم حسی - ইলমে হিসসী) বা অভিজ্ঞতাজাত ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান (علم تجربی - ইলমে তাজরাবী)।

এক হিসেবে ইন্দ্রিয়নিচয়কে জ্ঞানমাধ্যম না বলে স্রেফ তথ্যসংগ্রহ মাধ্যম বলাই অধিকতর সঠিক। কারণ , ইন্দ্রিয়নিচয় অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ করে মাত্র ; বিচারবুদ্ধিই এসব তথ্যকে সমন্বিত করে জ্ঞানে পরিণত করে। উদাহরণস্বরূপ , কোনো ব্যক্তির নাকে যখন সুগন্ধ অনুভূত হয় তখন তার নাকের স্নায়ুতন্ত্র তার মস্তিষ্কে এ তথ্যটি পাঠিয়ে দেয় এবং তার চোখ যখন একটি ফুল দেখতে পায় তখন চোখের স্বায়ুতন্ত্রী মস্তিষ্কে সে তথ্য পাঠিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় তার বিচারবুদ্ধি এ দুই তথ্যের সমন্বয়ে গবেষণা করে এ উপসংহারে উপনীত হয় যে , ঐ ফুলটিই নাকে ভেসে আসা সুগন্ধির উৎস। এমনকি সে ঐ সময় চোখে ঐ ফুলটি দেখতে না পেলেও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মস্তিষ্কে সঞ্চিত তথ্যের সাথে বর্তমান তথ্য অর্থাৎ নাকের মাধ্যমে সংগৃহীত সর্বসাম্প্রতিক তথ্যকে মিলিয়ে নিয়ে বিচারবুদ্ধি উপসংহারে উপনীত হয় যে , আশেপাশে কোথাও অমুক ফুল রয়েছে এবং তা থেকেই এ সুঘ্রাণ আসছে।

বিচারবুদ্ধিজাত জ্ঞান

বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) হচ্ছে মানুষের বস্তুগত শরীরকে আশ্রয় করে অবস্থানরত একটি অবস্তুগত শক্তি। বিচারবুদ্ধি হচ্ছে স্বয়ং জ্ঞানের উৎস , অন্যান্য তথ্য-আহরণ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির পর্যালোচনা ও সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী তথা জ্ঞানের উৎপাদনকারী এবং তথ্য-আহরণ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভুলত্রুটি নির্ণয়কারী।

বিচারবুদ্ধি স্বীয় অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী ; এজন্য সে অন্য কোনো তথ্য-আহরণ মাধ্যমের দ্বারস্থ নয়। বিচারবুদ্ধি জ্ঞানের অস্তিত্বও অবগত - যা কোনো বস্তুগত বিষয় নয়। বিচারবুদ্ধি এমন অনেক অকাট্য বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তথ্যাদি অবগত হতে পারে যা ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে। যেমন: বিচারবুদ্ধি এ বিশ্বজগতের অস্তিত্বের পিছনে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা করতে ও প্রত্যয়ে উপনীত হতে সক্ষম যদিও কোনো ইন্দ্রিয়েই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রতিফলিত হয় না (অর্থাৎ ব্যক্তি চোখ দ্বারা স্রষ্টাকে দেখে নি , কান দ্বারা স্রষ্টার কথা শোনে নি , হাত দ্বারা তাঁকে স্পর্শ করে নি , ...)। তেমনি বিচারবুদ্ধি কোনো বস্তুর সাহায্য ছাড়াই সংখ্যার ধারণা করতে পারে , একমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক অস্তিত্ব (যা অবস্তুগত) সম্বন্ধে এবং অবস্তুগত ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব সম্বন্ধেও ধারণা করতে পারে। সে কল্পনা করতে পারে এবং কল্পনায় অনেক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি সে বস্তুগত সৃষ্টিতে রূপান্তর সাধনের পরিকল্পনা করতে পারে অর্থাৎ বাস্তবে রূপান্তর সাধনের পূর্বে সে কল্পনায় রূপান্তর সাধনের কাজ করে থাকে। আর এ সবের কোনোটিই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান নয় যদিও এসব ক্ষেত্রে সে ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি থেকে সাহায্য নিয়ে থাকতে পারে।

অতএব , বিচারবুদ্ধি হচ্ছে একটি স্বাধীন জ্ঞানমাধ্যম ও জ্ঞান-উৎস।

অনেকে (বস্তুবাদীরা) বিচারবুদ্ধির অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করে এবং দাবী করে যে , যে সব কাজকে বিচারবুদ্ধির কাজ বলে দাবী করা হয় তা আসলে মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মাত্র। কিন্তু তাদের এ দাবী এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মস্তিষ্কের জ্ঞানকোষগুলো বস্তুগত উপাদানে তৈরী এবং তা প্রাপ্ত তথ্যাদি সঞ্চয় করে মাত্র ; এসব তথ্যের পর্যালোচনা , সমন্বয় সাধন , সংশোধন ও তা থেকে নতুন তথ্যে তথা উপসংহারে উপনীত হওয়ার জন্য অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র হস্তক্ষেপকারী উপাদান অপরিহার্য। আর বস্তুজগতের বাইরের বিষয়ে তো নিজে নিজেই মস্তিষ্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ , এরূপ ক্ষেত্রে কোনোরূপ ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যের প্রভাব থাকে না। অতএব , এ ক্ষেত্রে একটি অবস্তুগত শক্তির প্রভাব বা হস্তক্ষেপ অপরিহার্য ; তা-ই হচ্ছে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)।

তাছাড়া বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একমুখী অর্থাৎ হ্যা বা না হয়ে থাকে এবং প্রতিক্রিয়াটি টিকে থাকে বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা সন্দেহ-সংশয়ের বা বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় অনেক বিষয়েই উপসংহার বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হই ; এ ধরনের অবস্থা বিচারবুদ্ধির অস্তিত্বই প্রমাণ করে।

এছাড়া সৌন্দর্যচেতনা , শিল্পকলা , সাহিত্য ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপেই বিচারবুদ্ধি ও অন্যান্য অবস্তুগত অভ্যন্তরীণ শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ , একটি ছোটগল্প রচনা , গল্পটির সংক্ষেপণের প্রয়োজন অনুভব করা ও সংক্ষেপণের কাজ আঞ্জাম দেয়া ইন্দ্রিয়নিচয়ের কাজ নয় , বিচারবুদ্ধির কাজ।

যাই হোক , মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধি এক অবস্তুগত অভ্যন্তরীণ শক্তি। অবশ্য তার প্রধান কর্মক্ষেত্র মস্তিষ্ক। তবে বিচারবুদ্ধিকে মস্তিষ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা ঠিক হবে না।

বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে , তা অন্যান্য তথ্যসংগ্রহ মাধ্যম কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সে সবের ভুল নির্ণয় ও নিরসন করতে পারে। বিচারবুদ্ধি বুঝতে পারে , চোখ সূর্যকে ছোট দেখলেও আসলে সূর্য অত ছোট নয় ; একই পানি দুই হাতে গরম ও ঠাণ্ডা অনুভূত হলেও আসলে ঐ পানির তাপমাত্রা একটিই , দু টি নয় , বরং দুই হাত ইতিপূর্বে দুই ধরনের তাপমাত্রায় ছিলো বলেই এরূপ অনুভব করছে ; গত রাতের জীবন বাস্তব বা বস্তুগত জগতের অভিজ্ঞতা ছিলো , কিন্তু গত রাতের স্বপ্ন বস্তুগত জগতের অভিজ্ঞতা ছিলো না , যদিও দু টি অভিজ্ঞতার একটিও এখন বর্তমান নেই ; ....।

অবশ্য বিচারবুদ্ধিও ভুল করতে পারে এবং ভুল উপসংহারে উপনীত হতে পারে। তবে বিচারবুদ্ধি পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে স্বীয় ভুল চিহ্নিত করে তা সংশোধন করতে পারে। কিন্তু ইান্দ্রিয়নিচয়ের সে ক্ষমতা নেই। যেমন: কোনো যান্ত্রিক উপকরণের সাহায্য গ্রহণ ছাড়াই খোলা চোখ একই জায়গা থেকে সূর্যকে লক্ষ বার দেখলেও ছোটই দেখতে পাবে।


3

4

5

6

7