সহজাত জ্ঞান:
কোরআন মজীদে আমরা মানুষের সত্তা (نفس
) বা প্রকৃতি (فطرة
)-এর মধ্যে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে সহজাত জ্ঞান নিহিত রাখার কথা উল্লেখ দেখতে পাই। এরশাদ হয়েছে:
)
وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا(
“
শপথ সেই প্রাণসত্তার এবং তার তিনি যা সুসংহত করেছেন , অতঃপর তার মধ্যে তার পাপের (ও ধ্বংসের) আর (তা থেকে) বেঁচে থাকা (-এর জ্ঞান) ইলহাম্ করে (সত্তায় প্রদান করে) দিয়েছেন।”
(সূরাহ্ আশ্-শামস্: 7-8)
বলা বাহুল্য যে , ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদি সংক্রান্ত সহজাত জ্ঞান এতোই সুস্পষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য যে , কোরআন মজীদ তার উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করে নি , বরং এমন এক সহজাত জ্ঞানের কথা বলেছে যে সম্বন্ধে অনেকেই চিন্তা করে না , তবে উল্লেখের পর যে কেউই সামান্য চিন্তা করলেই তা অনুধাবন করতে সক্ষম।
এমন কতোগুলো কাজ আছে যা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের কাছেই ভালো বা উচিত বলে মনে হয় , যেমন: সত্য কথা বলা , বিশ্বস্ততা রক্ষা করা , বড়কে সম্মান করা , ছোটকে স্নেহ করা , দরিদ্র ও অসহায়কে সাহায্য ও সহায়তা করা , আমানত প্রত্যর্পণ করা ইত্যাদি। অন্যদিকে এমন কতোগুলো কাজ আছে যা প্রতিটি মানুষের কাছেই মন্দ বা বর্জনীয় বলে মনে হয় , যেমন: মিথ্যা বলা , বিশ্বাসঘাতকতা করা , আমানত আত্মসাৎ করা , চুরি-ডাকাতি করা , নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেয়া , অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা ইত্যাদি। কোনোরূপ ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা না পেলেও সহজাতভাবেই মানুষের মধ্যে এ জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে (তা কার্যতঃ সে তা অনুসরণ করুক বা না-ই করুক)।
ইন্দ্রিয়নিচয়:
ইন্দ্রিয়নিচয় যে জ্ঞান আহরণের মাধ্যম তা কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:
)
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ(
“
আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের মায়েদের গর্ভ থেকে (এমন অবস্থায়) বের করে এনেছেন যে , তোমরা কোনো কিছুই জানো না এবং তিনি তোমাদের জন্য শ্রবণশক্তি , দর্শনশক্তি ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন ; আশা করা যায় যে , তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।”
(সূরাহ্ আন্-নাহল্: 78)
কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে ইন্দ্রিয়নিচয় ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চোখ ; কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে চর্মচক্ষুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন আয়াতে বিদেশ ভ্রমণের কথা বলা হয়েছে এবং বলা বাহুল্য যে , বিদেশ ভ্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে নতুন নতুন জিনিস ও দৃশ্য চাক্ষুষভাবে দর্শন। তবে আল্লাহ্ তা‘
আলা উচ্চতর লক্ষ্যে অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে ভ্রমণকে ব্যবহারের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:
)
قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلُ(
.
“
(হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন , তোমরা ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করো এবং (দেখে) মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করো যে , (তোমাদের) পূর্ববর্তীদের পরিণতি কেমন হয়েছিলো।”
(সূরাহ্ আর্-রূম্: 42)
সুস্পষ্ট যে , এখানে চাক্ষুষ দেখাকে অনুসন্ধিৎসা সহকারে তথ্য সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহার করতে তথা পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ইন্দ্রিয়জ চক্ষু লব্ধ তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
অন্য বহু আয়াতে শ্রবণশক্তির সাহায্যে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:
)
فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ(
.
“
অতঃপর সে (ইমরাআতুল‘
আযী্য্) যখন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনলো ।”
(সূরাহ্ ইউসুফ: 31)
এ আয়াতে কথা কানে আসা থেকে তথ্য সংগ্রহ বা জ্ঞান হাছ্বিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র মনোযোগ দিয়ে শুনে জ্ঞানার্জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:
)
فَبَشِّرْ عِبَادِ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ(
“
অতএব , (হে রাসূল!) সেই বান্দাহদেরকে সুসংবাদ দিন যারা বক্তব্য শ্রবণ করে এবং এরপর তার মধ্য থেকে যা অধিকতর উত্তম তার অনুসরণ করে।”
(সূরাহ্ আয্-যুমার্: 17-18)
এ আয়াত থেকেও শ্রবণশক্তির তথ্যসংগ্রহমাধ্যম হওয়ার বিষয়টির স্বীকৃতি প্রমাণিত হয়। তবে তথ্য যাচাই-বাছাই করা যে শ্রবণযন্ত্রের কাজ নয় , বরং বিচারবুদ্ধির কাজ সে ইঙ্গিতও এতে রয়েছে।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
)
أَوَلَمْ يَرَوْا كَيْفَ يُبْدِئُ اللَّهُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (19) قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ(
“
তারা কি (কতক ক্ষেত্রে হলেও) (চাক্ষুষভাবে) দেখে নি যে , আল্লাহ্ কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন ? আর এরপর তিনিই তাকে প্রত্যাবর্তন করাবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর জন্য এ কাজ খুবই সহজ। (হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন , তোমরা ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করো এবং (চাক্ষুষভাবে দেখে) মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে ভেবে দেখো যে , কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন।”
(সূরাহ্ আল্-‘
আনকাবূত্: 19-20)
বলা বাহুল্য যে , এখানে দর্শনেন্দ্রিয়ের সাথে বিচারবুদ্ধির সংযোগেরও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
কোরআন মজীদে আস্বাদনের কথা বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে জিহবা দ্বারা আস্বাদন প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত আয়াতের দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। হযরত আদম (‘
আঃ) ও হযরত হাওয়া (‘
আঃ) যে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের স্বাদ গ্রহণ করেন সে প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে:
)
فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ(
“
অতঃপর তারা উভয়ে যখন বৃক্ষটির স্বাদ গ্রহণ করলো।”
(সূরাহ্ আল্-আ‘
রাফ: 22)
লক্ষণীয় , এখানে খাওয়ার কথা বলা হয় নি , স্বাদগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। যদিও খাওয়ার মাধ্যমে একই সাথে ক্ষুন্নিবৃত্তি ও স্বাদগ্রহণ দুইই ঘটে থাকে , কিন্তু‘
খাওয়া বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষুন্নিবৃত্তি বুঝানো। অন্যদিকে না খেয়েও (গলাধঃকরণ না করেও) শুধু জিহবা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করা যায়। জিহবা দ্বারা বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন স্বাদ সম্পর্কে ও তা ভক্ষণোপযোগী কিনা সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়। কিন্তু জিহবায় না লাগিয়ে সরাসরি পাকস্থলীতে বিভিন্ন বস্তু পৌঁছানো হলে পাকস্থলী বিভিন্ন ধরনের স্বাদ সম্পর্কে বা কী কী ধরনের বস্তু তার মধ্যে পৌঁছানো হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারবে না।
ত্বকের স্পর্শ-অনুভূতি সম্পর্কে বহু আয়াতে উল্লেখ রয়েছে ; বিশেষভাবে হাত দিয়ে স্পর্শের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:
)
قَالَ فَاذْهَبْ فَإِنَّ لَكَ فِي الْحَيَاةِ أَنْ تَقُولَ لَا مِسَاسَ(
“
(মূসা সামেরীকে) বললো: সুতরাং দূর হয়ে যাও ; অবশ্যই তোমার জন্য এটাই নির্ধারিত যে , সারা জীবন (অনারোগ্য জঘন্য চর্মরোগের কারণে ) তুমি বলবে: আমাকে স্পর্শ করো না।”
(সূরাহ্ ত্বা-হা: 97)।
মোট কথা , কোরআন মজীদ যে , ইন্দ্রিয়নিচয়কে জ্ঞান বা তথ্য আহরণের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অবশ্য কোরআন মজীদে ইন্দ্রিয়নিচয়ের মধ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় ও দর্শনেন্দ্রিয়ের কথা সর্বাধিক বার উল্লিখিত হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ , মানুষ এ দু’
টি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই , বিশেষ করে দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণে তথ্যসংগ্রহের কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে।