জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম0%

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 8468
ডাউনলোড: 2946

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 8468 / ডাউনলোড: 2946
সাইজ সাইজ সাইজ
জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

জ্ঞানতত্ত্ব ও ইসলাম

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে যথেষ্ট জানার আছে এবং লেখক , সাংবাদিক ও জ্ঞানগবেষকদের জন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। এ পুস্তকে এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা দেয়া হয়েছে মাত্র। আশা করি এ পুস্তক পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে এ বিষয়ে অধিকতর অধ্যয়নের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আর তাহলেই অত্র পুস্তকের সফলতা।

সহজাত জ্ঞান:

কোরআন মজীদে আমরা মানুষের সত্তা (نفس ) বা প্রকৃতি (فطرة )-এর মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সহজাত জ্ঞান নিহিত রাখার কথা উল্লেখ দেখতে পাই। এরশাদ হয়েছে:

) وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا(

শপথ সেই প্রাণসত্তার এবং তার তিনি যা সুসংহত করেছেন , অতঃপর তার মধ্যে তার পাপের (ও ধ্বংসের) আর (তা থেকে) বেঁচে থাকা (-এর জ্ঞান) ইলহাম্ করে (সত্তায় প্রদান করে) দিয়েছেন। (সূরাহ্ আশ্-শামস্: 7-8)

বলা বাহুল্য যে , ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদি সংক্রান্ত সহজাত জ্ঞান এতোই সুস্পষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য যে , কোরআন মজীদ তার উল্লেখের প্রয়োজন বোধ করে নি , বরং এমন এক সহজাত জ্ঞানের কথা বলেছে যে সম্বন্ধে অনেকেই চিন্তা করে না , তবে উল্লেখের পর যে কেউই সামান্য চিন্তা করলেই তা অনুধাবন করতে সক্ষম।

এমন কতোগুলো কাজ আছে যা আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের কাছেই ভালো বা উচিত বলে মনে হয় , যেমন: সত্য কথা বলা , বিশ্বস্ততা রক্ষা করা , বড়কে সম্মান করা , ছোটকে স্নেহ করা , দরিদ্র ও অসহায়কে সাহায্য ও সহায়তা করা , আমানত প্রত্যর্পণ করা ইত্যাদি। অন্যদিকে এমন কতোগুলো কাজ আছে যা প্রতিটি মানুষের কাছেই মন্দ বা বর্জনীয় বলে মনে হয় , যেমন: মিথ্যা বলা , বিশ্বাসঘাতকতা করা , আমানত আত্মসাৎ করা , চুরি-ডাকাতি করা , নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেয়া , অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা ইত্যাদি। কোনোরূপ ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা না পেলেও সহজাতভাবেই মানুষের মধ্যে এ জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে (তা কার্যতঃ সে তা অনুসরণ করুক বা না-ই করুক)।

ইন্দ্রিয়নিচয়:

ইন্দ্রিয়নিচয় যে জ্ঞান আহরণের মাধ্যম তা কোরআন মজীদে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

) وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ(

আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের মায়েদের গর্ভ থেকে (এমন অবস্থায়) বের করে এনেছেন যে , তোমরা কোনো কিছুই জানো না এবং তিনি তোমাদের জন্য শ্রবণশক্তি , দর্শনশক্তি ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন ; আশা করা যায় যে , তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। (সূরাহ্ আন্-নাহল্: 78)

কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে ইন্দ্রিয়নিচয় ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চোখ ; কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে চর্মচক্ষুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন আয়াতে বিদেশ ভ্রমণের কথা বলা হয়েছে এবং বলা বাহুল্য যে , বিদেশ ভ্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে নতুন নতুন জিনিস ও দৃশ্য চাক্ষুষভাবে দর্শন। তবে আল্লাহ্ তা আলা উচ্চতর লক্ষ্যে অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে ভ্রমণকে ব্যবহারের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

) قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلُ( .

(হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন , তোমরা ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করো এবং (দেখে) মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করো যে , (তোমাদের) পূর্ববর্তীদের পরিণতি কেমন হয়েছিলো। (সূরাহ্ আর্-রূম্: 42)

সুস্পষ্ট যে , এখানে চাক্ষুষ দেখাকে অনুসন্ধিৎসা সহকারে তথ্য সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহার করতে তথা পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে অর্থাৎ বিচারবুদ্ধির সাহায্যে ইন্দ্রিয়জ চক্ষু লব্ধ তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

অন্য বহু আয়াতে শ্রবণশক্তির সাহায্যে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

) فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ( .

অতঃপর সে (ইমরাআতুল আযী্য্) যখন তাদের ষড়যন্ত্রের কথা শুনলো । (সূরাহ্ ইউসুফ: 31)

এ আয়াতে কথা কানে আসা থেকে তথ্য সংগ্রহ বা জ্ঞান হাছ্বিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র মনোযোগ দিয়ে শুনে জ্ঞানার্জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:

) فَبَشِّرْ عِبَادِ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ(

অতএব , (হে রাসূল!) সেই বান্দাহদেরকে সুসংবাদ দিন যারা বক্তব্য শ্রবণ করে এবং এরপর তার মধ্য থেকে যা অধিকতর উত্তম তার অনুসরণ করে। (সূরাহ্ আয্-যুমার্: 17-18)

এ আয়াত থেকেও শ্রবণশক্তির তথ্যসংগ্রহমাধ্যম হওয়ার বিষয়টির স্বীকৃতি প্রমাণিত হয়। তবে তথ্য যাচাই-বাছাই করা যে শ্রবণযন্ত্রের কাজ নয় , বরং বিচারবুদ্ধির কাজ সে ইঙ্গিতও এতে রয়েছে।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

) أَوَلَمْ يَرَوْا كَيْفَ يُبْدِئُ اللَّهُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (19) قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ(

তারা কি (কতক ক্ষেত্রে হলেও) (চাক্ষুষভাবে) দেখে নি যে , আল্লাহ্ কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেন ? আর এরপর তিনিই তাকে প্রত্যাবর্তন করাবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর জন্য এ কাজ খুবই সহজ। (হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন , তোমরা ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করো এবং (চাক্ষুষভাবে দেখে) মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে ভেবে দেখো যে , কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন। (সূরাহ্ আল্- আনকাবূত্: 19-20)

বলা বাহুল্য যে , এখানে দর্শনেন্দ্রিয়ের সাথে বিচারবুদ্ধির সংযোগেরও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

কোরআন মজীদে আস্বাদনের কথা বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে জিহবা দ্বারা আস্বাদন প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত আয়াতের দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। হযরত আদম ( আঃ) ও হযরত হাওয়া ( আঃ) যে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের স্বাদ গ্রহণ করেন সে প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে:

) فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ(

অতঃপর তারা উভয়ে যখন বৃক্ষটির স্বাদ গ্রহণ করলো। (সূরাহ্ আল্-আ রাফ: 22)

লক্ষণীয় , এখানে খাওয়ার কথা বলা হয় নি , স্বাদগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। যদিও খাওয়ার মাধ্যমে একই সাথে ক্ষুন্নিবৃত্তি ও স্বাদগ্রহণ দুইই ঘটে থাকে , কিন্তু খাওয়া বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষুন্নিবৃত্তি বুঝানো। অন্যদিকে না খেয়েও (গলাধঃকরণ না করেও) শুধু জিহবা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করা যায়। জিহবা দ্বারা বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন স্বাদ সম্পর্কে ও তা ভক্ষণোপযোগী কিনা সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়। কিন্তু জিহবায় না লাগিয়ে সরাসরি পাকস্থলীতে বিভিন্ন বস্তু পৌঁছানো হলে পাকস্থলী বিভিন্ন ধরনের স্বাদ সম্পর্কে বা কী কী ধরনের বস্তু তার মধ্যে পৌঁছানো হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারবে না।

ত্বকের স্পর্শ-অনুভূতি সম্পর্কে বহু আয়াতে উল্লেখ রয়েছে ; বিশেষভাবে হাত দিয়ে স্পর্শের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

) قَالَ فَاذْهَبْ فَإِنَّ لَكَ فِي الْحَيَاةِ أَنْ تَقُولَ لَا مِسَاسَ(

(মূসা সামেরীকে) বললো: সুতরাং দূর হয়ে যাও ; অবশ্যই তোমার জন্য এটাই নির্ধারিত যে , সারা জীবন (অনারোগ্য জঘন্য চর্মরোগের কারণে ) তুমি বলবে: আমাকে স্পর্শ করো না। (সূরাহ্ ত্বা-হা: 97)।

মোট কথা , কোরআন মজীদ যে , ইন্দ্রিয়নিচয়কে জ্ঞান বা তথ্য আহরণের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অবশ্য কোরআন মজীদে ইন্দ্রিয়নিচয়ের মধ্যে শ্রবণেন্দ্রিয় ও দর্শনেন্দ্রিয়ের কথা সর্বাধিক বার উল্লিখিত হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ , মানুষ এ দু টি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই , বিশেষ করে দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণে তথ্যসংগ্রহের কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকে।

বিচারবুদ্ধি:

কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধি (عقل )কে শুধু অন্যতম জ্ঞানমাধ্যম হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় নি , বরং এর ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোরআন মজীদেعقل শব্দমূল হতে নিষ্পন্ন শব্দাবলী 49 বার ব্যবহৃত হয়েছে ; এর মধ্যে আট জায়গায় বিভিন্ন বিষয় উল্লেখের পর বলা হয়েছে যে , এতে সেই সব লোকের জন্য নিদর্শন/ নিদর্শনাদি রয়েছে যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

) وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ رِزْقٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ آيَاتٌ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ (.

আর দিনরাত্রির পরিবর্তনে (বা পার্থক্য ঘটার মধ্যে) এবং আল্লাহ্ আকাশ থেকে যে রিয্ক্ব (বৃষ্টি) নাযিল করেছেন এবং তার সাহায্যে ধরণীকে এর মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত করেছেন তাতে , আর বায়ুর আবর্তন-পরিবর্তনে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরাহ্ আল্-জাছিয়াহ্: 5)

অনেকেلقوم يعقلون -এর অর্থ করেছেন বুদ্ধিমান লোকদের জন্য ; এটা সঠিক অর্থ নয়। কারণ , সে ক্ষেত্রেلقوم عاقلون বলা হতো । আর মানসিক প্রতিবন্ধী ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটে নি এমন শিশু ছাড়া সকলেইعاقل বা বুদ্ধিমান। আলোচ্য আয়াতেيعقلون ক্রিয়াপদ ব্যবহার থেকে সুস্পষ্ট যে , এতে বুদ্ধিমানদের বুঝানো উদ্দেশ্য নয় , এমনকি বিচারবুদ্ধির অধিকারী সকল লোককে বুঝানোও উদ্দেশ্য নয় , বরং বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারীদের বুঝানোই উদ্দেশ্য।

এছাড়া কোরআন মজীদে 13 বার তাকিদ করে বলা হয়েছেافلا تعقلون - অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না ? অনেকে এর অর্থ করেছেন: তোমরা কি বোঝো না ? কিন্তু এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়। কারণ , তা বলতে চাওয়া হলে বলা হতো:افلا تفهمون অর্থাৎ বিষয়টি কি তোমাদের জন্য কঠিন বা জটিল এবং এ কারণে তোমরা বুঝতে পারছো না ? তাছাড়া বুঝতে না পারা বলতে অনিচ্ছাকৃত বা সাধ্যাতীত অক্ষমতা বুঝায় এবং সে জন্য কাউকে তিরস্কার করা চলে না।

বস্তুতঃ আক্বল্ বা বিচারবুদ্ধির দ্বারা যা বুঝা সম্ভব তা সর্বজনীনভাবে সহজবোধগম্য বিষয় ; বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সহজেই তা বুঝা যেতে পারে। কিন্তু লোকেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ থেকে দূরে থাকে। এ কারণেই এ জন্য তারা তিরস্কারের উপযুক্ত বিধায় কোরআন মজীদ তাদেরকে তিরস্কার করেছে।

অন্তঃকরণ:

কোরআন মজীদেقلب (অন্তঃকরণ)কে একটি জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত জিবরাঈল ( আঃ) হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অন্তঃকরণে কোরআন মজীদ পৌঁছে দেন। এরশাদ হয়েছে:

) قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللَّهِ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَهُدًى وَبُشْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ(

(হে রাসূল!) বলুন: যে ব্যক্তি জিবরাঈলের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে (সে জেনে রাখুক যে) , অবশ্যই সে (জিবরাঈল্) আল্লাহর অনুমতিক্রমেই আপনার অন্তঃকরণে তা (কোরআন) নাযিল করে যা , (পূর্ব থেকে) যা তাদের সামনে বিদ্যমান আছে তার সত্যায়নকারী এবং তা (এ কোরআন) হচ্ছে মু মিনদের জন্য হেদায়াত ও সুসংবাদস্বরূপ। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: 97)

আরো এরশাদ হয়েছে:

) نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ(

তা (কোরআন) সহ বিশ্বস্ত চেতনা (জিবরাঈল্) আপনার অন্তঃকরণে নাযিল হয়েছে যাতে আপনি সতর্ককারীদের অন্যতম হন। (সূরাহ্ আশ্-শু আরা: 193-194)।

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

) لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ( .

তাদের অন্তঃকরণ আছে , কিন্তু তা দ্বারা তারা হৃদয়ঙ্গম করে না। (সূরাহ্ আল্-আরাফ: 179)

তবে এখানে উল্লেখযোগ্য যে , কোরআন মজীদেقلب শব্দটি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ; বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ , হৃদয়ঙ্গমকরণ , অনুধাবন এবং ওয়াহী ও ইলহাম্ গ্রহণকেقلب -এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করাقلب -এরই কাজ। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

) أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا(

তাহলে তারা কি ধরণীর বুকে পরিভ্রমণ করেনি যাতে তাদের এমন অন্তঃকরণ (قلب ) হয় যার সাহায্যে তারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে ? (সূরাহ্ আল্-হাজ্জ: 46)

এখানে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করাকেقلب -এর কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবেقلب -কে এ ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে বলতে হবে ,قلب -এর মধ্যে দুই ধরনের জ্ঞান-আহরণ ক্ষমতা নিহিত রয়েছে: একটি হচ্ছে বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা , অপরটি হচ্ছে সহজাত জ্ঞান , ইন্দিয়লব্ধ তথ্যাদি এবং বিচারবুদ্ধির জ্ঞান ও তথ্যাদি বহির্ভূত তথা পার্থিব কার্যকারণ বহির্ভূত অনুভূতি এবং ওয়াহী ও ইলহাম্ ধারণের ক্ষমতা। আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের ভাষায় এ দু টি অভ্যন্তরীণ শক্তিকে দু টি স্বতন্ত্র জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং প্রথমটিকে বিচারবুদ্ধি (عقل ) নাম দেয়া হয়েছে , আর দ্বিতীয়টিকে অন্তঃকরণ (قلب ) নামেই অভিহিত করা হয়েছে। তবে এ কারণে আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে না। কারণ , কোরআন মজীদেقلب -এর এ ঊভয় ধরনের ক্ষমতার সপক্ষেই প্রমাণ রয়েছে যার কিছু আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি।

অন্তঃকরণের ইন্দ্রিয়নিচয়:

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , মানুষের মধ্যে অন্তঃকরণ (قلب ) নামে যে অবস্তুগত জ্ঞানমাধ্যম রয়েছে বা এ কালের পরিভাষায় , বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণ নামে যে শক্তি রয়েছে বস্তুদেহের ইন্দ্রিয়নিচয়ের মতো তারও (অবস্তুগত) ইন্দ্র্রিয়নিচয় রয়েছে। বস্তুদেহের ইন্দ্রিয়নিচয়ের সাহায্য ছাড়াই মানুষের বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণ তার এ সব নিজস্ব ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা জ্ঞান আহরণ করতে পারে। অর্থাৎ অন্তঃকরণের শ্রবণ , দর্শন , স্পর্শকরণ , আঘ্রাণ ও স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা আছে। কল্পনার চোখে অনেক দৃশ্য দর্শন করার অভিজ্ঞতা কমবেশী সকলেরই রয়েছে। এমনকি শুধু কল্পনাশক্তির সাহায্যে বস্তুদেহের ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা শ্রবণ , স্পর্শকরণ , আঘ্রাণ ও স্বাদ গ্রহণের অভিজ্ঞতার হুবহু অনুরূপ কিছু কিছু অভিজ্ঞতাও অনেকের থাকতে পারে।

মানুষের বস্তুদেহের ইন্দ্রিয়নিচয়ের বাইরে অন্তঃকরণের ইন্দ্রিয়নিচয় থাকার কথা কোরআন মজীদ থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

) أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً( .

(হে রাসূল!) আপনি কি তাকে দেখেছেন যে তার প্রবৃত্তিকে স্বীয় ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহ্ তাকে জ্ঞানের ওপরে গোমরাহ্ করেছেন , আর তার শ্রবণের ও তার অন্তঃকরণের ওপর মোহর করে দিয়েছেন এবং তার দর্শনক্ষমতার ওপর আবরণ তৈরী করে দিয়েছেন ? (সূরাহ্ আল্-জাছিয়াহ্: 23)

নিঃসন্দেহে এখানে বস্তুদেহের কান ও চোখের কথা বলা হয় নি।

অন্যত্র অধিকতর সুস্পষ্ট ভাষায় এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:

) وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُونَ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تُسْمِعُ الصُّمَّ وَلَوْ كَانُوا لَا يَعْقِلُونَ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْظُرُ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تَهْدِي الْعُمْيَ وَلَوْ كَانُوا لَا يُبْصِرُونَ(

আর তাদের মধ্যে কতক লোক আছে যারা (হে রাসূল!) আপনার কথা (বস্তুদেহের কান দ্বারা) শোনে ; আপনি কি বধিরকে (আপনার কথা) শুনাতে চান যদিও তারা বিচারবুদ্ধি কাজে লাগায় না ? আর তাদের মধ্যে কতক লোক আছে যারা আপনার দিকে (বস্তুদেহের চক্ষু দ্বারা) মনোযোগ সহকারেই দৃষ্টিপাত করে ; আপনি কি অন্ধকে পথ দেখাতে পারবেন যদিও তারা (অন্তঃকরণের চোখ দ্বারা) দেখতে পায় না ? (সূরাহ্ ইউনুস: 42-43)

এখানে সুস্পষ্ট যে , যাদেরকে বধির ও অন্ধ বলা হয়েছে তাদের বস্তুদেহের কান ও চোখ অকেজো নয়।

এ ধরনের আয়াত কোরআন মজীদে আরো আছে।