আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন0%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 77207
ডাউনলোড: 7467

আশুরা সংকলন
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 77207 / ডাউনলোড: 7467
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।

শাহাদাতের পর

শহীদ ড.আলী শরীয়তী*

[বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ হচ্ছে ইরানের অন্যতম বিপ্লবী চিন্তানায়ক ড.আলী শরীয়তীর একটি বক্তৃতা । তার এ বক্তৃতাটি স্বৈরতন্ত্র ও শোষণ মূলক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইরানের মুসলিম জনগণকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । ]

ভাই ও বোনেরা!

এখন আমাদের শহীদরা মৃত্যুকে আলিংগন করেছেন ,কিন্তু আমরা যারা জীবিত আছি তারাও মৃত। শহীদরা তাদের বাণী আমাদের সামনে পেশ করেছেন । কিন্তু তাদের সেই উপদেশের প্রতি আমরা কর্ণপাত করছি না ,বধির হয়ে রয়েছি। তারা যখন দেখলেন যে ,(ইসলামের পথে ) বেচে থাকা আর কোনো ক্রমেই সম্ভব নয় তখন তারা সাহসিকতার সাথে লড়াই করে শাহাদাতের পেয়ালা পান করাকেই গৌরবোজ্জ্বল পথ হিসাবে বেছে নিলেন।

আমাদের শহীদ ভাইয়েরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ,আর আমরা লজ্জাকর জীবন নিয়ে বেচে আছি। আমরা এভাবে বেচে আছি শত শত বছর ধরে । আমাদের এ হীন অবস্থা দেখে বিশ্বের জনগণ আমাদের বিদ্রূপ করছে ,এটা আমাদের উপলদ্ধি করা উচিত। আমাদের হেয় ও শোচনীয় অবস্থা অবমাননা ও গ্লানির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আর সেই আমরাই ইমাম হোসাইন (আ.) ও হযরত যায়নাব (আ.) -এর নাম নিয়ে চিৎকার করছি ,যারা হচ্ছেন গৌরব আর মহত্বের অনুপম আদর্শ ।

আমরা যারা অবমাননা ও গ্লানিকর জীবন যাপন করছি তারাই আবার এসব মহৎপ্রাণ ,মহিমান্বিত ও সম্মানিত প্রিয় ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করছি ,শোক পালন করছি ,এটা ইতিহাসের পাতায় আরেকটা অন্যায় আর অত্যাচারের অধ্যায় সংযোজন মাত্র। আজ শহীদরা তাদের রক্ত দিয়ে আমাদের সম্মুখে তাদের বাণী উপস্থাপন করেছেন । শহীদরা আমাদের মুখোমুখিই বসে আছেন ,আর আমরা যারা তাদের সম্মুখে উপবিষ্ট তাদের জেগে ওঠার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। আমাদের সংস্কৃতি ,ধর্ম এবং শিয়াদের ইতিহাসে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে ,মানবতা অত্যন্ত শক্তিশালী জীবন সঞ্জীবনী চেতনা সৃষ্টি করেছে যা ইতিহাসকে দিয়েছে প্রাণ আর প্রেরণামূলক উত্তেজনা। আর স্বর্গীয় শিক্ষা মানুষের জীবনে আনে জাগরণ যার ফলে মানুষ তার স্রষ্টা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। সেই প্রিয়তম মহৎ ব্যক্তিত্বগণ আর সেই অনুপম স্বর্গীয় সম্পদের উত্তরাধিকার যারা তারাই আজ নির্যাতিত ,হীন গ্লানিকর জীবন কাটাচ্ছেন। তারা আজ লুকিয়ে থাকছেন ;নিজের পরিচয় গোপন করে বেড়াচ্ছেন।

আমরা হচ্ছি সেই সঞ্চয় ও সম্পদের অধিকারী যা অর্জিত হয়েছে জিহাদ ,শাহাদাত এবং মানবতার সবচাইতে মহত্তর ও মহিমান্বিত মুল্যবোধের লালনে ,কুরবানি করার মাধ্যমে । আমরা হলাম এতসব মহৎ সম্পদের অধিকারী। আমাদের দায়িত্ব হবে এমন এক জনগোষ্ঠী বা উম্মাহ গড়ে তোলা যেখানে মানবতার আদর্শ সমুন্নত থাকবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা আলা আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন : আমরা তোমাদের মধ্যপন্থী জাতি রূপে সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা অন্যান্য জাতির সামনে সাক্ষী হয়ে দাড়াতে পার এবং আল্লাহর রাসূল ও যেন তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দান করেন। সুতরাং এ মহা মূল্যবান উত্তরাধিকারের কারণে শহীদ যোদ্ধাগণ ,নেতৃবর্গ ,সেনাপতিগণ ,ঈমানদারগণ এবং আল্লাহর কিতাবের প্রতি আমাদের এক মহান দায়িত্ব রয়েছে । আমাদের সেই দায়িত্ব হচ্ছে একটি আদর্শ সমাজ সৃষ্টি করা যাতে আমরা বিশ্ববাসীর সামনে সাক্ষী হয়ে দাড়াতে পারি এবং আল্লাহর রাসূল গণ এরসাক্ষী হতে পারেন।

আমাদের ওপর এই যে দায়িত্ব এসেছে তা অত্যন্ত কঠিন। মানবতার মধ্যে প্রাণ সঞ্জীবন করা ,তাকে জীবন্ত ও সজীব করে তোলা এবং একে গতিশীল করার দায়িত্ব এসে পড়েছে আমাদের ওপর ,অথচ আমরা হচ্ছি এমনই যে ,সাধারণ ভাবে জীবন চালিয়ে নেয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। হে আমার খোদা! এর মধ্যে কী মহিমা লুক্কায়িত রয়েছে ? আমরা যারা পদস্খলন আর বিভ্রান্তির অতলে আছি ,আমরা যারা সাধারণ প্রাণীর মতো রুটিনমাফিক জীবন যাপন করছি ,আমাদের পক্ষে কী করে সম্ভব কারবালার সেই মহৎ প্রাণ পুরুষ ,মহিলা ও শিশু শহীদদের জন্য চির শোক আর মাতমের অনুষ্ঠান আয়োজন করা ? কারবালার শহীদগণ শাহাদাতের মর্যাদাকে চিরায়ত সুষমামণ্ডিত করে গেছেন এবং তারা ইতিহাসের পাতায় ,মহান আল্লাহর সামনে ,স্বাধীনতার সামনে সাক্ষী হয়ে রয়েছেন।

আমরা দেখেছি একজন অত্যাচারী ইতিহাসকে শাসন করছে ,আমরা দেখেছি একজন হত্যাকারীই এতসব শহীদ সৃষ্টি করেছে। এ হত্যাকারীর খড়গের নিচে বহু শহীদকে জীবন দিতে হয়েছে ,সমগ্র ইতিহাস জুড়ে রয়েছে তার সাক্ষ্য ,এ হত্যাকারীর বেত্রাঘাতে বহু মহিলার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে । রক্ত -সাগরের বিনিময়ে বহু জনশূন্য জনপদ সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ইতিহাসের সকল যুগে ,সকল জাতিতে ক্ষুধার্ত মানুষ ,দাসদাসী ,মহিলা ও শিশুদের নিধন করা হয়েছে ,যেমন নিধন করা হয়েছে পুরুষ ,বীর ,চাকর ও শিক্ষকদের।

প্রত্যেকটি বিপ্লবের দু টি দিক রয়েছে : একটি হচ্ছে রক্ত আর অপরটি হচ্ছে বাণী । শাহাদাতের মানে হচ্ছে সাক্ষ্য প্রদান। তারাই শহীদ- যারা সত্যের জন্য নিজেদের প্রেম ও ভালোবাসার কারণে রক্তস্নাত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন । যে সত্য প্রেম মানুষকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে ,পৃথিবীর মানুষ তা হারাতে বসেছিল ,পৃথিবীর মানুষ থেকে মানবিক মূল্যবোধ অপসৃত হয়ে যাচ্ছিল ,শহীদরা আবার তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের রক্ত ঢেলে দিলেন।

শহীদরা অনন্তে মিলিয়ে যাননি ,তারা সদা বর্তমান ,তারা জীবিত ,তারা মানব জাতির জন্য সাক্ষ্য হয়ে রয়েছেন ,তাদের সাক্ষ্য শুধু আল্লাহর সামনেই নয় ,বিশ্বের সকল যুগের ,সকল শতাব্দীর ,সকল সময়ের ও সকল স্থানের মানুষের সামনে। যারা বেচে থাকতে চায় এবং তজ্জন্য যে কোনা গ্লানিকর ও অবমাননাকর পরিস্থিতিকেও মেনে নেয় তারা জীবন্মৃত ,ইতিহাসে তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত অপমানকর ও অমর্যাদাকর মৃত্যু। কিন্তু সেসব মহৎপ্রাণ ব্যক্তি যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন ,ইসলামের জন্য ভালোবাসা ও উদারতার কারণে যারা ইমাম হোসাইনের সঙ্গী হয়ে লড়াই করেছেন তাদের মৃত্যু হচ্ছে গৌরবোজ্জল ,মহিমান্বিত । তারা বেচে থাকার জন্য শত শত ধর্মীয় যুক্তির আশ্রয় নিতে পারতেন ,কিন্তু তার প্রতি তারা কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ করেননি এবং এ ধরণের খোড়াযুক্তির আশ্রয় না নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন । ইতিহাসে কারা বেচে আছেন ? যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তারা ,না যারা ইমাম হোসাইনকে ত্যাগ করে গেছে এবং বেচে থাকার জন্য ইয়াযীদের আদেশ পালন করতে গিয়ে অত্যন্ত অবমাননাকর ও গ্লানিকর পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছে ? আমাদের মাঝে এখন পর্যন্ত কারা জীবিত আছেন ? তারাই জীবিত আছেন যারা জীবনকে শুধু একটি চলন্ত বস্তুরূপে মনে করেন না। জীবিত তারাই যারা ইমাম হোসাইনের অস্তিত্বকে উপলদ্ধি করতে পরেছেন এবং নিজেদের সকল সাত্তাকে বিলীন করে দিয়ে ইমাম হোসাইনের অস্তিত্বের প্রতি সাক্ষ্য প্রদান করেছেন । তারাই জীবিত যারা দেখতে পেরেছেন বেচে থাকার জন্য নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপন করা জীবন্মৃত ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং এরূপ হেয় জীবন ত্যাগ করে সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।

কারবালার সেই বীরেরা ,সেই শহীদরা আমাদের জন্য এক মহৎ শিক্ষা ,মহৎ বাণী রেখে গেছেন। এ বাণী হচ্ছে ,অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়া যায়না । শাহাদাত কখনো এ কথা মেনে নেয় না যে ,শত্রুকে পরাস্ত করার মধ্যেই বিজয় নিহিত। শহীদরা শত্রুকে পরাস্ত করতে না পারলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মাধ্যমেই বিজয় অর্জন করেন ,আর শক্রুকে পরাস্ত করতে না পারাটাকে নিজের জন্য অবমাননাকর মনে করেন না।

শহীদরা হচ্ছেন ইতিহাসের হৃৎপিণ্ড বা কেন্দ্রবিন্দু। হৃৎপিণ্ড যেমন সারা শরীরকে রক্ত সরবরাহ করে জীবন্ত রাখে ,শহীদরাও ইতিহাসকে তা-ই দেন। যে সমাজ মৃতপ্রায় ,প্রাণস্পন্দনহীন হয়ে পড়েছে ,যে সমাজে মানুষ তাদের বিশ্বাস হারাতে বসেছে ,যে সমাজ আত্মসমর্পণ নীতি অবলম্বন করে নিজের সত্তাকে হারাচ্ছে ,যে সমাজের মানুষ নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্মৃত ,যে সমাজের মানুষ তার মানবিক সত্তা ও মানবিক মর্যাদা সম্পর্কে অসচেতন ,যে সমাজ তার উৎপাদিকা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ,যে সমাজের চালিকাশক্তি রহিত হয়ে গেছে একজন শহীদ সে সমাজের হৃৎপিণ্ড হিসাবে সেই শুষ্ক ও মৃত সমাজে রক্ত সরবরাহ করেন। সমাজের গতিহীন লাশো প্রাণ সঞ্চার করেন।

একজন শহীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোজেজা হচ্ছে এই যে ,শাহাদাতের মাধ্যমে তিনি বংশধরদের জন্য একটি নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেন। এভাবে একজন শহীদ আমাদের কাছে হয়ে ওঠেন চিরঞ্জীব ,চিরাস্থায়ী।

সত্য ও মিথ্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে ,প্রতিটি দিগন্তে শহীদ বর্তমান-সত্য ও মিথ্যার প্রতিটি জিহাদে ,প্রতিটি সংঘাতে শহীদ বর্তমান। শহীদের উপস্থিতি সর্বত্র এবং তার এ উপস্থিতির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল মানুষকে এ বাণী প্রদান করা-হে মানুষ ! যদি তোমরা সত্য আর মিথ্যার লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত না থাক ,তবে তোমরা যে স্থানেই থাক না কনো তার কোনো মূল্য নেই। যদি তোমরা তোমাদের জীবদ্দশায় সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ের ময়দানের সাক্ষ্য বহন করতে না পারো (অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার সংঘাতে শরীক না হও) ,তবে তুমি অন্য যে- কোনো কাজই কর না কেনো তার কোনোই মূল্য নেই। তুমি ইবাদাতে মশগুল থাক অথবা খাদ্যবস্তু গ্রহণে ব্যস্ত থাক ,এর মধ্যে কোনোও তারতম্য নেই।

শাহাদাত সত্য ও মিথ্যার চিরস্থায়ী রণক্ষেত্রের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে । যারা অনুপস্থিত তাদের পরিণতি কী ? যারা (কারবালার ময়দানে) হযরত হোসাইন (আ.) -কে একাকী ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল এবং লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত ছিল না এবং যারা শাহাদাতের অমর গৌরব অর্জনে তার সাথী হয়নি এদের সকলের পরিণতি একই । যারা হযরত হোসাইন (আ.) -কে কারবালার ময়দানে একাকী ফেলে চলে গিয়েছে এবং ইয়াযীদের নিকট গিয়েও তার চর হিসাবে কাজ করেছে অথবা যারা বেহেশ্ত লাভের আশায় হযরত হোসাইন (আ.) -কে ত্যাগ করে নিরাপত্তা ও শান্তির সঙ্গে ইবাদাতখানায় গিয়ে ইবাদাতে মশগুল হয়েছে ,যারা সত্য আর মিথ্যার লড়াইয়ে যে-কোনো প্রকার সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার জন্য দৌড়ে গিয়ে ইবাদাতখানা অথবা নিজেদের ঘরের কোণে কেবল আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য আশ্রয় নিয়েছে ,অথবা যারা ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কারণে নিশ্চুপ ছিল এদের সকলেই জিহাদের ময়দান ত্যাগ করেছিলো এবং তাদের পরিণতিও একই ।

শহীদ হযরত হোসাইন (আ.) -এর আদর্শ আমাদের সামনে রয়েছে । সকল শতাব্দীতে ,সকল যুগে তার উপস্থিতি বর্তমান ,যারা তার পার্শ্বে এসে দাঁড়াবে না তিনি যে কেউ হোন না কেনো-ঈমানদার ,নাস্তিক ,অপরাধী অথবা ধার্মিক ব্যক্তি তারা সকলেই একই কাতারের।

শিয়া মাযহাবের আদর্শ অনুযায়ী কোনো কাজের প্রকৃতি নির্ভর করে ইমামত (নেতৃত্ব) এবং পরিচালকের ওপর । এ (ইমামত) ব্যতীত কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই এবং আমরাও দেখেছি ইমামত ব্যতীত কার্যাদি অর্থহীন ,মূল্যহীন হয়ে পড়েছে।

হযরত হোসাইন (আ.) সকল যুগে ,সকল বংশধরের মধ্যে ,সকল যুদ্ধে ,সকল জিহাদে ,পৃথিবীর সর্বযুগের সকল রণক্ষেত্রে তার উপস্থিতি ঘোষণা করেছেন । সকল যুগের মানুষ ,সকল বংশধরকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে তিনি কারবালায় শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেছিলেন ।

আর আপনি ও আমি-আমরা হতভাগা ,আমরা আমাদের উপস্থিতির ঘোষণা দিতে পারিনি ,সেজন্য অবশ্যই আমাদের রোনাজারী করতে হবে । প্রত্যেক বিপ্লবের দু টি দিক বা পর্যায় রয়েছে । রক্তদান এবং বাণী প্রচার। হযরত হোসাইন (আ.) ও তার সঙ্গী-সাথীরা বিপ্লবের প্রথম মিশন বা পর্যায় অর্থাৎ রক্তদান সম্পাদন করেছেন ।

শাহাদাতের (অর্থাৎ বিপ্লবের) দ্বিতীয় মিশন বা পর্যায়ে বিশ্ববাসীর নিকট শাহাদাতের বাণী প্রচারের দরূহ কার্যটি সম্পাদন করেছেন হযরত যায়নাব যে মহীয়সী মহিলার অসম সাহসিকতা ও নির্ভীকতা আজও বিশ্বের লোকদের জন্য একটা শিক্ষার বিষয়। হযরত যায়নাবের মিশন তার ভাইয়ের মিশন অপেক্ষা আরও অধিক ভারী এবং দুঃসহ। যারা বাতিলের মোকাবিলায় লড়াই করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পেরেছেন ,তারা জীবনের একটি মহত্তর লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছেন মাত্র ,কিন্তু যারা বেচে রয়েছেন তাদের দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিন। হযরত যায়নাব বেচে রয়েছেন। তাকে অনুসরণ করছে ভৃত্যদের এক বাহিনী। তার সম্মুখে রয়েছে শত্রু বাহিনী। তার ভাইয়ের শাহাদাতের বাণী প্রচারের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে তার ওপর বর্তেছে। তিনি শহরে প্রবেশ করেছেন ,রণক্ষেত্র থেকে এসেছেন ,পেছনে রেখে এসেছেন শাহাদাতের এক লাল বাগান ,আর লাল ফুলের সাবাস ছড়িয়ে রয়েছে তার পোশাক জুড়ে। তিনি প্রবেশ করছেন অপরাধের নগরীতে ,ক্ষমতা ,নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের রাজধানীতে।

ক্ষমতাসীন ও নিষ্ঠুর লোকদের দাসত্বের শৃঙ্খলাবদ্ধ চর ,হত্যাকারী এবং উপনিবেশ ও স্বৈরাচারের কূলনিধিদের প্রতি তিনি (হযরত যায়নাব ) বিজয়ীর বেশে শান্তভাবে ঘোষণা করলেন : হে খোদা! আপনি আমাদের পরিবারের প্রতি যে উদারতা ও মহানুভবতা দেখিয়েছেন সে জন্য আপনার প্রতি জানাই শুকরিয়া। আপনি (আমাদের পরিবারকে) দিয়েছেন নবুওয়াতের সম্মান এবং শাহাদাতের সম্মান। হযরত যায়নাব -এর ওপর দায়িত্ব হচ্ছে যারা সাক্ষ্যদান করেছেন অথচ নীরব হয়ে গেছেন (অর্থাৎ শহীদ হয়েছেন) তাদের বাণী ঘোষণা করা। কেননা ,তিনি বেচে রয়েছেন এবং তাকে অবশ্যই শহীদদের জন্য কথা বলতে হবে ,যে শহীদদের বাকশক্তি তাদের হত্যাকারীরা চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে।

যদি রক্তদানের পর শহীদদের বাণী প্রচারিত না হয় ,তবে ইতিহাসে তাদের বাণী অকথিত থেকে যাবে । যদি রক্ত সকল বংশধরকে বাণী পৌছিয়ে না যায় তবে হত্যাকারী কোনো সময়ে অথবা যুগে তাকে বন্দি করবে। যদি হযরত যায়নাব কারবালার বাণী ঘোষণা করে না যেতেন ,তবে কারবালা নীরব হয়ে যত এবং যাদের এ বাণী প্রয়োজন তারা তা পেতনা। যারা কেবল রক্তদানের মধ্যেই তাদের বাণীর কথা বলে যান (প্রচার করার কেউ থাকেনা) তাদের বাণী কারো কাছে পৌছে না।

এ কারণেই হযরত যায়নাবের মিশন এত ভারী ও কঠিন। হযরত যায়নাবের বাণী হচ্ছে সকল মানুষের প্রতি-যারা হযরত হোসাইন (আ.) -এর ই্ন্তেকালে কান্নাকাটি করছেন তাদের প্রতি ,হযরত হোসাইন (আ.) -এর বিশ্বাস বা আদর্শের প্রতি অনুরাগী ,শ্রদ্ধাশীল তাদের প্রতি ,যারা হযরত হোসাইন (আ.) -এর মতো জীবন ঈমান ও জিহাদ ছাড়া আর কিছুই নয় - এ কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন তাদের প্রতি।

হযরত যায়নাব এর বাণী হচ্ছে- আপনারা যারা এ পরিবারের অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) এর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা এ পরিবারকে সম্মান ও মান্য করেন ,আপনারা যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -এর মিশনের প্রতি ঈমান স্থাপন করেছেন ,আপনাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে এবং (সত্যকে) বছে নিতে হবে । আপনারা যে যুগে ,যে বংশ পরস্পরায় এবং যে দেশেই থাকুন না কেনো আপনাদের অবশ্যই কারবালার শহীদদের বাণী স্মরণ করতে হবে ।

কারবালার বাণী হচ্ছে ,সে-ই ভালোভাবে বাচতে পারে ,যে ভালোভাবে মরতে পারে। আপনারা যারা আল্লাহর একত্ব ও কুরআন মজীদের বাণীকে বিশ্বাস করেন এবং সাথে সাথে যারা হযরত আলী (আ.) ও তার পরিবারের পথকে মেনে চলেন এবং যারা আমাদের পরে (দুনিয়াতে) আসবেন ,(তারা জানুন) মানবতার প্রতি আমাদের পরিবারের বাণী হচ্ছে ,কীভাবে ভালোভাবে বেচে থাকা ও কীভাবে ভালোভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যায় সে জীবন পদ্ধতি পেশ করা।

আপনি যদি ধার্মিক হন ,তবে আপনার ধর্মের প্রতি আপনার একটা কর্তব্য আছে। একজন মুক্ত মানুষেরও মানবতা মুক্তি সাধনের ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে । আপনি আপনার সময়ের সাক্ষী হোন ,সত্য আর মিথ্যার সংঘাতের সাক্ষ্য বহন করুন। যখনই আমাদের শহীদরা সাক্ষ্য দিয়েছেন (শাহাদাতের মাধ্যমে ) তারা হয়েছেন জ্ঞাত ,জীবন্ত ও চিরঞ্জীব। তারা হচ্ছেন (সত্যের ) এক নমুনা এবং সত্য ও মিথ্যার এবং মানবতার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সাক্ষ্যদাতা ।

একজন শহীদকে এতসব বরণ করে নিতে হয়। প্রত্যেক বিপ্লবেরই এ দু টি দিক রয়েছে : রক্ত আর বাণী । প্রত্যেক ব্যক্তি যে সত্যকে গ্রহণ করার দায়িত্ব মেনে নিয়েছে ,যে জানে শিয়াদের দায়িত্ব গ্রহণের অর্থ কী ,যে মানবতার মুক্তি উপলদ্ধি করতে পারে ,তাকে অবশ্যই জানতে হবে ইতিহাসের চিরস্থায়ী যুদ্ধ সম্পর্কে ,সর্বত্র যা সর্বস্থানে চলছে- এ যুদ্ধে প্রতিটি স্থানই কারবালা ,প্রতিটি মাসই মুহররম ,প্রতিটি দিনই হচ্ছে আশুরা । এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এটা ঠিক করে নিতে হবে রক্তদান ও বাণী প্রচারের মধ্যে কোনটি সে বেছে নেবে। হযরত হোসাইন (আ.) অথবা যায়নাব এ দু জনের একজন হতে হবে । হযরত হোসাইন (আ.) -এর মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে অথবা যায়নাব এর মতো বেচে থাকতে হবে । যদি সে জিহাদের ময়দানে অনুপস্থিত থাকতে না চায় এবং নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করতে চায় তবে তাকে হযরত হোসাইন (আ.) -এর মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে অথবা যায়নাব -এর মতো বেচে থাকতে হবে । যারা মৃত্যুবরণ করেছেন (শহীদ হয়েছেন) তারা একটি হোসাইনী কার্য সম্পাদন করেছেন । যারা বেচে আছেন তাদের অবশ্যই যায়নাবী (যায়নাবের মতো) কাজ করতে হবে । তা করা না হলে তারা হবে ইয়াযীদ ।

*অনুবাদ :মুহাম্মদ আবুল হোসেন মাহমুদ