30 নং প্রশ্ন : শোকানুষ্ঠানের দর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করা যুক্তিসঙ্গত কি ?
উত্তর : প্রকৃতপক্ষে বাহির থেকে কোন বিষয়ের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা বর্তমান সময়ের মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । নতুন এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে যদি কোন ব্যক্তি বাহির থেকে শোকানুষ্ঠানের বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করে ও একে বিশ্লেষণ করে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত এর সপক্ষে তার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা না পায় অথবা অন্তত এটি তার বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয় তা অনুধাবন করে ততক্ষণ শোক পালনের বিষয়টি গ্রহণ এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না ।
বিষয়সমূহের প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ভালো । কেননা ,তা ইসলামী ও শিয়া সংস্কৃতি গঠনকারী শিক্ষার উপাদানসমূহের ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞানের ভিত্তিসমূহকে শক্তিশালী করে । আর এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে ,এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ মানুষের ঈমানকেও আরো দৃঢ় ও উন্নত করবে । কেননা ,ঈমান জ্ঞান ও জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হয় । এ কারণেই যদি শোক পালন করার বিষয়ের গ্রহণযোগ্য বর্ণনা ও যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এ সম্পর্কে যুবক ও নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসের ভিত্তি শক্তিশালী হবে ।
আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালনের দর্শন ও উপকারিতা
31 নং প্রশ্ন : আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালনের দর্শন কী ও এর কী উপকারিতা রয়েছে ?
উত্তর : শোক পালন করার দর্শন নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে খুঁজে পাওয়া সম্ভব :
ক
ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ :
কোরআন ও রেওয়ায়াত রাসূল (সা.)-এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসাকে আবশ্যক করেছে ।
এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে ,ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের কিছু প্রয়োজনীয় শর্ত রয়েছে । নিষ্ঠার সাথে ভালোবাসাকারী ব্যক্তি তিনিই হবেন যিনি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার শর্ত যথাযথ পূরণ করেন । বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ,তাদের সুখ ও দুঃখের সময় সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা ।
এ কারণেই হাদীসে আহলে বাইতের সুখে ও আনন্দে আনন্দ অনুষ্ঠান পালন এবং দুঃখের সময় সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের ওপর অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ।
হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে :
یفرحون لفرحنا و يحزنون لحزننا
‘
(আমাদের শিয়ারা) আমাদের সুখে সুখী ও আমাদের দুঃখে দুঃখী হয় ।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :
شیعتنا جزء منا خلقوا من فضل طینتنا یس و ؤهم ما یس ؤنا و یس رّهم ما یس رّنا
‘
আমাদের শিয়ারা আমাদেরই অংশ ,আমাদের মাটির অতিরিক্ত অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ;যা আমাদেরকে ব্যথিত ও আনন্দিত করে ,তা তাদেরকেও ব্যথিত ও আনন্দিত করে ।’
এছাড়াও ,আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিগত ও ধর্মীয় দায়িত্ব যে ,আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশের দিনগুলোতে অশ্রু বিসর্জন ও আহাজারির মাধ্যমে নিজেদের শোক ও দুঃখকে প্রকাশ করা এবং দুঃখিত ও ব্যথিত ব্যক্তির মতো কম খাওয়া ও কম পান করা ।
পোশাকের দিক থেকে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যে সকল পোশাক রং এবং পরিধানের ধরনের দিক থেকে শোক ও দুঃখের প্রকাশ ঘটায় সেগুলো পরিধান করাই বাঞ্ছনীয় ।
খ
মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধ তৈরির দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ :
যেহেতু শিয়া সংস্কৃতিতে শোক প্রকাশ অবশ্যই জ্ঞান ও পরিচিতির ভিত্তিতে হওয়া অপরিহার্য ,সেহেতু শোকানুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো সম্মানিত ইমামদের সাথে একাত্মতা ও সমবেদনা প্রকাশ করা ,তাঁদের মর্যাদা ,গুণ এবং আদর্শের স্মরণ করা । প্রকৃতপক্ষে এ কাজটি মানুষকে তাঁদের নিকট থেকে আদর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে ।
যে ব্যক্তি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সহকারে শোকের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও আবেগ-উদ্দীপনা এবং জ্ঞান ও হৃদয়ের অনুভূতির মধ্যে সমন্বয় ঘটে । এর ফলে তার ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় ও শক্তিশালী হয় । আর যখন সে শোকের অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসে তখন একজন কর্মতৎপর অগ্রগামী প্রেমিকে পরিণত হয় ,যে নিজের মধ্যে প্রেমাস্পদের পূর্ণতার গুণাবলি সৃষ্টির জন্য সংকল্পবদ্ধ ।
গ
সমাজ গঠনের দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ :
যেহেতু শোকানুষ্ঠান পালন প্রকৃত মানুষ গড়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে সেহেতু এর ফলে মানুষের অন্তরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় যার প্রভাব সমাজে পড়ে এবং মানুষ সচেষ্ট হয় আহলে বাইতের আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ।
অন্য ভাষায় ,আহলে বাইতের প্রতি শোক প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে একটি মাধ্যম যা আমাদেরকে তাঁদের আদর্শ রক্ষা ও বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে । এ কারণেই বলা যায় যে ,শোক প্রকাশের একটি দর্শন হলো ইসলামের আদর্শ অনুসারে সমাজ গঠন করা ।
ঘ
শিয়া সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর :
কেউ এ চরম সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারবে না যে ,নতুন প্রজন্ম শিশুকাল থেকেই শোক প্রকাশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আহলে বাইতের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয় । প্রকৃতপক্ষে শোকানুষ্ঠান পালন ইমামদের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শিক্ষা ও আদর্শকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট স্থানান্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । শোকানুষ্ঠান পালন ,এর ধরন ও বিষয়বস্তুর কারণে এটি আহলে বাইতের বাণী এবং কর্মের সাথে পরিচিত হওয়া এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা ও গড়ে তোলার সবচেয়ে উত্তম পথ ।
32 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের দর্শন কী ?
উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে মানুষ ও সমাজ গড়া এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিকট আশুরা সংস্কৃতির উপাদানগুলো পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি শক্তিশালীভাবে বিদ্যমান । কেননা ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ও প্রশিক্ষণমূলক রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শিক্ষা মানুষ এবং সমাজের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে মৌলিক অবদান রেখেছে । কারবালার ঘটনার মূল উপাদান আশুরা ও শিয়া সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে যা শোকানুষ্ঠানের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট স্থানান্তরিত হয় ।
আশুরার ঘটনা বর্ণনা ও এ সম্পর্কিত আলোচনা ও স্লোগানগুলোর মধ্যে মানুষ ও সমাজ এবং বিপ্লবী সংস্কৃতি তৈরির মূল উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইবাদত ,ত্যাগ ,বীরত্ব ,আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ,ধৈর্য ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ,ইয়াযীদী শাসনের অধীনে ইসলামের ধ্বংস ,ইয়াযীদীদের মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত গ্রহণ নিষিদ্ধ ,অপমানের চেয়ে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ ,পরীক্ষার ময়দানে সত্যপথ অবলম্বনকারীদের স্বল্পতা ,অবৈধ ও বাতিল শাসকের সময়ে শাহাদাত কামনার প্রয়োজনীয়তা ,শাহাদাত মানুষের জন্য সৌন্দর্য বলে গণ্য হওয়া ,অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ব ,সত্য ও সঠিক ইমামের বৈশিষ্ট্য ,আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর সন্তুষ্ট থাকা ,সত্য সংগ্রামে শাহাদাতকামীদের সহযোগিতা করা ,ঈমানদার ,জ্ঞানী ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য অপমান সহ্য করা নিষিদ্ধ হওয়া ,মৃত্যুকে চিরস্থায়ী বেহেশতে প্রবেশের সাঁকো হিসেবে গণ্য করা ,সত্য প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সবসময় সকল মানুষের কাছে সহযোগিতা কামনা করা এবং এ ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সাহসী হওয়া ।
হোসাইনের আচরণ দুনিয়াকে স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছে
হোসাইনের চিন্তা-চেতনা মানুষের অন্তরে সাহসের বীজ বপণ করেছে ।
যদি তুমি পৃথিবীর কোন ধর্মে বিশ্বাসী না হও ,কমপক্ষে স্বাধীনচেতা মানুষ হও
এটি হোসাইন এর বিস্ময়কর বক্তব্য ।
অপমানের জীবন থেকে সম্মানের মৃত্যু উত্তম
এটি হোসাইন এর কণ্ঠ থেকে উত্থিত সুমিষ্ট সংগীত ।
এ ছাড়া নিচের বিষয়গুলো ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের দর্শনের অন্তর্ভুক্ত :
1. সকল যুগের অন্যায়-অত্যাচারীদের প্রতি এক ধরনের প্রতিবাদ
ও বিশ্বের মযলুমদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ।
2. মানুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনুভূতিকে প্রবল ও অত্যাচারীদের অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রবণতাকে শক্তিশালী করা ।
3. মুসলিম সমাজকে সত্যের প্রতিরক্ষায় উদ্বুদ্ধ ও বিজয়ী করার জন্য প্রস্তুত করা ।
রেওয়ায়াতে শোক প্রকাশ
33 নং প্রশ্ন : আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালন করার ক্ষেত্রে কোন রেওয়ায়াত রয়েছে কি ?
উত্তর : এ সম্পর্কে অনেক রেওয়ায়াত রয়েছে । আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশ করার বিষয়ে তিনটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করাকে যথেষ্ট বলে মনে করছি ।
1. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :
رحم الله شیعتنا، شیعتنا والله هم الم ؤمنون فقد والله شرکونا فی المصیبة بطول الحزن و الحسرة
‘
আল্লাহ আমাদের শিয়া ও অনুসারীদেরকে রহমত ও দয়া করুন । আল্লাহর শপথ ,আমাদের অনুসারীরাই হলো ঈমানদার যারা তাদের দীর্ঘ দুঃখণ্ডশোক প্রকাশ ও অনুশোচনা দ্বারা আমাদের ওপর আপতিত মুসিবতে অংশীদার হয় ।’
2. ইমাম রেযা (আ.) বলেন :
من تذکر مصابنا و بکی لما ارتکب مناکان معنا فی درجتنا یوم القیامه ومن ذکر بمصابنا فبکی وابکی لم تبك عینه یوم تبکی العیون ومن جلس مجلسا يحیی فیه امرنا لم یمت قلبه یوم تموت القلوب
‘
যে আমাদের মুসিবতকে স্মরণ করে ও আমাদের ওপর যে যুলুম ও অত্যাচার হয়েছে তার জন্য ক্রন্দন করে কিয়ামতের দিন সে আমাদের সাথে থাকবে ;আমাদের যে সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে তা লাভ করবে । যে ব্যক্তি আমাদের মুসিবতসমূহকে বর্ণনা করবে অতঃপর নিজে ক্রন্দন করবে এবং অন্যকে কাঁদাবে ,কিয়ামতের দিনে তার (ইমামদের শোকে ক্রন্দনকারী) চোখ ব্যতীত সকল চোখ ক্রন্দনরত অবস্থায় থাকবে । যে আমাদের নির্দেশের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ,তার অন্তর সেদিন জীবিত থাকবে যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে ।’
3. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ফুদাইলকে বলেছেন :
تجلسون و تَدثون؟ قال: نعم جعلت فدا ك، قال: ان تلك المجالس احبها فاحیوا امرنا یا فضیل، فرحم الله من احیی امرنا یا فضیل من ذکرنا اوذکرنا عنده فخرج من عینه مثل جناح الذباب غفرالله له ذنوبه لو کانت اکثر من زبدالبحر
‘
তোমরা কি (আমাদের কথা স্মরণ করে শোকানুষ্ঠান পালন করার উদ্দেশ্যে) একসঙ্গে বস এবং (আমাদের ওপর যা বিপদ-মুসিবত আপতিত হয়েছে তা নিয়ে) আলোচনা কর ? ফুদাইল বললেন :‘
জী ,অবশ্যই ,আপনার জন্য আমি উৎসর্গিত!’
ইমাম (আ.) বললেন :‘
এ ধরনের শোকানুষ্ঠানকে আমরা পছন্দ করি । অতঃপর হে ফুদাইল! আমাদের নির্দেশকে বাস্তবায়ন কর । যারা আমাদের নির্দেশের বাস্তবায়ন করে তারা আল্লাহর দয়া ও রহমতের অন্তর্ভুক্ত হয় । হে ফুদাইল! যে কেউ আমাদেরকে স্মরণ করবে ও যার নিকট আমাদের স্মরণ করানো হবে এবং তাতে কারো চোখ থেকে মাছির পাখার সমপরিমাণেও অশ্রু ঝরবে ,আল্লাহ তার সকল গুনাহকে ক্ষমা করে দেবেন ,যদিও তার গুনাহের পরিমাণ সাগরের ফেনার থেকেও অধিক হয় ।’
শোক প্রকাশের ইতিহাস
34 নং প্রশ্ন : ইমাম (আ.)-দের জীবদ্দশায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক পালনের কোন নজির আছে কি ?
উত্তর : ইমামদের জীবদ্দশায় শোক পালনের নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে যার কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হলো :
ঐতিহাসিক ইয়াকুবি তাঁর‘
তারীখ’
গ্রন্থে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার অঝরে ক্রন্দনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন । উম্মুল মুমিনীন বলেন :“
যেদিন হোসাইন শহীদ হন আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে ধূলি ধুসরিত ও শোকে মূহ্যমান অবস্থায় দেখলাম । আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম :‘
হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এ অবস্থা কেন ?’
তিনি বললেন :‘
আমার সন্তান হোসাইন ও তার আহলে বাইতকে আজ শহীদ করা হয়েছে । আমি এইমাত্র তাদের দাফন সম্পন্ন করে আসলাম ।’
1. শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য বনি হাশেমের শোক প্রকাশ :
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে :‘
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বনি হাশেমের কোন নারী সুরমা ও মেহেদী ব্যবহার করে নি এবং বনি হাশেমের কোন ঘর থেকে খাবার রান্না করার চিহ্ন হিসেবে উনুন থেকে কোন ধোঁয়া বের হতে দেখা যায় নি ,যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে যিয়াদ নিহত ও ধ্বংস হয় । কারবালার মর্মান্তিক ও রক্তাক্ত ঘটনার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাদের চোখে অশ্রু ছিল ।’
2. ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
‘
তীব্র শোক ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে ,তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ক্রন্দনময় । তিনি তাঁর পিতা শহীদদের নেতার মুসিবতের জন্য সবচেয়ে বেশি অশ্রু ঝরিয়েছেন । তাঁর ভাই ,চাচা ,চাচাতো ভাই ,ফুফু ও তাঁর বোনদের ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা স্মরণ করে তিনি অজ ¯ ধারায় ক্রন্দন করতেন । এমনকি যখন তাঁর সামনে পান করার জন্য পানি নিয়ে আসা হতো তখন তিনি পানি দেখে ক্রন্দন শুরু করে দিতেন এবং বলতেন :‘
কিভাবে পান করব যখন রাসূল (সা.)-এর সন্তানদের পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে ।’
আর তিনি বলতেন :‘
যখনই আমার দাদী ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তানের শাহাদাতের কথা স্মরণ হয় তখনই আমার কান্না পায় ।’
ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর অন্যতম সাহাবী যুরারাকে বলেছেন :‘
আমার দাদা আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) যখনই হোসাইন ইবনে আলী (আ.)-কে স্মরণ করতেন তখন এত বেশি ক্রন্দন করতেন যে ,তাঁর দাড়ি ভিজে যেত ও তার ক্রন্দন দেখে উপস্থিত ব্যক্তিরাও ক্রন্দন করত ।’
3. ইমাম বাকির (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
ইমাম বাকির (আ.) আশুরার দিন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন ও তাঁর ওপর মুসিবতের কথা স্মরণ করে ক্রন্দন করতেন । এ রকম কোন একটি শোকানুষ্ঠানে ইমাম বাকিরের উপস্থিতিতে কুমাইত নামক একজন কবি কবিতা পাঠ করেন । যখন কবিতা পাঠ করার এক পর্যায়ে এ অংশে এসে পৌঁছেন-قتیل بالطف
অর্থাৎ‘
তাফের ভূমিতে নিহত’
,ইমাম (আ.) এ অংশ শোনামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন :‘
হে কুমাইত! এই কবিতার পুরস্কার হিসেবে আমার কাছে কোন সম্পদ থাকলে তোমাকে পুরস্কৃত করতাম । কিন্তু তোমার পুরস্কার হিসেবে ঐ দোয়াটি করব যা রাসূল (সা.) হাস্সান ইবনে ছাবিত সম্পর্কে করেছেন । আর দোয়াটি হলো :‘
আমাদের আহলে বাইতের পক্ষ সমর্থন ও তাদের প্রতিরক্ষা করার জন্য যখনই পদক্ষেপ নেবে তখনই রুহুল কুদ্সের (পবিত্র আত্মার) সমর্থন ও সহায়তা লাভ করবে ।’
4. ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেন :“
যখনই পবিত্র মুহররম মাস আসত ,আমার পিতা ইমাম বাকির (আ.) আর হাসতেন না ;বরং দুঃখ ও শোক তাঁর চেহারাতে স্পষ্ট হয়ে উঠত । তাঁর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত । এভাবেই আশুরার দিন উপনীত হতো ,এই মুসিবতের দিনে ইমামের দুঃখ ও শোক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছত । তিনি বিরামহীনভাবে ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন :‘
আজকে এমন একটি দিন যে দিন আমার দাদা হোসাইন ইবনে আলী শাহাদাত বরণ করেছেন’
।”
5. ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
ইমাম রেযা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে ,তিনি বলেছেন :‘
যখন পবিত্র মুহররম মাস আসত তখন আমার পিতা মূসা কাযিম (আ.)-কে কেউ হাসতে দেখত না ;এভাবে চলতে থাকত আশুরার দিন পর্যন্ত ;এ দিনে দুঃখণ্ডশোক ,মর্মপীড়া-মুসিবত আমার পিতাকে ঘিরে ধরত ;তিনি ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন :‘
এ দিনে হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করা হয়েছে ।”
6. ইমাম রেযা (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
ইমাম রেযা (আ.)-এর ক্রন্দন এত বেশি পরিমাণ ছিল যে ,তিনি বলতেন :‘
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতের দিন আমাদের চোখের পাতাকে আহত করেছে ,আমাদের অশ্রুধারা প্রবাহিত করেছে ।’
বিশিষ্ট শিয়া কবি দেবেল খুজায়ী ইমাম রেযার নিকট আসলেন । ইমাম রেযা ইমাম হোসাইনের জন্য ক্রন্দন ও শোকের কবিতার গুরুত্ব তুলে ধরে বললেন :‘
হে দেবেল! যে ব্যক্তি আমার দাদার মুসিবতে ক্রন্দন করে আল্লাহ তা‘
আলা তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেন ।’
অতঃপর তাঁর পরিবার ও উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে পর্দা টেনে দিলেন যাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতে তাঁরা ক্রন্দন করতে পারেন ।
অতঃপর ইমাম রেযা (আ.) দেবেল খুজায়ীকে বললেন :‘
যতদিন জীবিত থাকবে ইমাম হোসাইনের জন্য শোকগাথা পাঠ কর । যতক্ষণ তোমার শারীরিক শক্তি থাকবে ততক্ষণ আমাদেরকে সহযোগিতা করতে কার্পণ্য কর না ।’
এ কথা শুনে দেবেল খুজায়ী ক্রন্দনরত অবস্থায় একটি কবিতাটি পাঠ করেছিলেন যার বিষয়টি ছিল এমন:
হে ফাতিমা! যদি হোসাইনকে কারবালার যমিনে পড়ে থাকতে দেখতেন ;যিনি ফুরাত নদীর তীরে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন । তখন অত্যধিক দুঃখ ও কষ্টের কারণে নিজের হাত দিয়ে মুখ চাপড়াতেন এবং আপনার গাল দিয়ে চোখের পানি প্রবাহিত হতো ।’
এ কবিতা শুনে ইমাম রেযা (আ.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করলেন ।
7. ইমাম মাহদী (আ.)-এর শোক প্রকাশ :
রেওয়ায়াত অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.) (আল্লাহ তাঁর আগমনকে ত্বরান্বিত করুন) আত্মগোপনকালীন এবং আত্মপ্রকাশের পর উভয় অবস্থায় তাঁর দাদার শাহাদাতের জন্য ক্রন্দন করছেন এবং করবেন । তিনি তাঁর সম্মানিত পিতামহ শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন :
فلئن اخرتنی الدهور و عاقنی عن نصرك المقدور ولم اکن لمن حاربك محارباً و لمن نصب لك العداوة مناصبا فلاندبنك صباحاً و مساء ولابکین لك بدل الدموع دما، حسرة علیك و تأسفاً علی ما دهاك
‘
যদিও সময় আমাকে পশ্চাদ্বর্তী করেছে এবং আপনাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভাগ্য আমাকে দূরে রেখেছে যে কারণে আপনার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করতে পারি নি ,কিন্তু এখন প্রত্যেক সকাল-সন্ধ্যা আপনার জন্য ক্রন্দন করি এবং আপনার মুসিবতে আমার দু’
চোখ থেকে অশ্রুপাতের বদলে রক্ত বর্ষিত হয় । আপনার ওপর ঘটে যাওয়া মুসিবত আমার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছে ।’
35 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান সাফাভীদের সময় থেকে চালু হয়েছিল কি ?
উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান তাঁর শাহাদাতের সময় থেকে চালু হয়েছিল ,তবে আলে-বুইয়া বংশ ক্ষমতায় আসার (352 হিজরি) পূর্ব পর্যন্ত এই শোকানুষ্ঠান গোপনে অনুষ্ঠিত হতো ।
চতুর্থ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান প্রকাশ্য ছিল না ;বরং গৃহসমূহে গোপনে পালিত হতো । কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শোকানুষ্ঠান অলিতে-গলিতে সর্বত্র প্রকাশ্যে পালিত হতো । সাধারণতভাবে মুসলিম ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে যাঁরা সারা বছরের বিভিন্ন ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা 352 হিজরি ও তার পরবর্তী বছরগুলোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আশুরার দিনে শিয়াদের শোকানুষ্ঠান পালন সম্পর্কে লিখেছেন । এদের মধ্যে ইবনে জাওযির‘
মুনতাজেম’
,ইবনে আসিরের‘
কামিল’
,ইবনে কাসিরের‘
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’
,ইয়াফেয়ীর‘
মিরআতুল জিনান’
গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য ,এছাড়াও যাহাবী ও আরো অনেকে এ সম্পর্কে লিখেছেন ।
ইবনে জাওযি বর্ণনা করেছেন : 352 হিজরিতে মুইয্যুদ্দৌলা দায়লামী জনগণকে আশুরার দিনে একত্র হয়ে শোক প্রকাশের নির্দেশ দেন । এ দিনে বাজারগুলো বন্ধ থাকত ,কেনা-বেচা হতো না ;কসাইরা ভেড়া ,দুম্বা জবাই করত না ,হালিম রান্না করত না । জনসাধারণ পানি পান করত না ,বাজারগুলোতে তাঁবু টাঙ্গানো হতো ও শোক প্রকাশের নিয়ম অনুসারে তাঁবুগুলোতে চট ঝুলানো হতো ,নারীরা তাদের মাথা ও মুখ চাপড়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ করতেন ।
হামাদানীর বর্ণনা অনুসারে : এদিনে নারীরা অগোছালো চুলে শোক প্রকাশের প্রথা অনুযায়ী নিজেদের চেহারাকে কালো করত ও গলিতে পথ চলত এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে নিজেদের চেহারায় আঘাত করত ।
শাফেয়ীর বর্ণনা অনুসারে : প্রথম বারের মতো কারবালার শহীদদের জন্য প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের ঘটনা ছিল এটা ।
ইবনে কাসির 352 হিজরির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে ,সুন্নিরা শিয়াদের এ কাজে বাধা দিত না । কেননা ,শিয়ারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং সরকারও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করত ।
352 হিজরি থেকে পঞ্চম হিজরি শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত আলে বুইয়া শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল । এ সময়ে বেশির ভাগ বছরগুলোতে উল্লিখিত রীতি অনুসারে সামান্য পরিসরে হলেও শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো । যদি আশুরার দিন ও ইরানী নববর্ষ বা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসীদের শরৎকালীন ফসলী নববর্ষের প্রাচীন উৎসব একই সময়ে পড়ত ,সেক্ষেত্রে আশুরার সম্মানে প্রাচীন নববর্ষের আনন্দ উৎসবকে দেরিতে উদ্যাপন করত ।
এই বছরগুলোতে ফাতিমী ও ইসমাইলী সম্প্রদায় সবেমাত্র মিশরে ক্ষমতা দখল করে কায়রো শহরকে নির্মাণ করেছিল এবং তারাই আশুরার শোকানুষ্ঠানকে মিশরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল । মাকরিজীর লিখিত দলিল অনুসারে : 363 হিজরির আশুরার দিনে শিয়াদের একটি দল প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ইমাম হাসান (আ.)-এর এর দুই কন্যাসন্তান সাইয়্যেদা কুলছুম ও সাইয়্যেদা নাফিছার দাফনস্থলে যেতেন এবং এই দু’
টি পবিত্র স্থানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকগাথা পাঠ ও ক্রন্দন করতেন (এই বাক্য থেকে স্পষ্ট হয় যে ,উল্লিখিত অনুষ্ঠান এর পূর্বের বছরগুলোতেও যথারীতি প্রচলিত ছিল) । ফাতিমীদের শাসনকালে আশুরার অনুষ্ঠান যথারীতি প্রতি বছর পালিত হতো । এ কারণে বাজারগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হতো ;জনসাধারণ সমবেত হয়ে কারবালার শোকাবহ কথা স্মরণ করে শোকগাথা পাঠরত অবস্থায় কায়রোর জামে মসজিদে যেত ।
এর পরে মিশরে শিয়াদের বিচ্ছিন্নতা ও সমাজের সাথে সংশ্রবহীনতার কারণে শোকানুষ্ঠান অতটা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হতো না । যদিও শোকানুষ্ঠান আলে বুইয়ার শাসকদের পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তম ছিল । কিছু সূত্র থেকে প্রমাণিত হয় ইরানের সাফাভী শাসনের প্রতিষ্ঠার পূর্বেও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো ।
বিশেষ ভাবে কাশেফীর গ্রন্থ‘
রওজাতুশ শুহাদা’
র বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । ইরানের সাফাভীদের আমলে শিয়া মাযহাবের প্রসারের কারণে শোকানুষ্ঠান সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও প্রকাশ লাভ করে ।
শিকল মারা ও বুক চাপড়ানো এবং তাজিয়ার উৎপত্তি
36 নং প্রশ্ন : শিকল মারা ও বুক চাপড়ানো
এবং তাজিয়া কোন্ জাতি এবং কোন্ সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি ঘটেছে ?
উত্তর : শিকল মারার সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তান থেকে ইরানে এসেছে । সেখানে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এমনভাবে শিকল দিয়ে নিজেকে আঘাত করে শোক প্রকাশ করে যে ,তাদের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি ও রক্ত বের হয় । এ কারণে কিছুসংখ্যক আলেম এ বিষয়টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন । যদি এ বিষয়টি এমনভাবে পালন করা হয় যেখানে শরীরে কোন ক্ষত সৃষ্টি হবে না ও বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে তা অপছন্দনীয় নয় অথবা তা আশুরার শিক্ষার অবমাননার কারণ না হয় তাহলে এ ধরনের শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই । যেহেতু ইরানের জনগণ বিশেষভাবে শিকল মারার ক্ষেত্রে শোক প্রকাশের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা রক্ষা করে চলে সেহেতু এ ধরনের শোক প্রকাশ প্রচলিত রয়েছে ।
‘
বুক চাপড়ানো’
শোক প্রকাশের একটি প্রথা হিসেবে পূর্ব থেকে আরবদের মাঝে প্রচলিত ছিল এবং পরে এই বিষয়টি সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে । গুরুগম্ভীর শোক-গাথা পাঠের সাথে বিশেষ ছন্দে বুক চাপড়িয়ে শোকপ্রকাশ প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত ছিল ,কিন্তু পরে যখন সাফাভীদের সময় প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের প্রসার ঘটেছিল তখন শোকানুষ্ঠান ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিক ও সামাজিক রূপ লাভ করেছিল ।
তাজিয়া (تعزیه
)-পারিভাষিক অর্থে আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে অভিনয়ের মাধ্যমে চিত্রায়ন করাকে বোঝায় । প্রথম করিম খাঁন যান্দ এবং সাফাভীদের শাসনকালে বাহ্যত ইরানে এ ধরনের শোক প্রকাশের প্রচলন ঘটে এবং তা নাসির উদ্দিন শাহের সময় ব্যাপক প্রসার লাভ করে । ইউরোপ সফরে গিয়ে নাসির উদ্দিন শাহ থিয়েটার বা মঞ্চ নাটক দেখেছিলেন । তিনিই পরবর্তীকালে অন্যদেরকে আশুরার ঘটনাকে বাস্তব রূপ দানের উদ্দেশ্যে নাট্যরূপে উপস্থাপনে উৎসাহিত করেছিলেন । স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,তাজিয়া (অভিনয়ের মাধ্যমে কারবালার ঘটনাকে চিত্রায়িত করা) শুধু ইরানের সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত ছিল না ,অন্যান্য মুসলিম দেশ ও শিয়া অঞ্চলেও এ সংস্কৃতির প্রচলন ছিল । বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস ও বিভিন্ন উপকরণ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা করা হতো । বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে এ ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ছিল ।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের উপকরণ হিসেবে এক বা কয়েক ব্যক্তি কর্তৃক ভারী লৌহদণ্ডের ওপর লৌহ নির্মিত ময়ূর বহনের আচারটি বিভিন্ন আশুরা উদ্যাপন কমিটি পালন করে থাকে । এ ধরনের উপকরণ কাজার বংশের শাসনামলে ইরান ও ইউরোপের সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আচার থেকে গ্রহণ করা হয়েছে । এ উপকরণে এমন কিছু বিষয়ের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোক প্রকাশকারীকে শোক প্রকাশের মূল লক্ষ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ।
37 নং প্রশ্ন : ইসলামের শুরুতে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতিগুলোর প্রচলন ছিল না সেগুলোকে ইসলামে প্রচলন করা এক ধরনের বেদআত সমতুল্য নয় কি ?
উত্তর : প্রথমত ,স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের ধরন স্বয়ং শোক প্রকাশ করা থেকে ভিন্ন এক বিষয় । প্রকৃতপক্ষে শোক প্রকাশের বিষয়টি ভিন্নভাবে ও পদ্ধতিতে প্রকাশ লাভ করতে পারে । তাই শোক প্রকাশের পদ্ধতি এক্ষেত্রে একটি উপকরণ বা মাধ্যম ছাড়া অন্য কিছু নয় ।
দ্বিতীয়ত ,শোক প্রকাশের উপকরণ বা মাধ্যম ও পদ্ধতি অবশ্যই শোক প্রকাশের মূল লক্ষ্য ও এর বার্তার সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে অর্থাৎ তার প্রকাশ এমনভাবে হতে হবে যে ,সাবলীল ,কার্যকর ও উত্তম রূপে আশুরার বার্তাকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে । অন্যভাবে বলা যায় যে ,যদি আশুরার শিক্ষাকে একজন ব্যক্তির গায়ের জামার সাথে তুলনা করা হয় তাহলে এমন একটি জামা হতে হবে যা কোন ব্যক্তির গায়ের সাথে মানানসই হয়-যেন ছোট বা বড় না হয় । যদি ছোট হয় তাহলে সমস্ত শরীরকে ঢেকে রাখবে না অর্থাৎ আশুরার সকল বার্তাকে পৌঁছাবে না । আর যদি জামাটি বড় হয় তাহলেও বার্তাগ্রহণকারীদের বিচ্যুত করবে ও বাস্তবতা অনুধাবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবে ।
তৃতীয়ত ,আশুরার প্রকৃত বার্তা প্রচার ও প্রসারের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার পছন্দনীয় উপকরণ
ও উপাদান থেকে উপকৃত হতে হবে ও এগুলো ব্যবহার করতে হবে । যেমন ভারতে ইসলাম ধর্মকে প্রচারের জন্য উর্দু ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা দর্শনশাস্ত্রকে গ্রীক সভ্যতা থেকে গ্রহণ করে ওহীর শিক্ষার প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে...
চতুর্থত ,ইসলাম ইসলামের মৌলিক বিষয়বস্তুর সাথে সংঘর্ষিক না হওয়া শর্তে সকল জাতির মধ্যে প্রচলিত রীতি ও প্রথাকে সম্মান দেখায় । এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না । উদাহরণস্বরূপ ,ইসলাম সকল জাতির ভাষা ,পোশাক-আশাক ,খাদ্যাভ্যাস ,বিজ্ঞান ,শিল্পকলা ইত্যাদিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে ,যদি না এর মৌলিক বিশ্বাস ও সারসত্তার পরিপন্থী হয় ।
ওপরে উল্লিখিত বিষয় অনুসারে ,ইসলামের দৃষ্টিতে আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশ বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতিতে প্রচলিত থাকতে ও বাস্তবায়িত হতে পারে যতক্ষণ না তা আশুরার সত্যিকার বার্তাকে পৌঁছানোর পথে বাধা সৃষ্টি করে ;বরং তা ভালোমত শ্রোতার মন-মগজে পৌঁছাতে সাহায্য করে । এ কারণেই শোক প্রকাশের এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার-যেগুলো ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ছিল না (যেমন শিকল মারা ,বুক চাপড়ানো ,তাজিয়া) সেগুলো বেদআত তো নয়ই বরং ইসলামের প্রচার-প্রসারে সাহায্যকারী হিসেবে গণ্য হবে ;এগুলো নিজের গণ্ডির মধ্যে আশুরার বাণীকে বর্তমান সময়ের মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছে এবং তাদের অন্তরকে বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেছে ।
আবারো গুরুত্ব আরোপ করছি যে ,এগুলো উপকরণ ছাড়া অন্য কিছুই নয় । অবশ্যই সবসময় এ বিষয়গুলোকে উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে সীমানা রক্ষা করে চলতে হবে । আল্লাহ না করুন ,কেউ যেন কোন বিষয়ের
উপকরণ বা মাধ্যমকে আসল বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দান না করে । উপকরণ ও মাধ্যম কেবল একটি ব্রিজের মতো যা দিয়ে আসল বিষয়ে পৌঁছানো সম্ভব এবং এগুলো কখনই প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে পারে না । দুঃখের বিষয় যে ,এ ক্ষেত্রে অনেকে অজ্ঞতাবশত বাহ্যিক রূপ ও আচারকে অভ্যন্তরীণ সারসত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃত বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে যায় ।
38 নং প্রশ্ন : কেন অন্য ইমামদের জন্য শোক প্রকাশ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের মতো নয় ?
উত্তর : এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে আশুরার ঘটনার পরিমাণ ও গুণগত বিস্তৃতির (গভীর প্রভাবের) কারণে ঘটেছে । একদিকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সময় মুসলমান ও ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজমান বিশেষ অবস্থা ,তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অবস্থা ও তাদের অত্যধিক যুলুম এবং সার্বিকভাবে মানবতা ও স্বাধীনতা হরণ ও ইসলাম সংকটাপন্ন হওয়া ,মুসলিম উম্মাহর অবমাননা ,সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা ,শিয়াদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া ,ধর্মে বেদআতের প্রবেশ ও প্রচার করা ,মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী ঐক্য বিনষ্ট করা ,ইসলামী ও মানবীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়া ইত্যাদি কারণ (যা ইসলামের লক্ষ্য ও গতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে দিয়েছিল । তাই এ অবস্থাকে পূর্বের পথে ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল) ,অপর দিকে কারবালায় আবু আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর মাযলুমিয়াত (অন্যায় ও নিপীড়নের শিকার হওয়া) ও একাকিত্ব ,ইমামের সাথে বন্ধু বেশধারী মুসলমানদের আচরণ ,যুদ্ধের ধরন (অসম যুদ্ধ ও সীমাহীন অনাচার ও চরম নৃশংসতার পরিচয় দান) ,ইমাম ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীদের সাথে শারীরিকভাবে অবমাননাকর আচরণ এবং সেসাথে কারবালার ঘটনায় বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক ,রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণমূলক যে অফুরন্ত শিক্ষা রয়েছে সে দিক থেকে এ শোক প্রকাশ স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্নতার দাবি রাখে ।
এই ঘটনার বিশেষ ধরন ও ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন জটিলতা উন্মোচনকারী ভূমিকা ও গভীর তাৎপর্যের কারণে গবেষকদের অনেক প্রশ্নের উদ্রেক ও সমাধান দান করেছে । ফলে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে ।
হযরত রাসূল (সা.) ,ইমাম আলী (আ.) ,হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) ,ইমাম হাসান (আ.) ও অন্য ইমামগণ (আ.) ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত ও কারবালার ঘটনার অনুপম ও অতুলনীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একে শোকানুষ্ঠানের ছাঁচে উজ্জীবিত রাখার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।
আশুরার ঘটনার ভিন্ন দিক একে ঐতিহাসিক নজিরবিহীন ঘটনায় পরিণত করেছে । একারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :
لا یوم کیومك یا ابا عبد الله
‘
হে আবা আবদিল্লাহ (হে হোসাইন)! আপনার (শোকের) দিনের মতো কোন (দুঃখজনক) দিন নেই ।’
এ বিষয়টি স্পষ্ট যে ,কোন ঘটনার প্রভাবের ব্যাপকতা ও গভীরতার ওপর ঐ ঘটনার সম্মান-মর্যাদা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে । এ দিক থেকে আশুরার ঘটনাটি এমন একটি ঘটনা যা পরিমাণ ,ব্যাপকতা ও গুণগত দিক থেকে অন্য কোন ঘটনার সাথে তুলনীয় নয় । তাই এর স্মরণও অনন্য ও অসাধারণভাবে হয়ে থাকে ।