ثار الله
এর অর্থ
প্রশ্ন নং 58 :ثار الله
শব্দের অর্থ কী ? ইমাম হোসাইন (আ.)-কে এ নামে অভিহিত করার সপক্ষে কোরআন ও হাদীসের কোন দলিল আছে কি ?
উত্তর :ثار
শব্দটিثأر
অথবাثؤرة
শব্দ মূল থেকে এসেছে । এর অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ ,রক্তের বদলা ,রক্তপণ ;রক্ত অর্থেও তা ব্যবহৃত হয় ।
1ثارالله
শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে ,যেগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো যে ,আল্লাহ্ তা‘
আলা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তের অভিভাবক এবং তিনি নিজেই শত্রুদের থেকে এই মহান ব্যক্তির রক্তের বদলা নিতে চান । কেননা ,কারবালায় সাইয়্যেদুশ শুহাদার রক্ত ঝরানো মহান আল্লাহর নিষিদ্ধের সীমা লঙ্ঘন ,তাঁর সম্মান বিনষ্ট করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল । সর্বোপরি আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন‘
আলুল্লাহ্’
অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত ও বিশেষজন ;এই ইমামদের রক্ত ঝরানোর অর্থ আল্লাহ তা‘
আলার কাছে সম্মানিত ও তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানো ।
যদিও এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়নি ,কিন্তু কোরআনের আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে ,আল্লাহ্ বলেছেন–
)
وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا(
অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় নিশ্চয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি । (সূরা বনি ইসরাঈল : 33)
যদি কেউ (যে কোন ধর্মের অনুসারী হোক) অন্যায় ও মযলুমভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা তার রক্তপণ আদায়ের অধিকার রাখে । যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.) সত্য ,ন্যায় এবং আল্লাহর পথে অসহায় ও মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন ,সেহেতু আল্লাহ নিজেই তাঁর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী । কেননা ,স্বয়ং আল্লাহ্ই ইমাম হোসাইনের রক্তের উত্তরাধিকারী ।
এই কারণেثأرالله
এই অর্থে ব্যবহৃত হয় যে ,ইমাম হোসাইনের রক্ত আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তিনি নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন । এই শব্দটা আল্লাহর সাথে সাইয়্যেদুশ শুহাদার সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে যে ,তাঁকে হত্যার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা‘
আলার সাথে সম্পৃক্ত ও তাঁর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হয়েছে । ফলে তাঁর রক্তের প্রতিশোধ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গ্রহণ করলে হবে না ।
2. যদিثار
শব্দটির অর্থ রক্ত হয় ,তাহলে অবশ্যইثار الله
শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ;বরং তা উপমা হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । কেননা ,এ বিষয়টি সুনিশ্চিত যে ,আল্লাহ কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নন যে ,তাঁর শরীর অথবা রক্ত থাকবে । অতএব ,এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপমা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে বুঝানো হয়েছে ,যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের ভূমিকা অর্থাৎ জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা । আল্লাহর দ্বীনের সাথে ইমাম হোসাইনের সম্পর্কও ঠিক সেরকম । আশুরা বিপ্লবই ইসলামকে পুনরায় জীবনদান করেছে ।
3. সম্ভবত এই ব্যাপারটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা বিভিন্ন রেওয়ায়াতের দলিলের ভিত্তিতে একটি ভালো ফলাফলে পৌঁছতে পারি । আলী (আ.)-কেও‘
আসাদুল্লাহ’
(আল্লাহর সিংহ) বা‘
ইয়াদুল্লাহ’
(আল্লাহর হাত) বলা হয়েছে ।‘
হাদীসে কুরবে নাওয়াফেল’
(নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ সংক্রান্ত হাদীস)-এ মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,আল্লাহ্ তা‘
আলা বলেছেন :‘
আমার বান্দা ওয়াজিবসমূহের থেকে অধিক পছন্দনীয় কিছু দ্বারা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না ,তদ্রূপ নফল দ্বারাও আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে । তখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে দেখে ,আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে কথা বলে ,আমি তার হাত হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে ধরে ,আমি তার পা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে পথ চলে ;যদি সে আমার দরবারে দোয়া করে আমি তা পছন্দ করি এবং যদি আমার কাছে কিছু চায় তবে তাকে তা দান করি ।’
এই রেওয়ায়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ,আল্লাহর ওলীরা হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর স্পষ্ট দলিল হিসেবে তাঁর কর্মের প্রকাশকারী । যেহেতু আল্লাহ নিরাকার সেহেতু তাঁর দেহ নেই ,কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন । তাঁর ওলীদের মাধ্যমেই নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটান এবং যখন তাঁর কোন বান্দাকে সাহায্য করতে চান তখন তাঁদের মাধ্যমেই তা করেন এবং ধর্মকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তিনি ঝরাতে চান তা তাঁর ওলীদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ঝরান । ঠিক যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তাঁর হাতকে সবার হাতের ওপর আল্লাহর কুদরাতী হাতের (ইয়াদুল্লাহ) নমুনাস্বরূপ রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তখন এ আয়াতيَدُ اللَّـهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ
অবতীর্ণ করেন ,তেমনি ইমাম হোসাইনের রক্তও‘
আল্লাহর রক্ত’
(ثارالله
) হিসেবে গণ্য হয়েছে । যিয়ারতে আশুরায় আমরা পড়ি :
السلام علیك یا ثار الله و ابن ثاره و الوتر الموتور
অর্থাৎ‘
হে আল্লাহর রক্ত ,তাঁর রক্তের সন্তান ,তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক । তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে নিঃসঙ্গ একাকী!’
তেমনিভাবে মরহুম ইবনে কুলাভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর 17 এবং 23 নং যিয়ারতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :
انک ثارالله فی الارض والدم الذی لا یدرک ترته احد من اهل الارض ولا یدرکه الا الله وحده
যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের জীবনসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে এবং রক্ত থাকা বা না থাকার ওপর তার জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে ,ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের উপস্থিতি আল্লাহর নিকট তাঁর ধর্মের জন্য তেমন ভূমিকা রাখে । যদি হযরত আলী (আ.) না থাকতেন তাহলে বদর ,উহুদ ,খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতো এবং ইসলাম টিকে থাকত না ;আর যদি ইমাম হোসাইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইসলামের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । কেননা ,আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের-যখন তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গী ভূমিকা রাখেন-প্রতি তাঁর ঐশী সাহায্য প্রেরণ করার মাধ্যমেই সকল যুগে তাঁর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন ।
হ্যাঁ ,যতদিন ইমাম হোসাইনের স্মৃতি জগরুক থাকবে ,তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে ,হোসাইনপ্রীতি মানুষের অন্তরে অন্তরে স্পন্দিত হবে ,তাঁর বেলায়াত ও প্রেমের শিখা মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবে ,‘
ইয়া হোসাইন’
আহাজারি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে ততদিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর নাম টিকে থাকবে । কেননা ,তিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন ,উৎসর্গ করেছেন । সত্যকে বিচ্যুতকারী মুনাফিকদের কুৎসিত চেহারা থেকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং মহানবীর খাঁটি ও প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন । আর তাই তাঁর রক্ত আল্লাহর রক্তের মর্যাদা পেয়েছে ।
আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ক্রন্দনের ভূমিকা
প্রশ্ন নং 59 : এরফান ও অধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ক্রন্দন-আহাজারিকে কিভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণের (আল্লাহর দিকে যাত্রা) সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে ?
উত্তর :
মনের দহন এবং ক্রন্দন :
একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে ঐকান্তিকতার সাথে ক্রন্দন ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এরূপ অনুভূতি সৃষ্টিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং সবসময় তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন । যদি তিনি প্রকৃতই সেটা অর্জনে ব্যর্থ হন অর্থাৎ শোকে মুহ্যমান হয়ে অশ্রু না ঝরাতে পারেন ,তবে অন্ততপক্ষে ঐকান্তিকতার সাথে কান্নার ভাব অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্ত হন ।
সর্বোপরি ইবাদতের পথপরিক্রমায় ইস্তিগ্ফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) সময়ই হোক অথবা যে কোন অবস্থায় ,ক্রন্দন ও দগ্ধ হৃদয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে । কখনই এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এবং এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় । হৃদয়ের দহন এবং ক্রন্দন ভালোবাসার কারণে হোক অথবা ভয়ে ,ইস্তিগফারের অবস্থায় হোক অথবা কোরআন পড়া অথবা শোনার সময় ,সিজদায় অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক ,অবশ্যই তা গভীর অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি লাভ করে । যে উপলব্ধি করতে পারে সেই দগ্ধ হয় ও অশ্রু ঝরায় আর যে উপলব্ধি করতে পারে না সে দগ্ধও হয় না এবং অশ্রুও ঝরায় না ।
সূরা বনি ইসরাঈলের 107-109 নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব ,এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ,যারা অনুধাবন করতে পারে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াতের সামনে বিনয়ী ও নম্র হয় এবং ক্রন্দন করে :
)
قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا (107) وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا (108) وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا(
“
(হে নবী) তুমি বল ,তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর না-ই কর ,নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে । তখন তারা বলে :‘
আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান ,অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে ।’
আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে ;(মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে ।”
একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মিক সাধককে এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য গভীরভাবে বোঝার উপদেশ দিচ্ছি ;কারণ ,এটা আল্লাহর মহা সত্যবাণী ।
যে কোন সুগভীর জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত এবং শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে পারবে ও অন্তরে তা বিশ্বাস করবে । প্রভুর অঙ্গীকারসমূহকে সুনিশ্চিতভাবে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে । ফলশ্রুতিতে তার বিনয় ,নম্রতা ও ঈমান অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে । ঐশী উৎসাহ ,উদ্দীপনা ,আকুলতা এবং আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা তার সমগ্র অস্তিত্বকে ছেয়ে ফেলবে । তখন তার চেষ্টা ও সাধনা আরো গতিশীল ও পূর্ণতা লাভ করবে । দারিদ্র ও দুনিয়াবিমুখতার পথ বেছে নেবে ,আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে ও দগ্ধ হৃদয়ে অশ্রু ঝরাবে । তার অন্তরের দহন ও নয়নের অশ্রু যেন আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় রয়েছে ।
যে মহাসত্য ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেনি সে যে নিজের জাহান্নাম নিজেই তৈরি করেছে-এবং তার মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে-তা অনুভব করতে পারেনি । সে তার অন্তরের ওপর যে পর্দা পড়েছে এবং যা পড়ার কারণে সে বিভিন্ন রূপ বিপদে পতিত হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি ।
বলে রাখা দরকার যে ,উল্লিখিত আয়াতে যে জ্ঞান এবং সূক্ষ্ণ দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-এবং ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ক্রন্দনকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে-তা শাস্ত্রীয় বা তাত্ত্বিক জ্ঞান নয় ;বরং অন্য এক জ্ঞান ও দর্শন । তা না হলে কত বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী আছেন যাঁরা শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই বিশেষত্ব নেই ।
সর্বাবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ এবং ক্রন্দন করা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী এবং আল্লাহর জ্ঞানে ধন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের বিশেষত্ব । পবিত্র কোরআন এটাকে নবিগণের-যাঁরা সকল আধ্যাত্মিক সাধক এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারীর শিক্ষক-বিভিন্ন গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে । সূরা মারইয়ামে আল্লাহর মনোনীত কিছুসংখ্যক বান্দা ও নবীকে তাঁদের বৈশিষ্ট্যসহকারে স্মরণ করা হয়েছে । তাঁদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :
)
أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا(
‘
এরা হচ্ছে আদমের বংশধর সেসব নবী যাদের প্রতি আল্লাহ তা‘
আলা অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের তিনি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর ,যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি এবং মনোনীত করেছি ,যখনই তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘
আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তখন এরা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত ।’
(সূরা মারইয়াম : 58)
)
إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(
অর্থাৎ যখন তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহর তা‘
আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত ।
এই অংশটি (আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াতের সময়) তাঁদের বিনয় ও নম্রতার সাথে সিজদা করা এবং ক্রন্দনের সংবাদ দেয় । তাঁদের এই কান্না আল্লাহর ভালোবাসায় হোক আর তাঁর ভয়েই হোক ।
এই আয়াতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে রহস্যময় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত । আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহর নির্বাচিত একদল নবীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেছেন ,এরাই হলো তাঁরা যাঁদের সম্পর্কে পূর্বে (এ সূরায় উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে) বলা হয়েছে । এরাই তাঁরা আল্লাহ যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন-
أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ
অতঃপর আয়াতের শেষে
)
إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(
এই বাক্যটি দ্বারা তাঁদের বিনয়ের সাথে মাথা নত করে অশ্রু ঝরানোকে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এটি এ সূক্ষ্ম ও গূঢ় রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে ,মহান আল্লাহ যাঁকেই বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁর সামনে মাথা নত করা এবং মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেন তা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ ,রহমত ও ফযিলত ।
হে ভাই! মনের হাসি ,দুঃখ ও কান্নার
প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা উৎসমূল ,
জেনে রাখ তায়
এও জেনে রাখ ,রয়েছে প্রতিটির স্বতন্ত্র ভাণ্ডার ও চাবি
রয়েছে যা এক মহা উন্মোচকের হাতের মুঠোয়
হাফেজ বলেন :
ভোর রাতের এত বেদনা ও ক্রন্দন
সবই জানি তোমার থেকে হে পরমজন!
কোরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-
)
وَمَن يُؤْمِن بِاللَّـهِ يَهْدِ قَلْبَهُ(
যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে পথ দেখিয়ে দেন ।
রাসূল (সা.)ও বলেছেন
:
قلب المؤمن بین اصبعین من اصابع الرحمن
মুমিনের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে অবস্থান করছে ।
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন
:
ان القلوب بین اصبعین من اصابع الله,یقلبها كیف یشاء,ساعة كذا,وساعة كذا
নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙ্গুলগুলোর দু’
টির মাঝে রয়েছে ;তিনি যেমনভাবে চান তা পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।
এই দুই রেওয়ায়াত থেকে প্রত্যেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টি বুঝতে পারে ।
প্রথম রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,ঐ ব্যক্তির অন্তর প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তা তাঁর রহমান নামের পূর্ণ অধীনে রয়েছে এবং এই নামের কিরণ ও তাজাল্লীর ছায়ায় প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে । অর্থাৎ ঈমান আনয়নকারীদের অন্তরসমূহ তাদের যোগ্যতা এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর‘
রহমান’
নামের বিভিন্ন স্তরের প্রকাশের নিয়ন্ত্রণাধীন ।
দ্বিতীয় রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,অন্তরসমূহ-বিশ্বাসীদের অন্তর হোক বা যে কোন অন্তর-‘
আল্লাহ’
নামের নিয়ন্ত্রণাধীন । আর এই পবিত্র ও বরকতময় নামের বিভিন্নরূপ প্রকাশ রয়েছে । তিনি তাঁর ইচ্ছামত প্রত্যেক হৃদয়কে এ নামের বিশেষ তাজাল্লি দ্বারা পরিচালিত করেন এবং ব্যক্তির প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তার অবস্থার পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।
সালেক (আধ্যাত্মিক যাত্রী)-কে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে ক্রন্দন করাটাকে তার বন্দেগির পথে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে নিজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে । বিশেষ করে এই মাকামে (মাকামে ইস্তিগফারে) যা কিছু মনের দহন দ্বারা অর্জিত হয় তার কদর তারা ভালোভাবেই জানে । যখনই এমন তাওফিক লাভ হয় তখন ইস্তিগফারের সাথে আকুতি মিনতি এবং অনুনয় প্রার্থনাকে অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে হাতছাড়া করে না । সে সতর্ক থাকে যে ,শত্রু যেন তাকে ধোঁকা দিতে না পারে এবং তার সম্মুখে যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে শয়তান সূক্ষ্ম চক্রান্ত দ্বারা সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে । সুতরাং অনুনয়-বিনয় ,প্রার্থনা ও ইস্তিগফার কখনই বন্ধ করে না ,নিজের এ অবস্থাকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং অন্য সময়ে তা হবে এমন মনে করে অমনোযোগী হয় না । কারণ ,সে জানে যে ,এই সৌভাগ্য এত সহজে অর্জন করা যায় না এবং এই সুযোগ সবসময় আসে না । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
اذا اقشعر جلدک و دمعت عیناک، فدونک دونک، فقد قصدقصدک
‘
যখন তোমার দেহ আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু বর্ষিত হয় ,তখন জেনো ,তিনি তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলেই তুমি এমন অনুভূতির অধিকারী হয়েছ ।’
শোক ও কান্নার অন্য দিক :
আরেফদের হৃদয়ের শোক এবং প্রেমাসক্ত ও ভীতদের কান্নার পর্দার একদিকে যেমন রয়েছে হৃদয়ের দগ্ধতা অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বস্তি ,আনন্দ ,উপভোগ এবং মর্যাদার অনুভূতি ।
এখন রাসূল (সা.) এবং ইমামদের বাণী থেকে এর অর্থ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ।
দগ্ধ হৃদয় ,কান্না এবং মানসিক প্রশান্তি
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :‘
কিয়ামতের দিন প্রতিটি চক্ষু থেকেই অশ্রু ঝরবে ,কিন্তু ঐসব চক্ষু ছাড়া যেসব চক্ষু আল্লাহর নিষেধসমূহকে পরিহার করে চলেছে এবং ঐ চক্ষু যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য জাগ্রত থেকেছে এবং ঐ চক্ষু যে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে ।’
এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,পর্দার এ পাশে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুখটিই পর্দার ওপাশে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রশান্ত এবং নিশ্চিন্ত রূপে প্রকাশিত হবে । কেননা ,কিয়ামতের দিন পর্দার অন্তরালের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়ার দিন ।
ঐ দিন পর্দার আড়ালে থাকা সত্যই সামনে হাজির হবে ।
দুঃখ ,কান্না ও আনন্দ উপভোগ
রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ্ তা‘
আলা শোকাহত ও ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবাসেন ।
আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ বান্দাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা । যার ফলে হাদীসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে ,বান্দার হৃদয় যখন পর্দার এ পাশে শোক ও কান্নায় বিহ্বল তখন পর্দার অপর দিকে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।
আর এই আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ উপভোগ করা যায় । ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন :‘
আল্লাহর নিকট রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনায় যে অশ্রুবিন্দু ঝরে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোন কিছু নেই ।’
এটা এই অর্থে যে ,বান্দা রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরায় ও আকুতি প্রকাশ করে তা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় অর্থাৎ এ দুঃখ ও কান্নার আড়ালে তার হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং সে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের আনন্দ উপভোগ করছে । পর্দার আড়ালের ঐশী আকর্ষণই আধ্যাত্মিকতার পথিককে সর্বক্ষণ আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং এই আকর্ষণই এই জগতে শোক-দুঃখ ও অশ্রুর আকৃতিতে প্রকাশিত হয় । একদিকে মনের দুঃখ ,পেরেশানি ও অশ্রু বিসর্জন অন্যদিকে মনের আনন্দ ,পবিত্র পানীয়ের স্বাদ আস্বাদন এবং তাঁর দর্শনের আনন্দ উপভোগ । যদি কারো এপার ওপার দু’
পারে কী ঘটছে দেখার সুযোগ থাকে অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান ,তখন এপারে ও ওপারে উভয় জগতের আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পারবেন । তিনি এক ব্যক্তিকে একই সময়ে পরস্পর বিপরীত দুই অবস্থায় দেখতে পাবেন ।
এই দিকে (দুনিয়ায়) তাকে শোকাহত ,অশ্রু বিসর্জনকারী ও আবেদন-নিবেদনকারী রূপে দেখতে পাবে । অন্যদিকে (আখেরাতে) পবিত্র পানীয় পানের আনন্দ ,ঐশী দর্শনের স্বাদ আস্বাদনরত অবস্থায় দেখবে । এরূপ মর্যাদা আসলেই বিস্ময়কর যে ,দুঃখের মাঝে আনন্দ ,আনন্দের মাঝে দুঃখ ,কান্নার মাঝে হাসি এবং হাসির মাঝে কান্না ।
এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক যে ,আমরা ধারণা করি এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ ,গভীর রহস্য এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি । কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনই এরূপ নয় । কারণ ,সত্যের রূপকে যে দেখবে তার অবস্থা ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের মতো হবে ,যাঁরা আশুরার রাতে ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছেন । আর এজন্যই নিজেদের সমগ্র সত্তাকে তাঁর পথে এভাবে বিসর্জন দিতে পেরেছেন ।
শোককান্না এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ
ইমাম সাদিক (আ.) এক রেওয়ায়াতে আবি বাছিরকে দোয়া এবং কান্না সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যেখানে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন :‘
মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা হচ্ছে সিজদায় ক্রন্দনরত অবস্থা ।’
এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,এ কর্মের বাহ্যিক দিক হলো ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া ,কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ দিক হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দে আপ্লুত হওয়া ।
কারবালার আন্দোলন আবেগতাড়িত নাকি বিজ্ঞতাপূর্ণ পদক্ষেপ
প্রশ্ন নং 60 : অনেকে বলেন :‘
আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাজগুলো নিতান্তই প্রেমপ্রসূত ছিল-বিজ্ঞতাপ্রসূত ছিল না ।’
একথার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে ,ইমামের কাজগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী ?
উত্তর : মানুষের মধ্যে সবসময়ই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব লেগে আছে ,সাধারণত তাকে‘
জিহাদে আকবার’
(বড় জিহাদ) বলা হয়ে থাকে । অথচ এটা জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) ।
মানুষ যখন তার জ্ঞান ,বিবেক দিয়ে মনের কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে তা হচ্ছে জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) । কেননা ,সে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে চায় । এর পরের পর্যায় হচ্ছে জিহাদে আকবার-যা হচ্ছে ভালোবাসা ও বিবেক ,প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা এবং বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ দর্শনের যুদ্ধ ।
এই পর্যায়ে যদিও সে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে কোন সত্যের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রমাণসমূহের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একটি সমাধানে পৌঁছে ,কিন্তু তার অন্তর-যা প্রেম-ভালোবাসার কেন্দ্র তা কখনোই বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে (অর্জিত জ্ঞানকে) যথেষ্ট মনে করে না ;বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতাকে অনুভব করতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান কামনা করে । অর্থাৎ যা কিছু বুঝতে পেরেছে তা আত্মা দিয়ে অবলোকন করতে চায় ।
এই কারণে এর পর থেকেই প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জিহাদে আকবার শুরু হয় । অবশ্য এতে কোন দোষ নেই । কেননা ,দু’
টিই সত্যের সন্ধান পেয়েছে ,কিন্তু একটি সত্যকে বুঝেছে অপরটি সত্যে পৌঁছেছে । প্রকৃত অর্থে একটি সত্য ,আরেকটি চূড়ান্ত সত্য । একটি ভালো আর অপরটি খুব ভালো । একটি পূর্ণতার নিম্নতর স্তর আরেকটি পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায় । এই কারণে আল্লাহর ওলী ও প্রেমিকদের কাজগুলো প্রেম-ভালোবাসার ভিত্তিতে হয়ে থাকে । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :‘
সর্বোত্তম মানুষ তিনিই যিনি প্রেমের মাধ্যমে ইবাদত করেন ।’
সেই ব্যক্তিই ইবাদতের স্বাদ পায় এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃত রূপ দেখতে পায় ।
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান মূলত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দোযখ এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব প্রমাণ করে । কিন্তু প্রেম ও মন বলে যে ,আমি (এ পৃথিবীতেই) দোযখ ও বেহেশত্ দেখতে চাই । যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে কিয়ামত ,বেহেশত ,জান্নাত ইত্যাদিকে সত্য হিসেবে গণ্য করে সে হচ্ছে জ্ঞানী । কিন্তু যে ব্যক্তি বেহেশত ও দোজখ দেখতে চায় সে হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ ।
সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইন) কাজগুলো প্রেমপূর্ণ ছিল ,আর সে প্রেম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে-জ্ঞানহীনতা নয় । এক সময় বলা হয়ে থাকে ,অমুক কাজ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । অর্থাৎ যে কাজ কেবল ধারণা এবং কল্পনার ভিত্তিতে হয়েছে । কিন্তু কখনো কখনো কাজ এমন হয়ে থাকে যে ,শুধু বিজ্ঞতাপূর্ণই নয় ;বরং তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রেমপূর্ণ । অর্থাৎ যা কিছু বুঝেছে নিজের মধ্যে তা পেয়েছে ও অর্জন করেছে ।
যখন মানুষ বাস্তবতার মর্মে পৌঁছে তখন সে প্রেমসুলভ আচরণ করে । তখন তার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোন ভূমিকাই নেই । এই ভূমিকা না থাকার অর্থ এই যে ,জ্ঞানের আলো তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এক আলোক রশ্মির নিচে ঢাকা পড়েছে । এই কারণে নয় যে ,জ্ঞানের আলো নিভে গেছে এবং আলো নেই । দু’
টি অবস্থায় জ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং মানুষের কাজ-কর্ম জ্ঞান অনুযায়ী হয় না :
1. যখন মানুষ ক্রোধ এবং কুপ্রবৃত্তির বশে পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন তা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;বরং বোকামিপূর্ণ । এর উদাহরণ হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণের সম্মুখীন চাঁদের মতো যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এই রূপ অবস্থায় জ্ঞানের আলো নেই । পাপীর জ্ঞান চন্দ্রগ্রহণ হওয়া চন্দ্রের মতো । হযরত আলী (আ.) এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন :‘
এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক রয়েছে যা প্রবৃত্তির কর্তৃত্বের হাতে বন্দি (অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কুপ্রবৃত্তির নির্দেশের দাস হয়ে পড়েছে) ।’
2. এক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো আছে ,কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই । এটা ঐ সময়ে যখন জ্ঞানের আলো তার চেয়ে শক্তিশালী আলোক রশ্মির নিচে থাকে । যেমন দিনের বেলায় তারার কোন কার্যকারিতা (কোন আলো) নেই । এই কার্যকারিতা না থাকা এই কারণে যে ,সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে ,তার আলোক রশ্মির নিচে তারার আলো রঙ হারিয়ে ফেলেছে । তারার আলো না থাকা বা তা নিষ্প্রভ হওয়ার কারণে এমন হয়নি ;বরং সে সূর্যের বিপরীতে ম্রীয়মাণ হয়ে পড়েছে । যে প্রেমাসক্ত হয়েছে তার জ্ঞান আছে এবং আলোও আছে ,কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রেমের আলোক রশ্মির নিচে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে ।
কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি এই রকমই ছিল অর্থাৎ তাঁর কাজ শুধু বুদ্ধিমানের মতোই ছিল না ;বরং তার চেয়েও উচ্চতর ছিল । কেননা ,তা প্রেমপূর্ণও ছিল ।
আশুরার সৌন্দর্য
প্রশ্ন নং 61 : কীভাবে আশুরার সৌন্দর্য এবং যায়নাব (আ.)-এর এই উক্তি“
ما رایت الا جمیلا
”
-‘
আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি’
-কে উপলব্ধি করা সম্ভব ?
উত্তর : কখনও কখনও মহত্ত্ব কোন বিষয়কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকে ,ঐ জিনিসে নয়-যাকে দেখা হয় । যেমন কেউ কেউ বলেছেন ,কখনও কখনও সৌন্দর্য থাকে মানুষের চোখে এবং দৃষ্টিতে ,ঐ বস্তুতে নয়-যাকে দেখা হয় ।‘
আল্লাহর সৃষ্ট এ জগৎ হলো সর্বোত্তম সৃষ্টিব্যবস্থা’
-যদি কেউ এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল অস্তিত্বের দিকে তাকায় তবে অনেক অদৃশ্য বিষয়কে সে দেখতে পাবে এবং তাকে সুন্দরও দেখবে । এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্ব বা ঘটনাটিকে দেখছি ।
সুন্দর দৃষ্টিতে অস্তিত্ব জগৎ ও জীবনকে দেখলে একদিকে আত্মা ও বিবেক প্রশান্তি লাভ করে অন্যদিকে তা মনে এমন অবিচলতা ,দৃঢ়তা এবং পৌরুষের সৃষ্টি করে যা অপ্রিয় জিনিসসমূহকে সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । এই দৃষ্টিতেই আশুরা হযরত যায়নাব কুবরা (সা.আ.)-এর কাছে সুন্দর ব্যতীত কিছুই ছিল না । যখন শত্রুরা এ ঘটনাকে আহলে বাইতের জন্য অবমাননাকর গণ্য করে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করছিল তখন বীরঙ্গনা নারী যায়নাবما رایت الا جمیلا
(আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি) বলে তাদেরকে জবাব দিয়েছেন ।
ইমাম হোসাইন (আ.) এই সফরের শুরুতেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ,যা কিছু ঘটবে আল্লাহর ইচ্ছায় তা যেন তাঁর এবং তাঁর সাথিদের জন্য মঙ্গলকর হয় । আর তা বিজয়ের দ্বারাই হোক আর শাহাদাতের মাধ্যমেই হোক ।
ارجو ان یکون خیرا ما اراد الله بنا قتلنا ام ظفرنا
অর্থাৎ আমি আশা করছি আল্লাহর ইচ্ছায় যা-ই সংঘটিত হোক তা আমাদের জন্য মঙ্গলই হবে ,শহীদ হই অথবা বিজয়ী হই ।
বোনের দৃষ্টিতে ঘটনাটি সৌন্দর্যময় হওয়া এবং ভাইয়ের দৃষ্টিতে তা মঙ্গলজনক হওয়া এ দু’
টি একে অপরের পরিপূরক । কারবালার দর্পণের অনেক সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে । তার থেকে আমরা এখানে কিছু দিকের উল্লেখ করব ।
1. মানুষের পূর্ণতার দ্যুতি :
মানুষ যে কত ঊর্ধ্বে আরোহণ এবং কতটা খোদায়ী রঙ ধারণ করতে পারে যে ,তাঁর (তাজাল্লির) মধ্যে বিলীন হতে পারে তা কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় । কারবালা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের আত্মার মর্যাদা কত বেশি এবং এর ঊর্ধ্বগামিতা ও পূর্ণতার সীমা কতদূর পর্যন্ত হতে পারে! এই মহান ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ,মানুষের মর্যাদা সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে । মূল্যবোধের অনুসন্ধানকারীদের কাছে এ দিকটি অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ।
2. আল্লাহর সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশ :
আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হওয়ার মর্যাদায় পৌঁছানো অনেক কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । যদি হযরত যায়নাব (আ.) কারবালার ঘটনাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে করেন তা আল্লাহর ওলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা ,তাঁর সঙ্গী সাথি এবং পরিবার-পরিজনের কর্মে যে মহান বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশিত হয়েছে তার কারণে ।
সত্যিই হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ব্যথা অথবা নিরাময় এবং মিলন অথবা বিরহের মধ্যে কোন্টাকে বেছে নেবেন তা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন । অতঃপর যা কিছু মহান প্রেমময় সত্তা আল্লাহ পছন্দ করেন তা-ই পছন্দ করেছিলেন ।
কারবালা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষের সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশস্থল । ইমাম হোসাইন (আ.) জীবনের শেষ মুহূর্তে শহীদ হওয়ার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন-
الهی رضی بقضائک
(‘
হে আল্লাহ! আমরা তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট’
)। নিজের বোনকেও তিনি এই উপদেশ দিচ্ছিলেন-ارضی بقضائ الله
(‘
আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাক’
)। এটা আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায় । অর্থাৎ নিজেকে মোটেই না দেখা এবং কেবল আল্লাহকেই দেখা । আল্লাহর পছন্দের মোকাবিলায় নিজের কোন পছন্দ না থাকা । তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেও তাঁর বক্তৃতায় বলেন :رضا الله رضانا اهل البیت
(‘
আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের সন্তুষ্টি’
)।
এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের ভিত্তি । আর যায়নাব (আ.) এটাকেই সুন্দর বলেছেন এবং এই চিন্তাধারা ও জীবনধারাকেই প্রশংসা করেছেন ।
সত্যমিথ্যার সীমারেখা :
আশুরার অন্যান্য সৌন্দর্যের মধ্যে একটি হলো সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং হিংস্র স্বভাবের মানুষ ও ফেরেশতার মতো মানুষের অবস্থান ও কর্মের সীমা পরিষ্কার করে দেওয়া । যখন ভালো-মন্দ ,সত্যমিথ্যা মিশ্রিত হয়ে পড়ে ,মিথ্যার অন্ধকাররাশি সত্যকে অস্পষ্ট ও আচ্ছাদিত করে দেয় ,সেই অন্ধকারময় অবস্থায় মানুষের চিন্তাধারায় বিকৃতি ঘটা ও মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার । আর তখন অস্পষ্ট মুখোশধারী কুফর ইসলামের বেশ ধরে সহজ-সরল মুসলমান এবং অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সত্য সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেয় । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কর্মের সৌন্দর্য হচ্ছে যে ,তিনি এমন এক মশাল জ্বালিয়েছেন যেন সত্যপথ পরিষ্কার হয় এবং অন্ধকার দূরীভূত হয় । মেষের পোশাকে আসা নেকড়েস্বরূপ‘
ফিতনা ও মিথ্যার চেহারা’
প্রকাশিত ও চিহ্নিত হয় এবং তাদের প্রতারণা বা ধোঁকা যেন আর কার্যকর না হয় । এটা কি সুন্দর নয় ?
আশুরা ছিল সত্যমিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী একটি সীমানা যা নামধারী মুসলমানদের থেকে প্রকৃত মুসলমানদের চিহ্নিত করেছে । কারবালায় পরম করুণাময়ের অনুসারীরা এবং শয়তানের বাহিনী পৃথক প্লাটফর্মে আবির্ভূত হয়েছে । যেহেতু মিথ্যা কারবালায় মুখোশবিহীন অবস্থায় ময়দানে এসেছিল সেহেতু সত্য নিশ্চিন্তে ও অকুণ্ঠ চিত্তে মিথ্যার মোকাবেলায় নেমেছিল । যদিও তারা প্রতারণামূলকভাবে ইমাম হোসাইনকে হত্যার উদ্দেশে আগতদেরیا خیل الله ارکبی
(‘
হে আল্লাহর সৈন্যরা! যুদ্ধের জন্য আরোহণ কর’
) স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল ।
যদি তাদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পথে সামান্য কিছু অস্পষ্টতা থেকেও থাকে তবে সিরিয়া এবং কুফায় যায়নাব (আ.)-এর বক্তৃতার মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়েছিল । এটা রক্তাক্ত আশুরার একটি অতি মূল্যবান সৌন্দর্য ।
4. প্রকৃত বিজয়ের দীপ্তি :
আশুরার অপর একটি সৌন্দর্য হচ্ছে বিজয়ের নতুন এক অর্থ ও তাৎপর্য দান । কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ভুলবশত কেবল সামরিক বিজয়কেই বিজয় এবং অত্যাচারিত হওয়া ও শাহাদাত বরণ করাকে পরাজয় বলে মনে করে । আশুরা দেখিয়ে দিয়েছে যে ,চরম অত্যাচারিত হওয়ার মধ্যেও বিজয় থাকতে পারে । নিহত হওয়ার মাধ্যমেও বিজয়ের গ্রন্থ রচনা করা এবং রক্ত দিয়েও বিজয়ের চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব । সুতরাং কারবালা সংগ্রামের প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং কী চমৎকার এ বিজয়!
এটাই সেই‘
তরবারির ওপর রক্তের বিজয়’
-যা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তিনি বলেছেন :‘
যে জাতি শাহাদাতকে সৌভাগ্য বলে মনে করে তারাই বিজয়ী । আমরা শহীদ হওয়া এবং হত্যা করা উভয় অবস্থায়ই বিজয়ী ।
এটাই কোরআনের সেই শিক্ষাاِحدی الحسنین
(অর্থ: দুই কল্যাণের একটি অর্জন) যা আল্লাহর পথে সংগ্রামীদের সংস্কৃতি ।
যে আল্লাহর নির্ধারিত ছক ও নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে সে সর্বাবস্থায় বিজয়ী এবং সেটা প্রকৃত বিজয়ও বটে ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম হোসাইন ,ইমাম সাজ্জাদ এবং হযরত যায়নাবেরও ছিল ।
যেহেতু ঐসব তিক্ত ঘটনা সত্য এবং ইসলামের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ছিল সেহেতু তা সুন্দর এবং আকর্ষণীয় । যখন ইবরাহীম বিন তালহা ইয়াযীদের দরবারে ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তিরস্কার করে বলল :‘
(আজ) কে বিজয়ী হয়েছে ?’
তিনি বললেন :‘
যখন নামাযের সময় হবে এবং আযান ও ইকামত দেয়া হবে তখন বুঝবে যে ,কে বিজয়ী হয়েছে!’
নিহত এবং শহীদ হয়েও বিজয় লাভ করা কি সুন্দর নয় ?
5. আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত পথে যাত্রা করা :
মানুষ যখন কোন কাজ‘
আল্লাহর ইচ্ছা’
ও‘
আল্লাহর চাওয়া অনুযায়ী’
ই ঘটেছে বলে মনে করে তখন তার সৌন্দর্য উত্তমরূপে প্রতিভাত হয় । যদি শহীদদের নেতা বা তাঁর সঙ্গী-সাথিরা শহীদ হয়ে থাকেন এবং হযরত যায়নাব ও নবীর পরিবার বন্দি হয়ে থাকেন তবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়েছে । কেননা ,লওহে মাহফুযে তা লিপিবদ্ধ ছিল । কী চমৎকার যে ,দলবদ্ধ একটি কাজ আল্লাহর চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ!
তাহলে কি হোসাইন বিন আলী (আ.)-কে অদৃশ্য থেকে সম্বোধন করে বলা হয়নি-
ان الله شاء ان یراک قتیلا ان الله شاء ان یراهن سبایا
‘
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে নিহত অবস্থায় দেখতে চান এবং তাদেরকেও (নারী-শিশুদের) বন্দি দেখতে চান ।’
সুতরাং এটাই কি আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না যে ,নবীর আহলে বাইত (নারী-শিশুসহ সকল সদস্য) তাঁর ধর্ম এবং মানুষের মুক্তির জন্য বন্দি হবেন ?
অতএব ,এই শাহাদাত বা বন্দি হওয়াতে দুঃখ বা আফসোস কিসের ?
এ দু’
টি ছিল আল্লাহর দ্বীন রক্ষা এবং খোদাদ্রোহীদের মুখোশ উন্মোচন করার মূল্য যা অবশ্যই দিতে হবে যা প্রেমপূর্ণভাবে ,ধৈর্যসহকারে এবং সাহসিকতার সাথে সম্পাদিত হয়েছে ।
মহীয়সী নারী যায়নাব ওহীর ক্রোড়ে এবং হযরত আলীর শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন । তাই তাঁর নিকট আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরই পথে এই যাত্রা হচ্ছে অতি মূল্যবান এবং সৌন্দর্যের সর্বোত্তম রূপ । তিনি এই কর্মসূচির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত অবলোকন করেছেন । কারণ ,তিনি একে একে প্রতিটি প্রাঙ্গন ও ক্ষেত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করেন । এই ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরার ঘটনাটি কি সৌন্দর্যময় নয় ?
6. আশুরা ভাগ্যনির্ধারণের রাত্রি :
এই ক্ষেত্রটিতে আশুরার সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতম প্রকাশ ঘটেছে । কারণ ,হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীরা প্রস্থান এবং অবস্থান এই দুয়ের মধ্যে অবস্থান করাকে বেছে নিয়েছিলেন ,যা তাঁদের আত্মত্যাগ ও বিশ্বস্ততার নিদর্শন । তাঁরা হোসাইনবিহীন জীবনকে অপমান ও প্রকৃত মৃত্যু মনে করেছেন ।
আশুরার রাতে ইমামের ঐ ঐতিহাসিক বক্তৃতা ,তাঁর প্রতি সঙ্গী-সাথিদের বিশ্বস্ত থাকার ঘোষণা ,ইমাম হাসানের কিশোর সন্তান কাসেমের সাথে ইমামের কথোপকথন এবং প্রশ্নোত্তরের বিষয়বস্তু ও ধরন ,
সকাল পর্যন্ত সাহাবীদের ইবাদত ,মৃদুস্বরে কোরআন পাঠ ,তাঁবুগুলো থেকে দোয়া পাঠের ধ্বনি উচ্চারিত হওয়া ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং যায়নাবের সামনে তাঁদের সাথিদের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করা-এগুলোর প্রতিটি এই সুন্দর বইয়ের সোনালি অধ্যায় । তাই যায়নাব কেন আশুরাকে সৌন্দর্যময় দেখবেন না ?
কারবালার শিক্ষার ভিত্তিতেই ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায় যুলুম-অত্যাচারের সাথে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে । এটা কি অপরূপ নয় ?
আশুরার প্রতিটি মুহূর্ত ও ক্ষণ শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ,বিশ্বস্ততা ,মহানুভবতা ,ঈমান ,সাহসিকতা ,শাহাদাতকামিতা এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের শিক্ষা দেয় । এটা কি সুন্দর নয় ?
মরু-প্রান্তরের মাটিতে ঝরে পড়া পবিত্র রক্তের স্রোত যুলুম-অত্যাচারের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে । এটা কি সুন্দর নয় ?
কুফা এবং সিরিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা ভেবেছিল যে ,সত্যপন্থীদের হত্যার মাধ্যমে নিজেদেরকে চিরস্থায়ী করেছে! কিন্তু যায়নাব (আ.)-এর দৃষ্টিতে তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছে এবং আহলে বাইতের নূরানি চেহারাকে আরো উজ্জ্বল এবং তাঁদের নাম চিরস্থায়ী করেছে । আর এভাবে আল্লাহর ধর্মকে পুনর্জীবিত করেছে । ফলে কারবালা হয়েছে এক বিশ্ববিদ্যালয় ।
পরম সাহসী ও মহীয়সী নারী হযরত যায়নাব এ সত্যগুলো জানতেন এবং সময়ের ঊর্ধ্বে এ ঘটনার সুপ্রসারিত প্রভাবকে দেখেছিলেন । এই সম্মানিত বন্দি নারীকে ইবনে যিয়াদ তিরস্কারপূর্ণ ভাবে সম্বোধন করে বলেছিল :‘
তোমার ভাই এবং তার পরিবারের সাথে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে ? তিনি বললেন :‘
আমি সুন্দর ছাড়া কিছু দেখিনি ।’
এটাই ছিল কুফার শাসকের বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব ।