ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মনঃকষ্ট
আশুরা আন্দোলনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক
প্রশ্ন নং 62 : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক সম্পর্কে কিছু বলুন
উত্তর : কারবালার আকাশের তারার ন্যায় উজ্জ্বল ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে অন্য কোন আকাশের তারা উজ্জ্বল ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হয়নি । আশুরার দিনে সূর্য যেরূপ দুঃখভারাক্রান্ত ,বিবর্ণ ও দ্বিধা নিয়ে উদিত হয়েছিল অন্য কোন দিন সেরূপ রঙহীন ও মনোবেদনা নিয়ে উদিত হয়নি । পৃথিবীর কোন স্থানই নেইনাওয়া (কারবালা)-র ন্যায় সুন্দর ও অসুন্দরকে পাশাপাশি এত উত্তমরূপে প্রদর্শন করেনি । ঐতিহাসিক কোন ঘটনাই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের মতো মানবতার মহান বাণী ধারণ করেনি ।‘
তাফ’
-এর মরুভূমিতে সেদিন‘
তাওহীদ’
দ্বিতীয়বারের মতো জন্মগ্রহণ করেছিল । আশুরার দিন‘
খোদাপ্রেম’
নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছিল এবং কোরআন (এর শিক্ষা) নবজীবন লাভ করেছিল । কেন ফেরেশতারা হযরত আদম (আ.)-কে সিজদা করেছিল ,দশই মুহররমেই তার রহস্য উন্মোচিত হয়েছিল । বস্তুত আশুরার দিন কারবালায় মহান আল্লাহর সকল সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল ।
চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ফোরাতের কূলে আলীর সন্তান আব্বাস যখন ঘোড়াসহ পানিতে নেমে পানি পান না করেই মশক ভর্তি করে পানি থেকে উঠে এলেন ,তাঁর এ কর্মের মাধ্যমে ভালোবাসা ,আত্মসম্মানবোধ ,মনুষ্যত্ব ও আত্মত্যাগের যে মহান শিক্ষার নমুনা পৃথিবীর বুকে রেখে গেলেন তা সত্যপিপাসুদের জন্য চিরন্তন এক সুপেয় পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছে । রক্তাক্ত কারবালার এ মহান বীর মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের নিশান উড়িয়েছিলেন । তিনি সুন্দরের চিরন্তনতা ও অসুন্দরের স্থায়িত্বহীনতার মহান সাক্ষী । কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর ভাই আব্বাস এবং তাঁদের সঙ্গী-সাথিরা কারবালাকে খোদাপরিচিতি ,মানবতা ও মানুষ গড়ার মহান এক শিক্ষালয়ে পরিণত করেছিলেন ।
কোন শিক্ষালয়ই কারবালার শিক্ষালয়ের মতো উত্তম ও সফল শিক্ষার্থী তৈরি ও প্রশিক্ষিত করতে পারেনি । কারবালার ন্যায় কোন শিক্ষাকেন্দ্রেই এত বৈচিত্র্যময় শিক্ষাবিভাগ নেই । খোদাপরিচিত ,খোদাপ্রেম ,মর্যাদাকর বৈশিষ্ট্য ,লক্ষ্যের পথে চূড়ান্ত দৃঢ়তা প্রদর্শন ,ধৈর্য ,সাহসিকতা ,একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্বসহ অসংখ্য বিভাগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন । এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুগ্ধপোষ্য শিশু ,কিশোর ,তরুণ ,যুবক ,মধ্যবয়সী ,প্রবীণ ,বৃদ্ধ ,পুরুষ-নারী ,স্বাধীন মানুষ ও দাস সকলেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন । তাঁদের সকলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষক ইমাম হোসাইন ইবনে আলী থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন । তাঁর ছাত্ররা কঠিনতম পরীক্ষায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন যা তাঁদের অতুলনীয় যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে । শাহাদাতের ময়দানের এ অকুতোভয় সৈনিকরা খোদাপ্রেমে এতটা নিমজ্জিত ছিলেন যে ,তাঁদের নেতার পাশে তাঁদের নাম চিরন্তনতা লাভ করেছে । কেননা ,যে কেউ মহান আল্লাহর জন্য তার সত্তাকে একনিষ্ঠ করবে অবশ্যই সে স্থায়িত্ব ও অমরতা লাভ করবে । আশুরার ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত জ্ঞান ,উন্নত নৈতিক চরিত্র ও মর্যাদাকর বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ । কারবালার ভূমির প্রতিটি অংশ মহান আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও মহান প্রভুর দাসত্বের স্বীকৃতির প্রমাণবাহী ।
কারবালার চিরন্তন বিপ্লবী ইতিহাসের প্রতিটি পাতা আত্মমর্যাদা ,বন্দেগি ,মহত্ত্ব ও আত্মত্যাগের স্বর্ণলিপি খচিত । এ মহান ঘটনার সকল দিক একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয় । আমরা সংক্ষেপে এ কালজয়ী বিপ্লবের কিছু দিকের উল্লেখ করছি :
1. ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জ্ঞান ,চরিত্র ও মর্যাদার দিক
কথা এবং কাজের মাধ্যমে তাওহীদের দিকে আহ্বান সকল ঐশী ধর্মের মূল এবং নবীদের শিক্ষার ভিত্তি । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাওহীদের সর্বোজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয় । ইমাম হোসাইন এক মুহূর্তের জন্য মহান আল্লাহর স্মরণ ,প্রশংসা ,মর্যাদা বর্ণনা এবং কৃতজ্ঞতা থেকে উদাসীন হননি । তিনি যখন মক্কা থেকে ইরাকের দিকে রওয়ানা হন তখন প্রথমেই মহান আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করেন :
الحمد لله و ما شاء الله و لا حول ولا قوة الا بالله
‘
মহান আল্লাহর প্রশংসা ,তিনি যা চান তা-ই হবে ,আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই ।’
তিনি তাঁর জীবনের শেষলগ্নে শাহাদাতের মুহূর্তে যখন তিনি তৃষ্ণার্ত ও রক্তাক্ত অবস্থায় শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন এবং শিমার তাঁর শির বিচ্ছিন্ন করার জন্য তাঁর বুকের ওপর বসেছিল তখন বলেন :‘
হে প্রভু! আমি আপনার সিদ্ধান্তে (সন্তুষ্ট চিত্তে) ধৈর্যধারণ করছি । আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই । হে আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় (দাতা)!’
2. ঐশী (খোদা অর্পিত) দায়িত্ব পালন ও মানবিক মূল্যবোধকে দৃঢ়ীকরণ
স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন সেনাপতি যখন শত্রুর সামনে দাঁড়ায় এবং সৈন্য সমবেত করে তখন তার উদ্দেশ্য থাকে শত্রুকে পরাভূত করে জয়ী হওয়া । ইমাম হোসাইনও এ সাধারণ নীতি থেকে ব্যতিক্রম নন । কিন্তু জয় ও পরাজয় তাঁর দৃষ্টিতে ছিল ভিন্ন যা অনেকের জন্যই বোঝা বেশ কঠিন ।
ইমাম হোসাইনের দৃষ্টিতে বিজয় হলো আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সর্বোত্তমরূপে সম্পাদন করা এবং মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করা । যদিও এ কর্ম সম্পাদন করতে তাঁকে শহীদ হতে হয় ও বাহ্যিকভাবে পরাজিত হতে হয় । বাহ্যিক জয়-পরাজয় তাঁর লক্ষ্য ছিল না ।
এ কারণেই আমরা দেখি ,মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত এবং ইমাম আলী (আ.)-এর বিশেষ ভক্ত ও অনুসারী তেরেম্মাহ ইবনে আদী যখন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে কারবালার পথে সাক্ষাৎ করেন তখন ইমাম তাঁকে কুফার পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন । তেরেম্মাহ বলেন :‘
কুফার বিভিন্ন গোত্রপ্রধান এবং গোত্রপতিরা (গোত্রের বিশেষ ব্যক্তিরা) ইবনে যিয়াদের নিকট থেকে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণ করে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে । আর সাধারণ মানুষের অন্তর আপনার সঙ্গে ,কিন্তু তাদের তরবারিগুলো আপনার দিকে (বিরুদ্ধে) ।’
তেরেম্মাহ ইমাম হোসাইনকে প্রস্তাব করেন :‘
আপনাকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে বলছি যে ,এ সফর থেকে বিরত হয়ে আমার গোত্র যে অঞ্চলে বাস করে আমার সঙ্গে সেখানে আসুন । কারণ ,তা শত্রুর নাগালের বাইরে । এতে আপনি শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবেন ।’
আবু আবদিল্লাহ (আ.) দু’
টি বিষয়ের দিকে তেরেম্মার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন-যে ঐশী দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করা । এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে তিনি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন যা তাঁর ও কুফার অধিবাসীদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে । তিনি বলেন :‘
কুফাবাসীর সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছে তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় । এতে শেষ পরিণতি যা-ই হোক না কেন ?’
অর্থাৎ আমি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে ,কুফায় গিয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করব এবং তাদেরকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করব । আর তারা আমার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে ,আমাকে সাহায্য করবে ও পৃষ্ঠপোষকতা দেবে । আমার দায়িত্ব হলো আমি আমার প্রতিশ্রুতি পালন করব ,যদিও এ পথে আমাকে বিভিন্ন রূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয় । এখন কুফাবাসী তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুক বা না করুক (অঙ্গীকার ভঙ্গ করুক) আমি আমার দায়িত্ব পালন করব ।
প্রশ্ন নং 63 : শত্রুরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করবে না জানা সত্ত্বেও কেন ইমাম হোসাইন (আ.) শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নসিহত করেছেন এবং তাদের প্রতি করুণা দেখিয়েছেন ?
উত্তর : আল্লাহর নবী এবং তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির প্রতি স্নেহ ,মমতা ও ভালোবাসা প্রকাশ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া । কোরআনের আয়াত এবং ইতিহাস থেকে এটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায় যে ,ঐশী পথনির্দেশকরা জনগণের বিপথগামিতায় আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি ব্যথিত হন এবং কষ্ট পেয়ে থাকেন । তাঁরা যখন দেখতে পান যে ,তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি নির্মল স্বচ্ছ ঝরনাধারার পাশে বসে তৃষ্ণায় আর্তনাদ করছে তখন তাঁরা কষ্ট পান ,অশ্রু ঝরান এবং তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করেন ।
সত্য ও সরল-সঠিক পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত এবং কুফর ও বাতিলের দিকে তাদের পা বাড়ানো দেখে তাঁরা চরম কষ্ট পান এবং দুশ্চিন্তায় পড়েন । নবী (সা.)-এর কোমল ও স্পর্শকাতর হৃদয় এসব মূর্খতা ও বিপথগামিতা দেখে কখনো কখনো এমন ব্যথিত হতো এবং তিনি এমন মানসিক চাপ অনুভব করতেন যে ,কষ্ট এবং দুঃখের তীব্রতায় তাঁর পবিত্র জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ত । আল্লাহ তা‘
আলা তাঁকে এমনই প্রেম-ভালবাসা দিয়েছেন ।
“
لعلك باخع نفسك الا یكونوا مؤمنین
”
‘
হয়ত তারা ঈমান না আনার কারণে তুমি তোমার জীবন ধ্বংস করে দেবে ।’
যদি আসমানি পথনির্দেশকের মধ্যে এমন বিশেষত্ব না থাকে তবে তাঁর নেতৃত্ব প্রকৃত তাৎপর্য লাভ করতে পারে না । ইমাম হোসাইন (আ.) রেসালাতের বৃক্ষের ফল । তিনি মহানবী (সা.)-এর সন্তান এবং তাঁর অস্তিত্বের অংশ । তিনি নবী থেকে এবং নবী তাঁর থেকে । যেমনি ভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন :حسین منِ و انا من الحسین
‘
হোসাইন আমা থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে ।’
তিনি নবী (সা.)-এর সমস্ত পূর্ণতার উওরাধিকারী এবং তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিচ্ছবি । নবী (সা.)-এর স্নেহ ও মায়া-মমতার ঝরনাধারা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহত্ত্বের পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে । এই কারণেই আবু আবদিল্লাহ (আ.) তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মানুষকে দিকনির্দেশনা দান এবং নসিহত করেছেন । এমনকি ঐশী নেতা তাঁর রক্তপিপাসু দুশমন ও হীন শত্রুদেরকেও তাঁর বক্তব্য এবং উপদেশ-নসিহত দ্বারা হেদায়াতের চেষ্টা করেছেন যা তাঁর মানবপ্রেম ,উন্নত চরিত্র এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে । বিশ্ববাসীর সামনে তাঁর এ কর্ম অলৌকিক এক নিদর্শনস্বরূপ টিকে আছে ।
ইমাম হোসাইন (আ.) যখন আশুরার দিন শত্রুর বিরাট বাহিনীর মুখোমুখি হন কখনই তাদেরকে নসিহত করা এবং তাদের বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেননি । অথচ তিনি জানতেন যে ,নিশ্চিত শত্রুরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য সর্ব প্রকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ,এমনকি কারবালায় তাঁর অবস্থানস্থলে থাকা শিশুদের কাছে পর্যন্ত পানি পৌঁছানোর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে এবং তাদেরকে দেখছেন তাঁর ওপর হামলার জন্য কেবল নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে ও তাঁর কথা যেন কেউ না শোনে এজন্য শোরগোল ও চিৎকার করছে । তিনি তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায়-যার প্রতিটি বাক্য গভীর অর্থপূর্ণ এবং বিশ্লেষণের দাবি রাখে ,তাতে শত্রুদের নাফরমানি ,অবাধ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতার মূল কারণ বর্ণিত হয়েছে । শত্রুদের উদ্দেশেই তিনি তা বর্ণনা করেছেন ।
আবু আবদিল্লাহ (আ.) এমনকি শত্রুপক্ষের নেতাদের ,যেমন উমর বিন সা’
দ ও শিমারকেও উপদেশ দেয়া থেকে বিরত থাকেননি । আশুরার দিন দুই বাহিনীর মাঝখানে উমরের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি বলেন :‘
হে সা’
দের সন্তান! আফসোস তোমার জন্য ,তুমি কি সেই আল্লাহকে ভয় কর না যাঁর দিকে ফিরে যেতে হবে ? আমি কার সন্তান তা জানা সত্ত্বেও কি তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করবে ? এ (বিপথগামী) গোষ্ঠীকে ত্যাগ করে আমার সাথে আস তাহলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে ।’
উমর ইবনে সা’
দ বলল :‘
আমি ভয় পাচ্ছি যে ,আমার বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে ফেলা হবে ।’
ইমাম বললেন :‘
আমি তোমার জন্য তা তৈরি করে দেব ।’
উমর ইবনে সা’
দ বলল :‘
আমি ভয় পাচ্ছি যে ,আমার ধনসম্পদ ,সহায়-সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হবে ।
ইমাম বললেন :‘
হেজাজে আমার যে সম্পদ (ভূমি) আছে তার চেয়েও ভালো সম্পদ তোমাকে দেব ।’
উমর ইবনে সা’
দ বলল :‘
আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানের জীবন নিয়ে শঙ্কিত ।’
ইমাম হোসাইন (আ.) নীরব হয়ে গেলেন এবং কোন উত্তর দিলেন না । ইমামের লক্ষ্য ছিল নিজেকে বিকিয়ে দেয়া এক নীচ ও হীন ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া যে তাঁকে হত্যা করে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুনকে নিজের জন্য অবধারিত করেছে ।
ইমাম হোসাইনের এসব বক্তৃতা এবং উপদেশ-নসিহতের দু’
টি লক্ষ্য ছিল :
1. শত্রুদের প্রতি তাঁর হুজ্জাত পূর্ণ (চূড়ান্ত প্রমাণ পেশ) করা এবং তাদের জন্য কোন অজুহাতের পথ খোলা না রাখা ।
2. মুষ্টিমেয় লোককে হলেও জাগ্রত করা ,যেমন হুর ইবনে ইয়াযীদ-যাঁর মনে আহলে বাইতের ভালোবাসা এবং ইমামের আলো জ্বলে উঠেছিল ।
এই দয়ার্দ্র এবং জাগরণমূলক বক্তৃতামালা মুসলমান নামধারীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্যের মনে প্রভাব ফেলেছিল এবং কিছুসংখ্যক ইমামের বাহিনীতে যোগ দিয়ে চিরন্তন সৌভাগ্য ও মর্যাদা অর্জন করেছিল । এই ছিল ঐশী নেতার পাপী এবং নির্দয় শত্রুদের মোকাবিলায় ভালোবাসা ,স্নেহ-মমতা এবং মানবপ্রেমের প্রকাশ । এই হচ্ছে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তানের নীতি ও পদ্ধতি ,যিনি চরম স্পর্শকাতর মুহূর্তেও আল্লাহর নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুত হননি ।
আশুরার নামায
প্রশ্ন নং 64 : ইমাম হোসাইন (আ.) কেন আশুরার দিন তাঁর কিছুসংখ্যক সাথি শহীদ হবেন জেনেও শত্রুসেনাদের মাঝে যোহরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করেন ?
উত্তর : নামায হচ্ছে ধর্মের ভিত্তি ।
আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন হচ্ছে নামায । নামাযের দ্বারাই মুমিনকে চেনা যায় । এই সিঁড়ি দিয়ে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত (মিরাজে) যাওয়া যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ।
নামায আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা এবং রাসূল (সা.)-এর নয়নের আলো ।
আর তাই নবী (সা.)-এর প্রথম ও শেষ উপদেশ ছিল নামায প্রতিষ্ঠা করা ।
নামায মানুষকে পাপকাজ এবং কলুষতা থেকে মুক্ত রাখে ।
এমনকি অপূর্ণাঙ্গ এবং অমনোযোগী নামাযও মানুষ ও পাপ কাজের মধ্যে বাধার সৃষ্টি করে ।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সাথি মুয়াবিয়া বিন ওয়াহহাব ইমামকে জিজ্ঞেস করলেন :‘
কোন্ উত্তম বস্তু বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কী ?’
ইমাম বললেন :‘
আমার দৃষ্টিতে আল্লাহর পরিচয় লাভের পর নামাযের থেকে উত্তম কিছু নেই ।’
হোসাইন বিন আলী (আ.) আল্লাহর ধর্মকে জীবিত রাখা ,সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং কুসংস্কার ও আত্মপূজারি অত্যাচারীদের হাত থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য কালজয়ী বিপ্লব করেছেন । আর নামায হচ্ছে আল্লাহর এই ধর্মের ভিত্তি । এই ধর্ম এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর শরীয়তের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.) কেন ধর্মের খুঁটি নামাযকে রক্তাক্ত কারবালা প্রাঙ্গনে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে শত্রুদের কাপুরুষোচিত হামলার সামনে প্রতিষ্ঠা করবেন না আর এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় ও গভীর করবেন না ?
আবু সুমামাহ ছাইদাবী তাঁর নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন । তিনি আশুরার দিন দুপুরে যখন ইমাম শত্রু কর্তৃক সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হন তখন তাঁর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে যোহরের নামাযের সময় স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাঁর পেছনে জামাআতে নামায পড়ে আল্লাহর সাক্ষাতে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন । ইমাম এর উত্তরে বলেন :‘
তুমি আমাকে নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ । আল্লাহ তোমাকে নামায আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন ।’
হোসাইন বিন আলী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিরা শত্রুদের থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়া তীরের সম্মুখে যোহরের নামায আদায় করলেন এবং তাঁদের কয়েকজন নামাযের সময় রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং শাহাদাতের ডানায় ভর করে প্রিয়জনের দর্শনে যাত্রা করলেন ।
আশুরার রাতে ইমাম ,তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাথিদের কোরআন তেলাওয়াত ,ইবাদত-বন্দেগি এবং দোয়া ও মোনাজাতের দৃশ্য মহান আল্লাহর দাসত্বের সর্বোত্তম প্রদর্শনী । নামাযের প্রতি প্রেম ,আল্লাহর নিকট নিজের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে গোপনে প্রার্থনা করা এ সবকিছুই আবু আবদিল্লাহ (আ.) তাঁর সম্মানিত পিতার নিকট থেকে শিখেছিলেন । ইবনে আব্বাস সিফফিন যুদ্ধের চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে আলী (আ.)-কে দেখলেন যে ,আকাশের দিকে মুখ তুলে যেন কোন কিছুর অপেক্ষা করছেন ।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন :‘
হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি কোন কিছুর জন্য চিন্তিত ?’
তিনি বললেন :‘
হ্যাঁ নামাযের সময় হওয়ার অপেক্ষায় আছি ।’
ইবনে আব্বাস বললেন :‘
এই চরম মুহূর্তে যুদ্ধ বাদ দিয়ে আমরা নামাযে নিমগ্ন হতে পারি না ।’
আমীরুল মুমিনীন (আ.) বললেন :‘
আমরা তো নামাযকে প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের সাথে লড়াই করছি ।’
সত্যিই যখন আমাদের নেতা ও পথপ্রদর্শক যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রাঙ্গনেও নামাযের মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি এতটা দৃষ্টি রেখেছেন এবং ঐ কঠিন ও চরম মুহূর্তেও নামায আদায় করেছেন ,তখন আমরা যাঁরা ঐ রূপ যুদ্ধের অবস্থায় নেই ,বরং শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে আছি ,আমাদের জন্য কি নামাযকে অবহেলা করা ও হালকা করে দেখা শোভনীয় ? এটা কি যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য যে ,আমরা ঐসব মহান ও পবিত্র ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা পোষণ করি এবং নিজেদেরকে তাঁদের অনুসারী মনে করি ,অথচ যে নামাযকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাঁরা এত কিছু করেছেন আমাদের জীবনে তার কোন গুরুত্ব থাকবে না ?
আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত যে ,কোরআন পাঠ ,দোয়া এবং নামাযে কি গুপ্ত রহস্য ও স্বাদ লুকিয়ে রয়েছে যে কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) মুহররমের নবম দিন আছরের সময় যখন মুনাফিক বাহিনী হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছিল তখন তিনি তাঁর সাহসী-বীর ভাই আব্বাসকে তাদের নিকট এ বলে পাঠালেন যে ,যদি পার যুদ্ধকে কাল পর্যন্ত পিছিয়ে দাও । অতঃপর বললেন :‘
এটা এজন্য যে ,যেন আজ রাতে পরওয়ার দিগারের জন্য নামায আদায় করতে এবং তাঁর দরবারে দোয়া করতে পারি । আল্লাহ জানেন যে ,আমি তাঁর জন্য নামায আদায় ,তাঁর কিতাব পাঠ এবং তাঁর নিকট ইস্তিগফার করাকে কত ভালোবাসি!
এটা কি সেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কথা নয় যিনি‘
নিশ্চয় অপমান আমাদের থেকে দূরে’
-এই স্লোগান দিয়ে যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ইসলাম ও মনুষ্যত্বের পথে চরম আত্মত্যাগের শিক্ষা মানবজাতির জন্য রেখে গিয়েছেন ? অথচ তিনিই অমানুষ পাষ-দলের কাছে কোরআন তেলাওয়াত ,ইবাদত ও নামাযের জন্য সময় চেয়েছেন ।
নামায আদায় এবং আল্লাহর দরবারে মোনাজাত ও গোপন প্রার্থনা করার মধ্যে কী মহান মর্যাদা নিহিত আছে যে ,শহীদদের নেতা সে জন্য শত্রুদের কাছে যুদ্ধ বিলম্বিত করার আবেদন জানান ।