আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর0%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক: লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ:

ভিজিট: 46818
ডাউনলোড: 4841

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46818 / ডাউনলোড: 4841
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে

কুফাকে নির্বাচন

5 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) আন্দোলন করার জন্য কুফাকে বেছে নিলেন ?

উত্তর : ইসলামের ইতিহাসের পর্যালোচনায় শিয়া ,সুন্নি ও প্রাচ্যবিদ নির্বিশেষে প্রত্যেক গবেষক এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এবং সবাই নিজ নিজ জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন । যে বিষয়গুলো এ প্রশ্নটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে তা হলো-

1. ইমাম হোসাইন (আ.) এ রাজনৈতিক ও সামরিক অভ্যুত্থানে বাহ্যিকভাবে পরাজয়ের শিকার হন এবং তাঁর এ পরাজয়ের অন্যতম কারণ হলো কুফাকে বিপ্লবের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়া ।

2. ঐ সময়ের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা ,যেমন তাঁর চাচাত ভাই ও ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ বিন জাফর40 ,আবদুল্লাহ বিন আব্বাস41 ,আবদুল্লাহ বিন মুতি42 ,মিসওয়ার বিন মাখরামা43 এবং মুহাম্মাদ হানাফিয়া44 ইমাম হোসাইন (আ.)-কে ইরাক ও কুফায় যেতে নিষেধ করেছিলেন । আর তাঁদের কেউ কেউ কুফাবাসীদের অতীত বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার কথা তুলে ধরেছিলেন যা তারা ইমাম আলী (আ.) এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে করেছিল ।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁদের নিষেধ সত্ত্বেও-যদিও এগুলো পরবর্তীকালে বাহ্যিকভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল-নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং কুফার দিকে রওয়ানা দেন । আর এখানেই কতিপয় ঐতিহাসিক বিশেষ করে ইবনে খালদুন সুস্পষ্ট বলেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি ।45

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসসহ কতিপয় ব্যক্তিত্বের কথা থেকে বোঝা যায় যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সামনে কুফা ছাড়াও অন্যান্য জায়গা ,যেমন ইয়েমেনের পথ খোলা ছিল । আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে বলেন : যদি নিতান্তই মক্কা থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করেন তাহলে ইয়েমেনের দিকে যান । কারণ ,সেখানে সুরক্ষিত উপত্যকা ও দুর্গ আছে ,আর তা বিস্তৃত এক এলাকা । অতএব ,সেখানে থেকে আপনি আপনার আহ্বায়ক ও প্রচারকদেরকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে পারবেন । 46

কিন্তু কেন ইমাম হোসাইন (আ.) ঐ পথগুলা বেছে নিলেন না ?

এ প্রশ্নের জবাবে শিয়া আলেমরা ছাড়া অন্য ব্যক্তিবর্গ ,যেমন সুন্নি আলেম ও প্রাচ্যবিদগণ সাধারণ দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করেছেন । আর তাঁরা এ ক্ষেত্রে শিয়াদের আকীদা-বিশ্বাস বিশেষ করে ইমামদের গায়েবের জ্ঞান থাকা এবং ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার বিষয় দু টিকে দৃষ্টিতে রাখেননি ;বরং তাঁরা বিপ্লবের সামরিক ফলাফলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর সিদ্ধান্তে ভুলের শিকার হয়েছেন ।

কিন্তু শিয়ারা নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইমামের পদক্ষেপকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন মতামত পেশ করেছেন । তাঁদের মতামতগুলো সাধারণত দু টি মৌলিক মতের মধ্যে সীমাবদ্ধ যা নিম্নরূপ :

এক. শাহাদাতের দৃষ্টিভঙ্গি

এ মতটি নিম্নোক্ত মৌলনীতিগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত :

1. শিয়াদের প্রত্যেক ইমাম ইমামতের দায়িত্ব লাভের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একটি বই খোলেন এবং তার মধ্যে লিখিত নির্দেশনা থেকে স্বীয় ঐশী দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হন । আর তাতে বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরা কাজ করেন ।47

2. ইমাম হোসাইন (আ.) যখন নিজের কর্মসূচির পাতা খোলেন তার মধ্যে নিজের দায়িত্ব এভাবে লক্ষ্য করেন- যুদ্ধ কর ,হত্যা কর এবং জেনে রেখ যে ,নিহত হবে । একদল লোক নিয়ে শাহাদাতের জন্য নিজের এলাকা ত্যাগ করে চলে যাও এবং জেনে রেখ যে ,তারা তোমার সাথেই শাহাদাত বরণ করবে । 48

অতএব ,প্রথম থেকেই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) শাহাদাত বরণ করুন । আর ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আল্লাহর এ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না । ইমাম হোসাইন (আ.) যখন ইরাক অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছিলেন তখন একবার স্বপ্নে মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে তিনি শাহাদাতের বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন । যখন মুহাম্মাদ হানাফিয়া কুফা যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তখন তিনি জবাবে বলেছিলেন : মহানবী (সা.) স্বপ্নে আমার কাছে আসেন এবং আমাকে বলেন : হে হোসাইন! বের হও ,কারণ ,আল্লাহ তা আলা তোমাকে শহীদ অবস্থায় দেখতে চান । 49

উপরিউক্ত মতামতের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে ,50 কুফার দিকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর যাত্রা আসলে শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যে ছিল । আর ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই তাঁর এরূপ নিয়তির কথা জানতেন । অতএব ,এটি ছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিশেষ দায়িত্ব যে ক্ষেত্রে তিনি কোনক্রমেই অন্য কোন ব্যক্তি ,এমনকি পূর্ববর্তী দুই ইমামের অনুসরণ করতে পারেন না ।

অতএব ,এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে না । আর বড় বড় ব্যক্তিত্বের মতকে উপেক্ষা করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কুফা যাওয়ার বিষয়টিও সমাধান হয়ে যায় । কারণ ,শিয়াদের দৃষ্টিতে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা সম্পর্কে অন্যদের থেকে ভালো জানতেন । তিনি এটাও জানতেন যে ,পরিশেষে কুফাবাসী তাঁকে পরিত্যাগ করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং তাঁকে শহীদ করবে । এ বিষয়টি জানা সত্ত্বেও তিনি কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হন যাতে স্বীয় শাহাদাতের স্থানে পৌঁছেন এবং শহীদ হন ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো-এ শাহাদাতের উদ্দেশ্য কী ছিল ?

এক. এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে । তাঁদের কেউ কেউ বলেন : শাহাদাতের উদ্দেশ্য ছিল সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন । আর তাঁর রক্তের মাধ্যমে ইসলামের চারাগাছে পানি সিঞ্চন করা এ দায়িত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় ছিল । পরিশেষে এ রক্ত ইসলামের পুনরুজ্জীবন এবং ইয়াযীদ ও বনি উমাইয়ার মুখোশ উন্মোচনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । যার ফলশ্রুতিতে 70 বছর পর উমাইয়া শাসনের কবর রচিত হয় ।

আবার কেউ কেউ ,যাঁরা সাধারণত আবেগপ্রবণ এবং যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী নন তাঁরা কোনরূপ দলিল উপস্থাপন ছাড়াই শাহাদাতের উদ্দেশ্যকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অনুসারীদের গুনাহের কাফ্ফারা এবং শিয়াদের জন্য ইমামের শাফাআত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন । ঠিক যে রকম হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে খ্রিস্টানরা মনে করে ।51

শাহাদাতের উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গিটি যে সকল বর্ণনার ভিত্তিতে বলা হয়েছে সেগুলোর সনদের সমস্যা (বর্ণনাকারীদের দুর্বলতা) ছাড়াও আরও কতগুলো সমস্যা রয়েছে যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

1. ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিশেষ কোন দায়িত্ব থাকার বিষয়টি তাঁর এবং অন্য ইমামদের সকলের জন্য আদর্শ হওয়ার মৌলনীতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে । অথচ ঐ ইমামদের অনুসরণীয় আদর্শ হওয়া এবং শিয়াদের জন্য তাঁদের আনুগত্যের আবশ্যকতা যুগ যুগ ধরে শিয়াদের নিকট একটি সুনিশ্চিত বিষয় হিসেবে চলে এসেছে ।

2. এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যের সুস্পষ্ট বৈপরীত্য রয়েছে । কারণ ,তিনি বলেছেন : আমি তোমাদের আদর্শ । 52

3. যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে পূর্ববতী নবিগণ ,মহানবী (সা.) ,ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কতগুলো বক্তব্য থেকেও স্পষ্টভাবে জানা যায় যে ,তিনি নিজের শাহাদাত সম্পর্কে অবগত ছিলেন ,কিন্তু তাঁর কোন বক্তব্য থেকেই এটা বোঝা যায় না যে ,ইমামের আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শাহাদাত বরণ করা । তাই আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সামগ্রিক বক্তব্য থেকে উদ্ঘাটন করতে হবে । ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় ভ্রাতা মুহাম্মাদ বিন হানাফিয়ার কাছে লিখিত অসিয়তনামায় সুস্পষ্টভাবে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন-

...আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি । আমি চাই সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে । আর আমার নানা মুহাম্মাদ (সা.) এবং আমার পিতা আলী বিন আবী তালিব (আ.) যে পথে চলেছেন ,আমিও সেই পথে চলতে চাই । 52

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এই অসিয়তনামায় তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে । সেগুলো হলো : সংস্কার সাধন ,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এবং মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ । ইমাম তাঁর এ অসিয়তনামায় শাহাদাত সম্পর্কে কিছুই বলেননি ।

দুই. ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি

কতিপয় লেখকের মতে54 ,এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমবার শিয়াদের মধ্যে বিশেষ করে সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার (355-436 হি.) লেখনীর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে । তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কুফা রওয়ানা দেয়া সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেন : ...আমাদের মাওলা আবু আবদুল্লাহ (আ.) কেবল তখনই খেলাফত লাভের জন্য কুফার দিকে যান যখন তিনি কুফাবাসীদের পক্ষ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান এবং বিজয় সুনিশ্চিত দেখেন । 55 সাইয়্যেদ মুরতাজার পর কোন শিয়া আলেম এরকম দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেননি ;বরং অধিকাংশ আলেম ,যেমন শেখ তূসী (র.) ,সাইয়্যেদ বিন তাউস (র.) ও আল্লামা মাজলিসি (র.) কোন কোন সময় এ দৃষ্টিভঙ্গির চরম বিরোধিতা করেছেন ।56

সমসাময়িক কালে কতিপয় লেখক পুনরায় এ দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন ,যাতে আহলে সুন্নাত এবং প্রাচ্যবিদদের সন্দেহ-সংশয় নিরসনের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি উপযুক্ত জবাব দিতে পারেন । চিন্তাশীল মহলের ওপর এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব থাকার কারণে আলেমসমাজ এবং পণ্ডিত ব্যক্তিগণ চরমভাবে এর বিরোধিতা করেছেন । এমনকি শহীদ মোতাহ্হারী এবং ডক্টর শরিয়তীর মতো পণ্ডিত ব্যক্তিগণ এ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি ।57 কারণ ,এ দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো ,এতে ইমামের (আ.) ইলমে গায়েবের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়নি ।

কিন্তু এ মতের সার কথাটি হলো ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল ;আর এ কাজ ইয়াযীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং উমাইয়া গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে সম্ভব ছিল না । ইমাম খোমেইনী (র.) সহ আরো অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি তা সমর্থন করেছেন । ইমাম খোমেইনী (র.) বিভিন্ন সময় এ বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন এবং বলেছেন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে একটি ছিল ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা । যেমন:

. 6/3/1350 ফারসি (1952 খ্রি.) তারীখে নাজাফ শহরে ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁর বক্তৃতায় বলেন : ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীদের থেকে বাইআত নেয়ার জন্য মুসলিম বিন আকীলকে পাঠান ,যাতে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং ইয়াযীদের অবৈধ সরকারকে উৎখাত করতে পারেন । 58

. ইমাম হোসাইন (আ.) যখন মক্কায় আসেন এবং হজের মওসুমে মক্কা থেকে বের হন তখন সেটা ছিল একটা বড় রাজনৈতিক পদক্ষেপ । ইমামের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ইসলামী ও রাজনৈতিক । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এসব ইসলামী ও রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোই উমাইয়া শাসনের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । যদি তিনি এসব পদক্ষেপ না নিতেন তাহলে ইসলামই ধ্বংস হয়ে যেত । 59

. ইমাম হোসাইন (আ.) খেলাফত লাভের জন্য এসেছিলেন । তাঁর আন্দোলনে নামার আসল উদ্দেশ্য ছিল এটাই । আর এটা ছিল তাঁর গৌরব ।

যারা মনে করে তিনি খেলাফত লাভের জন্য আসেননি তাদের ধারণা ভুল ;বরং ইমাম এসেছিলেন খেলাফত লাভের জন্য । তিনি চেয়েছিলেন খেলাফত যেন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর অনুসারীদের মতো ব্যক্তিদের হাতে থাকে । 60

এ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে কতগুলো দলিল নিচে উল্লেখ করা হলো-

1. সবচেয়ে বড় দলিল হলো ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সেই বক্তব্য যা তিনি মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় প্রদান করেছিলেন । আর এতে তিনি স্বীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন : সংস্কার সাধন ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং মহানবী (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ ।61 আর এটা সুস্পষ্ট যে ,সংস্কার সাধন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয় । এছাড়া সর্বোচ্চ পর্যায়ে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কেবল এমন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্ভব ,যে সরকারের শাসক হবেন ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ এবং যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী । আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহানবী (সা.) ও ইমাম আলী (আ.)-এর সুন্নাতের অনুসরণের কথা ,যার মাধ্যমে ইমাম এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের শাসন পরিচালনার পদ্ধতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন । আর নিজের উদ্দেশ্য হিসেবে ঐ মহান ব্যক্তিদের সুন্নাতের অনুসরণের কথা বলার অর্থ হলো তিনি তাঁদের ন্যায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চান ।

2. কুফাবাসীরা তাদের চিঠিতে লিখেছিল ,আমাদের যোদ্ধা ও সৈন্যরা প্রস্তুত ,কিন্তু তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কোন ইমাম নেই ।62 তাদের চিঠির ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে ,তারা ইয়াযীদের সরকারকে অবৈধ মনে করে । তাই তারা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে চেয়েছিল যে ,তিনি যেন কুফায় এসে ইমাম হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন । ইমাম কুফাবাসীদের এ মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে আন্দোলন শুরু করেন । উদাহরণস্বরূপ : কুফা থেকে আগত একটি চিঠিতে-যেটি কুফার বড় বড় ব্যক্তিত্ব ,যেমন সুলায়মান বিন সুরাদ খুজায়ী ,মুসাইয়্যেব বিন নাজাবাহ্ ও হাবীব বিন মাজাহের লিখেছিলেন-বর্ণিত হয়েছে : আমাদের কোন ইমাম নেই । অতএব ,আমাদের কাছে আসুন । আশা করা যায় যে ,আল্লাহ তা আলা আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে সত্যের ওপর একত্র করবেন । 63

3. কুফাবাসীদের দাওয়াতের প্রথম জবাবে ইমাম হোসাইন (আ.) মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় পাঠান । আর এটা ছিল ইমামত এবং ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার নিদর্শন । মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় পাঠানোর সময় ইমাম কুফাবাসীদেরকে সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখেন- তোমরা যা বলেছ তা বুঝতে পেরেছি ,তোমাদের চিঠির সারমর্ম হলো তোমাদের কোন ইমাম নেই । 64

এ চিঠি দ্বারা ইমাম নিজের কুফা যাওয়াটাকে শর্তসাপেক্ষ করে তোলেন । আর সে শর্ত হলো-মুসলিমের দ্বারা কুফাবাসীর দাবির সত্যতা প্রত্যয়ন ।65

4. ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় চিঠিতে কতগুলো শর্ত উল্লেখ করেছিলেন । আর সেগুলো যে কেবল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ওপরই প্রযোজ্য হয় তা সুস্পষ্ট । এ শর্তগুলো উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রমাণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে । ইমাম (আ.) তাঁর এ চিঠিতে ইমামতের ধারায় রাষ্ট্র-পরিচালনার দিকগুলো নিয়েই বেশি আলোচনা করেছেন । আর শরীয়তের আহকাম বর্ণনা সংক্রান্ত কোন আলোচনা তিনি করেননি । যদিও পরবর্তীকালে কেউ কেউ ইমামতকে আহকাম (শরীয়তের বিধিবিধান) বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন-যা একটি আংশিক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ।

এ সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় চিঠিতে বলেন : আমার আত্মার শপথ! শুধু ঐ ব্যক্তিই ইমাম হতে পারেন যিনি পবিত্র কুরআনের পূর্ণ জ্ঞান রাখেন ,ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকারী ,সত্যের ওপর আমলকারী এবং নিজের সমস্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে আল্লাহর পথে কাজে লাগান (আল্লাহর জন্য নিজেকে একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত রাখেন) । 66

5. মুসলিমের কর্মকাণ্ডগুলো ছিল কুফায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট আলামত । তাঁর কর্মকাণ্ডগুলো ছিল নিম্নরূপ:

ক. ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্য করার জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতির ওপর আমল করার জন্য কুফাবাসীদের থেকে বাইআত গ্রহণ ।67

খ. বাইআতকারীদের তালিকা তৈরি করা । বলা হয়েছে যে ,বাইআতকারীদের সংখ্যা 12 হাজার থেকে 18 হাজারের মধ্যে ছিল ।68

6. বনি উমাইয়ার অনুসারীরা ইয়াযীদকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল যে ,দিন দিন মুসলিমের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এ থেকে বলা যায় ,তারা বুঝতে পেরেছিল যে ,মুসলিমের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে কুফা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে । নিচের বাক্য থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়- যদি কুফার প্রয়োজন থাকে ,তাহলে কঠোর শাসক সেখানে নিয়োগ কর ,যে তোমার নির্দেশ পালন করবে এবং তোমার দুশমনের সাথে তোমার মতো আচরণ করবে । 69

7. এ দাবির পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো-ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে প্রেরিত মুসলিমের প্রতিবেদন । মুসলিম ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্য করার জন্য কুফাবাসীদের আগ্রহ এবং পদক্ষেপকে সমর্থন করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন যা কুফা অভিমুখে ইমামের রওয়ানা হওয়ার কারণ হয় ।70 ইমাম (আ.) মাঝপথে কুফাবাসীদের উদ্দেশে চিঠি লেখেন এবং তা কায়েস বিন মুসাহ্হার সায়দাভীর মাধ্যমে কুফায় প্রেরণ করেন । ইমাম সেই চিঠিতে মুসলিমের পত্রের ভিত্তিতে 8ই যিলহজকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার তারীখ হিসেবে ঘোষণা করেন । আর তিনি কুফা শহরে পৌঁছা পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে বলেন । ইমাম স্বীয় চিঠিতে বলেন : মুসলিমের পত্র আমার কাছে পৌঁছেছে যা তোমাদের সঠিক সিদ্ধান্তের পরিচায়ক । আর তোমরা যে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত এবং দুশমনদের থেকে আমাদের অধিকার আদায় করার জন্য তৈরি তা আমি বুঝতে পারলাম । মহান আল্লাহর কাছে চাই ,তিনি যেন আমাদের কাজকে সুন্দর করে দেন এবং তোমাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করেন । এ চিঠি প্রেরণের পরই মঙ্গলবার 8ই যিলহজ তারবিয়ার দিন মক্কা থেকে তোমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । তোমাদের কাছে আমার দূত পৌঁছা মাত্রই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্তুত হয়ে যাও এবং সত্যের পথে অটল থাক । আমিও খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের কাছে চলে আসছি । 71

কয়েকটি সমস্যা

উপরিউক্ত দাবির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দু টি সমস্যা রয়েছে ,যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

1. এ দৃষ্টিভঙ্গির শিয়াদের কালামশাস্ত্রের মৌলিক ভিত্তির সাথে বৈপরীত্য রয়েছে । কারণ ,কালামশাস্ত্রের মতে ,ইমামদের অদৃশ্যের জ্ঞান আছে ।

2. এ দৃষ্টিভঙ্গি ইমামের ভুল কাজ করার প্রতি ইশারা করে যা ইমামের নিষ্পাপ হওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় । বলা যেতে পারে যে ,এ সমস্যার কারণেই শিয়া সমাজ এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ।

এ সমস্যার উত্তর দিতে গেলে আমাদেরকে শিয়াদের কালামশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে হবে যেখানে ইমামের অদৃশ্যের জ্ঞান ও নিষ্পাপ হওয়া এবং ঐগুলো প্রমাণ করার দলিল এবং ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সেগুলোর গরমিল পরিলিক্ষিত হলে তা দূর করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । কিন্তু আমাদের কাজ যেহেতু ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা সেহেতু কালামশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা থেকে বিরত থাকব । তবে ,এটুকু বলতে চাই যে ,কালামশাস্ত্রের ভিত্তিতেও এ দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক প্রমাণ করা সম্ভব । যেমন ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মতো বড় ব্যক্তিত্বের মতও এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা একটি দ্বীনি দায়িত্ব । আর তা অবশ্যই পরিকল্পনা ,চূড়ান্ত দলিল উপস্থাপন (যাতে কারো কোন অজুহাত দেখানোর অবকাশ না থাকে) ,বিচক্ষণতা এবং অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে । কিন্তু ফলাফল আল্লাহর কাছে এবং সেটার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে । এমনকি ফলাফল জানা থাকলেও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে কোন বাধা নেই । কেননা ,যে ব্যক্তি সত্যের পথে অগ্রসর হয় তার পরাজয় সাময়িক ,আর কালক্রমে চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যই সত্যপন্থীদের হয়ে থাকে ।

তদুপরি এ সমস্যা থেকে যায় যে ,ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন যে পরাজয়ের শিকার হয় তা প্রমাণ করে যে ,কুফাবাসীদের সম্পর্কে ইমামের ধারণা সঠিক ছিল না ;বরং ঐ সময়ের অন্যান্য ব্যক্তিত্ব ,যেমন ইবনে আব্বাসের ধারণাই ছিল সঠিক ।

ঐতিহাসিক পর্যালোচনা ও বাস্তবভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ সমস্যাটির সমাধান করা যায় ।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের যৌক্তিকতা

যদি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একটি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যথেষ্ট পর্যালোচনা ও বিভিন্ন অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখার পর কোন একটা ফলাফলে পৌঁছে এবং সেই ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় ,আর এর মাঝে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা সংঘটিত হয়ে তার সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করে ,তাহলে সে ব্যক্তিকে কোনক্রমেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না ।

আমরা বিশ্বাস করি ,ঐ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) কুফার অবস্থা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন । তিনি মুয়াবিয়ার খেলাফতকালে কুফাবাসীদেরকে কোন জবাব দেননি এবং সুস্পষ্টভাবে তাদের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন72 ,এমনকি স্বীয় ভ্রাতা মুহাম্মাদ হানাফিয়াকে তাদের আহ্বানে সাড়া দিতে নিষেধ করেছিলেন ।73

আর এ সময়ও কুফাবাসীদের চিঠি পৌঁছামাত্রই তাদের প্রতি বিশ্বাস করেননি ;বরং তাদের দাবির যথার্থতা ও সত্যতা জানার জন্য স্বীয় চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকীলকে সেখানে পাঠান । মুসলিম সেখানে এক মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করেন এবং খুব নিকট থেকে ঐ এলাকার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন ,আর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আগমনের জন্য কুফার অবস্থা অনুকূলে । মুসলিম স্বীয় চিঠিতে কুফার অনুকূল অবস্থার কথা ইমামকে জানান । এ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) কুফার দিকে রওয়ানা হন । অবশ্য ইমাম যে হজের মওসুমে তাড়াতাড়ি করে মক্কা থেকে বের হয়েছিলেন তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তাঁর জীবননাশের আশঙ্কা ।

এর মাঝে যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা সংঘটিত হয় তা হলো ,কুফার গভর্নরের পদ থেকে নোমান বিন বশীরের অপসারণ এবং উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে তাঁর স্থলাভিষিক্তকরণ যা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ছিল না । বরং বাহ্যিক অবস্থা পুরোপুরি এর বিপরীত ছিল । কারণ ,ইয়াযীদ ও উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে এরকম বলা হয়েছে যে ,ইয়াযীদ তার ওপর খুব রাগান্বিত ছিল ।74 এজন্য তাকে বসরার গভর্নরের পদ থেকে অপসারণের চিন্তায় ছিল ।75 এমনকি কোন কোন গ্রন্থে এসেছে ,ইয়াযীদ উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের সবচেয়ে বড় দুশমন ছিল ।76

এ বাধা থাকা সত্ত্বেও যদি মুসলিম এবং তাঁর সাথিরা ইবনে যিয়াদের মতো ভীতি প্রদর্শন ,হুমকি ,চাপ প্রয়োগ ,লোভ দেখানো ইত্যাদি অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাইআতকারীদেরকে সংগঠিত রাখতেন এবং অর্থনৈতিক ,রাজনৈতিক ,সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন উপাদান ও নিয়ামক কাজে লাগাতেন ,যেমনটা ইবনে যিয়াদ করেছিল ,তাহলে কুফায় তাঁদের বিজয়ের সমূহ সম্ভাবনা ছিল ।

এমনকি মুসলিম যদি শারীক বিন আত্তার ও আম্মারা বিন আবদুস সলূলের প্রস্তাব অনুযায়ী সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগাতেন এবং হানীর গৃহে ইবনে যিয়াদকে হত্যা করতেন77 তাহলে খুব ভালোভাবে কুফার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন ।

এখানে আমরা বলতে পারি ,কুফার জনগণ সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.) অন্য ব্যক্তিবর্গ ,যেমন ইবনে আব্বাসের থেকে বেশি ভালো করে জানতেন । কারণ ,প্রথমত ,ইবনে আব্বাসের ধারণা ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর যুগকেন্দ্রিক ছিল । কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ধারণা বর্তমান যুগকেন্দ্রিক ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কুফাবাসীদের সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ধারণা শিয়াদের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ,যেমন সুলাইমান বিন সুরাদ ও হাবীব বিন মাজাহেরের চিঠি ছাড়াও স্বীয় প্রতিনিধি মুসলিমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল ;কিন্তু ইবনে আব্বাস ও অন্যান্য ব্যক্তির হাতে এরকম কোন মাধ্যমই ছিল না যাতে কুফার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন ।

উল্লেখ্য যে ,কুফার বর্তমান অবস্থা বিশ বছর আগের অবস্থার সাথে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল এবং ইমাম হোসাইনের সাথে আন্দোলন করার জন্য কুফাবাসীদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল । আর তাদের পশ্চাদপসরণ ও বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম । কারণ :

এক . কুফা ইসলামী জাহানের কেন্দ্র হওয়ার দিক থেকে সিরিয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি । ফলে কেন্দ্র কুফা থেকে সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল । যেহেতু উমাইয়া শাসকরা সব সময় কুফাকে অনুন্নত করে রাখার চেষ্টা করত ,সেহেতু কুফাবাসীরা তাদের অতীত গৌরব ,নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ফিরিয়ে পাওয়ার প্রচেষ্টায় রত ছিল ।

দুই এ সময় কুফাবাসী বিশেষ করে শিয়াদের ওপর উমাইয়া শাসকদের যুলুম-অত্যাচার তাদেরকে শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছিল ।

তিন. ইয়াযীদের ব্যাপারে কুফাবাসীদের ধারণা এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে তার তুলনা তাদেরকে ইয়াযীদের শাসন গ্রহণ না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল ।

এখন অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে ,বিশেষ কতগুলো কারণ যেমন: ইয়াযীদের অদক্ষতা ও মুয়াবিয়ার মতো ধর্মীয় ,রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যক্তিত্ব না থাকার কারণে কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা ,অপরদিকে কুফার প্রাদেশিক গভর্নরের দুর্বলতার করণে ইমাম হোসাইনের বিজয়ের সমূহ সম্ভাবনা ছিল এবং কুফায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সিরিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে মোকাবিলা করাও তাঁর পক্ষে সহজ ছিল ।

অতএব ,বলা যায় যে ,ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রভাব ,কুফার অবস্থা ,কুফাবাসীর মনোভাব এবং সিরিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনের অবস্থা অনুসারে কুফাকে বেছে নেয়ার ব্যাপারে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সঠিক ছিল । আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যদি না ঘটত তাহলে নিশ্চিতভাবে ইমাম হোসাইন (আ.) বাহ্যিক বিজয়ও লাভ করতেন ।

ইয়েমেনকে বাছাই না করার কারণ

6 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়েমেনকে স্বীয় আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেননি ,যদিও সেখানে শিয়াদের উপস্থিতি ছিল ?

উত্তর : গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে আবদুল্লাহ বিন আব্বাস ইমাম হোসাইন (আ.)-কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ,তিনি যেন ইয়েমেনের দিকে যান এবং সেখান থেকে প্রচারকদেরকে বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করেণ এবং ইয়াযীদের মোকাবিলা করার জন্য স্বীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ।78

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় যে ,কেন ইমাম হোসাইন (আ.) এ ধরনের প্রস্তাবে মোটেই গুরুত্ব দেননি ?

এর উত্তর দেয়ার জন্য নিচের বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে :

1. যদিও মহানবী (সা.)-এর আমলে ইয়েমেনে হযরত আলী (আ.)-এর উপস্থিতির কারণে ইয়েমেনবাসী সুখময় স্মৃতির অধিকারী ছিল79 এবং হযরত আলী (আ.)-এর প্রতি তাদের খুব ভালোবাসা ছিল ;কিন্তু কোন ক্রমেই সেসময়ে এ ভূখণ্ডকে কুফার তুলনায় শিয়াদের ঘাঁটি হিসেবে উত্তম বলে বিবেচনা করা যায় না ।

2. অতীত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ,দুর্যোগকালে ইয়েমেনবাসীর ওপর কোন ক্রমেই ভরসা করা যায় না । কারণ ,ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে এ ইয়েমেনবাসী মুয়াবিয়ার দুর্বল সেনাবাহিনীর মোকাবিলায়80 অক্ষমতার পরিচয় দেয় এবং গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসকে ত্যাগ করে । উবায়দুল্লাহ নিরুপায় হয়ে কুফার দিকে পলায়ন করে । আর মুয়াবিয়ার পাষাণহৃদয় সেনাবাহিনী বুসর বিন আবী আরতাতের নেতৃত্বে খুব সহজেই শহর দখল করে নেয় এবং উবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসের দুই শিশুসহ অনেক মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ।81

3. এ সময়ে ইয়েমেন ইসলামী ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় শহর হিসেবে গণ্য হতো না এবং বসরা ,মাদায়েন ও অন্য শহরগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরও তাঁর কাছে ছিল না যাতে ইমাম একটি শক্তিশালী সেনাদল গড়ে তুলতে পারেন এবং অন্যরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে পারে ।

4. মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের প্রাক্কালে ইয়েমেনের কয়েকটি গোত্রের মুরতাদ হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মনে তাদের ব্যাপারে খুব একটা ভালো ধারণা ছিল না । আর এ সম্ভাবনা ছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে ঐ জায়গা বাছাই করলে মানুষ হুকুমাতের বিরুদ্ধে এ আন্দোলনকে ইয়েমেনবাসীর অতীত কার্যকলাপের ধারাবাহিকতা হিসেবেই মনে করত ,বিশেষ করে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠী খুব সহজেই এ ক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনকে বিকৃত করার মাধ্যমে ফায়দা লুটত ।

5. ইয়েমেন অন্যান্য ইসলামী শহর থেকে দূরে থাকার কারণে সেখানে কোন বিদ্রোহ ঘটলে উমাইয়া শাসকদের পক্ষে খুব সহজেই সেটাকে দমন করার সম্ভাবনা ছিল ।

6. এ সময়ে ইয়েমেনবাসীর পক্ষ থেকে ইমামের কাছে কোন পত্র আসেনি । অতএব ,ইয়াযীদের মোকাবিলায় ইমাম হোসাইন (আ.)-কে রক্ষা করার জন্য তাদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ ছিল না । আর ইমাম হোসাইন (আ.)-কে দাওয়াত দেওয়ার জন্য কুফাবাসীর মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল তার শতভাগের এক ভাগও ইয়েমেনবাসীর মধ্যে ছিল না । কুফাবাসীর উৎসাহের মূল কারণ ছিল বনি উমাইয়ার যুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্তি ,সিরিয়ার মোকাবিলায় কুফার কেন্দ্রীয় শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ,কুফায় ন্যায়ের ভিত্তিতে আলী-বংশের শাসনের পুনরুদ্ধার এবং আহলে বাইতের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিরক্ষা ।