কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা
7 নং প্রশ্ন : যে কুফাবাসী যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে দাওয়াত দিল তারাই কেন পরবর্তীকালে ইমামকে সাহায্য না করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল ?
উত্তর : এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অন্য দু’
টি প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিতে হবে ।
এক. কুফাবাসীর চিঠি লেখা এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-কে দাওয়াত করার কারণ কী ছিল ?
দুই. উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফার আন্দোলন দমন করার জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছিল ?
এক. প্রথমে এ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মক্কায় অবস্থানকালে কুফাবাসীরা তাঁকে পত্র প্রেরণ শুরু করে ।
তাদের পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্রের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে ,ঐ অবস্থাকে পত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদ আন্দোলন বলা যেতে পারে । কয়েক দিনের মধ্যে এত ব্যাপকভাবে পত্র আসা শুরু হয় যে ,প্রতিদিন গড়ে 600 চিঠি ইমামের কাছে আসত । পরিশেষে চিঠির পরিমাণ প্রায় 12 হাজারে পৌঁছে ।
ঐ চিঠিসমূহের যেগুলো পাওয়া গেছে তার কতিপয় চিঠিতে উল্লিখিত নাম ও স্বাক্ষরসমূহের ব্যাপারে সার্বিক গবেষণা করে দেখা গেছে ,চিঠি লেখকগণ নির্দিষ্ট কোন দল বা গোত্রের ছিল না ;বরং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বিভিন্ন দল চিঠি লেখকদের মধ্যে ছিল । আর তাদের মধ্যে বিশিষ্ট শিয়া ব্যক্তিবর্গ ,যেমন ,সুলাইমান বিন সুরাদ খূজায়ী ,মুসাইয়্যাব বিন নাহবা খাজারী ,রোফাআ বিন শাদ্দাদ ও হাবীব বিন মাজাহের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও ছিলেন ।
অপরদিকে ,কুফায় বসবাসকারী উমাইয়া গোষ্ঠীর কতিপয় ব্যক্তি ,যেমন শাবাস বিন রিবয়ী (যে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের পর খুশি হয়ে মসজিদ নির্মাণ করেছিল)
,হাজ্জার বিন আবজার (যে আশুরার দিন উমর বিন সাদের দলে ছিল এবং ইমামের কাছে প্রেরিত চিঠির কথা অস্বীকার করেছিল)
,ইয়াযীদ বিন হারেস বিন ইয়াযীদ (সেও আশুরার দিন ইমামকে দেয়া চিঠির কথা অস্বীকার করেছিল)
,আজরা বিন কায়েস (উমর বিন সাদের অশ্ববাহিনীর সেনাপতি)
এবং আমর বিন হাজ্জাজ জাবিদী (যে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে ফোরাত নদীর পানি নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য 500 সৈন্য দ্বারা গঠিত একটি দলের সদস্য ছিল)
প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি দিয়েছিল । ঘটনাক্রমে উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক পত্রগুলো এরাই দিয়েছিল এবং ইমামকে বলেছিল-‘
কুফার সেনাবাহিনী আপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।’
কিন্তু মনে হয় ,অধিকাংশ পত্র লেখক সাধারণ মানুষ ছিল যাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয়নি এবং তারা দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই পত্র লিখেছিল । আর তারা যেদিকে বাতাস প্রবাহিত হয় সেদিকে চলত । যদিও দুর্যোগকালে তা প্রবাহিত করার ক্ষমতা এদের নেই তবুও এদের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে ,প্রচণ্ড এক শক্তি বলে বিবেচিত হতো-যাদেরকে ব্যবহার করে এক অভিজ্ঞ ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ফায়দা লুটতে এবং নিজ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে ।
সম্ভবত মুসলিমের কাছে বাইআতকারী 18 হাজার লোকের মধ্যে অধিকাংশই এরা ছিল । এরা যখন (উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কুটচক্রের কারণে) নিজেদের পার্থিব স্বার্থ হুমকির মুখে দেখে তখন মুসলিমের দল থেকে বের হয়ে যায় এবং তাঁকে কুফায় অসহায় অবস্থায় ত্যাগ করে ।
অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,এদেরকে কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অল্প সংখ্যক সৈন্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যাবে । কারণ ,উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাদের দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে বহু ওয়াদা দিয়েছিল । এছাড়া ,তারা মনে করত ইমামের সঙ্গী-সাথি কম থাকায় উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের বিজয়ের সম্ভবনা বেশি । এ সম্ভাবনা তাদের মনে যথেষ্ট আশার উদ্রেক করেছিল । আবার এরা এমন লোক ছিল যাদের অন্তরে নবীর দৌহিত্র এবং ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তান হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল । এদের সম্পর্কে মাজমা বিন আবদুল্লাহ আয়েজী ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেন :‘
অধিকাংশ মানুষের অন্তর তোমার দিকে ,কিন্তু আগামীকাল তাদের তরবারি তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে ।’
এদেরই একটি দল কারবালার ময়দানে এক কোনায় দাঁড়িয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের দৃশ্য দেখছিল ,চেখের পানি ঝরাচ্ছিল এবং দোয়া করছিল এ বলে যে ,‘
হে আল্লাহ! ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্য করুন ।’
উপরিউক্ত ভূমিকার পর এ ফলাফলে পৌঁছি যে ,পত্র লেখকদের মধ্যে বিভিন্ন দল থাকায় কোন ক্রমেই তাদের উদ্দেশ্য এক ছিল বলে মনে করা যায় না ;বরং বিভিন্ন দলের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল । যেমন-
1. হাবীব বিন মাজাহের এবং মুসলিম বিন আওসাজার মতো খাঁটি শিয়ারা খেলাফতকে আহলে বাইতের ন্যায্য অধিকার এবং উমাইয়াদের যুলুম-অত্যাচারের রাজত্বকে অবৈধ মনে করতেন । তাঁরা খেলাফতের পুনরুদ্ধার এবং উপযুক্ত জায়গায় তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য চিঠি লিখেছিলেন । তবে তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম ছিলেন ।
2. কুফার অনেক লোক বিশেষ করে মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ,যারা কুফায় হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা মনে রেখেছিল এবং মুয়াবিয়ার বিশ বছরের শাসনামলে উমাইয়া গোষ্ঠীর যুলুম-অত্যাচার দেখেছিল তারা এ অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তানের প্রতি মুখ চেয়ে ছিল যাতে তাঁর মাধ্যমে উমাইয়া শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে ।
3. একদল লোক কুফায় রাজধানী ফিরিয়ে আনার জন্য একজন যোগ্য নেতা খুঁজছিল ,যিনি এ কাজ সম্পাদন করতে পারেন । কারণ ,কুফার সাথে সিরিয়ার প্রতিযোগিতা ছিল এবং মুয়াবিয়ার বিশ বছরের শাসনামলে রাজধানী কুফা থেকে সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল । এদের দৃষ্টিতে এ সময়ে ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন একজন উপযুক্ত ব্যক্তি যিনি একদিকে কুফাবাসীকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ,অপরদিকে উমাইয়াদের শাসনকে অবৈধ মনে করেন । এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ দল ইমাম হোসাইন (আ.)-কে কুফায় আসার জন্য দাওয়াত করেন ।
4. শাবাস বিন রাব্য়ী ও হাজ্জার বিন আবজারের মতো গোত্রপতিরা একদিকে নিজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার চিন্তায় ছিল ,অপরদিকে নবী-বংশের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না । যখন তারা দেখল ,কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত ,তখন তারা ধারণা করল ভবিষ্যতে অবশ্যই কুফায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে । ঐ সময় তারা যেন কাফেলা থেকে পেছনে পড়ে না থাকে
এবং ইমামের খেলাফতকালে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয় এজন্য পত্র লেখকদের অন্তর্ভুক্ত হয় ।
5. সাধারণ মানুষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে চিঠি লিখতে আগ্রহী হয় এবং বিদ্রোহের আগুনকে উস্কে দেয় ।
দুই. উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কুফায় প্রবেশের ফলে গোত্রপতিরা ও উমাইয়া গোষ্ঠীর অনুসারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে । খুব দ্রুত তার চারিদিকে সমবেত হয় এবং কুফার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনা তার সামনে বর্ণনা করে । উবায়দুল্লাহ কুফায় প্রবেশের সাথে সাথে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি কুফাবাসীর ভালোবাসা এবং আন্দোলনের পরিধি সম্পর্কে উত্তমরূপে অবগত হয় ;কারণ ,সে মাথায় কাল পাগড়ি ও নেকাব পরিহিত অবস্থায় কুফায় প্রবেশ করে । আর এদিকে ,ইমামের জন্য প্রতীক্ষারত কুফাবাসী তাকে ইমাম হোসাইন (আ.) মনে করে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় ।
আর এভাবে উবায়দুল্লাহ খুব ভালোভাবে বিপদের গভীরতা আঁচ করে এবং বসরায় স্বীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যে দক্ষতা ছিল তার ওপর ভিত্তি করে ও স্বীয় অনুসারীদের সহযোগিতায় কুফাবাসীর আন্দোলন দমন করার জন্য খুব দ্রুত প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নেয় । তার এ রাজনীতিকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যথা:-মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ,সামাজিক কৌশল ও অর্থনৈতিক কৌশল । নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো:
1. মনস্তাত্ত্বিক কৌশল : ইবনে যিয়াদ কুফায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভনের অপকৌশল হাতে নেয় । কুফার জামে মসজিদে সে তার প্রথম বক্তৃতায় নিজেকে অনুগতদের জন্য দয়ালু পিতা হিসেবে উল্লেখ করে ,আর অবাধ্য ব্যক্তিদের জন্য তরবারি ও চাবুকের কথা বলে ।
সে আরেকটি কৌশল কাজে লাগায় । আর তা হলো ,সে কুফাবাসীকে জানায় যে ,সিরিয়ার বিশাল বাহিনী বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য কুফার দিকে আসছে । তার এ ঘোষণার পর কুফার বিদ্রোহ ,বিশেষ করে যারা মুসলিমের সাথে‘
দারুল ইমারাহ’
অবরোধ করে রেখেছিল তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিস্তেজ হয়ে পড়ে ।
কুফাবাসী সিরিয়ার বাহিনীর সাথে তাদের সর্বশেষ সংঘর্ষের-অর্থাৎ ইমাম হাসান (আ.) যখন সন্ধি করেছিলেন-পর থেকে সিরিয়ার বাহিনীকে প্রচণ্ড ভয় পেত এবং সমসময় মনে করত ঐ বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করার কোন শক্তি তাদের নেই । কুফার মহিলারাও এ রকম মনোভাব পোষণ করত । এজন্য ইবনে যিয়াদের ঘোষণার পর পরই মহিলারা তাদের স্বামী ,ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন যারা মুসলিমের সাথে ছিল তাদের কাছে যায় এবং তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।
পরিশেষে এ ধরনের কৌশলের ফলেই যে মুসলিম দুপুরে চার হাজার কুফাবাসীকে সাথে নিয়ে দারুল ইমারাহ অবরোধ করে রেখেছিল এবং উবায়দুল্লাহকে পতনের সম্মুখীন করে তুলেছিল সেই মুসলিম রাতের প্রথম প্রহরে কুফার গলিতে একাকী ঘুবতে থাকেন ।
2. সামাজিক কৌশল : যেহেতু তখন পর্যন্ত গোত্রীয় ঐক্য ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেহেতু গোত্রপতিরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামাজিক দিক থেকে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী ছিল । এজন্য তাদের অনেকেই (যেমন : শাবাস বিন রাবয়ী ,আমর বিন হাজ্জাজ ও হাজ্জার বিন আবজার) পত্র প্রেরণের আন্দোলনে কার্যকর ভাবে যোগ দিয়েছিল এবং স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিমের কুফায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাথে মিলিত হয়েছিল । কিন্তু অধিকাংশই যেহেতু নিজের পদ ও দুনিয়ার স্বার্থ রক্ষার চিন্তায় ছিল সেহেতু উবায়দুল্লাহ্ কুফায় প্রবেশের পর তারাও তার হুমকির মুখে পড়ে মুসলিমের কাছ থেকে সরে গিয়ে উবায়দুল্লাহর বাহিনীতে যোগ দেওয়াটাকেই তাদের দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করে । এ জন্য তারা খুব দ্রুত বিদ্রোহ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । কারণ ,উবায়দুল্লাহ খুব ভালোভাবে জানত যে ,তাদেরকে কিভাবে নিজের পাশে একত্র করা যায় । সে হুমকি ও মোটা অংকের ঘুষের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে গোত্রপতি ও বিভিন্ন অঞ্চলের সম্মানী ব্যক্তিদেরকে নিজের পাশে জড়ো করতে সক্ষম হয় । মুজতামা বিন আবদুল্লাহ আয়েজী ,যে কুফার অবস্থা ভালোভাবে জানত এবং সবেমাত্র কুফা থেকে বের হয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ,সে ইমামের নিকট কুফার গোত্রপতিদের সম্পর্কে বলে :‘
কুফার গোত্রপতি ও সম্মানী ব্যক্তিদেরকে মোটা অংকের ঘুষ দেয়া হয়েছে ,তাদের গোডাউনগুলোকে গম আর যব দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে ,তাদের ভালোবাসাকে টাকা-পয়সা দিয়ে কিনে নেয়া হয়েছে ,তারা শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে এবং আপনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে... ।’
সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী দ্বিতীয় যে দলটিকে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ ব্যবহার করে সেটি হলো অভিভাবক দল । পরিভাষায় অভিভাবক সেই ব্যক্তিকে বলা হতো যার ওপর কয়েক ব্যক্তিকে দেখাশুনা করার ভার ন্যস্ত ছিল । তাদের অনেকেই সরকার থেকে বাৎসরিক এক লক্ষ দিরহাম লাভ করত ।
তবে বিভিন্ন অভিভাবকের আয়ের পরিমাণ ছিল বিভিন্ন রকম । আর তাদের অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যা বিশ থেকে একশ’
র ওপর ছিল ।
যখন কুফায় গোত্রবাসীরা শহরে বাস করা শুরু করে তখন এ পদ একটি সরকারি পদে রূপান্তরিত হয় এবং এ পদের অধিকারীদেরকে কুফার ওয়ালী ও আমীরের কাছে জবাবদিহি করতে হতো ।
আর তাদের নিয়োগ এবং অপসারণও গোত্রপতির মাধ্যমে না হয়ে ওয়ালীর (গভর্নর) মাধ্যমে হতো । এ পদ সরকার এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করত । আর এ পদের অধিকারীদের অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যা যেহেতু গোত্রপতির অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যার থেকে অনেক কম ছিল সেহেতু তারা খুব সহজেই স্বীয় অধীনস্থ লোকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত ।
অভিভাবকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল রেজিস্ট্রি খাতায় স্বীয় অধীনস্থ লোকদের স্ত্রী ও সন্তানসহ নামের তালিকা তৈরি করা । যখনই কেউ জন্মগ্রহণ করত তখনই তার নাম এ খাতায় লিপিবদ্ধ হতো ,অপরদিকে কেউ মারা গেলে তার নাম মুছে ফেলা হতো । এভাবে তারা স্বীয় অধীনস্থ লোকদের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল থাকত । কিন্তু দুর্যোগময় মুহূর্তে অভিভাবকদের কাজ কয়েক গুণ বেড়ে যেত । কারণ ,স্বীয় অধীন এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব-যেটাকে অভিভাবকত্ব বলা হতো-তাদের ওপর ন্যস্ত ছিল । আর সরকার নির্দেশ দেয়া মাত্রই বিদ্রোহী দলকে খুব দ্রুত শাসকদের কাছে পরিচিত করাতে হতো ।
উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফায় প্রবেশ করার পরই চতুরতার সাথে সামাজিক দিক থেকে শক্তিশালী এ দলটিকে ব্যবহার করা শুরু করে । সম্ভবত উবায়দুল্লাহ্ এ কাজের অভিজ্ঞতা স্বীয় পিতা যিয়াদের কাছে তার কুফায় শাসনকালে শিখেছিল । সে কুফার জামে মসজিদে প্রথম বক্তৃতা করার পর রাজপ্রাসাদে আসে এবং অভিভাবকদেরকে একত্রিত করে তাদের উদ্দেশে বলে :‘
তোমরা অবশ্যই তোমাদের অধীনস্থ এলাকায় বসবাসরত অস্থানীয় এবং আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদের বিরোধী লোকদের তালিকা তৈরি করে আমাকে দেবে । তেমনি খারেজী সম্প্রদায় এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তি যারা বিরোধ সৃষ্টি করতে চায় তাদের ব্যাপারেও আমার কাছে প্রতিবেদন দেবে । যে ব্যক্তি আমার এ নির্দেশ পালন করবে তার সাথে আমার কোন বিরোধ নেই ,কিন্তু যে ব্যক্তি তালিকা তৈরি করবে না সেও যেন স্বীয় এলাকার ব্যাপারে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে যে ,তার এলাকার কোন বিদ্রোহী বা বিরোধী ব্যক্তি আমাদের সাথে বিরোধিতা না করে । আর যদি এ রকম না করে তাহলে আমাদের নিরাপত্তা তার ওপর থেকে তুলে নেয়া হবে এবং তার জান ও মালের কোন নিরাপত্তা থাকবে না । আর যে অভিভাবকের এলাকায় আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদের কোন বিরোধীকে পাওয়া যাবে সে অভিভাবককে তার বাড়ির দরজার ওপর ফাঁসিতে ঝুলানো হবে এবং ঐ এলাকায় কোন বাৎসরিক বাজেট প্রদান করা হবে না ।
অতএব ,বলা যেতে পারে যে ,কুফায় মুসলিমের আন্দোলন নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল উবায়দুল্লাহর এ ধরনের নীতি অবলম্বন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মাধ্যমসমূহের ব্যবহার । কারণ ,অভিভাবকগণ ইবনে যিয়াদের হুমকিকে সত্য বলে মনে করেছিল এবং খুব দ্রুত তার চাওয়া-পাওয়াগুলো পূরণ করেছিল আর কঠিনভাবে স্বীয় এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল ।
3. অর্থনৈতিক কৌশল : ঐ সময় জনগণের গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য গ্রহণ । তারা ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে যুদ্ধের শুরুতে এ সাহায্য গ্রহণ করত । তাদের শহুরে জীবন শুরু হওয়ার পর এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও আগের রীতি মোতাবেক তাদেরকে সেই সাহায্য প্রদান করা হতো । এ কারণে আরব জনগণ শিল্প ,কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব কম মনোযোগ দিত । সাধারণত এ কাজগলো মাওয়ালীরা (যেসব অনারব আরবদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল) করত । এ অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ,মূলত ঐ সময়ে আরবগণ শিল্প ও যে কোন পেশায় রত হওয়াটাকে নিজের পদ-মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করত ।
সরকারি‘
সাহায্য’
নগদ পরিশোধযোগ্য একটি পরিমাণ ছিল যা কুফার শাসকদের পক্ষ থেকে এককালীন অথবা কয়েক কিস্তিতে জনগণকে প্রদান করা হতো । এছাড়া খেজুর ,গম ,যব ও তেলসহ বিভিন্ন জিনিস রেশন হিসেবে প্রতি মাসে তাদেরকে দেয়া হতো । বলার অপেক্ষা রাখে না যে ,এ রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অধিকাংশ আরবকে প্রচণ্ডভাবে সরকারের প্রতি নির্ভরশীল করে রাখত এবং স্বৈরাচারী শাসকগণও এ দুর্বল দিকটি ভালো করে জানত ;ফলে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত ।
উবায়দুল্লাহ্ বিন যিয়াদ অভিভাবকদেরকে ভয়-ভীতি দেখানোর সময় এ হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করে এবং কোন অভিভাবকের এলাকায় বিদ্রোহী ব্যক্তিকে পাওয়া গেলে ঐ এলাকার সকল লোকের সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার মতো কঠিন পরিণিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকগণ ছাড়াও দুনিয়াকামী অন্য ব্যক্তিরাও বিদ্রোহ দমনে মাঠে নেমেছিল ।
যখন মুসলিম এবং তাঁর সাথিরা উবায়দুল্লাহর প্রাসাদ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তখন তার এক সফল অনুচর মুসলিমের সাথিদেরকে বিচ্ছিন্ন করার কাজে ব্যস্ত ছিল এবং তাদেরকে এ বলে লোভ দেখাচ্ছিল যে ,যদি তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে তাদের রেশন ও অন্যান্য সাহায্য বাড়িয়ে দেয়া হবে । পক্ষান্তরে ,যদি বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের রেশন বন্ধ করে দেয়া হবে ।
ইবনে যিয়াদ এ অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে এবং রেশন বৃদ্ধির ওয়াদা দিয়ে কুফার জনগণের মধ্য থেকে 30 হাজার
সৈন্য সম্বলিত এক বিশাল বাহিনী তৈরি করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠাতে সক্ষম হয় ;যে বাহিনীর অনেকের হৃদয় ছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দিকে ।
ইমাম হোসাইনও এ হাতিয়ারের প্রভাব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন । আর এজন্য তিনি আশুরার দিন স্বীয় বক্তৃতায় তাঁর বিরুদ্ধে কুফাবাসীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি কারণ হিসেবে সেটিকে উল্লেখ করেছিলেন :‘
তোমরা সবাই আমার বিরোধিতা করছ এবং আমার বক্তব্য শুনছ না ;কারণ ,হারাম মাল থেকে তোমাদেরকে সাহায্য দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের পেট হারামে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে । আর এটা তোমাদের অন্তরের ওপর মোহর পড়ে যওয়ার কারণ হয়েছে ।’
কারবালায় পিপাসা
8 প্রশ্ন নং : কারবালায় কী রকম পিপাসা ছিল ?
উত্তর : নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে যা পাওয়া যায় তা হলো ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের তিন দিন পূর্বে অর্থাৎ সাতই মুহররম উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ সেনাপতি উমর বিন সাদকে নির্দেশ দিয়েছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে পানি নেয়া থেকে বিরত রাখ এবং তাঁকে এক ফোঁটা পানি পান করার সুযোগ দিও না । আর সে উসমানের ওপর পানি বন্ধ করার প্রতিশোধ নেয়ার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে এ কাজ করে!
উমর বিন সাদ এ নির্দেশ পাওয়া মাত্র আমর বিন হাজ্জাজকে 500 অশ্বারোহী সাথে দিয়ে ফোরাত নদীর তীর বন্ধ করার হুকুম দেয় যাতে ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিরা পানি নিতে না পারে ।
এ দুই তিন দিন ইমাম এবং তাঁর সাথিরা বিভিন্ন পন্থায় পানি আনার চেষ্টা করছিলেন ;কারণ ,ঐ উত্তপ্ত মরুভূমিতে পিপাসার কষ্ট সহ্য করা বিশেষ করে শিশু ও নারীদের সাধ্যের বাইরে ছিল ।
কোন কোন গ্রন্থে এ রকম এসেছে : ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর শিবিরে পানির জন্য কূপ খনন করা শুরু করেছিলেন ;কিন্তু ইবনে যিয়াদের কাছে যখন এ খবর পৌঁছল তখন সে উমর বিন সাদকে নির্দেশ দিল ,অবরোধ যেন কঠোর করা হয় এবং কূপ খনন করতে বাধা দেয়া হয় ।
আবার কোন কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে এসেছে ,হযরত আব্বাস (আ.) 30 জন অশ্বারোহী এবং 20 জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে পতাকাবাহী নাফে বিন হেলালের সাথে রাতের বেলায় ফোরাতের তীরে হামলা করেন । তারা আমর বিন হাজ্জাজের বাহিনীর সাথে লড়াই করার পর 20 মশক পানি নিয়ে আসতে সক্ষম হন ।
উপরিউক্ত ঘটনার সুনির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ করা হয়নি । তবে এ বাক্যটি বর্ণিত হয়েছে :‘
যখন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের পিপাসার কষ্ট চরম আকার ধারণ করেছিল ।’
কোন কোন জায়গায় বলা হয়েছে : ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরার দিনে তাঁর বোন যায়নাবের চেহারার ওপর পানি ছিটিয়ে দিয়েছিলেন ;কারণ ,তিনি যখন শাহাদাত নিকটবর্তী হওয়া সম্পর্কিত ইমামের কবিতা শ্রবণ করেন তখন বেহুশ হয়ে যান ।
উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,আশুরার রাতে ইমামের শিবিরে পানি ছিল । আল্লামা মাজলিসী (র.)‘
বিহারুল আনওয়ার’
গ্রন্থে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন যে ,আশুরার দিন সকাল বেলাতেও খাওয়ার পানির কোন সমস্যা ছিল না ।
এ সম্পর্কে এভাবে বলা হয়েছে :“
অতঃপর ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় সাথিদেরকে বললেন :‘
ওঠ ,পানি পান কর ;কারণ ,এটা হচ্ছে তোমাদের সর্বশেষ খাদ্য । ওজু কর এবং গোসল কর । আর নিজেদের কাপড়গুলোকে পানি দিয়ে ধৌত কর যাতে ঐগুলো তোমাদের কাফন হতে পারে ।’
ঐ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁদের সাথে ফজরের নামায জামাতে আদায় করেন ।’
‘
এটা তোমাদের সর্বশেষ খাদ্য’
এই বাক্য এবং আশুরার দিবস সম্পর্কিত অন্যান্য বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,সঞ্চিত পানি শেষ হওয়ার পর পুনরায় পানি সংগ্রহ সম্ভব হয়নি । আর ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদেরকে নিয়ে কারবালার ঐ উত্তপ্ত মরুভূমিতে শাহাদাতের মুহূর্ত পর্যন্ত একদিকে দুশমনদের সাথে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন ,অপরদিকে কঠিন পিপাসায় কাতর ছিলেন ।
আল্লামা মাজলিসী (র.) স্বীয় বর্ণনায় তামীম বিন হাসীন খাজারী নামে উমর বিন সাদের এক সৈন্যের উপহাসের কথা উল্লেখ করেন । সে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলছিল :‘
হে হোসাইন! হে হোসাইনের সাথিরা! ফোরাত নদীর পানি দেখতে পাচ্ছ ,কিভাবে সাপের পেটের মতো জ্বলজ্বল করছে ;খোদার শপথ! মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানি সেখান থেকে পান করতে পারবে না ।’
হুর ইবনে ইয়াযীদ আশুরার দিন কুফাবাসীকে নসীহত করার সময় ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের ওপর ফোরাত নদীর পানি বন্ধ রাখার জন্য তাদেরকে খুব তিরস্কার করেন ।
কোন কোন গ্রন্থে এসেছে ,ইমাম (আ.) পানি নিয়ে আসার জন্য খুব চেষ্টা করছিলেন ;কিন্তু শিমার বাধা দিয়েছিল এবং ইমামকে উপহাস করেছিল । এ কারণে ইমাম তাকে অভিসম্পাত করেন ।
আল্লামা মাজলিসী (র.) একটি হাদীস বর্ণনা করেন যার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে ,হযরত আব্বাস যুদ্ধ করার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন আর ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁকে শিশুদের খাওয়ার পানি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন । প্রসিদ্ধ মতে ,হযরত আব্বাস (আ.) পানি নিয়ে আনতে সক্ষম হননি ;বরং ফেরার পথে শাহাদাত বরণ করেন ।
পানির জন্য আবেদন
9 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.) কি শত্রুদের কাছে নিজের জন্য পানির আবেদন করেছিলেন ?
উত্তর : আশুরার দিন সকাল বেলায় যদিও ইমাম হোসাইন (আ.) ,তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথিরা কঠিন পিপাসায় কাতর হয়ে গিয়েছিলেন ,তবুও কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে আসেনি যে ,তিনি শত্রুদের কাছে পানির আবেদন করেছিলেন ।
মূলত কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থেই পিপাসার বিষয়টি এতটা গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়নি ,তবে সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোর কোন কোন কিতাবে এবং বক্তাদের মাঝে এ বিষয়টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে । আশ্চর্যের বিষয় হলো ,যুদ্ধের ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের বীরত্বপূর্ণ কবিতায় পিপাসার প্রতি কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না ।
এর বিপরীতে আশুরার দিন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কবিতা ও বক্তব্যে যা দেখতে পাওয়া যায় তা আত্মসম্মান ,মর্যাদা এবং বীরত্বগাথায় পরিপূর্ণ । উদাহরণস্বরূপ ঐ বিখ্যাত বাক্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে যা আশুরার দিনে ঘোরতর যুদ্ধের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) পাঠ করেছিলেন :‘
জেনে রাখ ,জারজের সন্তান জারজ ইবনে যিয়াদ আমাকে দু’
টি বিষয়ের যে কোন একটি মানতে বলেছে: হয় তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে ,আর না হয় অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইআত করতে হবে । কিন্তু অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে দূরে । আর আল্লাহ ,আল্লাহর রাসূল ,ঈমানদারগণ ,পবিত্র ক্রোড়ে লালিত ব্যক্তিগণ ,পৌরুষের অধিকারী এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমাদের জন্য বৈধ মনে করেন না যে ,নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্যের লাঞ্ছনাকে সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করার ওপর প্রাধান্য দেই ।’
কোন কোন আলোচনা সভা ও শোকানুষ্ঠানে ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের সম্মান-মর্যাদা ও বীরত্বপূর্ণ দিকটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না ,বরং ইমামের ওপর দয়া ও অনুকম্পার বিষয়টি আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয় । একদল কারবালার ঘটনাকে বেশি করুণ করে তোলার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কিস্সা-কাহিনীর আশ্রয় নেয় এবং কোন কোন সময় ইমামের চেহারাকে কলঙ্কিত করে তুলে ধরে ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ,এসব মিথ্যা কিসসা-কাহিনীর একটিতে এসেছে ,ইমাম হোসাইন (আ.) উমর বিন সাদের কাছে গিয়ে তিনটি আবেদন করেন যার দ্বিতীয়টি ছিল ,‘
আমাকে একটু পানি পান করাও ,কারণ ,তৃষ্ণায় আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে’
,
কিন্তু উমর বিন সাদ বেহায়ার মতো এ আবেদন নাকচ করে ।
যদিও এ ঘটনাগুলো পাথরের চোখেও পানি প্রবাহিত করতে সক্ষম ,কিন্তু অন্যদিকে আশুরা এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সম্মানিত চেহারার ওপর কালিমা লেপন করে । আর চিন্তাশীল শিয়াদেরকে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মৌলিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে । পরিশেষে ,দুশমনদের হাতে বাহানা তুলে দিয়ে শিয়াদের সম্মান ও মর্যাদার ওপর বড় ধরনের আঘাত হানে ।