সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ
প্রশ্ন 15 : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ কথা‘
আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য উত্থান করেছি’
বলার উদ্দেশ্য কী ?
উত্তর : এই উক্তিটি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের প্রকৃত মর্যাদাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে ।
ইমাম হোসাইন (আ.) এ উক্তির মাধ্যমে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মৌলিক ভূমিকাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন । তিনি তাঁর উত্থানের আসল উদ্দেশ্য এ কাজটি সম্পাদনের মধ্যেই নিহিত বলে বিশ্বাস করেন । যদি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের প্রকৃত মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয় তাহলেই ইমামের এই উক্তির উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে ।
প্রকৃত অর্থে‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’
সম্পর্কে সকল ঐশী ধর্মেই আলোচনা করা হয়েছে এবং তা সকল নবী ,রাসূল ,নিষ্পাপ ইমাম ও মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত । এই বিষয়টি শুধুই শরীয়তের বিধানগত দায়িত্ব নয় ;বরং প্রকৃত অর্থে এটা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল প্রেরণের মানদণ্ড ,অন্যতম উদ্দেশ্য এবং কারণ । কেননা ,এই বস্তুজগৎ ভালো ও মন্দ ,হক ও বাতিল ,আনন্দদায়ক ও কষ্টদায়ক জীবন ও পরিণতি ,অন্ধকার ও আলো ,মর্যাদাকর ও অমর্যাদাকর গুণাবলির সংমিশ্রণ এবং এগুলো কখনো কখনো এমনভাবে পরস্পর একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ে যে ,সেগুলো থেকে সঠিক ও সত্যকে শনাক্ত করে তার ওপর আমল করা বা সেগুলোকে মেনে চলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে ।
ঐশী ধর্মগুলো সৎকর্ম ও অসৎকর্মের সাথে মানুষকে পরিচিত করানোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভালো ও মন্দ ,সত্য ও মিথ্যা ,অন্ধকার ও আলো ,সৎগুণ ও অসৎগুণের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং সেই সাথে সৎকর্মের প্রতি আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধ করার নির্দেশ দিয়ে ঐশী পথনির্দেশনার শিক্ষা দিয়েছে আর এভাবে তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেছে ।
রাসূল (সা.) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন :‘
যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে সে এই দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর মহাগ্রন্থ ও তাঁর রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ।’
হযরত আলী (আ.) বলেছেন :‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ হচ্ছে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখার ভিত্তি ।’
কোরআনুল কারীম একজন মুমিনের জন্য সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার বিষয়টিকে নামায আদায় ,যাকাত প্রদান ,আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যের পূর্বে উল্লেখ করে এর বিশেষ গুরুত্ব তুলে ধরেছে ।
ইমাম বাকের (আ.)ও বলেছেন :‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি রাসূলগণের কাজ ,সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের অনুসৃত রীতি ;এটি এমনই এক আবশ্যিক দায়িত্ব যার মাধ্যমে অন্যান্য ওয়াজিব তথা অপরিহার্য কর্মগুলো প্রতিষ্ঠা লাভ করে । সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমেই পথসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় । এর কারণেই ব্যবসা -বাণিজ্য ও উপার্জনের হালাল পথসমূহ উন্মুক্ত হয় (ও হারাম পথগুলো বন্ধ হয়) । সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালনই শত্রুদেরকে সুবিচার করতে বাধ্য করে.. ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মাধ্যমেই বিভিন্ন কর্ম সুশৃঙ্খল হয়ে থাকে ।
সুতরাং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্বটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্যই নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত নয় ;বরং এটা সকল নবী-রাসূল ,আল্লাহর মনোনীত ইমাম ,সৎকর্মপরায়ণ ও মুমিন বান্দার ওপর অর্পিত দায়িত্ব । কিন্তু যেহেতু সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিষয়টি সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইনের) সময়ে চূড়ান্তভাবে অবহেলিত কর্মে পরিণত হয়েছিল এবং সমাজের (রাষ্ট্রের শীর্ষ থেকে সাধারণ) সকল পর্যায়ে অসৎকর্ম ব্যাপকভাবে প্রচলন লাভ করেছিল এবং সৎকর্ম ও অসৎকর্ম পরস্পর মিশ্রিত হয়ে পড়েছিল ,এই অবস্থা দ্বীন ইসলামকে বিলুপ্ত ও রাসূলের সুন্নাতকে বিস্মৃতির সম্মুখীন করেছিল ,তাই বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো এবং রাসূলের সুন্নাত ও দ্বীন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত ও রক্ষা করার জন্য ইমাম হোসাইন (আ.) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করাকে একমাত্র পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । সে কারণেই তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সংস্কার সাধনই তাঁর বিপ্লবের উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেছেন :
انّی لم اخرج اشرا و لا بطرا و لا مفسدا و لا ظالما و انّما خرجت لطلب الاصلاح فی امّة جدّیصلىاللهعليهوآلهوسلم
ارید آن آمر بالمعروف و انهی عنالمنکر
‘
আমি উন্মাদনা বা অহংকারের বশে অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বা জুলুমকারী হিসেবে উত্থান করিনি । আমি কেবল আমার নানার উম্মতের সংশোধন করার জন্য বের হয়েছি । আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে চাই ।’
সৎকাজের আদেশ ও বিপদের ভয়
প্রশ্ন 16 : সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শর্ত হচ্ছে বিপদ ও ক্ষতির কোন ভয় বা আশঙ্কা না থাকা ,এই শর্তটি তো সে সময়ে বিদ্যমান ছিলই না । কারণ ,ইয়াযীদ ও বনি উমাইয়া শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও কর্মকাণ্ড-যাদের কাজ ছিল অত্যাচার চালানো ও নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা-থেকে সুস্পষ্ট যে ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ক্ষেত্র ও পরিবেশ ছিল না । তাই ঐ রকম পরিস্থিতিতে ইমাম হোসাইন (আ.) অথবা অন্য যে কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে এরূপ উদ্যোগ নেওয়ার অর্থ হচ্ছে মহাবিপদের সম্মুখীন হওয়া! অতএব ,কিভাবে তিনি সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার সংগ্রামে নামলেন ?
উত্তর : আমরা আল্লাহর বিধান পালনের শর্তাবলি এবং তার বৈশিষ্ট্য ও শাখাগত দিকগুলো অবশ্যই রাসূল (সা.) এবং ইমামগণের অনুসৃত নীতি ও কর্মপদ্ধতি থেকে গ্রহণ করব । আর যে কোন কর্মের শরীয়তগত বৈধতার শর্ত হচ্ছে এই যে ,ইমামগণের মাধ্যমে তা সম্পাদিত বা বর্ণিত হতে হবে । অন্য কথায় ,ঐ মহান ব্যক্তিদের বাণী ও কর্মই (চাল-চলন বা আচার-আচরণ) হলো কোন কর্মের শরীয়তসিদ্ধতার প্রমাণ ।
অতএব ,যদি ধরে নিই যে ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজটি‘
(সমাজের ওপর) বাস্তব প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ও আদেশ-নিষেধকারী ব্যক্তি নিজে বিপদমুক্ত থাকা’
র শর্তাধীন এবং এ বিষয়টি সর্বজনীন ও সামগ্রিক একটি শর্ত (যা সকল অবস্থার জন্য প্রযোজ্য) বলে বিবেচিত ,তাহলেও ইমাম হোসাইনের এই বিপ্লবী উদ্যোগ ও কর্ম ঐ শর্তকে বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করবে এবং তা সর্বজনীনতা হারাবে । কারণ ,তাঁর পদক্ষেপ থেকে এটাই বুঝতে পারি যে ,যদি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের পেছনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন কল্যাণকর উদ্দেশ্য থাকে তাহলে এই শর্ত দু’
টির আর কার্যকারিতা থাকে না । বরং উল্লিখিত শর্ত দু’
টি না থাকলেও-অর্থাৎ যদিও সেক্ষেত্রে ক্ষতির ও মহাবিপদের সম্ভাবনাও থাকে-সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটি করতে হবে ।
এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের পেছনে নিহিত কল্যাণের গুরুত্বের সাথে ব্যক্তির সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়টিকে যাচাই করতে হবে । যদি কল্যাণের বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ (যেমন-সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের ওপর দ্বীন অবশিষ্ট থাকার বিষয়টি নির্ভরশীল) হয়ে থাকে ,তাহলে ক্ষতিকে স্বীকার করে নেয়া আবশ্যক । আর এ ক্ষেত্রে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা থেকে বিরত থাকাটা উচিত নয় বা জায়েয নয় ।
অন্য কথায় ,সাধারণ পর্যায়ের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ-যেমন পাপ ও আইনবিরোধী কোন কাজ করা থেকে কোন ব্যক্তিকে বিরত রাখা এবং আইন অনুসরণ ও কর্তব্য পালনে বাধ্য করা এবং সর্বজনীন ও সর্বব্যাপী সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের (যেটার সাথে দ্বীন ও ঐশী হুকুম-আহকাম ও আল্লাহর নিদর্শনসমূহ টিকে থাকার বিষয়টি জড়িত ,যেটা পরিত্যাগ করলে মুসলমানরা অপূরণীয় ক্ষতি ও দুর্দশার শিকার হবে) মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে । যেমন ইয়াযীদের শাসনামলে ইসলামী রাষ্ট্র একটি কুফরী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার মতো
ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সে সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতিই সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে ,অতি শীঘ্রই দ্বীন-ইসলাম নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিবে ।
প্রথম (সাধারণ) পর্যায়ের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিষয়টি ক্ষতির দিক থেকে ব্যক্তি নিরাপদ থাকার শর্তের ওপর নির্ভরশীল ,কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়টির অপরিহার্যতা ক্ষতির দিক থেকে ব্যক্তি নিরাপদ থাকার ওপর নির্ভরশীল নয় ;বরং এক্ষেত্রে অবশ্যই দ্বীনকে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে ও দ্বীনকে বিপদমুক্ত করতে হবে ;এমনকি জান ও মাল উৎসর্গ করার বিনিময়ে হলেও ।
দ্বীন যে সম্পূর্ণ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে ইমাম হোসাইন (আ.) তা জানতেন । এ কারণে সেই প্রথমেই ,যখন মারওয়ান মদীনাতে ইমামকে ইয়াযীদের হাতে বাইআত করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন :
انّا لله و انّا الیه راجعون و علی الاسلام السلام اذ قد بلیت الامّة براعمثل یزید
‘
...অবশ্যই ইসলামকে চির বিদায় জানাতে হবে যখন উম্মত ইয়াযীদের মতো রাখালের (নেতা) কবলে পড়েছে’
অর্থাৎ যখন ইয়াযীদের মতো ব্যক্তি মুসলমানদের নেতৃত্বে এসেছে তখন এটা স্পষ্ট যে ,ইসলাম কী ধরনের পরিণতির স্বীকার হবে! যেখানে ইয়াযীদ থাকবে সেখানে ইসলাম থাকতে পারে না । আর যেখানে ইসলাম থাকবে সেখানে ইয়াযীদ থাকতে পারে না ।
এ ধরনের অন্যায় কর্ম ও বিপদের মোকাবিলায় ইমাম হোসাইন (আ.) অবশ্যই রুখে দাঁড়াবেন ও প্রতিবাদ করবেন এবং ইসলামকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে যাবেন না ;যদিও তাঁকে ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করা হোক না কেন । কেননা ,তিনি তাঁর বেঁচে থাকার চাইতে ইসলামের বেঁচে থাকাটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন । অতএব ,স্বীয় জীবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করতে হবে । আর সে জন্যই যদিও তাঁর পরিবার-পরিজন ও শিশুরা কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন ,তবুও তিনি স্বীয় কর্মসূচি ও দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি ।
হ্যাঁ ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ছিল সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের উদ্দেশ্যে এবং যুলুম-নির্যাতন ও কুফর ও ইসলামের শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে । কিন্তু বিশ্বের ইতিহাস কখনো এ ধরনের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের নমুনা দেখেনি । যুলুম-নির্যাতন ও কুফরের বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধ কেউ অবলোকন করেনি । কারণ ,ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার চরম পিশাচ যালিমদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও স্বীয় বিশ্বাস ও সম্মানকে রক্ষা করেছেন এবং স্বীয় কর্তব্য পালনে অতুলনীয় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন ।
আবু আবদিল্লাহ ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন এমনই এক ব্যক্তি যিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের পথে 10ই মুহররমের দিনে এমন মানসিক শক্তি ও সাহসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে ,সকল মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং সত্যের পথে শহীদদের মধ্যে প্রথম হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন ।
এ পর্যায়ে আয়াতুল্লাহ ওস্তাদ শহীদ মোতাহ্হারীর নির্মল বাণীর কিছু অংশ উল্লেখ করা উপযুক্ত বলে মনে করছি । তিনি বলেছেন :‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজে যখন সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে তখন তা ওয়াজিব তথা অপরিহার্য হয়ে পড়ে ,এ ক্ষেত্রে সকলেই একমত পোষণ করেন । কিন্তু যে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয় সে ক্ষেত্রে অনেকেই বলে থাকেন যে ,ঐ দায়িত্বটি এখানেই শেষ ;অর্থাৎ এটার আবশ্যিকতা ঐ পর্যন্তই যে পর্যন্ত বিপদ বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না এবং যিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজ করবে তার যেন জান-মালের কোন ক্ষতিসাধন না হয় ও মান-সম্মানের যেন হানি না হয় । উল্লিখিত বিষয়গুলো ঐ দায়িত্ব-কর্তব্যের গুরুত্বকে ম্লান করে দেয় । কিন্তু কেউ কেউ বলেন ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব বা মর্যাদা এগুলোর অনেক ঊর্ধ্বে ;কারণ ,যদি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিষয়টি এতটাই সহজ ও সাধারণ হতো তাহলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সেটা ওয়াজিব তথা অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি অকার্যকর হতো ;কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বিষয়টি এমন নয় ,যেমন যদি পবিত্র কোরআন ধ্বংসের সম্মুখীন হয় ,ন্যায়বিচার অথবা
ইসলামী ঐক্য যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে আর বলা যাবে না-‘
আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজ করব না ;কেননা ,যদি কিছু বলতে যাই তাহলে আমার প্রাণনাশের ভয় আছে ,আমার মানহানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে অথবা সমাজ এটা পছন্দ করে না ।’
এদিক থেকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিষয়টি অত্যন্ত বড় একটি বিষয় যা কোন সীমা-পরিসীমা মানে না ,এমনকি ক্ষতির ও মহাবিপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তা আঞ্জাম দেওয়া ওয়াজিব বা অপরিহার্য হয়ে পড়ে । আমরা এটাই বলি যে ,হোসাইনী আন্দোলন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে-যা প্রমাণিত-অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে ;কারণ ,তিনি শুধুই যে স্বীয় জান ও মাল দিয়েছেন তা নয় ;বরং তাঁর অত্যন্ত প্রিয়ভাজনদের জীবনকেও এ পথে উৎসর্গ করে দিয়েছেন ,এমনকি তাঁর পরিবারের বন্দিদশাকেও এই মূলনীতির জন্যই মেনে নিয়েছেন । ইমামের এ কাজের ক্ষেত্রে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে ,এ রকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ-যে কোন বিপদ-আপদের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ওয়াজিব ও অপরিহার্য হবে এবং এই পথে যে কোন ক্ষতিকে জীবনের বিনিময়ে হলেও গ্রহণ করতে হবে ।
প্রশ্ন 17 : শরীয়তের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যেও সাধারণ শর্তসমূহের একটি শর্ত হচ্ছে-সামর্থ্য বা ক্ষমতা থাকা আর পাক-পবিত্র ও নিষ্পাপ আহলে বাইতের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ,এই আবশ্যকতা শুধু তাদের জন্য যারা এগুলো সম্পাদনের ক্ষমতা রাখে ;অথচ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনে আমরা দেখি যে ,জনগণ অজ্ঞতা ,নিস্পৃহতা ,দুর্বল ঈমান ,স্বার্থপরতা ,ভীতি ,কাপুরুষতা অথবা অন্য কোন কারণে তাঁকে সহযোগিতা দান থেকে বিরত থেকে ছিল এবং এক ক্ষমতাধর শাসকের সাথে লড়াইয়ের জন্য তেমন শক্তিও তাঁর ছিল না । তাহলে কি করে তিনি আন্দোলনে নামলেন এবং সেটাকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ হিসেবে ঘোষণা দিলেন ?
উত্তর : ওস্তাদ মোতাহহারী এ ব্যাপারে বলেছেন :‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের শর্তগুলোর মধ্যে একটি শর্ত হিসেবে‘
ক্ষমতা’
বা‘
শক্তি-সামর্থ্য’
থাকার বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়েছে-
انّما یجب علی القوی المطلع
‘
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজটি কেবল শক্তিমান ও এবিষয়ে জ্ঞাত ব্যক্তির জন্য ফরজ (নির্ধারিত)’
অর্থাৎ অক্ষম ব্যক্তি কখনোই যেন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজ না করে । এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে ,স্বীয় শক্তিকে সংরক্ষণ করে রাখ ও সফলতা অর্জন কর ,কিন্তু যে ক্ষেত্রে অক্ষম ও তোমার শক্তির অপচয় হবে সেক্ষেত্রে উদ্যোগ নিও না । এখানেও অনেকের জন্য একটি ভুলের উদ্রেক হয়েছে । তারা বলে থাকে ,যেহেতু অমুক কাজটি করার ক্ষমতা আমার নেই আর ইসলামও বলেছে যে ,যদি কোন কাজ করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে সেটা করার দরকার নেই ,তাই এ ক্ষেত্রে আমার কোন দায়িত্ব নেই অর্থাৎ আমি দায়িত্বমুক্ত । এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে : না! ইসলাম যেটা বলেছে সেটা হলো এই যে ,যাও ,শক্তি বা ক্ষমতা অর্জন কর ;আর এটা হচ্ছে শারতে ওজুদ ,না শারতে ওজুব ।
অর্থাৎ তুমি অক্ষম ,তোমার কোন কিছু করার প্রয়োজন নেই ,ঠিক আছে ,কিন্তু তোমাকে অবশ্যই শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করতে হবে যাতে সাফল্য অর্জন করতে পার ।
এই মূলনীতির জন্য শক্তি অর্জন করা এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে ,কখনো হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ করাও ফরয তথা অপরিহার্য হয়ে পড়ে । যেমন অত্যাচারী শাসকের নিকট থেকে কোন পদমর্যাদা লাভ করা ও তাদের অধীনে কাজ করা । কিন্তু যদি দেখা যায় যে ,এই পদটি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য একটি উসিলা বা মাধ্যম হতে পারে ,তাহলে অবশ্যই ঐ কাজটিই করা প্রয়োজন । ইসলামী ইতিহাসে এ রকম ঘটনা অনেক আছে যে ,কোন কোন ব্যক্তি আহলে বাইতের কোন ইমামের নির্দেশে খলিফাদের দরবারে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ।
যদি ঘটনাক্রমে ও আকস্মিকভাবে ক্ষমতা হাতে আসে ,তাহলেই কেবল সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ওয়াজিব । আর যদি এমনটি না হয় তাহলে আবশ্যক নয় ;এই ধরনের কথার ভিত্তি কতটুকু তা জানতে হলে আমাদেরকে ইসলাম সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার মূলনীতি ও বিশ্বাসকে কতটা মূল্যায়ন করেছে তা অবশ্যই পর্যালোচনা করে দেখতে হবে ।
কেননা ,বলা হয়েছে যে ,এই মূলনীতিটি দ্বীন-ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিশ্চয়তা দানকারী । আর এ কারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিগণ শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজন বন্দিদশা ভোগ করেছেন । শেষ যুগের কতক লোকের সমালোচনায় হাদীসে এসেছে যে ,
لا یوجبون امراً بالمعروف و نهیاً عن المنکر الاّ اذا أمنوا الضرر
‘
তারা ক্ষতি থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকলেই কেবল সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালন করে নতুবা তাতে সাড়া দেয় না ।’
ইমাম বাকের (আ.) অপর এক হাদীসে বর্ণনা করেছেন :
انّ الْمر بالمعروف و النهی عن المنکر سبیل الانبیاء منهاج الصلحاء بها تقام الفرایض و تأمن المذاهب و تعمر الارض و ینتصب من الاعداء
‘
সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎকাজে নিষেধ করাটা নবী ও সৎকর্মপরায়ণদের পন্থা । এই মূলনীতির মাধ্যমেই অন্য আবশ্যিক কর্মগুলো ভিত্তি লাভ করে থাকে ,রাস্তা-ঘাট নিরাপদ ও পৃথিবী বসবাসযোগ্য হয় এবং শত্রুদের থেকে (যে অধিকার হরণ করা হয়েছে) ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়ে থাকে ।’
যে ফরযের এতটা মূল্যায়ন করা হয়েছে সে সম্পর্কে এ ধরনের উক্তি করাটা কি সমীচীন যে ,যদি একদিন হঠাৎ করে ও ঘটনাক্রমে ক্ষমতাবান হও তাহলে তা সম্পাদন কর ;নতুবা তুমি দায়িত্বমুক্ত অর্থাৎ যদি ক্ষমতাবান না হও তাহলে তা সম্পাদন না করলেও তোমাকে কোন অপরাধী বলে গণ্য করা হবে না । এটা ঐ অর্থে যে ,বলা হয়ে থাকে : যদি ঘটনাক্রমে দেখ যে ,তুমি ইসলামকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখ তাহলে রক্ষা কর আর যদি দেখ পারবে না তাহলে তার আর দরকার নেই । প্রভাব পড়া বা সফলতার সম্ভাবনার শর্তের ক্ষেত্রেও ঠিক সে রকমই ;অর্থাৎ আমরা বলতে পারি না যে ,যেহেতু প্রভাব পড়া বা সফলতার কোন সম্ভাবনা নেই ,তাই আমরা দায়িত্বমুক্ত ।
প্রভাব পড়া বা সফলতার সম্ভাবনার সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারের নমুনা আমরা 10ই মুহররমের দিন দেখতে পাই যে ,মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত ,এমনকি ইমাম হোসাইনের শাহাদাতকে সর্বশেষ কর্ম বা সর্বশেষ দায়িত্ব বলে মনে করেননি ;বরং তাঁরা ইয়াযীদ ও ইবনে যিয়াদের দরবারেও ঐ হোসাইনী মিশন অব্যাহত রেখেছেন ও তাঁর উদ্দেশ্যের অনুসরণ করে চলেছেন । ইমাম হোসাইনের শাহাদাতবরণ করাটা তাঁদের জন্য এক প্রকার প্রারম্ভিকা ছিল ,না সমাপিকা ।
প্রশ্ন 18 : সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ ওয়াজিব তথা আবশ্যিক হওয়ার যেসব শর্ত আছে তন্মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে প্রভাব পড়া বা সফলতার সম্ভাবনা থাকা ,অথচ আমরা ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ শর্তের উপস্থিতি লক্ষ্য করি না ;কারণ ,যদিও তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট ছিল যে ,ইয়াযীদ ও তার অনুচররা শাসন ক্ষমতা ত্যাগ করবে না ও তাদের দুর্নীতি থেকে সরে দাঁড়াবে না ;তারপরেও তিনি এ কাজে রত হয়েছিলেন । তাহলে ইমাম হোসাইন (আ.) শরীয়তের কোন্ দলিল-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং এই দায়িত্বকে আবশ্যিক ও অপরিহার্য দায়িত্ব বলে মনে করেছিলেন ?
উত্তর : ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের বিধান ও অন্যান্য শর্ত আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষা নেব আর শরীয়তে এটা জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হলো স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আ.) বেহেশতের যুবকদের নেতা হিসেবে সেটা সম্পাদন করেছেন । অন্য কথায় ,তাঁর কথা-বার্তা ও আচার-আচরণ শরীয়তের হুকুম-আহকামের প্রমাণ বা দলিল । অপরপক্ষে প্রভাব বা সফলতার সম্ভাবনা দু’
ধরনের : কখনো এমনও হয় যে ,কোন এক ব্যক্তি এখন পাপে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত অথবা লিপ্ত হয়ে পড়েছে ,তাকে অসৎকাজে নিষেধ করতে চাই ,যদি এর প্রভাব পড়ার বা এ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে ,তাহলে অসৎকাজে নিষেধ করা ওয়াজিব নয় । আবার কখনো কখনো ত্বরিত প্রভাব পড়া বা সফলতার সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আমরা অসৎকাজে নিষেধ করি । কারণ ,আমরা জানি যে ,ভবিষ্যতে এটার প্রভাব পড়বে বা সুফল পাওয়া যাবে । তাই এরূপ ক্ষেত্রে অসৎকাজে নিষেধ করা অপরিহার্য এবং এটার সাথে ত্বরিত ফল পাওয়া ও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনার কোন পার্থক্য নেই । উভয় ক্ষেত্রেই তা করা বাঞ্ছনীয় ।
যেমন যখন কোন পথভ্রষ্ট ফেরকা বা দল অথবা দুর্নীতিতে জড়িত কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা থাকবে যে ,তাদের দোষ-ত্রুটি ,দুর্নীতি ও অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়গুলো মানুষকে জানিয়ে দিয়ে সতর্ক করলে হয়তো কয়েকদিন পরেই তারা তাদের সবকিছু গুটিয়ে নেবে ও সমাজে তাদের প্রভাব বিস্তার রোধ হবে এবং যদি তাদের হোতারা এই অপকর্ম থেকে বিরত না-ও থাকে ,অন্ততঃপক্ষে অসৎকাজে নিষেধের প্রভাবে এবং তাদের অপকর্মের কথা প্রচার হওয়ার কারণে অন্যরা পথভ্রষ্ট হবে না সে ক্ষেত্রে কেবল ভবিষ্যতে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকার কারণেই সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা আবশ্যক ও অপরিহার্য ।
সমকালীন বিশ্বে যেসব রাষ্ট্র নিজেদেরকে উপনিবেশবাদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করতে এবং মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে তাদের বেশিরভাগই এ পন্থা বেছে নিয়েছিল । তারা নিজেদের আত্মত্যাগ এবং অত্যাচারী শাসকদের বৈরী আচরণ ও নির্যাতন সহ্য করার মাধ্যমে স্বীয় শত্রুদেরকে সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে উদ্দীপ্ত করেছে ও অন্যদের দৃষ্টিতে শাসকগোষ্ঠীকে নিন্দিত করে তুলেছে । এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের অনুপ্রবেশের পথকে রুদ্ধ এবং ক্ষমতার ভিত্তিকে ন্নড়ে করে দিয়েছে । আর এই সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা তাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন করেছে । তারা এই লড়াইকে -যদিও তার ফল
পেতে দেরী হতে পারে-সাফল্য ও গৌরব বলে গণ্য করেছে । কেননা ,তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পদ ও মর্যাদা ছিল না ;বরং জনগণের মুক্তিই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ।
ঐশী ব্যক্তিরাও তাঁদের ঐশী মহান উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্য কখনো কখনো এ ধরনের সংগ্রাম করে থাকেন । অর্থাৎ যদিও তারা জানেন যে ,আল্লাহর দুশমনরা তাদের রক্ত ঝরাবে ও মস্তককে বর্শার আগায় উঠাবে ,কিন্তু তারপরেও ইসলাম ও তাওহীদকে উদ্ধার করার জন্য জিহাদ ও সংগ্রাম করেন যাতে এই বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে জনগণ ধীরে ধীরে সচেতন হয় এবং ইতিহাসের ধারাতে পরিবর্তন সূচিত হয় ।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সময়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে ,কোরআন ও ইসলামের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য মহা বিপদের সংকেত বেজে উঠেছিল অর্থাৎ বনি উমাইয়া যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তা ভবিষ্যতে ইসলামকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট করে দিত । এমনকি ইমামের জন্য এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ,অদূর ভবিষ্যতে ইসলামের জ্যোতির্ময় সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবে এবং সেই র্শিক ও জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে ।
এমন অবস্থায় ইমাম হোসাইন (আ.) কখনোই ক্ষতি ও ভয়ের আশঙ্কায় অথবা মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না এবং ইসলামের এই দুর্দশা ও দুরাবস্থাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারেন না ।
এক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.) শুধু প্রভাব পড়া বা সফলতার সম্ভাবনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেননি ;বরং এ বিষয়ে তাঁর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে ,এর নিশ্চিত সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে এবং তিনি জানতেন যে ,তাঁর এই পদক্ষেপ ইসলাম অবশিষ্ট থাকার ক্ষেত্রে জামিনদার হবে । তিনি এটাও জানতেন যে ,বনি উমাইয়া তাঁকে-তিনি রাসূল (সা.)-এর দৌহিত্র ,জনগণের দ্বীন ও নৈতিকতার উৎস ও প্রাণকেন্দ্র এবং আল্লাহর নিকট তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে জানা সত্ত্বেও-হত্যা করবে ;অতঃপর তাদের দাপট ও ক্ষমতা হ্রাস পাবে ও তাদের ওপর জনগণের এমন ঘৃণা ও অভিশাপের বন্যার ঢল নেমে আসবে যে ,তারা বর্তমানের আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকে রাখা এবং তাদের স্বৈরাচারী ও নিকৃষ্ট শাসন ক্ষমতার ন্নড়ে ভিত্তিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে!
সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.) এটাও জানতেন যে ,তাঁর শাহাদত ও তাঁর পরিবারের বন্দিত্ব বরণের মাধ্যমে বনি উমাইয়ার প্রকৃত চেহারা এবং ইসলাম ও রাসূলের সাথে শত্রুতার বিষয়টি স্পষ্ট হবে আর উমাইয়াদের বিরোধিতা করার প্রবণতা সকলের মাঝে জেগে উঠবে এবং ইসলামী চেতনা ও দ্বীনি অনুভূতি জনগণকে সচেতন ও উজ্জীবিত করবে । আর এভাবে ইসলামের মূল শিকড় মানুষের মনে মজবুতভাবে গেঁথে যাবে ।
ইমাম হোসাইন (আ.) আরো জানতেন যে ,যখন বনি উমাইয়া তাঁকে শহীদ করবে তখন খেলাফতের নামে অবৈধ শাসন প্রতিষ্ঠাকারীদের চেহারার ওপর থেকে মুখোশ উন্মোচিত হবে ,তারা লাঞ্ছিত হবে ও জনগণ তাদের বিপথগামিতার বিষয়টি বুঝতে পারবে । আর এটাও স্পষ্ট হবে যে ,যে রাষ্ট্র দ্বীন ও রাসূল (সা.)-এর পরিবারের সাথে শত্রুতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় ,তা বাহ্যিকভাবে স্বল্প সময়ের জন্য জনগণের ওপর শাসন করলেও ইসলামী খেলাফতের দাবি করতে পারে না ও তাদের অনৈতিক শাসনক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারে না ।
কারবালার ঘটনা এবং ইমাম হোসাইনের শাহাদাত সারা বিশ্বকে এমনভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে যেন স্বয়ং রাসূল (সা.) শাহাদাত বরণ করেছেন । [কারণ ,রাসূল (সা.) বলেছেন :‘
হোসাইন আমা থেকে আর আমি হোসাইন থেকে ।’
]
মদীনা ,মক্কা ,কুফাসহ অনেক শহরেই বনি উমাইয়ার প্রতি জনগণের ক্রোধ অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং ইয়াযীদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা বিক্ষোভ শুরু হয় যাতে বনি উমাইয়ার র্শিক ও কুফরমিশ্রিত নামসর্বস্ব ইসলামী শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় আর আহলে বাইতের পবিত্র রক্তগুলো দ্বীনের মুক্তি ও জনগণের দ্বীনি চেতনা বৃদ্ধির কারণ হয় ।
অতএব ,প্রমাণিত হলো যে ,ইমাম হোসাইনের সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের সংগ্রাম সাধারণ দৃষ্টিকোণ ও ঐশী দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরি ও অপরিহার্য কর্মগুলোর মধ্যে একটি ছিল আর তিনি এই আবশ্যিক কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এ পথে স্বীয় প্রাণসহ তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান ও ভাইদের এবং বনি হাশেমের শ্রেষ্ঠ যুবক এবং সকল সঙ্গী-সাথিকে বিলিয়ে দিয়েছেন । তাঁদেরকে তিনি ইসলামের মহান উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন । এ পথে যদিও দুঃখণ্ডদুর্দশার ঢল তাঁর দিকে ছুটে এসেছিল তারপরেও তিনি দৃঢ় ও সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করেছেন এবং দ্বীন ও স্বীয় ঐশী উদ্দেশ্যের প্রতিরক্ষা করেছেন ।
এখানে আয়াতুল্লাহ শহীদ মোতাহহারীর বক্তব্যের অংশবিশেষ তুলে ধরা শ্রেয় বলে মনে করছি ,তিনি লিখেছেন যে ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের অপর একটি শর্ত হচ্ছে‘
প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা’
,অর্থাৎ এই ফরয কাজটি ঠিক নামায ও রোযার মতো‘
নিঃশর্ত ইবাদত’
নয় । আমাদেরকে নামায পড়ার ক্ষেত্রে বলা হয়নি-‘
এর কোন দর্শনীয় প্রভাব আছে কি নেই সেটা নিয়ে গবেষণা কর’
;কিন্তু সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার পর সম্পাদন করতে বলা হয়েছে । অর্থাৎ অবশ্যই এর ফলাফলের ওপর হিসাব করতে হবে যে ,এর থেকে যে লাভ আসবে সেটা যেন অবশ্যই মূলধনের চেয়ে বেশি হয় ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক খারেজীদের যুক্তির বিপরীতে যে ,তারা বলে থাকে : এমনকি যদি সামান্যতম প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাও না থাকে তাহলেও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের কাজটি করতে হবে । কেউ কেউ খারেজীদের পতনের মূল কারণ এই বিশ্বাস বলে মনে করে থাকেন । শিয়াদের মধ্যে যে‘
তাকিয়্যা’
র প্রচলন আছে তা হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করা-তাকিয়্যা (প্রতিরক্ষামূলক পন্থা) কাজে লাগানো । অর্থাৎ দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চেষ্টা কর ;কিন্তু লক্ষ্য রাখ যাতে বড় কোন ক্ষতির শিকার না হও [ধর্ম ও ইসলামী ঐক্য বিনষ্ট না হয় এবং তোমার ও তোমার সমবিশ্বাসীরা (জান-মাল ও সম্মানের ক্ষেত্রে) বিপদের মুখে না পড়ে] ।
প্রভাব পড়ার সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনার অর্থ এটা নয় যে ,কোন প্রচেষ্টা না চালিয়ে নিজ গৃহে বসে থেকে বলবে ,আমি প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা
দেখছি অথবা দেখছি না ;বরং অবশ্যই যেতে হবে ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে গবেষণা ও যাচাই করতে হবে যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ,সুফল আছে নাকি নেই । যে ব্যক্তি অজ্ঞ ও যাচাইয়ের চেষ্টাও করে না ,সে কখনোই অজুহাত দেখাতে পারে না ।
ইয়াযীদের হাতে বাইআত না করা
প্রশ্ন 19 : কোন্ দলিলের ভিত্তিতে ও কোন্ যুক্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.) কোনভাবেই ,এমনকি বাহ্যিক কল্যাণ বিবেচনা করেও ইয়াযীদের হাতে বাইআত করতে প্রস্তুত ছিলেন না ?
উত্তর : আমাদের প্রথমেই জানতে হবে যে ,ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রতিটি সিদ্ধান্ত এক স্পর্শকাতর মুহূর্তে ও কোন কারণ বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়ে থাকে অর্থাৎ ঘটনা এমনভাবে অগ্রসর হয় ও এমন কিছু সংঘটিত হয় যেন উভয়পক্ষ আগে থেকেই এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ।
মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত ও হযরত আলীর ন্যায়ভিত্তিক শাসন থেকে মুসলমানদের একদলের বিচ্যুতি ইতিপূর্বেই শুরু হয়েছিল ;কিন্তু বাহ্যিকভাবে তারা তাদের কর্মগুলোকে ভালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করত ,পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও সত্যপন্থী সাহাবাগণ ,যেমন-সালমান ফারসী ,আবু জার গিফারী ,আম্মার ইয়াসির এবং আরো অনেকে যখনই সুযোগ পেতেন তখনই জনগণকে সত্য সম্পর্কে অবহিত করতেন । কিন্তু ইতিহাসের যে বিষয়টি এখানে তুলে ধরা দরকার সেটা হচ্ছে এমন যে ,উভয় পক্ষই চাচ্ছে যে ,অবশ্যই শেষ কথাটি বলতে হবে এবং সব কাজ সেরে ফেলতে হবে । মুয়াবিয়ার মৃত্যু ও ইয়াযীদের দায়িত্বভার গ্রহণের পর ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । একদিকে ইয়াযীদ সবকিছু অস্বীকার করে বসল ও ঘোষণা দিল যে ,
لعبت هاشم بالملک فلا خبر جاء و لا وحیٌ نزل
‘
বনি হাশেম ক্ষমতা নিয়ে খেলা করেছে ,আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সংবাদই আসেনি ও কোন ঐশী বাণীই নাযিল হয়নি ।’
সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ,কাউকে তার মতের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার সুযোগ দেবে না-তা হুমকির মাধ্যমেই হোক অথবা হত্যার মাধ্যমেই হোক ;এ কারণেই সে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই চেষ্টা করেছিল ইমাম হোসাইন (আ.) ,আবদুল্লাহ বিন যুবাইর ও আবদুল্লাহ বিন উমরের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করার ;এমনকি হত্যার হুমকি দিয়ে হলেও । আর এটাই ছিল উপযুক্ত সময় যে ,ইমাম হোসাইনও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন । তিনি তাঁর সত্যতা ও সঠিকতার প্রমাণ কুফাবাসীদের দাওয়াত পত্রের বিচক্ষণ জবাব দানের মাধ্যমে দিয়েছেন ও তাঁর সুচিন্তিত পরিকল্পনাকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ;আর এমনভাবে তা করেছেন যে ,সবার জন্য সেটা সুস্পষ্ট ও চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল । তিনি তাঁর এই সংগ্রামকে আহলে বাইতের মাযলুমিয়াতের (অধিকার হরণ ,বঞ্চনা ও নির্যাতিত হওয়ার) সাথে এমনভাবে মিশ্রিত করেছিলেন যে ,যালিমদের নিকৃষ্ট চেহারাটি ইতিহাসের পাতায় জঘন্যভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছিল এবং এ ঘটনা নিঃশেষ বা মলিন হওয়ার কোন সুযোগ না থাকেনি । আর এই ঐশী কর্মটি শুধু আহলে বাইত ও তাঁদের মহান সঙ্গীদের‘
শাহাদাত ও বন্দিদশা’
র মাধ্যমে চিরজীবি হয়ে আছে ।
ইমাম হোসাইন (আ.)-যিনি ঐশী বাণীর দর্পণ এবং যাঁর গৃহ ঐশী বাণী অবতীর্ণ হওয়ার গৃহ ও আল্লাহর ফেরেশতাদের আসা-যাওয়ার স্থান-এর দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর ইমামত ও নেতৃত্বের জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য তার কোনটিই ইয়াযীদ বা ইয়াযীদের মতো ব্যক্তিদের মধ্যে নেই । সে কারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছিলেন :
ما الإمام الاّ العامل بالکتاب و القائم بالقسط بدین الحقّ والحابس نفسه علی ذات الله
‘
(সত্য) ইমাম কেবল সেই যে আল্লাহর কিতাবের ওপর আমল ও তার বাস্তবায়নকারী ,যে সত্যদ্বীন অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং আল্লাহর কারণে (সন্তুষ্টির জন্য) প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে ।’
ওয়ালিদ যখন পবিত্র মদীনার গভর্নর হয় তখন ইমাম হোসাইনকে তার দরবারে আসার দাওয়াত করে ও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ দেয় এবং যে পত্রটি ইয়াযীদ বাইআত গ্রহণের জন্য তাকে দিয়েছিল সেটা পাঠ করে
শোনায় ।
ইমাম হোসাইন (আ.) তার উত্তরে বলেন :‘
আমি যে গোপনে ও নির্জনে বাইআত করব নিশ্চয়ই তোমার জন্য তা যথেষ্ট হবে না ,যদি না প্রকাশ্যে বাইআত করি ও জনগণ তা অবগত হয় ।’
ওয়ালিদ বলল :‘
হ্যাঁ ,তা ঠিক!’
ইমাম তাকে বললেন :‘
ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর আর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নাও ।’
মারওয়ান বলল :‘
আল্লাহর শপথ! যদি হোসাইন এই মুহূর্তে বাইআত না করে ও তোমার নিকট থেকে চলে যায় ,তাহলে তোমার আর কিছু করার থাকবে না । তাকে বন্দি কর ও এখান থেকে চলে যেতে দিও না যদি না বাইআত করে অথবা তাকে হত্যা না কর!’
ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন :‘
আফসোস তোমার জন্য ,হে জারাকার (নীল চোখের রমনীর) পুত্র! তুমি কি আমাকে হত্যা করার নির্দেশ দিচ্ছ ? মিথ্যা বলছ ও হীনমন্যতা করছ ?’
অতঃপর ওয়ালিদের দিকে ফিরে বললেন :‘
ওহে আমীর! আমরা নবুওয়াতের বংশধর ও রেসালাতের গুপ্তধন । আল্লাহর ফেরেশতাদের আসা-যাওয়ার ও আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হওয়ার কেন্দ্রস্থল । আল্লাহ আমাদের মাধ্যমে (তাঁর সৃষ্টির) সূচনা করেছেন এবং আমাদের মাধ্যমেই তার সমাপ্তি ঘটাবেন । ইয়াযীদ পাপাচারী ,চরিত্রহীন ,মদ্যপায়ী ,নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যাকারী ,প্রকাশ্যে পাপাচারকারী । কখনো আমার মতো ব্যক্তি তার মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত করতে পারে না ;আমি ও তোমরা উভয়েই অপেক্ষা করি ,অচিরেই দেখতে পাবে যে ,আমাদের মধ্যে কে বাইআত ও খেলাফতের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত ।’
ইমাম যখন ওয়ালিদের নিকট থেকে বেড়িয়ে গেলেন তখন মারওয়ান বলল :‘
যদি আমার মতের বিপরীত কাজ কর ,আল্লাহর শপথ করে বলছি দ্বিতীয়বার আর এ রকম সুযোগ পাবে না ।’
ওয়ালিদ বলল :“
ধিক তোমার ওপর! তুমি আমাকে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ই হাতছাড়া করতে বলছ! আল্লাহর শপথ! আমি চাই না যে ,এই দুনিয়ার মালিক হই আর ইমাম হোসাইনকে হত্যা করি । সুবহানাল্লাহ! হোসাইনকে হত্যা করব শুধু এই জন্য যে ,তিনি বলে থাকেন :‘
আমি বাইআত করব না!’
শপথ আল্লাহর! যে ব্যক্তি হোসাইনের রক্তমাখা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তার আমলের পাল্লা হবে অত্যন্ত হালকা এবং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না ,তার প্রতি কোন দয়া করবেন না ও তার জন্য অত্যন্ত কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবেন ।”
ইতিহাসের এ অধ্যায়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এই উত্থান ও বিদ্রোহের কারণ নির্ণয় এবং তাঁর বাইআত না করার উদ্দেশ্য উদ্ঘাটন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় । কেননা ,তিনি তাঁর এ বক্তব্যে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন যে ,সেগুলোর যে কোন একটিই বাইআত করতে অস্বীকৃতি জানানো ও তাঁর উত্থানকে অপরিহার্য মনে করার জন্য যথেষ্ট । তাঁর শাহাদতের কারণ অনুধাবন করার জন্য তাঁর বক্তব্যগুলো সর্বোত্তম উৎস হিসেবে গণ্য ।
ইমাম হোসাইন (আ.) বাইআত করা থেকে বিরত থাকা ও স্বীয় বিরোধিতার সিদ্ধান্তের পক্ষে যে সকল প্রমাণ উত্থাপন করেছেন সেগুলোর সত্যতার বিষয়ে কারোও কোন সন্দেহ ছিল না এবং এ ব্যাপারে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি একই ছিল ,এমনকি ওয়ালিদ ,যে ইয়াযীদের চাচাতো ভাই ও তার গভর্নর ছিল ,সেও এই বক্তব্যের সঠিকতাকে অস্বীকার করে নি ও ইমামের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের মধ্যে কোন ত্রুটি খুঁজে পায় নি ।
و مثلی لا یبایع مثله
‘
কখনো আমার মতো ব্যক্তি তার মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত করতে পারে না ।’
-এ কথাটি বলার পূর্বে ইমাম হোসাইন যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা ইমাম হোসাইনের বিরল ও অনুপম যোগ্যতা ,তাঁর শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং ইয়াযীদের কলঙ্কময় চরিত্রের প্রমাণবাহী এক দলিল । অর্থাৎ আমার মতো কোন ব্যক্তি-যার এ রকম উজ্জ্বল অতীত ও সমাজের ওপর নেতৃত্ব দানের স্বীকৃত অধিকার রয়েছে সে ইয়াযীদের মতো ব্যক্তির হাতে কখনো বাইআত করতে পারে না । কেননা ,ইসলামী পরিভাষায় খলিফার হাতে বাইআত করার অর্থ হচ্ছে তার অনুসরণ করার অঙ্গীকার করা ও ঐ ব্যক্তির অনুগত হওয়া যিনি ইসলামী সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যসমূহের বাস্তবায়নের প্রাণকেন্দ্র ,যিনি মুসলমানদের মর্যাদা বা সম্মানের উৎসমূল ,পবিত্র কোরআনের সংরক্ষক ,সৎকাজের আদেশদাতা ,অসৎকাজে বাধাদানকারী-এক কথায় যিনি রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি হবেন ।
বাইআতের সঠিক অর্থ হচ্ছে ,প্রকৃত খলিফা বা প্রতিনিধির নির্দেশ পালনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা ও তাঁর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে আত্মত্যাগ করা-যা প্রতিটি মুসলমানের ক্ষেত্রে কোরআনের এই আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী ওয়াজিব বা অপরিহার্য-
)
أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُم(
‘
আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের ।’
আর ইয়াযীদের মতো ব্যক্তির সাথে এ ধরনের আনুগত্যের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া ও বাইআত করার-যতই তা লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে হোক বা ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই হোক-অর্থ হলো পাপাচার ও ব্যভিচারকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য স্বাক্ষর করা ,অসৎকাজ ও পাপের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করা ,অধিকার বিনষ্ট করা ,অত্যাচারী ,নির্যাতনকারী ,পাপাচারী ও চরিত্রহীনদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া । আর এগুলো ইমাম হোসাইনের মতো ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হওয়া শরীয়তগত ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্ভবপর ছিল না ।
এই বাইআতের অর্থ হচ্ছে নির্দোষ জনগণকে হত্যা এবং ইসলামের মান-মর্যাদাকে বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার করা । আর ইমাম হোসাইনের মতো পবিত্র ব্যক্তির দ্বারা এ ধরনের অপমানকর বাইআত সংঘটিত হতে পারে না । এটা বিবেকের দৃষ্টিতে স্বতঃসিদ্ধ এবং সকলের কাছে সঠিক বলে বিবেচিত একটি বিষয় । তাই তিনি এই বাক্যটি-و مثلی
لا یبایع مثله
সুনিশ্চিত হয়েই বলেছেন ;কোন বিবেকবান মুসলমান এ কথা বলতে পারে না যে ,ইমাম হোসাইনের মতো এক ব্যক্তি ইয়াযীদের মতো কোন হীন লোকের হাতে বাইআত করবে ।
এটি সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি ফলাফল ছিল যা তিনি তাঁর অতীতের ধার্মিকতা ও আধ্যাত্মিকতা আর ইয়াযীদের অতীতের কুকর্মের বিবরণ দেওয়ার পর প্রকাশ করেছিলেন ।
হ্যাঁ ,যদি ধরেও নিই যে ,সকল মুসলমান এই ধরনের অপমান ও লাঞ্ছনাকে মেনে নেয় ও ইয়াযীদের মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত করে এবং তার মতো ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে সমর্থন দেয় ,তবুও ইমাম হোসাইন (আ.) ,যিনি ঐ রকম সম্মান ,উচ্চ মর্যাদা ,ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের অধিকারী ,তিনি ঐরূপ পাপাচারী ,নিষ্ঠুর ,দুশ্চরিত্র ব্যক্তির হাতে বাইআত করতে পারেন না । মুসলমানরা তাঁর প্রতি দ্বীনের মুক্তিদাতা ,কাণ্ডারি ও ঐশী গ্রন্থের কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী হিসেবে এধরনের সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই আশা করে ।
তাই ইমাম হোসাইনের ব্যাপারটি সবার থেকে আলাদা । তিনি নবুওয়াতের পরিবারের সদস্য ,রেসালাতের গুপ্তধন ,ফেরেশতাদের আসা-যাওয়ার স্থান ,রহমতের অবতরণ স্থল ও ইমাম হাসান (আ.)-এর পরে নবীনন্দিনীর পুত্র ছিলেন । তিনি কোন এক স্থানে কবি ফারাজদাক
কে বলেছেন :‘
এই দল (বনি উমাইয়া) শয়তানের অনুসারী হয়ে গেছে ,দয়াশীল আল্লাহর আনুগত্য করাকে ত্যাগ করেছে ,প্রকাশ্যে পাপাচার ও অন্যায় করছে ,আল্লাহর বিধানসমূহকে লঙ্ঘন করছে ,মদপান করছে ,বায়তুল মাল ও দরিদ্রদের সম্পদকে তাদের উত্তরাধিকার সম্পদ গণ্য করে তা আত্মসাৎ করছে (জনগণের সম্পদকে দুর্নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠন করছে) । আর আমিই এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি যে দ্বীনের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শরীয়তের বিধানকে পুনর্বহাল এবং আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য তাঁর পথে সংগ্রাম করবে । (আর আমি এজন্যই উত্থান করেছি) ।’
অতএব ,যখন পরিস্থিতি এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ,ইয়াযীদের মতো ব্যক্তি চাচ্ছে রাসূল (সা.)-এর মসনদে বসতে ও নিজেকে মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং মুসলিম বিশ্বের ধ্বজাধারী বলে দাবি করছে ,সে ক্ষেত্রে ইমামের জন্য বিপদ সংকেত ঘোষণা করা ,সংগ্রামের ডাক দেওয়া ও শাসকগোষ্ঠীকে অনৈসলামিক ঘোষণা দেওয়া ছাড়া আর অন্য কোন পথ ছিল না ;কেননা ,এই অপবিত্র শাসকগোষ্ঠীর হাতে ইমাম হোসাইন অথবা যে কোন মহান সাহাবী ও তাবেঈর বাইআত করার অর্থ হলো তাদের শাসনব্যবস্থাকে সঠিক বলে স্বাক্ষর করা ,প্রকৃত খেলাফতকে বাতিল ঘোষণা করা এবং ইসলামী খেলাফতের জন্য আবশ্যক প্রধান প্রধান শর্তসমূহকে প্রত্যাখ্যান করা । আর ইমাম হোসাইনের জন্য তা ছিল রাসূলের প্রতিনিধিত্ব থেকে ও সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া । এই বাইআত ঐশী ব্যক্তিদের গলায় শাস্তির শিকলের ন্যায় এবং তাঁদের রূহের ওপর এর ভার পর্বতের ভার ও চাপের চেয়েও অনেক বেশি ।
ইমাম হোসাইন (আ.) এই যুক্তির ভিত্তিতে উত্থান করেছেন ও এই কথার ওপর অটল ছিলেন এবং বলেছেন যে:
ما الامام الا العامل بالکتاب، و القائم بالقسط، الدائن بدین الحق،والحابس نفسه علی ذات الله
‘
(
সত্য ) ইমাম কেবল সেই যে আল্লাহর কিতাবের ওপর আমল ও তার বাস্তবায়নকারী ,যে সত্য দ্বীন অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং আল্লাহর কারণে (সন্তুষ্টির জন্য ) প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্ণ করে ।’
তিনি 10ই মুহররমে ,যে দিন তাঁর ওপর দুর্যোগের ঝড় বইছিল ,উক্ত যুক্তিটিই বার বার উপস্থাপন করছিলেন ও বলছিলেন :
و ما والله لا اجیبهم الی شئ ممّا یریدون حتّی القی الله و انا مخضّب بدمی
‘
আল্লাহর শপথ! কখনোই এসব লোকের আবেদনে সাড়া দেব না ,এমনকি যদি এজন্য আমাকে আমার রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে হয় ।’
ইমাম হোসাইনের যুগে মুসলিমসমাজ বা শাসকদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জানার জন্য আহলে সুন্নাতের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞ আলেম সাইয়্যেদ কুতুবের (মিশরের প্রখ্যাত মুফাস্সির ও বিপ্লবী চিন্তাবিদ) দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ইঙ্গিত করব :
ইয়াযীদের শাসন ইসলামী খেলাফত বা ইসলামী শাসনব্যবস্থা ছিল না ;বরং স্বৈরতন্ত্র ছিল আর ঐশী বাণীর সাথে কোন প্রকার সামঞ্জস্য ছিল না ;বরং জাহেলিয়াতের বা ইসলাম-পূর্ব অন্ধকার যুগের চিন্তাধারায় পরিচালিত হতো । উমাইয়া বংশের শাসনব্যবস্থা কোন্ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হতো সেটা জানার জন্য ইয়াযীদের বাইআত কীভাবে হয়েছিল তার প্রতি দৃষ্টিপাত করাই যথেষ্ট । মুয়াবিয়া একদল লোককে ডেকে পাঠালেন যাতে ইয়াযীদের বাইআত গ্রহণের বিষয়ে তাদের নিজ নিজ মতামত তুলে ধরে । ইয়াযীদ বিন মাকফা’
নামে পরিচিত এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল :‘
এই ব্যক্তি হচ্ছেন আমীরুল মুমিনীন ।’
আর সে মুয়াবিয়ার প্রতি ইশারা করল (অর্থাৎ তিনি যা বলবেন তা-ই চূড়ান্ত) । অতঃপর বলল :‘
যদি মুয়াবিয়া পুরুষ হয়ে থাকে ,তাহলে এই ব্যক্তি হচ্ছে আমীরুল মুমিনীন’
ও ইয়াযীদের প্রতি ইশারা করল । তারপর বলল :‘
যদি কেউ এটাকে মেনে না নেয় তাহলে এটা আছে’
(তরবারির প্রতি ইশারা করল) । মুয়াবিয়া বলল :‘
তুমি বস ,তুমি তো আমার বক্তাদের প্রধান (আনতা সাইয়্যেদু খুতাবায়ী) ।’
এ ঘটনা উল্লেখের পর তিনি ইয়াযীদের পক্ষে মুয়াবিয়া কীভাবে মক্কায় জোর করে ,তরবারি দেখিয়ে ও ধোঁকা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেছে তার বর্ণনা দিয়েছেন ।
ইয়াযীদের অপকর্মগুলো ,যেমন-মদপান ,ব্যভিচার ও নামায ত্যাগ করা ইত্যাদির বর্ণনা দেওয়ার পর তিনি বলেছেন :
ইয়াযীদের অপকর্ম ,যেমন-ইমাম হোসাইনকে হত্যা ,পবিত্র কাবা ঘর ঘেরাও করা ,পাথর নিক্ষেপ করে তা গুঁড়িয়ে দেয়া ও আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো এবং মদীনায় মুসলমান পুরুষদের হত্যা ও নারীদের ধর্ষণের জন্য স্বীয় সৈন্যদের অনুমতি দান ও স্বাধীনভাবে অনাচারের ঘোষণা দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত আছে । এ ঘটনাগুলো সাক্ষ্য প্রদান করছে যে ,ইয়াযীদ সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার কোনটিই অতিরঞ্জিত নয়... খেলাফতের জন্য ইয়াযীদকে নির্ধারণ করাটা ছিল ইসলামের প্রাণ ইসলামী শাসনব্যবস্থার মহান উদ্দেশ্যের প্রতি ও ইসলামের মূলে একটি বিরাট আঘাতস্বরূপ ।
মুয়াবিয়ার শাসনামলে দিন দিন রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি ইসলামী পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল ও তার শাসনব্যবস্থায় এক আশ্চর্যজনক পরিবর্তন ঘটেছিল । মুয়াবিয়া সেটাকে ভাবী খলিফা ইয়াযীদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ করে ,যেমনভাবে সাইয়্যেদ কুতুব বলেছেন-‘
এটা ইসলামের প্রাণ ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যের ওপর এক বিরাট আঘাত ।’
অতএব ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অপরিহার্য দায়িত্ব ছিল সেটার ক্ষতিপূরণ করা ও মহান ইসলামের ওপর আঘাতের কারণে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়া আর সাধারণ জনগণকে বুঝানো যে ,তার এই শাসনব্যবস্থা শরীয়তসিদ্ধ নয় ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে এর কোন সম্পর্ক ও সাদৃশ্য নেই ।
তিনি স্বীয় উত্থানের মাধ্যমে ইয়াযীদের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে দ্বীনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন । নিশ্চুপ থাকা অথবা বাইআত করা-এর যে কোনটিই ইসলামের ব্যাপারে ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে মহাভ্রান্তিতে ফেলত । ফলে ইসলাম বলে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না ।
মুহাম্মাদ গাজ্জালী (আহলে সুন্নাতের একজন প্রসিদ্ধ লেখক ও গবেষক) উমাইয়া বংশের শাসনব্যবস্থার দুর্নীতি সম্পর্কে লিখেছেন : বাস্তব এটাই যে ,ইসলাম উমাইয়্যা বংশের অপকর্ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যে ধাক্কাটি খেয়েছে সেটা এতটাই প্রকট ছিল যে ,এ ধরনের আঘাত ইসলাম ব্যতীত অন্য যে কোন ধর্মের ওপর আসলে তার ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যেত ।
মোটকথা ,ইয়াযীদ ও বনি উমাইয়া ইসলামের প্রাণে আঘাত হেনেছিল এবং ইসলামের সর্বোত্তম ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থাকে ভয়ঙ্কর ও ভীতিময় এক রূপে পরিবর্তিত করেছিল ।
যদি ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর উত্থানের মাধ্যমে সময়মতো ইসলামের আহ্বানে সাড়া না দিতেন এবং ঐ শাসনব্যবস্থা যে ইসলামী শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক ছিল তা প্রকাশ করে না দিতেন তাহলে সবচেয়ে বড় অপমান ও লজ্জা ইসলামকে কলঙ্কিত করত এবং ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহর দ্বীনের সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেত ।