10
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অপনোদন
বস্তুবাদীরা আস্তিকবাদীদের উপর জোরালো আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন এই বলে যে ,“
প্রকৃতিই হল সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতা। এ প্রকৃতির কারনেই সকল বস্তু গতিশীল ও ক্রিয়াশীল অবস্থায় রয়েছে।”
-এর উত্তর আমরা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় অপনোদন করতে সক্ষম। আমাদের উপযুক্ত জবাব নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
প্রথমতঃ
আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবো ,‘
প্রকৃতি কি কোন বস্তু নাকি অন্য কিছু ?’
আরো ভালো করে বললে এভাবে বলা যায় ,‘
প্রকৃতি কি একটি বস্তুগত সত্তা ?’
প্রতিত্তোরে তারা অবশ্যই বলবেন ,‘
নিশ্চয়ই বস্তুগত সত্তা’
। কেননা ,উত্তর ইতিবাচক না হয়ে পারে না। তার কারণ ,বস্তুবহির্ভূত কোন সত্তার অস্তিত্বে তারা বিশ্বাসী নন।
পদার্থ বিজ্ঞানে বস্তুর সংজ্ঞানুযায়ী প্রতিটি বস্তু স্থান দখল করে ,সময়ের মধ্য সীমাবদ্ধ ,ওজন ও আয়তন আছে। যে সত্তা নিজের অস্তিত্ব লাভের জন্যে স্থান ,কাল ,পাত্র ,আয়তন ও ওজনের মুখাপেক্ষী সে কি করে অন্য বস্তুকে সেগুলো দান করতে পারে ? দর্শনের প্রণিধানযোগ্য যথার্থ নীতিটি হচ্ছে--“
শূন্য হাতের কেউ অন্যের হাতকে ভরে দিতে পারে না।”
যার যে জিনিষ নেই সে কি করে অন্যকে সে জিনিষ দান করতে পারে ? তাই সৃষ্টিকর্তা কোন বস্তুগত সত্তা হতে পারেন না। এ ধরনের ধারণা নিতান্তই অবাস্তব।
অধিকন্তু বস্তুগত প্রকৃতির কোন জ্ঞান-বৃদ্ধি ,বিবেক ও প্রজ্ঞাশক্তি নেই। পক্ষান্তরে বিশ্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টিতে আমরা সাংঘাতিক জ্ঞানবুদ্ধি ও প্রজ্ঞা শক্তির বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করি । যদি প্রকৃতির ন্যায় নির্বোধ কোন সৃষ্টিকারককে সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেয়া হয় তাহলে বলতে হবে যে এ ধরনের বক্তব্য দানকারীরাও প্রকৃতির মতই নির্বোধ। কেননা যে নির্বোধ ,প্রজ্ঞাহীন সে কিভাবে এতসব জটিল ব্যবস্থাপনার প্রবর্তক হতে পারে ?
বস্তুত্ব : বস্তুগত সত্তা নির্ভরশীল সত্তার সমতুল্য। বস্তু যেমনিভাবে অস্তিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে অন্য কোন সত্তার মুখাপেক্ষী তোমনিভাবে তার অনবরত অস্তিত্বমান থাকার জন্যেও অপরের সাহায্যের প্রয়োজন। মোটকথা বস্তু আপাদমস্তক একটি নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী সত্তা।
আর যদি প্রকৃতি একটি বস্তুগত সত্তা হিসেবে অন্য সব বস্তুর স্রষ্টা হয়ে থাকে তা’
হলে প্রকৃতির স্রষ্টা কে ? উত্তরে যদি বলা হয় প্রকৃতি নিজেই তার স্রষ্টা তা’
হলে দর্শনের নীতির বিরোধীতা করা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর থাকবে না। দর্শনের সুপ্রমাণিত সুত্রটি হচ্ছে“
সকল কার্যের কারণ আছে।”
অতএব প্রকৃতির ন্যায় একটি বস্তুর অস্তিত্ব লাভের জন্যে নিশ্চয়ই একটি কার্যকারণ প্রয়োজন। সুতরাং প্রকৃতির ন্যায় কোন বস্তুজাত সত্তা স্রষ্টার আসন দখল করতে পারে না। কেননা সে নিজেই সৃষ্ট বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
উপসংহারে আমাদেরকে প্রাকৃতিক তথা বস্তুগত জগতের ঊর্দ্ধে এমন এক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করতেই হবে যিনি সকল বস্তুগত সত্তার বহির্ভূত পরম সত্তা ,যিনি আপন সত্তাবলে অস্তিত্বমান। তাকে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন হয়নি। সকল কিছু তারই সৃষ্টি। তিনি একজন অমুখাপেক্ষী সত্তা। প্রকৃতিকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই হচ্ছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহান প্রতিপালক। আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেন :
(
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّـهِ ۖ وَاللَّـهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ)
অর্থাৎ : এবং হে মানবসকল ,তোমরা সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী পক্ষান্তরে আল্লাহ্ সকল কিছুর অমুখাপেক্ষী এবং সকলের প্রসংশারযোগ্য। (ফাতির ,আঃ নং-15। )
এতক্ষনে আমরা এ সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছি যে ,সমস্ত নির্ভরশীল সম্ভাব্য অস্তিত্বের মূলে একটি কার্যকারণ রয়েছে ,যিনি হচ্ছে স্বয়ম্ভু ও স্বতঃষ্ফুর্ত সত্তা। তিনি সকল কিছুই স্রষ্টা ,তাকে অন্য কেউ সৃষ্টি করেনি।
দর্শনের সূত্রানুসারে“
প্রতিটি ফলাফলের পেছনে একটি কারণ বর্তমান।”
সুতরাং শুধুমাত্র আদিসত্তাতে এসে দর্শনের সেই নীতি লংঘন হয়ে যায়-যা বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। কেননা আস্তিকবাদীদের মতে স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের জন্যে কোন কার্যকারনের প্রয়োজন নেই।
বস্তুবাদীদের পক্ষ থেকে এখানে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটির অবতারণা করা হয় তাহলো ,“
এক্ষত্রে দর্শনের নীতির ব্যতিক্রম ঘটে কেন ?”
সংক্ষেপে এবং সহজভাবে বলতে গেলে তাদের প্রশ্নটি এভাবে বলা যায়“
সবকিছুর সৃষ্টিকারক আছে ,আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা কে ?”
এর উত্তরে বলা যায় ,
প্রথমত : প্রশ্নটি বস্তুবাদী ও আস্তিকবাদী উভয়ের মধ্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। কেননা তারা উভয়েই কারণহীন স্বয়ংসৃষ্ট ,শাশ্বত সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। শুধু এখানেই পার্থক্য যে ,আস্তিকবাদীরা সকল সত্তার মূল হিসেবে এমন এক সত্তায় বিশ্বাসী যিনি পার্থিব জগতের ঊর্দ্ধে ,বস্তুনিচয়ের বাহিভর্তূ ,সমস্ত নির্ভরশীল সত্তার ধারাবাহিকতা যেখানে গিয়ে স্থিমিত হয়ে যায়। আর বস্তুবাদীরা এমন এক সত্তার কথা বলেন যিনি বস্তুনিচয়ের সর্বপ্রথম অস্তিত্ব ,যার থেকে সকল বস্তু নির্গত। দর্শনের ভাষায় তাকে বলা হয় আদি বস্তু। আর বস্তুবাদীরাও আদিবস্তুর ব্যাপারে বিশ্বাস করেন যে তা স্বয়ম্ভু ও স্বয়ংসৃষ্ট। অতএব ,যদি দর্শনের নীতির বরখেলাপ কোন ব্যতিক্রম কিছু ঘটে থাকে তা’
হলে সে আপত্তি উক্ত দুই মতবাদের উপরেই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
দ্বিতীয়ত : দর্শনের উক্ত সূত্রটি (সকল কার্যের কারণ বিদ্যমান) শুধুমাত্র বস্তুজগত ও সম্ভাব্য নির্ভরশীল সত্তাসমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আস্তিকবাদীদের মতানুসারে স্রষ্টা অবস্তুগত ,স্বাধীন ,প্রকৃতি-ঊর্দ্ধ একটি সত্তা ,যিনি শাশ্বত ,চিরঞ্জীব ও চিরন্তন। তাই তিনি সকল ধরনের কার্যকারণ থেকে মুক্ত। মুলতঃ তিনি নিজেই কার্যকারনের স্রষ্টা। কার্যকারনের ছোঁয়া তারই দেহে স্পর্শ করবে যিনি বস্তুগত সত্তা ,সে সত্তা পূর্বে অস্তিত্বহীন ছিল ,পরে অস্তিত্বমান হয়েছে। যে স্রষ্টার ধারণা আস্তিকবাদীরা দেয় ,তিনি হলেন অস্তিত্বের মূল। তিনি সর্বকাল জুড়ে অস্তিত্বমান ছিলেন এবং অব্যাহতভাবে সত্তাশীল থাকবেন। তিনিই প্রথম যিনি সকল বস্তুনিচয়ের পূর্ব হতে বিরাজমান। অনস্তিত্বের সম্ভাবনা তার প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় ,‘
লবনের স্বাদ কটা কেন ?’
অথবা‘
চিনিদ্রব্য মিষ্টি কেন ?’
তাহলে উত্তরে বলতে হবে যে ,‘
লবনের প্রকৃতিই হল কটার গুণ বর্তমান থাকা অথবা চিনির জন্যে মিষ্টির বৈশিষ্ট্যই হল তার সহজাত। এখন যদি লবন বা চিনি থেকে তাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য তুলে নেয়া হয় তাহলে সেগুলো লবন বা চিনিই থাকবে না’
। তাই উক্ত প্রশ্নের অর্থাৎ‘
কেন’
এর উত্তর হচ্ছে এগুলোর সহজাত প্রকৃতি। তদ্রূপ আল্লাহ্ সন্বন্ধে প্রশ্ন করলে একই ধরনের উত্তর আসবে।‘
আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন ?’
এই প্রশ্নটিই ভুল । কেননা মহান আল্লাহর সহজাত বৈশিষ্ট্যই হল স্বয়ংসৃষ্টতা। বিশ্ব বিধাতার সারসত্তাই হলো সর্বদা অস্তিত্বমান থাকা এবং স্বয়ম্ভু ও স্বয়ংক্রিয় অবস্থা। যদি আল্লাহর জন্যে কোন সৃষ্টি কারণ নির্ণয় করা হয় তা’
হলে তিনিও আমাদের ন্যায় সৃষ্ট বস্তু হয়ে পড়বেন ,অবস্তগত সত্তা থেকে বস্তুগত সত্তায় নেমে আসবেন।
তিনি পরম পরিপূর্ণ সত্তা। আদি সত্তা ও এই আল্লাহ্-ই। আদি ও অন্তকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন। আদি ও অন্তের প্রভাবমুক্ত তিনি। তিনি সকল কিছুর সূচনাকারী ।