20
আল্লাহ সর্বশক্তিমান
আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অসীম ক্ষমতাধর প্রভু তিনি। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। তাঁর ক্ষমতার পরিমাপ করা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। তিনি পরম পরাক্রমশালী। অপারগতা তাঁর সত্তা থেকে বহুদূরে। সকল কিছুই তাঁর জন্যে সম্ভব। তবে বস্তুর গুণগত অপারগতা ও সসীমতার কারণে সে বস্তুর বাস্তব অস্তিত্বের অনুপস্থিতি আল্লাহর অপারগতা প্রমাণ করে না। যেমন ধরুন ,কেউ যদি বলে ,আল্লাহ কি সমস্ত পৃথিবীকে একটা মুরগীর ডিমের ভিতর স্থাপন করতে পারবেন যে ডিমের আয়তনও বড় হবে না আবার পৃথিবীও আয়তনে ক্ষুদ্র হবে না ? এর উত্তরে বলতে হয় ,আল্লাহর জন্যে সব কিছু সম্ভব। আমাদের ধারণা মতে এর চেয়েও বৃহৎ ও কঠিন বলে স্বীকৃত যত কিছু হতে পারে ,তারও অস্তিত্ব লাভ আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনরূপ কঠিন কাজ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ ডিমের কি পৃথিবী ধারণ করার ক্ষমতা আছে ? আর পৃথিবী কি তার স্বীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে ডিমের ন্যায় কোন ক্ষুদ্র আকৃতির বস্তুর ভিতর প্রবেশ ক্ষমতা রাখে ? এ সবই হচ্ছে ডিম বা পৃথিবীর গুণগত অপারগতা। দার্শনিক নীতি অনুসারে কোন বস্তুর অস্তিত্বে আগমণের প্রয়োজনীয় উপকরণ সম্মিলিত না হলে কখনো ঐ বস্তু অস্তিত্বমান হতে পারে না। দর্শনের পরিভাষায় এ ধরনের বস্তুকে অসম্ভব বস্তুগত সত্তা বলা হয় । মহান আল্লাহ্ এ ধরণের কোন অসম্ভব বস্তুগত সত্তার সৃষ্টি করতে পারেন না।
প্রশ্ন হতে পারে ,‘
আল্লাহ কি অন্য আরেকটি আল্লাহ সৃষ্টি করতে পারেন ?’
মূলত : এ ধরণের প্রশ্নের অবতারণা বিভিন্ন ভুল চিন্তা-চেতনা থেকে করা হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রশ্নই ভুল। আল্লাহর জন্যে কোন কিছু অসম্ভব নয়। তবে অসম্ভব বস্তুর সৃষ্টিহীনতার জন্যে ঐ বস্তুর সত্তাহীনতাই দায়ী। এতে আল্লাহর শক্তির মান ও পরিমাপের স্বল্পতা প্রামাণিত হয় না। যেমন ধরুন আপনি একজন বিখ্যাত চিত্রকরকে অনুরোধ করলেন বঙ্গোপসাগরের মাঝে পানির উপরিভাগে একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় চিত্র অংকন করে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে চিত্রশিল্পী ভদ্রলোকটি নিশ্চয়ই বলবেন ,‘
এটা একটা অসম্ভব কাজ।’
তাহলে‘
আপনি চিত্র অংকন করতে পারেন না।’
কথাটি ব্যক্ত করতে পারবেন ? আপনার উপলব্ধি ক্ষমতা নিশ্চয়ই এধরণের বক্তব্যে সায় দিবে না। আর তখন যদি আপনি ভাবেন ,তিনি একজন মিথ্যাবাদী ,তাহলে আপনার ধারণা কি সঠিক হবে ? চিত্র অংকনের সকল অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও উপকরণ প্রস্তুত থাকার পরও ভদ্রলোকটি কেন পানির উপরে ছবি অংকন করতে পারলেন না ? এটা কি তার অপারগতা বলে আপনি চিহ্নিত করতে পারেন ? কখনো কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ ধরণের অপবাদ দিতে পারে না। আসলে বিষয়টি হচ্ছে ,চিত্র ধারণ ক্ষমতা পানির নেই। পানির পক্ষে কোন চিত্র তার বুকে ধারণ করে রাখা অসম্ভব। এটি পানিরই অযোগ্যতা ও অপারগতা। এর জন্যে চিত্রকরকে কোনক্রমে দায়ী করা যাবে না।
তদ্রূপ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ও সব কিছু করতে পারেন। কিন্তু কোন বস্তুর সত্তাহীনতা ও সম্ভাব্য বস্তুতে পরিণত হতে অপারগতা এবং অসম্ভাব্য অস্তিত্বে পরিণত হওয়া থেকে আল্লাহর অক্ষমতা ও অযোগ্যতার পরিচয় ফুটে উঠেনা কিছুতেই।
পবিত্র আল্ কোরআনে আল্লাহ বলেন ,
(
وَمَا كَانَ اللَّـهُ لِيُعْجِزَهُ مِن شَيْءٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا)
অর্থাৎ ,পৃথিবী ও আসমানসমূহে কোন কিছুই আল্লাহর জন্যে অসম্ভব নয়। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান। (ফাতের ,আয়াত নং 44 )
আল্লাহ যদি অন্য কোন আল্লাহ্ সৃষ্টি করেন তাহলে তিনি (কাল্পনিক দ্বিতীয় আল্লাহ্) তো সৃষ্টি বস্তুতে পরিণত হয়ে যাবেন। কেননা ,তার অস্তিত্ব অর্জনে অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে। অতএব ,এই সৃষ্টি সত্তা (দ্বিতীয় কাল্পনিক আল্লাহ) স্রষ্টার আসন থেকে পদচ্যুত হয়ে পড়বেন। কারণ ,আমরা এমন এক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী যিনি স্বয়ংসৃষ্ট ও অপরিহার্য সত্তা। সত্তাহীনতা তার জন্যে কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এ ধরণের কাল্পনিক অস্তিত্বের সৃষ্টি ,সৃষ্ট বস্তুরই নামান্তর আর তা কক্ষনো আল্লাহ্ হতে পারে না।
21
ভাল-মন্দের সঠিক অবস্থান
সর্বজনবিদিত সত্য কথা :
“
আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন”
-এর দু’
টি অর্থ হতে পারে।
একটি হলো
:
“
আল্লাহ্ যে কাজই আঞ্জাম দিয়ে থাকেন তাই ভাল কাজ হিসেবে পরিগণিত ,যদিওবা সে কাজটি বিবেকপ্রসূত মন্দকাজ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।”
অপরটি হলো
:
“
আল্লাহ্ কোন মন্দকাজ আঞ্জাম দিতে পারেন না। তিনি শুধু ভাল কাজই করেন।”
এখান থেকেই ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় দু’
টি মতবাদ তৈরী হয়ে বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে ,যা একটি অপরটির বিপরীত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই যে ,আল্লাহর সকল কাজই ভাল কাজ। কিন্তু মতভেদ হচ্ছে এ নিয়ে যে ,“
মানুষ ধর্মের বিধিনিষেধের সাহায্য ব্যতিরেকে স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভাল-মন্দের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা এবং এর পার্থক্য নিরূপণ করতে কি সক্ষম ?
এটা স্মরণ রাখা দরকার যে আল্লাহর সকল কাজ তার মহাপ্রজ্ঞা ক্ষমতা দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই আল্লাহর কোন কাজই অকারণে সংঘটিত হয় না ,প্রতিটি কাজের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ নির্ধারিত থাকে। আমাদের বিবেক ও বুদ্ধি ক্ষমতাও যেহেতু মহান আল্লাহর সৃষ্টি ,তাই এর স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে ভাল-মন্দ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে বিচার ক্ষমতার প্রয়োগে যথার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।
এর বিপরীতে আশআরী মতাবলম্বীরা বিবেক-বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা- চেতনার মাধ্যমে মানুষের জন্যে ভাল-মন্দের জ্ঞানকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা বলেন ,ধর্মীয় বিধি-বিধান আগমনের পূর্বে মানুষ কোন বিষয়ের ভাল-মন্দ ধারণা অর্জন করতে পারে না। ধর্ম যা আদেশ করেছে তাই হচ্ছে ভাল কাজ আর ধর্মের সকল নিষিদ্ধ কাজই হচ্ছে মন্দ কাজ। মুলতঃ ভাল-মন্দের ধারণা ধর্মীয় বিধি-বিধান থেকেই প্রসূত।
প্রকৃত পক্ষে যদি আমরা ভাল মন্দের ধারণাকে ধর্মের বিধি-বিধান ও নিয়মাবলীর মাধ্যমে অক্টোপাসের মত আবদ্ধ করে ফেলি তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যেখানে ধর্মের কোন আলো-বাতাস পৌঁছেনি ,যেখানকার জনগণ ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কোন ছোঁয়া পায়নি তারা কি ভাল-মন্দ অনুধাবনের ক্ষমতা রাখে না ? তারা কি ভাল কাজ করা আর মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার অধিকার রাখে না ? এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি আশআরীগণ বলেন ,তাদের ভাল-মন্দ অনুধাবন করার ক্ষমতা নেই তাহলে তারা বাস্তবতাকেই উপেক্ষা করেছেন। আর যদি বলেন ,তারা ভাল-মন্দের কোন কাজ নির্বাচন করার অধিকার রাখেন না তাহলে বলতে হবে তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত স্বাধীনতার উপর খবরদারী করেছেন। আর আশআরীদের মতে এ ধরনের জনগোষ্ঠির হিসাব-নিকাশ হবে কিভাবে পরকালে ,কিয়ামতের ময়দানে ? আশআরী মতাবলম্বীরা এ সব প্রশ্নের উত্তর দানে সম্পূর্ণ অপারগ।
মূলত : আল্লাহ্ সকল মানুষকে সমানভাবে ভাল-মন্দের বিচার ক্ষমতা দান করেছেন। যেখানে ধর্মের বিধি-বিধান অবতীর্ণ হয়নি অথবা পৌঁছেনি তাদের হিসাব-নিকাশ তাদের বিবেকের কাছে থেকেই নেয়া হবে কিয়ামতের দিবসে। এ ব্যাপারে আবুল হাসান মুসা বিন জা’
ফার (তাঁর উপর আল্লাহর অফুরন্ত শান্তি বর্ষিত হোক) ---- এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন :
“
হে হিশাম,ন
িশ্চয়ই মানুষের জন্যে আল্লাহর দুটি হুজ্জাত বা অকাট্য দলিল রয়েছে। একটি হচ্ছে জাহেরী বা প্রকাশ্য হুজ্জাত অপরটি বাতেনী বা অপ্রকাশ্য হুজ্জাত। জাহেরী হুজ্জাত হচ্ছে রাসুল ,আম্বীয়া ,ও ইমামগণ আর বাতেনী হুজ্জাত হচ্ছে আক্বাল বা বিচার বুদ্ধি।”
প্রকাশ্য হুজ্জাত যেমনিভাবে মানুষকে ভাল কাজের দিকে দেহায়েত করেন তেমনি অপ্রকাশ্য তথা গুপ্ত হুজ্জাতও মানবজাতিকে সৎ ও ন্যায়ের দিকে পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
ভাল কাজের কতগুলো উদাহরণ হচ্ছে : সুবিচার করা ,ন্যায্য অধিকার দান ইত্যাদি। আর মন্দ কাজ যেমনঃ অবিচার করা ,অন্যায়ভাবে অধিকার হরণ ইত্যাদি। ভাল কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভাল আর মন্দ তার নিন্দনীয় কাজের জন্যে মন্দ। ধর্মীয় বিধি-বিধান এসে ভাল কাজকে ভাল করতে পারে না ,বরং পূর্বে থেকেই ভাল। সকল ভাল কাজই ধর্মের অনুকূলে। অপরদিকে মন্দ কাজ শুধু শরিয়তের আইন প্রণয়নের কারণে তা মন্দ হয়ে যায় না ,বরং পূর্বে থেকেই আপন বৈশিষ্ট্যবলে মন্দ কাজ হিসেবে পরিগণিত। ধর্মীয় অনুশাসন কখনো ভাল কাজকে মন্দ আর মন্দ কাজকে ভাল বলে ঘোষণা দিতে পারে না। কেননা বিবেক বিরোধী কোন কাজই ধর্মীয় নীতিমালায় স্থান পায় না। আল্লাহ্ স্বয়ং সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও মহা-বিবেকবান। মানুষের বিবেকবুদ্ধিও তারই সৃষ্টি। তাই বুদ্ধিবৃত্তি নিষ্কুলুষ ভাবে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম।
স্মরণীয় যে ,আমাদের ভাল-মন্দের আলোচনা ঐ সব ক্রিয়া-কর্ম নিয়ে আবৃত যারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং জাতসত্তাগত দৃষ্টিকোন থেকে ভাল অথবা মন্দ। দৃষ্টান্তস্বরূপ সুবিচার অথবা অত্যাচার-যুলুম ইত্যাদি ধরা যেতে পারে। আমাদের আলোচনা এমন সব ভাল-মন্দের গুণগত মান নিয়ে ব্যাপৃত যেগুলো চিরন্তন ও শাশ্বত ,যেগুলো ভাল-মন্দের আবরণ পরিধান করে স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তনশীল নয়। এর বিপরীতে এমন সব ভাল বা মন্দ কাজ পৃথিবীতে বিদ্যমান যা ভালমন্দের আবরণে নিজেকে উপস্থাপন এবং বিভিন্ন সময়ে বা ক্ষেত্রে আবরণ পরিবর্তন করে থাকে। যেমনঃ সত্যবাদীতা ,মিথ্যা বলা ,অথবা সম্মান বা অসম্মান করা। এটা কখনো কেউ ব্যক্ত করতে পারবে না যে ,সব সময় সত্য কথা বলা ভাল কাজ। কখনো সত্য কথা বলা একটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। যে সত্য কথা বলার কারণে কোন মানুষ বা সমাজের ক্ষতি হতে পারে তা কখনো বিবেকবান মানুষের কাছে ভাল বলে গণ্য হতে পারে না। তদ্রূপ মিথ্যা সব সময় মন্দ কাজ বলে পরিগণিত নয়। বরং কাউকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মিথ্যা বলাটা একটা ভাল কাজ বলে পরিগণিত হতে পারে। একইরকমভাবে সম্মান করা সর্বদা সর্বস্থানে ভাল কাজ হতে পারে না। বরং কোন অত্যাচারী শাসককে সম্মান প্রদর্শন করা একটা অমার্জনীয় অপরাধ।
আবার এমন কতগুলো ভাল বা মন্দ কাজ বিদ্যমান যে ,সেগুলো যে পাত্রে ধারণ করা হয় সে পাত্রের আকার ধারণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বেত্রাঘাত করা। যখন কাউকে আদব শিক্ষা দেয়ার জন্যে বেত্রাঘাত করা হয় তখন এ কাজটি একটি ভাল কাজ হিসেবে গণ্য। আবার যখন কাউকে অত্যাচার ও বিরক্ত করার জন্যে বেত্রাঘাত করা হয় তখন এ কাজটি একটি অন্যায় কাজ বলে পরিগণিত হয়। সুতরাং চিরন্তন ,শাশ্বত ও স্বভাবগত ভাল বা মন্দের বিপরীতে উপরোল্লেখিত পরিবর্তনশীল ভাল-মন্দের আলোচনা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের বহির্ভূত।