উপসংহার
আমরা পুরো আলোচনা থেকে এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্ম ও পরিণতি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জাবর্ ও নিরঙ্কুশ এখতিয়ারের চিন্তাধারা ভ্রান্ত। আল্লাহ্ তা‘
আলা প্রতিটি মানুষের জীবন , কর্ম ও চূড়ান্ত পরিণতির সব কিছু তাকে সৃষ্টি করার পূর্বে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংঘটিত হচ্ছে অথবা আল্লাহ্ তা‘
আলা স্বয়ং প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিকভাবে সম্পাদন করছেন বা তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন-এ ধারণা ঠিক নয়। তেমনি মানুষ এ দুনিয়ার জীবনে পুরোপুরি স্বাধীন এবং আল্লাহ্ তা‘
আলা তার কোনো কাজেই হস্তক্ষেপ করেন না-এ ধারণাও ঠিক নয়। বরং সঠিক বিষয় এর মাঝামাঝি। তা হচ্ছে , মানুষকে পার্থিব জীবনে স্বাধীন এখতিয়ার ও কর্মক্ষমতা দেয়া হয়েছে , তবে বিভিন্ন পার্থিব তথা প্রাকৃতিক ও প্রাণীজ কারণ সে এখতিয়ার ও কর্মক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ , ব্যাহত ও সঙ্কুচিত করে। তেমনি আল্লাহ্ তা‘
আলা এ সৃষ্টিলোকের প্রতি ও বিশেষভাবে মানুষের প্রতি সব সময় দৃষ্টি রাখেন এবং সাধারণভাবে মানুষকে প্রদত্ত স্বাধীন এখতিয়ার ও কর্মক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করলেও সৃষ্টিলোককে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং সমষ্টি ও ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য বিবেচিত হলে তাতে হস্তক্ষেপ করেন।
দ্বিতীয়তঃ পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ মানুষকে ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করায় পার্থিব দৃষ্টিতে সে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয় বটে , কিন্তু পরকালীন সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের জন্য সে নিজেই দায়ী। উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে বিশেষ হস্তক্ষেপ হতে পারে , তবে সে হস্তক্ষেপের ফল পার্থিব জীবনের জন্য যা-ই হোক না কেন , চূড়ান্ত সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের দৃষ্টিতে অর্থাৎ পরকালীন জীবনের জন্য অবশ্যই তা ইতিবাচক-তা তার মাত্রা যতখানিই হোক না কেন ; আল্লাহ্ তা‘
আলার হস্তক্ষেপের ফলাফল মানুষের পরকালীন জীবনের জন্য কখনোই নেতিবাচক নয়। মানুষকে এমন প্রবল ইচ্ছাশক্তি দেয়া হয়েছে যে , সে চাইলে যে কোনো অবস্থায়ই তার প্রকৃত (পরকালীন) সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে পারে ; কোনো পার্থিব কারণই তাকে চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যের কবলে নিক্ষেপ করতে পারে না যদি না সে নিজেই তাকে স্বাগত জানায়।
আমরা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের উপাদানগুলোকে তালিকা আকারে এভাবে সাজাতে পারি:
১) আল্লাহ্ তা‘
আলার মূল সৃষ্টিপরিকল্পনা ও সৃষ্টিলক্ষ্য -যাকে আমরা“
ইরাদায়ে তাক্বভীনীয়ে‘
আামে ইলাহী”
(আল্লাহ্ তা‘
আলার সাধারণ বা সর্বজনীন সৃষ্টি-ইচ্ছা) নামে অভিহিত করতে পারি।
২) আল্লাহ্ তা‘
আলা কর্তৃক সৃষ্ট জড় উপাদান সমূহ ও জড় জগতে প্রতষ্ঠিত প্রাকৃতিক বিধিবিধান। প্রকৃত পক্ষে কোরআন মজীদে একেই“
তাক্বদীর্”
বলা হয়েছে , যেহেতু এসব নিয়ম সুনির্দিষ্ট , অপরিবর্তনীয় ও সৃষ্টিকুলের জন্য অলঙ্ঘনীয়। ফেরেশতাদের কাজের একটি অংশ এ পর্যায়ের , কারণ (দ্বীনী সূত্রের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী) তারা সৃষ্টিজগতের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এ ক্ষেত্রে তারা আল্লাহ্ তা‘
আলার স্থায়ী নির্দেশ কার্যকর করে মাত্র ; তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো কিছুই করে না। ফলে তাদের কাজ মানুষের ভাগ্যের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে তা প্রাকৃতিক বিধিবিধানেরই অনুরূপ। [ফেরেশতাদের কাজের অপর অংশটি আল্লাহ্ তা‘
আলার বিশেষ ইচ্ছা বা হস্তক্ষেপ কার্যকরকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট।]
৩) প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়। এই প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়কে নিম্নোক্ত কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের জীবন ও পার্থিব ভাগ্যকে কমবেশী প্রভাবিত করতে পারে: (ক) উদ্ভিদ , (খ) রোগজীবাণু , (গ) সহজাত প্রবণতার অধিকারী প্রাণীকুল , যেমন: সাপ , ব্যাঙ , ইঁদুর , ইত্যাদি , (ঘ) একই সাথে সহজাত প্রবণতা ও বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)-এর অধিকারী স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও এখতিয়ার সম্পন্ন প্রাণী (অন্য মানুষ ও জিন্)।
(৪) আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে সাধারণ ও বিশেষ পথনির্দেশ। সাধারণ পথনির্দেশ হচ্ছে ব্যক্তি-মানুষের সহজাত প্রবণতা , বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্) ও তার সত্তায় নিহিতি ভালো-মন্দের জ্ঞান। আর বিশেষ পথনির্দেশ হচ্ছে ওয়াহী ও ইলহাম্-যা তার প্রাপককেই শুধু নয় , বরং অন্যদেরকেও প্রভাবিত করে। এর মধ্যে শেষোক্ত পথনির্দেশ অর্থাৎ ইলহাম্ সর্বজনীন দ্বীনী বিষয়েও হতে পারে , আবার সর্বজনীন পার্থিব বিষয়েও (যেমন: আবিষ্কার-উদ্ভাবন) হতে পারে , তেমনি তা নেহায়েত ব্যক্তিগত বিষয়েও হতে পারে।
(৫) আল্লাহ্ তা‘
আলার বিশেষ ফয়সালা বা বিশেষ হস্তক্ষেপ যাকে আমরা“
ক্বাযায়ে ইলাহীয়ে খাছ্ব”
নামে অভিহিত করতে পারি। এ বিশেষ হস্তক্ষেপ দু’
টি ক্ষেত্রে মানুষের ভাগ্যকে প্রভাবিত করে: পার্থিব ও পারলৌকিক। তেমনি তা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও হতে পারে , সমষ্টির ক্ষেত্রেও হতে পারে। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে দু’
টি লক্ষ্যে এ হস্তক্ষেপ হতে পারে: (ক) গোটা সৃষ্টিলোককে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত করার জন্য অপরিহার্য হলে-যা ব্যক্তি-মানুষ , সমষ্টি , এমনকি গোটা মানবকুলের জন্য পার্থিব দৃষ্টিতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। [স্মর্তব্য , প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলে তিনি মানব প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দিয়ে অন্য কোনো প্রজাতি সৃষ্টি করে তাকে খেলাফত প্রদান করবেন।] (খ) ব্যক্তিবিশেষ , সমষ্টিবিশেষ বা সমগ্র মানবমণ্ডলীর কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলে-যা পার্থিব দৃষ্টিতে বাহ্যতঃ কল্যাণকর বা অকল্যাণকর বিবেচিত হতে পারে , কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতির বিচারে তা পার্থিব বা পরকালীন বা উভয় জীবনের জন্যই অবশ্যই কল্যাণকর।
(৬) মানুষের ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্)-যে তার পার্থিব ভাগ্যের ব্যাপারে খুবই শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান এবং চূড়ান্ত (পরকালীন) সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের ক্ষেত্রে একমাত্র সিদ্ধান্তকর উপাদান। এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে তথা পরকালীন ব্যাপারে সে যা চায় তা থেকে তাকে বিরত রাখার ক্ষমতা কারোই নেই একমাত্র আল্লাহ্ তা‘
আলা ছাড়া ; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলা তার এতদসংক্রান্ত‘
সিদ্ধান্তে’
হস্তক্ষেপ করেন না। তবে দুর্ভাগ্যের পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সে যতক্ষণ পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত না নেয় , বা ঔদ্ধত্যের আশ্রয় না নেয় বা এ পথে বেশীদূর অগ্রসর না হয় ততক্ষণ আল্লাহ্ তা‘
আলা চাইলে অনুগ্রহপূর্বক তার চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে তার মধ্যে ঐ পথ থেকে প্রত্যাবর্তনের প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারেন। আর যে ব্যক্তি সৌভাগ্যের পথ বেছে নিয়েছে আল্লাহ্ তা‘
আলা চাইলে তার দুর্বলতা বিবেচনা করে , বিশেষ করে সে আল্লাহ্ তা‘
আলার সাহায্য কামনা করলে , তাকে সাহায্য করেন।
এই নাফ্স্ বা ব্যক্তিসত্তার মধ্যে অনেকগুলো প্রভাবশালী গুণ-বৈশিষ্ট্য আছে যা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এ সব গুণ-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে জ্ঞানপিপাসা , আশা-আকাঙ্ক্ষা , হতাশা , ভাবাবেগ , ঘৃণা-বিদ্বেষ , হিংসা , হিংস্রতা , দয়া , মায়ামমতা , প্রেম-ভালোবাসা , স্নেহ-প্রীতি , লোভ-লালসা , সৌন্দর্যপ্রিয়তা , যৌন কামনা , ক্ষুৎপিপাসা , প্রশংসাপ্রিয়তা , নেতৃত্বলিপ্সা , সম্পদলিপ্সা এবং অন্যের ভালোবাসা ও ঘৃণা , নিন্দা ও প্রশংসা , আদর ও তিরস্কার , অনুরোধ ও শাসনে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ইত্যাদি খুবই শক্তিশালী উপাদান। এ সব উপাদানের প্রতিটিই পরিচর্যায় কমবেশী বৃদ্ধি পায় এবং শাসনে বা দমনে কমবেশী হ্রাস পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যা , আত্মহত্যা , আত্মত্যাগ (দেশ , দ্বীন বা অন্য কিছু বা কারো জন্য জীবন দান) , ধনসম্পদ ত্যাগ , সংসার ত্যাগ , ইত্যাদির ন্যায় তীব্র ও প্রান্তিক কাজ নাফসের কোনো না কোনো গুণের প্রাবল্যের ফসল। অবশ্য মানুষের বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্) সর্বাবস্থায়ই ন্যায়-অন্যায় , ভালো-মন্দ , সত্য-মিথ্যা ও উচিত-অনুচিতের পার্থক্য করতে ও ইতিবাচক পথ বেছে নিতে সক্ষম। কিন্তু ব্যক্তি স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে নেতিবাচক গুণের পরিচর্যা ও ইতিবাচক গুণের দমনে এতদূর অগ্রসর হতে পারে যার ফলে নেতিবাচক গুণগুলো তার বিচারবুদ্ধিকে দুর্বল , পরাভূত ও আচ্ছন্ন করে ফেলে , অতঃপর আর তার বিচারবুদ্ধির পক্ষে তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা সম্ভব হয় না বা হলেও নাফসের পক্ষে আর বিচারবুদ্ধির রায় মেনে চলা সম্ভব হয় না।