কোরআন মজীদে“
ক্বাদর্
”
ও
“
তাক্বদীর্
”
পরিভাষা
আলোচনার শুরুতেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , মুসলিম সমাজের বেশীর ভাগ অংশেই শৈশব কালেই“
ঈমানে মুফাছ্বছ্বাল্”
(বিস্তারিত ঈমান) নামক বাক্যে‘
ভাগ্যের’
ভালো-মন্দের কথা শিক্ষা দেয়া হয়। উল্লিখিত বাক্যে‘
ভাগ্য’
বুঝাবার জন্যالقدر
(আল্-ক্বাদর্) পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে সাধারণভাবে‘
ভাগ্যলিপি’
বুঝাবার জন্যتقدير
(তাক্বদীর্) পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। তাই আমরা আলোচনার শুরুতেই দেখতে চাই যে , কোরআন মজীদে এ পরিভাষা দু’
টি‘
ভাগ্যলিপি’
বা‘
ভাগ্যনির্ধারণ’
অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান থেকে যে জবাব পাওয়া যায় তা না-বাচক।
“
ক্বাদর্”
শব্দটি একটি ক্রিয়াবিশেষ্য। এ শব্দটি এবং এ থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী (ক্রিয়াপদ , বিশেষ্য ও বিশেষণ) কোরআন মজীদে মোট একশ’
বত্রিশ বার ব্যবহৃত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবগুলো শব্দ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আলোচনা খুবই দীর্ঘায়িত হবে। তাই আমরা এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করবো।
কোরআন মজীদে“
ক্বাদর্”
শব্দটি ও তা থেকে সরাসরি নিষ্পন্ন পদসমূহ‘
শক্তি’
,‘
মর্যাদা ও মূল্যায়ন’
,‘
পরিমাপ করণ’
,‘
যথাযথভাবে নির্ধারণ’
ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বয়ং“
আল্-ক্বাদর্”
শব্দটি কোরআন মজীদের সূরাহ্ আল্-ক্বাদর্-এ তিন বার উল্লিখিত হয়েছে। এ সূরায় শব্দটি তিন বারই“
লাইলাতুল্ ক্বাদর্”
পরিভাষার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ‘
মহিমান্বিত রজনী’
।
এ ছাড়া তিনটি সূরায় আল্লাহ্ তা‘
আলা প্রসঙ্গে“
ক্বাদর্”
শব্দটি এবং এতদসহ এ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন একটি ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
(
وَمَا قَدَرُوا اللَّـهَ حَقَّ قَدْرِهِ)
“
আর তারা আল্লাহকে তাঁর যথোপযুক্ত মূল্যায়নে মূল্যায়ন করে নি।”
(সূরাহ্ আল্-আন্‘
আাম্: ৯১ ; আল্-হাজ্জ: ৭৪ ; আয্-যুমার্: ৬৭)
এছাড়া আরো একটি আয়াতে“
ক্বাদর্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:
(
إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا)
“
অবশ্যই আল্লাহ্ তার (তাক্ব্ওয়া অবলম্বনকারীর) কাজকে পূর্ণতায় উপনীতকারী ; বস্তুতঃ আল্লাহ্ প্রতিটি জিনিসের জন্যই“
ক্বাদর্”
তৈরী করে রেখেছেন।”
(সূরাহ্ আত্ব্-ত্বালাক্ব: ৩)
এই শেষোক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে আল্লাহ্ তা‘
আলা“
ক্বাদর্”
শব্দটিকে‘
মূল্যায়ন’
অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি প্রতিটি জিনিসেরই মূল্যায়ন নির্ধারণ করে রেখেছেন বিধায়ই মুত্তাক্বীর কাজকে পূর্ণতায় উপনীত করে দেবেন।
দেখা যাচ্ছে যে , কোরআন মজীদে“
ক্বাদর্”
ক্রিয়াবিশেষ্য (مصدر
)টি কোথাওই মানুষের ভাগ্যনির্ধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। অনুরূপভাবে এ ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদগুলোও ভাগ্যনির্ধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। বরং ক্রিয়াপদগুলো‘
মূল্যায়ন করা’
,‘
পরিমাপ করা’
(পরিমাণ মতো প্রদান) ,‘
সক্ষম হওয়া’
ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ , এরশাদ হয়েছে:
(
اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ)
“
আল্লাহ্ যার জন্য চান রিয্ক্ব প্রশস্ত করে দেন এবং পরিমাপ করে (বা তার পরিমাণ নির্ধারণ করে) দেন।”
(সূরাহ্ আর্-রাদ্: ২৬) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলা যাকে চান তার প্রাপ্যের চেয়েও তাকে বেশী রিয্ক্ব প্রদান করেন এবং সে বেশী পরিমাণটা সুনির্দিষ্ট করে দেন। অবশ্য অনেক মুফাসসিরের মতে , এখানেيقدر
(পরিমাপ করে দেন) কথাটি যাদেরকে রিয্ক্ব প্রশস্ত করে দেন তাদের ব্যতীত অন্যদের সাথে সম্পর্কিত এবং এ কথাটির মানে হচ্ছে সে প্রকৃতই যা পাবার হক্ব্দার তাকে তা-ই প্রদান করেন অর্থাৎ তার চেষ্টা-সাধনা অনুযায়ী ও প্রাকৃতিক কার্যকারণের আওতায় তার যা প্রাপ্য তিনি তাকে তা-ই প্রদান করেন , বেশী দেন না।
অনেকে এই শেষোক্ত আয়াতে উল্লিখিতيقدر
ক্রিয়াপদের অর্থ করেন‘
কমিয়ে দেন’
। কিন্তু এ ক্রিয়াপদ থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ করার কোনো আভিধানিক বা ব্যাকরণগত ভিত্তি নেই। এরপরও , এমনকি যুক্তির খাতিরে যদি এ অর্থকে সঠিক বলে মেনে নেয়া হয় , তাহলেও এ থেকে এ ক্রিয়াপদের মূল অর্থাৎ ক্রিয়াবিশেষ্য“
ক্বাদর্”
শব্দ থেকে‘
ভাগ্য নির্ধারণ’
অর্থ গ্রহণের সুযোগ নেই। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলা যাকে চান তার রিয্ক্ব বৃদ্ধি করে দেন এবং যাকে চান তার রিয্ক্ব কমিয়ে দেন-এ কথার মানে এ নয় যে , তিনি মানুষকে সৃষ্টির সময় তার ভাগ্যে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রিয্ক্ব্ লিখে দিয়েছেন। কারণ , পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ তা‘
আলা যদি আগেই কোনো কিছু নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন , তো পরে তা বৃদ্ধি বা হ্রাস করার কোনো কারণই নেই। কারণ , স্বীয় নির্ধারিত পরিকল্পনায় পরবর্তীতে পরিবর্তন সাধন অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী সত্তার কাজ-যার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি ছিলো বিধায়ই সে পরবর্তীতে তাতে পরিবর্তন সাধন করে তা কার্যকর করে। আল্লাহ্ তা‘
আলা তাকে তার প্রাপ্য হতে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেন-এর মানে হচ্ছে তার মূল প্রাপ্য স্বয়ং আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দেন নি , বরং তার চেষ্টাসাধনা ও প্রাকৃতিক কার্যকারণের ফলেই তা নির্ধারিত হয়েছিলো , কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলা তাকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশী বা কম দেয়াতেই তার বা সমষ্টির কল্যাণ দেখতে পেয়েছেন বলেই দয়া করে তাকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশী বা কম দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে“
ক্বাদর্”
ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন অপর একটি শব্দ (এটিও ক্রিয়াবিশেষ্য) হচ্ছেتقدير
(তাক্বদীর্)-যে শব্দটিকে ক্রিয়াবিশেষ্য হিসেবে নয় , বরং সাধারণ বিশেষ্য হিসেবে মানুষের‘
ভাগ্য’
বা‘
ভাগ্যলিপি’
অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোরআন মজীদে কোথাওই এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। যেমন , এ শব্দটি নিম্নোক্ত আয়াতে প্রাকৃতিক বিধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:
(
وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ)
“
আর তিনি (আল্লাহ্) রাত্রিকে আরামদায়ক এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাব স্বরূপ (বর্ষ ও তিথি গণনায় সহায়ক) বানিয়েছেন। এ হচ্ছে মহাপরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ (তাঁর নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধান)।
”
(সূরাহ্ আল্-আন্‘
আাম্: ৯৬)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
(
قَوَارِيرَ مِنْ فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِيرًا)
“
তারা রৌপ্যপাত্রকে (তাতে রক্ষিত/ প্রদত্ত পানীয়কে) পরিমাণ করবে (পূর্ণ করবে) ঠিক পরিমাণ করার মতোই (অর্থাৎ ঠিক মতো পূর্ণ করবে ; কমও হবে না , উপচেও পড়ব না)।
”
(সূরাহ্ আদ্-দাহর্: ১৬)
আরো এরশাদ হয়েছে:
(
وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا)
“
আর তিনি প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার পরিমাণ (নির্ধারণ) করে দিয়েছেন ঠিক পরিমাণ করার মতোই (অর্থাৎ যথাযথভাবে)।
”
(সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ২) নিঃসন্দেহে এখানে পরিমাণ নির্ধারণ বলতে প্রতিটি জিনিসের গঠন-উপাদান সমূহ ও তার অনুপাত বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ্ তা‘
আলা আরো এরশাদ করেন:
(
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ)
“
আর আমি চন্দ্রের জন্য মনযিল সমূহ (চন্দ্রকলা বা তিথি সমূহ) নির্ধারণ করে দিয়েছি।”
(সূরাহ্ ইয়া-সীন্: ৩৯)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
(
وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ)
“
আর আমরা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছি পরিমাণ মতো।”
(সূরাহ্ আল্-মু’
মিনূন: ১৮)
উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতের সবগুলোতেই জড়বস্তু সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে , মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণশীল সৃষ্টির ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে কথা বলা হয় নি। তবে‘
তিনি প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন’
(خلق کل شیء
) বলতে যদি মানুষ সহ প্রাণশীল সৃষ্টিদেরকেও অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয় সে ক্ষেত্রেও পরিমাণ নির্ধারণের মানে হবে বিভিন্ন প্রাণীর গঠন-উপাদান ও সে সবের অনুপাত নির্ধারণ করে দেয়া ; প্রতিটি প্রাণীপ্রজাতির প্রতিটি সদস্যের সারা জীবনের সব কিছু নির্ধারণ করে দেয়া নয়।
“
ক্বাদর্”
ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী সম্বলিত কোরআন মজীদের সবগুলো আয়াত নিয়ে আলোচনা করলেও কোথাওই এটা পাওয়া যাবে না যে ,“
মানব প্রজাতিকে সৃষ্টির পূর্বে বা সৃষ্টির সমসময়ে তার‘
ভাগ্যলিপি’
বা‘
ভাগ্য নির্ধারণ’
অর্থে“
ক্বাদর্”
বা“
তাক্বদীর্”
অথবা এর কোনোটি থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি আল্লাহ্ তা‘
আলা প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজ সম্পাদন করেন বা তার দ্বারা সম্পাদন করিয়ে নেন-এ অর্থেও উপরোক্ত শব্দ বা তা থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলীর কোনোটি ব্যবহৃত হয় নি।