মুসলিম সমাজে অদৃষ্টবাদ ও নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদ
হযরত আদম (‘
আঃ) থেকে শুরু করে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলই (‘
আঃ) মানুষকে আল্লাহ্ তা‘
আলার নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পিত হয়ে চলার দিকে আহবান জানিয়েছেন। তাঁরা মানুষের নিকট প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও আচরণবিধি উপস্থাপন করেন ও তাদেরকে তা শিক্ষা দেন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে তা পূর্ণ মাত্রায় বাস্তবায়িত করেন। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া জীবনবিধান ইসলাম পরিপূর্ণ ও চূড়ান্তরূপে নাযিল হয় এবং এ জীবনবিধান সহ মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘
আলার পরিপূর্ণ বাণী কোরআন মজীদকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলাই সামান্যতম বিকৃতি থেকেও রক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা করেন (সূরাহ্ আল্-হিজর্: ৯)।
কোরআন মজীদ মানুষের গড়া অন্ধ‘
আক্বীদাহ্-বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্ম ও মতাদর্শ সমূহের কঠোর সমালোচনা করেছে এবং তাদেরকে বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্) প্রয়োগের জন্য আহবান জানিয়েছে। কোরআন মজীদে বার বার বলা হয়েছে:افلا تعقلون
(অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না ?) আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
(
إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ)
“
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জন্তু হচ্ছে সেই বধির-বোবার দল যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না।”
(সূরাহ্ আল-আনফাল্: ২২)
অবশ্য কোরআন মজীদ‘
আক্বলের অগম্য ক্ষেত্রসমূহের জন্য এবং‘
আক্বলের গম্য ক্ষেত্রসমূহেও তাকে ভুল-ভ্রান্তি থেকে রক্ষা ও তাকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দিয়েছে। আর হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ছিলেন জীবন্ত কোরআন ; তিনি কোরআন মজীদের প্রচার করেছেন , লোকদেরকে সেদিকে আহবান করেছেন , তা শিক্ষা দিয়েছেন , প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা পেশ করেছেন এবং স্বীয় জীবনে ও সমাজে তা বাস্তবায়িত করেছেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) যে ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও আচরণ শিক্ষা দিয়ে যান তা তাঁর ওফাতের পরেও কয়েক দশক পর্যন্ত , বিশেষ করে বানী উমাইয়াহর শাসনামল শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মোটামুটি অব্যাহত থাকে। তাই এ যুগে মুসলিম সমাজে অদৃষ্টবাদ ও নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদের উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। কিন্তু বানী উমাইয়াহর রাজতান্ত্রিক শাসনামল শুরু হবার পর অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারা গড়ে উঠতে থাকে। এর আভাস পাওয়া যায় ইয়াযীদের এতদসংক্রান্ত যুক্তি উপস্থাপনের মাঝে। হযরত ইমাম হোসেন (‘
আঃ)-এর বোন হযরত যায়নাব (সালামুল্লাহ্‘
আলাইহা)-এর সাথে বিতর্ককালে ইয়াযীদ তাঁকে বলেছিলো:“
আমরাই সত্যের ওপরে আছি ; আল্লাহ্ তোমার পিতার নিকট থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে আমার পিতাকে দিয়েছেন এবং হোসেনকে লাঞ্ছিত ও আমাকে সম্মানিত করেছেন।”
ইয়াযীদের দাবী ছিলো এবং তার অনুগতরা প্রচার করতো যে , আল্লাহর ইচ্ছা না হলে ইয়াযীদ খেলাফতে অধিষ্ঠিত হতে পারতো না। অবশ্য দ্বীনী বিষয়ে মানুষ যাদের কথা মেনে চলতো এবং যাদের নিকট থেকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতো তাঁদের মধ্যে তখনো অদৃষ্টবাদিতা প্রবেশ করে নি। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতির কারণে অদৃষ্টবাদিতার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। পরবর্তী কালে দ্বীনী চিন্তাবিদগণের কারো কারো মধ্যে এর প্রভাব কিছুটা হলেও প্রবেশ করতে থাকে। এ কারণেই দ্বীনী ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক বিষয়াদিকে সযত্নে এড়িয়ে চলার পথ বেছে নেন। অর্থাৎ দ্বীনী ব্যক্তিত্ববর্গের কতক যেখানে উমাইয়াহ্ বংশের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং একাংশ অহিংস অসহযোগ নীতি অনুসরণ করে স্বাধীনভাবে দ্বীনী জ্ঞান-গবেষণা ও জনগণকে শিক্ষাদানের কাজে আত্মনিয়োগ করেন , তখন এই তৃতীয় অংশটি উক্ত উভয় পন্থা পরিহার করে‘
অরাজনৈতিক’
দ্বীনী চর্চায় মশগূল হন।