দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াতের ব্যাখ্যা
কোরআন মজীদের যে সব আয়াত থেকে দৃশ্যতঃ প্রতীয়মান হয় যে , আল্লাহ্ তা‘
আলাই সব কিছু করেন বা করান অথবা পূর্ব থেকেই সব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তদনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব কিছু সংঘটিত হচ্ছে , সে সব আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কারণেই এরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু এটা কোরআন মজীদের আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে এসব আয়াতের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এবং কোরআন মজীদকে একটি একক ও অবিভাজ্য পথনির্দেশ গণ্য করে অর্থ গ্রহণ করা। নচেৎ কোরআন মজীদে যেখানে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক উভয় ধরনের আয়াত রয়েছে তখন একে স্ববিরোধী বলে মনে হবে। কিন্তু কোরআন মজীদ যে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতারূপ দুর্বলতা থেকে মুক্ত। স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা কাফেরদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন:
)
أ
َفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا(
“
তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না ?
আর তা (কোরআন) যদি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে হতো (কোনো মানুষের রচিত হতো) তাহলে তাতে বহু স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব থাকতো।”
(সূরাহ্ আন্-নিসা’
: ৮২)
কিন্তু কোরআন মজীদে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক ডজন ডজন আয়াত থাকা সত্ত্বেও কোরআন নাযিল কালীন বা তদপরবর্তী কালীন আরব মুশরিক , ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতার একটি দৃষ্টান্তও নির্দেশ করা হয় নি। আশ্চর্যের বিষয় যে , তারা কোরআন মজীদকে মানুষের রচিত গ্রন্থ বলে দাবী করা সত্ত্বেও উক্ত চ্যালেঞ্জের মুখেও কোরআন মজীদে এমন দু’
টি আয়াতও খুঁজে পায় নি যাকে পরস্পর বিরোধী বলে দাবী করা যেতে পারে। কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পর এক শতাব্দী কালেরও কম সময়ে কতক মুসলিম মনীষী কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতকে প্রেক্ষাপট ও সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন অর্থ গ্রহণ করতে থাকেন যার ফলে ডজন ডজন আয়াত পরস্পর বিরোধী বলে প্রতিভাত হয়। এখানে আমরা উদাহরণ স্বরূপ , দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াত সমূহের মধ্য থেকে ইতিপূর্বে উল্লিখিত আয়াত সমূহ নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখবো যে , এসব আয়াত আদৌ অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না।
(১) আল্লাহ্ তা‘
আলা প্রতিটি প্রাণীর অবস্থানস্থল ও সাময়িক বিশ্রামস্থল (অথবা , বেশীর ভাগ অনুবাদকের গৃহীত অর্থ অনুযায়ী , মৃত্যুস্থল) সম্বন্ধে অবগত (সূরাহ্ হূদ্: ৬)।
এমন কোনো পাতাও ঝরে পড়ে না যা তিনি জানেন না (সূরাহ্ আল্-আন্‘
আম্: ৫৯)। তিনি জানেন যা আছে লোকদের বর্তমানে ও ভবিষ্যতে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৫৫)।
কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলার জানা থাকা মানেই যে তা তাঁর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত-এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , প্রথমতঃ মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে অতীতে যে সব কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘
আলা পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘
আলা তাদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে সম্যক অবগত। ব্যক্তির ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের কারণ সমূহের মধ্যে প্রাকৃতিক বিধিবিধান , জেনেটিক কারণ , ব্যক্তির নিজের স্বাধীন ইচ্ছা , এখতিয়ার , মন-মেজাজ ও প্রবণতা এবং তার সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক সহ সব ধরনের কারণ সম্বন্ধেই তিনি পুরোপুরি অবগত । তাই বলে এজন্য তিনিই দায়ী এরূপ দাবী করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক বিধিবিধান , জেনেটিক কারণ এবং ব্যক্তির সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক তার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকার অধিকারী হওয়ার মানে কখনোই এটা হতে পারে না যে , এর ফলে তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এ ব্যাপারে কোনোই ভূমিকার অধিকারী নয়।
এ প্রসঙ্গে মানবিক জগতের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। যেমন: একজন শিক্ষক স্বীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একজন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে , সে পরীক্ষায় প্রথম হবে এবং আরেক জন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে , সে অকৃতকার্য হবে। তাই বলে তাদের প্রথম হওয়া ও অকৃতকার্য হওয়ার জন্য ঐ শিক্ষককে দায়ী করা চলে না। তেমনি একটি রাস্তার মোড়ে অবস্থিত একটি উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তি যদি মোড়ের দুই দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আগত দু’
টি গাড়ী দেখে , গাড়ী দু’
টির চালকদ্বয় রাস্তার পাশের বাড়ীঘরের কারণে একে অপরের গাড়ীকে দেখতে পাচ্ছে না লক্ষ্য করে এবং গাড়ী দু’
টির গতিবেগ ও রাস্তার মোড় থেকে উভয়ের দূরত্বের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে , দুই মিনিট পর গাড়ী দু’
টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটবে , আর সত্যিই যদি দুই মিনিট পর গাড়ী দু’
টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে , তাহলে ঐ সংঘর্ষের জন্য কিছুতেই ভবিষ্যদ্বাণীকারী ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে না। স্মর্তব্য , এ ক্ষেত্রে গাড়ী দু’
টির ভিতর ও বাইরের অবস্থা , চালকদ্বয়ের শারীরিক-মানসিক অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট পথের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান যত বেশী হবে তার পক্ষে তত বেশী নির্ভুলভাবে ও তত আগে এ দুর্ঘটনা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এ দুর্ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা যাবে না।
দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টি সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা‘
আলার ভবিষ্যত জ্ঞানের মধ্যে এমন কতক বিষয় রয়েছে যা দু’
টি ভিন্ন ভিন্ন বা পরস্পর বিরোধী সমান সম্ভাবনার অধিকারী। এমনকি কিছু বিষয় বহু সম্ভাবনার অধিকারী থাকাও স্বাভাবিক। (এ সম্পর্কে পরে প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।)
আর‘
কিতাবুম্ মুবীন্’
(সুস্পষ্ট/ সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ) সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে , তাকে প্রতীকী বর্ণমালায় কালির হরফে কাগজের বুকে লেখা আমাদের পঠনীয় গ্রন্থ মনে করলে ভুল করা হবে। বরং এ হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও বস্তুলোকের উর্ধস্থিত বিষয় (মুতাশাবেহ্)। অতএব , এতে সব কিছু কী অবস্থায় নিহিত রয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , এতে নিহিত তথ্যবিলীর মধ্যে সমান দুই সম্ভাবনা বা বহু-সম্ভাবনা বিশিষ্ট বিষয়াদিও অন্যতম।
(২) আল্লাহ্ তা‘
আলা প্রাণ দান করেন এবং মৃত্যু প্রদান করেন (আল্-হাদীদ্: ২)। এর মানে হচ্ছে , তিনিই জীবনের সূচনা করেন ও মৃত্যুর অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান নির্ধারণ করেন। এছাড়া জীবনের উদ্ভব ও বিকাশের এবং মৃত্যু ঘটার কারণ সমূহ (কারণ-বিধি) তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অধিকন্তু তিনি জীবন ও মৃত্যুর প্রতি সদা দৃষ্টি রাখেন এবং গোটা সৃষ্টিলোক , বা মানব প্রজাতি , বা কোনো জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ব্যক্তির কল্যাণের জন্যে যদি চান যখন ইচ্ছা তাতে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু এর মানে এ নয় যে , জীবন ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি ও মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা এবং অন্যান্য কারণের কোনোই ভূমিকা নেই। কারণ , স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলাই মানুষের এ ধরনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার থাকার কথা বলেছেন। যেমন , আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
(
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا)
“
যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ বা ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টির দায়ে ব্যতীত কাউকে হত্যা করলো সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে হত্যা করলো এবং যে তাকে জীবিত রাখলো (তার জীবন রক্ষা করলো) সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে জীবন দান করলো।”
(সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্: ৩২)
এ ছাড়াও কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে মানুষের হত্যা করার ক্ষমতা প্রমাণিত হয়। অতএব , মানুষের মৃত্যুর দিন-ক্ষণ , স্থান ও কারণ পূর্ব থেকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ হতে নির্ধারিত বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ , তাহলে বলতে হবে যে , আল্লাহ্ তা‘
আলাই তার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে রেখে ছিলেন। যদি তা-ই হতো তাহলে হত্যার জন্য ঘাতককে অপরাধী ও গুনাহ্গার গণ্য করা ঠিক হতো না। বস্তুতঃ এটা বড়ই অন্যায় ধারণা যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা একজনকে দিয়ে আরেক জনকে হত্যা করাবেন , অথচ হত্যার অপরাধে হত্যাকারীকে (যে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের যান্ত্রিক হাতিয়ার বৈ নয়) শাস্তি দেবেন ; তিনি এরূপ অন্যায় নীতি ও আচরণ থেকে প্রমুক্ত।
(৩) আল্লাহ্ যাকে চান রিযক্ব্ প্রসারিত করে দেন (সূরাহ্ আল্-‘
আনকাবুত্: ৬২)। এ আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয় যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার জন্য রিযক্বের ধরন , পরিমাণ , সময় ও মাধ্যম নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারণ , এ আয়াতে বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের ক্রিয়ারূপ (ছ্বীগাহ্) ব্যবহার করা হয়েছে।‘
প্রসারিত করে দেন’
কথাটি থেকেও প্রমাণিত হয় যে , তিনি তা পূর্ব থেকে নির্ধারিত করে রাখেন নি। কারণ , পূর্বনির্ধারণের পর তাতে পরিবর্তন সাধন সীমিত জ্ঞানের অধিকারী দুর্বলমনা মানুষের বৈশিষ্ট্য ; পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘
আলা এরূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত। বরং এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে , কারণ-বিধির আওতায় ব্যক্তির জন্য রিযক্ব্ নির্ধারিত হয়ে যায় , তবে তিনি চাইলে তাকে তা সম্প্রসারিত করে দেন , নয়তো কারণ-বিধির আওতায় তার যা প্রাপ্য তাকে তা-ই (পরিমাপ করে) প্রদান করেন।
(৪) প্রতিটি উম্মাহরই একটি শেষ সময় (আজাল্) রয়েছে যা এসে গেলে আর অগ্র-পশ্চাত হয় না (সূরাহ্ ইউনুস: ৪৯)। এখানে“
আজাল্”
শব্দের অর্থ করা হয় আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত শেষ সময়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোরআন মজীদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য তা নয়। বরং এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে , কোনো জনগোষ্ঠী বা জাতির আয়ুষ্কাল অব্যাহত থাকা ও ধ্বংসের জন্য সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে ; যখন তার ধ্বংসের উপযোগী সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে যায় তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ , আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
(
ذَلِكَ أَنْ لَمْ يَكُنْ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا غَافِلُون)
“
এটা এজন্য যে , (হে রাসূল!)
আপনার রব কোনো জনপদকে তার অধিবাসীরা অসচেতন থাকা অবস্থায় অন্যায়ভাবে তাকে ধ্বংস করেন নি।”
(সূরাহ্ আল্-আন্‘
আম্: ১৩১)
আল্লাহ্ তা‘
আলা আরো এরশাদ করেন:
(
وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُون)
“
(হে রাসূল!)
আপনার রব এমন নন যে , কোনো জনপদের অধিবাসীরা যথোচিত কর্ম সম্পাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে সে জনপদকে ধ্বংস করে দেবেন।”
(সূরাহ্ হূদ্: ১১৭)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
(
يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى)
“
তিনি (আল্লাহ্) তোমাদেরকে আহবান করছেন যাতে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের গুনাহ্ সমূহ মাফ করে দেন এবং তোমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় (আজালে মুসাম্মা) পর্যন্ত অবকাশ প্রদান করেন।”
(সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১০)
এ আয়াতে নবী (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের শর্তে আজালে মুসাম্মা পর্যন্ত শাস্তি বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ ,يوخرکم
(তোমাদেরকে অবকাশ প্রদান করেন) কথাটির ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য (مصدر
) হচ্ছেتأخير
-যার অর্থ পিছিয়ে দেয়া। তাছাড়া এ আয়াতে যে আযাব্ বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা পূর্বাপর আয়াতের ধারাবাহিকতা থেকেই প্রমাণিত হয়। কারণ , কাফেররা নবী (আঃ)-কে প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ্ তা‘
আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। এরশাদ হয়েছে:
(
فَأَوْحَى إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِين)
“
অতঃপর তাদের রব তাদের নিকট ওয়াহী করলেন যে , অবশ্যই আমরা যালেমদেরকে ধ্বংস করে দেবো।”
(সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১৩)
বলা বাহুল্য যে , কোনো জাতির ধ্বংসের দিনক্ষণ ও প্রেক্ষাপট যদি সৃষ্টির সূচনায়ই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে ঈমান আনলে ধ্বংস পিছিয়ে দেয়া হবে বলে জানানোর কোনো অর্থ হয় না। তাছাড়া কারো ঈমান বা কুফরী যদি পূর্ব নির্ধারিত হয় তাহলে তার জন্যে ঈমান আনার শর্ত আরোপ করাও অর্থহীন। আর আল্লাহ্ তা‘
আলা অর্থহীন কথা ও কাজ রূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত।
উপরোক্ত প্রথম আয়াতে (সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১০)“
আজালে মুসাম্মা”
মানে যে পূর্বনির্ধারিত দিন-তারিখ নয় , বরং যদ্দিন তারা নিজেদেরকে পুনরায় ধ্বংসের উপযুক্ত না করে তদ্দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে-তা-ও সুস্পষ্ট। কারণ , পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ পর্যন্ত ঈমান আনার শর্তে অবকাশ প্রদানের কথা বলা স্ববিরোধিতা বৈ নয়। কেননা , অবকাশটি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকলে সে অবকাশ অনিবার্য হয়ে যায় , ফলে তাকে আর‘
অবকাশ’
নামে অভিহিত করা চলে না।
অবশ্য এখানে“
আজালে মুসাম্মা”
বলতে ক্বিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রেও এ সত্যই প্রমাণিত হয় যে , কোনো জাতির ধ্বংসের জন্য দিনক্ষণ পূর্বনির্ধারিত নেই , বরং তার ধ্বংসের শর্তাবলী নির্ধারিত হয়ে আছে-যা পূর্ণ হলে তাকে ধ্বংস করে দেয়া হবে , আর পূর্ণ না হলে তার অস্তিত্ব অব্যাহত থাকবে এবং তাকে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে।
অন্য একটি আয়াত থেকেও মনে হয় যে ,“
আজালে মুসাম্মা”
মানে ক্বিয়ামত দিবস। এরশাদ হয়েছে:
(
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ ثُمَّ قَضَى أَجَلًا وَأَجَلٌ مُسَمًّى)
“
তিনিই (আল্লাহ্) যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন , অতঃপর (তোমাদের জন্য)“
আজাল্”
-এর অমোঘ বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তাঁর নিকটে রয়েছে“
আজালে মুসাম্মা”
।”
(সূরাহ্ আল্-আন্‘
আম্: ২)
এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , প্রথমোক্ত“
আজাল্”
মানে‘
শেষ সময়’
বা‘
মৃত্যু’
র‘
অমোঘ বিধান’
এবং দ্বিতীয়োক্ত“
আজালে মুসাম্মা”
মানে‘
ক্বিয়ামত দিবস’
। এ আয়াতের বক্তব্য থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে , মানুষের জন্য“
আজাল”
-এর ফয়সালা বলতে‘
শেষ সময়’
বা‘
মৃত্যু’
র অনিবার্যতা বুঝানোই এখানে লক্ষ্য , সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বুঝানো লক্ষ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলা মানুষের (এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির) জন্য মৃত্যুর বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন , অতঃপর যখন কোনো না কোনো কারণে কারো জন্য মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায় তখনই তার মৃত্যু ঘটে।
অবশ্য মৃত্যুর জন্য এই প্রাকৃতিক কারণ সমূহ ছাড়াও একটি ব্যতিক্রমী কারণও রয়েছে , তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘
আলার প্রত্যক্ষ ফয়সালা। অর্থাৎ সৃষ্টিলোক , মানব প্রজাতি , কোনো জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস আল্লাহ্ তা‘
আলার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় হয় তখন মৃত্যু বা ধ্বংসের জন্য প্রাকৃতিক কারণ বিদ্যমান না থাকলেও আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছায় তার মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য। (অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক কারণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠলেও সৃষ্টিলোক , মানব প্রজাতি , উক্ত জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘
আলা তা পিছিয়ে দিতে পারেন।) আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছাক্রমে হযরত খিযির (আঃ) কর্তৃক একটি শিশুকে হত্যার ঘটনা (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৭৪) এ পর্যায়ের-যা শিশুটি ও তার পিতামাতার জন্য কল্যাণকর বিবেচিত হয়। এ ঘটনা থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে , শিশুটির মৃত্যু আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে (তার জন্মের পূর্ব থেকেই) পূর্বনির্ধারিত ও অনিবার্য ছিলো না। কারণ , তাহলে সে বড় হয়ে অবাধ্যতা ও কুফর্ দ্বারা পিতামাতাকে প্রভাবিত করবে বলে আল্লাহ্ তা‘
আলা ও হযরত খিযির (আঃ)-এর পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করার (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৮০) কোনো কারণ থাকতো না এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ারও প্রয়োজন হতো না।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , সাধারণভাবে মানুষদের মৃত্যুর দিনক্ষণ তার জন্মের পূর্বে নির্ধারিত নয় (তবে কতক ব্যতিক্রম থাকা স্বাভাবিক)।
এখানে বিচারবুদ্ধির আলোকে মানুষের‘
আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’
র সম্ভাবনার ওপর দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। বিচারবুদ্ধির পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাই যে , একটি মানবসন্তান জন্মগ্রহণের সময়‘
আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’
র বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসে। কিন্তু জন্মের পর বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণ তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার‘
সম্ভাবনা’
র বৃত্ত দু’
টির আয়তনকে ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করতে থাকে । আমরা যদি তার বয়সকে একটি ক্রমপ্রসারমান নেতিবাচক বৃত্ত হিসেবে এবং তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার‘
সম্ভাবনা’
র বৃত্ত দু’
টিকে ক্রমসঙ্কোচনরত ইতিবাচক বৃত্ত হিসেবে ধরে নেই , তাহলে তার বয়সবৃত্তের বৃদ্ধি এবং আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার সম্ভাবনার বৃত্তদ্বয়ের সঙ্কোচন অব্যাহত থাকায় যখন তার বয়সবৃত্ত ও প্রতিভা সম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখন তার প্রতিভার বিকাশধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে এবং যখন তার বয়সবৃত্ত ও আয়ুষ্কাল সম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখনই তার মৃত্যু ঘটবে। এর ব্যতিক্রম কেবল তখনই সম্ভব যদি আল্লাহ্ তা‘
আলা তার প্রতিভাসম্ভাবনাবৃত্ত বা আয়ুষ্কালসম্ভাবনাবৃত্ত সঙ্কুচিত হয়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সেখান থেকে পিছিয়ে দেন তথা তার সঙ্কোচনকে (আংশিকভাবে হলেও) দূর করে দেন তথা হারিয়ে যাওয়া প্রসারতাকে (আংশিকভাবে হলেও) ফিরিয়ে দেন।
অনুরূপভাবে ব্যক্তির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণে তার প্রতিভাসম্ভাবনার অনেকগুলো দিক বা শাখার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বা তার বিকাশের গতি শ্লথ হয়ে যায় , যদি না কোনো কারণে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে তাতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়।
(৫) এমন কোনো মুছ্বীবত্ আপতিত হয় না যা পূর্ব থেকেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই (সূরাহ্ আল্-হাদীদ: ২২) এবং আল্লাহ্ যখন কোনো জনগোষ্ঠীর অকল্যাণ চান তখন তা কেউ রোধ করতে পারে না (সূরাহ্ আর্-রা‘
দ্: ১১)।
এখানে কিতাবে মুছ্বীবত্ লিপিবদ্ধ থাকা মানে প্রতিটি ব্যক্তির ওপর কবে কখন কী ধরনের মুছ্বীবত্ আপতিত হবে তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই বা সূচনার মুহূর্তেই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো-এমন নয়। বরং এ আয়াতে“
আজাল্”
-এর লক্ষ্য দু’
টি সম্ভাবনার একটি। হয় এর লক্ষ্য এই যে , মুছ্বীবত্ সমূহের ধরন সুনির্দিষ্ট এবং তার শর্তাবলী কারণবিধি দ্বারা সুনির্দিষ্ট রয়েছে। অতএব , এর বাইরে নতুন ধরনের কোনো মুছ্বীবত্ হতে পারে না (যা আল্লাহ্ তা‘
আলার জানা থাকবে না এবং তিনি চাইলে যা রোধ করতে পারবেন না)। অথবা এর লক্ষ্য এই যে ,‘
বিভিন্ন কারণে’
(মানবিক , প্রাকৃতিক ও অন্যবিধ) ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য যে মুছ্বীবত্ অবধারিত হয়ে গেছে যথাসময়ে তার বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য ; তা থেকে কেউ কিছুতেই পালাতে পারবে না।
সূরাহ্ আর্-রা‘
দ্-এর ১১ নং আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় যে , ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর স্থান ও কালের আওতায় যে বিপদ আপতিত হয় তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে বা সূচনাকালে বা ব্যক্তির অস্তিত্বের সূচনাকালে নির্ধারিত করে রাখা হয় নি। কারণ ,“
আল্লাহ্ যখন চান বা চাইবেন”
থেকেই প্রমাণিত হয় যে , তিনি তা সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির বা ব্যক্তির অস্তিত্বলাভের সূচনাকালে বা তার পূর্বে নির্ধারণ করে রাখেন নি।