একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত
আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি , ভবিষ্যতের একটি অংশ সুনিশ্চিতরূপে এবং একটি অংশ দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘
আলার ভবিষ্যত বিষয়ক জ্ঞানে এ উভয় ধরনের বিষয়াদিই শামিল রয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতের আরো একটি অংশ রয়েছে যা শূন্য তথা পুরোপুরি অনিশ্চিত।
যে সব বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ণ কারণ বিদ্যমান তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই পূর্ণ কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহ্ তা‘
আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা , প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া , প্রাণীজ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ্ তা‘
আলার প্রাজ্ঞ হস্তক্ষেপের ফল। এর কোনো একটি বা একাধিক বা সবগুলো কারণ যা‘
অনিবার্য’
করে তোলে তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রথম ও শেষ কারণ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা এবং তাঁর হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া ব্যতীত অন্যান্য কারণের প্রতিক্রিয়াকে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘
আলা চাইলে পরিবর্তিত করে দেন। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা‘
আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ ব্যতিক্রম , সেহেতু ভবিষ্যতের এ অংশটিকে অর্থাৎ পূর্ণ কারণ যা অনিবার্য করে ফেলেছে তাকে আমরা অনিবার্য বলে গণ্য করতে পারি।
অন্যদিকে পূর্ণ কারণ ভবিষ্যতের একটি অংশকে দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে রেখেছে-ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কারণ যার একটি বাদে অপর সম্ভাবনাটিকে বা সম্ভাবনাগুলোকে বিলুপ্ত করে দেবে এবং যে সম্ভাবনাটি অবশিষ্ট থাকবে তা অনিবার্য হয়ে উঠবে।
এছাড়া ভবিষ্যতের রয়েছে এক সীমাহীন শূন্য দিগন্ত যেখানে কোনো কারণ কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোথিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তোলে নি। অন্য কথায় , ভবিষ্যতের একটি অংশে কোনই কারণ বিদ্যমান নেই অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলা ভবিষ্যতের একটি অংশকে সকল প্রকার কারণ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্ তা‘
আলার ভবিষ্যত ইচ্ছাই কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তুলতে পারে।
আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
(
يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ)
“
আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং (যা ইচ্ছা করেন) স্থির করে দেন। আর তাঁর সামনে রয়েছে গ্রন্থজননী (উম্মুল কিতাব)।
”
(সূরাহ্ আর্-রা‘
দ্: ৩৯) অর্থাৎ উম্মুল কিতাবে কতগুলো ভবিষ্যত বিষয় একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত রূপে নিহিত রয়েছে।
তিনি আরো এরশাদ করেন:
(
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلً)
“
[তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ্) পরম বরকতময়] যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে , তোমাদের মধ্যে কর্মের বিচারে কে অধিকতর উত্তম।”
(সূরাহ্ আল্-মুলক্: ২)
এর মানে আল্লাহ্ তা‘
আলা সৃষ্টির শুরুতেই নির্ধারণ করে রাখেন নি যে , কর্মের বিচারে কে ভালো হবে ও কে মন্দ হবে। অর্থাৎ তিনি মানুষকে ভালো-মন্দের উভয় সম্ভাবনাযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য সেহেতু তিনি ব্যক্তি-মানুষের ভবিষ্যতকে ভালো ও মন্দের সমান সম্ভাবনাযুক্ত করে দিয়েছেন , অতঃপর বিভিন্ন কারণ তাকে প্রভাবিত করে , তবে ভালো-মন্দ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বেশী‘
প্রভাবশালী কারণ’
যা অন্য সমস্ত কারণ ও তজ্জনিত সম্ভাবনা সমূহকে পরাভূত করতে সক্ষম।
এছাড়া কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয়কে শর্তযুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে যা একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতেরই প্রমাণ বহন করে। এখানে আমরা মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো। যেমন , এরশাদ হয়েছে:
(
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ)
“
আর জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীন থেকে বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।”
(সূরাহ্ আল্-আ‘
রাফ্: ৯৬)
এ আয়াতে বরকত প্রাপ্তির জন্য ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে , বলা হয় নি যে , তাদের ভাগ্যে বরকত লিপিবদ্ধ ছিলো না বিধায় তাদেরকে বরকত প্রদান করা হয় নি। আর এ আয়াত থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে , ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বন করা তাদের এখতিয়ারাধীন বিষয় , নইলে আল্লাহ্ তা‘
আলা বলতেন না“
যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো”
।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
(
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُم)
“
হে ঈমানদারগণ!
তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম সমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন।”
(সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ৭)
এখানে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তিকে তাঁকে সাহায্য করার (তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা-সাধনার) সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে সাহায্য না করলে তথা তাঁর রাস্তায় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম না করলে তিনি মু’
মিনদেরকে সাহায্য করবেন না ।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
(
إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا)
“
তোমাদের মধ্য থেকে যদি ধৈর্য ও দৃঢ়তার অধিকারী বিশ জন হয় তাহলে কাফেরদের দুইশ’
জনকে পরাজিত করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে (এরূপ) একশ’
জন হলে তাদের এক হাজার জনকে পরাজিত করবে।”
(সূরাহ্ আল্-আনফাল্: ৬৫)
এখানে ধৈর্য ও দৃঢ়তাকে বিজয়ের শর্ত করা হয়েছে , ভাগ্যলিপিকে নয়।
অন্যদিকে শূন্য বা পুরোপুরি অনিশ্চিত ভবিষ্যত হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে না কিছু নিশ্চিত হয়ে আছে , না সুনির্দিষ্ট একাধিক সম্ভাবনা আছে , বরং তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘
আলার ভবিষ্যত ইচ্ছার সীমাহীন দিগন্ত। এরূপ একটি সীমাহীন দিগন্ত আল্লাহ্ তা‘
আলার চিরন্তন সৃষ্টিশীলতা গুণের জন্য অপরিহার্য। শুধু বর্তমান সৃষ্টিনিচয়ের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘
আলার সৃষ্টিশীলতাকে (তা যতই না দৃশ্যতঃ সীমাহীন হোক) সীমাবদ্ধ গণ্য করা মানে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে সীমিত গণ্য করা-যা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।
আল্লাহ্ তা‘
আলার সৃষ্টিশীলতার ওপরে সীমাবদ্ধতা কল্পনাকারী চিন্তাধারা বর্তমানে প্রাপ্ত বিকৃত তাওরাতে লক্ষ্য করা যায় । তাওরাত নামে দাবীকৃত বাইবেলের প্রথম পুস্তকে (আদি/ সৃষ্টি পুস্তক) বলা হয়েছে:“
পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃত কার্য হতে নিবৃত্ত হলেন ; সেই সপ্তম দিবসে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হতে বিশ্রাম করলেন।”
(২:২)
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:
(
وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ)
“
আর ইয়াহূদীরা বলে:“
আল্লাহর হাত সংবদ্ধ।”
তাদেরই হাত সংবদ্ধ হোক এবং তারা যা বলেছে সে কারণে তারা অভিশপ্ত হোক। বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় (কুদরাতী) হাতই সম্প্রসারিত।”
(সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্: ৬৪)
অবশ্য উক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরশাদ হয়েছে:ينفق کيف يشاء
-“
তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন।”
এ থেকে বাহ্যতঃ আল্লাহ্ তা‘
আলার কুদরাতী হাতের প্রসারতা তাঁর নে‘
আমত প্রদান সংক্রান্ত বলে মনে হলেও এ আয়াতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে আল্লাহ্ তা‘
আলার সীমাহীন সৃষ্টিশীলতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন:
(
إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيم)
“
নিঃসন্দেহে (হে রাসূল!)
আপনার রব অনবরত সৃষ্টিকারী সদাজ্ঞানী।”
(সূরাহ্ আল্-হিজর্: ৮৬)
অন্য এক আয়াত থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ তা‘
আলা এরশাদ করেন:
(
يَاأَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (১৫) إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ (১৬) وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ)
“
হে মানব মণ্ডলী!
তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ্ ; তিনি হচ্ছেন অ-মুখাপেক্ষী সদাপ্রশংসনীয়। তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) কোনো নতুন সৃষ্টিকে নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়।”
(সূরাহ্ আল্-ফাতের: ১৫-১৭)
সূরাহ্ ইবরাহীমের ১৯ ও ২০তম আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এখানে‘
নতুন সৃষ্টি’
(خلق جديد
) বলতে এমন সৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা তিনি এখনো করেন নি।
অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:
(
إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا)
“
হে মানবমণ্ডলী!
তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) অন্য কাউকে (কোনো নতুন সৃষ্টিকে) নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর এটা করতে আল্লাহ্ পুরোপুরি সক্ষম।”
(সূরাহ্ আন্-নিসা’
: ১৩৩)
অনেকে উপরোক্ত আয়াত সমূহের তাৎপর্য করেছেন এই যে , আল্লাহ্ তা‘
আলা এক জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করার কথা বলেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কারণ , আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকেايها الناس
(হে মানবমণ্ডলী!) সম্বোধন থেকে সুস্পষ্ট যে , তিনি সমগ্র মানব প্রজাতিকে সরিয়ে দেয়ার ও তাদের পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন প্রজাতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। তবে তা করা বা না-করার ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি।
বস্তুতঃ ভবিষ্যতের একাধিক সম্ভাবনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে আশা‘
এরী ও মু‘
তাযিলী উভয় চিন্তাধারাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।