মুসলিম ও হানির শাহাদত
ইবনে যিয়াদ বকর ইবনে হামারানকে দারুল ইমারার ছাদের উপর মুসলিমকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার হুকুম দিল । মুসলিম যাওয়ার সময় তাছবীহ পাঠ করছিলেন এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন । ছাদের উপর পৌছা পর্যন্ত তিনি রাসূলে পাকের (সা.)উপর দরুদ পাঠ করতে থাকলেন ।
তার মাথা দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেল । তার হত্যাকারী অত্যন্ত ভীত বিহ্বলভাবে ছাদ থেকে নেমে আসল । ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করল তোমার কি হল । বলল- হে আমীর যখন তাকে হত্যা করছিলাম তখন কুৎসিত কাল চেহারার এক লোক দেখলাম যে , আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে দাতে নিজের আঙ্গুল কামড়াচ্ছে । তাকে দেখে এত ভয় পেয়েছি যে জীবনে কোন কিছুতেই এরূপ ভয় পাইনি । ইবনে যিয়াদ বলল- বোধহয় মুসলিমকে হত্যা করাতে তোমার মনে ভয় ধরে গেছে । এরপর হানিকে নিয়ে আসার হুকুম দিল । হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হল । তখন হানি বারবার বলছিলেন-
وامذْحجاهُ و أيْن منّى مذْحجُ! واعشيرتاهُ و أيْن منّى عشيرتى !
“ কোথায় আমার গোত্রের লোকেরা ? কোথায় আমার আত্মীয়-স্বজন ?”
জল্লাদ বলল-তোমার গর্দান নোয়াও । হানি বললেন খোদার কসম! আমার প্রাণ ও গর্দান দান করার জন্য আমি বদান্যতা দেখাব না । আমাকে হত্যা করার কাজে তোমাকে সহায়তা করব না । রশীদ নামক ইবনে যিয়াদের এক গোলাম তরবারীর আঘাত হেনে তাকে শহীদ করল ।
মুসলিম ও হানির মৃত্যুশোকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর আসাদী এই কবিতাগুলো রচনা করেন। এক বর্ণনা মতে এ কবিতার রচয়িতা ফারাযদাক এবং কেউ কেউ বলেছেন যে , সালমান হানাফী তা রচনা করেছেন।
فإنْ كُنْت لا تدْرين ما الْموْتُ فانْظُرى
|
|
إلى هانى فى السُّوق وابْن عقيل
|
إلى بطلٍ قدْ هشّم السّيْفُ وجْههُ
|
|
وآخرُ يُهْوى منْ طمارٍ قتيل
|
أصابهُما فرْخُ الْبغيّ ف أصْبحا
|
|
أحاديث منْ يسْري بكُلّ سبيل
|
ترى جسدا قدْ غيّر الْموْتُ لوْنهُ
|
|
ونضحُ دمٍ قدْ سال كُلُّ مسيل
|
فتىً كان أحْيى منْ فتاةٍ حييّةٍ
|
|
و أقْطع منْ ذى شفْرتيْن صقيل
|
أيرْكبُ أسْمأُ الْهماليج آمنا
|
|
وقدْ طلبْتهُ مذْحجُ بذُحُول
|
تطُوفُ حواليه مُرادٌ وكُلُّهُم
|
|
على رقْبةٍ منْ سائلٍ ومسُول
|
فإنْ أنْتُمْ لمْ تث أرُوا ب أخيكُم
|
|
فكُونُوا بغايا أُرْضيتْ بقليل
|
“
অর্থাৎ যদি মৃত্যু কি তা না চেন , কুফার বাজারে মুসলিম এবং হানিকে দেখ। সেই বীরপুরুষ যার চেহারাকে তরবারী ক্ষ-বিক্ষত করেছে। অপর বীরপুরুষকে হত্যার পর ছাদের উপর থেকে নীচে ফেলে দেয়া হয়েছে। নাপাক ইবনে যিয়াদ তাদের হত্যা করেছে। পরের দিনই মানুষের মুখে মুখে বর্ণিত হয়েছে সে নির্মম হত্যাকাণ্ড। দেখবে এমন লোককে-মৃত্যু যার রঙ বদলে দিয়েছে। পথে পথে তার রক্ষ প্রবাহিত হয়েছে। সে বীরপুরুষের একজন নারীদের চাইতেও লাজুক আর দ্বিতীয়জন ধারালো তরবারীর চাইতেও ক্ষুরধার। আসমা ইবনে হারেছা যে হানিকে ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে গেল , সে কি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে পারবে এবং নিহত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে ? অথচ মাসহাজ গোত্র তার কাছ থেকে হানির রক্তের বদলা নিতে বদ্ধপরিকর। এ সময় মুরাদ গোত্র হানির চারদিকে ঘুরছিল এবং পরস্পর থেকে তার অবস্থা জিজ্ঞেস করছিল-তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। হে মুরাদ গোত্র। তোমরা যেখানেই থাক , যদি তোমাদের ভাই হানির রক্তের প্রতিশোধ না নাও তাহলে তোমরা সেই ভবঘুরে মেয়েদের মতই হবে-যারা অল্প পয়সায় রাজি হয়ে যায়। ”
ইবনে য়িয়াদ মুসলিম ইবনে আকিল ও হানি ইবনে ওরওয়াকে শহীদ করার খবর জানিয়ে ইয়াজিদকে চিঠি লিখল । কয়েক দিন পর পত্রের জবাব আসল । ইয়াজিদ তার কাজের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখল- শুনেছি যে , হোসাইন কুফার দিকে আসছে । কিন্তু এ সময় তোমাকে ধরপাকর করতে হবে । প্রতিশোধ নিতে হবে । কারো বিরোধিতার আশংকা ও আলামত দেখা দিলে সাথে সাথে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ কর ।
হযরত হোসাইনের ইরাক অভিমুখে যাত্রা
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) হিজরী ৬০ সালের জিলহজ্বের ৩ তারিখ মঙ্গলবার বর্ণনান্তরে ৮ই জিলহজ্ব বুধবার মুসলিমের মৃত্যূর খবর পাওয়ার আগেই মক্কা থেকে বের হন। কারণ , তিনি যেদিন মক্কাত্যাগ করেন সেদিনই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় শহীদ করা হয় । বর্ণিত আছে , হোসাইন (আ.) ইরাকের উদ্দেশ্য যাত্রা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর জন সমাবেশে দাড়িয়ে বলেন-
ألْحمْدُ للّه ما ش أ اللّهُ ولا قُوّة إلاّ باللّه و صلّى اللّهُ على رسُوله وسلّم. خُطّ الْموْتُ على وُلْد آدم مخطّ الْقلادة على جيْد الْفتاة، وما أوْلهنى إلى أسْلا فى إشْتياق يعْقُوب إلى يُوسُف و خيْر لى مصْرعٌ أنا لاقيه، ك أنّى ب أوْصالى تقطّعُها عُسْلانُ الْفلوات بيْن النّواويس و كرْبل أ، فيمْلانّ منّى أكْراشا جُوّفا و أجْربةً سغْبا، لا محيص عنْ يوْم خُطّ بالْقلم. رضى اللّه رضانا أهْل الْبيْت، نصْبرُ على بلائه ويُوفّينا أجْر الصّابرين، لنْ تشُذّ عنْ رسُول اللّه صلّى اللّه عليه و آله لحْمتُهُ، وهي مجْمُوعةٌ لهُ في حظيرة الْقُدْس، تقرُّ بهمْ عيْنُهُ ويُنْجزُ بهمْ وعْدُهُ، منْ كان باذلا فينا مُهْجتهُ ومُوطّنا على لق أ اللّه نفْسهُ فلْيرْحلْ معنا، فإنّنى راحلٌ مُصْبحا إنْ ش أ اللّهُ تعالى
“ মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলে খোদার প্রতি দরুদ । এরপর তিনি ফরমান , মহান আল্লাহ আদম (আ.) এর সন্তানদের উপর মৃত্যূর দাগ একে দিয়েছেন , যা তাদের জন্য সৌন্দর্য , যেমন যুবতীদের গলায় হারের দাগ (সৌন্দর্য) একে দেয় । আমি আমার পূর্ব পূরুষদের দেখার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি । যেমনি ভাবে হযরত ইউসুফকে দেখার জন্য হযরত উয়াকুব উদগ্রীব ছিলেন । আমার নিহত হওয়ার জন্য একটি ভূখণ্ড নির্ধারিত রয়েছে যেখানে আমি গিয়ে পৌছব। আমি বোধ হয় দেখতে পাচ্ছি যে , মরুভূমির নেকড়েরা নাওয়ামীস ও কারবালার মধ্যবর্তী স্থানে আমার দেহকে টুকরা টুকরা করছে , যাতে তাদের ক্ষুধার্ত পেটগুলোকে সান্তনা দেয় । সত্যিই ভাগ্যের লিখন থেকে পালানো যায়না । মহান আল্লাহ যাতে খুশী আমাদের পরিবারও তাতে খুশী । আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বালা মুসিবত আসে তাতে আমরা ধৈর্য ধারণ করব। তিনি ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করবেন আমরা যে পয়গম্বরে খোদার (সা.)দেহেরই অংশ । আমরা রাসূলে পাক (সা.) থেকে কোন আবস্থাতেই পৃথক হব না । বেহেশতে তার সাথেই থাকব । এভাবেই তার সন্তুষ্টির ভাগী হওয়া যাবে আর আল্লাহ তার রাসূল (সা.) কে যে ওয়াদা দিয়েছেন তা পূর্ণ হবে । যারা আমাদের সাথে জানকে বাজী রেখে লড়তে প্রস্তুত এবং শাহাদত বরণ ও আল্লাহর সাথে মুলাকাতের জন্য উদগ্রীব তারা আমাদের সাথে আসুন , আল্লাহর সাহায্যে আগমীকাল আমরা মক্কা থেকে বের হয়ে যাব । ”
বর্ণিত আছে , আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জাবীর তাবারী ইমামী তার‘
দালায়েলুল ইমামাহ ’ গ্রন্থে নিজস্ব বর্ণনা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে , আবু মুহাম্মদ ওয়াকেদী ও যারারা ইবনে খালাজ বলেছেন যে , হোসাইন (আ.) ইরাকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে আমরা তার সাথে সাক্ষাত করে কুফাবাসীর অবহেলা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি । তাকে আমরা বলেছি যে , কুফাবাসীর অন্তরসমূহ আপনার সাথে কিন্তু তাদের তরবারীগুলো আপনাকে হত্যার জন্য প্রস্তুত । এ কথা শুনে হোসাইন (আ.) হাত তুলে আকাশের দিকে ইশারা করেন । আসমানের দরজাগুলো খুলে গেল এবং অগনিত ফেরেশতা নাজিল হল-যাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । অতঃপর তিনি বললেন , আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর যদি এমন না হত যে , আমার দেহ কারবালা প্রান্তরের নিকটবর্তী হবে , যদি সওয়াব হাতছাড়া হওয়ার ভয় না করতাম তাহলে এই শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে তাদের সাথে লড়াই করতাম । কিন্ত আমি নিশ্চিত যে , আমার ছেলে আলী ছাড়া আমি এবং আমার সকল সঙ্গীদের নিহত হওয়ার স্থান ওখানেই নির্ধারিত ।
মুতায়াম্মার ইবনে মুসান্না মাকতালুল হোসাইন নামক কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে , তালবিয়ার দিনগুলো আসার সাথে সাথে আমর ইবনে সাআদ ইবনে আস বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কায় উপনীত হয় । ইয়াজিদের পক্ষ থেকে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় যে , সম্ভব হলে হোসাইনকে যেন হত্যা করে , যদি যুদ্ধ করতে হয় তার সাথে যুদ্ধ করবে । কিন্ত ঐ দিনই ইমাম হোসাইন মক্কা থেকে বেরিয়ে হয়ে যান ।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) হতে বর্ণিত মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া সেই এক রাতে হযরত হোসাইনের খেদমতে উপস্থিত হন , যার পরের দিনই সেখানেই তার যাত্রা করার কথা ছিল । তিনি বললেন- ভাইজান , আপনি জানেন যে , কুফাবাসী আপনার পিতা ও ভাইয়ের সাথে প্রতারণা করেছে । আমি আশংকা করছি তারা আপনার সাথেও প্রতারণা করবে । যদি ভাল মনে করেন মক্কায় থাকুন , কেননা আপনি আতি প্রিয় ও সম্মানিত ব্যাক্তি । তিনি বললেন – আমার ভয় হচ্ছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া অতর্কিতে আল্লাহর ঘর হেরেমে এসে আমাকে হত্যা করবে এবং এর ফলে আমার দ্বারা আল্লাহর ঘরের মানহানি হবে । মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া বললেন – আপনার যদি এই আশংকা হয় , তাহলে ইয়ামেনের দিকে গমন করুন । কেননা সেখানে আপনি সম্মানিত হবেন । ইয়াজিদও আপনার নাগাল পাবে না । অথবা মরুভূমির কোথাও গিয়ে বসবাস করুন । বললেন-তোমার এই প্রস্তাব আমি চিন্তা করে দেখব ।