তৃতীয় অধ্যায়
কুফা ও সিরিয়ার উদ্দেশ্যে নবী বংশের বন্দীদের যাত্রা
উমর ইবনে সা’
দ ইমাম হোসাইন (আ.) এর পবিত্র মাথা খওলা ইবনে ইয়াযীদ আসহাবী এবং হামীদ ইবনে মুসলিম আযদীর মাধ্যমে আশুরার দিন বিকেল বেলা ইবনে যিয়াদের কাছে প্রেরণ করে। এরপর উমর ইবনে সা’
দের আদেশে ইমাম হোসাইন (আ.) এর সঙ্গী-সাথী ও বনী হাশিমের নিহত যুবকদের লাশের মাথা কেটে শিমার ইবনে জুল জওশন , কায়স ইবনে আশ্আস্ এবং আমর বিন হাজ্জাজের কাছে কুফায় পাঠানো হয়। ঐ সব কর্তিত মাথা ইবনে যিয়াদের কাছে আনা হয়। উমর ইবনে সা’
দ আশুরার দিন এবং পরের দিন (১১ মুহররম) দুপুর পর্যন্ত কারবালায় থেকে গেল। তারপর সে ইমাম পরিবারের বন্দী সদস্যদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হল। ইমাম পরিবারের মহিলাদেরকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় খোলা মাথায় এবং হাওদা বিহীন উঠের উপর বসান হয়েছিল। অথচ এ সব পূণ্যবতী মহিলা ছিলেন মহান নবীর পবিত্র আমানত। আর তাদেরকেই তুর্কী ও রোমের যুদ্ধবন্দীদের মত সবচেয়ে কঠিন দুরবস্থা , শোক ও বেদনার মধ্য দিয়ে বন্দীত্বের শিকল পড়ানো হয়েছিল।
কবি এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ
یصلی علی المبعوث من ال هاشم
|
|
ویغزی بنوه إن ذا لعجیب
|
হাশেমী বংশোদ্ভূত নবীর (সা.) উপর তারা (নবী বংশের হত্যাকারীরা) দরুদ ও সালাম পাঠ করে। আর তারাই তার (সা.) বংশধরদের সাথে যুদ্ধ করে। সত্যিই এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।
اترجو امة قتلت حسینا
|
|
شفاعة جده یوم الحساب
|
যারা হোসাইনকে (আ.) শহীদ করেছে তারা কি করে কিয়ামত দিবসে তার মাতামহের (সা.) শাফায়াতের প্রত্যাশা করে ?
বর্ণিত আছে যে , ইমাম হোসাইন (আ.)এর সঙ্গী-সাথীদের কর্তিত মাথার সংখ্যা ছিল ৭৮। আর যে সব গোত্র কারবালায় ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল তারা ইবনে যিয়াদ ও ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করার জন্য ঐসব কর্তিত মাথা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। কায়স ইবনে আশআসের নেতৃত্বে কিন্দা গোত্র ১৩ টি মাথা , শিমার ইবনে জুল জওশনের নেতৃত্বে হাওয়াযিন গোত্র ১২টি মাথা , বনী তামীম গোত্র ১৭ টি মাথা , বনী আসাদ গোত্র ১৬টি মাথা , বনী মুযহাজ গোত্র ৭ টি মাথা এবং আরো অন্যান্য গোত্র ১৩ টি মাথা কুফায় নিয়ে আসে।
শহীদদের দাফন এবং কুফায় বন্দী আগমন
রাবী থেকে বর্ণিতঃ উমর ইবনে সাদ কারবালা থেকে বেরিয়ে গেলেই বনী আসাদ গোত্রের একদল ব্যক্তি কারবালায় এসে শহীদদের জানাযার নামায পড়ে এবং যে স্থানগুলো এখন শহীদদের কবর হিসেবে প্রসিদ্ধ সেখানেই তারা শহীদদের লাশগুলো দাফন করে। ইবনে সা’
দ বন্দী নবী পরিবারের সাথে আগমন করে। আর তারা কুফার নিকটবর্তী হওয়া মাত্রই কুফাবাসীরা তাদেরকে দেখার জন্য সেখানে সমবেত হয়। কুফা নগরীর এক মহিলা ছাদ থেকে উচ্চঃস্বরে জিজ্ঞেস করলঃ "من ای الاساری أنتنّ
" তোমরা কোন দেশের বন্দী রমণী ? নবী পরিবারের বন্দী রমণীগণ তাকে বললেন- "نحن أساری ال محمد
" আমরা নবী পরিবারের বন্দী রমণী। ঐ মহিলা ছাদ থেকে নেমে এসে ঘর থেকে পোশাক পরিচ্ছদ , মাথার চাদর ওড়না এনে তাদেরকে দিল । অসুস্থ , কৃশকায় এবং শোকাভিভূত আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) এবং ইমাম হাসান (আ.)এর পুত্র দ্বিতীয় হাসান যিনি পিতৃব্য ইমাম হোসাইন (আ.) কে সাহায্যার্থে কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আহত হয়েছিলেন তিনিও যুদ্ধ বন্দীদের মাঝে ছিলেন। মাসাবিহ গ্রন্থের লেখক বর্ণনা করেছেনঃ ইমাম হাসান (আ.) এর পুত্র দ্বিতীয় হাসান শত্রুপক্ষের ১৭ জনকে হত্যা করেন এবং তার দেহ আঠারো বার জখম হলে তিনি অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে পড়ে যান। তার মামা আসমা বিন খারেজাহ তাকে মাটি থেকে তুলে কুফায় নিয়ে চিকিৎসা করেন। সুস্থ হয়ে গেলে দ্বিতীয় হাসান মদীনায় ফিরে আসেন। যায়দ এবং আমরের বন্দীদের মধ্যে ইমাম হাসান মুজতাবার সন্তানগণও ছিলেন। এরপর কুফাবাসীরা কান্না কাটির উদ্যোগ নিলে ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন।
اتنوحون و تبکون من أجلنا؟ فمن ذا الذی قتلنا ؟
“
তোমরা আমাদের জন্য কাদতে চাও ? তাহলে কে আমাদেরকে হত্যা করেছে”
হযরত যয়নাবের (আ.) ভাষণ
বশীর বিন হাযীম আল-আসাদী থেকে বর্ণিত খোদার শপথ , আমি আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীর (আ.) কন্যা হযরত যয়নাবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বক্তা রমণীকে আর দেখিনি। যেন তার কন্ঠ দিয়ে হযরত আলী (আ.) এর বাণীগুলো নিঃসৃত হচ্ছিল।
و قدْ أوْم أتْ الى النّاس أن اسْكُتُوا، فارْتدّت الانْفاسُ و سكنت الاجْراسُ
তিনি উপস্থিত জনতাকে নীরবতা অবলম্বন করতে বললে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন স্তিমিত হয়ে গেল। এমন কি উটের ঘন্টাধ্বনিও আর শোনা গেল না। এরপর হযরত যয়নাব (আ.) নিম্নোক্ত ভাষণ দিলেন ,
ثُمّ قالتْ: ألْحمْدُ للّه، و الصّلاةُ على جدّى مُحمّدٍ و آله الطّيّبين الاخْيار. أمّا بعْدُ: يا أهْل الْكُوفة، يا أهْل الْختْل و الْغدْر، أتبْكُون؟! فلا رق أت الدّمْعةُ، و لا هد أت الرّنّةُ، انّما مثلُكُمْ كمثل الّتى نقضتْ غزْلها منْ بعْد قُوّةٍ أنْكاثا، تتّخذون أيْمانكُمْ دخلا بيْنكُمْ. ألا و هْلْ فيكُمْ الا الصّلفُ و النّطفُ، والصّدْرُ الشّنفُ، و ملقُ الام أ، و غمْزُ الاعْد أ؟! أوْ كمرْعى على دمْنةٍ. أوْ كفضّةٍ على ملْحُودةٍ، ألا س أ ما قدّمْتُمْ ل أنْفُسكُمْ أنْ سخط اللّهُ عليْكُمْ و فى الْعذاب أنْتُمْ خالدوُن. أتبْكُون و تنْتحبون؟! ايْ و اللّه فابْكُوا كثيرا، واضْحكُوا قليلا. فلقدْ ذهبْتُمْ بعارها و شنارها، و لنْ ترْحضُوها بغسْلٍ بعْدها أبدا. و أنّى ترْحضُون قتْل سليل خاتم النُّبُوّة، و معْدن الرّسالة، و سيّد شباب أهْل الْجنّة، و ملاذ خيرتكُمْ، و مفْزع نازلتكُمْ، و منار حُجّتكُمْ، و مدْرة سُنّتكُمْ. ألا س أ ما تزرون، و بُعْدا لكُمْ و سُحْقا، فلقدْ خاب السّعْيُّ، و تبّت، الايْدي، و خسرت الصّفْقةُ، و بُؤْتُمْ بغضبٍ من اللّه، و ضُربتْ عليْكُمُ الذّلّةُ والْمسْكنةُ. ويْلكُمْ يا أهْل الْكُوفة، أتدْرُون أيّ كبدٍ لرسُول اللّه فريْتُمْ؟! و أيّ كريمةٍ لهُ أبْرزْتُمْ؟! و أيّ دمٍ لهُ سفكْتُمْ؟! و أيّ حُرْمةٍ لهُ انْتهكْتُمْ؟! لقدْ جئْتُمْ بها صلْع أ عنْق أ سوْد أ فقُم أ. و فى بعْضها: خرْق أ شوْه أ، كطلاع الارْض و مل أ السّم أ. أفعجبْتُمْ أنْ مطرت السّمأُ دما، و لعذابُ الاخرة أخْزى و أنْتُمْ لا تُنْصرُون، فلا يسْتخفّنّكُمْ الْمهْلُ، ف أنّهُ لا يحْفُزُهُ البدارُ و لا يخافُ فوْت الثّار، و انّ ربّكُمْ لبالْمرْصاد
মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার পবিত্র বংশধরদের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করার পর তিনি বললেন ,“
হে কুফাবাসীরা .হে প্রতারক ও চক্রান্তকারীরা , তোমরা কি এখন আমাদের জন্য কাদছ ? এখনো আমাদের নয়ন অশ্রু দ্বারা সিক্ত , এখনো আমাদের কান্না থামেনি। তোমরা ঐ রমণীর ন্যায় যে সূতা দিয়ে সুন্দর করে কাপড় বোনার পর আবার সেই কাপড় থেকে সূতাগুলো আলাদা করে ফেলে। তোমরা তোমাদের ঈমানের রজ্জুকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছ। আত্মপ্রশংসা , বিশৃংখলা এবং দাসীদের মত হিংসা দ্বেষ , চাটুকারিতা এবং উপেক্ষা করার মত দোষ ছাড়া আর কোন ভাল গুনই তোমাদের নেই। তেমার পচা আবর্জনার ভেতরে জন্মানো উদ্ভিদের ন্যায় , যা খাওয়ার অযোগ্য।
আর তোমারা সৌন্দর্য বিবর্জিত ও অব্যাবহার্য রূপার মত। তোমরা পরকালের জন্য কত মন্দ পাথেয়ই না সংগ্রহ করেছ যার ফলে তোমরা খোদার রোষানলে আপতিত হয়েছ এবং তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থ্ করা হয়েছে। আমাদেরকে হত্যা করার পর কি তোমরা আমাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করছো এবং নিজেদেরকে ধিক্কার দিচ্ছো ? খোদার শপথ তোমরা বেশী বেশী কাদবে এবং কম হাসবে। নিশ্চয় তোমরাইতো নিজেদেরকে কালের কলংকে কলংকিত ও কলুষিত করেছ যা থেকে তোমরা কখনো পরিত্রাণ পাবেনা। বেহেশতের যুবকদের নেতা নবী দৌহিত্র যিনি ছিলেন যুদ্ধ ও সংকটজনক পরিস্থিতিতে তোমাদের আশ্রয়স্থল , যিনি ছিলেন শত্রুদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তোমাদের নেতা যার কাছে তোমরা ধর্ম ও শরীয়তের বিধি বিধানের শিক্ষা নিতে , তাকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে সম্ভব ? জেনে রেখো যে , তোমরা কত বড় পাপের বোঝা বহন করছ। খোদা তোমাদেরকে তার দয়া ও করুনা থেকে বঞ্চিত করুক । তোমাদের ধ্বংস হোক। নিঃসন্দেহে তোমাদের শ্রম বিফল হয়েছে এবং তোমাদের হাত পাপ দ্বারা কলুষিত হয়ে গেছে। আর তোমাদের পাপের ব্যবসা তোমাদের জন্য ক্ষতিই ডেকে এনেছে। নিশ্চয়ই তোমরা খোদার রোষানলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছ। অপমান লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা তোমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। হে কুফাবাসীরা! তোমাদের জন্য আক্ষেপ। তোমরা জান কি যে , তোমারা মহানবীর (সা.) কত বড় কলিজার টুকরা ছিন্ন ভিন্ন করেছ। তোমারা জান কি যে , তোমারা তার নিস্পাপ পর্দাবৃতা কন্যা ও রমণীদের পর্দা ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেআব্রু করেছ ! ! তেমারা জান কি , মহানবীর (সা.) কত বড় রক্ত তোমরা ঝরিয়েছ এবং তার কত বড় বেইজ্জতি তোমরা করেছ। তোমরা জান কি যে , কত বড় জঘন্য অন্যায় করেছ এবং আকাশ ও পৃথিবীর সমান অত্যাচার ও জুলুম করেছ। নিঃসন্দেহে পরকালের শাস্তি সবচেয়ে কঠিন ও অপমানজনক আর কিয়ামত দিবসে তেমাদের কোন সাহায্যকারীই থাকবে না। মহান আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগ যেন তোমাদের কোন কাজে না আসে এবং তোমাদের পাপের বোঝাও যেন না কমে । কারণ তিনি (মহান আল্লাহ) তাড়াহুড়া করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না এবং শহীদের রক্ত বৃথা যাওয়ার কোন আশংকা নেই। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই তোমাদের ধরার অপেক্ষায় আছেন।
انّ ربّکم لبالمرصاد
বর্ণনাকারী বলেনঃ খোদার শপথ এ বক্তৃতাটি শোনার পর জনগণ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে কাদতে লাগল এবং নিজেদের আঙ্গুলগুলো দাত দিয়ে দংশন করতে লাগল । যে বৃদ্ধ লোকটি আমার পাশে দাড়িয়ে ছিল এবং যার দাড়ি চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল সে বলতে লাগল , আমার পিতা মাতা আপনাদের চরণতলে উৎসর্গ হোক। আপনাদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ তারা বৃদ্ধদের মধ্যে সর্বোত্তম , আপনাদের যুবকরাই সর্বোত্তম যুবক এবং আপনাদের রমণীরাই সর্বশ্রেষ্ঠ নারী এবং আপনাদের বংশই সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ যারা কস্মিনকালেও লাঞ্ছিত ও পর্যদস্ত হবে না ।
ফাতেমা বিনতে হোসাইনের ভাষণ
যায়দ বিন মুসা বিন জাফর থেকে বর্ণিতঃ ইমাম হোসাইন তনয়া ফাতেমা সুগরা কারবালা থেকে কুফায় আগমন করার পর এ ভাষণটি দিয়েছিলেনঃ-
الحمد لله عدد الرمل و الحصی وزنة العرش الی الشّری احمده و اومن به و اتوکل علیه
বালুকণা ও পাথরের সংখ্যা যেমন অগণিত ও অননুমেয় তদ্রুপ মর্ত্যলোকে যা কিছু আছে সেগুলো সহ আরশ পর্যন্ত যা কিছু আছে সে গুলোর ওজনের পরিমাণ মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। তার উপর বিশ্বাস স্থাপন ও ভরসা করছি। আর সাক্ষ দিচ্ছি যে মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় । তার কোন শরীক বা অংশীদার নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও প্রেরিত পুরুষ। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , হযরত মুহাম্মদের (সা.) বংশধরদেরকে শরীয়তসিদ্ধ বৈধ কোন কারণ ছাড়াই অসহায় অবস্থায় ফোরাত নদীর তীরে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের মস্তক দেহচ্যুত করা হয়েছে। হে মহা প্রভু আল্লাহ তোমার সম্পর্কে মিথ্যারোপ করা ও মিথ্যা বলা থেকে আমি আশ্রয় প্রর্থনা করছি । হে খোদা , নবীর অসি হিসেবে জনগণকে হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের হাতে বায়াত করার প্রদত্ত আদেশ সংক্রান্ত তোমার মহান নবীর (সা.) বাণী সমূহের বিরোধী কোন উক্তিই আমি করব না । হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের ন্যায্য অধিকার জবর দখল করা হয়েছিল। আর তারই সন্তানকে (হোসাইন) কারবালায় একদল লোকের হাতে বিনা দোষে নিহত হতে হয়েছে। আর এসব লোকেরা ছিল বাহ্যতঃ মুসলমান কিন্তু অন্তরে ঠিকই তারা কুফরী পোষণ করত। ঐ সব লোক ধ্বংস হোক যারা হোসাইনের জীবদ্দশায় এবং তার শাহাদতের সময় তাকে জুলুম ও উৎপীড়নের হাত থেকে হেফাযত করেনি। হে খোদা , তুমিতো হোসাইন (আ.) কে মহৎ গুনাবলী ও জ্ঞানের অধিকারী করে অত্যন্ত প্রশংসিত ও পবিত্র অন্তঃকরণ সহকারে তোমার সান্নিধ্যে নিয়ে গেছো । হে খোদা কোন কুৎসা রটনাকারীরই কুৎসা তাকে কস্মিনকালেও তাকে তোমার ইবাদত ও বন্দেগী করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি । তুমি শৈশবে তাকে ইসলামের দিকে পথ প্রদর্শন করেছ এবং যখন তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন তখন তাকে উত্তম গুণাবলী দিয়ে প্রশংসিত করেছ। তিনি আজীবন তোমার পথে এবং তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মুসলিম উম্মাহকে সদুপদেশ দিয়েছেন। তিনি ইহকালের প্রতি নিরাসক্ত এবং পরকালের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। আর তিনি তোমার পথে তোমার শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম ও জিহাদ করেছেন। হে খোদা! তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছ , তাকে তুমি মনোনীত করেছ এবং সঠিক পথে তাকে পরিচালিত করেছ।
أمّا بعْدُ، يا أهْل الكُوفة، يا أهْل الْمكْر و الْغدْر و الْخيل أ. فإ نّا أهْلُ بيْتٍ ابْتلانا اللّه بكُمْ، و ابْتلاكُمْ بنا، فجعل بل أنا حسنا، و جعل علْمهُ عنْدنا و فهْمهُ لديْنا. فنحْنُ عيْبةُ علْمه و وعأُ فهْمه و حكْمته و حُجّته على أهْل الاْ رْض فى بلاده لعباده. أكْرمنا اللّه بكرامته و فضلّنا بنبيّه مُحمّدٍ ص على كثيرٍ ممّنْ خلق تفْضيلا بيّنا. فكذّبْتُمُونا، و كفّرْتُمُونا. و ر أيْتُمْ قتالنا حلالا و أمْوالنا نهْبا. ك أنّنا أوْلادُ تُرْكٍ و كإ بُل كما قتلْتُمْ جدّنا بالاْْمس، و سُيُوفُكُم تقْطُرُ منْ دمائنا أهْل الْبيْت
হে কুফাবাসীরা! হে ষড়যন্ত্রকারী ও ধোকাবাজরা , সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদেরকে দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করেছেন। আর তিনি আমাদেরকে এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশংসিত করেছেন। তিনি তার জ্ঞান ও বিদ্যাকে আমানতস্বরূপ আমাদেরকে প্রদান করেছেন। তাই আমরাই তার জ্ঞান , বিদ্যা ও প্রজ্ঞার আধার। আমরাই সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহর সঠিক প্রমাণ বা হুজ্জাত। মহান আল্লাহ আমাদের মাঝেই মহানবী (সা.) কে প্রেরণ করে আমাদেরকে সবার উপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং উচ্চ মর্য়াদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর তোমরা আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছ ও কুফরীর অপবাদ দিয়েছ তোমরা আমাদের রক্ত ঝরানো এবং আমাদের সম্পদ লুন্ঠন করা বৈধ করেছ। আমরা যেন বিধর্মী অমুসলিম তুর্কী ও কাবুলী যুদ্ধবন্দী। যেমনিভাবে গতকাল তোমরা আমাদের পিতামহের রক্ত ঝরিয়েছ ঠিক তেমনি তোমাদের অন্তরে আমাদের প্রতি তোমাদের পুরানো শত্রুতা থাকার কারণে আজও তোমাদের তলোয়ার থেকে আমাদের (আহলে বাইতের) রক্ত ঝরছে।
তোমরা খোদার সম্পর্কে যে মিথ্যারোপ করেছ এবং যে ষড়যন্ত্রে তোমরা লিপ্ত হয়েছ সে জন্য তেমার খুব স্ফুর্তি ও আনন্দ উল্লাস করছ। তবে জেনে রেখো যে , মহান আল্লাহ সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রকারী। তাই তোমরা আমাদের রক্ত ঝরাবে এবং আমাদের সম্পদ লুন্ঠন করতে পেরে আর অধিক আনন্দিত হয়ো না। কারণ এসব বিপদাপদ পূর্ব থেকেই আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ ছিল। আর এটা তার জন্য অত্যন্ত সহজ। যাতে করে তোমরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে হতাশ ও মনঃক্ষুন্ন না হও এবং লাভ ও মুনাফা অর্জন করতে পেরে অযথা উল্লাসিত না হও। কারণ মহান আল্লাহ চক্রান্তকারী ও উদ্ধতদেরকে পছন্দ করেন না।
হে কুফাবাসীরা , তোমাদের ধ্বংস হোক। তোমরা খোদার অভিশাপ ও শাস্তির অপেক্ষা করতে থাক যা অতি শীঘ্রই একের পর এক তোমাদের উপর অবতীর্ণ হবে এবং নিজেদের কু-কর্মের জন্য তোমরা সাজা প্রাপ্ত হবে। মহান আল্লাহ তোমাদেরকে পারস্পরিক কলহ , বিবাদ , দ্বন্দ-সংঘাতে লিপ্ত করে তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর এরপর আমাদের প্রতি যে অন্যায় ও জুলুম করেছ সে জন্য তোমরা কিয়ামত দিবসে চিরস্থায়ী নরকের মহাযন্ত্রনাদায়ক আগুনে দগ্ধ হওয়ার শাস্তি অবশ্যই পাবে। মনে রেখো , অত্যাচারী গোষ্ঠির উপর মহান আল্লাহর অভিশাপ।
الا لعنة الله علی القوم الظالمین
হে কুফাবাসীগণ , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তোমরা কি জান , কোন হাতে আমাদেরকে তীর ধনুক ও তরবারী আক্রমণের শিকার করেছ , তোমরা কোন সাহসে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছ ? খোদার শপথ তোমাদের অন্তর পাষাণ এবং বিবেক বুদ্ধি বিবর্জিত , তোমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে। হে কুফাবাসীরা , শয়তান তোমাদেরকে ধোকা দিয়েছে , তোমাদেরকে সৎ পথ থেকে বিচ্যুত করেছে এবং তোমাদের চোখের উপর অজ্ঞতার আচ্ছাদন টেনে দিয়েছে যার ফলে তোমরা কখনো সুপথ প্রাপ্ত হবে না। হে কুফাবাসীগণ , তোমাদের ধ্বংস হোক। তোমরা জান কি যে তোমাদের কাধে মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধদের রক্ত ঝরানোর পাপ রয়েছে এবং তোমাদের থেকে সে রক্তের প্রতিশোধ অবশ্যই গ্রহণ করা হবে ?
তোমরা মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর ভ্রাতা হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.) ও তার বংশধরদের সাথে যে শত্রুতা করেছ সে জন্য তোমাদের মধ্য থেকে কেউ দম্ভোক্তি করে বলেছঃ
نحن قتلنا علیها و بنی علی
|
|
بسیوف هندیة و رماح
|
وسبینا نسائهم سبی ترک
|
|
ونطحناهم فایّ نطاح
|
“
আমারা ভারতে নির্মিত তরবারী ও বর্শা দিয়ে আলী ও তার বংশধরদেরকে হত্যা করেছি। আমরা তার বংশীয়া মহিলাদেরকে বিধর্মী তুর্কী যুদ্ধবন্দীদের মত বন্দী করেছি। ” ঐ সব পুণ্যাত্মা যাদেরকে মহান আল্লাহ সব ধরনের পাপ-পংকিলতা থেকে পবিত্র করে দিয়েছেন তাদেরকে হত্যা করে যে ব্যক্তি গর্ব ও আনন্দ উল্লাস করছে তার মুখে (কলংকের) প্রস্তর ও ধুলো নিক্ষিপ্ত-প্রক্ষিপ্ত হোক। হে অপবিত্র ব্যক্তি তুই তোর ক্রোধাগ্নি গলাধঃকরণ কর আর তোর পিতা যেমনিভাবে বসেছিল তদ্রুপ কুকুরের মত তোর আপন জায়গায় বসে পড়। যে ব্যক্তি যেমন কর্ম করবে তেমন প্রতিফলও সে প্রাপ্ত হবে। তোমাদের জন্য আক্ষেপ. মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে জন্য সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আমাদের সাথে হিংসা করছ বলে।
فما ذنبنا إن جاش دهرا بحورنا
|
|
وبحرک ساج ما یواری الدعا مصا
|
আমাদের বংশের মহৎ গুণাবলী যদি কালজয়ী হয় তাহলে কি এতে আমাদের অপরাধ হবে অথচ তোমাদের পাপ ও কুকীর্তিসমূহ ইচ্ছে করলেও তোমরা কখনো গোপন রাখতে পারবে না।
ذلك فضْلُ اللّه يُؤ تيه منْ يشأُ و اللّهُ ذُوالْفضْل الْعظيم و منْ لمْ يجْعل اللّهُ لهُ نُورا فما لهُ منْ نُور
এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে এ অনুগ্রহ দান করেন। কারণ তিনিইতো বিশাল অনুগ্রহের মালিক আর মহান আল্লাহ যাকে (হেদায়তের) আলো দেন না সে কখনোই (হেদায়তের) আলোর সন্ধান পায় না ।
হযরত ফাতেমা সুগরার ভাষণ সমাপ্ত হলে উপস্থিত জনতা উচ্চস্বরে কাদতে কাদতে বললঃ হে পুণ্যাত্মাদের বংশধর। আপনি আমাদের অন্তরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। আমাদের কলিজাকে আপনি শোক দুঃখ আর বেদনা অনলে ভস্মীভূত করেছেন। আপনি থামুন আর বলবেন না। অতঃপর হযরত ফাতেমা সুগরা কথা বলা বন্ধ করলেন ।
হযরত উম্মে কুলসুমের ভাষণ
বর্ণনাকারী বলেনঃ হযরত আলী (আ.) এর কন্যা উম্মে কুলসুম (আ.) উচ্চস্বরে ক্রন্দনরত ও হাওদার উপর উপবিষ্টাবস্থায় ঐ দিন এ ভাষণটি দেনঃ
فقالتْ: يا أهْل الْكُوفة، سُوْءا لكُمْ، ما لكُمْ خذلْتُمْ حُسيْنا و قتلْتُمُوُهُ و انْتهبْتُمْ أمْوالهُ و ورثْتُمُوهُ و سبيْتُمْ نس أهُ و نكبْتُمُوهُ؟! فتبّا لكُمْ و سُحْقا. ويْلكُمْ، أتدْرون أيُّ دواةٍ دهتْكُمْ؟ و أيّ وزْرٍ على ظُهُوركُمْ حملْتُمْ؟ و أيّ دم أ سفكْتُمُوها؟ قتلْتُمْ خيْر رجالاتٍ بعْد النّبيّ ص ، و نُزعت الرّحْمةُ منْ قُلُوبكُمْ ألا انّ حُزْب اللّه هُمُ الغالبُون و حزْبُ الشيْطان هُمُ الْخاسرُون
হে কুফাবাসীগণ , তোমাদের অবস্থা কতই খারাপ। তোমারা কেন হোসাইন (আ.) কে অপদস্ত ও হত্যা করেছ ? কেন তার সম্পদ লুন্ঠন করেছ ? কেন তার স্ত্রী-কন্যাদেরকে বন্দী করেছ ? এতসব করে এখন তার জন্য কাদছো ? তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তোমাদের ধ্বংস ও অমঙ্গল হোক। তোমরা কি জান যে তোমরা কত বড় পাপ করেছ ? তেমরা কি জান তোমরা অন্যায় ভাবে কি ধরণের রক্ত ঝরিয়েছ ? তোমরা জান কি কোন ধরনের অন্তঃপুর বাসিনীদেরকে তোমরা পর্দার অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে বের করে এনেছ ? তোমরা জান কি তোমরা কোন পরিবারের অলংকারসমূহ বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছ এবং কাদের সম্পদ লুন্ঠন করেছ ? আর তোমরা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছ মহানবীর (সা.) পর যার মান মর্যাদার অধিকারী কেউ নেই ? তোমাদের অন্তর থেকে দয়া মায়া তুলে নেয়া হয়েছে । জেনে রেখো যে আল্লাহর দলই সফলকাম এবং শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্থ। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করলেন–
قتلْتُمْ أخى صبْرا فويْلٌ لامّكُمُ
|
|
ستُجْزوْن نارا حرُّها يتوقّدُ
|
سفكْتُمْ دم أ حرّم اللّهُ سفْكها
|
|
و حرّمها الْقُرآنُ ثُمّ مُحمّدُ
|
ألا ف أبْشروا بالنّار انّكُمْ غدا
|
|
لفى سقرٍ حقّا يقينا تخلّدُوا
|
و أنّى لابْكى فى حياتى على أخى
|
|
على خيْر منْ بعْد النّبيّ سيُولدُ
|
بدمْعٍ غريزٍ مُسْتهلٍّ مُكفْكفٍ
|
|
على الْخدّ منّى دائما ليْس يُحْمدُ
|
তোমরা আমার ভ্রাতাকে হত্যা করেছ , তোমাদের কাজের জন্য আক্ষেপ ,
তোমরা শীঘ্রই এমন নরকে প্রবেশ করবে যার তাপ দগ্ধ করে দেয় ,
মহান আল্লাহ , পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) যে রক্ত ঝরানো
হারাম করে দিয়েছেন সে রক্তই তোমরা ঝরিয়েছ।
তোমরা একে অপরকে নরকাগ্নির সুসংবাদ দাও
নিশ্চয় তোমরা নরকাগ্নিতে চিরকাল দগ্ধ হবে
মহানবীর (সা.) পরে আমার যে ভ্রাতা মঙ্গলের উপর ছিলেন তার জন্য আমি আমার সারাটা জীবন ক্রন্দন করব।
আমার গন্ডদেশ দিয়ে সর্বদা প্রবাহিত থাকবে অশ্রু যা কখনো শুকাবে না ।
এ সময় জনগণ উচ্চস্বরে কাদছিল। মহিলারা শোকে তাদের কেশমালা এলোমেলো করেছিল এবং মাথায় ধুলো মাটি মেখেছিল। তারা নিজেদের মুখমণ্ডলে আচড় দিচ্ছিল এবং মুখে থাপ্পর মারছিল। তারা উচ্চস্বরে ফরিয়াদ ও‘
ওয়াওয়াইলা ’ বলছিল। পুরুষরা কাদছিল এবং চুল দাড়ি উপড়ে ফেলছিল। ঐদিনের চেয়ে অন্য কোন সময় লোকদের এত অধিক কাদতে দেখা যায়নি।
ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যয়নুল আবেদীনের ভাষণ
হযরত ফাতেমা সুগরার ভাষণ সমাপ্ত হওয়ার পর ইমাম যয়নুল আবেদীন জনগণকে নীরবতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেন । জনতা নীরব হলে তিনি (যয়নুল আবেদীন) দাড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নাম উচ্চারণ করে তার উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করেন। তারপর তিনি বললেনঃ
أيُّها النّاسُ منْ عرفنى فقدْ عرفنى ، و منْ لمْ يعْرفْنى ف أنا أُعرّفُهُ بنفْسى : أنا عليُّ بْنُ الْحُسيْن بْن عليّ بْن أبي طالبٍ. أنا ابْنُ الْمذْبُوح بشطّ الْفُرات منْ غيْر ذحْلٍ و لا تراتٍ. أنا ابْنُ من انْتُهك حريمُهُ و سُلب نعيمُهُ وانْتُهب مالُهُ و سُبى عيالُهُ. أنا ابْنُ منْ قُتل صبْرا و كفى بذلك فخْرا. أيُّها النّاسُ، ناشدْتُكُمُ اللّه هلْ تعْلمُون أنّكُمْ كتبْتُمْ الى أبى و خدعْتُمُوهُ و أعْطيْتُمُوهُ منْ أنْفُسكُمْ الْعهْد والْميثاق والْبيْعة و قاتلْتمُوهُ و خذلْتُمُوهُ؟! فتبّا لما قدّمْتُمْ لانْفُسكُمْ و سوْءا لر أيكُمْ ب أيّة عيْنٍ تنْظُرون الى رسول اللّه ص اذْ يقُولُ لكُمْ: قتلْتُمْ عتْرتى وانْتهكْتُمْ حُرْمتى فلسْتُمْ منْ أُمّتى ؟ !
হে জনতা , যারা আমাকে চিনে তাদের কাছে নতুন করে আমার পরিচিতি তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। আর যার আমাকে চিনে না তাদের কাছে আমি নিজেই আমার পরিচিতি তুলে ধরছি। আমি আলী ইবনুল হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব (আ.) । আমি এমন এক ব্যক্তির সন্তান যার মান সম্ভ্রম পদদলিত করা হয়েছে , যার সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে এবং যার আহলে বাইত (পরিবার পরিজনকে) বন্দী করা হয়েছে। আমি এমন এক ব্যক্তির সন্তান যাকে ফোরাত নদীর তীরে কোন প্রকার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করা ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে । আমি এমন এক ব্যক্তির সন্তান যাকে অনেক কষ্ট ও যাতনা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে । আর এটাই আমার গৌরববোধের জন্য যথেষ্ট। হে লোকসকল , তোমাদের কাছে আল্লাহর শপথ করে বলছি তোমরাইতো আমার পিতার কাছে চিঠির পর চিঠি দিয়েছ। তারপর যখন তিনি তোমাদের কাছে আসলেন তখন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করলে !! তোমরা আমার পিতার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে , তার হাতে বায়াত করেছিলে। আর এগুলো করার পর তোমরাই তাকে হত্যা করলে। তোমরা যে পাথেয় পরকালের জন্য সঞ্চয় করেছ তা ধ্বংস হোক আর তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আকীদা বিশ্বাস কতই না মন্দ। কিয়ামতের দিনে মহানবী (সা.) যখন তোমাদেরকে বলবেন ,“
তোমারা আমার দৌহিত্রকে হত্যা করেছ এবং আমার মান সম্ভ্রম পদদলিত করেছ। তোমরা আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নও। তখন তোমরা তাকে কি জবাব দিবে ? একথাগুলো বলার পর চারিদিকে জনতার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। আর তখন লোকেরা একে অন্যকে বলছিল ,“
তোমার ধ্বংস হয়ে গেছ। তোমরা কি জানতে না ” ? ইমাম যয়নুল আবেদীন বললেন ,
" رحم الله عبدا قبل نصیحتی وحفظ وصیتی فی الله و فی رسوله و اهل بیته فانّ لنا فی رسول الله اسرة حسنة "
“ মহান আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর দয়া করুন যে আমার উপদেশ গ্রহণ করবে এবং মহান আল্লাহ , রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইত সংক্রান্ত আমার নসিহত সংরক্ষণ করবে। কারণ মহানবী (সা.)ই আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। ” তখন জনগণ সমস্বরে বলে উঠলঃ হে নবী (সা.) এর বংশধর , আমরা সবাই আল্লাহর নির্দেশের গোলাম আপনার অনুগত এবং আপনার সাথে যে ওয়াদা করেছি তা রক্ষা করব। কখনোই আমরা আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব না। আপনি যা আদেশ করবেন আমরা তাই করব। যারাই আপনার বিরুদ্ধে লড়বে আমরাও তার বিরুদ্ধে লড়ব। যারা আপনার সাথে সন্ধি করবে আমরাও তাদের সাথে সন্ধি করব। আমরা ইয়াজিদের কাছে ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা চাইব। যারা আপনার উপর জুলুম করেছে তাদের সাথে আমরা সম্পর্কচ্ছেদ করব। উপস্থিত জনতার বক্তব্য শোনার পর ইমাম বললেন ,“
চক্রান্তকারী গাদ্দারেরা দূর হও আমার সামনে থেকে। চক্রান্ত , ষড়যন্ত্র ও দাগাবাজী ছাড়া আর কোন গুণই নেই তোমাদের। আমার পিতার সাথে যে আচরণ করেছ আমার সাথেও সেরূপ আচরণ করতে চাচ্ছ ? মহান আল্লাহর শপথ , এধরনের আচরণ আর তোমাদের দ্বারা করা সম্ভব হবে না। কারণ আমার পিতার আহলে বাইতের ব্যাপারে আমার অন্তরে যে সব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো আরোগ্য লাভ করেনি এবং আমার পিতামহ (মহানবী) , পিতা এবং আমার ভাইদের প্রতি আপতিত বিপদাপদের কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। ঐ সব বিপদের তিক্ত স্মৃতি এখনো আমার অন্তরে জাগরুক থেকে আমার বক্ষদেশকে ভারী ও শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে। আমি তোমাদের কাছে এতটুকুই প্রত্যাশা করছি যে , তোমরা আমাদেরকে সাহায্যও করো না এবং আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইও করো না। এরপর ইমাম যয়নুল আবেদীন আবৃত্তি করলেন।
لا غروان قتل الحسین فشیخه
|
|
قد کان خیرا من حسین و اکرما
|
فلا تقرحو یا اهل کوفان بالذی
|
|
اصیب حسین کان ذالک اعظما
|
قتیل بشط النهر روحی فدائه
|
|
جز أ الذی اراده نار حهنّما
|
অর্থাৎ হোসাইন (আ.) যদি নিহত হয় এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ আলী ইবনে আবু তালিব হোসাইনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়েও নিহত হয়েছেন। হে কুফাবাসীরা হোসাইনের উপর যে সব বিপদ আপতিত হয়েছে তার জন্য তোমরা খুশী হয়ো না। হোসাইন (আ.) এর উপর আপতিত বিপদসমূহ অন্য সব বিপদ অপেক্ষা ভয়ংকর ছিল। ফোরাত নদীর তীরে শহীদ হোসাইনের চরণতলে আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক। হোসাইন (আ.) এর হত্যাকারীদের পুরস্কার হচ্ছে নরকাগ্নি।
ইমাম যয়নুল আবেদীন উপরোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করার পর এ পংক্তিটিও আবৃত্তি করলেন ।
رضینا منکم رأسأ برأس
|
|
فلا یوم لنا ولا علینا
|
অর্থাৎ তোমরা আমাদের সাথে ধোকাবাজীও করনা বা আমাদের বিরুদ্ধেও যেও না । (আমাদেরকে সাহায্যও করো না আর আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণও করো না) এতে করে আমরা তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকব ।
আহলে বাইতের কুফার শাসনকর্তার প্রাসাদে আগমন বর্ণিত আছেঃ
ইবনে যিয়াদ‘
দারুল ইমারাহ ’ বা প্রাসাদে আসন গ্রহণ করল এবং জনতাকে প্রবেশের অনুমতি দিল। ইমাম হোসাইন (আ.) এর পবিত্র মাথা এনে ইবনে যিয়াদের সামনে রাখা হল । ইমামের বন্দী পরিবার পরিজন ও সন্তান সন্ততিদেরকে ইবনে যিয়াদের দরবারে হাজির করা হল । হযরত আলী (আ.) এর কন্যা সভায় প্রবেশ করে এক কোণায় বসে পড়লেন। কেউ তাকে চিনতেও পারলনা। ইবনে যিয়াদ জিজ্ঞেস করল , এ মহিলাটি কে ? তাকে বলা হল , ইনি হযরত আলী (আ.) এর কন্যা যয়নাব (আ.) । ইবনে যিয়াদ হযরত যয়নাব (আ.) কে লক্ষ্য করে বলল ,“
খোদার সমস্ত প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে অপদস্ত করেছেন এবং তোমাদের মিথ্যাবাদিতাকে ফাস করে দিয়েছেন। হযরত যয়ানাব (আ.) বললেন-
انّما يفْتضحُ الْفاسقُ و يكْذبُ الْفاجرُ، و هُو غيْرُنا
“ যারা ফাসেক-লম্পট তারাই অপদস্ত হয় ; লম্পট লোকেরাই মিথ্যা কথা বলে। আর আমরা ফাসেক-ফাজের বা লম্পট নই। ইবনে যিয়াদ তখন তাকে বলল ,“
খোদা তোমার ভাইয়ের সাথে যে আচরণ করেছে সে সম্পর্কে তোমার কি অভিমত ?”
হযরত যয়নাব (সা.আ.) প্রত্যুত্তরে বললেন-
ما رأیت الا جمیلا هول أ قوم کتب الله علیهم القتل فبرزوا الی مضاجعهم
“ তাদের সাথে খোদা যে আচরণ করেছেন সেটা ছিল উত্তম আচরণ। কারণ এদের জন্য মহান আল্লাহ শাহাদতের মর্যাদা লিখে রেখেছিলেন। আর তারা তাদের চিরস্থায়ী বাসস্থানের দিকেই চলে গেছেন। আমি পূণ্য ছাড়া তাদের জন্য আর কিছুই প্রত্যক্ষ করছি না। আর অতিশীঘ্রই মহান আল্লাহ তোকে ও এদেরকে হিসাব কিতাবের জন্য একত্রিত করবেন। আর তখন তারা তোর সাথে ঝগড়া বিবাদ করবে। আর তখনই বুঝতে পারবি কারা পরকালে সফলকাম ও মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। তোর মা তোর জন্য কাদুক হে মারজানার পুত্র। ” একথা শুনে ইবনে যিয়াদ এতই ক্ষুদ্ধ হল যেন সে এক্ষুনি হযরত যয়নাবকে হত্যা করে ফেলবে।
ঐ সভায় উপস্তিত উমর ইবনে হারীস ইবনে যিয়াদকে বলল ,“
এ হলো একজন সামান্য নারী। মহিলাদেরকে তাদের কথায় ধরতে হয়না। অর্থাৎ তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয় না। ” এ কথা শোনার পর ইবনে যিয়াদ যয়নাবকে হত্যা করার অভিপ্রায় ত্যাগ করে। সে হযরত যয়নাবকে লক্ষ্য করে বললঃ হোসাইনকে নিহত করে আল্লাহ আমার প্রাণকে জুড়িয়ে দিয়েছেন। হযরত যয়নাব (আ.) এর প্রত্যুত্তরে বললেন ,“
আমার জীবনের শপথ। আমাদের বয়ঃজ্যেষ্ঠদেরকে তুই হত্যা করেছিস এবং আমার বংশ ও বংশধরদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করেছিস। আর এতে যদি তোর প্রাণ জুড়িয়ে থাকে তাহলে আসলেই তোর প্রাণ জুড়িয়েছে। ” ইবনে যিয়াদ তখন বললঃ“
যয়নাব এমনই একজন মহিলা যে কাব্যিক ছন্দে কথা বলে। আর আমার জীবনের শপথ তার পিতাও একজন কবি ছিলেন। ” ইবনে যিয়াদের এ উক্তি শুনে হযরত যয়নাব (আ.) বললেন.“
হে ইবনে যিয়াদ কবিতা ও কাব্যের সাথে মহিলার কি সম্পর্ক ? এরপর ইবনে যিয়াদ ইমাম যয়নুল আবেদীনকে (আ.) লক্ষ্য করে বলল এ যুবকটি কে ? তাকে বলা হল , ইনি আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) । তখন ইবনে যিয়াদ বলল–
“
আল্লাহ কি তাকে এখনও হত্যা করেনি ?”
ইমাম যয়নুল আবেদীন বললেনঃ“
আলী ইবনুল হোসাইন নামে আমার এক ভাই ছিল লোকেরা তাকে হত্যা করেছে। ” ইবনে যিয়াদ একাথা শুনে বলল“
বরং খোদাই তাকে হত্যা করেছে। ” ইমাম যয়নুল আবেদীন তখন বললেন–
)
للّـهُ يتوفّى الْأنفُس حين موْتها والّتي لمْ تمُتْ في منامها)
আল্লাহই মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়। আর যে সব মানুষ নিদ্রাকালে মৃত্যুবরণ করেনি তাদের প্রাণও হরন করেন।(সূরা যুমারঃ৪৩)
ইবনে য়িয়াদ একথা শোনার পর বলল ,“
আমার কথার জবাব দেয়ার সাহস তোমার কি করে হল ? অতঃপর পাপিষ্ট ইবনে যিয়াদ ইমাম যয়নুলকে (আ.) বাহিরে নিয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। হযরত যয়নাব ইবনে যিয়াদের আদেশ শোনা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে বললেন-
يا ابْن زيادٍ انّك لمْ تُبْق منّا أحدا، فإنْ كُنْت عزمْت على قتْله فاقْتُلْنى معهُ
“ হে ইবনে য়িয়াদ ,তুই আমাদের মাঝে কাউকেই জীবিত রাখিসনি। যদি তুই যয়নুলকে হত্যা করতে চাস তাহলে আমাকেও হত্যা করে ফেল। ” ইমাম যয়নুল ফুফুকে লক্ষ্য করে বললেন ,“
হে ফুফুজান , আমি যতক্ষণ ইবনে যিয়াদের সাথে কথা বলব আপনি চুপ করে থাকুন। ” তারপর ইমাম যয়নল আবেদীন (আ.) ইবনে যিয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন-
أبالْقتْل تُهدّدنى يا ابْن زيادٍ أما علمْت أنّ الْقتْل لنا عادةُ و كرامتُتنا الشّهادةُ
হে ইবনে যিয়াদ তুই আমাকে হত্যার ভয় দেখাচ্ছিস ? অথচ তোর কি জানা নেই যে নিহত হওয়া আমাদের কাছে স্বাভাবিক এবং শাহাদতই আমাদের গৌরব। এরপর ইবনে যিয়াদের আদেশক্রমে ইমাম এবং আহলে বাইতকে কুফার জামে মসজিদের পাশে অবস্থিত একটি গৃহে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। হযরত যয়নাব নির্দেশ দিলেন যে সব মহিলা উম্ম ওয়ালাদ বা দাসী তারা ছাড়া আর কোন মহিলা যেন আমাদের গৃহে প্রবেশ না করে। কারণ যেমনিভাবে আমাদের বন্দীত্বের শিকলে বাধা হয়েছে তেমনি ভাবে মহিলারাও (দাসীরাও) দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
ইবনে যিয়াদ ইমাম হোসাইনের (আ.) দেহচ্যুত মাথা মোবারক কুফার রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শন করার আদেশ দেয়। এ ব্যাপারে আমরা ইমাম হোসাইন (আ.) এর শানে একজন আলেমের শোকগাথা উদ্ধৃত করা সমীচীন মনে করছি।
ر أسُ ابْن بنْت مُحمّدٍ و وصيّه
|
|
للنّاظرين على قناةٍ يُرْفعُ
|
و الْمُسْلمُون بمنْظرٍ و بمسْمعٍ
|
|
لا مُنْكرُ منْهُمْ و لا مُتفجّعُ
|
كحُلتْ بمنْظرك الْعُيُونُ عمايةً
|
|
و أصمّ رُزْءُك كُلّ أُذُن تسْمعُ
|
أيْقظْت أجْفانا و كُنْت لها كرى
|
|
و أنمْت عيْنا لمْ تكُنْ بك تهْجعُ
|
ما روْضةُ الا تمنّتْ أنّها
|
|
لك حُفْرةُ و لخظّ قبْرك مضْجعُ
|
জনসমক্ষে প্রদর্শনীর জন্য মহানবীর দৌহিত্র ও উত্তরাধিকারীর মস্তক বর্শার মাথায় গাথা হয়েছে। আর মুসলমানরা তা দেখছে এবং শুনছে। তাদের মধ্যে কেউই এ গর্হিত কাজে বাধা দিচ্ছে না বা তাদের অন্তর ব্যথিত হচ্ছে না। যে এই বিভৎস দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করছে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাক। হে হোসাইন , তোমার মুসিবতের কথা শুনেও যে ব্যক্তি তা প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসেনি তার কর্ণদ্বয় বধির হয়ে যাক। হে হোসাইন তুমি তোমার শাহাদতের দ্বারা ঐসব চোখগুলোকে জাগ্রত করেছ যারা তোমার জীবদ্দশায় নিদ্রামগ্ন ছিল। আর ঐসব চোখগুলোকে নিদ্রামগ্ন করেছ যারা তোমার জীবদ্দশায় তোমার ভয়ে ঘুমাতে পারত না । হে হোসাইন , পৃথিবীর বুকে এমন কোন উদ্যান ছিল না যে তোমার সমাধিস্থল ও চিরস্থায়ী আবাস হওয়ার আকাঙ্খা করেনি।
আবদুল্লাহ ইবনে আফীফের বীরত্ব ও শাহাদাত
বর্ণিত আছেঃ ইবনে যিয়াদ মিম্বরে দাড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা করার পর ভাষণের মধ্যে বলতে লাগলঃ ঐ খোদার শুকরিয়া আদায় করছি যিনি আমীরুল মুমেনীন ইয়াজিদ ও তার অনুসারীদেরকে সাহায্য করেছেন এবং মিথ্যাবাদীর পুত্র মিথ্যাবাদী হোসাইন ইবনে আলীকে হত্যা করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ) যখন সে একথা বলল তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আফীফ আল-আযদী প্রতিবাদ করে বললেন ,“
হে মারজানার পুত্র তুই , তোর পিতা আর যে তোকে কুফার শাসনকর্তা করেছে সে ও তার পিতাই আসলে প্রকৃত মিথ্যাবাদী। হে খোদার শত্রু , মহান নবীদের বংশধরদেরকে হত্যা করে মুসলমানদের মিম্বরে আরোহণ করে এ ধরনের মিথ্যা উক্তি করছিস ?”
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , আব্দুল্লাহ ইবনে আফীফ আল-আযদী একজন পূণ্যবান , দুনিয়াত্যাগী সাধক পুরুষ ছিলো। উষ্ঠের যুদ্ধে তার বাম চোখ এবং সিফফীনের যুদ্ধে তার ডান চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি কুফার জামে মসজিদে সারা দিনরাত ইবাদত-বন্দেগী ও নামায-রোযায় মগ্ন থাকতেন। ইবনে যিয়াদ আব্দুল্লাহ ইবনে আফীফের এ কথাগুলো শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল এবং বলতে লাগলঃ“
এ কথ কে বলল ?”
আব্দুল্লাহ ইবনে আফীফ তখন উচ্চস্বরে বলে উঠলেন ,“
হে খোদার শত্রু , আমিই এ কথাগুলো বলছি। মহানবীর (সা.) পবিত্র বংশধরদেরকে হত্যা করেছিস যাদেরকে মহান আল্লাহ সব ধরনের পাপ-পংঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করে দিয়েছেন ? আর এরপরও নিজেকে মুসলমান মনে করছিস ?!!! হায় মহানবী (সা.) যাকে অভিশপ্তের পুত্র অভিশপ্ত বলে অভিহিত করেছেন সেই পাপিষ্ঠ অপবিত্র ইবনে যিয়াদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণকারী মুহাজির ও আনসারদের বংশধরেরা আজ কোথায় ?”
এ কথায় ইবনে যিয়াদের ক্রোধ আরো বেড়ে গেল , তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল এবং সে বলতে লাগল ,“
আব্দুল্লাহকে আামর সামনে ধরে আনো। ” শক্তিশালী রক্ষীরা চারদিক থেকে আব্দুল্লাহর দিকে ছুটে গেল। কিন্তু আযদ গোত্রপতিরা যারা সম্পর্কে আব্দুল্লাহর জ্ঞাতি ও সম্পর্কে চাচাত ভাই তারা সবাই আব্দুল্লাহকে রক্ষীদের হাত থেকে রক্ষা করে এবং নিরাপদে মসজিদ থেকে তার গৃহে পৌছে দেয়। ইবনে যিয়াদ এ ঘটনার পর সৈন্যদেরকে আদেশ দেয় , !ঐ অন্ধ আযদীর ঘরে গিয়ে ওকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এস। খোদা যেমনিভাবে ওর দু’
চোখ অন্ধ করে দিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ওর অর্ন্তচক্ষুও যেন অন্ধ করে দেন। ” ইবনে যিয়াদের এ আদেশ পেয়ে একদল সৈন্য আব্দুল্লাহর গৃহে হানা দেয়। আর এ খবর শোনামাত্রই আযদ গোত্র আব্দুল্লাহকে রক্ষা করার জন্য ইয়ামানী কবীলাসমূহের সাথে একত্রিত হয়। আযদ ও অন্যান্য গোত্রের একত্রিত হওয়ার সংবাদ পেয়ে ইবনে যিয়াদ“
মাযার গোত্রসমূহকে ” একত্রিত করে তাদেরকে মুহাম্মদ বিন আশ ’ আশের নেতৃত্বে আযদ ও ইয়ামানী গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রেরণ করে। এক ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায় এবং একদল লোকও যুদ্ধে নিহত হয়। ইবনে যিয়াদের সৈন্যরা এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহর ঘরে পৌছে যায় এবং দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে। তখন আব্দুল্লাহও তাকে অভয় দিয়ে বলতে থাকেন ,“
ভয় পেয়ো না। আমাকে তরবারীটা দাও। ” তখন সে তরবারীটা এনে আব্দুল্লাহকে দেয় এবং আব্দুল্লাহও নিম্নোক্ত কবিতা আবুত্তি করতে করতে আত্মরক্ষা করার জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
أنا ابْن ذى الْفضل عفيف الّطاهر
|
|
عفيفُ شيْخى و ابْنُ أُمّ عامر
|
كمْ دارٍع منْ جمْعكُمْ و حاسرٍ
|
|
و بطلٍ جدلْتُهُ مُغاورٍ
|
“
আমি পুণ্যাত্মা আফীফ তনয় ,
আমার পিতা আফীফ যিনি উম্মু আমেরের সন্তান
আমি তোমাদের মধ্য থেকে কত বর্মধারী , বীর ও সিপাইদের বিরুদ্ধে লড়েছি। ”
আব্দুল্লাহর মেয়ে তখন বলছিলঃ“
হে পিতা , হায় আমি যদি পুরুষ হতাম তাহলে তোমার পাশাপাশি নবীবংশ হত্যাকারী এসব পাপিষ্ঠ নরাধমদের বিরুদ্ধে লড়তাম। ”
ইবনে যিয়াদের সৈন্যরা চারদিক থেকে আব্দুল্লাহর উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। আর আব্দুল্লাহও একাই লড়ে যাচ্ছিলেন। যারাই যে দিক থেকে তার কাছাকাছি পৌছে যেত অমনি তার মেয়ে তাকে জানিয়ে দিত। । অবশেষে শত্রুদের চাপ চারদিক থেকে বেড়ে গেল এবং তারা আব্দুল্লাহকে ঘিরে ফেলল। তখন আব্দুল্লাহর মেয়ে চীৎকার করে বলল ,“
হায় পিতা , পিতা , কঠিন বিপদের সম্মুখীন অথচ তার কোন সাহায্যকারী নেই। ” আব্দুল্লাহ চারদিকে তরবারী ঘুরিয়ে বলতে লাগলেনঃ
أُقْسمُ لوْ يفْسحُ لى عنْ بصرى
|
|
ضاق عليْكُمْ موْردى و مصْدرى
|
“
খোদার শপথ , আমি যদি অন্ধ না হতাম তাহলে তোমাদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। ” ইবনে যিয়াদের সৈন্যরা তার সাথে অবিরাম লড়ে যেতে লাগল এবং অবশেষে তাকে বন্দী করে ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে গেল। ইবনে যিয়াদ আব্দুল্লাহকে দেখামাত্রই বলে উঠল ,
الْحمْدُ لله الّذى أخْزاك
ঐ খোদার সমস্ত প্রশংসা যিনি তোমাকে অপদস্থ করেছেন। ” আব্দুল্লাহ প্রত্যুত্তরে বললেন-
يا عدُوّ الله و بماذا أخْزانى اللهُ
হে খোদার দুশমন , আল্লাহ কেন আমাকে অপদস্থ করবেন ? আমি শপথ করে বলছি , যদি আমি অন্ধ না হতাম তাহলে তোর অবস্থা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। ” ইবনে যিয়াদ তখন তাকে বলল ,“
হে খোদার দুশমন , উসমান ইবনে আফফানের ব্যাপারে তোর অভিমত কি ?”
আব্দুল্লাহ , ইবনে যিয়াদকে গালি দিয়ে বললেন ,“
হে বনি ইলাজের ক্রীতদাস , হে মারজানা তনয় , উসমানকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন ? উসমান যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তার ও অন্যান্যদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে ফয়সালা করে দেবেন। তুই এ ব্যাপারে নিজকে , তোর পিতাকে এবং ইয়াজিদ ও তার পিতাকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ” ইবনে যিয়াদ প্রত্যুত্তরে বলল ,“
তোর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। আব্দুল্লাহ মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন ,“
তোর জন্মেরও আগে আমি খোদার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম ,“
আমাকে শাহাদাতের মর্তবা দান কর এবং সবচে ’ নিকৃষ্ট ব্যক্তির হাতে যেন আমার মৃত্যু হয়। ” কিন্তু আমার দু’
চোখ যখন অন্ধ হয়ে গেল তখন শাহাততের সৌভাগ্য অর্জনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আর এখন আমি আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌছে যাচ্ছি বলেই মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। ” অতঃপর ইবনে যিয়াদ আব্দুল্লাহর মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করলে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার মৃতদেহ কুফার কোন এক গলিতে ঝুলিযে রাখা হয়।
বর্ণিত আছেঃ উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ পত্রযোগে ইয়াজিদকে ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদত ও তার আহলে বাইতকে বন্দী করার ব্যাপারে অবহিত করে। উবায়দুল্লাহ মদীনার শাসনকর্তা আমর বিন সাঈদ বিন আসের কাছে একই ধরনের চিঠি লিখে । চিঠি পৌছানো মাত্রই আমর বিন সাঈদ বিন আস মসজিদে নববীর মিম্বারে দাড়িয়ে ভাষণ দেয় এবং হোসাইন (আ.) এর শাহাদাত সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে এ সংবাদ শোনা মাত্রই হাশিমী বংশীয়দের মাঝে কান্নার রোল পড়ে যায় এবং তারা শোক প্রকাশ করতে থাকে। আকীল ইবনে আবী তালেবের কন্যা যয়নাব বিলাপ করে বলতে থাকেনঃ মহানবী (সা.) যখন তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন ,
ماذا تقُولُون اذْ قال الّنبىُ لكُمْ
|
|
ماذا فعلْتُمُ و أنْتُمْ آخرُ الاْ مم
|
بعتْرتى و أهْل مُفْتقدى
|
|
منْهُمْ أُسارى و منْهُمْ ضُرّجُوا بدم
|
ما كان هذا جزائى اذْ نصحْتُ لكُمْ
|
|
أنْ تخْلُفُونى بسُوءٍ فى ذوى رحمى
|
আমার আহলে বাইতের সাথে আমার মৃত্যুর পর তোমরা কি আচরণ করেছ অথচ তোমরাই ছিলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত ? তাদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যককে বন্দী করেছ আর কিছুসংখ্যককে হত্যা করেছ। তোমাদেরকে না আমি উপদেশ দিয়েছিলাম যে আমার আহলে বাইতের সাথে খারাপ আচরণ করবে না। অথচ এই তার প্রতিদান। তখন তোমরা তাকে (সা.) কি জবাব দেবে ? ঐ দিন দিবাগত রাতে মদীনাবাসীরা শুনতে পেল যে , কে যেন অদৃশ্যলোক থেকে বলছে-
ماذا تقُولُون اذْ قال الّنبىُ لكُمْ
|
|
ماذا فعلْتُمُ و أنْتُمْ آخرُ الاْ مم
|
بعتْرتى و أهْل مُفْتقدى
|
|
منْهُمْ أُسارى و منْهُمْ ضُرّجُوا بدم
|
ما كان هذا جزائى اذْ نصحْتُ لكُمْ
|
|
أنْ تخْلُفُونى بسُوءٍ فى ذوى رحمى
|
أيُّها الْقاتلُون جهْلا حُسيْنا
|
|
أبْشرُوا بالْعذاب و التّنْكيل
|
كُلُ أهْل السّم أ يدْعُو عليْكُمْ
|
|
منْ نبّى و مالكٍ و قتيل
|
قد لعنتم علی لسان ابن داود
|
|
و موسی و صاحب الانجیل
|
“
যারা ইমাম হোসাইনকে (আ.) অজ্ঞতাবশত হত্যা করছে তাদেরকে শাস্তি ও দুর্ভাগ্যর সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে । নবী-পয়গম্বর- ফেরেশতা ও শহীদগণসহ সকল আকাশবাসী হোসাইন (আ.) এর হত্যাকারীদেরকে অভিশাপ দিচ্ছে। হযরত সুলাইমান (আ.) হযরত মূসা (আ.) ও তোমাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন।
ইবনে যিয়াদ কর্তৃক বন্দী ইমাম পরিবারকে সিরিয়ায় প্রেরণ
ইবনে যিয়াদের চিঠি পেয়ে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর ইয়াজিদ ইবনে যিয়াদকে লিখল , হোসাইন (আ.) এর মস্তক ও যারা তার সাথে নিহত হয়েছে তাদের কর্তিত মাথা ইমাম হোসাইন (আ.) এর বন্দী পরবিার-পরিজনসহ সিরিয়ায় পাঠিয়ে দাও। ইবনে যিয়াদ মাহফার বনি সা ’ লাবা আল আনেদীর নেতৃত্বে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তার নিগত সঙ্গী-সাথীদের মাথা এবং বন্দী আহলে বাইত (আ.) কে সিরিয়ায় প্রেরণ করে। কাফির মুশরিক যুদ্ধবন্দীদেরকে যেমনিভাবে মুখমণ্ডল অনাবৃত করে রাখা হয় ঠিক তেমনিভাবে মিহফার বন্দী নবী-পরিবারকে সিরিয়ায় নিয়ে যায়।
সিরিয়ায় আহলে বাইত (আ.)-এর করুণ অবস্থা
বন্দী আহলে বাইত (আ.) এর কাফেলা দামেশক শহরের সদর দরজার নিকটবর্তী হলে হযরত উম্মে কুলসুম (আ.) শিমারের কাছে গিয়ে বললেন ,“
তোমার সাথে একটু কথা আছে। ” শিমার তাকে জিজ্ঞেস করল ,“
কি কথা ?”
কথন উম্মে কুলসুম তাকে বললেন ,
قالتْ: اذا دخلْت بِنا الْبلد فاحْمِلْنا فى درْبٍ قلِيلِ النّظارةِ، و تقدّم اليْهِمْ أنْ يُخْرِجُوا هذِهِ الرُّؤ وس مِنْ بيْنِ الْمحامِلِ و يُنحُّونا عنْها، فقدْ خزينا مِنْ كثْرةِ النّظرِ اليْنا و نحْنُ فى هذِهِ الْحالِ
“ এ শহরে প্রবেশ করানোর সময় আমাদেরকে এমন ফটক দিয়ে শহরের ভিতরে নিয়ে যাও যেখান । অল্পসংখ্যক দর্শক জড়ো হয়েছে এবং তোমার সিপাইদেরকে বল তারা এই মাথাগুলোকে পতাকাসমূহের মধ্য থেকে বাইরে বের করে আনে এবং এবং আমাদের (বন্দী নবী পরিবার) ওগুলো থেকে দূরে রাখে। করাণ আমরা ইতোমধ্যে অনেক অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। আর আমরা তো বন্দী অবস্থার মধ্যেই রয়েছি। শিমারের মাঝে বিশেষ ধরনের কুফরী ও পাপ-পঙ্কিলতা (কলুষতা) থাকার কারণে হযরত উম্মে কুলসুমের এ কথায় সে মোটেও কান দিল না বরং উল্টো আদেশ দিল ,“
কর্তিত মস্তকগুলোকে বর্শাগ্রে বেধে পতাকাসমূহের মাঝেই রাখা হয়। ” আর এভাবেই বন্দী নবী পরিবারকে দর্শকদের উপস্থিতিতে দামেশকের প্রধান ফটকের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করানো হল। শহরের প্রধান জামে মসজিদের দরজার সামনে যেখানে যুদ্ধবন্দীদেরকে রাখা হত সেখানেই বন্দী নবী পরিবারকে রাখা হয়। বর্ণিত আছে যে , একজন জ্ঞানী তাবেয়ী
সিরয়িায় যখন ইমাম হোসাইনের কর্তিত মাথা মোবারক দেখতে পান তখন থেকে এক মাসের জন্য তিনি নিজ বান্ধবদের সাথেও দেখা দেননি , আত্মগোপন করেছিলেন। একমাস পর যখন তাকে দেখা গেল তখন তাকে আত্মগোপন করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি জবাবে বলেছিলেন , !তোমরা দেখতে পাচ্ছ না যে আমরা কত বড় দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছি ?”
তারপর তিনি নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করলেন ,
“ তোমরা কারা ? তখন ঐ মেয়েটি বলল , আমি হোসাইনের (আ.) কন্যা সাকীনা। ” আমি তাকে বললাম ,“
আমি আপনার প্রপিতামহের একজন সাহাবা । আমার নাম সাহল বিন সা ’ দ। আমার দ্বরা যদি আপনাদের কোন উপকার হয় তাহলে আমাকে বলুন। ” তখন তিনি (সাকীনা) বললেলঃ
جاؤُا بِر أسِك يابْن بِنْتِ مُحمّدٍ
|
|
مُترمِّلا بِدِمائِهِ ترْميلا
|
و ك أنّما بِك يابْن بِنْتِ مُحمّدٍ
|
|
قتلُوا جِهارا عامِدين رسولا
|
قتلُوك عطْشانا و لمّا يترقّبُوا
|
|
فى قتْلِك التّنْزيل و التّ أويلا
|
و يُكبِّرُون بِ أنْ قُتِلْت و أنّما
|
|
قتلُوا بِك التّكْبير والتّهْليلا
|
“
হে নবী দৌহিত্র সিরিয়ায় আপনার রক্তাক্ত মাথা আনা হয়েছে। আপনাকে হত্যা করার অর্থই হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে প্রকাশ্যে ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা। হে নবী দৌহিত্র , আপনাকে তৃষ্ণার্তাবস্থায় ওরা হত্যা করেছে এবং পবিত্র কোরআনের বিধান লংঘন করেছে। আপনাকে হত্যা করার সময় তারা তাকবীর-ধ্বনি দিয়েছেন। আসলে তারা আপনাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তাকবীর ও তাহলীলেরই ধ্বংস সাধন করেছে। ”
একজন সিরিয়াবাসী বৃদ্ধের কাহিনী
বর্ণিত আছেঃ বন্দী নবী পরিবারকে যখন দামেশ্কের জামে মসজিদের দরজার সামনে জড় করা হল তখন তাদের (আ.) সামনে একজন বৃদ্ধ এসে বলল ,“
মহান আল্লাহর সব প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে হত্যা ও ধ্বংস করেছেন এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে দেশের শহর ও জনপদসমূহকে নিরাপদ করেছেন। তিনি আমীরুল মুমেনীন ইয়াজিদকে তোমাদের উপর বিচয়ী করেছেন। ” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তখন ঐ বৃদ্ধ লোকটিকে বললেন ,“
তুমি কি এ আয়াতটা …
(
قُلْ لا أسْألُكُمْ عليْهِ أجْرًا إِلّا الْمودّة فِي الْقُرْبى)
“
হে নবী বলে দিন একমাত্র আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের কাছে এ রিসালাতের(দাওয়াতের) দায়িত্ব পলন করার জন্য কোন প্রতিদানই প্রত্যাশা করি না। ” (সূরা আস-সূরা , আয়াত নং-২৩) পবিত্র কোরআনে পড়নি ? তখন বৃদ্ধ লোকটি বলল , হ্যাঁ পড়েছি। ” তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন , জেনে রাখ আমরাই মহানবীর নিকটাত্মীয়। আচ্ছা তুমি কি বনী ইসরাইলের এ আয়াটি
(
وآتِ ذا الْقُرْبى حقّه)
(বনী ইসরাইল , আয়াত নং-২৬)
(“
নিকটাত্মীয়ের অধিকার। ” ) পড়নি ? ইমাম (আ.) বললেন ,“
আমরাই মহানবীর নিকটাত্মীয় অর্থাৎذا الْقُرْبى
(যাল-কুরবা) । ” তোমরা কি এ আয়াতটি
(
واعْلمُوا أنّما غنِمْتُمْ مِنْ شيْءٍ فأنّ لِلّهِ خُمُسهُ ولِلرّسُولِ ولِذِي الْقُرْبى)
আর জেনে রাখো যখন তোমরা কোন জিনিস গণীমত লাভ করবে তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ , তার রাসূল ও নিকটাত্মীয়দের জন্য … । (সূরা আনফাল , আয়াত নং-৪১) বৃদ্ধ লোকটি বলল ,“
হ্যাঁ , আমি পড়েছি। ” তখন ইমাম বললেন , আমরাই যাল কুরবা অর্থাৎ নিকটাত্মীয়। ” আচ্ছা তুমি কি কোরআনের এ আয়াতটি
(
إِنّما يُرِيدُ اللّهُ لِيُذْهِب عنْكُمُ الرِّجْس أهْل الْبيْتِ ويُطهِّركُمْ تطْهِيرًا)
“ হে নবীর আহলে বাইত নিশ্চয় মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান। ’ (সূরা আহযাব , আয়াত নং-৩৩) পড়নি ? বৃদ্ধলোকটি বলল হ্যাঁ , পড়েছি। ” ইমাম (আ.) বললেন ,“
আমরাই মহানবীর আহলে বাইত। মহান আল্লাহ আমাদের শানেই এ আয়াতটি নাযিল করেছেন। ” বৃদ্ধলোকটি ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এর এ কথাগুলো শুনে নির্বাক হযে গেল এবং যে সব কথা সে কিছুক্ষন আগে বলেছিল সে জন্য সে অনুতপ্ত হয়ে বলল ,“
খোদার শপথ , কোরআনের এ আয়াতগুলো কি তোমাদের শানেই নাযিল হয়েছে ?”
তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন ,“
মহান আল্লাহ ও আমার দাদা মহানবীর (সা.) কসম , এ আয়াতগুলো আমাদের শানেই অবতীর্ণ হয়েছে। ” ঐ বৃদ্ধলোকটি এ কথা শুনে কেদে ফেলল এবং মাথা থেকে পাগড়ী খুলে মাটিতে ফেলে দিল এবং আকাশের দিকে মাথা তুলে প্রার্থনা করল ,“
হে খোদা , আমি মহানবীর (সা.) বংশধরদের মনুষ্য ও জ্বীন শত্রুদের থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। ” এরপর সে ইমাম (আ.) কে বলল ,“
আমার তওবা কি কবুল হবে ?”
ইমাম (আ.) তাকে বললেন ,“
হ্যাঁ , যদি তুমি তওবা কর তাহলে মহান আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করবেন। তুমি তো আমাদের সাথেই আছ। ” তখন বৃদ্ধ লোকটি বলল ,“
আমি তওবা করলাম। ” ইয়াজিদ যখন বৃদ্ধলোকটির এ কাহিনীটি শুনল তখন তাকে কতল করার আদেশ দিল এবং তাকে হত্যা করা হল।
ইয়াজিদের সভায় বন্দী আহলে বাইতের প্রবেশ
এরপর মহানবীর (সা.) বন্দী পরিবার-পরিজনকে দড়িতে বেধে ইয়াজিদের দরবারে আনা হয় । ঠিক এ সময় ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন,
(
أنْشِدُك اللّهُ يا يزيدُ، ما ظنُّك بِرسُولِ اللّهِ ص لوْ رآنا على هذِهِالصِّفةِ)
“
হে ইয়াজিদ,
তোমাকে,
খোদর নামে শপথ করে বলছি,
মহানবী (সা.) সম্পর্কে তুমি কেমন ধারণা পোষণ কর,
যদি তিনি আমাদেরকে এ অবস্থায় দেখতে পেতেন?”
ইয়াজিদের নির্দেশে বন্দী নবী-পরিবারকে যে সব রশি দিয়ে বধা হয়েছিল সেগুলো কেটে ফেলা হল। তারপর ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা ইয়াজিদের সামনে রাখা হয় এবং নবী-পরিবারের মহিলাদেরকে ইয়াজিদের পিছনে দাড় করানো হয় যাতে করে তারা ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা দেখতে না পান। কিন্তু ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এ দৃশ্য দেখে ফেললেন। হযরত যয়নাবের (আ.) দৃষ্টি ইমাম হোসাইনের (আ.) এ দৃশ্য দেখে ফেললেন। হযরত যয়নবের (আ.) দৃষ্টি ইমাম হোসাইনের (আ.) কর্তিত মাথার দিকে পড়ামাত্রই দুই গ্রীবাদেশে হাত রেখে অতি করুণ স্বরে বলে উঠলেন, “
ওয়া হেসাইনাহ (হায় হোসাইন),
হায় রাসুলুল্লাহর (সা.) দৌহিত্র,
হায় পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদীনার সন্তান,
হায় ফাতেমা যাহরার সন্তান,
হায় মুস্তাফার (সা.) দৌহিত্র।”
বর্ণনাকারী বলেনঃ হযরত যয়নব (আ.) উক্ত সভায় যারাই উপস্থিত ছিল তাদের সবাইকে কাদালেন। এর এ সময় পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ (তার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক) চুপ করে ছিল। এ সময় বনী হাশিমের যে মহিলাটি ইয়াজিদের গৃহে বাস করত সে ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্য শোক প্রকাশ করতে লাগল এবং উচ্চস্বরে বলতে লাগল, “
ইয়া হাবীবাহ (হায় প্রিয় হোসাইন),
হায় আহলে বাইতের নেতা,
হায় হযরত মুহাম্মদের (সা.) দৌহিত্র,
হায় অনাথদের আশ্রয় ও ভরসাস্থল,
হায় খোদার শত্রুদের হাতে নিহত শহীদ।”
যারাই তার ফরিয়াদ শুনতে পেল তারাই কাদতে লাগল। এরপর ইয়াজিদ খায়যুরান কাঠের নির্মিত একটি লাঠি আনার আদেশ দিল এবং সেই লাঠি দিয়ে সে ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র দাঁত ও ঠোটে আঘাত করতে লাগল। আবু বারযা আসলামী ইয়াজিদকে লক্ষ্য করে বললেন, “
ইয়াজিদ তোমার জন্য আক্ষেপ,
তুমি লাঠি দিয়ে হযরত ফাতেমার (আ.) পুত্র হোসাইনের (আ.) মুখে আঘাত করছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
আমি মহানবীকে (সা.) হাসান ও হোসাইনের গালে চুম্বন করতে দেখেছি এবং তিনি (সা.) বলতেনঃ
أنْتُما سيِّدا شبابِ أهْلِ الْجنّة
“
তোমরা দু’
ভাই বেহেশতের যুবকদের নেতা। তোমাদের হত্যাকারীদেরকে আল্লাহ হত্যা করবেন ও অভিশাপ দিন এবং তোদেরকে নিকৃষ্ট বাসস্থান জাহান্নামে প্রবেশ করান।“
ইয়াজিদ এ কথা শুনে অত্যন্ত ক্ষেপে গেল। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের নির্দেশে আবু বারযাহকে টেনে হিচড়ে দরবার থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ঘটনার পর ইয়াজিদ ইবনে যে’
বারীর কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল,
ليْت أشْياخى بِبدرٍ شهِدُوا
|
|
جزع الْخزْرجِ مِنْ وقْعِ الاسلْ
|
فأهلُّوا وسْتهلُّوا فرحا
|
|
أ ثُمّ قالُوا: يا يزيدُ لا تُشلْ
|
قدْ قتلْنا الْقوْم مِنْ ساداتِهِمْ
|
|
و عدلْناهُ بِبدرٍ فاعْتدلْ
|
لعِبتْ هاشِمُ بِالْمُلْكِ فلا
|
|
خبر جأ و لا وحْيٌ نزلْ
|
لسْتُ مِنْ خِنْدِف انْ لمْ أنْتقِمْ
|
|
مِن بنى أحْمد ما كان فعلْ
|
হায় আমার পূর্ব পুরুষেরা যারা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছে তারা যদি আজ দেখতে পেত যে খাযরাজ গোত্র আমাদের তরবারীর আঘাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাদছে তখন তারা অত্যন্ত আনন্দিত ও উল্লাসি হত এবং বলত সাবাস হে ইয়াজিদ , তোমার শক্তি অটুট থাকুক। আমরা হাশেমী গোত্র প্রধানদেরকে হত্যা করেছি এবং তাদের থেকে বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি। আমি যদি আহমদের কৃতকার্যের জন্য তারই বংশধরদের উপর প্রতিশোধই গ্রহণ না করি তাহলে আমি কি করে খিন্দিকের বংশধর হব ?
(ইবনে যে’
বারী কোরাইশ বংশীয় কাফির ছিল। তার আসল নাম আবদুল লাত। ইসরাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মহানবী (সা.) তার নাম আব্দুল্লাহ রেখেছিলেন। ইবনে যে’
বারী এ কবিতাটি উহুদের যুদ্ধে আবৃত্তি করেছিল।‘
নাসেখ ’ গ্রন্থের রচয়িতা বলেন ,“
প্রথম ও দ্বিতীয় কবিতা ইবনে যে’
বারীর রচিত। আর বাদ বাকী কবিতাসমূহ ইয়াজিদ কর্তৃক রচিত।)
হযরত যয়নাব (সা.আ.) এর ভাষণ
فقامتْ زيْنبُ ابْنةُ علِي و قالتْ :
ألْحمْدُ لِلّهِ ربِّ الْعالمين. و صلّى اللّهُ على مُحمّدٍ و آلِهِ أجْمعين، صدق اللّهُ كذلِك يقُولُ: ثُمّ كان عاقِبةُ الّذِين أساؤُا السُّواى أنْ كذّبُوا بِآياتِ اللّهِ و كانُوا بِها يسْتهْزِؤُن. أظننْت يا يزيدُ - حيْثُ أخذْت عليْنا أقْطار الارْضِ و آفاق السّمأ فأصْبحْنا نُساقُ كما تُساقُ الامأ - أنّ بِنا على اللّهِ هوانا، و بِك عليْهِ كرامةً!! و أنّ ذلِك لِعظيم خطرِك عِنْدهُ!! فشمخْت بِأنْفِك و نظرْت فى عطْفِك، جذْلان مسْرورا، حين رأيْت الدُّنْيا لك مُسْتوْسِقةً، والامُور مُتّسِقةً، و حين صفا لك مُلْكُنا و سُلْطانُنا، فمهْلا مهْلا، أنسيت قوْل اللّهِ عزّ و جلّ: و لا يحْسبنّ الّذِين كفرُوا أنّما نُمْلِى لهُمْ خيْرٌ لِأنْفُسِهِمْ إِنّما نُمْلِى لهُمْ لِيزْدادُوا إِثْما و لهُمْ عذابٌ مُهِينٌ. أمِن الْعدْلِ يابْن الطُّلقأ تخْديرُك حرائِرك و امائك و سُوقك بناتِ رسُولِ اللّهِ سبايا؟! قدْ هتكْت سُتُورهُنّ، و أبْديْت وُجُوههُنّ، تحْدو بِهِنّ الاعْدأ مِنْ بلدٍ الى بلدٍ، و يسْتشْرِفُهُنّ أهْلُ الْمنازِلِ و الْمناقِلِ، و يتصفّحُ وُجُوههُنّ الْقريبُ والْبعيدُ، والدّنِيُّ والشّريفُ، ليْس معهُنّ مِنْ رِجالِهِنّ ولِىُّ، و لا مِنْ حماتِهِنّ حمِيُّ. و كيْف تُرْتجى مُراقبةُ منْ لفظ فُوهُ أكْباد الازْكِيأ، و نبت لحْمُهُ بِدِمأ الشُّهدأ؟! و كيْف لا يسْتبْطأ فى بُغْضِنا أهْل الْبيْتِ منْ نظر اليْنا بِالشّنفِ والشّنآنِ و الاحنِ والاضْغانِ؟! ثُمّ تقُولُ غيْر مُتأثِّمٍ و لا مسْتعْظِمٍ :
لاهلُّوا وسْتهلُّوا فرحا
|
|
ثُمّ قالُوا: يا يزيدُ لا تُشلْ
|
مُنْتحِيا على ثنايا أبى عبْدِ اللّهِ سيِّدِ شبابِ أهْلِ الْجنّةِ تنْكُتُها بِمِحْصرتِك. و كيْف لا تقُولُ ذلِك، و قدْ نك أت الْقرْحة، واسْت أصلْت الشّافة بِاراقتِك دِم أ ذُرِّيّةِ مُحمّدٍ ص و نُجُومِ الارْضِ مِنْ آلِ عبْدِالْمُطّلِبِ؟! و تهْتِفُ بِ أشْياخِك، زعمْت أنّك تُناديهِمْ! فلترِدنّ وشيكا موْرِدهُمْ، و لتودّنّ أنّك شُلِلْت و بُكِمْت و لمْ تكُنْ قُلْت ما قُلْت و فعلْت ما فعلْت. أللّهُمّ خُذْ بِحقِّنا، وانْتقِمْ مِمّنْ ظلمْنا، و احْلُلْ غضبك بِمنْ سفك دمائِنا و قتل حُماتنا. فواللّهِ ما فريْت الا جِلْدك، و لا حززْت الاّ لحْمكْ. و لترِدنّ على رسُولِ اللّهِ ص بِما تحمّلْت مِنْ سفْكِ دِم أ ذُرِّيّتِهِ، وانْتهكْت مِنْ حُرْمتِهِ فى عِتْرتِهِ و لُحْمتِهِ، و حيْثُ يجْمعُ اللّهُ شمْلهُمْ ويلُمُّ شعْثهُمْ و ي أخُذُ بِحقِّهِمْ: و لا تحْسبنّ الّذين قُتِلُوا فى سبِيلِ اللّهِ أمْواتا بلْ أحْيأُ عِنْد ربِّهِمْ يُرِزقُون. و حسْبُك بِاللّهِ حاكِما، و بِمُحمّدٍ ص خصيما و بِجبْرئيل ظهيرا. و سيعْلمُ منْ سوّل لك و مكّنك مِنْ رِقابِ الْمُسْلِمين. بِئْس لِلظّالِمين بدلا و أيُّكُمُ شرُّ مكانا و أضْعفُ جُنْدا. و لئِنْ جرّتْ علىّ الدّواهى مُخاطبتك، أنّى لاسْتصْغِرُ قدْرك، و أسْتعْظِمُ تقْريعك، و أسْتكْثِرُ توْبيخك، لكِنِ الْعُيُونُ عُبْرى ، والصُّدُورُ حرّى ألا فالْعجبُ كُلُّ الْعجبِ لِقتْلِ حِزْبِ اللّهِ النُّجب أ بِحِزْبِ الشّيْطانِ الطُّلق أ. فهذِهِ الايْدى تنْطِفُ مِنْ دِمائِنا، و الافْواهُ تتحلّبُ مِنْ لُحُومِنا. و تِلْك الْجُثثُ الطّواهِرُ الزّواكى تنْتابُها الْعواسِلُ و تعْفِرُها أُمّهاتُ الْفراعِلِ
و لئِنِ اتّخذْتنا مغْنما لِتجِدُنا وشيكا مُغْرما، حين لا تجِدُ الاّ ما قدّمتْ يداك، و ما ربُّك بِظلاّمٍ لِلْعبيدِ. فالى اللّهِ الْمُشْتكى ، و عليْهِ الْمُعوّلُ. فكِدْ كيْدك، واسْع سعْيك، و ناصِبْ جهْدكْ، فو اللّهِ لا تمْحُونّ ذِكْرنا، و لا تُميتُ وحْينا، و لا تُدْرِكُ أمدنا، و لا ترْحضُ عنْك عارها. و هلْ ر أيُك الاّ فندا، و أيّامُك الاّ عددا، و جمْعُك الاّ بددا، يوْم يُنادِى الْمُنادِ :
ألاّ لعْنةُ اللّهِ على الظّالِمين
فالْحمْدُ لِلّهِ الّذى ختم لاوّلِنا بِالسّعادةِ والْمغْفِرةِ، و لاخِرِنا بِالشّهادةِ والرّحْمةِ
و نسْ ألُ اللّه أنْ يُكْمِل لهُمُ الثّواب، و يُوجِب لهُمْ الْمزيد، و يُحْسِن عليْنا الْخِلافة، انّهُ رحيمُ ودُودُ، و حسْبُنا اللّهُ و نِعم الْوكيل
হযরত যয়নাব (আ.) দাড়িয়ে বললেন, “
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি এ নিখিল বিশ্বের প্রভু। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার বংশরদের সকলের উপর মহান আল্লাহর দরুদ ও সালাম। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন, “
যারা মন্দ কাজ এবং অপরাধ করেছে তাদের পরিণাম হচ্ছে এটাই যে তারা মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং সেগুলো উপহাস ও ঠাট্টার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। হে ইয়াজিদ,
যেহেতু এ প্রশস্ত পৃথিবী ও আকাশকে আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে দিয়েছিস। আমাদেরকে যুদ্ধ বন্দীদের মত এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যাচ্ছিস এতে করে তুই ভাবাছিস যে আল্লাহর কাছে আমরা অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হয়েছি এবং খোদার কাছে তোর মর্যাদা বেড়ে গেছে?
এ কারণেই কি তুই এত গর্ব করছিস?
তোর পার্থিব জীবন নিরাপদ ও তোর সাম্রাজ্য এবং রাজত্ব সুদৃঢ় হয়েছে মনে করে তুই আজ উল্লসিত ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিস?
এত তাড়াহুড়া করিস নে। তুই কি মহান আল্লাহর বাণী“
যারা কুফরী করেছে তারা যেন অবশ্যই মনে না করে যে কয়দিনের সুযোগ তাদেরকে দেয়া হয়েছে তা তাদের সৌভাগ্যের সূচনা করেছে । না,
আসলে ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। বরং এ সুযোগ তাদের পাপ ও অপরাধকে আরো বাড়িয়ে দেবে। এ কারণে তাদের জন্য পরকালে ভয়ঙ্কর শাস্তি রয়েছে।”
-
ভুলে গিয়েছিস?
হে তুলাকাদের সন্তান
নিজের স্ত্রী,
দাসী ও মহিলাদেরকে পর্দাবৃত করে রেখেছিস আর মহানবীর (সা.) কন্যাদেরকে মুখমণ্ডল খোলাবস্থায় এবং অনাবৃত করে শত্রুদের সাথে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরাচ্ছিস অথচ তাদেরকে এ ঘোর দুর্দিনে সহায়তা করতে পারে এমন লোকেরা কেউ বেচে নেই- এটা কি ন্যায় বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার নমুনা?
যে ব্যক্তি মুক্তমনা মহামানবদের কলিজা দাত দিয়ে কামড়ায়
এবং শহীদদের রক্তে যার অস্থি ও মাংসপিণ্ড হয়েছে তার কাছে কি দয়া ও মায়ার আশা করা সম্ভব?!!
যে আমাদের সাথে সবসময় শত্রুতা পোষণ করে সে কেন আমাদের সাথে শত্রুতা করা থেকে বিরত থাকবে?
আদৌ এটা কি সম্ভব?
এখন যে ব্যক্তি শক্তি ও মদমত্ততায় নিমগ্ন সে কিভাবে নিজের পাপ ও অপরাধের কথা ভাববে?
ক্ষমতার দর্পে ও অহংকারে নেশাগ্রস্থ হয়ে তুই এখন লাঠি দিয়ে বেহেশতের যুবকদের নেতা হোসাইন (আ.) এর দাতে আঘাত করছিস আর প্রকাশ্যে আবৃত্তি করছিসঃ
ف أهلُّوا وسْتهلُّوا فرحا
|
|
ثُمّ قالُوا: يا يزيدُ لا تُشلْ
|
আর তোর পক্ষে এ ধরনের উক্তি আর এ ধরনের কবিতা আবৃত্তি করা শোভা পায়। কারণ তোর হাত মহানবীর (সা.) বংশধরদের রক্তে রঞ্জিত। মর্তের উজ্জ্বল নক্ষত্রদেরকে যারা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর ছিলেন তুই তাদেরকে ধ্বংস করেছিস। আর এ কাজ করে আসলে তুই নিজের মৃত্যু ও দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিস। এখন তুই তোর মৃত পূর্ব পুরুষদেরকে ডাকছিস আর ভাবছিস যে তারা তোর কথা শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু তুই জেনে রাখিস অচিরেই তুইও তাদের সাথে মিলিত হবে। আর তখনই তুই বুঝতে পারবি এবং আশা করবি হায় আমার দু’
হাত যদি অক্ষম হত এবং আমি যদি বোবা হতাম। আর যে জঘন্য কথা বলেছি তা যদি না বলতাম। যে অন্যায় করেছি তা যদি না করতাম। এখানে হযরত যয়নাব অভিশাপ দিয়ে বললেনঃ“
হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সাথে যারা অত্যাচার করেছে তাদের উপর তুমি প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তাদের কাছ থেকে আমাদের হক যা তারা আামদের থেকে কেড়ে নিয়েছে তা উদ্ধার কর এবং তাদেরকে দোযখের আগুনে দগ্ধ কর।”
এরপর তিনি ইয়াজিদকে লক্ষ্য করে বললেন, “
হে ইয়াজিদ এ গর্হিত কাজ করে তুই নিজের চামড়া নিজেই তুলে ফেলেছিস এর নিজের দেহকে খণ্ডিত খণ্ডিত করেছিস (নবী বংশকে হত্যা করে তুই আসলে নিজেকেই বধ করেছিস) । আর অচিরেই তুই মহানবীর (সা.) বংশধরদেরকে হত্যা ও অপদস্থ করে পাপের যে মহাভারী বোঝা ঘাড়ে বহন করেছিস তা নিয়ে মহানবীর সামনে উপস্থিত হবি। সেদিন আল্লাহ মহানবীর (সা.) বংশধরদেরকে (যাদের তুই হত্যা করেছিস) একত্রিত করে তাদের হৃত অধিকার আদায় করবেন এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। তুই ভাবিস না যে,
যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তারা মৃত ,
(
ولا تحْسبنّ الّذِين قُتِلُوا فِي سبِيلِ اللّهِ أمْواتًا بلْ أحْي أ عِنْد ربِّهِمْ يُرْزقُون)
যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত মনে করনা বরং তারা জীবিত ও মহান আল্লাহর কর্তৃক রিযিকপ্রাপ্ত। (সূরা আলে ইমরান , আয়াত নং -১৬৯ ) আর ঐ দিন মহান আল্লাহ বিচার করবেন,
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তোর সাথে বিবাদ করবেন এবং আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) তাকে (সা.) সাহায্য করবেন। যে সব লোক তোকে সিংহাসনে বসিয়েছিল তারা অচিরেই বুঝতে পারবে যে কত মন্দ,
নিকৃষ্ট ও অত্যাচারীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। আর তোদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যে সবচে হতভাগা তাও তারা জানতে পারবে। সময়ের চাপে পড়ে আমাকে যদিও তোর সাথে কথা বলতে হচ্ছে তারপরও আমি তোকে তুচ্ছ বলেই মনে করি এবং আমি জানি যে তোকে তিরস্কার করা আসলে পছন্দনীয় কাজ। হায় ! নয়নগুলো থেকে অশ্রু ঝরছে আর বক্ষগুলো দুঃখের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। আহ এটা ভাবতে কত অবাক লাগছে যে , আল্লাহর সৈন্যরা শয়তানের সৈন্যদের হাতে নিহত হচ্ছে। আমাদের রক্ত এদের হাত দিয়ে ঝরছে এবং বধ্যভূমিতে আজ শৃগাল-নেকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়েছে!! বুনো পশুগুলো ঐসব পবিত্র মৃতদেহগুলোকে মাটির সাথে পদদলিত করেছে। হে ইয়াজিদ আজ আমাদেরকে বাহ্যত পরাজিত করে আমাদেরকে গনীমতের সম্পদ বলে মনে করছিস। তাহলে জেনে রাখ অচিরেই তোকে একাজের পরিণাম ভোগ করতে হবে। আর যা তুই পরকালের জন্য অগ্রিম পঠিয়েছিস কেবল সেটুকু ছাড়া আর কিছুই তোর থাকবে না। মহান আল্লাহ বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না। আমরা কেবল তারই সমীপে আমাদের অভিযোগ উত্থাপন করব এবং তিনিই আমাদের আশ্রয়স্থল। হে ইয়াজিদ,
তুই তোর ঘৃণ্য অপতৎপরতায় ব্যস্ত থাক এবং সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করে যা। তারপর খোদার কসম করে বলছি,
তুই আমাদের নাম কখনো মুছে ফেলতে পরবি না। আমাদের রসূলের ওহীকে স্তব্ধ ও ধ্বংস করতে পারবি না এবং তোর নিজের পাপ থেকেও রেহাই পাবি না। কারণ তোর বিবেক বুদ্ধি বিকারগ্রস্থ। তোর আয়ুষ্কালও সীমিত। তোর সংগী-সাথীরা অবশ্যই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। যেদিন আহ্বানকারী যখন বলতে থাকবে, “
খোদার অভিশাপ অত্যাচারীদের উপর বর্ষিত হোক।”
ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাদের ভাগ্যকে সৌভাগ্য ও ক্ষমার দ্বারা আরম্ভ করেছেন এবং তা শাহাদাত ও রহমত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করেছেন।
আমারা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি আমাদের শহীদদের উপর তার নেয়ামতসমূহ পূর্ণ করে দেন এবং তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করেন এবং আমাদেরকে তাদের যোগ্য উত্তরসূরি করে দেন। কারণ তিনিই পরম দাতা ও দয়ালু। মহান আল্লাহই আমাদের সর্বোত্তম আশ্রয়স্থল।”
ইয়াজিদ হযরত যয়নাবের এ ভাষণ শোনার পর বলল,
يا صيْحةً تُحْمدُ مِنْ صوائِحِ
|
|
ما أهْون الْموْت على النّوائِحِ
|
বিলাপকারিণীদের বিলাপ ও কান্নার ধ্বনি কত পছন্দনীয়!! শোকগ্রস্থ বিলাপকারিণী মহিলাদের জন্য মৃত্যুবরণ করা কত সহজ!! এরপরই ইয়াজিদ সিরীয় নেতাদের সাথে বন্দী আহলে বাইতের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করল। তারা আহলে বাইতকে হত্যা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করল। তবে নু’
মান বিন বাশীর এ সময় বলল, “
আমাদেরকে দেখতে হবে যে মহানবী (সা.) বন্দীদের সাথে কেমন আচরণ করেছেন। তিনি (সা.) যে রকম আচরণ করে থাকবেন ঠিক সেরকমই তোমাকে করতে হবে।”
ইয়াজিদের রাজদরবারে একজন সিরীয় লোকের কাহিনী
এ সময় একজন সিরিয়াবাসী হযরত ফাতেমা বিনতে হোসাইনের দিকে তাকিয়ে বলল ,“
আমীরুল মুমেনীন , আমাকে এ দাসীটি দিন। ” ফাতেমা ফুফী হযরত যয়নাবকে বললেন ,“
ফুফী , এতিম হওয়ার পর আমাকে দাসী হিসেবে নিতে চাইছে। ” হযরত যয়নাব (আ.) তখন বললেন , না এ ফাসেক কখনোই এ ধরনের কাজ করতে পারবে না। ” তখন ঐ সিরীয় লোকটি ইয়াজিদকে জিজ্ঞেস করল ,“
এ মেয়েটি কে ?”
ইয়াজিদ বলল , এ মেয়েটি হোসাইনের কন্যা ফাতেমা এবং ঐ মহিলাটি হযরত আলীর কন্যা যয়নাব। তখন সিরীয় লোকটি বলল ,“
হে ইয়াজিদ তোর উপর খোদার লানত। তুই মহানবীর বংশধরদেরকে হত্যা করেছিস এবং তার (সা.) আহলে বাইতকে বন্দী করেছিস। খোদার কসম , আমি মনে করেছিলাম যে , এরা রোমের যুদ্ধবন্দী। ইয়াজিদ একথা শুনে ঐ সিরীয় লোকটিকে বলল ,“
খোদার শপথ , তোকেও ওদের অন্তর্ভুক্ত করব। ” এরপর ইয়াজিদের নির্দেশে ঐ সিরীয় লোকটিকে হত্যা করা হয়।
বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিতঃ ইয়াজিদ এক বক্তাকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে মিম্বার দাড়িয়ে ইমাম হোসাইন (আ.) ও হযরত আলী (আ.) কে গালি দিয়ে বক্তৃতা করতে বলে । ঐ বক্তাটি মিম্বরে উঠে হযরত আলী (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের উচ্ছসিত প্রশংসা করে । ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) প্রতিবাদ করে বললেন ,
ويْلك أيُّها الْخاطِبُ، اشْتريْت مرْضاة الْمخْلُوقِ بِسخطِ الْخالِقِ
“ হে বক্তা , তোমার জন্য আক্ষেপ , তুমি স্রষ্টার অসন্তুষ্টির বদলে এক নগণ্য সৃষ্ট জীবের সন্তুষ্টি খরিদ করছ। অতঃপর তুমি এ কাজের মাধ্যমে নিজের বাসস্থান জাহান্নামের আগুনেই নির্ধারণ করে নিয়েছ।
ইবনে সিনান খাফফাজী কত সুন্দর ভাষায় শেরে খোদা হযরত আলী (আ.) এর প্রশংসা করেছেনঃ
أعلى الْمنابِرِ تُعْلِنُون بِسبِّهِ
|
|
و بِسيْفِهِ نُصِبتْ لكُمْ أعْوادُها
|
তোমারা মিম্বারে আরোহণ করে আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীকে (আ.) গালি দিচ্ছো ? অথচ মিম্বরসমূহ তারই তরবারীর বদৌলতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (হযরত আলী অমিত বীরত্ব সহকারে মহানবীর পাশে দাড়িয়ে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং তাদেরকে পরাস্ত করেছেন। তার ত্যাগ-তিতিক্ষার কারণে ইসলামের বিজয় অর্জিত হয়েছে। মসজিদসমূহ আবাদ হয়েছে। আর এখন তোমরা তারই বিরুদ্ধে কথা বলছো , তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছো) ।
ওই দিনই ইয়াজিদ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর কাছে তার তিনটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করল। এরপর ইয়াজিদের নির্দেশে আহলে বাইতকে এমন এক গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয় যেখানে তারা শীত ও তাপে কষ্ট পেতে থাকেন। সেখানে তাদের অবস্থান করার ফলে তাদের বদনমণ্ডল ফেটে গিয়েছির। তারা যত দিনই দামেশকে ছিলেন ততদিন ইমাম হোসাইন (আ.) এর জন্য শোক ও আহাযারী করেছিলেন।
হযরত সাকীনার (আ.) স্বপ্ন
হযরত সাকীনা (আ.) থেকে বর্ণিতঃ দামেশকে চারদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমি আকটি স্বপ্ন দেখি। অতঃপর তিনি দীর্ঘ স্বপ্নটি বর্ণনা করলেন এবং শেষে বললেন ,“
স্বপ্নে দেখলাম একজন মহিলা হাওদায় মাথায় হাত রেখে বসে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ,“
মহিলাটি কে/”
তখন আমাকে বলা হল ,“
ইনি হযরত মুহাম্মদের (সা.) কন্যা ফাতেমা এবং তোমার পিতামহী। ” আমি একথা শুনে বললাম ,“
খোদার শপথ , আমি তার কাছে যাব এবং আমাদের প্রতি যে অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছে তা তাকে আমি জানাব। ” অতঃপর আমি দ্রুত তার কাছে গেলাম এবং তার সামনে দাড়ালাম এবং তাকে কেদে বললাম ,
يا أُمّتاهُ جحدُوا و اللّهِ حقِّنا، يا أُمّاهُ بدّدُوا و اللّهِ شمْلنا، يا أُمّتاهُ اسْتباحُوا و اللّهِ حريمنا، يا أُمّتاهُ قتلُوا و اللّهِ الْحُسيْن أبانا
পরিবারকে ধ্বংস করা হয়েছে আমাদের মান-সম্ভমের উপর আঘাত হানা হয়েছে , আমাদের পিতা হোসাইনকে (আ.) হত্যা করা হয়েছে। ” আমার একথা শুনে তিনি (সা.) বললেন ,“
সাকীনা আর বলিসনে দাদু। তোর কথা শুনে আমার হৃদপিণ্ডের ধমনী ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এ জামাটি তোমার পিতা হোসাইনের। আমি এ জামাটি নিয়ে কাল কিয়ামত দিবসে খোদার দরবারে ফরিয়াদ করব। ” ইবনে লাহীয়াহ , আবুল আসওয়াদ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণনা করেছেন ,“
রাসূল জালুত(এক ইয়াহুদীর নাম) আমাকে দেখে বলল ,“
খোদার শপথ আমি হযরত দাউদের (আ.) ৭০তম অধঃস্তন পুরুষ। ইহুদীরা আমাকে দেখলেই অত্যন্ত সম্মান করে। আর তোমরা মুসলমারা তোমাদের নবী (সা.) ও তার দৌহিত্রের মধ্যে কেলমাত্র এক পুরুষের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তার (সা.) বংশধরদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছ । ”
রোম সম্রাটের দূতের কাহিনী
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) থেকে বর্ণিতঃ ইমাম হোসাইনের (আ.) পবত্রি মস্তক পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের সামনে আনা হলে সব সময় সে মদপানের আসর বসাত এবং ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মস্তক ইয়াজিদের সামনে রাখা হত। কোন একদিন রোম সম্রাটের দূত ইয়াজিদের উক্ত আসরে আসল এবং বলল ,“
আরব জাহানের সম্রাট , এ মাথাটি কার ? ইয়াজিদ বলল , এ ব্যাপারে তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ ? দূত বলল , আমি যখন রোম সম্রাটের কাছে উপস্থিত হব তখন আপনার সাম্রাজ্যে আমি যা দেখেছি সে সম্পর্কে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। আর আমি এ মস্তক এবং যার এ মস্তক তার সম্পর্কেও সম্রাটকে জানানোর ইচ্ছা করছি যাতে করে তিনিও (সম্রাট) আপনার সাথে আপনার এ বিজয় ও আনন্দে শরীক হতে পারেন। ” ইয়াজিদ তখন দূতকে বলল , এ মাথা হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিবের। দূত জিজ্ঞেস করল ,“
ইনার মা কে ?”
তখন ইয়াজিদ বলল , হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) । তখন রোমান সম্রাটের দূত বলল ,“
আপনার ও আপনার ধর্মের জন্য আক্ষেপ , আমার ধর্ম আপনার ধর্মাপেক্ষা উত্তম। কারণ আমার পিতা হযরত দাউদের (আ.) বংশধর। আমার বাবা ও তার (আ.) মাঝে অনেক পুরুষের ব্যবধান হওয়া সত্ত্বেও খ্রীষ্টানরা আমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে এবং তারা আমার পায়ের মাটি তাবাররুক হিসেবে নিয়ে যায়। কিন্তু আপনারা আপনাদের নবীর দৌহিত্রকে হত্যা করেছেন। অতচ তার ও নবীর (সা.) মাঝে কেবলমাত্র এক পুরুষের ব্যবধান । কেমন আপনাদের ধর্ম ?”
এরপর সে ইয়াজিদকে বলল ,“
আপনি হাফেরবা খুরের গির্জার কথা শুনেছেন ?”
ইয়াজিদ বলল ,“
আচ্ছা বল তো দেখি। ” ঐ খ্রীষ্টান দূতটি বলল ,“
ওমান ও চীনের মাঝে এমন এক সাগর রয়েছে যা অতিক্রম করতে এক বছর লাগে। আর ঐ সমুদ্রের কেন্দ্রস্থলে একটি মাত্র শহর ছাড়া আর কোন জনবসতি সেখানে নেই। ঐ শহরের আয়তন ৮০ বর্গ ফারসাং। ঐ শহরটির মত অতবড় শহর পৃথিবীতে আর নেই। ওখান থেকে ইয়াকুত পাথর এবং কর্পূর অন্যান্য দেশে রপ্তানী করা হয় এবং উদ ও আম্বর হচ্ছে সেখানকার প্রধান উদ্ভিদ । এ শহর খ্রীষ্টানদের নিয়ন্ত্রণে এবং খ্রীষ্টান সম্রাট ছাড়া সেখানে আর কারো শাসন কর্তৃত্ব চলে না। সেখানে অনেক গীর্জা আছে। ঐ গীর্জার মেহরাবে একটি স্বর্ণ নির্মিত হুক্কা রয়েছে এবং তাতে একটি খুর রয়েছে। এ ব্যাপারে জনশ্রুতি রয়েছে যে , উক্ত খুরটি যে গাধার পিঠে হযরত ঈসা (আ.) চড়তেন সে গাধাটির। ঐ হুক্কার চারপাশে রেশমী কাপড় দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। প্রতি বছর দূর দূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত খ্রীষ্টান ঐ গীর্জা যিয়ারত করতে আসে। তারা ঐ হুক্কার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে এবং ওটিতে চুমো দেয়। সেখানে তারা মহান আল্লাহর কাছে মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। খ্রীষ্টান-নাসারারা এ ধরনের আচরণ করে আর ঐ খুর সম্পর্কে তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে , এটা ঐ গাধার খুর যার উপর হযরত ঈসা (আ.) সওয়ার হতেন। আর তোমরা মুসলমানেরা নিজেদের নবীর দৌহিত্রকে হত্যা কর।
فلا بارك اللّهُ فيكُمْ و لا فى دينِكُمْ
মহান আল্লাহ তোমাদেরকে কখনো যেন মঙ্গল না দেন। ইয়াজিদ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলল ,“
এ খ্রীষ্টানটিকে হত্যা কর ; এ কিনা আমাকেই আমার সাম্রাজ্যের মধ্যে অপদস্ত করেছে। এর স্পর্ধা তো কম নয়। ” ঐ খ্রীষ্টানটি যখন বুঝতে পারল যে , তাকে হত্যা করা হবে তখন সে ইয়াজিদকে বলল ,“
আমাকে আপনি কি হত্যা করবেন ?”
ইয়াজিদ বলল ,“
অবশ্যই ” । তখন ঐ খ্রীষ্টানটি ইয়াজিদকে বলল , তাহলে আপনি জেনে রাখুন যে , গতরাতে আমি আপনাদের নবীকে (সা.) স্বপ্নে দেখেছি। তিনি আমাকে বলছিলেন ,“
হে খ্রীষ্ট যুবক , তুমি বেহেশতী হবে। ” এ ধরনের সুসংবাদে আমর বিস্ময়ের সীমা ছিল না এবং আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি এখন সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,“
আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার রাসূল। ” এরপর ঐ খ্রীষ্টান লোকটি হোসইন (আ.) এর পবিত্র মাথা তুলে বুকে লাগাল , চুম্বন করল এবং নিহত হওয়া পর্যন্ত কাদতে লাগল।
মিনহালের ঘটনা
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) একদিন বাইরে বের হলেন এবং দামেশকের বাজারের ভিতরে হাটছিলেন। মিনহাল বিন আমর তার সামনে এগিয়ে এসে বলল ,
كيْف أمْسيْت يابْن رسُولِ اللّهِ؟
“ হে মহানবীর (সা.) সন্তান , সিরিয়ায় আপনাদের দিনকাল কেমন কাটছে ? তিনি (আ.) বললেন ,
أمْسيْنا كمِثْلِ بنى اسْرائيل فى آلِ فرْعْون
“ ফেরআউন বংশীয়দের মাঝে বনী ইসরাইল যেমনিভাবে দিন কাটাত আমরাও তেমনিভাবে (উমাইয়া বংশীয়দের মাঝে) দিন কাটাচ্ছি (অর্থাৎ ফেরআউন বংশীয়রা বনী ইসরাইলেন পুরুষদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেকে জীবিত রাখত) । হে মিনহাল , আরবরা অনারবদের উপর গর্ব করে বলে ,“
হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের স্ব-গোত্রীয়। আর আমরা তারই আহলে বাইত। কিন্তু আমাদের থেকে আমাদের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমাদেরকে হত্যা ও ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে।
فانّا لِلّهِ و انّا اليْهِ راجِعُون مِمّا أمْسيْنا فيهِ يا مِنْهالُ
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি আর তারই কাছে ফিরে যাব) কবি কত সুন্দর বলেছেন।
মহানবীর (সা.) সম্মানার্থে যারা তার মিম্বরের কাঠগুলোকে সম্মান করে অথচ তারাই তার (সা.) বংশধরদেরকে পিষ্ট করে মারছে। কোন আইনে মহানবী (সা.) এর বংশধরেরা তোমাদেরকে অনুসরণ করবে ? অথচ মহানবীর সঙ্গী-সাথী ও অনুসরণকারী হওয়ার কারণেই তো তোমাদের গৌরব।
يُعظِّمُون لهُ أعواد مِنْبرِهِ
|
|
و تحْت أقْدامِهِمْ أوْلادُهُ وُضِعُوا
|
بِ أىِّ حُكْمٍ بنُوهُ يتْبعُونكُمْ
|
|
و فخْرُكُمْ أنّكُمْ صحْبٌ لهُ تُبّعُ
|
একদিন , ইয়াজিদ আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) ও আমর ইবনুল হোসাইনকে ডেকে পাঠাল। আমরের বয়স তখন এগারো বছর ছিল। ইয়াজিদ আমরকে বলল ,“
তুমি কি আমার ছেলে খালেদের সাথে মল্লযুদ্ধ করবে ?”
তখন আমর ইয়াজিদকে বললেন ,“
না , তবে আমাকে ও তোমার ছেলে খালেদকে তলোয়ার দাও। আমরা যুদ্ধ করব। ” একথা শুনে ইয়াজিদ বলল ,“
পিতার রক্তধারা সন্তানদের মাঝে বহমান। তাই পিতার মত সন্তানরাও হয়(সাপের বাচ্চা সাপই হয়) । ”
شِنْشِنةٌ أعْرِفُها مِنْ أخْزمِ
|
|
هلْ تلِدُ الْحيّةُ الاّ الْحيّة
|
অতঃপর ইয়াজিদ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) কে বলল ,“
তোমার তিনটি মনস্কামনা পূরণ করার যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম তা আমি পূরণ করব। এখন তুমি সেগুলো একে একে বল। তখন ইমাম (আ.) বললেন ,
প্রথমতঃ আমার পিতা হোসাইনের কর্তিত মাথা আমাকে ফিরিয়ে দাও। আমি তার সুন্দর বদনমণ্ডল দেখতে চাই।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের যে সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে তা আমাদের কাছে ফেরত দেয়া হোক।
তৃতীয়তঃ যদি আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক তাহলে একজন বিশ্বস্ত লোকের সাথে নবীবংশের বন্দী মহিলাদেরকে মদীনায় পাঠিয়ে দিও।
ইয়াজিদ এ কথা শুনে বলল.“
পিতার মুখ কখনো দেখতে পাবে না। আমি তোমাকে হত্যা করব না। একমাত্র তুমি ব্যতীত আর কেউ মহিলাদেরকে মদীনায় নিয়ে যাবে না। তবে যে সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে তার বদলে অনেক গুণ বেশী দামের ধন-সম্পদ আমি তোমাদেরকে দেব। ” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তখন বললেন ,“
তোমার ধনসম্পদের এক কানা কড়িও আমাদের দরকার নেই। তোমার ধনসম্পদ থেকে আমাদেরকে কিছু দিতে হবে না। আমরা কেবল আমাদের লুন্ঠিত সম্পদগুলোই চাচ্ছিলাম। কারণ হযরত ফাতেমা (আ.) এর জামা , স্কার্ফ , হলার হার ও কামিজ ঐ সব লুন্ঠিত সম্পদের মধ্যে আছে। ” তখন ইয়াজিদ ঐ সব লুন্ঠিত নিয়ে আসার আদেশ দিল । সে ঐ সম্পদগুলো ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-কে ফেরৎ দিল এবং তাকে আরো দুশো দিরহাম দিল। ইমাম যয়নুল আবেদীন ঐ দু’
শো দিরহাম ফকির মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। অতঃপর ইয়াজিদ বন্দী ইমাম পরিবারকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার আদেশ দিল। তবে ইমাম হোসাইনের পবিত্র মাথা মোবারক সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে , ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র মাথা কারবালায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং পবিত্র দেহের সাথে মাথাও দাফন করা হয়েছিল। এতদসংক্রান্ত অনেক বর্ণনা রয়েছে। তবে এ পুস্তিকার স্বল্প পরিসরে এগুলো সব বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
নবী পরিবারের পুনরায় কারবালায় গমন
ইমাম হোসাইনের পরিবার যখন ইরাকে প্রবেশ করলেন , তখন তারা কাফেলার পথ প্রদর্শককে বললেন ,“
আমাদেরকে কারবালার উপর দিয়ে নিয়ে যাও। ” যখনই তারা কারবালায় পৌছালেন তখন সেখানে হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.) , একদল বনী হশিম এবং নবী পরিবারের কয়েকজন পুরুষের সাথে তাদের সাক্ষাত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে , হযরত জাবির (রা.) , বনী হাশিমের ঐ দল এবং নবী পরিবারের পুরুষ ব্যক্তিরা কারবালায় ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র সমাধি যিয়ারত করতে এসেছিলেন । সবাই কান্না কাটি করতে লাগল এবং শোকে-দুঃখে মুখ চাপড়াতে লাগলেন। তারা কারবালায় এমনভাবে মাতম করছিলেন যা দেখে এমন কোন হৃদয় নেই যা শোকানলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়নি। কারবালার আশে পাশে যে সব আরব বেদুইনরা বসবাস করত তাদের মহিলারাও সেখানে মাতম ও শোক করার জন্য জড়ো হয়েছিল। এভাবে সেখানে অনবরত
কয়েকদিন শোকানুষ্ঠান চলতে থাকে।
আবু হাব্বাব কলবী থেকে বর্ণিতঃ একদল চক ও কড়িমাটি সংগ্রহকারী বর্ণনা করেছেঃ আমরা এক রাতে হাব্বাহ নামক একটি স্থানে যাচ্ছিলাম। সে সময় আরা সবাই শুনতে পেলাম যে , জ্বীনরা ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্য বিলাপ করে চলছেঃ
مسح الرّسُولُ جبينهُ
|
|
فلهُ بريقٌ فِى الْخُدُودِ
|
أبْواهُ مِنْ علْيا قُريْشٍ
|
|
جدُّهُ خيْرُ الْجُدُودِ
|
ইমাম হোসাইনের কপালে চুম্বন করতেন রাসূল (সা.)
তার (ইমামের)গালে রয়েছে রাসূলের চুম্বনের ঔজ্জ্বল্য ,
হোসাইনের পিতা মাতা ছিলেন রাসূলের কুরায়শ
এবং তার মাতামহ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মাতামহ ;
আহলে বাইত (আ.) যখন মদীনার নিকটবর্তী হলেন
কারবালা থেকে নবী পরিবার (আ.) মদীনা পানে রওয়ানা হলেন। বশীর বিন জাযলাম থেকে বর্ণিতঃ মদীনার নকটবর্তী হওয়া মাত্রই যয়নুল আবেদীন (আ.) সওয়ারী থেকে নেমে পড়লেন , তাবু টানান হল এবং মহিলারাও সওয়ারী থেকে নামলেন । তখন ইমাম বললেন ,“
হে বশীর , খোদা তোমার পিতাকে ক্ষমা করুন। তোমার পিতা কবি ছিলেন। তুমি কি কবিতা রচনা করতে পার ?”
বশীর তখন বললঃ“
জ্বী হ্যাঁ , আমিও একজন কবি। ” ইমাম একথা শুনে বশীরকে বললেন , মদীনায় গিয়ে জনগণকে আবু আবদিল্লাহ ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের সংবাদ জানাও। ” বশীর এরপর বলেছেন ,“
আমি (ইমামের নির্দেশে) ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অতিদ্রুত মদীনায় পৌছালাম। আমি মসজিদে নববীতে পৌছে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে করতে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করলামঃ
يا أهْل يثْرِب لا مُقام لكُمْ بِها
|
|
قُتِل الْحُسيْنُ ف أدْمُعى مِدْرارُ
|
ألْجِسْمُ مِنْهُ بِكرْبل أ مُضرّجٌ
|
|
و الرّ أسُ مِنْهُ على الْقناةِ يُدارُ
|
“
হে মদীনাবাসীরা এরপর আর মদীনায় থেকো না। কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে শহীদ করা হয়েছে। আর তার শাহাদতের কারণে আমার চোখ দিয়ে যেন বৃষ্টির মত অশ্রু ঝরছে। রক্তে রঞ্জিত ইমাম হোসাইনের (আ.) পবিত্র দেহ কারবালায় আর তার পবিত্র মাথা বর্শাগ্রে গেথে শহর থেকে শহরে ঘুরানো হচ্ছে। ” এরপর আমি বললাম ,“
হে মদীনাবাসীরা , আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) ফুপু ও বোনদের সহকারে তোমাদের কাছে এবং মদীনার দেওয়ালের পশ্চাতেই অবস্থান করছেন। আমি তার প্রেরিত দূত। আমি তোমাদেরকে তার আবস্থানস্থল নির্দেশ করব। আমার এ কথায় মদীনার সব মহিলাও তাবু ছেড়ে বেরিয়ে এসে“
ওয়া ওয়াইলা , ওয়া সাবুরাহ ” বলে উচ্চস্বরে বিলাপ করতে লাগল।
আমি ঐ দিনের বিলাপকারীদের মত এত অধিকসংখ্যক বিলাপকারী আর কোন দিন দেখিনি। ঐ দিনের ন্যায় আর কোন দিবসই মুসলমানদের জন্য এত তিক্তকর ছিল না। আমি ঐ দিন একজন মহিলাকে ইমাম হোসাইন (আ.) এর জন্য কাদতে এবং শোক প্রকাশ করতে দেখেছি। সে বলছিলঃ
نعى سيِّدى ناعٍ نعاهُ ف أوْجعا
|
|
ف أمْرضنى ناعٍ نعاهُ ف أفْجعا
|
و عيْنىّ جُودا بِالدّذمُوعِ و اسْكِبا
|
|
وجُودا بِدمْعٍ بعْد دمْعِكُما معا
|
على منْ دهى عرْش الْجليلِ فزعْزعا
|
|
و أصْبح الدّينِ والْمجْدِ أجْدعا
|
على ابْنِ نبِيِّ اللّهِ و ابْنِ وصِيِّهِ
|
|
و انْ كان عنّا شاحِط الدّارِ أشْسعا
|
“
দূত এসে আমাকে আমার নেতা ও মওলা (আ.) এর শাহাদতের সংবাদ দিয়েছে। আর এ সংবাদ মুনে আমার অন্তর ব্যথা বেদনায় ভরে গেছে এবং আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। হে আমার নয়নযুগল , অশ্রুপাতের ক্ষেত্রে উদার হও এবং বার বার অশ্রু ঝরাতে থাক ঐ পুণ্যাত্মার জন্য যার মুসিবত খোদার আরশকেও করেছে প্রকম্পিত। তাকে (আ.) শহীদ করার মধ্য দিয়ে ধার্মিকতা ও মান-সম্ভ্রমকেও কর্তন করা হয়েছে। মহানবী (সা.) এর দৌহিত্র এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)-এর সন্তান হোসাইনের জন্য অশ্রুপাত করতে থাক যিনি এ নগরী থেকে বহু দূরে চলে গেছেন। ”
এ শোকগাথা আবৃত্তি করার পর ঐ মহিলা বলতে লাগল ,“
এ শোক সংবাদ বহনকারী হে দূত তুমি আমাদের দুঃখ-কষ্টকে ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের কারণে তাজা করে দিয়েছে এবং আমাদের অন্তরের ক্ষতসমূহ যা এখনও সেরে ওঠেনি তাতে আরো নতুন করে তাতে আরো ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তুমি কে হে দূত ?”
আমি তখন বললাম ,“
আমি বশীর বিন খাযলাম। আমাকে মওলা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) পাঠিয়েছেন। বশীর থেকে বর্ণিতঃ মদীনাবাসীরা আমাকে রেখেই অতিদ্রুত মদীনার বাইরে চলে আসল। আমি ঘোড়ায় চড়ে ওখানে এলাম। দেখলাম রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য । তিল ডরিমাণ জায়গা খালি নেই। ঘোড়া থেকে নেমে মানুষের কাধ ডিঙ্গিয়ে একদম তাবুর কাছে পৌছে গেলাম। ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তাবুর ভিতরে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি তাবুর বাইরে আসলেন। তার হাতে একটি রুমাল ছিল যা দিয়ে তিনি অশ্রু মুছছিলেন। তার পেছনে পেছনে একজন খাদেম একটি চেয়ার আনল। তিনি ঐ চেয়ারটির উপর বসলেন। কিন্তু তার দু’
চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রুপাত হচ্ছিল। চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। মহিলা ও দাসীদের ক্রন্দনধ্বনি তীব্র হয়ে উঠল। জনতা ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) কে সান্তনা দিতে লাগল। তবে ঐ স্থান জুড়ে কান্নাকাটিই চলছিল।
মদীনার উপকন্ঠে ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) ভাষণ
এ সময় ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) সবাইকে নীরবতা অবলম্বন করতে বললেন। লোকেরা কান্না থামাল। তিনি ভাষণে বললেনঃ
فقال: ( ألْحمْدُ لِلّهِ ربِّ الْعالمين، الرّحْمنِ الرّحيمِ، مالِكِ يوْمِ الدّينِ، بارِى ءِ الْخلائِقِ أجْمعين، الّذى بعْد فارْتفع فى السّمواتِ الْعُلى ، و قرُب فشهِد النّجْوى ، نحْمدُهُ على عظائِمِ الامُورِ، و فجائِعِ الدُّهُورِ، و ألمِ الْفواجِعِ، و مضاضةِ اللّواذِعِ، و جلِيلِ الرُّزْءِ، و عظِيمِ الْمصائِبِ الْفاظِعةِ الْكاظّةِ الْفادِحةِ الْجائِحةِ. أيُّها الْقوْمُ، انّ اللّه و لهُ الْحمْدُ ابْتلانا بِمصائِب جليلةٍ، و ثُلْمةٍ فى الاسْلامِ عظيمةٍ: قُتِل أبُو عبْدِ اللّهِ الحسين ع و عِتْرتُهُ، و سُبِى نِساؤُهُ و صِبْيتُهُ، و دارُوا بِر أسِهِ فى الْبُلْدانِ مِنْ فوْق عامِلِ السِّنانِ، و هذِهِ الرّزِيّةُ الّتى لا مِثْلُها رزِيّةُ. أيُّها النّاسُ، ف أيُّ رِجالاتٍ مِنْكُمْ يُسِرُّون بعْد قتْلِهِ؟! أمْ أىٍُّّ فُؤ ادٍ لا يحْزُنُ مِنْ أجْلِهِ أمْ أيّةُ عيْنٍ مِنْكُمْ تجْبسُ دمْعها و تضِنُّ عنْ انْهِمالِها؟! فلقدْ بكتِ السّبْعُ الشِّدادُ لِقتْلِهِ، وبكتِ الْبِحارُ بِ أمْواجِها، والسّمواتُ بِ أرْكانِها، و الارْضُ بِ أرْجائِها، و الاشْجارُ بِ أغْصانِها، والْحِيتانُ و لُججِ الْبِحارِ، و الْملائِكةُ الْمُقرّبُون و أهْلُ السّمواتِ أجْمعُون. أيُّها النّاسُ، أىُّ قلْبٍ لا ينْصدِعُ لِقتْلِهِ؟! أمْ أىُّ فُؤ ادٍ لا يحِنُّ اليْهِ؟! أمْ أىُّ سمْعٍ يسْمعُ هذِهِ الثُّلْمة الّتى ثُلِمتْ فى الاسلام و لا يُصمُّ؟! أيُّها النّاسُ، أصْبحْنا مطْرودين مُشرّدين مذُودين شاسِعين عنِ الامْصارِ، ك أنّنا أوْلادُ تُرْكٍ أوْ كابُل، مِنْ غيْرِ جُرْمٍ اجْترمْناهُ، و لا مكْرُوهٍ ارْتكبْناهُ، و لا ثُلْمةٍ فى الاسْلامِ ثلمْناها، ما سمِعْنا بِهذا فى آبائِنا الاوّلين، انْ هذا الاّ اخْتِلاقُ. و اللّهِ، لوْ أنّ النّبِىّ تقدّم اليْهِمْ فى قِتالِنا كما تقدّم اليْهِمْ فى الْوِصايةِ بِنا لما زادُوا على ما فعلُوا بِنا، فانّا لِلّهِ و انّا اليْهِ راجِعُون، مِنْ مُصيبةٍ ما أعْظمها و أوْجعها و أفْجعها و أكظّها و أفْظعها و أفْدحها، فعِنْد اللّهِ نحْتسِبُ فيما أصابنا و أبْلغ بِنا، انّهُ عزيزُ ذُو انْتِقامِ
“ ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি ইহকাল ও পরকালের প্রভু , মহান বিচার দিবসের অধিপতি এবং সব কিছুর স্রষ্টা। ঐ আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যার সত্তাকে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতে অক্ষম এবং সকল গুপ্ত বিষয় ও রহস্য তার কাছে উন্মোচিত ও প্রকাশিত। কালের সমস্যা , দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা বড় বড় বিপদাপদ , কঠিন আাঘাত , ঘাত প্রতিঘাত এবং বেদনার সময়ও ঐ মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি (অর্থাৎ সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তিনি প্রশংসনীয়) । হে লোকসকল , ঐ খোদার প্রশংসা করছি যিনি ইসলামের উপর আপতিত বড় বড় মুসিবত ও বিপদাপদের মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করেছেন। নিশ্চয়ই আবু আব্দুল্লাহ ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তার বংশধরদেরকে হত্যা করা হয়েছে , তার স্ত্রী , কন্যা ও আত্মীয়াদেরকে বন্দী করা হয়েছে। তার পবিত্র মাথঅ বর্শাগ্রে বেধে শহর থেকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা এমনই এক বিপদ যার তুল্য দ্বিতীয়টি আর নেই। হে লোকসকল , এ ঘটনার পর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি হাসিখুশী থাকতে পারবে ? সে কোন হৃদয় যে এ মহাঘটনায় ব্যথিত ও দুঃখভারাক্রান্ত হবে না ? সে কোন নয়ন যা অশ্রুপাত করবে না অথচ সাত আসমান হোসাইন (আ.) এর জন্য কাদেছে , সাগরসমূহ তরঙ্গ তুলে ক্রন্দন করেছে , আকাশের স্তম্ভসমূহ শোকে-দুঃখে গর্জন করে উঠেছে এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তও ক্রন্দন করেছে। আরো ক্রন্দন করেছে গাছের ডাল-পালাসমূহ , মৎস , সমুদ্রের ঢেউমালা , নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারা। সকল আকাশবাসী এ মহা বিপদে শোক করেছে , বিলাপ করেছে। হে লোকসকল , এমন কোন হৃদয় আছে কি যা হোসাইনের (আ.) প্রতি এখনও আকৃষ্ট হয়নি ? ইসলামের উপর আপতিত চরম সংকটের কথা শোনার মত ক্ষমতা কারো আছে কি ? হে লোকেরা , আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে এবং এমনভাবে আমাদেরকে শহর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে যেন আমরা তুর্কিস্থান ও কাবুলের বিধর্মী যুদ্ধবন্দী। অথচ আমরা তো কোন পাপ করিনি বা আমাদের দ্বারা কোন মন্দ কাজও সংঘটিত হয়নি। এমন কি আমরা ইসলাম ধর্মের কোন বিকৃতি সাধন করিনি।
খোদার কসম. মহানবী (সা.) আমাদের ব্যাপারে উম্মতকে যে সব উপদেশ প্রদান করেছেন তদস্থলে তিনি যদি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশও দিতেন তাহলে তারা আমাদের সাথে যা করেছে এর চেয়ে বেশী কিছু করতে পারত না। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আমাদের বিপদ কতবড় , কত বেদনাদায়ক , কত কঠিন কত তিক্ত। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি , যেন তিনি এমন বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার জন্য আমাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেন। কারণ তিনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর বক্তৃতা যখন শেষ হল তখন সওহান বিন সা ’ সাআহ বিন সওহান যিনি রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি উঠে দাড়িয়ে বললেন ,“
হে নবীর (সা.) দৌহিত্র , আমার চলার শক্তি রহিত হয়ে আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলাম। আর এ কারণে আমি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারিনি । ” ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) সওহানের কথা গ্রহণ করলেন , তাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং সওহানের পিতা সা ’ সাআর জন্য দোয়া করলেন।
মদীনার বাড়ীঘরের অবস্থা
এরপর ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) নিজ পরিবার-পরিজন সহকারে মদীনায় প্রবেশ করলেন। তিনি আত্মীয় ও বন্ধুদের ঘর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে , ঘরগুলো যেন নীরবে নিথরে (যারা ঘরে বসবাস করতো তাদের জন্য) বিলাপকারিনী মহিলাদের মত কাদছে , শোক করছে। এসব বাড়ীঘর ইমাম যয়নুল আবেদীনকে (আ.) ঘরের অধিবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল এবং নিহতের জন্য শোক প্রকাশ করছিল।
ইমাম হোসাইনের (আ.) গৃহ ফরিয়াদ করে বিলাপ করছিল আর বলছিল ,“
হে লোকেরা যেহেতু আমি এভাবে শোক ও ফরিয়াদ করছি বলে আমাকে ক্ষমা কর। তোমরাও এ মহা বিপদের দিনে আমাকে সাহায্য কর। তারা আমার দিনরাতের সংগী , আধার রাত ও ভোর রাতের প্রদীপ , মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক , আমার শক্তি ও বিজয়ের উৎস এবং আমার চন্দ্র-সূর্য ছিলেন। তাদের মহত্ত্বের কারণে কত রাতে আমার ভীতি দূর হয়ে গেছে। তাদের অনুগ্রহ ও কৃপায় সম্মান বেড়েছে। তাদের প্রভাতী প্রার্থনা আমার কর্ণকুহরে এসে পৌছেছে। তাদের গুপ্তভেদের দ্বারা আমি সম্মানিত হয়েছি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা উদযাপন করতেন , আর এ সব অনুষ্ঠান ও সভা আমার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিত।
তাদের ফযীলত ও মহৎ গুণাবলী আমাকে মিষ্টি সৌরভে ভরপুর করে দিত। আমার শুষ্ক কাঠগুলো তাদের সদর্শনে সবুজ ও রসাল হয়ে পড়ত। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আমার থেকে যাবতীয় অমঙ্গল দূর হয়ে যেত। আমার আশাকে তারা নব নব পল্লবে বিকশিত করেছিলেন। আর আমাকে নানাবিধ বিপদাপদ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ রেখেছিলেন। প্রভাতকালে তাদেরকে পেয়ে অন্য সকল প্রাসাদ ও গ্রহের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হত। আর এ কারণে আমি গর্ববোধ করতাম , সুখী ছিলাম। তাদের সান্নিধ্যে অনেক নিরাশা আশার আলোয় পরিণত হয়েছিল। অনেক বিপদাপদ ও ভয় বা ভীতি ক্ষয়প্রাপ্ত অস্থির মত আমার অস্তিত্বের সীমারেখার মাঝে লুক্কায়িত ছিল তাদেরই বদৌলতে সেগুলো দূরীভূত হয়ে গিযেছিল। কিন্তু অবশেষে মৃত্যুর তীর তাদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করল। তারা অপরিচিত শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। মর্যাদা ও সম্মানবোধ যা তাদের জীবদ্দশায় বিদ্যমান ছিল তা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদেরকে হারিয়ে আজ উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহর বিধি-বিধানসমূহে তাদের জন্য বিলাপ করছে। হায় , ঐ পুণ্যাত্মার (হোসাইনের) রক্তপাত করা হয়েছে। হায় , পূর্ণত্বপ্রাপ্তদের সেনাদলের পতাকা আজ ভূলুন্ঠিত হযে গেছে। আজ যদি আমার সাথে মানবজাতি ক্রন্দন না করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যদি এ বিপদে শোকে প্রকাশ করার সময় আমাকে ত্যাগ করে তাহলে পুরোনো টিলা-পাহাড় এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহসমূহের দেওয়ালগুলোই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ ওগুলোও আমার মত ক্রন্দন করছে , বিলাপ করছে। আর আমার মত তারাও শোকাচ্ছন্ন এবং দুঃখভারাক্রান্ত। যদি তোমারা শুনতে পাও যে , নামায কিভাবে ঐ সব সত্যপন্থী শহীদের জন্য বিলাপ করেছে , দানশীলতা ও মহানুভবতা তাদের দর্শনপ্রার্থী এবং দর্শনের জন্য অপেক্ষমান ; মসজিদের মেহরাব তাদের বিচ্ছেদ বেদনায় ক্রন্দনরত এবং অভাবীদের অভাব তাদের দান পাওয়ার জন্য উচ্চস্বরে ফরিয়াদ করছে ; তাহলে অবশ্যই এসব ফরিয়াদ শুনে তোমরাও শোকাচ্ছন্ন ও দুঃখভারাক্রান্ত হতে এবং জানতে পারতে যে এ মহাবিপদে তোমরা দায়িত্ব পালন করনি। বরং যদি তোমরা আমার একাকিত্ব ও ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে এবং তাদের বিহনে আমার সভাগুলো যে খালি , এ অবস্থা যদি দেখতে পেতে তাহলে তোমাদের মানসপটে এমন এক চিত্র ফুটে উঠত যা সহিষ্ণু হৃদয়কে দুঃখ ও বেদনায় উদ্বেলিত করে ও বক্ষকে ভারী করে দেয়। যে সব গৃহ আমার সাথে হিংসা করত , আজ তারা আমাকে ভর্ৎসনা করছে। আমার উপর যুগের বিপদাপদ জয়ী হয়েছে। হায় , অধীর আগ্রহের সাথে ঐ গৃহকে দেখতে ইচ্ছে করছে যেখানে তাদের দেহ শায়িত । হায়! আক্ষেপ , আমি যদি মানুষ হতাম এবং তলোয়ারের সামনে যদি ঢালের মত দাড়িয়ে তাদের চরণতলে নিজকে উৎসর্গ করতে পারতাম যাতে করে তারা জীবতি থাকতে পারেন। হায় , যদি আামি ঐসব শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারতাম যারা তাদেরকে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করেছে। হায় , আমি যদি তাদের কাছ থেকে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ফিরিয়ে দিতে পারতাম। অথচ আমি এ মুহূর্তে কিছুই করতে পারলাম না। হায় , যদি আমি তাদের সুকোমল দেহের বাসস্থান হতে পারতাম এবং তাদের পবিত্র দেহকে যদি রক্ষা করতে পারতাম। আহ আমি ঐ সব মহান আত্মোৎসর্গকারী পুণ্যাত্মাদের অবস্থানস্থল হতে পারতাম তাহলে সর্বশক্তি ব্যয় করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের দেহগুলোকে রক্ষা করতাম এবং তাদের পুরোনো হক বা অধিকার আদায় করে আনতাম। পাথরগুলোকে তাদের উপর পড়তে দিতাম না। তাদের সামনে অনুগত দাসের মত সব সময় উপস্থিত থাকতাম তাদের চরণতলে সম্মান ও মর্যাদার গালিচা বিছিয়ে দিতাম। তাহলে তাদের সহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য হত এবং অন্ধকারে তাদের আলো থেকে উপকৃত হতাম। আহ! এসব আশা পূরণ হওয়ার জন্য আমি কত আগ্রহী। আমার মাঝে যারা বসবাস করতেন তাদের বিরহ বিচ্ছেদে আমি জ্বলছি। আমার ফরিয়াদ অন্য সব ফরিয়াদকে ছাড়িয়ে গেছে । তারা ছাড়া আর কোন ওষুধে আমি আরোগ্য লাভ করব না। তাদেরকে হারিয়ে আমি শোকের পোশাক পরিধান করেছি। আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারছি না। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি বলছি হে শান্তিদাতা , তোমার সাথে আমার দেখা হবে রোজ হাশরের মাঠে।
মালিকশূন্য ঘরগুলো যখন কাদছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কুতাইবা কত সুন্দর বলেছেনঃ
مررْتُ على أبْياتِ آلِ مُحمّدٍ
|
|
فلمْ أرها أمْثالها يوْم حلّتِ
|
فلا يُبْعِدُ اللّهُ الدِّيار و أهْلها
|
|
و انْ أصْبحتْ مِنْهُمْ بِزعْمى تخلّتِ
|
ألا انّ قتْلى الطّفِّ مِنْ آلِ هاشِمٍ
|
|
أذلّتْ رِقاب الْمُسْلِمين فذلّتِ
|
و كانُوا غِياثا ثُمّ أضْحوا رزِيّةً
|
|
لقدْ عظُمتْ تِلْك الرّزايا و جلّتِ
|
ألمْ تر أنّ الشّمْسً أضْحتْ مريضةً
|
|
لِفقْدِ حُسيْنِ والْبِلادُ اقْشعرّتِ
|
মুহাম্মদের (সা.) বংশধরদের গৃহসমূহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঐ ঘরগুলো যখন মহানবীর (সা.) বংশধরেরা এখানে থাকতেন এখন আর নেই। মহান আল্লাহ , এ গৃহ ও এ গৃহের মালিককে রহমত থেকে বঞ্চিত না করেন। আমার ধারণায় যদিও এ ঘরগুলো মালিকবিহীন হয়ে গেছে । তোমরা জেনে রেখো যে , কারবালায় শহীদদের নিহত হওয়ার কারণে মুসলমানদের ঘাড়ে অপমানের বোঝা অর্পিত হয়েছে। আর এখন তাদের উপর আপমানের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সা.) বংশধরেরা সব সময় উম্মতের আশ্রয়স্থল ছিলেন। আর এখন তাদের উপর অর্পিত বিপদাপদই সকল বিপদাপদ অপেক্ষা ভয়ানক। তোমরা কি দেখনি যে , ইমাম হোসাইনের শাহাদাতে আকাশের সূর্য স্লান হয়ে গিযেছিল এবং পৃথিবী এ তীব্র বিপদে প্রকম্পিত হয়েছিল ?
তোমরা যে কেউ ইমাম হোসাইনের এ বিপদের কথা শুনবে যেমনিভাবে মহানবীর (সা.) বংশধরেরা শোকাভিভূত হয়েছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তোমরাও শোকাভিভূত ।
ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) ক্রন্দন
বর্ণিত আছে যে , ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হওয়া সত্ত্বেও এ মহা বিপদের সময় অত্যন্ত কাদলেন এবং তার দুঃখ-কষ্টের অন্ত ছিল না। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত আছে যে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তার পিতার কথা স্মরণ করে চল্লিশ বছর কেদেছিলেন। তিনি এ দীর্ঘ চল্লিশ বছরে দিবাভাগে রোযা রাখতেন এবং ইবাদত-বন্দেগী করে রাত কাটাতেন। ইফতারের সময় যখন তার গোলাম তার সামনে খাবার ও পানি এনে বলত ,“
প্রভু ইফতার করুন। ” তখন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলতেন-
قُتِل ابْنُ رسُولِ اللّهِ ع جائِعا، قُتِل ابْنُ رسُولِ اللّهِ عطْشانا
“ মহানবীর (সা.) দৌহিত্র (আ.)-কে ক্ষুধার্তাবস্থায় হত্যা করা হয়েছে , তাকে তৃষ্ণার্তাবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। ” তিনি বার বার এ কথা বলতেন এবং কাদতেন। যার ফলে খাবার ও পানির সাথে তার অশ্রু মিশে একাকার হয়ে যেত। তিনি আমৃত্য এ অবস্থার উপর ছিলেন।
ইমাম যয়নুল আবেদীনের (আ.) একজন দাস থেকে বর্ণিতঃ একদিন ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) মরুভূমির দিকে বের হলে আমিও তার (আ.) পিছু পিছু গেলাম। দেখলাম , তিনি একটি কঠিন পাথরের উপর কপাল রাখছেন। আমি দাড়িয়ে গেলাম ও তার কান্না শুনতে পেলাম। আমি শুনলাম তিনি এক হাজার বার
لا اله الاّ اللّهُ حقّا حقّا، لا اله الاّ اللّهُ تعبُّدا ورِقّا، لا اله الاّ اللّهُ ايمانا و تصْديقا
পড়লেন । তারপর তিনি সিজদা থেকে মাথা উঠালেন ; দেখলাম তার পবিত্র বদনমণ্ডল ও দাড়ি চোখের জলে ভিজে গেছে। আমি বললাম ,“
হে আমার (প্রভু) মওলা আপনার দুঃখের কি শেষ নেই , আপনার কান্নার কি শেষ নেই ” তিনি একথা শুনে বললেন ,“
তোমার জন্য আক্ষেপ , ইয়াকুব বিন ইসহাক বিন ইব্রাহীম নিজেও নবী ও নবী পুত্র ছিলেন। তার ১২জন সন্তান ছিল। মহান আল্লাহ তার এক পুত্রকে তার দৃষ্টিশক্তির অন্তরালে নিয়ে যান। শোক-দুঃখের ভারে তার চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল , তার কোমর বাকা হয়ে গিয়েছিল এবং অনবরত কাদার ফলে তার দু’
চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথচ তার ঐ সন্তান ঠিকই জীবিত ছিল। আর আমি স্বচক্ষে আমার পিতা , ভাই এবং আমার পরিবারের ১৭ জনকে নিহত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। তাই কি করে আমার শোক-দুঃখের অবসান হবে এবং কান্না থামবে ?
গ্রন্থ প্রণেতা বলেন-আমি ঐ সব পুন্যাত্মদের স্মরণে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করছিঃ
منْ مُخْبِرُ الْمُلْبِسينا بِانْتِزاحِهِمُ
|
|
ثوْبا مِن الْحُزْنِ لا يبْلى و يُبْلينا
|
انّ الزّمان الّذى قدْ كان يُضْحِكُنا
|
|
بِقُرْبِهِمْ صار بِالتّفْريقِ يُبْكينا
|
حالتْ لِفُقْدانِهِمْ أيّامُنا فغدتْ
|
|
سُودا وكانتْ بِهِمْ بِيضا ليالينا
|
কে কারবালার শহীদদেরকে বলবে যে ,“
তোমাদের বিরহ বিচ্ছেদে আমরা যে শোকের পোশাক পড়েছি তা কখনও পুরোনো ও ধ্বংস হবে না। বরং আমরা বৃদ্ধ ও মৃত্যুমুখে পতিত হব। এই তো সেদিন তাদের সান্নিধ্যে আমরা হাসিখুশী ছিলাম। আর এখন তাদের বিরহে আমরা কাদি। তাদেরকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে (আমাদের জীবন তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেছে) । অথচ এককালে তাদের উজ্জ্বল আলোর প্রভাবে আমাদের অন্ধকার রাতগুলো দিনের মত আলোকিত ছিল।
বইটির এখানেই সমাপ্তি। যে কেউ এ বই সম্পর্কে জ্ঞাত তারা জানেন যে , কলেবরের দিকে থেকে ছোট হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হোসইনের জীবনী ও কারবালার ইতিহাসের ক্ষেত্রে যে সব বই পুস্তক লেখা হয়েছে সেগুলো থেকে এ বইটি সর্বাধিক উন্নত।