মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 30%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25383 / ডাউনলোড: 4283
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

পর্বতমালার কাজ

পর্বতমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক কার্যাবলীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পবিত্র কোরআনের নিম্নের আয়াত :

আর আমি জমিনের উপর সুদৃঢ় পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে তাদের নিয়ে জমিন ঝুঁকে না পড়ে ; এবং আমি সেখানে প্রশস্ত প্রশস্ত রাস্তা সৃষ্টি করেছি যেন তারা গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারে। (কোরআন , ২১ : ৩১)

ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে নীচে পর্বতমালাসমূহের মূল অংশ রয়েছে। (Earth, Press and Siever, p.৪১৩)

ছকবদ্ধ অবচ্ছেদ পর্বতমালার রয়েছে পেরেকের মতো অংশ যার গভীর মূল মাটিতে প্রোথিত অবস্থায় আছে। ( Anatomy of the Earth, Cailleux, p. ২২০ )

অন্য আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে , পর্বতমালার গভীর মূলের কারণে কিভাবে পর্বতসমূহ পেরেকের মতো আকার ধারণ করে। ( Earth Science, Tarbuck and Lutgens, p.১৫৮)

ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন প্রতিরোধে পর্বতমালার যে ভূমিকা রয়েছে সেটি আমরা আয়াতটিতে খেয়াল করেছি। কোরআন যে সময়ে নাযিল হয় , তখন কেউ এ ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ভূ -বিজ্ঞানের প্রাপ্ত তথ্যসমূহের মাধ্যমে কেবলি সেদিন এ বিষয়টি প্রকাশ পেল।

এ সমস্ত তথ্যানুসারে , যে ভারী ভারী বড় প্লেটগুলো পৃথিবীর উপরের শক্ত স্তর সৃষ্টি করে , সেগুলোর নড়াচড়া আর সংঘর্ষের ফলেই উৎপত্তি ঘটে পর্বতমালাসমূহের। দুটি প্লেট যখন পরস্পর ধাক্কা খায় তখন শক্তিশালী প্লেটটি অন্য প্লেটের নীচে গড়িয়ে চলে যায় , তখন উপরের প্লেটটি বেঁকে গিয়ে পর্বত ও উঁচু উচুঁ জায়গার জন্ম দেয়। নিম্নের স্তরটি ভূমির নীচে অগ্রসর হয়ে ভেতরের দিকে এক গভীর প্রসারণের জন্ম দেয়। এর মানে পর্বতের রয়েছে দুটো অংশ , উপরে সবার জন্য দর্শনযোগ্য একটি অংশ যেমন থাকে , তেমনি নীচের দিকে গভীরে এর সমপরিমাণ বিস্তৃতি রয়েছে।

পর্বতসমূহ ভূমির উপরে ও নিম্নদেশে বিস্তৃত হয়ে পেরেকের ন্যায় ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন প্লেটকে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরে রাখে। ভূ-পৃষ্ঠের উপরের অংশ বা ক্রাস্ট অবিরাম গতিশীল প্লেট নিয়ে গঠিত। পর্বতগুলোর দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার বৈশিষ্ট্যটিই ভূ-পৃষ্ঠের উপরের স্তরকে স্থির রেখে কম্পন প্রতিরোধ করে অনেকাংশে। অথচ এই ক্রাস্টের রয়েছে গতিশীল গঠন

বিজ্ঞানের বইগুলোতে পাহাড়ের গঠন বর্ণিত হয়েছে নিম্নরূপে :

মহাদেশগুলোর যে অঞ্চলসমূহ পুরু , যেথায় সারি সারি পর্বতমালা রয়েছে , সেথায় ভূ - পৃষ্ঠের শক্ত স্তর বা ক্রাস্ট ম্যান্টলের ভেতরে গভীরে ঢুকে যায়।

একটি আয়াতে পর্বতমালার এই ভূমিকাকে পেরেকের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে :

আমি কি জমিনকে করিনি বিছানা সদৃশ ? এবং পাহাড়সমূহকে পেরেকস্বরূপ ? (কোরআন ,৭৮ : ৬৭)

অন্য কথায় পর্বতমালাগুলো ভূ-পৃষ্ঠের উপরে ও নীচে গভীরে বর্ধিত হয়ে প্লেটগুলোকে তাদেরই সন্ধি বা মিলনস্থরেল স্থিরভাবে ধরে রাখে। এভাবে তারা পৃথিবীর উপরের স্তর বা ক্রাস্টকে দৃঢ়ভাবে এঁটে রাখে আর ম্যাগমা স্তরের উপরে কিংবা প্লেটগুলোর মাঝে ক্রাস্ট এর ভেসে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে। সংক্ষেপে আমরা পর্বতমালাকে লৌহের পেরেকের সঙ্গে তুলনা করতে পারি যেগুলো কিনা কাঠের বিভিন্ন টুকরাকে একত্রে আটকে রাখে। পর্বতমালার এরূপ সেটে বা এটে ধরার কাজটি বিজ্ঞান সাহিত্যেIsostasy শব্দ দ্বারা বর্ণিত রয়েছে।Isostasy বলতে যা বুঝায় তা নিম্নরূপ :

Isostasy : মাধ্যাকষর্ন জনিত চাপের ফলে ভূ - পৃষ্ঠের নীচে সহজে বক্র হয় এমন পাথর জাতীয় জিনিষ দ্বারা পৃথিবীর ক্রাস্ট বা উপরিস্তরের - সাধারণ ভারসাম্য বজায় থাকে।

পর্বতমালার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বহু শতাব্দী পূর্বে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল যা কিনা আজ আধুনিক ভূবিজ্ঞানে ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা উন্মোচিত হয়েছে - এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞতারই উদাহ রণ।

আর আমি জমিনের উপর সুদৃশ পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে তাদেরকে নিয়ে জমিন ঝুঁকে না পড়ে ; এবং আমি সেখানে প্রশস্ত প্রশস্ত রাস্তা সৃষ্টি করেছি যেন তারা গন্তব্যস্তলে পৌছতে পারে।(কোরআন , ২১ : ৩১)

পর্বতমালার গতিশীলতা

পর্বতগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন এরা স্থির , অবিচল। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি তা নয়। আসলে প্রতিনিয়তই পর্বতমালা রয়েছে সচল , গতিশীল। এই ব্যাপারটি কোরআনের একটি আয়াতে উল্লেখিত আছে :

আর তুমি পর্বতসমূহকে দেখে অটল -অচল মনে কর , অথচ এগুলো সেদিন মেঘরাশির ন্যায় চলমান হবে। এ হল আল্লাহর সৃষ্টি নৈ পুণ্য , যিনি সবকিছুকে করেছেন সুষম -সুসংহত। তোমরা যা কিছু করছ , তিনি তা সম্যক অবগত আছেন। (কোরআন , ২৭ : ৮৮)

পৃথিবীর উপরিস্তর (Crust ) , যার উপরে পর্বতসমূহ অবস্থিত , সে স্তরের -(Crust ) নড়াচড়াই পর্বতমালার গতিশীলতার কারণ । নীচে অধিকতর পু রু আরেকটি স্তর রয়েছে যাকে বলা হয় ম্যান্টল ; ম্যান্টলের উপরে ভাসমান রয়েছে এই উপরিস্তরটি(Crust ) । এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ , যখন জার্মান বিজ্ঞানীAlfred Wegner ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে প্রথম যখন পৃথিবীর সৃষ্টি হয় , মহাদেশগুলো একত্রে সংযুক্ত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এরপর এরা ভেসে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়। আর এভাবেই নড়াচড়ার কারণে একটি আরেকটি থেকে দূরে সরে যায়।

Wegner এর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর ১৯৮০ এর দশকে ভূ -তত্ত্ববিদগণWegner এর এই প্রস্তাবটি সঠিক ছিল বলে বুঝতে পারেন। ১৯১৫ সালেWegner একটি আর্টিকলে নির্দেশ করেন যে , প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে ভূ -পৃষ্ঠের স্থলভাগসমূহ একসঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় ছিল। আর এই বৃহৎ স্থল ভাগটি পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে ছিলPangaea নামে।

প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর পূর্বেPangaea দুটি ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দিকে ভেসে চলে যায়। এদের মাঝেGondwana নামে বৃহৎ একটি মহাদেশ ছিল , যাতে বিদ্যমান ছিল আফ্রিকা , অষ্ট্রেলিয়া , এন্টার্টিকা-আর ইন্ডিয়া। দ্বিতীয় অংশটি ছিলLaurasia নামে , যেথায় অবস্থিতছিল ইউরোপ , উত্তর আমেরিকা আর ইন্ডিয়া বাদে এশিয়া। এই পৃথকীকরনের পর ১৫০ মিলিয়ন বছর ধরে Gondwana আর Laurasia ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে আলাদা হয়ে যায়।

Pangaea বিভক্তির পর আবির্ভূত এই মহাদেশগুলো ভূ - পৃষ্ঠের উপরে অবিরাম সরে যাচ্ছে , প্রতি বছরে কয়েক সেন্টিমিটার করে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর স্থল ভাগ আর সমুদ্রের অনুপাতও বদলে গিয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে চালানো গবেষণায় উদঘাটিত ভূ-পৃষ্ঠের কঠিন আবরণ ক্রাস্ট এর নড়া চড়া বিজ্ঞানীগণ নিম্নরূপে ব্যাখ্যা করেন :

Crust আরMantle এর সর্বোপরিস্থিত স্তরটি -প্রায় ১০০ কিলোমিটার পুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয় যাদেরPlate বলা হয়ে থাকে। ছয়টি বড় বড় আর কয়েকটি ছোট খাট প্লেট বিদ্যমান রয়েছে এখানে।Plate Tectonices নামক থিওরী অনুসারে এই প্লেটগুলো তাদের সঙ্গে মহাদেশ আর সমুদ্রের তলভাগ নিয়ে ভূ - পৃষ্ঠে নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। পরিমাপ করে দেখা গেছে যে , মহাদেশগুলোর এই গতি বছরে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার। প্লেটগুলো যেহেতু অবিরত চলমান রয়েছে সেহেতু পৃথিবীর ভূগোলে ধীর গতির পরিবর্তন হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রতি বছর আটলান্টিক মহাসাগর একটু একটু করে প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হচ্ছে।

এখানে এটি উল্লেখ করার মতো গুরুতপূর্ণ একটি পয়েন্ট : আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা পর্বতমালার নড়াচড়াকে চলমান বা প্রবাহিত হওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আজ আধুনিক বিজ্ঞানীগণও এই গতির জন্য মহাদেশের প্রবাহ ( continental drift ) শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

প্রশ্নাতীতভাবেই এটি কোরআনের একটি অলৌকিকত্ব। বিংশ শতাব্দীতে সম্প্রতি সেদিন যা বিজ্ঞান দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে তাই কোরআনে অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছিল।

লৌহে অলৌকিকত্ব

পবিত্র কোরআনে লৌহকে ধাতু হিসেবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা হাদীদে লৌহ সম্পর্কে আমরা যা অবগত হই তা নিম্নরূপ :-

আর আমি প্রেরণ করেছি লৌহ , যাতে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি এবং মানুষের জন্য আরো বহুবিধ উপকার। (কোরআন , ৫৭ : ২৫)

আয়াতটিতে একমাত্র লৌহের জন্য প্রেরণ করেছি শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। লৌহকে মানুষের উপকারের জন্য দেয়া হয়েছে - উপমাগতভাবে এ অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যখন আমরা বিবেচনায় আনি , যার অর্থ হলো লৌহকে বাস্তবিকই সশরীরে আকাশ থেকে নিম্নে পাঠানো হয়েছে তখন আমরা হৃদয়ংগম বা উপলব্ধি করতে পারি যে , আয়াতটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অলৌকিক ব্যাপারের ইংগিত দিচ্ছে।

কেননা আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যায় প্রাপ্ত তথ্যসমূহ উদঘাটন করেছে যে , আমাদের পৃথিবীতে প্রাপ্ত লৌহ মহাশূণ্যের বিশাল বিশাল নক্ষত্রসমূহ থেকে এসেছে।

মহাবিশ্বে বড় বড় নক্ষত্রের কেন্দ্রে ভারী ধাতুগুলো উৎপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সৌর জগতের নক্ষত্রগুলোর নিজেদের লৌহ উৎপন্ন করার মতো যথাযোগ্য গঠন নেই। সূর্যের চেয়েও বড় বড় নক্ষত্র যেখানে তাপমাত্রা কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রীতে পৌছে , সেখানেই কেবল লৌহ উৎপন্ন হতে পারে। একটি নক্ষত্রে যখন লৌহের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে ছাড়িয়ে যায় , তখন নক্ষত্রটি সে পরিমাণ আর ধারণ করে রাখতে পারে না। অবশেষে তা বিস্ফোরিত হয় এমনভাবে যাকে বলা হয় নোভা বা সুপার নোভা। এই বিস্ফোরণের ফলে লৌহ বহনকারী উল্কাগুলো বিশ্বব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় এবং তারা ততক্ষণ পর্যন্ত শূণ্যে চলাফেরা করে যতক্ষন পর্যন্ত মহাশূণ্যজাত পদার্থগুলোর মাধ্যাকষর্ন জনিত বল দ্বারা আকৃষ্ট না হয় ।

এ সবকিছু এটাই প্রমাণ করে যে , লৌহ পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়নি বরং তা মহাশূণ্যের বিস্ফোরিত নক্ষত্রগুলো হতে উল্কা দিয়ে বহন করে নিয়ে আসা হয়েছে পৃথিবীতে এবং আমরা প্রেরণ করেছি লৌহ আয়াতটিতে যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই লৌহকে পাঠানো হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে , সপ্তম শতাব্দীতে কোরআন যখন নাযিল হয় তখনকার সময় এ বিষয়টি বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায়নি।

জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি

পবিত্র মহান তিনি , যিনি জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ , মানুষ এবং তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে। (কোরআন , ৩৬ : ৩৬)

যদিও জোড়া বা যুগল শব্দটি দ্বারা পুরুষ আর নারীর জোড়াই ধারণা করা হয়ে থাকে , ...... কিন্তু তারা যাদেরকে জানে না তাদের প্রত্যেককে এ উক্তিটির আবার বিস্তৃত পরিসরের ব্যবহার অথবা ব্যাখ্যা রয়েছে। অধুনা এই আয়াতটির একটি ব্যাখ্যার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীPaul Dirac ১৯৩৩ সালে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে ,বস্তুসমূহ জোড়ায় জোড়ায় বা যুগল হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে।Parite নামের এই আবিষ্কার এটাই বলে যে , প্রতিটি বস্তুরই (Matter ) রয়েছে এর বিপরীত প্রতিবস্তু (Antimatter ) । অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুই বিপরীত গুণাবলীর প্রতিবস্তুর সঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় বা যুগলরূপে বিদ্যমান রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ,প্রতিটি বস্তুর পরমাণুর বৈশিষ্ট্যের ঠিক উল্টো বৈশিষ্ট্য বহন করে তারই প্রতিবস্তু । অর্থাৎ বস্তুর উল্টো প্রতিটি প্রতিবস্তুর রয়েছে ধনাত্মক বিদ্যুৎবাহী ইলেকট্রন আর ঋণাত্মক বিদ্যুৎবাহী প্রোটন। এক বৈজ্ঞানিক সূত্রে বিষয়টি নিম্নরূপে বর্ণিত রয়েছে :

প্রতিটি কণারই ( Particle ) বিপরীত বিদ্যুৎবাহী প্রতিকণা ( Anti-particle ) বিদ্যমান রয়েছে - আর অনিশ্চিত সম্পর্ক এটাই আমাদের বলে যে , জোড়ায় জোড়ায় বা যুগলের সৃষ্টি বা ধ্বংস শূণ্যে সকল সময় সকল স্থানে ঘটে থাকে।

সময়ের আপেক্ষিকতা

আজ সময়ের আপেক্ষিকতা একটি প্রমাণিত সত্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বছরগুলোয় এ বিষয়টি বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতার থিওরী বা তত্ত্ব (Theory of Relativity ) দ্বারা উন্মোচিত বা প্রমাণিত হয়। অথচ তখনও পর্যন্ত মানুষ জানত না যে সময় আসলে একটি আপেক্ষিক বা তুলনামূলক ধারণা আর তা পরিবেশ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আপেক্ষিকতার থিওরী দিয়ে প্রমাণ করে দেখান। তিনি প্রমাণ করেন যে , সময় ভর (mass ) আর বেগের (velocity ) উপর নিভর্র শীল। মানব জাতির ইতিহাসে এর আগে আর কেউ এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রমাণ বা প্রকাশ করতে পারেননি।

অথচ ভিন্নভাবে পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে যে , সময় আপেক্ষিক। বিষয়টি সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত যা বলে তা নিম্নরূপ :

আর তারা আপনাকে আযাব ত্বরান্বিত করার জন্য তাগাদা করছে। অথচ আল্লাহ কখনও তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। নিশ্চয় আপনার রবের কাছে একদিন তোমাদের গণনার এক হাজার বছরের সমান। (কোরআন , ২২ : ৪৭)

সময়ের ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে নিভর্র করে যে সময়টি উপলব্ধি করছে তার উপর। কোন একটি নির্দিষ্ট সময় একজনের কাছে স্বল্প সময় হিসেবে অনুভূত হতে পারে যেখানে এটিই আবার আরেকজনের কাছে মনে হতে পারে লম্বা সময়। এখানে কে সঠিক সেটি জানতে হলে ঘড়ি আর কেলেন্ডারের মতো কিছু জিনিষ রাখা দরকার। এগুলো ছাড়া সঠিকভাবে সময় নির্ণয় করা অসম্ভব।

তিনি আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন , অবশেষে তা তারঁ সমীপে এমন একদিনে পৌছাবে , যার পরিমাণ হবে তোমাদের গণনানুযায়ী হাজার বছরের সমান। (কোরআন , ৩২ : ৫)

ফেরেশতাগণ এবং রূহ আল্লাহর সমীপে আরোহণ করে যায় এমন এক দিনে , যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। (কোরআন , ৭০ : ৪)

কিছু কিছু আয়াতে নির্দেশিত রয়েছে যে , মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সময়কে উপলব্ধি করে থাকে আর কখনও কখনও খুব সংক্ষিপ্ত বা অল্প সময়কে অতি লম্বা সময় হিসেবে উপলব্ধি করে থাকে । পরকালে শেষ বিচারের দিন মানুষ যেমন ধরণের কথাবার্তা বলবে তা এটিরই একটি পরিষ্কার উদাহরণ :

আল্লাহ বলবেন : বছরের গণনায় তোমরা পৃথিবীতে কত সময় অবস্থান করেছিলে ? তারা বলবে : আমরা একদিন অথবা দিনের কিছু অংশ অবস্থান করেছিলাম। অতএব আপনি গণনাকারী ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করুন।

আল্লাহ বলবেন ; তোমরা সেখানে অল্প সময়ই অবস্থান করেছিলে যদি তোমরা তা জানতে ? (কোরআন , ২৩ : ১১২)

প্রকৃত সত্য ব্যাপারটি হলো যে ৬১০ সন থেকে নাযিল হতে থাকা কোরআনে সময়ের আপেক্ষিকতা বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে - এটি কোরআন পবিত্র গ্রন্থ হওয়ার পক্ষে আরো একটি প্রমাণ।

বৃষ্টির অনুপাত

বৃষ্টি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে প্রদত্ত তথ্যাবলীর মাঝে একটি হলো যে , পৃথিবীতে বৃষ্টি পরিমিত পরিমাণে পতিত বা বর্ষিত হয়ে থাকে। সূরা যুখরুফে এটি নিম্নরূপে উল্লেখ করা হয়েছে :

আর যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন নির্দিষ্ট পরিমাণে। তারপর আমি সে পানির সাহায্যে মৃত জমিনকে সঞ্জীবিত করি। এরূপেই তোমাদেরকে বের করে আনা হবে। (কোরআন , ৪৩ : ১১)

আধুনিক গবেষণায় বৃষ্টির পরিমিত নির্দিষ্ট পরিমাণ আবারো একবার উদঘাটিত হয়েছে। আন্দাজ করা হয়েছে যে , প্রতি সেকেন্ডে ভূ -পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ মিলিয়ন টন পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়। আর বছরে এ পরিমাণটি দাড়ায় ৫১৩ ট্রিলিয়ন টনে। আর পানি বাষ্প হওয়ার পরিমাণ প্রতি বছরে ভূ পৃষ্ঠে পতিত বৃষ্টিধারার পরিমাণের সমান। এর মানে এই দাড়ায় যে , পানি অবিরতই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে একটি সুষম চক্রের মধ্যে প্রবাহমান। পৃথিবীর জীবজগৎ এই পানি চক্রের উপরেই নিভর্র শীল। এমনকি মানুষ দুনিয়ায় সমস্ত টেকনোলজী বা প্রযুক্তি ব্যবহার করেও পানির এই চক্রটি কৃত্রিমভাবে পুণরুৎপাদন করতে সমর্থ হবে না।

এই ভারসাম্যের মাঝে ন্যূনতম পরিবর্তনও পৃথিবীর পরিবেশে মারাত্মক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্ট হবে যার ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ত্বের অবসান হতে পারে অর্থাৎ তা পৃথিবীর জীব জগতের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তা কখনও ঘটে না , কোরআনে যেমন করে বলা হয়েছে , ঠিক তেমন করেই বৃষ্টি প্রতি বছরে ঠিক একই নির্দিষ্ট পরিমানে বর্ষিত হতেই থাকে।

প্রতি বছরে যে পরিমাণ পানি বাষ্প হয়ে উবে যায় আর যে পরিমাণ পানি বৃষ্টিধারায় নেমে আসে এ দুটিরই পরিমাণ ধ্রুব বা অপরিবর্তনীয় : ৫১৩ ট্রিলিয়ন টন। কোরআনে এই পরিমাণটি ঘোষিত হয়েছে এভাবে : আর যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন নির্দিষ্ট পরিমাণে........ এই পরিমাণের নিত্যতা বা অপরিবর্তিতা পরিবেশগত ভারসাম্যের অস্তিত্বের জন্য আর এভাবে জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

বৃষ্টির উৎপত্তি

বৃষ্টি কিভাবে হয় ? এ বিষয়টি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একটি রহস্যময় ব্যাপার ছিল। কেবলি সেদিন যখন আবহাওয়া নির্ণয়ের জন্য রাডার আবিষ্কৃত হলো , তার পর পরই বৃষ্টি উৎপন্ন হওয়ার পর্যায়গুলো জানা গেল।

সে অনুসারে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় তিনটি পর্যায়ে। প্রথমতঃ বৃষ্টির কাঁচামাল বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে উপরে বাতাসে উঠে আসে , এরপর মেঘমালা উৎপন্ন হয় আর অবশেষে বৃষ্টিকণা দেখা দেয়। কোরআনে প্রদত্ত বৃষ্টি উৎপাদনের বর্ণনাটি ঠিক এ পদ্ধতিরই উল্লেখ করেছে। একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা ব্যাপারটি এভাবে বর্ণনা করেছেন :

আল্লাহ এমন সত্তা যে , তিনি বায়ু প্রেরণ করেন , অতঃপর বায়ু মেঘরাশিকে সঞ্চালিত করে ; তারপর তিনি মেঘরাশিকে যেমন ইচ্ছা আসমানের শূণ্যমন্ডলের মধ্যে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দেন , এবং কখনও তা খণ্ড বিখণ্ড করে দেন ; অতঃপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে বের হয়ে আসে বৃষ্টিধারা। তিনি যখন তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা তা পৌছিয়ে দেন , তখন তারা আনন্দ করতে থাকে। (কোরআন , ৩০ : ৪৮)

এবার চলুন আয়াতে বর্ণিত এই পর্যায়গুলো আরো প্রযুক্তিগতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখি :প্রথম পর্যায় : তিনি আল্লাহ এমন সত্ত্বা যিনি বায়ু প্রেরণ করেন সমুদ্রের ফেনায় উৎপন্ন বায়ুর অগণিত বুদবুদ বিরামহীনভাবে ফেটে গিয়ে জলীয় কণাসমূহকে আকাশের দিকে উৎক্ষিপ্ত করে। এরপর লবণে পরিপূর্ণ এই কণাগুলো বাতাসে বাহিত হয়ে উর্ধ্বে বায়ুমন্ডলে উঠে যায়। এরোসল নামের এই কণাগুলো পানির ফাঁদ হিসেবে কাজ করে আর নিজেদের চারদিকে পানি বাষ্প জড়ো করে উৎপন্ন করে মেঘকণা।

উপরের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে যে পানির কণাগুলো বাতাসে মুক্ত হচ্ছে। বৃষ্টি তৈরীর প্রথম পর্যায় এটি। এর পর নূতন তৈরী মেঘে পানি কণাগুলো বাতাসে ঝুলে থাকে আর পরে সেগুলো ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি তৈরী করে। এসবগুলো পর্যায়ই কোরআনে বর্ণিত আছে।

দ্বিতীয় পর্যায় : .......... বায়ু মেঘরাশিকে সঞ্চালিত করে তারপর তিনি মেঘরাশিকে যেমন ইচ্ছা আসমানের শূণ্যমন্ডলের মাঝে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে দেন

বাতাসে ভাসমান লবণ স্ফটিক কিংবা ধূলিকণার চারদিকের পানি কণিকা ঘনীভূত হয়ে উৎপন্ন হয় মেঘমালা। কেননা মেঘমালায় বিদ্যমান পানি কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র (.০১ -.০২মিলি মিটার ব্যাস) হওয়ায় মেঘসমূহ বাতাসে ঝুলে থাকে আর আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই মেঘে পরিপূর্ণ হয়ে ঢেকে যায় আকাশ।

তৃতীয় পর্যায় : তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে বের হয়ে আসে বৃষ্টিধারা লবণ স্ফটিক কিংবা ধূলিকণার চতুর্দিকে ঘিরে বিদ্যমান পানিকণাগুলো ঘন ও ভারী হয়ে তৈরি করে বৃষ্টির কণা। এরপর বাতাসের চেয়ে ভারী বৃষ্টিকণাগুলো মেঘ থেকে সরে আসে এবং বৃষ্টিধারা হিসেবে মাটিতে নেমে আসতে শুরু করে।

আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে , বৃষ্টি উৎপাদনের প্রতিটি ধাপই কোরআনের আয়াতসমূহে বর্ণিত রয়েছে। অধিকন্তু একদম সঠিক অনুক্রমে বা একটার পর আরেকটি পর্ব অত্যন্ত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠে বিদ্যমান অন্যান্য বিষয় বা বস্তুর ন্যায় এ বিষয়টির সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন মহান আল্লাহ তাআলা আর এভাবেই মানুষ বৃষ্টির পর্যায়গুলো উদঘাটন করার শত শত বছর পূর্বেই আল্লাহ্ তাআলা সে সম্বন্ধে মানুষকে অবগত করেন। অন্য একটি আয়াতে বৃষ্টির উৎপাদন সম্পর্কে নিম্নের তথ্যটি দেয়া হয়েছে :

তুমি কি দেখ না যে , আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। তারপর মেঘগুলোকে একত্র করেন এবং পরে তা পুঞ্জীভতূ করেন স্তরে স্তরে ; অতঃপর তুমি দেখতে পাও যে , সে মেঘের মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টি। আর তিনি আসমানস্থিত পাহাড়সদৃশ মেঘমালা থেকে বর্ষণ করেন শিলা এবং তা দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার উপর থেকে তিনি ইচ্ছা করেন তা দূরে সরিয়ে দেন। সে মেঘের বিদ্যুতের চমক এমন , যেন মনে হয় দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। ( সূরা নূর : ৪৩ )

বিজ্ঞানীগণ মেঘমালার প্রকার পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বৃষ্টির মেঘ উৎপত্তির এক বিস্ময়কর ফলাফলের মুখোমুখী হন। সুনির্দিষ্ট সিস্টেম ও পর্যায়সমূহের মধ্য দিয়ে তৈরী হয় ও আকার ধারণ করে বৃষ্টির মেঘমালা। পঞ্জু পুঞ্জ মেঘমালা এক ধরণের মেঘ যা নিম্নের পর্যায়গুলোতে ধাপে ধাপে তৈরী হয়।

১নং পর্যায় : মেঘমালাসমূহ সঞ্চালিত হয়ে থাকে বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে মেঘমালা বাহিত হয়ে থাকে।

২নং পর্যায় : সংযোগীকরণ , পুঞ্জীভূতকরণ এর পর বায়ুবাহিত ক্ষদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালা একত্রিত হয়ে তৈরি করে বৃহত্তর মেঘ।

৩নং পর্যায় : স্তুপীকৃত হওয়া বা স্তুপে স্তুপে জমা হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালা একত্রে সংযুক্ত হলে বৃহদাকার মেঘমালার মাঝেUpdraft বেড়ে যায়। এইUpdraft মেঘমালার প্রান্তভাগের চেয়ে কেন্দ্রভাগে বেশী জোরালো। এ প্রক্রিয়াতে মেঘগুলো খাড়াখাড়িভাবে বা লম্বালম্বিভাবে জমা হয়ে বাড়তে থাকে। এভাবেই মেঘমালাসমূহ স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়। মেঘের এই খাড়া বৃদ্ধি মেঘকে বায়ুমন্ডলের শীতলতর স্থানের দিকে টেনে নিয়ে যায় , সেখানেই উৎপন্ন হয় পানিবিন্দু আর শিলা এগুলোই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় আকাশে। যখন এই শিলা ও পানি বিন্দুগুলি বেশী ভারী হয় , যখন মেঘের এইUpdraft আর বহন করতে পারে না তখন মেঘ থেকে এরা মাটিতে পতিত হতে থাকে বৃষ্টি , শিলা ইত্যাদিরূপে।১০

১.পৃথক পৃথক টুকরা মেঘ।

২. মেঘগুলো যখন সংযুক্ত হয় তখন এদের ভিতরে Updraft বৃদ্ধি পায়। বৃহদাকারের মেঘ বাড়তে থাকে আর মেঘমালাসমূহ স্তুপীভূত হয়।

মেঘের Updraft এর ফলে স্তরে স্তরে মেঘমালা লম্বালম্বিভাবে বৃদ্ধি পায়। লম্বালম্বি বৃদ্ধির ফলে মেঘদেহটিকে বায়ুমন্ডলের অধিকতর ঠান্ডা অঞ্চলে টেনে নিয়ে যায় যেখানে বৃষ্টি কণা , শিলাবৃষ্টি তৈ রি হতে থাকে , বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন বৃষ্টিকণা আর শিলাবৃষ্টি অতিরিক্ত ভারী হয়ে যায় তখন মেঘের এই Updraft আর মেঘমালাসমূহকে ধারণ করতে না পারায় মেঘগুলো হতে বৃষ্টি , শিলাবৃষ্টি নীচে পতিত হতে থাকে। ১৪০০ বছর আগে পবিত্র কোরআনে সূরা নূরের ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছিলেন , .....তারপর মেঘগুলোকে একত্র করেন এবং পরে তা পুঞ্জীভূত করেন স্তরে স্তরে : অতঃপর তুমি দেখতে পাও যে সে মেঘের মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টি।

প্লেন , উপগ্রহ. কম্পিউটার এমনতর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবহাওয়াবিদগণ কেবলি অতি সম্প্রতি মেঘ উৎপাদন , গঠন আর কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন-এ বিষয়টি আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখা উচিত। এটি স্পষ্ট যে , আল্লাহ এমন একটি তথ্য দিয়েছেন যা ১৪০০ বছর পূর্বে মানুষের জানা ছিল না।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘমালাসমূহ (পুঞ্জীভূত মেঘমালা) বায়ু প্রবাহের মাধ্যমে বাহিত হয়ে সংযুক্ত হয় যা নীচের আয়াতটিতে বর্ণিত রয়েছে : ..... আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন। তারপর মেঘগুলোকে একত্র করেন এবং পরে তা পুঞ্জীভূত করেন স্তরে-স্তরে......... ।

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।

স্রষ্টার বাইরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নেই

এখানে প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা প্রয়োজন যে , আমরা বাস্তব জগতে যা কিছু সৃষ্টি করি সে ক্ষেত্রে আসলে আমরা সৃষ্টি করি না , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটাই মাত্র। আমাদের বাস্তব সৃজনক্ষমতার প্রয়োগের বা সৃষ্টিকর্ম সম্পাদনের স্বরূপ হচ্ছে এই যে , আমরা যা কল্পনা করি তার ভিত্তিতে বাস্তব জগতে বিরাজমান সৃষ্টিতে রূপান্তর ঘটিয়ে তার (কল্পনার) অনুরূপ করি মাত্র। কিন্তু প্রকৃত সৃষ্টি তা-ই যা বিদ্যমান উপাদান ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়। অতএব , আমরা যা কল্পনা করি তা-ই আমাদের প্রকৃত সৃষ্টি। এরূপ সৃষ্টি তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য তার স্রষ্টার (কল্পনাকারীর) ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার স্বাধীন অস্তিত্ব অকল্পনীয়।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , সৃষ্টিমাত্রই তার অস্তিত্বলাভ , স্থিতি , ধারাবাহিকতা রক্ষা , বিনাশ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য স্বীয় স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। স্রষ্টার অস্তিত্বের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নেই , যদিও সে স্রষ্টার অংশ নয়। পরম স্রষ্টা অপরিহার্য সত্তার সাথে তাঁর সৃষ্ট সৃষ্টিলোকের সম্পর্কও এ ধরনেরই।

পরম স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্র্য

যে স্রষ্টা সীমাহীন জ্ঞান , ইচ্ছাশক্তি ও সৃজনক্ষমতার অধিকারী সে পরম স্রষ্টার সৃষ্টি শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে নয় , বরং গুণগত ও মাত্রাগত দিক থেকেও এতো বেশী ও এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক যা আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তি দ্বারা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

ইতিপূর্বে আমরা অস্তিত্বের দার্শনিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছি এবং সে ক্ষেত্রে প্রচলিত দার্শনিক বিভাজন থেকে কিছুটা (কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) ভিন্নমত পোষণ করে এভাবে বিভাজন করেছি: অস্তিত্ব দু রকম: অপরিহার্য ও সম্ভব ; সম্ভব অস্তিত্ব হয় অবস্তুগত , নয়তো প্রায় বস্তুগত , নয়তো বস্তুগত। এখানে আরো অনেক বিভাগ চিন্তা করা যায়। যেমন: বস্তুগত সৃষ্টি দু রকমের: জড় ও প্রাণশীল। প্রাণশীল সৃষ্টি দু রকম: বদ্ধ ও মুক্ত। উদ্ভিদ হচ্ছে বদ্ধ এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি মুক্ত। মুক্ত প্রাণশীল সৃষ্টি হয় স্বাধীন বিচরণক্ষমতাহীন (যেমন: লোহিত কণিকা , শ্বেত কণিকা ও রোগজীবাণু) , নয়তো স্বাধীন বিচরণক্ষমতা সম্পন্ন। শেষোক্ত গোষ্ঠী হয় পুরোপুরি সহজাত প্রবৃত্তি চালিত (যেমন: মশা-মাছি) , নয়তো বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণী হয় বিচারবুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির অধিকারী (মানুষ) , নয়তো এ ক্ষমতার অধিকারী নয়।

অবস্তুগত ও প্রায় বস্তুগত সৃষ্টির মধ্যেও নিঃসন্দেহে বহুবিধ বিভাজন সম্ভব - যে সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এরূপ সৃষ্টি ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন ও ব্যক্তিসত্তাবিহীন হতে পারে। আবার জ্যামিতিক সত্যগুলো অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক , একমাত্রিক ও শূন্যমাত্রিক অস্তিত্ব , গাণিতিক সংখ্যা , তরঙ্গ , চৌম্বক ক্ষেত্র , মানবমস্তিষ্কের কল্পিত সৃষ্টি , সুর , সৌন্দর্য ইত্যাদি অবস্তুগত সত্যকে কোন্ পর্যায়ে ফেলা যায় সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

এ তো গেলো এমন সৃষ্টির কথা যা কম - বেশী আমাদের বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার আওতাভুক্ত। এর বাইরে আরো বিভিন্ন মাত্রার ( Dimension)কতো রকম সৃষ্টি রয়েছে তা আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

বন্দিত্ব নাকি স্বাধীনতা ?

পরম স্রষ্টা যেমন বস্তুগত , অবস্তুগত , প্রায় বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয় সৃষ্টি করেছেন , তেমনি সৃষ্টি করেছেন প্রাকৃতিক বিধিবিধান। তিনি মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষণ শক্তি এবং মৌলিক ও যৌগিক সৃষ্টিসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট গঠন-ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টিজগৎকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করেছেন। এছাড়া তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্য সহজাত প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন এবং কতক সৃষ্টিকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন ও জ্ঞানার্জনের যোগ্যতা দিয়েছেন। তিনি কতক প্রাণশীল সৃষ্টিকে বিচরণের স্বাধীনতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন এবং মানুষকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা , এমনকি প্রাকৃতিক বিধান ও সহজাত প্রবণতার বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা। ফলে প্রাকৃতিক বিধিবিধান ও সহজাত প্রবণতা দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর স্বাধীনতা যতোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতা ততোখানি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।

কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে অনেকে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ মানুষকে নিরঙ্কুশ স্বাধীন বলে দাবী করেছেন , কেউ কেউ তাকে স্রষ্টার ইচ্ছার ক্রীড়নক গণ্য করেছেন এবং তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। একদল বলছেন , আমরা যখন প্রাকৃতিক বিধিবিধানের সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে মানবিক ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা অনুভব করি না , বরং স্বাধীনতা অনুভব করি , তখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন। অপর দল বলছেন , সৃষ্টিপ্রকৃতির নিখুঁত শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অবকাশ থাকতে পারে না। বরং আমরা রেকর্ডকৃত কার্টুন-চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ন্যায় পূর্বসম্পাদিত ভূমিকার পর্দায় নিক্ষিপ্ত দৃশ্যসম বৈ নই ; আগামীতে আমি কোন্ ভূমিকায় আবির্ভূত হবো তা না জানলেও এতে সন্দেহ নেই যে , পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা দৃশ্যে ও ভূমিকায়ই আবির্ভূত হবো। তাঁরা আরো বলেন যে , ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সৃষ্টিকর্তা তো জানেনই ভবিষ্যতে আমার ভূমিকা কী হবে , অতএব , আমার পক্ষে তার অন্যথা করা সম্ভব নয়।

এ দুই মতের ধারকরা দুই প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছেন ; একদেশদর্শিতার কারণে তাঁরা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

বাস্তবে আমরা কী অনুভব করি ? আমরা একদিকে যেমন স্বাধীনতা অনুভব করি , অন্যদিকে সীমাবদ্ধতাও অনুভব করি ; স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা কোনোটিই নিরঙ্কুশভাবে অনুভব করি না।

বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা এমন দাবীও করে থাকেন যে , আমরা যে স্বাধীনতা অনুভব করছি , আসলে আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের এ ধারণা এ কারণে গ্রহণযোগ্য নয় যে , মানুষের যদি স্বাধীনতা না-ই থাকবে অথচ তাকে স্বাধীনতা অনুভব করতে বাধ্য করা হবে , তাহলে তা হবে এক ধরনের অন্যায় ও প্রতারণা। কিন্তু পরম পূর্ণতার অধিকারী স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির সাথে অন্যায় ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেন এরূপ দুর্বলতা থেকে তিনি প্রমুক্ত।

অন্যদিকে স্বাধীনতার অনুভূতি যেমন অকাট্য ও সর্বজনীন , স্বাধীন অনুভব করতে বাধ্য করার অনুভূতি তদ্রূপ সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ যারা মনে করছেন যে , আসলে আমরা স্বাধীন নই , তাঁরাও নিজেদেরকে স্বাধীন অনুভব করছেন , তবে কোনো কোনো যুক্তির ভিত্তিতে স্বীয় অনুভূতির বিপরীতে ধারণা করছেন যে , আমরা যা অনুভব করছি তা ঠিক নয় , বরং আমাদেরকে এরূপ অনুভব করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে বাস্তব অনুভূতির বিপরীত জ্ঞানগত বিতর্কের দাবী মাত্র এবং তার উৎস হচ্ছে ধারণা । অতএব , এ ধারণা যেমন সর্বজনীন নয় , তেমনি তা অকাট্যও নয়। আর ধারণাজাত বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে সর্বজনীন অকাট্য অনুভূতির সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করা চলে না।

যারা স্বাধীনতার অনুভূতিকে অস্বীকার করেন তাঁদের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে , এটা সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ হলেও স্বাধীন এক্তিয়ার সম্পন্ন সৃষ্টির অস্তিত্ব তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার ব্যাপকতাই প্রমাণ করে , যার অনুপস্থিতিতে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অপেক্ষাকৃত সীমিত প্রতিভাত হতো।

মানুষের স্বাধীনতার অনুভূতি অস্বীকারকারীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যুক্তি। [এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া শিরোনামে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।] এর জবাবে বলতে হয় যে , আমরা সৃষ্টিকর্তার ভবিষ্যৎ জ্ঞানের স্বরূপ অবগত নই। অতএব , সে যুক্তিতে আমরা আমাদের অনুভূত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

আমরা সৃষ্টিকর্তার জ্ঞানের স্বরূপ অনুধাবনে অক্ষম , তবে এর কয়েকটি দিক আমাদের বিচারবুদ্ধির নিকট অকাট্যভাবে প্রতিভাত। যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকার্যক্রম মানে হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সংশ্লিষ্ট স্থান , কাল , পাত্রপাত্রী , অবস্থা , কারণ ও প্রক্রিয়া সহ অনিবার্য হয়ে যায় , সেহেতু তিনি যদি সমগ্র ভবিষ্যত কে একবারে ইচ্ছা করেন তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা অনিবার্য হয়ে যায়। তাহলে অতঃপর আর তাঁর কিছুই করার থাকে না এবং তাঁর অন্য সমস্ত গুণ প্রয়োগ হারিয়ে ফেলে। কারণ , তিনি যা ইচ্ছা করে রেখেছেন তার বাইরে নতুন কিছুই তিনি করবেন না। কিন্তু বিচারবুদ্ধি সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন সৃষ্টিক্ষমতার ও সীমাহীন মাত্রার অন্যান্য গুণের প্রয়োগ হারিয়ে ফেলার ধারণা গ্রহণ করে না। কারণ , তা তাঁর এ সব গুণ ও ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। অতএব , সৃষ্টিক্ষমতা সহ তাঁর সকল গুণের অনবরত কার্যকরিতা অনস্বীকার্য বিষয়। এমতাবস্থায় এমন অসংখ্য ক্ষেত্র থাকতে হবে যে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ধরনেরই ইচ্ছা করেন নি , যে সব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছা করা বা না-করার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই ক্ষেত্রসমূহেরই একটি হতে পারে সৃষ্টির স্বাধীনতার আওতাভুক্ত ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র। অর্থাৎ কতক ক্ষেত্রে সৃষ্টি ভবিষ্যতে কী করবে সে ব্যাপারে স্রষ্টা কোনো কিছু ইচ্ছা করা থেকে বা সেদিকে মনোযোগ (توجه ) প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। কারণ , তিনি সেদিকে মনোযোগ প্রদান করলে তিনি যেভাবে মনোযোগ প্রদান করবেন সেভাবে তা ঘটা অনিবার্য হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে , সমগ্র ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগ প্রদান করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তিনি এভাবে কতক ক্ষেত্রকে মনোযোগের বাইরে রাখতে এবং সৃষ্টির জন্য স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পুরোপুরি সক্ষম।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টিকর্তা যেমন কতক বিষয় সরাসরি বা কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির দ্বারা স্থির করে দিয়েছেন তেমনি কতক বিষয় স্থির করে না দিয়ে শর্তাধীন করে দিতে পারেন , যেমন: অমুক ব্যক্তি এ কাজ করলে ফল এই হবে এবং তা না করলে বা তার পরিবর্তে অমুক কাজ করলে ফল ঐ রকম হবে। অতঃপর ব্যক্তি স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারা যা করবে তার ফলটি অকাট্য হয়ে যাবে এবং তার বিকল্প সম্ভাবনাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ , সম্ভব অস্তিত্ব (সৃষ্টি ও কাজ উভয়ই) অস্তিত্বলাভ করার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে এই যে , তা অস্তিত্বলাভের পূর্ণ কারণ ঘটলে তার অস্তিত্বলাভ অনিবার্য হয়ে যায় এবং পূর্ণ কারণ না ঘটা পর্যন্ত তার অস্তিত্বলাভ অসম্ভব থাকে। এরূপ শর্তাধীন স্থিরকরণ সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার বৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক।

তৃতীয়তঃ ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীন সৃষ্টির অতীত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক বিধিবিধানের দ্বারা তার ভবিষ্যৎ এমনভাবেও নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে যে , সে ক্ষেত্রে দ্বৈত সম্ভাবনার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টি আগে যে স্বাধীনতার অধিকারী ছিলো তা বিলুপ্ত বা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিশ্চিত জানেন যে , ঐ ব্যক্তি এ কাজ করবে ও তার ফল এরূপ হবে ; এর অন্যথা হবে না। কিন্তু স্রষ্টার এ ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণে এ কথা বলা চলে না যে , স্রষ্টা তাকে এ কাজে বাধ্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি একজন ছাত্র সম্পর্কে নিশ্চিত জানেন যে , সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবে , তো এ কারণে বলা চলে না যে , শিক্ষকের ঐ ছাত্র সংক্রান্ত ভবিষ্যৎজ্ঞানের কারণেই এ ছাত্রটি অকৃতকার্য হয়েছে।

অবশ্য আগেও যেমন বলা হয়েছে , মানুষের এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। প্রাকৃতিক বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও পারিবারিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও মানব-জাত অন্যান্য কার্যকারণ তার এ স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে , কিন্তু তার স্বাধীনতাকে পুরোপুরি হরণ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তার জন্য স্বাধীনতার ক্ষেত্র কমবেশী থেকেই যায়। এমনকি মানুষ যখন অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করে তখনো কার্যতঃ সে তার স্বাধীন এ্খতিয়ারকেই কাজে লাগায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণ কি কেবল প্রাকৃতিক ও মানব-জাত কার্যকারণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে ? এখানে পরম জ্ঞানী স্রষ্টার কি করণীয় কিছু নেই ? অন্য কথায় , তিনি কি সৃষ্টির কার্যক্রমে আদৌ হস্তক্ষেপ করবেন না ? বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে কী বলে ?

বস্তুতঃ স্বাধীনতা হচ্ছে পরম পূর্ণতার অধিকারী অপরিহার্য সত্তার বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা তিনি তাঁর সসীম অপূর্ণ সৃষ্টি মানুষকে প্রদান করেছেন। যদিও এ স্বাধীনতা ব্যবহারের জন্য মানুষকে বিচারবুদ্ধি দেয়া হয়েছে , তথাপি দুর্বল ও অপূর্ণ হবার কারণেই এ স্বাধীনতা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ভুল হবার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে , ক্ষেত্রবিশেষে , বিশেষ করে সমগ্র সৃষ্টিলোক বা মানবপ্রজাতির স্বার্থে অপরিহার্য হলে , তেমনি মানুষ তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে ও তাঁর বিবেচনায় সে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত হলে তিনি সৃষ্টির স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবেন। (তবে এটা করা তাঁর জন্য অপরিহার্য গণ্য করা যায় না এবং সর্বাবস্থায়ই তিনি হস্তক্ষেপ বা সাহায্য করবেন এটাও ভাবা যায় না। কারণ , তাহলে সৃষ্টির স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।)

বিষয়টি কয়েকটি উপমার সাহায্যে সহজে বুঝা যেতে পারে।

প্রথম উপমা: একজন পিতা তাঁর শিশু সন্তানকে খেলার জন্য একটি বল দিলেন , সাথে সাথে তিনি তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেন। কিন্তু শিশুটি নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে লাগলো। কারণ , তার পিতা তাকে নদীর কিনারে গিয়ে খেলতে নিষেধ করলেও তার সেখানে যাওয়া ও খেলার পথ রুদ্ধ করেন নি ; ধরুন , পিতা তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারতেন , কিন্তু তিনি তা করেন নি। এমতাবস্থায় খেলার সময় শিশুটির বলটি ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো। এখন পিতা কী করবেন ? এ অবস্থায় শিশুটি পিতাকে বলটি তুলে দিতে বলতে পারে , বা না-ও বলতে পারে। উভয় অবস্থায়ই পিতা চাইলে বলটি তুলে দিতে পারেন , বা তা তুলে আনার আগেই অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তিনি তাকে আরেকটি নতুন বল কিনে দিতে পারেন ও আগেকার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিতে পারেন। অবশ্য তিনি চাইলে কোনো কারণে বলটি তুলে দেয়ার চেষ্টা না-ও করতে পারেন বা নতুন বল কিনে দেয়া থেকেও বিরত থাকতে পারেন। তবে সাধারণতঃ তিনি প্রথম বারের ক্ষেত্রে বা শিশুর বয়স ও আরো কিছু বিষয় বিবেচনা করে বলটি তুলে দেন বা নতুন একটি বল কিনে দেন।

অথবা ধরুন , একটি বাড়ীর চতুর্দিকে পানিভর্তি গভীর খাদ ; পিতা শিশুকে খাদে নামতে , এমনকি তার কাছে যেতেও নিষেধ করলেন , বললেন: খাদে নামলে বা তাতে পড়ে গেলে ডুবে মরবে। কিন্তু শিশু শিশু হওয়ার কারণেই পিতার কথার গুরুত্ব বুঝলো না এবং খেলতে খেলতে খাদের কিনারে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ বা পা পিছলে তাতে পড়ে গেলো অথবা কৌতুহলবশে তাতে নেমে গেলো এবং ফলে সে পানিতে ডুবে গেলো। এ অবস্থায় পিতা খাদে নেমে তাকে তুলে আনলেন , ফলে সে বেঁচে গেলো , কিন্তু নাকে , কানে ও পেটে দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ঢুকে যাওয়ায় সে শুধু তাৎক্ষণিক কষ্ট আর ভোগান্তির শিকারই হলো না , বরং অসুস্থ হয়ে পড়লো।

আবার এমনও হতে পারে যে , খাদটি এতোই গভীর ছিলো যে , তার তলদেশ থেকে তুলে আনতে আনতে সে মারা গেলো। হতে পারে যে , খাদটি খুব বেশী গভীর না হলেও খাদের পানি খুব বেশী দূষিত থাকায় ঐ বিষাক্ত পানি পেটে যাবার কারণেই সে মারা গেলো অথবা মারা না গেলেও সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো এবং তার জীবনীশক্তি হ্রাস পেলো।

ক্ষেত্রবিশেষে খাদের মধ্যে কাঁটা বা ভাঙ্গা কাঁচ থাকতে পারে যার ফলে সে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে এবং বেঁচে গেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সে কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার বা অসুস্থ বা বিকলাঙ্গ হওয়ায় অথবা মারা যাওয়ায় এ ঘটনাটা অন্য শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় হলো।

আবার এমনও হতে পারে যে , শিশুটি এক পা খাদে ফেলতে উদ্যত হওয়ার সাথে সাথেই , অথবা এমনকি খাদের কিনারে যেতেই বাবা তাকে ধরে ফেললো ও সেখান থেকে দূরে সরিয়ে আনলো এবং এভাবে ধরে নিয়ে আসার কাজটা প্রহারসমেতও হতে পারে যাতে সে ভবিষ্যতে এ কাজের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকে।

অথবা মনে করুন , কোনো জাহাযের সারেং যাত্রীদেরকে ডেকের কিনারে যেতে নিষেধ করলেন এবং বলে দিলেন যে , পানিতে হাঙ্গর ও কুমীর আছে। কিন্তু কতক যাত্রী তাঁর কথা শুনলো না। তারা ডেকের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পানিতে পড়ে গেলো , আর ডুবুরী নেমে উদ্ধার করার আগেই তাদেরকে কুমীর এসে টেনে নিয়ে গেলো বা হাঙ্গর এসে ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

অথবা সাঁতার জানা এক ব্যক্তি প্রয়োজনের তাগিদে সাঁতরে নদী পাড়ি দিলো , কিন্তু কিনার থেকে পাঁচ , সাত বা দশ হাত দূরে পৌঁছতেই সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো। তখন সে সাহায্য চাইতে বা না চাইতেই কিনারে থাকা লোকদের মধ্য থেকে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীরে তুলে আনলো। কিন্তু অপর এক ব্যক্তি ভালো সাঁতার না জানা সত্ত্বেও অন্যদের নিষেধ উপেক্ষা করে অহঙ্কার অথবা বোকামি বশতঃ এক মাইল প্রশস্ত নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সিকি বা অর্ধ বা পৌনে এক মাইল পৌঁছার পর সাঁতরাবার শক্তি হারিয়ে ফেললো এবং লোকদের কাছে সাহায্য চাইলো , কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলো না , কারণ , সে অন্যদের সদুপদেশ না শুনে নিজের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই কেউ তাকে সাহায্যের হক্বদার মনে করে নি , অথবা সাহায্য পৌঁছার আগেই তার মারা যাওয়া নিশ্চিত জেনে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা অর্থহীন মনে করে তারা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা থেকে বিরত থাকলো। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে তার কাছাকাছি কোনো নৌকা বা স্পীড-বোট থাকলে তিরস্কার করেও তাকে দয়া দেখাতে পারে। তেমনি সে যদি নদীর তীরের খুবই কাছাকাছি এসে যায় , ধরুন বিশ গজের মধ্যে এসে যায় , সে ক্ষেত্রে তার হঠকারিতা বা বোকামির জন্য তিরস্কার করলেও কেউ দয়া করে তাকে তীরে তুলে আনতে পারে।

অবশ্য মানুষের আচরণে আমরা দেখতে পাই যে , অন্যদের পক্ষ থেকে উচ্চারিত সতর্কবাণী ও কৃত কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে অথবা নির্বুদ্ধিতাবশতঃ যারা নিজেদেরকে বিপদে নিক্ষেপ করে তাদের সকলের ক্ষেত্রে বা একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি বারই কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ , সে ক্ষেত্রে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা উপেক্ষা করে নিজেকে বিপদে নিক্ষেপ করতে কেউই দ্বিধা করতো না এবং এর ফলে সতর্কবাণী ও কল্যাণকামনা অর্থহীন হয়ে যেতো। অবশ্য সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করলে সাহায্য লাভের সম্ভাবনা বেশী থাকে , তবে তা-ও নিশ্চিত নয়।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিকর্তা তাঁর এ দুর্বল সৃষ্টিকে স্বাধীনতা দেয়ার পর নিরঙ্কুশভাবে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন না ও তার কাজে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবেন না - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না। বিশেষ করে মানবপ্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করে। এমতাবস্থায় তার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা যদি অন্যায় , অযৌক্তিক বা অবাস্তব না হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে সাহায্য করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সর্বাবস্থায়ই তিনি তাকে সাহায্য করবেন বা তার এক্তিয়ারাধীন কাজে হস্তক্ষেপ করবেনই এমনটি মনে করাও ঠিক হবে না। কারণ , তিনি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নন। তিনি যদি সাহায্য বা হস্তক্ষেপ করেন , তো সেটা সৃষ্টির অধিকার নয় , বরং তাঁর অনুগ্রহ।

অন্যদিকে কোনো মানুষের বা কোনো মানবগোষ্ঠীর স্বাধীনতার অপব্যবহারমূলক নেতিবাচক পদক্ষেপের উদ্যোগ যদি সমগ্র সৃষ্টিলোক বা পৃথিবী বা মানবপ্রজাতির জন্য এমনই ধ্বংসাত্মক হয় যার ফলে সৃষ্টির লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে , সে ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির দাবী এটাই যে , সৃষ্টিকর্তা সেখানে হস্তক্ষেপ করবেন এবং ধ্বংসকামী ঐ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নেতিবাচক উদ্যোগকে বানচাল করে দেবেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , যেহেতু সৃষ্টিকর্তা ইতিবাচক , সেহেতু সৃষ্টির কাজে তাঁর হস্তক্ষেপও সর্বাবস্থায়ই ইতিবাচক হবে , কখনোই নেতিবাচক হবে না - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে সৃষ্টিকর্তার কোনো কোনো হস্তক্ষেপ আপতঃদৃষ্টিতে নেতিবাচক বলে মনে হতে পারে , কিন্তু পিতা কর্তৃক তার দুষ্ট শিশুকে প্রহার করার ন্যায় অথবা চিকিৎসক কর্তৃক কারো শরীরের পচনধরা অঙ্গ কেটে ফেলার ন্যায় উদ্দেশ্য ও পরিণামফলের বিচারে তাঁর সে দৃশ্যতঃ নেতিবাচক হস্তক্ষেপ অবশ্যই ইতিবাচক।


5

6

7

8

9

10