প্রচুর উৎপাদনশীল বায়ু
বায়ুপ্রবাহের প্রচুর উৎপাদন ক্ষমতা কিংবা উর্বরা ক্ষমতা রয়েছে। এটি বায়ুর একটি বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যটি আর তারই ফলস্বরূপ বৃষ্টি উৎপাদনের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে।
“
আর আমিই প্রেরণ করি বায়ুরাশিকে যা বহন করে পানিপূর্ণ মেঘমালাগুলোকে ;
তারপর আমিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করাই
।
”
(
কোরআন ,
১৫ :
২২ )
বৃষ্টিপাতের বা বৃষ্টি উৎপাদনের প্রথম পর্যায় যে বায়ুপ্রবাহ -
আয়াতটিতে সে বিষয়েই মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে । বাতাস বা বায়ুপ্রবাহ মেঘমালাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় -
বায়ুপ্রবাহ আর বৃষ্টির মধ্য
কার এই একটি মাত্র সম্পর্কের কথাই জানা ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত।
যাই হোক না কেন আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত তথ্যাগুলো হাতে কলমে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বৃষ্টি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাতসের উৎপাদনশীল বা উর্বরা ক্ষমতার ভূমিকা রয়েছে।
বায়ুর এই উর্বরা বা প্রচুর উৎপাদনশীলতার ক্ষমতা নিম্নরূপে কাজ করে :
পানির ফেনিল বা ফেনায়িত কার্যাবলীর জন্য মহাসমুদ্র আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিপৃষ্ঠ থেকে অগণিত বায়ুর বুদবুদ তৈরী হয়। ঠিক যে মুহূর্তে বুদবুদ গুলি ফেটে যায় তখনই মাত্র ১০০ ভাগের এক ভাগ পরিধির হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা বের হয়ে এসে উপরে বাতাসে উত্থিত হয়।
“
এরোসোল
”
নামের এই কণিকাগুলো স্থলভাগ থেকে বায়ু বাহিত ধূলিকণার সঙ্গে মিশে ভূমি থেকে উপরে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরগুলোয় উঠে যায়। বাতাসের মাধ্যমে এই কণিকাগুলো আরো উচুঁতে উত্থিত হয়ে পানি বাষ্পের সংস্পর্শে আসে। পানিবাষ্প এই কণিকাগুলোর চারপার্শ্বে ঘনীভূত হয়ে পানিকণিকায় রূপ নেয়। প্রথমে এই পানিকণাগুলো এক সঙ্গে মিশে মেঘ উৎপন্ন করে আর বারিধারা হিসেবে নেমে আসে ধরাতলে।
দেখা গেল যে , সমুদ্র থেকে বয়ে নিয়ে আসা কণিকাগুলোসহ বাতাসে ভাসমান পানি বাষ্প প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় এই বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে আর তারই ফলস্বরূপ বৃষ্টির মেঘ তৈরীতে সাহায্য করে এই বায়ুপ্রবাহ।
যদি বায়ুর এই বৈশিষ্ট্যটি না থাকতো তাহলে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে কখনো পানি বিন্দু তৈরী হতো না , ফলে বৃষ্টি নামের এই পদার্থটি উৎপন্ন হতো না।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো শত শত বছর পূর্বে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে বায়ুমন্ডলের অতি প্রয়োজনীয় ভূমিকাটি বর্ণিত হয়েছিল তখনই , যখন মানুষ প্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপার খুবই কম জানতো ।
উপরের চিত্রটি একটি ঢেউ উৎপাদনের পর্যায়সমূহ প্রদর্শন করছে। পানি পৃষ্ঠের উপরে বাহিত বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমেই এই ঢেউগুলো উৎপন্ন হয়। বাতাসের দ্বারা এই পানিবিন্দুগুলো একটি গোলাকার আবর্তে আবর্তিত হতে থাকে। এই প্রবাহের বা গতিশীলতার মাধ্যমে একের পর একটি ঢেউ তৈরী হয়। এই ঢেউগুলো তৈরী করে বুদবুদসমূহ-যারা বাতাসে যায় ছড়িয়ে। বৃষ্টি উৎপাদনের প্রথম পর্যায় এটি। এই পদ্ধতিটিই ঘোষিত হয়েছে এভাবে :“
আমিই প্রেরণ করি বায়ুরাশিকে যা বহন করে পানিপূর্ণ মেঘমালাকে তারপর আমিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করাই........।”
সাগরসমূহ কখনো মিশে যায়না
কেবলি সেদিন সমুদ্রের একটি বৈশিষ্ট্য উদঘাটিত হয়েছে-যা কিনা পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত , নিম্নে সেই আয়াতটি হলো :
“
তিনিই মুক্তভাবে প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া , যারা পরস্পর মিলিত হয়ে থাকে , কিন্তু উভয়ের মাঝখানে রয়েছে একটি পর্দা , যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (কোরআন , ৫৫ : ১৯ -২০)
সমুদ্রগুলো পাশাপাশি বয়ে যায় , কাছাকছি আসে কিন্তু কখনোই মিশে যায়না-সাগরগুলোর এই বৈশিষ্ট্যটি সাম্প্রতিক কালে মহাসমুদ্রবিদগণ কর্তৃক উদঘাটিত হয়েছে।Surface Tension
বা বহিপৃষ্ঠের টান নামক এক প্রাকৃতিক শক্তির কারণেই প্রতিবেশী সমুদ্রের পানি কখনই একত্রে মিশ্রিত হয় না। বহিপৃষ্ঠের টান নামক এই বলটির সূত্রপাত ঘটে সাগরের পানির ঘনত্বের তারতম্যের কারণে যা কিনা এক সমুদ্রের পানিকে অপর সমুদ্রের সঙ্গে মিশ্রিত হতে দেয় না। বরং দুটি সমুদ্রের পানির মাঝে একটি পাতলা আবরণ হিসেবে বিদ্যমান থাকে।
যে যুগের মানুষ পদার্থবিদ্যা , পৃষ্ঠটান কিংবা মহাসমুদ্রবিদ্যা-এগুলো সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা ধারণাই রাখতো না , ঠিক সে সময়েই এই বিষয়টি কোরআনে প্রকাশিত হয় এটি একটি বিরাট আশ্চর্যের ব্যাপার।
ভূমধ্য সাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরে রয়েছে বিরাট বিরাট ঢেউ , শক্তিশালী প্রবাহ আর বিদ্যুত। জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে ভূমধ্য সাগরের পানি আটলান্টিক মহাসাগরে চালিত হয়। কিন্তু যে একটি প্রাচীর বা দেয়াল এদের আলাদা করে রেখেছে সেটির কারণেই এদের তাপমাত্রা , লবণত্ত্ব ও ঘনত্তের মাঝে কোন পরিবর্তন ঘটে না।
সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা
সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা অথবা তাদের কার্যাবলী অত্যন্ত গভীর সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকারের ন্যায় , যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের পর তরঙ্গ , যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার। এমনকি যখন কেউ তার হাত বের করবে , তখন সে আদৌ তা দেখতে পাবে না। আর যাকে আল্লাহ হেদায়েতের নূর দান করেন না তার জন্য কোথাও কোন নূর নেই। (কোরআন , ২৪ : ৪০)
Oceans
নামক বইটিতে গভীর সমুদ্রের সাধারণ পরিবেশের কথা বর্ণিত হয়েছে :
গভীর সমুদ্র ও মহাসমুদ্রসমূহের গভীরে ২০০
মিটার ও তারও নীচে এক আঁধার পরিবেশ বিরাজ করে। এ পরিমাণ
গভীরতায় প্রায় কোন আলো নেই। আর প্রায় ১০০০ মিটার গভীরতায় একদমই কোন আলো থাকে না।
অধুনা সমুদ্রের সাধারণ গঠনপ্রণালী , এর মাঝে বিদ্যমান জীবসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলী , এর ঘনত্ব , এর ধারণকৃত পানির পরিমাণ , এর পৃষ্ঠতল আর গভীরতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী ডুবো জাহাজ ও বিশেষ যন্ত্রাদির মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ এই তথ্যসমূহ পেতে পারেন।
কোন ধরনের বিশেষ যন্ত্রাদির সাহায্য ছাড়া মানুষ সাগরের ৪০ মিটার গভীরে বা আরো নীচে ডুব দিতে বা যেতে পারে না। যেমন , ২০০মিটার গভীরে সমুদ্রের গভীর অন্ধকার অংশে কোন প্রকার সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না মানুষ । এ সমস্ত কারণেই বিজ্ঞানীগণ সম্প্রতি সমুদ্র সম্পর্কে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম তথ্যাদি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ ১৪০০ বছর আগেই সূরা নূরে“
সমুদ্রের আঁধার”
শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এটা অবশ্যই কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের পক্ষে একটি যুক্তি কেননা এ তথ্যটি কোরআনে এমন সময় প্রদান করা হয়েছে , যখন মানুষ মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে তথ্যাদি খুঁজে আনার মত কোন যন্ত্রাদির অস্তিত্বই ছিল না।
অধিকন্তু ,“
তরঙ্গের পর তরঙ্গ , যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার”
-সূরা নূরের এ আয়াতটিও কোরআনে বর্ণিত আরেকটি অলৌকিক বিষয় হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।
সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীগণ উদঘাটন করেছেন যে , সেখানে রয়েছে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা যারা“
পানির ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের স্তরের
মাঝে সৃষ্টি হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থান করে
”
।
আভ্যন্তরীন
তরঙ্গমালা বা ঢেউসমূহ সাগর ও মহাসাগর সমূহের গভীর পানির স্তরগুলো
ঢেকে থাকে ,
কেননা উপরকার পানির চেয়ে ভেতরের পানির রয়েছে বেশী মাত্রার ঘনত্ব।
আজকের প্রযুক্তি দিয়ে পরিমাপ করে দেখা গেছে যে , সমদ্রপৃষ্ঠে শতকরা ৩৩০ অংশ সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়। এর পর আলোর বর্ণালীর প্রায় সাতটি রং প্রথম ২০০ মিটারে শোষিত হয় কেবল নীল আলো ছাড়া। (বামের চিত্রটি) প্রায় ১০০০মিটার তলদেশে একেবারেই কোন আলো নেই। (উপরের চিত্র) ১৪০০ বছর আগে এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি সূরা নূরের ৪০নং আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছিল।
আভ্যন্তরীন
তরঙ্গমালা উপরি পৃষ্ঠের তরঙ্গমালার ন্যায় কাজ করে থাকে। উপরিপৃষ্ঠের তরঙ্গমালার মতো আভ্যন্তরীন
তরঙ্গমালাও ভাঙ্গতে পারে। কোন মানব চক্ষু দিয়ে নয় বরং কোন একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের তাপমাত্রা বা লবণের ঘনত্বের পরিবর্তনের পরীক্ষা -
পর্যবেক্ষন করেই তবে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালাকে সণাক্ত করা হয়ে থাকে।
উপরের ব্যাখ্যাগুলোর সঙ্গে কোরআনের উক্তিসমূহ সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোন প্রকার গবেষণা ব্যতীত একজন কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের ঢেউগুলোকেই চর্মচক্ষে অবলোকন করতে পারে। সমুদ্রের আভ্যন্তরীন তরঙ্গ সম্পর্কে অবহিত হওয়া একজনের পক্ষে অসাধ্য ব্যাপার। তারপরেও সূরা নূরে আল্লাহ তাআলা সমুদ্রের বিভিন্ন ঘনত্বে আরেক ধরণের তরঙ্গের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকষর্ণ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই অতি সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীগন যা উদঘাটন করতে পেরেছেন , তা আরো একবার প্রমাণ করে যে , কোরআনের প্রতিটি কথাই আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তাআলার কথা।
মস্তিস্কের যে অংশটুকু আমদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে
আর এরূপ করা কখনই উচিত নয় , যদি সে এরূপ করা থেকে ফিরে না আসে , তবে আমি তাকে অবশ্যই ললাটের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাব।
যে কেশগুচ্ছমিথ্যাচারী পাপাচারীর।
(
কোরআন ,
৯৬ :
১৫ -
১৬ )
“
যে কেশগুছ মিথ্যাচারী , পাপাচারীর”
-উপরের আয়াতের এই অভিব্যক্তিটি সবচাইতে কৌতুহলকর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চালানো গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে , মস্তিস্কের প্রিফ্র্রন্টাল অঞ্চল যা মস্তিস্কের বিশেষ বিশেষ কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে , তা মাথার খুলির অভ্যন্তরে সম্মুখভাগে বিদ্যমান । বিজ্ঞানীগণ এই অঞ্চলের কার্যাবলী গত ষাট বছরে উদঘাটন করেছেন , যা কিনা কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই নির্দেশিত হয়েছিল। আমরা যদি মাথার খুলির ভেতরের আর সম্মুখের অংশে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা সেরিব্রামের ফ্রন্টাল অঞ্চলটি খুঁজে পাব।Essentials of Anatomy and Physiology
নামের একটি বই , যাতে এই অঞ্চলের কার্যাবলীর উপরের সর্বশেষ গবেষণার ফলাফলের কথা উল্লেখ রয়েছে , সেই বইটি বলে :
পরিকল্পনা করার আর নড়াচড়া শুরু করার জন্য উদ্বুদ্ধতা আর দুরদশির্তা মস্তিস্কের -সামনের লোবের (Frontal Lobe
) সম্মুখের অংশে অর্থাৎ প্রিফ্রন্টাল-অঞ্চলে ঘটে থাকে। এটি সহযোগী কর্টেক্সের অঞ্চল...।
বইটি আরো বলে : প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলের উদ্বুদ্ধ করার কাজে জড়িত থাকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটিও ধারণা করা হয় যে , এই অঞ্চলটি আগ্রাসনের কার্যকর কেন্দ্র ।
তাই সেরিব্রামের এই অঞ্চলটি পরিকল্পনা , উদ্বুদ্ধ করা আর ভাল ও মন্দ আচরণ শুরু করা এবং সত্যমিথ্যা বলার জন্য দায়ী। এটি পরিস্কার বুঝা গেল যে ,“
যে কেশগুছ পাপাচারী ,
মিথ্যাচারীর
”
-
উক্তিটির সঙ্গে উপরের ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ । বিজ্ঞানীগণ গত ষাট বছরে যে বিষয়টি আবিষ্কার করেছে ,
তাই অনেক অনেক বছর আগে মহান আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেন।
মানব শিশুর জন্ম
মানুষকে বিশ্বাসের পথে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে কোরআনে বহু বৈচিত্রময় বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। কখনো বা আকাশ , কখনো প্রাণী জগৎ , কখনো বা উদ্ভিদসমূহকে আল্লাহ মানুষের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক আয়াতে মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে নিজেদের সৃষ্টি সম্পর্কে মনোযোগী হতে। প্রায়ই মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে , সে কিভাবে এ পৃথিবীতে আসল , কি কি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সে এলো , তার মৌলিক স্বভাব কি ?
আমিই তোমাদের সৃষ্টি করেছি , তবে তোমরা কেন বিশ্বাস করছ না ? তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে ? তোমরা কি তা সৃষ্টি কর , না আমি তার স্রষ্টা ? (কোরআন , ৫৬ : ৫৭ -৫৯)
বহু আয়াতে মানুষের জন্ম আর জন্মের অলৌকিক অংশগুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। এই আয়াতগুলোয় কিছু কিছু বিষয়ের তথ্যাদি এত পুংখানুপুংখ যে , সপ্তম শতাব্দীতে বিদ্যমান কোন লোকের পক্ষে জানা অসম্ভব ছিল । এদের কিছু কিছু নিম্নরূপ :
১. সম্পূর্ণ বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়নি , এর অত্যন্ত ক্ষুদ্রাংশ থেকে তা সৃষ্টি হয়েছে (শুক্রাণু)।
২. পুরুষ থেকেই শিশুর লিংগ নির্ধারিত হয়।
৩. মানুষের ভ্রুণ জরায়ুর গায়ে জোঁকের মত লেগে থাকে।
৪. মানব শিশু জরায়ুতে তিনটি অন্ধকার অঞ্চলে বেড়ে উঠে ।
কোরআন যে সময়ে নাযিল হয়েছে ,
সে সময়ের মানুষেরা জানতো যে ,
যৌনমিলনের সময় বের হয়ে আসা বীর্যের সঙ্গে মানব জন্মের মৌলিক বিষয়টির সম্পর্ক রয়েছে। আর নয় মাস সময়সীমা পরে বাচ্চা জন্ম গ্রহন করে যা স্পষ্টভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি বিষয় ছিল ;
এটিকে আরো ঘাটিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল না। যাই হোক এই আয়াতগুলোয় বর্ণিত বিষয়গুলো সে সময়ের মানুষের জানার পরিধি থেকে আরো অধিক দূরের ব্যাপার ছিল । যা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান কর্তৃক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এখন চলুন একের পর এক বিষয়গুলোয় যাই।
একবিন্দু বীর্য
যৌন মিলনের সময় পুরুষের দেহ থেকে প্রতিবারে ২৫০ মিলিয়ন শুক্রকীট বের হয়ে আসে। মায়ের দেহে শুক্রকীট একটি দুরারূহ যাত্রা চালায় ডিম্বাণুতে পৌছা পর্যন্ত । ২৫০ মিলিয়নের মাঝে কেবলমাত্র এক হাজারটি শুক্রাণু ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌছুতে সফল হয়ে থাকে। এই পাঁচ মিনিটের দৌড় শেষে একটি লবণের দানার অর্ধেক আকারের একটি ডিম্বাণু কেবলি একটি শুক্রাণুকে তার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। তাই মানুষের জন্মের সারংশ পুরু বীর্য নয় , বরং এটি তার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। কোরআনে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
মানুষ কি মনে করে যে , তাকে এমনি বেহিসাব ছেড়ে দেয়া হবে ? সে কি একবিন্দু শুক্র ছিলনা , যা মাতৃগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ? (কোরআন , ৭৫ : ৩৬ -৩৭)
আমরা দেখেছি যে , মানুষ সবটুকু বীর্য থেকে নয় বরং এর অতি অল্প অংশ থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এই উক্তিটি এমন একটি বিষয়ের ঘোষণা করছে যা কেবলি আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে । তাই এই উক্তিটি যে স্বর্গীয় এটি তারই প্রমাণ।
বামের ছবিটিতে আমরা দেখি যে , জরায়ুতে বীর্য উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে। পুরুষের দেহ হতে বের হওয়া ২৫০মিলিয়ন শুক্রকীটের মধ্যে মাত্র অল্প সংখ্যক শুক্রকীটই ডিম্বাণুর দিকে পরিচালিত হতে পারে। যে হাজার খানেক শুক্রকীট বেঁচে থাকতে পারে তাদের মাঝে মাত্র একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে। মানুষ পুরো বীর্য নয় বরং একটি ক্ষুদ্রাংশ থেকে সৃষ্ট হয়েছে সেটি কোরআনে বর্ণিত হয়েছে“
এক বিন্দু শুক্র”
হিসেবে।
বীযের্র মিশ্রণ
বীর্য নামক তরল পদার্থটি শুধুমাত্র শুক্রাণু নিয়েই গঠিত নয়। বিপরীতক্রমে এটি আসলে বিভিন্ন তরল পদার্থের মিশ্রণ। এই তরল পদার্থটির বিভিন্ন কাজ রয়েছে। যেমন ,
এতে শুক্রকীটের শক্তি সরবরাহের জন্য শর্করা থাকে ,
জরায়ুতে শুক্রের প্রবেশ পথের এসিড নিষ্ক্রিয় করে থাকে এই তরল পদার্থটি ,
আর শুক্রকীটটির সহজ গতিবিধির জন্য একটি পিচ্ছিল পরিবেশ বজায় রাখে।
যথেষ্ট কৌতূহলের বিষয় হলো যে , কোরআনে এই বীর্যের কথা উল্লেখিত আছে আর এটিকে তরল পদার্থের মিশ্রণ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান কেবল সেদিন এটি আবিষ্কার করলঃ
আমিতো মানুষকে মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি তাকে পরীক্ষা করার জন্য ; এ কারণে আমি তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। (কোরআন , ৭৬ : ২)
অন্য একটি আয়াতে বীর্যকে আবার মিশ্র তরল পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আর মানুষকে যে এই তরলের নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
যিনি অত্যন্ত সুন্দররূপে তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে , তারপর তার বংশধরকে সৃষ্টি করেন নগণ্য পানির নির্যাস থেকে। (কোরআন , ৩২ : ৭৮)
আরবী শব্দ
“
সুলালার
”
অনুবাদ করা হয়েছে নির্যাস হিসেবে ,
যার মানে হলো কোন কিছুর দরকারী অথবা উত্তম অংশ হিসেবে। ব্যঞ্জণার্থেও এর অর্থ একটি অখণ্ড জিনিষের একটি অংশ। এটি দেখিয়ে দেয় যে ,
কোরআন এক মহাশক্তির কথা যিনি মানুষের সৃষ্টির প্রতিটি অণু পরমাণু অংশ জানেন। আর এই মহাশক্তিশালীই হলেন আল্লাহ ,
মানুষের সৃষ্টিকর্তা।
শিশুর লিঙ্গ
এইতো সেদিন পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে , মাতৃকোষ দিয়ে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণয় হয়ে থাকে। অথবা এটুকু অন্তত
বিশ্বাস করা হতো যে বাবামা উভয়ের কোষ দিয়ে বা
চ্চার লিঙ্গ নির্ণিত হয়। অথচ পবিত্র কোরআন আমাদের ভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকে যা বলে যে
,
“
নির্গত শুক্রবিন্দু থেকে
”
মেয়ে বা ছেলে লিঙ্গ নির্ণিত হয়।
আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন জোড়া নর ও নারী শুক্রবিন্দু থেকে যখন তা গর্ভপাত করা হয়। (কোরআন , ৫ : ৪৫ -৪৬)
ক্রমে উন্নত জেনেটিকস আর মলিকিউলার বায়োলজীর শাখা কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি সত্য বলে প্রমাণ করেছে। এখন বুঝা গেছে যে ,
পুরুষের শুক্রকীট থেকেই লিঙ্গ নির্ণিত হয় আর এ প্রক্রিয়ায় নারীর কোন ভূমিকা নেই। লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যাপারে ক্রোমোজোমই প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। সনাক্ত করা গেছে যে ৪৬টি ক্রোমোজমের মাঝে দুইটি মানুষের গঠন প্রকৃতি নির্ণয় করে আর এগুলোকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। পুরুষে এ দুটি ক্রোমোজোম হলো
“
XY
”
আর নারীতে এ দুটি
“
XX
”
।
কেননা এ দুটি ক্রোমোজোমের আকৃতি এ দুটি অক্ষরের মতোই। Y
ক্রোমোজোমে বিদ্যমান জীনগুলো পুরুষালী ভাবের কোড বা সংকেত বহন করে আর X
ক্রোমোজোম স্ত্রীসুলভ ভাবের কোড বহন করে থাকে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে ,“
নির্গত এক বিন্দু শুক্রের উপর”
পুরুষত্ব বা নারীত্ব বিষয়টি নির্ভর করে। যাই হোক মোটামুটিভাবে সাম্প্রতিক কালেও বিশ্বাস করা হতো যে , মাতৃকোষ হতেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে। মানুষের জন্ম সম্বন্ধে এটি এবং বহু তথ্যাদি শতাব্দী পূর্বে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
Y ক্রোমোজোম পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করে থাকে আর X ক্রোমোজোমে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মায়ের ডিম্বাণূতে থাকে শুধু X ক্রোমোজোম যা নারীর স্বভাব নির্ণয় করে। পিতার বীর্যে শুক্রাণুতে থাকে হয় X ক্রোমোজোম অথবা Y ক্রোমোজোম। সুতরাং বাচ্চার লিংগ নির্ভর করে-পিতার শুক্রাণুর X অথবা Y ক্রোমোজোম ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে কিনা তার উপর। অন্য কথায় আয়াতটিতে বলা হয়েছে ঠিক তেমনি বাচ্চার লিংগ নির্ধারণকারী উপাদান আসে পুরুষ থেকে নির্গত বীর্য থেকে। এই জ্ঞানটি কোরআন নাযিল হওয়ার সময়ে মানুষের জানা ছিল না যা কিনা প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহরই কথা।
এ ক্রোমোজোমদ্বয়ের যে কোন একটির ক্রস কম্বাইনেশনের মাধ্যমে নুতন এক মানব সন্তানের জন্মের সূত্রপাত ঘটে আর এ ক্রোমোজোমগুলো পুরুষ আর নারীতে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। অভ্যূলেশনের ( ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হওয়ার সময় ) সময় নারীর সেক্স কোষের দুটি অংশ দুটিভাগে বিভক্ত হয় , এদুটি অংশই X ক্রোমোজোম বহন করে থাকে। অন্যদিকে পুরুষের সেক্স কোষ দু ধরণের শুক্রকীট বা স্পার্ম তৈরী করে , এদের একটিতে থাকে X ক্রোমোজোম আর অন্যটিতে Y ক্রোমোজোম। যখন নারীর X ক্রোমোজোম পুরুষের Y ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বাচ্চাটি হবে মেয়ে। আর যদি তা পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রেমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তবে বাচ্চাটি হবে ছেলে।
অন্য কথায় পুরুষের যে ক্রোমোজোমটি নারীর ডিম্বাণুর ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় সেটির উপরই নিভর্র করছে বাচ্চার সেক্স বা লিঙ্গ।
বিংশ শতাব্দীতে জেনেটিক্স আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই তথ্যগুলো জানা সম্ভব ছিল না। বাস্তবে বহু সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস ছিল যে , বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারিত হয় নারীর দেহ দ্বারা। আর সেজন্যেই কন্যা সন্তান
জন্ম নিলে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হত।
মানুষের জীন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে তেরোশত বছর পূর্বে কোরআন তথ্য দিয়েছিল যা অন্ধ বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে এবং লিংগ নির্ণয়ে পুরুষের ভূমিকার কথা বলে।