মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 30%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25401 / ডাউনলোড: 4295
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

প্রচুর উৎপাদনশীল বায়ু

বায়ুপ্রবাহের প্রচুর উৎপাদন ক্ষমতা কিংবা উর্বরা ক্ষমতা রয়েছে। এটি বায়ুর একটি বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যটি আর তারই ফলস্বরূপ বৃষ্টি উৎপাদনের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে।

আর আমিই প্রেরণ করি বায়ুরাশিকে যা বহন করে পানিপূর্ণ মেঘমালাগুলোকে ; তারপর আমিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করাই ( কোরআন , ১৫ : ২২ ) বৃষ্টিপাতের বা বৃষ্টি উৎপাদনের প্রথম পর্যায় যে বায়ুপ্রবাহ - আয়াতটিতে সে বিষয়েই মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে । বাতাস বা বায়ুপ্রবাহ মেঘমালাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় - বায়ুপ্রবাহ আর বৃষ্টির মধ্য কার এই একটি মাত্র সম্পর্কের কথাই জানা ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত। যাই হোক না কেন আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত তথ্যাগুলো হাতে কলমে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বৃষ্টি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাতসের উৎপাদনশীল বা উর্বরা ক্ষমতার ভূমিকা রয়েছে।

বায়ুর এই উর্বরা বা প্রচুর উৎপাদনশীলতার ক্ষমতা নিম্নরূপে কাজ করে :

পানির ফেনিল বা ফেনায়িত কার্যাবলীর জন্য মহাসমুদ্র আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরিপৃষ্ঠ থেকে অগণিত বায়ুর বুদবুদ তৈরী হয়। ঠিক যে মুহূর্তে বুদবুদ গুলি ফেটে যায় তখনই মাত্র ১০০ ভাগের এক ভাগ পরিধির হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা বের হয়ে এসে উপরে বাতাসে উত্থিত হয়। এরোসোল নামের এই কণিকাগুলো স্থলভাগ থেকে বায়ু বাহিত ধূলিকণার সঙ্গে মিশে ভূমি থেকে উপরে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরগুলোয় উঠে যায়। বাতাসের মাধ্যমে এই কণিকাগুলো আরো উচুঁতে উত্থিত হয়ে পানি বাষ্পের সংস্পর্শে আসে। পানিবাষ্প এই কণিকাগুলোর চারপার্শ্বে ঘনীভূত হয়ে পানিকণিকায় রূপ নেয়। প্রথমে এই পানিকণাগুলো এক সঙ্গে মিশে মেঘ উৎপন্ন করে আর বারিধারা হিসেবে নেমে আসে ধরাতলে।

দেখা গেল যে , সমুদ্র থেকে বয়ে নিয়ে আসা কণিকাগুলোসহ বাতাসে ভাসমান পানি বাষ্প প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় এই বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে আর তারই ফলস্বরূপ বৃষ্টির মেঘ তৈরীতে সাহায্য করে এই বায়ুপ্রবাহ।

যদি বায়ুর এই বৈশিষ্ট্যটি না থাকতো তাহলে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে কখনো পানি বিন্দু তৈরী হতো না , ফলে বৃষ্টি নামের এই পদার্থটি উৎপন্ন হতো না।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো শত শত বছর পূর্বে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে বায়ুমন্ডলের অতি প্রয়োজনীয় ভূমিকাটি বর্ণিত হয়েছিল তখনই , যখন মানুষ প্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপার খুবই কম জানতো ।

উপরের চিত্রটি একটি ঢেউ উৎপাদনের পর্যায়সমূহ প্রদর্শন করছে। পানি পৃষ্ঠের উপরে বাহিত বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমেই এই ঢেউগুলো উৎপন্ন হয়। বাতাসের দ্বারা এই পানিবিন্দুগুলো একটি গোলাকার আবর্তে আবর্তিত হতে থাকে। এই প্রবাহের বা গতিশীলতার মাধ্যমে একের পর একটি ঢেউ তৈরী হয়। এই ঢেউগুলো তৈরী করে বুদবুদসমূহ-যারা বাতাসে যায় ছড়িয়ে। বৃষ্টি উৎপাদনের প্রথম পর্যায় এটি। এই পদ্ধতিটিই ঘোষিত হয়েছে এভাবে : আমিই প্রেরণ করি বায়ুরাশিকে যা বহন করে পানিপূর্ণ মেঘমালাকে তারপর আমিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করাই........।

সাগরসমূহ কখনো মিশে যায়না

কেবলি সেদিন সমুদ্রের একটি বৈশিষ্ট্য উদঘাটিত হয়েছে-যা কিনা পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত , নিম্নে সেই আয়াতটি হলো :

তিনিই মুক্তভাবে প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া , যারা পরস্পর মিলিত হয়ে থাকে , কিন্তু উভয়ের মাঝখানে রয়েছে একটি পর্দা , যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (কোরআন , ৫৫ : ১৯ -২০)

সমুদ্রগুলো পাশাপাশি বয়ে যায় , কাছাকছি আসে কিন্তু কখনোই মিশে যায়না-সাগরগুলোর এই বৈশিষ্ট্যটি সাম্প্রতিক কালে মহাসমুদ্রবিদগণ কর্তৃক উদঘাটিত হয়েছে।Surface Tension বা বহিপৃষ্ঠের টান নামক এক প্রাকৃতিক শক্তির কারণেই প্রতিবেশী সমুদ্রের পানি কখনই একত্রে মিশ্রিত হয় না। বহিপৃষ্ঠের টান নামক এই বলটির সূত্রপাত ঘটে সাগরের পানির ঘনত্বের তারতম্যের কারণে যা কিনা এক সমুদ্রের পানিকে অপর সমুদ্রের সঙ্গে মিশ্রিত হতে দেয় না। বরং দুটি সমুদ্রের পানির মাঝে একটি পাতলা আবরণ হিসেবে বিদ্যমান থাকে।১১

যে যুগের মানুষ পদার্থবিদ্যা , পৃষ্ঠটান কিংবা মহাসমুদ্রবিদ্যা-এগুলো সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা ধারণাই রাখতো না , ঠিক সে সময়েই এই বিষয়টি কোরআনে প্রকাশিত হয় এটি একটি বিরাট আশ্চর্যের ব্যাপার।

ভূমধ্য সাগর আর আটলান্টিক মহাসাগরে রয়েছে বিরাট বিরাট ঢেউ , শক্তিশালী প্রবাহ আর বিদ্যুত। জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে ভূমধ্য সাগরের পানি আটলান্টিক মহাসাগরে চালিত হয়। কিন্তু যে একটি প্রাচীর বা দেয়াল এদের আলাদা করে রেখেছে সেটির কারণেই এদের তাপমাত্রা , লবণত্ত্ব ও ঘনত্তের মাঝে কোন পরিবর্তন ঘটে না।

সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা

সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা অথবা তাদের কার্যাবলী অত্যন্ত গভীর সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকারের ন্যায় , যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের পর তরঙ্গ , যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার। এমনকি যখন কেউ তার হাত বের করবে , তখন সে আদৌ তা দেখতে পাবে না। আর যাকে আল্লাহ হেদায়েতের নূর দান করেন না তার জন্য কোথাও কোন নূর নেই। (কোরআন , ২৪ : ৪০)

Oceans নামক বইটিতে গভীর সমুদ্রের সাধারণ পরিবেশের কথা বর্ণিত হয়েছে : গভীর সমুদ্র ও মহাসমুদ্রসমূহের গভীরে ২০০ মিটার ও তারও নীচে এক আঁধার পরিবেশ বিরাজ করে। এ পরিমাণ গভীরতায় প্রায় কোন আলো নেই। আর প্রায় ১০০০ মিটার গভীরতায় একদমই কোন আলো থাকে না। ১২

অধুনা সমুদ্রের সাধারণ গঠনপ্রণালী , এর মাঝে বিদ্যমান জীবসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলী , এর ঘনত্ব , এর ধারণকৃত পানির পরিমাণ , এর পৃষ্ঠতল আর গভীরতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী ডুবো জাহাজ ও বিশেষ যন্ত্রাদির মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ এই তথ্যসমূহ পেতে পারেন।

কোন ধরনের বিশেষ যন্ত্রাদির সাহায্য ছাড়া মানুষ সাগরের ৪০ মিটার গভীরে বা আরো নীচে ডুব দিতে বা যেতে পারে না। যেমন , ২০০মিটার গভীরে সমুদ্রের গভীর অন্ধকার অংশে কোন প্রকার সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না মানুষ । এ সমস্ত কারণেই বিজ্ঞানীগণ সম্প্রতি সমুদ্র সম্পর্কে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম তথ্যাদি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ ১৪০০ বছর আগেই সূরা নূরে সমুদ্রের আঁধার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এটা অবশ্যই কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের পক্ষে একটি যুক্তি কেননা এ তথ্যটি কোরআনে এমন সময় প্রদান করা হয়েছে , যখন মানুষ মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে তথ্যাদি খুঁজে আনার মত কোন যন্ত্রাদির অস্তিত্বই ছিল না।

অধিকন্তু , তরঙ্গের পর তরঙ্গ , যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার -সূরা নূরের এ আয়াতটিও কোরআনে বর্ণিত আরেকটি অলৌকিক বিষয় হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।

সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীগণ উদঘাটন করেছেন যে , সেখানে রয়েছে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা যারা পানির ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের স্তরের মাঝে সৃষ্টি হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থান করে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা বা ঢেউসমূহ সাগর ও মহাসাগর সমূহের গভীর পানির স্তরগুলো ঢেকে থাকে , কেননা উপরকার পানির চেয়ে ভেতরের পানির রয়েছে বেশী মাত্রার ঘনত্ব।

আজকের প্রযুক্তি দিয়ে পরিমাপ করে দেখা গেছে যে , সমদ্রপৃষ্ঠে শতকরা ৩৩০ অংশ সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়। এর পর আলোর বর্ণালীর প্রায় সাতটি রং প্রথম ২০০ মিটারে শোষিত হয় কেবল নীল আলো ছাড়া। (বামের চিত্রটি) প্রায় ১০০০মিটার তলদেশে একেবারেই কোন আলো নেই। (উপরের চিত্র) ১৪০০ বছর আগে এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি সূরা নূরের ৪০নং আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছিল।

আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা উপরি পৃষ্ঠের তরঙ্গমালার ন্যায় কাজ করে থাকে। উপরিপৃষ্ঠের তরঙ্গমালার মতো আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালাও ভাঙ্গতে পারে। কোন মানব চক্ষু দিয়ে নয় বরং কোন একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের তাপমাত্রা বা লবণের ঘনত্বের পরিবর্তনের পরীক্ষা - পর্যবেক্ষন করেই তবে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালাকে সণাক্ত করা হয়ে থাকে। ১৩

উপরের ব্যাখ্যাগুলোর সঙ্গে কোরআনের উক্তিসমূহ সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোন প্রকার গবেষণা ব্যতীত একজন কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের ঢেউগুলোকেই চর্মচক্ষে অবলোকন করতে পারে। সমুদ্রের আভ্যন্তরীন তরঙ্গ সম্পর্কে অবহিত হওয়া একজনের পক্ষে অসাধ্য ব্যাপার। তারপরেও সূরা নূরে আল্লাহ তাআলা সমুদ্রের বিভিন্ন ঘনত্বে আরেক ধরণের তরঙ্গের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকষর্ণ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই অতি সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীগন যা উদঘাটন করতে পেরেছেন , তা আরো একবার প্রমাণ করে যে , কোরআনের প্রতিটি কথাই আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তাআলার কথা।

মস্তিস্কের যে অংশটুকু আমদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে

আর এরূপ করা কখনই উচিত নয় , যদি সে এরূপ করা থেকে ফিরে না আসে , তবে আমি তাকে অবশ্যই ললাটের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাব।

যে কেশগুচ্ছমিথ্যাচারী পাপাচারীর। ( কোরআন , ৯৬ : ১৫ - ১৬ )

যে কেশগুছ মিথ্যাচারী , পাপাচারীর -উপরের আয়াতের এই অভিব্যক্তিটি সবচাইতে কৌতুহলকর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চালানো গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে , মস্তিস্কের প্রিফ্র্রন্টাল অঞ্চল যা মস্তিস্কের বিশেষ বিশেষ কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে , তা মাথার খুলির অভ্যন্তরে সম্মুখভাগে বিদ্যমান । বিজ্ঞানীগণ এই অঞ্চলের কার্যাবলী গত ষাট বছরে উদঘাটন করেছেন , যা কিনা কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই নির্দেশিত হয়েছিল। আমরা যদি মাথার খুলির ভেতরের আর সম্মুখের অংশে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা সেরিব্রামের ফ্রন্টাল অঞ্চলটি খুঁজে পাব।Essentials of Anatomy and Physiology নামের একটি বই , যাতে এই অঞ্চলের কার্যাবলীর উপরের সর্বশেষ গবেষণার ফলাফলের কথা উল্লেখ রয়েছে , সেই বইটি বলে :

পরিকল্পনা করার আর নড়াচড়া শুরু করার জন্য উদ্বুদ্ধতা আর দুরদশির্তা মস্তিস্কের -সামনের লোবের (Frontal Lobe ) সম্মুখের অংশে অর্থাৎ প্রিফ্রন্টাল-অঞ্চলে ঘটে থাকে। এটি সহযোগী কর্টেক্সের অঞ্চল...।১৪

বইটি আরো বলে : প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলের উদ্বুদ্ধ করার কাজে জড়িত থাকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটিও ধারণা করা হয় যে , এই অঞ্চলটি আগ্রাসনের কার্যকর কেন্দ্র ।১৫

তাই সেরিব্রামের এই অঞ্চলটি পরিকল্পনা , উদ্বুদ্ধ করা আর ভাল ও মন্দ আচরণ শুরু করা এবং সত্যমিথ্যা বলার জন্য দায়ী। এটি পরিস্কার বুঝা গেল যে , যে কেশগুছ পাপাচারী , মিথ্যাচারীর - উক্তিটির সঙ্গে উপরের ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ । বিজ্ঞানীগণ গত ষাট বছরে যে বিষয়টি আবিষ্কার করেছে , তাই অনেক অনেক বছর আগে মহান আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেন।

মানব শিশুর জন্ম

মানুষকে বিশ্বাসের পথে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে কোরআনে বহু বৈচিত্রময় বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। কখনো বা আকাশ , কখনো প্রাণী জগৎ , কখনো বা উদ্ভিদসমূহকে আল্লাহ মানুষের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক আয়াতে মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে নিজেদের সৃষ্টি সম্পর্কে মনোযোগী হতে। প্রায়ই মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে , সে কিভাবে এ পৃথিবীতে আসল , কি কি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সে এলো , তার মৌলিক স্বভাব কি ?

আমিই তোমাদের সৃষ্টি করেছি , তবে তোমরা কেন বিশ্বাস করছ না ? তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে ? তোমরা কি তা সৃষ্টি কর , না আমি তার স্রষ্টা ? (কোরআন , ৫৬ : ৫৭ -৫৯)

বহু আয়াতে মানুষের জন্ম আর জন্মের অলৌকিক অংশগুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। এই আয়াতগুলোয় কিছু কিছু বিষয়ের তথ্যাদি এত পুংখানুপুংখ যে , সপ্তম শতাব্দীতে বিদ্যমান কোন লোকের পক্ষে জানা অসম্ভব ছিল । এদের কিছু কিছু নিম্নরূপ :

১. সম্পূর্ণ বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়নি , এর অত্যন্ত ক্ষুদ্রাংশ থেকে তা সৃষ্টি হয়েছে (শুক্রাণু)।

২. পুরুষ থেকেই শিশুর লিংগ নির্ধারিত হয়।

৩. মানুষের ভ্রুণ জরায়ুর গায়ে জোঁকের মত লেগে থাকে।

৪. মানব শিশু জরায়ুতে তিনটি অন্ধকার অঞ্চলে বেড়ে উঠে ।

কোরআন যে সময়ে নাযিল হয়েছে , সে সময়ের মানুষেরা জানতো যে , যৌনমিলনের সময় বের হয়ে আসা বীর্যের সঙ্গে মানব জন্মের মৌলিক বিষয়টির সম্পর্ক রয়েছে। আর নয় মাস সময়সীমা পরে বাচ্চা জন্ম গ্রহন করে যা স্পষ্টভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি বিষয় ছিল ; এটিকে আরো ঘাটিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল না। যাই হোক এই আয়াতগুলোয় বর্ণিত বিষয়গুলো সে সময়ের মানুষের জানার পরিধি থেকে আরো অধিক দূরের ব্যাপার ছিল । যা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান কর্তৃক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এখন চলুন একের পর এক বিষয়গুলোয় যাই।

একবিন্দু বীর্য

যৌন মিলনের সময় পুরুষের দেহ থেকে প্রতিবারে ২৫০ মিলিয়ন শুক্রকীট বের হয়ে আসে। মায়ের দেহে শুক্রকীট একটি দুরারূহ যাত্রা চালায় ডিম্বাণুতে পৌছা পর্যন্ত । ২৫০ মিলিয়নের মাঝে কেবলমাত্র এক হাজারটি শুক্রাণু ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌছুতে সফল হয়ে থাকে। এই পাঁচ মিনিটের দৌড় শেষে একটি লবণের দানার অর্ধেক আকারের একটি ডিম্বাণু কেবলি একটি শুক্রাণুকে তার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। তাই মানুষের জন্মের সারংশ পুরু বীর্য নয় , বরং এটি তার একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। কোরআনে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

মানুষ কি মনে করে যে , তাকে এমনি বেহিসাব ছেড়ে দেয়া হবে ? সে কি একবিন্দু শুক্র ছিলনা , যা মাতৃগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়েছিল ? (কোরআন , ৭৫ : ৩৬ -৩৭)

আমরা দেখেছি যে , মানুষ সবটুকু বীর্য থেকে নয় বরং এর অতি অল্প অংশ থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এই উক্তিটি এমন একটি বিষয়ের ঘোষণা করছে যা কেবলি আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে । তাই এই উক্তিটি যে স্বর্গীয় এটি তারই প্রমাণ।

বামের ছবিটিতে আমরা দেখি যে , জরায়ুতে বীর্য উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে। পুরুষের দেহ হতে বের হওয়া ২৫০মিলিয়ন শুক্রকীটের মধ্যে মাত্র অল্প সংখ্যক শুক্রকীটই ডিম্বাণুর দিকে পরিচালিত হতে পারে। যে হাজার খানেক শুক্রকীট বেঁচে থাকতে পারে তাদের মাঝে মাত্র একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে। মানুষ পুরো বীর্য নয় বরং একটি ক্ষুদ্রাংশ থেকে সৃষ্ট হয়েছে সেটি কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এক বিন্দু শুক্র হিসেবে।

বীযের্র মিশ্রণ

বীর্য নামক তরল পদার্থটি শুধুমাত্র শুক্রাণু নিয়েই গঠিত নয়। বিপরীতক্রমে এটি আসলে বিভিন্ন তরল পদার্থের মিশ্রণ। এই তরল পদার্থটির বিভিন্ন কাজ রয়েছে। যেমন , এতে শুক্রকীটের শক্তি সরবরাহের জন্য শর্করা থাকে , জরায়ুতে শুক্রের প্রবেশ পথের এসিড নিষ্ক্রিয় করে থাকে এই তরল পদার্থটি , আর শুক্রকীটটির সহজ গতিবিধির জন্য একটি পিচ্ছিল পরিবেশ বজায় রাখে।

যথেষ্ট কৌতূহলের বিষয় হলো যে , কোরআনে এই বীর্যের কথা উল্লেখিত আছে আর এটিকে তরল পদার্থের মিশ্রণ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান কেবল সেদিন এটি আবিষ্কার করলঃ

আমিতো মানুষকে মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি তাকে পরীক্ষা করার জন্য ; এ কারণে আমি তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। (কোরআন , ৭৬ : ২)

অন্য একটি আয়াতে বীর্যকে আবার মিশ্র তরল পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আর মানুষকে যে এই তরলের নির্যাস থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে।

যিনি অত্যন্ত সুন্দররূপে তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে , তারপর তার বংশধরকে সৃষ্টি করেন নগণ্য পানির নির্যাস থেকে। (কোরআন , ৩২ : ৭৮)

আরবী শব্দ সুলালার অনুবাদ করা হয়েছে নির্যাস হিসেবে , যার মানে হলো কোন কিছুর দরকারী অথবা উত্তম অংশ হিসেবে। ব্যঞ্জণার্থেও এর অর্থ একটি অখণ্ড জিনিষের একটি অংশ। এটি দেখিয়ে দেয় যে , কোরআন এক মহাশক্তির কথা যিনি মানুষের সৃষ্টির প্রতিটি অণু পরমাণু অংশ জানেন। আর এই মহাশক্তিশালীই হলেন আল্লাহ , মানুষের সৃষ্টিকর্তা।

শিশুর লিঙ্গ

এইতো সেদিন পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে , মাতৃকোষ দিয়ে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণয় হয়ে থাকে। অথবা এটুকু অন্তত বিশ্বাস করা হতো যে বাবামা উভয়ের কোষ দিয়ে বা চ্চার লিঙ্গ নির্ণিত হয়। অথচ পবিত্র কোরআন আমাদের ভিন্ন তথ্য দিয়ে থাকে যা বলে যে , নির্গত শুক্রবিন্দু থেকে মেয়ে বা ছেলে লিঙ্গ নির্ণিত হয়।

আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন জোড়া নর ও নারী শুক্রবিন্দু থেকে যখন তা গর্ভপাত করা হয়। (কোরআন , ৫ : ৪৫ -৪৬)

ক্রমে উন্নত জেনেটিকস আর মলিকিউলার বায়োলজীর শাখা কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি সত্য বলে প্রমাণ করেছে। এখন বুঝা গেছে যে , পুরুষের শুক্রকীট থেকেই লিঙ্গ নির্ণিত হয় আর এ প্রক্রিয়ায় নারীর কোন ভূমিকা নেই। লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যাপারে ক্রোমোজোমই প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। সনাক্ত করা গেছে যে ৪৬টি ক্রোমোজমের মাঝে দুইটি মানুষের গঠন প্রকৃতি নির্ণয় করে আর এগুলোকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। পুরুষে এ দুটি ক্রোমোজোম হলো XY আর নারীতে এ দুটি XX কেননা এ দুটি ক্রোমোজোমের আকৃতি এ দুটি অক্ষরের মতোই। Y ক্রোমোজোমে বিদ্যমান জীনগুলো পুরুষালী ভাবের কোড বা সংকেত বহন করে আর X ক্রোমোজোম স্ত্রীসুলভ ভাবের কোড বহন করে থাকে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে , নির্গত এক বিন্দু শুক্রের উপর পুরুষত্ব বা নারীত্ব বিষয়টি নির্ভর করে। যাই হোক মোটামুটিভাবে সাম্প্রতিক কালেও বিশ্বাস করা হতো যে , মাতৃকোষ হতেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কোরআনে প্রদত্ত এই তথ্যটি বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে। মানুষের জন্ম সম্বন্ধে এটি এবং বহু তথ্যাদি শতাব্দী পূর্বে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।

Y ক্রোমোজোম পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করে থাকে আর X ক্রোমোজোমে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মায়ের ডিম্বাণূতে থাকে শুধু X ক্রোমোজোম যা নারীর স্বভাব নির্ণয় করে। পিতার বীর্যে শুক্রাণুতে থাকে হয় X ক্রোমোজোম অথবা Y ক্রোমোজোম। সুতরাং বাচ্চার লিংগ নির্ভর করে-পিতার শুক্রাণুর X অথবা Y ক্রোমোজোম ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে কিনা তার উপর। অন্য কথায় আয়াতটিতে বলা হয়েছে ঠিক তেমনি বাচ্চার লিংগ নির্ধারণকারী উপাদান আসে পুরুষ থেকে নির্গত বীর্য থেকে। এই জ্ঞানটি কোরআন নাযিল হওয়ার সময়ে মানুষের জানা ছিল না যা কিনা প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহরই কথা।

এ ক্রোমোজোমদ্বয়ের যে কোন একটির ক্রস কম্বাইনেশনের মাধ্যমে নুতন এক মানব সন্তানের জন্মের সূত্রপাত ঘটে আর এ ক্রোমোজোমগুলো পুরুষ আর নারীতে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। অভ্যূলেশনের ( ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হওয়ার সময় ) সময় নারীর সেক্স কোষের দুটি অংশ দুটিভাগে বিভক্ত হয় , এদুটি অংশই X ক্রোমোজোম বহন করে থাকে। অন্যদিকে পুরুষের সেক্স কোষ দু ধরণের শুক্রকীট বা স্পার্ম তৈরী করে , এদের একটিতে থাকে X ক্রোমোজোম আর অন্যটিতে Y ক্রোমোজোম। যখন নারীর X ক্রোমোজোম পুরুষের Y ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বাচ্চাটি হবে মেয়ে। আর যদি তা পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রেমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় তবে বাচ্চাটি হবে ছেলে।

অন্য কথায় পুরুষের যে ক্রোমোজোমটি নারীর ডিম্বাণুর ক্রোমোজোমের সঙ্গে মিলিত হয় সেটির উপরই নিভর্র করছে বাচ্চার সেক্স বা লিঙ্গ।

বিংশ শতাব্দীতে জেনেটিক্স আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই তথ্যগুলো জানা সম্ভব ছিল না। বাস্তবে বহু সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস ছিল যে , বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারিত হয় নারীর দেহ দ্বারা। আর সেজন্যেই কন্যা সন্তান জন্ম নিলে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হত।

মানুষের জীন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে তেরোশত বছর পূর্বে কোরআন তথ্য দিয়েছিল যা অন্ধ বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে এবং লিংগ নির্ণয়ে পুরুষের ভূমিকার কথা বলে।

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149


6

7

8

9

10