মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন 30%

মিরেকলস অব দ্য কোরআন লেখক:
: ডাঃ উম্মে কাউসার হক
প্রকাশক: -
বিভাগ: কোরআন বিষয়ক জ্ঞান

মিরেকলস অব দ্য কোরআন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 14 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25385 / ডাউনলোড: 4283
সাইজ সাইজ সাইজ
মিরেকলস অব দ্য কোরআন

মিরেকলস অব দ্য কোরআন

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

বৈজ্ঞানিকভাবে ডারউইনবাদের পতন

প্রাচীন গ্রীস থেকেই একটি মতবাদ হিসেবে চলে আসলেও বিবর্তন থিওরিটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে যখন প্রজাতির উৎস নামক বইখানা প্রকাশিত হয়ে থিওরিটিকে বিজ্ঞান জগতে সর্বশেষ টপিকে নিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতিকে পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করেছেন-এটি ডারউইন তার এ বইখানায় অস্বীকার করেন । ডারউইনের মতানুসারে সমস্ত জীবেরই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল এবং এরা কালের যাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যমে বিচিত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ।

ডারউইনের থিওরিটি কোন দৃঢ় বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ছিল না ; তিনি নিজেও মেনে নিয়েছেন যে এটা ছিল নিছকই এক অনুমান অধিকন্তু , ডারউইন তার থিওরীর প্রতিকূলতা নামক বইখানার দীর্ঘ অধ্যায়সমূহে স্বীকার করেছেন যে , থিওরিটি বহু সমালোচনামূলক প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হ চ্ছিল ।

ডারউইন নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পানে তার সমস্ত আশা নিয়োগ করলেন , যেগুলো তার থিওরির প্রতিকূলতাগুলোর সমাধান নিয়ে আসবে বলে তার প্রত্যাশা ছিল । কিন্তু তার আশার বিপরীতে বৈজ্ঞানিত তথ্যগুলো এই সমস্যাগুলোর পরিধি আরো বাড়িয়ে দিল।

বিজ্ঞানের মোকাবেলায় ডারউইনবাদের এই পরাজয়টিকে তিনটি মূল আলোচ্য বিষয়ে পূণর্নিরীক্ষণ করা যায় :

১) ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণের ঊন্মেষ কিভাবে হল-এর ব্যাখ্যা মতবাদটি কোনভাবেই প্রদান করতে পারে না।

২ ) থিওরিটি কর্তৃক প্র স্তাবিত বিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর বিবর্তন ঘটানোর কোন প্রকার ক্ষমতা আদৌ আছে কি নেই - তা প্রমাণ করার জন্য কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই ।

৩) জীবাশ্ম রেকর্ডসমূহ বিবর্তন থিওরির প্রস্তাবনাসমূহের সম্পূর্ণ উল্টো তথ্য বা প্রমাণ সরবরাহ করে ।

এই পরিচ্ছেদে আমরা এই তিনটি মূল বিষয় সাধারণ পরিধিতে পর্যবেক্ষণ করব :

অনতিক্রম্য প্রথম ধাপ : প্রাণের ঊন্মেষ

বিবর্তন মতবাদ শুধুমাত্র তর্কের খাতিরে এটাই শুদ্ধ বলে ধরে নেয় যে , ৩ ৮ বিলিয়ন বছর আগে আদি পৃথিবীতে আবির্ভূত একটি মাত্র জীবকোষ হতেই সমস্ত জীবিত প্রজাতির বিকাশ ঘটেছে । কিভাবে একটি মাত্র কোষ হতে মিলিয়ন মিলিয়ন জটিল প্রজাতির উদ্ভব হলো , আর বিবর্তন বলে যদি কিছু ঘটেই থাকে তবে ফসিল রেকর্ডে কেনইবা এর সামান্য কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না - এ ধরণের কোন প্রশ্নের উত্তর প্রদানে মতবাদটি অক্ষম। যাইহোক , সর্বাগ্রে , উক্ত বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি অনুসন্ধান করতে হবে : কিভাবে এই আদি কোষের উৎপত্তি হলো ?

যেহেতু বিবর্তনবাদ সৃষ্টি কৌশলকে অস্বীকার করে আর অতি প্রাকৃতিক কোন প্রকার মধ্যস্থতাকে মেনে নেয় না , সেহেতু তা এতেই অটল থাকে যে , আদিকোষ কোন ডিজাইন , পরিকল্পনা বা কোন ব্যবস্থাপনা ছাড়াই প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এক আকস্মিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। এই মতবাদ অনুযায়ী , যুগপৎ ঘটনাসমূহের ফলস্বরূপই নিশ্চিতভাবে জড় বস্তুগুলোই একটি জীবকোষের জন্ম দিয়েছে । যাহোক , এটা এমনকি জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অনাক্রম্য নিয়মাবলীর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ একটি দাবী ।

প্রাণী থেকে প্রাণীর উৎপত্তি

ডারউইন তার বইখানায় প্রাণের উদ্ভবের ব্যাপারটি কখনও উল্লেখ করেননি । জীবিত সত্তাগুলোর গঠন কাঠামো অত্যন্ত সরল-এ অনুমানের উপরই তার সময়কার বিজ্ঞানের আদি ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল । মধ্যযুগ থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের নামে একটি থিওরী দাবী করে আসছিল যে , জড় বস্তুগুলো একত্রে মিলিত হয়েই জীবের উদ্ভব ঘটায় , আর এটি তখন বিস্তৃতভাবে গ্রহনযোগ্য ছিল । সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো যে , ফেলে রাখা অতিরিক্ত খাবার থেকে পোকামাকড় আর গম থেকে ইদুঁর জন্ম নেয় । এই মতবাদটি প্রমাণের জন্য মজার মজার গবেষণা চালানো হতো । একটি ময়লা কাপড়ের টুকরায় কিছু গম ফেলে রাখা হতো আর কিছুক্ষন পরেই তা থেকে ইদুঁর জন্ম নেবে বলে বিশ্বাস করা হতো । অনুরূপভাবে মাংস থেকে কীটের উৎপত্তিকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের একটি প্রমাণ বলে ধারণা করা হতো । অবশ্য মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে এটা বোঝা গেলো যে , কীটগুলো মাংসে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে হাজির হয় না , বরং খালি চোখে দেখা যায় না-এমন কিছু লার্ভার আকারে মাছিগুলো কীটগুলোকে বহন করে নিয়ে আসে ।

এমনকি যে সময়ে ডারউইন তার প্রজাতির উৎপত্তি বইখানা লিখেন তখনও ব্যাকটেরিয়া জড়বস্তু থেকে জন্ম নেয় এমন একটি বিশ্বাস বিজ্ঞান জগতে বহুল প্রচলিত ছিল ।

অবশ্য ডারউইনের বই প্রকাশনার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় লুই পাস্তুরদীর্ঘ পর্যবেক্ষন ও গবেষণা শেষে তার ফলাফল ঘোষণা করেন যা ডারউইনের মতবাদের ভিত্তি স্থাপনকারী এই স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনকে মিথ্যা প্রমাণ করে । ১৮৬৪ সনে , সর্বোনে দেয়া এক বিজয়ী লেকচারে লুই পাস্তুর বলেন , এই সরল গবেষণাটি হতে প্রাপ্ত গুরুতর আঘাত থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎপাদনের মতবাদটি আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে না ।

বিবর্তন মতবাদটির সমর্থকগণ পাস্তুরের এই তথ্যগুলোকে দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্য বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন জীবকোষের অতি জটিল গঠনের জট খোলে দিল , তার সাথে সাথে যুগপৎ ঘটনায় প্রাণের অস্তিত্ত্বে আসার কাল্পনিক ধারণা সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সম্মুখীন হলো ।

বিংশ শতাব্দীতে সিদ্ধান্তহীন প্রচেষ্টা

খ্যাতনামা রুশ জীববিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন প্রথম সেই বিবর্তনবাদী , যিনি বিংশ শতাব্দীতে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়টিকে নিয়ে আবার নূতন করে কাজ শুরু করেন । ১৯৩০ সনে তিনি বিভিন্ন থিসিস নিয়ে এগিয়ে আসলেন আর প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে , জীবকোষ যুগপৎ ঘটনায় উৎপন্ন হতে পারে। অবশ্য এবারও এই অনুসন্ধানগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো আর ওপারিনকে নিম্নোক্ত স্বীকারোক্তিখানি করতে হলো : যাইহোক , দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়তোবা কোষের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটি জীবসমূহের বিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের বেলায় সবচেয়ে অস্পষ্ট একটি পয়েন্ট হিসেবে রয়ে গিয়েছে । ২৫

ওপারিনের বিবর্তনবাদী অনুসারীগণ প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক সমস্যাটির সমাধানকল্পে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগলেন। এই পরীক্ষাগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুপরিচিত পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেন ১৯৫৩ সনে আমেরিকান রাসায়নবিদ ষ্ট্যানলী মিলার। তিনি গবেষনার একটি সেট তৈরী করলেন ; তার যুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর আদি পরিবেশে কিছু গ্যাস বিদ্যমান ছিল যেগুলোকে তিনি তার সেটটিতে একসংগে মেশালেন ও মিশ্রণটিতে শক্তি সরবরাহ করলেন। অবশেষে সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের জৈব অণু (এমাইনো এসিড) উৎপন্ন করলেন যেগুলো প্রোটিনের গঠন কাঠামোতে বিদ্যমান থাকে ।

সে সময় এ পরীক্ষাটিকে বিবর্তনের স্বপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উপস্থাপন করা হয়েছিল । কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই এ গবেষণাটি অগ্রহনযোগ্য বলে প্রকাশিত হলো ; কেননা গবেষণায় যে পরিবেশ ব্যবহৃত হয়েছিল তা পৃথিবীর প্রকৃত অবস্থা হতে ছিল অনেক অনেক ভিন্ন ।২৬

দীর্ঘ নীরবতার পর মিলার স্বীকার করে নিলেন যে , তিনি যে পরিবেশের মাধ্যম ব্যবহার করেছিলেন তা বাস্তবে নেই ।২৭

বিংশ শতাব্দী জুড়ে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দানে বিবর্তনবাদীদের পেশকৃত সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো । সান্ডিয়াগো স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট থেকে ভূ -রসায়নবিদ , জেফরী বাদা , ১৯৯৮ সনে আর্থ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক অনুচ্ছেদে এ সত্যটি মেনে নিয়ে বলেন :

আজ এই বিংশ শতাব্দী ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালেও সবচেয়ে বড় যে অমীমাংসিত সমস্যাটির মুখোমুখি আমরা হচ্ছি , যেমনটি হয়েছিলাম এ শতকে প্রবেশের সময় ; সমস্যাটি হল : ভূ - পৃষ্ঠে প্রাণের সঞ্চার হলো কিভাবে ? ২৮

জীবদেহের জটিল গঠন

প্রাণের উৎপত্তি প্রসংগে বিবর্তন মতবাদ এমন একটি বড় ধরণের অচলাবস্থায় সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রাথমিক কারণ যে সমস্ত জীবগুলো অত্যন্ত সরল গঠনের বলে বিবেচনা করা হয়েছিল , সেগুলোরও অবিশ্বাস্য ধরণের জটিল গঠন রয়েছে। মানবপ্রযুক্তি দ্বারা তৈরী সমস্ত পণ্যের চেয়ে একটি জীবকোষ অধিকতর জটিল । আজ এই সময়ে এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ল্যাবরেটরীগুলোতেও অজৈ ব বস্তুগুলোকে একত্রিত করে একখানি জীবকোষ তৈরী করা যায় না ।

একখানি কোষ তৈরীতে প্রয়োজনীয় শর্তাদির পরিমাণ এত বিপুল যে এটাকে যুগপৎ ঘটনায় সংঘটিত হওয়ার ব্যাখ্যা দেয়াই ভার । কোষের গঠন কাঠামোতে ব্লক হিসেবে ব্যবহৃত হয় যে প্রোটিনগুলো , তাদের প্রতিটি গড়ে ৫০০ এমাইনো এসিড নিয়ে গঠিত ; যুগপৎভাবে সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় সে প্রোটিনগুলোর তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা ১০৯৫০ ভাগেরও এক ভাগ। গাণিতিকভাবে ১০৫০ ভাগের চেয়ে কম কিংবা ক্ষুদ্রতর যে কোন সম্ভাবনা বাস্তবে অসম্ভব।

কোষের কেন্দ্রে অবস্থিতডি . এন একটি অবিশ্বাস্য ডাটা ব্যাংক , যা বংশগতির সমস্ত তথ্যাবলী বহন করে থাকে । গণনা করে দেখা গেছে যে , ডি এন তে যে তথ্যাদি সংকলিত রয়েছে তা যদি লিপিবদ্ধ করা যেতো তাহলে তা ৯০০ ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়ার এক বিশালাকায় লাইব্রেরী তৈরী করতো , যেখানে প্রতি ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়া রয়েছে ৫০০ পৃষ্ঠা ।

এই পয়েন্টটিতে একটি উভয় সংকট তৈরী হয় : ডি.এন.এ. কেবলমাত্র বিশেষ ধরণের কিছু প্রোটিনের (এনজাইম) সহায়তায় বিভাজিত হয় । আবার এ এনজাইমগুলো সংশ্লেষনের মাধ্যমে তৈ রী হওয়ার যাবতীয় তথ্যাবলী ডি.এন.এ. এর গায়ে সংকলিত থাকে । আর এই তথ্যাবলী থেকেই সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াগুলো বুঝে নেয়া যায় । দেখা যাচ্ছে যে , উভয়েই পরস্পর পরস্পরের উপর নিভর্রশীল । আর তাই কোষ বিভাজনের সময় তাদের উভয়কে একই সঙ্গে বর্তমান থাকতে হবে। এ কারণেই প্রাণ নিজে নিজেই উৎপত্তি লাভ করবে-এরূপ কাল্পনিক সম্ভাবনাটি বাতিল হয়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ায় সান্ডিয়াগো ইউানভার্সিটির সুনামধন্য বিবর্তনবাদী , অধ্যাপক রেসলি অরগেল , সায়েন্টিফিক এমেরিকান ম্যাগাজিনের ১৯৯৪ সনের সেপ্টেম্বরের প্রকাশনায় একটি আর্টিকেলে এ সত্যটি স্বীকার করে বলেন :

এটা একেবারেই অসম্ভব যে গঠনগতভাবে জটিল প্রোটিন ও এমাইনো এসিড উভয়েই একই সময়ে একই জায়গা হতে উৎপন্ন হবে । তদুপরি এদের একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব অসম্ভব বলেই মনে হয় । আর তাই , প্রথম দৃষ্টিতে একজন এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে , প্রকৃতপক্ষে প্রাণ কখনও রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরী হতে পারতো না ।২৯

বলতে দ্বিধা নেই যে , যদি প্রকৃতিগত কারণে প্রাণের উৎপত্তির সম্ভাবনা না থাকে , তবে তখন এটাই মেনে নিতে হবে যে , এক অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক উপায়েই প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। এ সত্যটুকু সুস্পষ্টভাবে সেই বিবর্তন মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে যার প্রকৃত উদ্দেশ্য সৃষ্টি কর্ম কে অস্বীকার করা।

জীবনের অবিশ্বাস্য রকমের জটিল গঠন বিবর্তন থিওরীকে নস্যাৎ করার মত একটি বিষয়। জীব কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত ডি.এন.এ এটিরই একটি উদাহরণ। ডি.এন.এ এক প্রকার ডাটা ব্যাংক যা চারটি ভিন্ন ভিন্ন অনু সজ্জিত হয়ে তৈরী হয়। জীবসত্ত্বার দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কোড বহন করে এই ডাটা ব্যাংক। গণনা করে দেখা গেছে যে ,যদি মানুষের ডি.এন.এ লিখার ব্যবস্থা করা হয় তবে তা হবে ৯০০ ভলিউম এনসাইক্লোপেডিয়ার সমান। প্রশ্নাতীতভাবেই এই অসাধারণ তথ্যটি নিশ্চিৎভাবে হঠাৎ যুগপত সংঘটনের ধারণাটি ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে।

কাল্পনিক বিবর্তন প্রক্রিয়াসমূহ

দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ডারউইনের মতবাদকে বাতিল করে দেয় তা হলো - বিবর্তনের প্রক্রিয়াবলী হিসেবে যে দুটি ধারণার অবতারনা করা হয়েছিল সেগুলোর বাস্তবে বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতা নেই বলে বুঝা গিয়েছে ।

ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তার উত্থাপিত বিবর্তনবাদের ভিত্তি হিসাবে দাঁড় করান। তিনি এই পদ্ধতির উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তা তার বইটির নামকরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠে : প্রজাতির উৎপত্তি , প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে

প্রাকৃতিক নির্বাচন বিবেচনা করে যে , যে সমস্ত জীব অধিকতর শক্তিশালী ও যেগুলো তাদের আবাস ভূমির স্বাভাবিক অবস্থায় অধিকতর উপযোগী বা যোগ্যতর বলে বিবেচিত হয় তারাই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ , কোন এক হরিণের পাল যখন অন্য কোন হিংস্র জন্তুর কবলে পতিত হয় , তখন যে হরিণগুলো অধিকতর দ্রুত বেগে দৌড়ে যেতে পারে তারাই কেবল টিকে থাকবে । অবশ্য প্রশ্নাতীতভাবেই , এই পদ্ধতি কোন হরিণের মাঝে বিবর্তন ঘটায় না আর একে বিকশিত করে অন্য কোন প্রজাতি , যেমন , ঘোড়ায় রূপান্তরিত -করে না ।

অতএব বিবর্তন ঘটানোর কোন ক্ষমতাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নেই । ডারউইন নিজেও এ সত্যটি অবগত ছিলেন আর তাকে তার প্রজাতির উৎস নামক বইটিতে নিম্ন লিখিত উক্তিখানি করতে হয়েছিল : প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকূল বৈষম্য কিংবা বৈচিত্র্য না ঘটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না । ৩০

ল্যামার্কের প্রভাব

তাহলে কিভাবে এই অনকূল পরিবর্তনগুলো ঘটবে ? ডারউইন তার যুগের বিজ্ঞানের আদি ধারণার দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের চেষ্টা করেন । ডারউইনের পূর্ব যুগে বিদ্যমান ফ্রান্সের জীববিজ্ঞানী ল্যামার্কের মতানুসারে , জীব তাদের জীবদ্দশায় তাদের অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরণ করেছিল আর সেগুলো প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে একত্রীভূত হয়ে নূতন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব ঘটিয়েছিল । যেমন , ল্যামার্কের মতে , জিরাফগুলো এক ধরণের কৃষ্ণকায় হরিণ থেকে বিকশিত হয়েছিল । যখন হরিণগুলো উঁচু বৃক্ষের পাতা খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত , তখন তাদের ঘাড় একটু একটু করে প্রসারিত হয়ে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে লম্বা হয়েছে ।

ডারউইন নিজেও একই ধরণের উদাহরণ দিয়েছেন ; দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি তার প্রজাতির উৎস বইটিতে বলেছেন যে খাবারের খোঁজে পানিতে নামতে গিয়ে কিছু ভালুক কালের পরিক্রমায় নিজেরাই তিমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল ।৩১

যাই হোক , বিংশ শতাব্দীতে ম্যান্ডেল উত্তরাধীকার সূত্রাবলী আবিষ্কার করলেন আর বংশানুগতি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান কর্তৃক সে সূত্রগুলোর যথার্থতা যাচাই করা হলো । বংশানুগতির বা উত্তরাধীকার সূত্রগুলো সে সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে আর অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরিত হয়-এ ধরণের উপাখ্যানটি নাকচ করে দেয়। এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন , বিবর্তন প্রক্রিয়া হিসেবে সমর্থন পেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় ।

নব্য -ডারউইনবাদ এবং মিউটেশন

ডারউইন ভক্তরা ১৯৩০ সালের শেষ দিকে একটি সমাধানে পৌছার লক্ষ্যে আধুনিক সংশ্লেষন থিওরী কিংবা আরো সাধারণভাবে যেটি নব্য -ডারউইনবাদ নামে পরিচিত , সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। নব্য -ডারউইনবাদে মিউটেশন প্রক্রিয়াটি যোগ করা হয় ; আর মিউটেশন হলো - বাহ্যিক কিছু কারণ যেমন , বিকিরণের (Radiation ) কিংবা সংযোজন ভ্রান্তির (Replication error ) কারণে জীবদেহের জীনে সংঘটিত বিকৃতি ; উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলোর জন্য প্রাকৃতিক মিউটেশনের সঙ্গে অনুকল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে জীনে এ বিকৃতি ঘটে থাকে ।

বর্তমানে এই পৃথিবীতে বিবর্তনের মডেল হিসেবে আমরা যেটিকে দেখতে পাই তাই হলো নব্য -ডারউইনবাদ । থিওরিটি এটাই বলে যাচ্ছে যে , পৃথিবীতে মিলিয়ন মিলিয়ন জীব এসেছে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে , যদ্দারা জীবগুলোর জটিল অঙ্গাদি যেমন: কান , চোখ , ফুসফুস আর পাখাসমূহে মিউটেশন কিংবা জিনগত বিশৃংখলা সংঘটিত হয় । তথাপি একটি নির্জলা বৈজ্ঞানিক তথ্য রয়েছে যা এ থিওরিটিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে :

মিউটেশন কখনো জীবদেহের বিকাশ বা উন্নয়ন ঘটায় না বরং তার ক্ষতিসাধন করে ।

এর কারণটি অত্যন্ত সাধারণ : ডি.এন.এ. এর রয়েছে একটি অতি জটিল গঠন আর এলোপাতাড়ি যে কোন পরিবর্তন এ কাঠামোটির ক্ষতি সাধন করে । আমেরিকার জিনতত্ত্ববিদ বি.জি. রাঙ্গানাথান বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন :

মিউটেশন হলো ক্ষুদ্র , এলোপাতাড়ি আর ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। এগুলো কদাচিৎ ঘটে আর ঘটলেও ভাল লক্ষণ যে , এরা কার্যকরী হবে না। মিউটেশনের ৪টি বৈশিষ্ট্য এটাই সূচিত করে যে , প্রক্রিয়াটি কখনো বিবর্তনজনিত বিকাশ ঘটায় না। অত্যন্ত জটিল জীবদেহে এলোপাতাড়ি পরিবর্তনগুলো হয় ব্যর্থ নচেৎ ক্ষতিকর বলে পরিলক্ষিত হয়। একটি ঘড়িতে এলোপাতাড়ি পরিবর্তন একে কোন উন্নতর ঘড়িতে রূপান্তরিত -করতে পারে না। খুব সম্ভবত এতে ঘড়িটির ক্ষতি হবে অথবা বড়জোর তা ব্যর্থ হবে। ভূমিকম্প কখনও নগরীর সমৃদ্ধি ঘটায় না বরং এর ধ্বংসই ডেকে আনে।৩২

এটা কোন আশ্চর্যের কথা নয় যে , মিউটেশনের কোন উদাহরণই কার্যকরী হয় না , তার মানে , মিউটেশন প্রক্রিয়া জীনের গায়ে বিদ্যমান সংকেতলিপির কোন প্রকার উন্নয়ন ঘটায়-এমন কোন দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় না। সব ধরণের মিউটেশনই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মিউটেশনগুলো-যাদের বিবর্তন প্রক্রিয়া বলে উপস্থাপন করা হয়েছে , তারা প্রকৃতপক্ষে জীবদেহে জীনের কতকগুলো সংঘটনমাত্র , যেগুলো বরং দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় বলেই দেখা গিয়েছে। আর সাথে সাথে তা জীবগুলোকে অচল ও পঙ্গু করে দেয়। (মানব দেহে মিউটেশনের ক্ষতিকর প্রভাবের সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ-ক্যান্সার ) এতে কোন সন্দেহ নেই যে , কোন ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া কখনো কোন ক্রমবিকাশ পদ্ধতি হতে পারে না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নির্বাচনও নিজে নিজে কিছু করতে পারে না যা ডারউইন নিজেও মেনে নিয়েছেন। এই তথ্যগুলো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃতিতে কোন বিবর্তন প্রক্রিয়া বিদ্যমান নেই। যেহেতু বিবর্তনের কোন পদ্ধতিরই অস্তিত্ব নেই সেহেতু বিবর্তন নামের কাল্পনিক কোন প্রক্রিয়াও সংঘটিত হয়নি।

ফসিল বা জীবাশ্ম রেকর্ডঃ মধ্যবর্তী কোন আকৃতির অস্তিত্ব নেই

বিবর্তন মতবাদ কর্তৃক প্রস্থাবিত - কোন দৃশ্যকল্প সংঘটিত হয়নি - এ সত্যটির সবচেয়ে পরিষ্কার সাক্ষ্য বহন করছে ফসিল রেকর্ড

বিবর্তন মতবাদ অনুসারে প্রতিটি জীব তার পূর্বসুরী থেকে জন্ম নিয়েছে। পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি সময়ের ধারাবাহিকতায় অন্য কোন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে আর এভাবে বাকী প্রজাতিগুলোও অস্তিত্বে এসেছে। এ মতবাদ অনুসারে , এই রূপান্তর প্রক্রিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়েছে।

এই যদি ব্যাপার হতো তখন অবশ্যই অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির অস্তিত্ব থাকত আর এরা দীর্ঘ পরিবর্তন কাল জুড়ে বর্তমান থাকতো ।

উদাহরণস্বরূপ , অতীতে কিছু অর্ধমাছ / অর্ধসরীসৃপ এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকত তাদের পূর্ব থেকে বিদ্যমান মাছের বৈশিষ্টের সঙ্গে সরীসৃপের কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। কিংবা কতক সরীসৃপ পাখি জাতীয় প্রাণী থাকতো যাদের পূর্বে রয়ে যাওয়া সরীসৃপের বৈশিষ্টের সংগে পাখির বৈশিষ্ট্য যোগ হতো। যেহেতু এরা একরূপ হতে অন্য রূপে উত্তরণের সময় জন্ম নিত সেহেতু তাদের অক্ষম , ত্রুটিপূর্ণ , পঙ্গু জীব হিসেবেই বিদ্যমান থাকার কথা । বিবর্তনবাদীরা এমন সব কাল্পনিক জীবের কথা বলে থাকেন যা অতীতে তাদের রূপ পরিবর্তনকালীন সময়ে দুয়ের মধ্যবর্তী আকারে (intermediate forms ) বিদ্যমান ছিল বলে তাদের বিশ্বাস ।

সত্যিই যদি এ ধরণের প্রাণীর অস্তিত্ব থাকত , তারা সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে হতো মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন অবধি। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে , অদ্ভুত এই প্রাণীগুলোর দেহাবশেষ ফসিল রেকর্ডে বিদ্যমান থাকার কথা। প্রজাতির উৎপত্তি বইটিতে ডারউইন বলেছেন :

আমার থিওরীটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে একই গ্রুপের সমস্ত প্রজাতির মাঝে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনকারী মধ্যবর্তী গঠনের এ ধরণের প্রাণীর সংখ্যা নিশ্চিত ভাবেই হবে অসংখ্য ।

ফলস্বরূপ তাদের অতীতে বিদ্যমান থাকার প্রমাণ কেবলমাত্র তাদের ফসিলসমূহে থেকে পাওয়া যেতে পারে । ৩৩

ডারউইনের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো

যদিও বিবর্তনবাদীরা ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ফসিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন , তথাপি এখনও পর্যন্ত কোথাও কোন অন্তর্বর্তীকালীন গঠনের প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাটি খুঁড়ে তুলে আনা সমস্ত ফসিলগুলো বিবর্তনবাদীদের প্রত্যাশার বিপরীত তথ্য প্রদর্শন করে এটাই প্রমাণ করছে যে , পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে আকস্মিকভাবে আর পরিপূর্ণ আকার নিয়ে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ জীবাশ্মবিদ , ডিরেক ভি. এগার নিজে একজন বিবর্তনবাদী হয়েও তিনি এ সত্যটি মেনে নিয়েছেন এভাবে :

যে তথ্যটি বের হয়ে আসে তাহলো যে , ফসিলগুলো বর্গ বা প্রজাতি - এ দুয়ের যে কোন পর্যায়েই থাকুকনা কেন , যেকোন একটি স্তরে আমরা যদি এদের পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখি , তাহলে বারংবার আমরা খুঁজে পাই কোন ক্রমান্বয় বিবর্তন নয় , বরং এক গ্রুপের পরিবর্তে অন্য আরেকটি গ্রুপের যেন আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে । ৩৪

ফসিল রেকর্ড থেকে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে , সমস্ত জীব প্রজাতিই কোন দুইটি প্রজাতির অন্তর্বর্তীকালীন কোন গঠন নিয়ে নয় বরং পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটি ডারউইনের অনুমানের ঠিক উল্টো। এটি এ বিষয়টিরও একটি অত্যন্ত জ্বলন্ত প্রমাণ যে , সমস্ত জীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমস্ত জীব যে পূর্ববর্তী কোন প্রজন্ম হতে বিকশিত হয়ে নয় বরং আকস্মিকভাবে এবং সম্পূর্ণ অখণ্ড রূপে আবির্ভূত হয়েছে-তার একমাত্র ব্যাখ্যা এটিই হতে পারে যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সুপরিচিত বিবর্তনবাদী ও জীববিদ ডগলাস ফুতুইমা ও এ সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন :

সৃষ্টি আর বিবর্তন - এ দুয়ের মাঝে প্রাণের উৎপত্তির ব্যাখ্যাগুলো ফুরিয়ে যায়। প্রাণীসমূহ পৃথিবীতে এসেছে হয় পূর্ণাঙ্গরূপে নচেৎ আসেনি। যদি তারা পূর্ণাঙ্গরূপে না আসে তবে তারা অবশ্যই পূর্বে বিদ্যমান কোন প্রজাতি হতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় উদ্ভ ূত হয়েছে । যদি তারা পূর্ণাঙ্গ রূপেই এসে থাকে তবে বাস্তবিকভাবে অবশ্যই তারা কোন সর্বশক্তিমান মহাকৌশলী কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে।৩৫

ফসিলগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে , ভূ-পৃষ্ঠে প্রাণসত্ত্বার আবির্ভাব ঘটেছে নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গরূপে। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে , প্রজাতির উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টি কৌশলের মধ্য দিয়ে , বিবর্তনের মাধ্যমে নয় ; আর এটা ডারউইনের অনুমানের ঠিক বিপরীত ।

মহানবী (সা.)-এর নামকরণ

মহানবী (সা.)-এর জন্মগ্রহণের পর সপ্তম দিবস উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিব মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য একটি দুম্বা যবেহ করলেন। মহানবীর নাম রাখার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে সকল কুরাইশ নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম মুহাম্মদ’রাখলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন আপনার নাতির নাম মুহাম্মদ’রাখলেন,অথচ আরবদের মধ্যে এ নামটি অত্যন্ত বিরল? তখন তিনি বললেন, আমি চেয়েছিলাম যে,সে আকাশ ও পৃথিবীতে প্রশংসিত হোক।” এ সম্পর্কে কবি হাসসান ইবনে সাবিত লিখেছেন :

فشق له من اسمه ليبجله

فذو العرش محمود و هذا محمّد

নবীর সম্মান ও মর্যাদার জন্য স্রষ্টা তাঁর নিজ নাম থেকে তাঁর (নবীর) নাম নিষ্পন্ন করেছেন;তাই আরশের অধিপতি (মহান আল্লাহ্) মাহমুদ (প্রশংসিত) এবং ইনি (তাঁর নবী) মুহাম্মদ (অর্থাৎ প্রশংসিত)।”

আর এ দু টি শব্দই (মাহমুদ ও মুহাম্মদ) একই উৎসমূল (হাম্দ) থেকে উৎসারিত এবং উক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থও একই। নিঃসন্দেহে এ নাম চয়ন করার ক্ষেত্রে ঐশী অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। কারণ মুহাম্মদ নামটি যদিও আরবদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল,কিন্তু সে সময় খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তির নামই মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল। কতিপয় ঐতিহাসিক যে সূক্ষ্ম পরিসংখ্যান দিয়েছেন তদনুযায়ী ঐ দিন পর্যন্ত সমগ্র আরবে কেবল 16 ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ’রাখা হয়েছিল। তাই এতৎসংক্রান্ত কবির উক্তি প্রণিধানযোগ্য :

أنّ الّذين سموا باسم محمّد

من قبل خير النّاس ضعف ثمان

মহানবীর আগে যাদের নাম মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল 8-এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ষোল। 132

বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে,একটি শব্দের বাস্তব নমুনা যত কম হবে এতে ভুলভ্রান্তিও তত কমে যাবে। আর যেহেতু পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ তাঁর নাম,চি হ্ন এবং আত্মিক ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই মহানবীর শনাক্তকারী নিদর্শন অবশ্যই এতটা উজ্জ্বল হতে হবে যে,তাতে কোন ভুলভ্রান্তির অবকাশই থাকবে না। তাঁর অন্যতম নিদর্শন তাঁর নাম। এ নামের বাস্তব নমুনা অর্থাৎ যাদের নাম মুহাম্মদ বাস্তবে তাদের সংখ্যা এতটা কম হবে যে,ব্যক্তি মহানবীকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সন্দেহ আর বিদ্যমান থাকবে না। বিশেষ করে যখন তাঁর পবিত্র নামের সাথে তাঁর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হবে। এমতাবস্থায় তাওরাত ও ইঞ্জিলে যে ব্যক্তির আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তাকে খুব স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

প্রাচ্যবিদদের ভুলভ্রান্তি

পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-কে দু বা ততোধিক নামে পরিচিত করিয়েছে।133 সূরা আলে ইমরান,সূরা মুহাম্মদ,সূরা ফাত্হ ও সূরা আহযাবের 138,2,29 ও 40 নং আয়াতে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে এবং সূরা সাফের 6 নং আয়াতে তাঁকে আহমদ’নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর এ দু নাম থাকার কারণ হচ্ছে এই যে,মহানবীর মা হযরত আমেনা দাদা আবদুল মুত্তালিবের আগেই তাঁর নাম আহমদ’রেখেছিলেন। আর এ বিষয়টি ইতিহাসেও উল্লিখিত হয়েছে।134 অতএব,কতিপয় প্রাচ্যবিদ যে দাবি করেছেন,সূরা সফের 6 নং আয়াতে পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিল শরীফ যে নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছে তাঁর নাম আহমদ,তিনি মুহাম্মদ নন;আর মুসলমানগণ যে ব্যক্তিকে তাদের নিজেদের নেতা বলে বিশ্বাস করে তিনি মুহাম্মদ,তিনি আহমদ নন”-তাঁদের এ দাবি সর্বৈব ভিত্তিহীন। কারণ পবিত্র কোরআন আমাদের নবীকে আহমদ’নামেও পরিচিত করিয়েছে এবং কতিপয় স্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে অভিহিত করেছে। যদি এ নবীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তাঁদের দলিল পবিত্র কোরআনই হয়ে থাকে (আর এ ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যাপার ঠিক এটিই) তাহলে এ ক্ষেত্রে বলতে হয়,পবিত্র কোরআন তাঁকে এ দু টি নামেই অভিহিত করেছে অর্থাৎ একস্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’এবং অন্যস্থানে আহমদ’নামে অভিহিত করেছে। এ আপত্তিটির মূলোৎপাটন করার জন্য আমরা নিচে আরো বেশি ব্যাখ্যা দেব।

আহমদ মহানবী (সা.)-এর নামসমূহের একটি

মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে যাঁদের সংক্ষিপ্ত তথ্য ও জ্ঞান রয়েছে তাঁরা জানেন যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) শৈশব ও বাল্যকাল থেকেই আহমদ’ও মুহাম্মদ’এ দু নামে পরিচিত ছিলেন। জনগণের কাছে তিনি এ দু নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর জন্য মুহাম্মদ’এবং তাঁর মা আমেনা আহমদ’নামটি মনোনীত করেছিলেন। এ বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত এবং সকল সীরাত রচয়িতা এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং এতৎসংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা সীরাতে হালাবীতে রয়েছে যা পাঠকবর্গ পড়ে দেখতে পারেন।135

দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর পিতৃব্য আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বর্ণনাধিক ভালোবাসা,মমতা ও স্নেহ দিয়ে পুরো 42 বছর মহানবীর পবিত্র অস্তিত্ব প্রদীপের চারদিকে পতঙ্গের মতো লেগে থেকেছেন। তিনি মহানবীর প্রাণ রক্ষা করার জন্য তাঁর নিজ জান-মাল উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবীর শানে যে কবিতা আবৃত্তি করেছেন তাতে তিনি কখনো তাঁকে মুহাম্মদ’নামে আবার কখনো আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। আর সে সাথে এ বিষয়টি থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,তখন থেকেই আহমদ’নামটি তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ নাম হিসাবেই প্রচলিত ছিল।

এখন আমরা নিচে নমুনাস্বরূপ আরো কতিপয় পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেব যেগুলোতে তিনি মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছিলেন।

إن يكن ما أتى به أحمد اليوم

سناء و كان في الحشر دينا

“আজ আহমদ যা আনয়ন করেছেন তা আসলে নূর (আলো) এবং কিয়ামত দিবসের পুরস্কার।”

و قوله لأحمد أنت أمرء

خلوف الحديث ضعيف النسب

“শত্রুরা বলছে : আহমদের বাণী ও কথাগুলো নিরর্থক এবং সে নিম্নবংশীয় অর্থাৎ দুর্বল বংশমর্যাদার অধিকারী।”

و ان كان أحمد قد جاء هم

بحق و لم يأتهم بالكذب

“নিঃসন্দেহে আহমদ তাদের কাছে সত্যধর্ম সহকারে এসেছেন,তিনি কোন মিথ্যা ধর্ম নিয়ে আসেন নি।”

ارادو قتل أحمد ظالموه

و ليس بقتلهم  فيهم زعيم

“যারা আহমদের ওপর জুলুম করেছে তারা চেয়েছিল তাঁকে হত্যা করতে,কিন্তু এ কাজে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ ছিল না।”

ইতিহাস ও হাদীসশাস্ত্রের গবেষক,পণ্ডিত ও আলেমগণ যে সব কবিতা আবু তালিবের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোতে তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। যা কিছু এখন আমরা বর্ণনা করেছি তার সব কিছুই আমরা তাঁর দিওয়ান (কাব্যসমগ্র)-এর 19,25 ও 29 পৃষ্ঠা হতে নিয়েছি। এ ব্যাপারে আগ্রহী পাঠকবর্গকে আমরা নিম্নোক্ত দু টি গ্রন্থ অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি। গ্রন্থদ্বয় হলো :

1. আহমাদ,মওউদুল ইঞ্জিল (ইঞ্জিলের প্রতিশ্রুত নবী আহমদ),পৃ. 101-107;

2. মাফাহীমুল কোরআন।

মহানবীর স্তন্যপানের সময়কাল

নবজাতক শিশু মুহাম্মদ (সা.) কেবল তিনদিন মাতৃস্তন্য পান করেছিলেন। এরপর দু জন মহিলা মহানবীর স্তন্যদানকারিণী দাই মা হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। তাঁরা হলেন :

1. আবু লাহাবের দাসী সাভীবাহ্ : তিনি তাঁকে চার মাস স্তন্যদান করেছিলেন। তাঁর এ কাজের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজাহ্ তাঁর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি পূর্বে মহানবীর চাচা হযরত হামযাকেও স্তন্যদান করেছিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর মহানবী (সা.) আবু লাহাবের কাছ থেকে তাঁকে ক্রয় করার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন,কিন্তু আবু লাহাব তাঁকে বিক্রয় করতে সম্মত হয় নি। কিন্তু মহানবী তাঁকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সাহায্য করেছেন। মহানবী যখন খাইবার যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন তিনি সাভীবার মৃত্যু সংবাদ পান এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে গভীর শোক ও বেদনার চি হ্ন ফুটে ওঠে। তিনি সওবিয়ার সন্তান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন যাতে করে তাঁর ব্যাপারে তিনি ইহ্সান করতে পারেন। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন যে,সেও তার মায়ের আগে মৃত্যুবরণ করেছে।136

2. হালীমাহ্ বিনতে আবি যূইযাব : তিনি ছিলেন সা দ বিন বকর বিন হাওয়াযিন গোত্রীয়। তাঁর সন্তানদের নাম ছিল আবদুল্লাহ্,আনীসাহ্ ও শাইমা;তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মহানবীর সেবা-যত্ন করেছে। আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারবর্গের প্রথা ছিল তারা তাদের নবজাতক সন্তানদের ধাত্রী মায়েদের কাছে অর্পণ করত। এ সব দাই সাধারণত শহরের বাইরে বসবাস করত। যাতে করে মরুর নির্মল মুক্ত হাওয়া ও পরিবেশে কুরাইশদের নবজাতক শিশুরা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হয় ও সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠে এবং তাদের অস্থি দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়,শহরের বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি ও কলেরা যা নবজাতক শিশুদের জন্য ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক তা থেকে নিরাপদ থাকে সেজন্য কুরাইশরা তাদের নবজাতক সন্তানদের ঐ সব দাইয়ের হাতে তুলে দিত। কুরাইশ নবজাতকগণ দাই মায়েদের কাছে (আরব গোত্রসমূহের মাঝে প্রতিপালিত হওয়ার কারণে) বিশুদ্ধ আরবী ভাষা রপ্ত করে ফেলত। বনি সা দ গোত্রের দাইগণ এ ক্ষেত্রে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পবিত্র মক্কায় আসত এবং কোন নবজাতককে পেলেই নিজেদের সাথে নিয়ে যেত।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করার 4 মাস পরে বনি সা দের দাইগণ মক্কায় আসে এবং ঐ সময় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বলেই তারা সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাহায্যের প্রতি আগের চেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল।

কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক বলেন : কোন দাই হযরত মুহাম্মদকে দুধ দিতে রাজী হয় নি। তারা ইয়াতিম নয় এমন শিশুদের অগ্রাধিকার দিচ্ছিল। কারণ ঐ সব শিশুর পিতারা দাইদের বেশি সাহায্য করতে পারবে। তাই তারা অনাথ শিশুদের নিতে চাইত না,এমনকি হালীমাও নবজাতক হযরত মুহাম্মদকে নিয়ে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। তবে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন বলে কোন ব্যক্তিই তাঁর কাছে নিজ সন্তান অর্পণ করে নি। তিনি আবদুল মুত্তালিবের নাতিকেই অবশেষে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হালীমাহ্ তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, চল,খালি হাতে বাসায় না ফিরে এ অনাথ শিশুকেই গ্রহণ করি। আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহর দয়া আমাদেরকেও শামিল করবে।” ঘটনাচক্রে তাঁর অনুমানই সত্য হলো। যে সময় থেকে তিনি অনাথ শিশু মহানবীর লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন সেদিন থেকেই মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহ তাঁর জীবনকে ঘিরে রেখেছিল।137

এ ঐতিহাসিক বর্ণনাটির প্রথম অংশ কাল্পনিক উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ বনি হাশিম বংশের সুমহান মর্যাদা এবং আবদুল মুত্তালিব-যাঁর দানশীলতা,পরোপকার এবং অভাবী-বিপদগ্রস্তদের সাহায্য প্রদানের বিষয়টি আপামর জনতার মুখে মুখে ফিরত তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের কারণে দাইগণ তো নবজাতক শিশু মুহাম্মদকে লালন-পালনের জন্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেই না,বরং তাঁকে নেয়ার জন্য তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এ কারণেই উপরিউক্ত ঐতিহাসিক বর্ণনার এ অংশ উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অন্য দাইয়ের কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে না দেয়ার কারণ ছিল তিনি স্তন্যদানকারী কোন মহিলার স্তন মুখেই দিচ্ছিলেন না। অবশেষে হালীমাহ্ সাদীয়াহ্ এলে তিনি তাঁর স্তন মুখে দিয়েছিলেন। তাই তখন আবদুল মুত্তালিবের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।138

আবদুল মুত্তালিব হালীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোন্ গোত্রের? তিনি বললেন, আমি বনি সা দ গোত্রের।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, তোমার নাম কি? তিনি উত্তরে বললেন, হালীমাহ্।” আবদুল মুত্তালিব হালীমার নাম ও গোত্রের নাম শুনে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বললেন,بخّ بخّ سعد و حلم. خصلتان فيهما خير الدهر و عز الأبد يا حليمة বাহবা,বাহবা! হে হালীমাহ্ ! দু টি যথাযথ ও সুন্দর গুণ;একটি সৌভাগ্য [সাআদাত (سعادت )-যা থেকে হালীমার গোত্রের নাম বনি সা দ-এর উৎপত্তি)] এবং অপরটি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা [হিলমুন (حلم )-যা থেকে হালীমাহ্ নামের উৎপত্তি)] যেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুগের কল্যাণ এবং চিরস্থায়ী সম্মান ও মর্যাদা। 139

মহানবী (সা.)-এর নামকরণ

মহানবী (সা.)-এর জন্মগ্রহণের পর সপ্তম দিবস উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিব মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য একটি দুম্বা যবেহ করলেন। মহানবীর নাম রাখার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে সকল কুরাইশ নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম মুহাম্মদ’রাখলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন আপনার নাতির নাম মুহাম্মদ’রাখলেন,অথচ আরবদের মধ্যে এ নামটি অত্যন্ত বিরল? তখন তিনি বললেন, আমি চেয়েছিলাম যে,সে আকাশ ও পৃথিবীতে প্রশংসিত হোক।” এ সম্পর্কে কবি হাসসান ইবনে সাবিত লিখেছেন :

فشق له من اسمه ليبجله

فذو العرش محمود و هذا محمّد

নবীর সম্মান ও মর্যাদার জন্য স্রষ্টা তাঁর নিজ নাম থেকে তাঁর (নবীর) নাম নিষ্পন্ন করেছেন;তাই আরশের অধিপতি (মহান আল্লাহ্) মাহমুদ (প্রশংসিত) এবং ইনি (তাঁর নবী) মুহাম্মদ (অর্থাৎ প্রশংসিত)।”

আর এ দু টি শব্দই (মাহমুদ ও মুহাম্মদ) একই উৎসমূল (হাম্দ) থেকে উৎসারিত এবং উক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থও একই। নিঃসন্দেহে এ নাম চয়ন করার ক্ষেত্রে ঐশী অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। কারণ মুহাম্মদ নামটি যদিও আরবদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল,কিন্তু সে সময় খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তির নামই মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল। কতিপয় ঐতিহাসিক যে সূক্ষ্ম পরিসংখ্যান দিয়েছেন তদনুযায়ী ঐ দিন পর্যন্ত সমগ্র আরবে কেবল 16 ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ’রাখা হয়েছিল। তাই এতৎসংক্রান্ত কবির উক্তি প্রণিধানযোগ্য :

أنّ الّذين سموا باسم محمّد

من قبل خير النّاس ضعف ثمان

মহানবীর আগে যাদের নাম মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল 8-এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ষোল। 132

বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে,একটি শব্দের বাস্তব নমুনা যত কম হবে এতে ভুলভ্রান্তিও তত কমে যাবে। আর যেহেতু পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ তাঁর নাম,চি হ্ন এবং আত্মিক ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই মহানবীর শনাক্তকারী নিদর্শন অবশ্যই এতটা উজ্জ্বল হতে হবে যে,তাতে কোন ভুলভ্রান্তির অবকাশই থাকবে না। তাঁর অন্যতম নিদর্শন তাঁর নাম। এ নামের বাস্তব নমুনা অর্থাৎ যাদের নাম মুহাম্মদ বাস্তবে তাদের সংখ্যা এতটা কম হবে যে,ব্যক্তি মহানবীকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সন্দেহ আর বিদ্যমান থাকবে না। বিশেষ করে যখন তাঁর পবিত্র নামের সাথে তাঁর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হবে। এমতাবস্থায় তাওরাত ও ইঞ্জিলে যে ব্যক্তির আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তাকে খুব স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

প্রাচ্যবিদদের ভুলভ্রান্তি

পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-কে দু বা ততোধিক নামে পরিচিত করিয়েছে।133 সূরা আলে ইমরান,সূরা মুহাম্মদ,সূরা ফাত্হ ও সূরা আহযাবের 138,2,29 ও 40 নং আয়াতে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে এবং সূরা সাফের 6 নং আয়াতে তাঁকে আহমদ’নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর এ দু নাম থাকার কারণ হচ্ছে এই যে,মহানবীর মা হযরত আমেনা দাদা আবদুল মুত্তালিবের আগেই তাঁর নাম আহমদ’রেখেছিলেন। আর এ বিষয়টি ইতিহাসেও উল্লিখিত হয়েছে।134 অতএব,কতিপয় প্রাচ্যবিদ যে দাবি করেছেন,সূরা সফের 6 নং আয়াতে পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিল শরীফ যে নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছে তাঁর নাম আহমদ,তিনি মুহাম্মদ নন;আর মুসলমানগণ যে ব্যক্তিকে তাদের নিজেদের নেতা বলে বিশ্বাস করে তিনি মুহাম্মদ,তিনি আহমদ নন”-তাঁদের এ দাবি সর্বৈব ভিত্তিহীন। কারণ পবিত্র কোরআন আমাদের নবীকে আহমদ’নামেও পরিচিত করিয়েছে এবং কতিপয় স্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে অভিহিত করেছে। যদি এ নবীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তাঁদের দলিল পবিত্র কোরআনই হয়ে থাকে (আর এ ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যাপার ঠিক এটিই) তাহলে এ ক্ষেত্রে বলতে হয়,পবিত্র কোরআন তাঁকে এ দু টি নামেই অভিহিত করেছে অর্থাৎ একস্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’এবং অন্যস্থানে আহমদ’নামে অভিহিত করেছে। এ আপত্তিটির মূলোৎপাটন করার জন্য আমরা নিচে আরো বেশি ব্যাখ্যা দেব।

আহমদ মহানবী (সা.)-এর নামসমূহের একটি

মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে যাঁদের সংক্ষিপ্ত তথ্য ও জ্ঞান রয়েছে তাঁরা জানেন যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) শৈশব ও বাল্যকাল থেকেই আহমদ’ও মুহাম্মদ’এ দু নামে পরিচিত ছিলেন। জনগণের কাছে তিনি এ দু নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর জন্য মুহাম্মদ’এবং তাঁর মা আমেনা আহমদ’নামটি মনোনীত করেছিলেন। এ বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত এবং সকল সীরাত রচয়িতা এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং এতৎসংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা সীরাতে হালাবীতে রয়েছে যা পাঠকবর্গ পড়ে দেখতে পারেন।135

দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর পিতৃব্য আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বর্ণনাধিক ভালোবাসা,মমতা ও স্নেহ দিয়ে পুরো 42 বছর মহানবীর পবিত্র অস্তিত্ব প্রদীপের চারদিকে পতঙ্গের মতো লেগে থেকেছেন। তিনি মহানবীর প্রাণ রক্ষা করার জন্য তাঁর নিজ জান-মাল উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবীর শানে যে কবিতা আবৃত্তি করেছেন তাতে তিনি কখনো তাঁকে মুহাম্মদ’নামে আবার কখনো আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। আর সে সাথে এ বিষয়টি থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,তখন থেকেই আহমদ’নামটি তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ নাম হিসাবেই প্রচলিত ছিল।

এখন আমরা নিচে নমুনাস্বরূপ আরো কতিপয় পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেব যেগুলোতে তিনি মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছিলেন।

إن يكن ما أتى به أحمد اليوم

سناء و كان في الحشر دينا

“আজ আহমদ যা আনয়ন করেছেন তা আসলে নূর (আলো) এবং কিয়ামত দিবসের পুরস্কার।”

و قوله لأحمد أنت أمرء

خلوف الحديث ضعيف النسب

“শত্রুরা বলছে : আহমদের বাণী ও কথাগুলো নিরর্থক এবং সে নিম্নবংশীয় অর্থাৎ দুর্বল বংশমর্যাদার অধিকারী।”

و ان كان أحمد قد جاء هم

بحق و لم يأتهم بالكذب

“নিঃসন্দেহে আহমদ তাদের কাছে সত্যধর্ম সহকারে এসেছেন,তিনি কোন মিথ্যা ধর্ম নিয়ে আসেন নি।”

ارادو قتل أحمد ظالموه

و ليس بقتلهم  فيهم زعيم

“যারা আহমদের ওপর জুলুম করেছে তারা চেয়েছিল তাঁকে হত্যা করতে,কিন্তু এ কাজে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ ছিল না।”

ইতিহাস ও হাদীসশাস্ত্রের গবেষক,পণ্ডিত ও আলেমগণ যে সব কবিতা আবু তালিবের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোতে তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। যা কিছু এখন আমরা বর্ণনা করেছি তার সব কিছুই আমরা তাঁর দিওয়ান (কাব্যসমগ্র)-এর 19,25 ও 29 পৃষ্ঠা হতে নিয়েছি। এ ব্যাপারে আগ্রহী পাঠকবর্গকে আমরা নিম্নোক্ত দু টি গ্রন্থ অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি। গ্রন্থদ্বয় হলো :

1. আহমাদ,মওউদুল ইঞ্জিল (ইঞ্জিলের প্রতিশ্রুত নবী আহমদ),পৃ. 101-107;

2. মাফাহীমুল কোরআন।

মহানবীর স্তন্যপানের সময়কাল

নবজাতক শিশু মুহাম্মদ (সা.) কেবল তিনদিন মাতৃস্তন্য পান করেছিলেন। এরপর দু জন মহিলা মহানবীর স্তন্যদানকারিণী দাই মা হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। তাঁরা হলেন :

1. আবু লাহাবের দাসী সাভীবাহ্ : তিনি তাঁকে চার মাস স্তন্যদান করেছিলেন। তাঁর এ কাজের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজাহ্ তাঁর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি পূর্বে মহানবীর চাচা হযরত হামযাকেও স্তন্যদান করেছিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর মহানবী (সা.) আবু লাহাবের কাছ থেকে তাঁকে ক্রয় করার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন,কিন্তু আবু লাহাব তাঁকে বিক্রয় করতে সম্মত হয় নি। কিন্তু মহানবী তাঁকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সাহায্য করেছেন। মহানবী যখন খাইবার যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন তিনি সাভীবার মৃত্যু সংবাদ পান এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে গভীর শোক ও বেদনার চি হ্ন ফুটে ওঠে। তিনি সওবিয়ার সন্তান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন যাতে করে তাঁর ব্যাপারে তিনি ইহ্সান করতে পারেন। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন যে,সেও তার মায়ের আগে মৃত্যুবরণ করেছে।136

2. হালীমাহ্ বিনতে আবি যূইযাব : তিনি ছিলেন সা দ বিন বকর বিন হাওয়াযিন গোত্রীয়। তাঁর সন্তানদের নাম ছিল আবদুল্লাহ্,আনীসাহ্ ও শাইমা;তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মহানবীর সেবা-যত্ন করেছে। আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারবর্গের প্রথা ছিল তারা তাদের নবজাতক সন্তানদের ধাত্রী মায়েদের কাছে অর্পণ করত। এ সব দাই সাধারণত শহরের বাইরে বসবাস করত। যাতে করে মরুর নির্মল মুক্ত হাওয়া ও পরিবেশে কুরাইশদের নবজাতক শিশুরা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হয় ও সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠে এবং তাদের অস্থি দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়,শহরের বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি ও কলেরা যা নবজাতক শিশুদের জন্য ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক তা থেকে নিরাপদ থাকে সেজন্য কুরাইশরা তাদের নবজাতক সন্তানদের ঐ সব দাইয়ের হাতে তুলে দিত। কুরাইশ নবজাতকগণ দাই মায়েদের কাছে (আরব গোত্রসমূহের মাঝে প্রতিপালিত হওয়ার কারণে) বিশুদ্ধ আরবী ভাষা রপ্ত করে ফেলত। বনি সা দ গোত্রের দাইগণ এ ক্ষেত্রে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পবিত্র মক্কায় আসত এবং কোন নবজাতককে পেলেই নিজেদের সাথে নিয়ে যেত।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করার 4 মাস পরে বনি সা দের দাইগণ মক্কায় আসে এবং ঐ সময় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বলেই তারা সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাহায্যের প্রতি আগের চেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল।

কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক বলেন : কোন দাই হযরত মুহাম্মদকে দুধ দিতে রাজী হয় নি। তারা ইয়াতিম নয় এমন শিশুদের অগ্রাধিকার দিচ্ছিল। কারণ ঐ সব শিশুর পিতারা দাইদের বেশি সাহায্য করতে পারবে। তাই তারা অনাথ শিশুদের নিতে চাইত না,এমনকি হালীমাও নবজাতক হযরত মুহাম্মদকে নিয়ে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। তবে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন বলে কোন ব্যক্তিই তাঁর কাছে নিজ সন্তান অর্পণ করে নি। তিনি আবদুল মুত্তালিবের নাতিকেই অবশেষে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হালীমাহ্ তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, চল,খালি হাতে বাসায় না ফিরে এ অনাথ শিশুকেই গ্রহণ করি। আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহর দয়া আমাদেরকেও শামিল করবে।” ঘটনাচক্রে তাঁর অনুমানই সত্য হলো। যে সময় থেকে তিনি অনাথ শিশু মহানবীর লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন সেদিন থেকেই মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহ তাঁর জীবনকে ঘিরে রেখেছিল।137

এ ঐতিহাসিক বর্ণনাটির প্রথম অংশ কাল্পনিক উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ বনি হাশিম বংশের সুমহান মর্যাদা এবং আবদুল মুত্তালিব-যাঁর দানশীলতা,পরোপকার এবং অভাবী-বিপদগ্রস্তদের সাহায্য প্রদানের বিষয়টি আপামর জনতার মুখে মুখে ফিরত তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের কারণে দাইগণ তো নবজাতক শিশু মুহাম্মদকে লালন-পালনের জন্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেই না,বরং তাঁকে নেয়ার জন্য তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এ কারণেই উপরিউক্ত ঐতিহাসিক বর্ণনার এ অংশ উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অন্য দাইয়ের কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে না দেয়ার কারণ ছিল তিনি স্তন্যদানকারী কোন মহিলার স্তন মুখেই দিচ্ছিলেন না। অবশেষে হালীমাহ্ সাদীয়াহ্ এলে তিনি তাঁর স্তন মুখে দিয়েছিলেন। তাই তখন আবদুল মুত্তালিবের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।138

আবদুল মুত্তালিব হালীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোন্ গোত্রের? তিনি বললেন, আমি বনি সা দ গোত্রের।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, তোমার নাম কি? তিনি উত্তরে বললেন, হালীমাহ্।” আবদুল মুত্তালিব হালীমার নাম ও গোত্রের নাম শুনে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বললেন,بخّ بخّ سعد و حلم. خصلتان فيهما خير الدهر و عز الأبد يا حليمة বাহবা,বাহবা! হে হালীমাহ্ ! দু টি যথাযথ ও সুন্দর গুণ;একটি সৌভাগ্য [সাআদাত (سعادت )-যা থেকে হালীমার গোত্রের নাম বনি সা দ-এর উৎপত্তি)] এবং অপরটি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা [হিলমুন (حلم )-যা থেকে হালীমাহ্ নামের উৎপত্তি)] যেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুগের কল্যাণ এবং চিরস্থায়ী সম্মান ও মর্যাদা। 139


9

10