আদর্শিক ও বংশগত উত্তরাধিকারের অভিন্নতা প্রসঙ্গে
এমনও কেউ কেউ আছেন যারা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আহলে বাইতের (‘
আঃ) নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে যুক্তি উপস্থাপন করেন যে , ইসলামে বংশগত শ্রেষ্ঠত্বের তথা বংশগত নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের কোনো স্থান নেই। কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে এ ব্যাপারে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে থাকেন এবং আহলে বাইতের (‘
আঃ) নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের অধিকার প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে এ মতকে কটাক্ষ করে রাজতন্ত্রের সাথে তুলনা করে বলেন , ইসলামে রাজতন্ত্রের স্থান নেই। আর এতে কিছু লোকের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই এ বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা অপরিহার্য।
ইসলামে যে বংশগত শ্রেষ্ঠত্বের তথা বংশগত নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের এবং রাজতন্ত্রের স্থান নেই , এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু আহলে বাইতের (‘
আঃ) সর্বাত্মক নেতৃত্বের (অর্থাৎ দ্বীনী ও পার্থিব নেতৃত্বের) সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই। কারণ , যাদেরকে আহলে বাইতের (‘
আঃ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা করা হয়েছে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর সাথে তাঁদের বংশগত ও আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে নয় , বরং তাঁদের গুণাবলীর কারণে। অতীতের নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ তা’
আলার একই নীতি কার্যকর ছিলো।
অতীতের নবী-রাসূলগণ (‘
আঃ) নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) বংশধারায়ই আগমন করেন , কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে , কেবল নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) বংশধর হওয়ার কারণেই কাউকে নবুওয়াত্ প্রদান করা হয় নি এবং নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) বংশধরদের সকলকেই নবী-রাসূল মনোনীত করা হয় নি।
আল্লাহ্ তা’
আলা নবী-রাসূলগণের (‘
আঃ) মনোনয়ন সম্বন্ধে এরশাদ করেন :
)
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ(
“ অবশ্যই আল্লাহ্ জগতবাসীদের ওপরে আদম , নূহ্ , আলে ইবরাহীম্ ও আলে‘
ইমরান্-কে নির্বাচিত করেছেন ; তাদের কতক অপর কতকের বংশধর। ” (সূরাহ্ আলে‘
ইমরান্ : ৩৩-৩৪)
ইমামত বা সর্বাত্মক দ্বীনী নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়টিও অনুরূপ। আল্লাহ্ তা’
আলার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম্ (‘
আঃ)কে ইমাম নিয়োগের কথা জানানো হলে ইবরাহীম্ (‘
আঃ) এ অঙ্গীকার তাঁর বংশধরদের বেলায়ও প্রযোজ্য কিনা জানতে চান , তখন আল্লাহ্ তা’
আলা যে জবাব দেন-যা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে-তা থেকে এটি প্রমাণিত হয়।
আল্লাহ্ তা’
আলার ফয়ছালাহর যথার্থতা সম্বন্ধে কারো মনে কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্বের উদ্রেক হলে তা সুস্পষ্টই ঈমানের পরিপন্থী। তবে এর যথার্থতার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা সহকারে বাস্তবতার আলোকে এর কারণ জানার চেষ্টা করা দূষণীয় নয় , বরং তা ঈমান মযবূত হবার কারণ হতে পারে।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে আমরা বুঝতে পারি যে , নবুওয়াত-রিসালাত ও দ্বীনী ইমামতের দায়িত্ব পালনের জন্য পাপ ও ভুলের উর্ধে থাকার নিশ্চয়তা থাকা অপরিহার্য। আর এ নিশ্চয়তার জন্য রক্তধারার পরিপূর্ণ পবিত্রতাও অপরিহার্য।
অবশ্য পবিত্র রক্তধারার অধস্তন বংশধরদের মধ্যে পাপ ও অপবিত্রতা প্রবেশ করতে পারে , কিন্তু পাপ ও অপবিত্রতার অধিকারী কোনো ব্যক্তির পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে এ থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভব না হলেও তার নিশ্চয়তা থাকে না এবং বাস্তবে এ ধরনের কোনো ব্যক্তির মনস্তাত্বিক গঠন সর্বস্তরে পবিত্রতার অধিকারী রক্তধারায় আগত নিষ্পাপ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে না। তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা’
আলার সৃষ্টিলক্ষ্যের চূড়ান্ত বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে তিনি সৃষ্টিপরিকল্পনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ই এর মৌলিক কাঠামো তথা যাদেরকে নবী-রাসূল ও নিষ্পাপ দ্বীনী ইমাম হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করবেন তাঁদেরকে সুনির্দিষ্ট করে রাখবেন , আর সে ক্ষেত্রে তাঁদেরকে নিষ্পাপ ও পবিত্র রক্তধারার মধ্যেই নির্ধারণ করে রাখবেন এটাই স্বাভাবিক ; যাদের পাপমুক্ততা ও ভুলের উর্ধে হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত তাদের মধ্য থেকে নয়।
অধিকতর বাস্তব সত্য এই যে , আল্লাহ্ তা’
আলা তাঁর নবী-রাসূল ও নিষ্পাপ দ্বীনী ইমাম সহ যে সব খাছ বান্দাহকে সৃষ্টি করার বিষয়টি তাঁর সৃষ্টিপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৃষ্টির শুরুতে নির্ধারণ করে রাখেন তাঁরা ব্যতীত অন্য সকলের দুনিয়ার বুকে আগমনের বিষয়টি ছিলো এজমালী এবং আল্লাহ্ তা’
আলার নির্ধারিত‘
কারণ ও ফলশ্রুতি ’ (Cause and Effect
-علت و معلول
) বিধির ওপর নির্ভরশীল , সুনির্দিষ্ট নয়।
এর মানে হচ্ছে , আল্লাহ্ তা’
আলার সৃষ্টিপরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত আদম (‘
আঃ)-এর বংশে হাজার হাজার কোটি‘
মানুষ ’ আগমনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আপনার-আমার মতো লোকদের আগমন নির্ধারিত ছিলো না , বরং‘
কারণ ও ফলশ্রুতি ’ বিধির আওতায় আপনার-আমার আগমন অপরিহার্য হয়ে ওঠার কারণেই আপনার-আমার মতো লোকদের আগমন ঘটে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’
আলার সৃষ্টিপরিকল্পনায় নবী-রাসূলগণ , নিষ্পাপ দ্বীনী ইমামগণ ও আরো কতক খাছ বান্দাহর [যেমন : হযরত মারইয়াম (‘
আঃ) ও হযরত ফাতেমাহ্ (সা.’
আঃ)] অন্তর্ভুক্তি ছিলো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি (Proper Noun
) হিসেবে এবং অন্য সকলের অন্তর্ভুক্তি ছিলো কেবল‘
মানুষ ’ (Common Noun
) হিসেবে।
বস্তুতঃ অনেক লোকের ভ্রান্ত ধারণার বরখেলাফে , নবী-রাসূলগণ , নিষ্পাপ ইমামগণ ও আল্লাহ্ তা’
আলার অপর কতক খাছ বান্দাহকে (‘
আঃ) সৃষ্টির বিষয়টি যে আল্লাহ্ তা’
আলার সৃষ্টিপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো শুধু তা-ই নয় , এমনকি তাঁদের নাম-ও পূর্ব থেকে নির্ধারিত ছিলো।
কোরআন মজীদে হযরত ইসমাঈল , হযরত ইসহাক্ব , হযরত ইয়াকূব , হযরত মূসা , হযরত‘
ঈসা ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ)-এর নবুওয়াত্ সম্পর্কে তাঁদের জন্মের আগেই নামোল্লেখ সহ সুসংবাদ দেয়ার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনি হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর নামও পূর্ব থেকেই নির্ধারিত ছিলো। কোরআন মজীদে উল্লেখ করা হয়েছে যে , হযরত‘
ঈসা (আঃ) নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর‘
আহমাদ্ ’ নাম উল্লেখ করে তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (সূরাহ্ আছ-ছাফ্ : ৬) । বারনাবাসের ইনজীলে এখনো তা উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।
এছাড়া ইসলামের সকল মাযহাব ও ফিরক্বাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হাদীছ অনুযায়ী , হযরত আদম (আঃ) আল্লাহ্ তা’
আলার‘
আরশে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও তাঁর আহলে বাইতের চার পবিত্র ব্যক্তিত্বের নূরানী রূপ ও‘
নাম ’ দেখতে পান এবং তাঁদেরকে ওয়াসীলাহ্ করে আল্লাহ্ তা’
আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ বিষয়টি ইয়াহূদীদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ‘
ইদরীস (‘
আঃ)-এর কিতাব ’ -এও উল্লেখ করা হয়েছে।
[এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , ব্যাপক মুসলমানদের মধ্যে এরূপ‘
আক্বীদাহরয়েছে যে , হযরত আদম (আঃ)-এর বংশে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষের আগমন ঘটবে তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগেই তাদের সকলের‘
নাফ্স্’
(যদিও ভুল করে বলা হয়‘
রূহ্’
) সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এটি ভ্রান্ত অদৃষ্টবাদী‘
আক্বীদাহ্ থেকে সৃষ্ট একটি কল্পকাহিনী বৈ নয়-যার পিছনে কোনো অকাট্য দলীল নেই। আর এ কল্পকাহিনীকে যথার্থতা প্রদানের লক্ষ্যে কোরআন মজীদের সেই আয়াতের (সূরাহ্ আল্-আ’
রাফ্ : ১৭২) ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে , আল্লাহ্ তা’
আলার প্রশ্নالست بربکم
(আমি কি তোমাদের রব নই ?)-এর জবাব দেয়া হয়েছিলো :بلا
(অবশ্যই) ।
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিলো হযরত আদম (আঃ)-এর ভবিষ্যত বংশধরদের থেকে নয় , বরং তাঁর সন্তানদের (بنی آدم
) বংশধরদের (من ظهورهم ذريتهم
) তথা হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তানদের সন্তান ও নাতি-নাত্নীদের কাছ থেকে। অর্থাৎ তা এ দুনিয়ার বুকেই সংঘটিত হয়েছিলো।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করি যে , অদৃষ্টবাদীদের‘
আক্বীদাহ্ অনুযায়ী আল্লাহ্ তা’
আলা যদি‘
সকল মানুষের’
সৃষ্টি , তাদের জন্ম-মৃত্যু ও ভালো-মন্দ সহ‘
সব কিছু’
ই আগেই নির্ধারিত করে রেখে থাকবেন তাহলে সে সবের ঘটা তো‘
অনিবার্য’
হয়ে যায় এবং তাহলে লোকদের আমলের জন্য পুরষ্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা তথা দ্বীন ও শারী’
আত্ অযৌক্তিক ও অর্থহীন হয়ে যায় , শুধু তা-ই নয় , বরং সব একবারে নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার ফলে সব সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে যাওয়ায় অতঃপর আল্লাহ্ তা’
আলার‘
স্রষ্টা’
-গুণ আর অনন্ত কালের জন্য অব্যাহত থাকে না। আমি আমার অপ্রকাশিত গ্রন্থ“
অদৃষ্টবাদ ও ইসলাম”
-এ-এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।]