প্রশ্ন ও
উত্তর
১। প্রশ্ন : বাহ্যতঃ আপনার আলোচনাকে কয়েকটি মূল বিষয়ে বিন্যস্ত করা যায় :
প্রথমত :
মুয়াবিয়ার পর ইসলামী সমাজের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) সেই অবস্থাকে মানতে পারছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে সে অবস্থাকে মেনে নেয়ার অর্থই ছিল ইসলামকে ধ্বংস করে দেয়া।
দ্বিতীয়ত , ইমাম হতে বাইআত গ্রহণের জন্যে ইয়াযীদের চাপ প্রয়োগ প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের সূচনা বিন্দু আর ইমামের (আ.) বিদ্রোহ হচ্ছে এই পদক্ষেপের বিপক্ষে এক প্রকার প্রতিরোধ স্বরূপ।
তৃতীয়ত :
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ এমন এক আকার ধারণ করেছিল যে , খলীফার আনুগত্যকে ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল। এই জন্যে হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করার চেষ্টায় ছিলেন যে , খলীফার বিপক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব এবং খলীফার আনুগত্য করা আবশ্যক নয়।
চতুর্থত :
ইমাম (আ.) মক্কায় থাকা কালে , তাঁর নিকট কুফাবাসীদের আহ্বান সম্বলিত বিপুল পরিমাণ পত্র পৌঁছেছিল। এর দ্বারা তারা ইমামের (আ.) নিকট এক প্রকার চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল। আর এই কারণে তাঁর নীরব থাকা অসম্ভব। তাদের দাওয়াত গ্রহণ ও আহ্বানে সাড়া দেয়া , আইনতঃ (শরীয়তগতভাবে) তাঁর উপর ওয়াজিব হয়ে গিয়েছিল।
পঞ্চমত :
এই যে , ইমাম হুসাইন(আ.) শাহাদতকে ইসলামের পুনর্জাগরণের নিয়ামক হিসেবে লক্ষ্য করেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে শাহাদতের মাঝে চূড়ান্ত বিজয়কে সন্ধান করছিলেন।
এখন আমরা যদি বিদ্রোহের কারণ , উদ্দেশ্য ও দর্শন সম্পর্কে আপনার আলোচনাকে তাত্ত্বিক রূপ দিতে চাই তাহলে কি আমরা সমগ্র আন্দোলনকে মাত্র একটি বাক্যে প্রকাশ করতে পারব ? না , আপনার মতে বিষয়টির বিভিন্ন দিক ও উদ্দেশ্য রয়েছে ? আপনি অবহিত আছেন যে , শহীদ মোতাহ্হারীর মত কতিপয় গবেষক এই বিষয়টিকে এই ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন‘
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধই ’ ছিল এই আন্দোলনের মূল নিয়ামক। অবশ্য , তারা অন্যান্য দিক ও বিভাগের কথাও বলেছেন। কেউ কেউ কুফায় শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে মূল ও কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হিসেবে স্বীকার করেছেন। অপর এক দল পণ্ডিত , বিশেষ করে সায়্যিদ ইবনে তাউসের যুগের পণ্ডিতগণ শাহাদতকে আন্দোলনের মূল প্রেরণা বলে বিশ্লেষণ করেছেন। শহীদ মোতাহ্হারীও নিজ মতামতের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেছেন।
আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন ? আর চূড়ান্ত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে , আন্দোলনের সামগ্রিকতাকে কি প্রতিরোধমূলক একটি কাজ হিসেবে গণ্য করছেন ? না , সেইটিকে আক্রমণাত্মক একটি কাজ বলে বিশ্লেষণ করছেন ?
উত্তর :
প্রথমতঃ হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদা (আ.) যেহেতু ইসলামের নবীর (সা.) স্থলাভিষিক্তগণের অন্তর্গত
এবং তাঁর মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিধি বিধানকে সংরক্ষণ করা। সেহেতু এই দায়িত্বকে পালন করা তাঁর কর্তব্য , যদিও তিনি এই পথে নিহত হন। আর এই বর্ণনার দ্বারা অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর চলে আসে।
দ্বিতীয়তঃ ইমাম খোমেনী (রহঃ) ও শহীদ মোতাহ্হারীর লিখাগুলি যতদূর দেখেছি তাতে কেউই এই কথা বলেন নি যে , হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) উদ্দেশ্য ছিল শাসন ক্ষমতা দখল করা। এইরূপ দৃষ্টিগোচর হয় যে , জনগণের নিকট হতে তিনি বাইআত গ্রহণ করার কারণে অনেকে ধারণা করেছেন যে , তিনি খলীফা হওয়ার জন্যে বাইআত গ্রহণ করেছেন , যদিও আজকাল আমরা বাইআত গ্রহণের অর্থ জানি না। রাসূল (সা.) তাঁর সাহাবীগণের নিকট হতে তিনবার বাইআত গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম আক্বাবার বাইআতটি ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল।
দ্বিতীয় আক্বাবার বাইআতটি ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সোলহে হোদায়বিয়ার ঘটনায় বাইআতুর রিদওয়ানটি ছিল মক্কার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে।
ইমাম জা’
ফর সাদিকের (আ.) যুগেও , মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ্ ইবনে হাসান ইবনে হাসানের (আ.) নিকট বাইআত গ্রহণের কারণ ছিল এই যে , বনী হাশিম বংশের লোকেরা ধারণা করছিল , তিনি স্বয়ং হযরত মাহ্দী (আ.) এবং তাঁর নিকট তারা বাইআত করেছিল। বনী উমাইয়্যা বংশের যুগ তখন শেষ হতে যাচ্ছে , ফলে বনী হাশিম বংশের লোকেরা তাঁর নিকট বাইআতের জন্যে সমবেত হয়। কাহিনীর সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ :
বনী হাশিম বংশের কিছু সংখ্যক লোক মদীনার বাইরে‘
আব্ওয়া’
নামক এলাকায় সমবেত হয়। তাদের মাঝে মনসুর দাওয়ানিকী , মনসুরের চাচা সালিহ্ ইবনে আলী ইবনে আব্বাস , আব্দুল্লাহ্ ইবনে হাসান (হাসানে মুছান্নার ছেলে) এবং তার দুই ছেলে মুহাম্মদ ও জা’
ফর উপস্থিত ছিল।
সালিহ্ ইবনে আলী বক্তব্য প্রদান করে বলে :‘
তোমরা সেই সব লোককে চিন অন্যান্য লোকেরা যাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং তাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এখন যেহেতু মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে এখানে সমবেত করেছেন সেহেতু তোমাদের নিজেদের মাঝে কোনো এক ব্যক্তির নিকট তোমরা বাইআত কর। তাহলে মহান আল্লাহ্ বিজয় ও প্রশস্ততা দান করবেন। আর তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম প্রশস্ততা দানকারী। ’
অতঃপর আব্দুল্লাহ্ ইবনে হাসান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলে :“
তোমরা জেনে রেখ যে , আমার এই সন্তান মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ্ই হচ্ছে সেই ইমাম মাহ্দী ! সুতরাং এসো , তার নিকট বাইআত গ্রহণ করি !”
আব্দুল্লাহ্ ইবনে হাসানের সত্যায়নে আবু জা’
ফর মনসুর দাওয়ানিকী বলে :“
আপনি কেন নিজেকে ধোকা দিচ্ছেন ? আল্লাহর শপথ ! আপনি জানেন যে , লোকেরা সবচেয়ে বেশি এই যুবকের (মুহাম্মদের) প্রতি আকৃষ্ট এবং তাকে ছাড়া অন্য কাউকেই এত সাদরে গ্রহণ করবে না ।”
(মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ্ই ছিল তার লক্ষ্য।)
সকলে বলল :“
হ্যাঁ , আল্লাহর শপথ ! তুমি সত্য বলেছ। ইনিই সেই ব্যক্তি যাকে আমরা চিনি ।”
তারপর তারা সকলেই মুহাম্মদের প্রতি হাত বাড়িয়ে তার নিকট বাইআত করে। অতঃপর ইমাম সাদিকের (আ.) সন্ধানে যায়।
ইমাম (আ.) আসেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে হাসান তাঁকে নিজের পাশে স্থান দেয় সেই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে। ইমাম (আ.) তাদেরকে বলেন :“
এই কাজ করো না ! কেননা , এখনও সেই যুগ (প্রতিশ্রুত মাহ্দীর আবির্ভাবের যুগ) আসে নি। হে আব্দুল্লাহ্ ! যদি এইরূপ ধারণা কর যে , প্রতিশ্রুত মাহ্দী হচ্ছেন তোমার এই সন্তান তবে জেনে রেখ যে , এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি নয় ! এই যুগটি ইমাম মাহদী(আ.) এর যুগ নয় ! কিন্তু তোমার লক্ষ্য যদি এই হয় যে , তুমি নিছক আল্লাহর জন্যেই ক্রোধান্বিত হবে (আন্দোলন করবে) এবং সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে , তাহলে আল্লাহর শপথ ! আমরা তোমাকে পরিত্যাগ করব না এবং তোমার সন্তানের নিকট বাইআত করব। কারণ তুমি আমাদের বনী হাশিম বংশের সম্মানিত ব্যক্তি ।”
আব্দুল্লাহ্ রাগান্বিত হয়ে বলে :“
আপনি স্বয়ং জানেন যে , আপনি আপনার জ্ঞানের বিপরীত কথাবার্তা বলছেন ! আল্লাহর শপথ ! আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর ইলমে গায়িব সম্পর্কে প্রতি অবগত করান নি ! বরং আপনার হিংসা আপনাকে , আমার ছেলের ব্যাপারে এইরূপ কথাবার্তা বলতে বাধ্য করেছে !”
ইমাম (আ.) বলেন :“
আল্লাহর শপথ ! এইরূপ নয় ! তোমার প্রতি হিংসা আমাকে এইরূপ কথাবার্তা বলতে বাধ্য করে নি। তবে এই ব্যক্তি (আবুল আব্বাস আস্ সাফ্ফা) , তার ভাই ও ছেলেরা তোমার অগ্রবর্তী হচ্ছে ।”
অতঃপর তিনি আব্দুল্লাহর কাঁধে হাত রেখে বলেন :“
আল্লাহর শপথ ! না তুমি ক্ষমতা পাবে আর না তোমার দুই পুত্র। বরং ক্ষমতা তাদেরই হস্তগত হবে এবং তোমার দুই পুত্র নিহত হবে !”
অতএব , যা কিছু বর্ণিত হল এবং যা কিছু ইমাম সাদিক (আ.) হতে আমরা দেখলাম (ক্ষমতার জন্যে বাইআত প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও , সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্যে বাইআতকে বৈধ মনে করেছেন) তার উপর ভিত্তি করে বোঝা যায় যে , ইসলামে যে কোনো বাইআতই শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়। হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদা (আ.) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতি নিষেধের জন্যে এবং ইয়াযীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে বাইআত গ্রহণ করেছিলেন। আর এইটি স্পষ্ট ছিল যে , তিনি যদি বাস্তবেও বিজয়ী হতেন তবে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতেন ।
হুরের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত একটি ভাষণে ইমাম (আ:) এই কাজেরই দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন।
মদীনায় অবস্থানরত বনী হাশিম বংশের লোকদের উদ্দেশ্যে , মক্কা হতে লিখা তাঁর একটি পত্রে তিনি লিখেন :“
আপনাদের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তিই আমার সাথে সংযুক্ত হবেন , তিনিই শহীদ হবেন ! আর যে ব্যক্তিই এর বিরোধিতা করবেন , তিনি সফলতা লাভ করতে পারবেন না ।”
আর এইরূপ বাইআত গ্রহণ , তাঁর‘
নিহত হওয়ার ’ জ্ঞানের সাথে সাজুয্য রাখে। তিনি জানতেন যে , নিহত হবেন তবুও তাঁর বিদ্রোহ করা উচিত। বিদ্রোহের জন্যেও বাইআত গ্রহণ আবশ্যক ছিল। বর্তমান সময়ে অনেকের ধারণা যে ,‘
যুগের ইমাম(আ.) আবির্ভূত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। ’ এই মতটি পূর্বোক্ত বর্ণনার পুরোপুরি বিপরীত। কিছু সংখ্যক অজ্ঞ লোকেরা ধারণা করে যে , শুধু যুগের ইমাম (আ.) প্রকাশ লাভ করলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে! আমি এই শ্রদ্ধেয়জনদের নিকট প্রশ্ন করতে চাই :
মানুষের জন্যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গরূপে এসেছে কি না ?
যদি ইসলাম পরিপূর্ণ হয় এবং মানুষ ও তার জীবন যাপনের জন্যে তার পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী থাকে তাহলে এই কর্মসূচীসমূহ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে ? যুগের ইমামের দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের (পূর্ণ গাইবাতের) সময়ে মুসলমানরা কি ইসলামী সরকার গঠন করতে ও ইসলামী বিধি বিধানকে কার্যকর করতে পারবে না ? চোরের হাত কাটতে ও ইসলামী অন্যান্য শাস্তির বিধানকে বাস্তবায়ন করতে পারবে না ?
প্রকৃতপক্ষেই কি ইসলামী সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না এবং ইসলামী দেশগুলোতে কি ইসলাম বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে ? অথবা না , সম্ভব হবে ? আমরা বিশ্বাস করি যে , যুগের ইমাম (আ.) প্রকাশ লাভ করে ইসলামী সরকার গঠন করবেন এর অর্থ এই যে , তিনি সার্বিক অর্থে ইসলামী ন্যায় বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি এমন এক সরকার গঠন করবেন যা ইতিহাসের পরিক্রমায় এমনকি পূর্ববর্তী কোনো নবীর (সা.) যুগেও ছিল না এবং তাঁর যুগে কোনো প্রকার জুলুম অত্যাচার থাকবে না । এ সম্ভাবনাও আছে যে , সম্ভবতঃ তিনি অত্যাচারিতের ডাকে সাড়া দেয়া এবং শাস্তি ও বিধি বিধানের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁর নিজ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই কাজ করবেন। বাহ্যিক কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ও দলীলের প্রয়োজন বোধ করবেন না। যেমন মতবিরোধপূর্ণ কোনো বিষয়ে দুইজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির সাক্ষ্যের মুখাপেক্ষী হবেন না ইত্যাদি।
অতএব ,তাঁর সরকার হবে বিশেষ একটি সরকার। এমন একটি সরকার যে , মানবতার ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। এমন নয় যে ,তাঁর আন্দোলনের পূর্বে মুসলমানরা সরকার গঠন করতে পারবেন না। যদি এরূপই হয় যে , মুসলমানরা শরীয়ত সম্মত সরকার গঠন করতে পারবেন না। তাহলে কিভাবে ইসলামকে মানবতার সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা দানকারী বলে স্বীকার করা যায় ? যদি এই ধরনের ধারণা থেকে থাকে তবে এইটি কত বড় ভুল ধারণা !
সুতরাং এইরূপ নয়। আমরাও ইসলামী সরকার গঠন করতে পারব। সেক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ ফকীহ্ , ইসলামী সরকার গঠন করবেন। অবশ্য , আমরা বলছি না যে , ন্যায়পরায়ণ ফকীহর সরকার ঠিক হযরত মাহ্দীর (আ.) সরকারের মত হবে , তাতে কোনো ত্রুটি থাকবে না এবং ফকীহর গঠিত ইসলামী সরকারের উচ্চপদস্থ সকল ব্যক্তিই ত্রুটিহীন হবেন। না , হতে পারে ইসলামী বিন্যাস কাঠামোতে বিভিন্ন ত্রুটি এবং সমস্যা থাকতে পারে। তবে এইরূপ সমস্যা ও ত্রুটিসমূহ , সরকার গঠনের আবশ্যকতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে না।
আসল আলোচনায় আমরা ফিরে যাই
হ্যাঁ , হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদা (আ.) জানতেন যে , তিনি ক্ষমতা লাভ করতে পারবেন না , এই অবস্থা সত্ত্বেও তিনি লোকজনের নিকট হতে বাইআত গ্রহণ করেছেন। কি উদ্দেশ্যে ? খোদা দ্রোহীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যেই শুধু বাইআত গ্রহণ করেছেন , ক্ষমতা লাভের জন্যে নয় ! উদাহরণ স্বরূপ , বর্তমানে ইরাকে স্বৈরাচারী‘
সাদ্দাম ’ ক্ষমতায় রয়েছে এবং মুসলমানদেরকে হত্যা করছে ; ইরাকের লোকদের কি করা উচিত ? তার যে কোনো ইচ্ছা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া উচিত কি ? অথবা না , লোকেরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন ? এতে যদি তারা ক্ষমতা লাভ করে তো করবে আর যদি ক্ষমতা লাভ না করে তবুও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। আমি তো বিষয়টিকে এই ভাবেই বুঝেছি। ইমাম খোমেনীর (রহ.) লেখা আমি যতটুকু দেখেছি এবং মরহুম জনাব মোতাহ্হারীর বক্তব্যগুলি যতটুকু শুনেছি তা এমনই ছিল। এর বিপরীত কিছু দেখিনি।
ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করেছেন , বাইআত গ্রহণ করেছেন , ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে বাইআত এবং এই বিদ্রোহকে শরীয়ত সম্মত ও ওয়াজিব হিসেবে জেনেছেন। এই বিদ্রোহ ও বাইআতের অপরিহার্য শর্ত এটি ছিল না যে , তিনি তাঁর নিহত হওয়াকে অবিশ্বাস করেছেন। বরং তিনি তাঁর নিহত হওয়াকে প্রাণপণে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও ইয়াযীদের বিপক্ষে বিদ্রোহ ঘোষণা করাকে ওয়াজিব গণ্য করেছেন।
২। প্রশ্ন :
আন্দোলন প্রকৃতিগত ও মানবিক হওয়া এবং শাহাদত সম্পর্কে ইমামের পূর্ব জ্ঞান এই দুয়ের মাঝে কি বিরোধ দেখা দেয় না ?‘
আন্দোলন ঐশী ও আধ্যাত্মিক হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ’ এবং‘
জাগতিক ও সামাজিক হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ’ এই দুয়ের মাঝে ও কি কোনরূপ দ্বন্দ্ব ও বিরোধ নেই ? উদাহরণ স্বরূপ , ইমাম (আ.) যখন হুরের মুখোমুখি হয়েছেন তখন বলেছেন“
আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও , আমি ফিরে যাব ।”
এই কথাটি কিভাবে ,‘
শাহাদত কামিতা ও স্বীয় শাহাদত সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান’
এর সাথে সমন্বিত হতে পারে ?
উত্তর :
যেমন আলোচনার মধ্যে বলা হয়েছে সার্বিকভাবে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের পটভূমি , বিরাজমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় তাঁর শাহাদত ব্যতীত ধর্মের পুনর্জাগরণ সম্ভব হত না। এমনকি , আলী আসগরকে যেভাবে শহীদ করা হয়েছে , তিনি যদি সেভাবে শহীদ না হতেন তবে খিলাফত ব্যবস্থার পবিত্রতা ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হত না এবং লোকেরা মর্মান্তিক ঘটনার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারত না। জনগণকে সুপথ দেখানোর জন্যে এবং জাগ্রত করার জন্যে এই সব ক্ষুদ্রক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম বিষয় সমুহের সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল।
ইমাম (আ.) আশুরার রাতে তাঁর সকল সাথি ও পরিবার পরিজনকে এ বিষয়ে অবগত করেন যে , পরের দিন তারা সকলে শহীদ হবে , কেউ চলে যেতে চাইলে যেতে পারে।
ঘটনার এটি একটি দিক। অপরদিকে পরিখা খনন করার জন্যেও আদেশ দিয়েছেন ! কেন ? সকলেই যখন শহীদই হবেন তখন যত দ্রুত হয় ততই ভাল ! কিন্তু না ! পরিখা খনন করেছেন এবং তার মাঝে আগুন জ্বালিয়েছেন যাতে যুদ্ধে পরাভূত না হন আর চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগ হাত ছাড়া না হয়। আশুরা দিবসে ইমাম (আ.) অবশ্যই সকলের প্রতি তাঁর চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণকে পূর্ণ করবেন। কারণ তিনি হচ্ছেন সুপথ প্রদর্শনকারী। তাঁর যাবতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে জনগণের হেদায়াতের জন্যে যদিও তিনি একাই হন। আপনারা জানেন যে , যুহাইর ইবনে কাইন‘
উছমানী মাযহাবের ’
লোক ছিলেন। পূর্বে তিনি আহলে বাইতের (আ.) বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ আলীর (আ.) শত্রুছিলেন। ইমাম (আ.) তাঁকে হুসাইনী (হুসাইনের অনুসারী) করেছিলেন। তিনি মক্কা হতে ফিরে আসার পথে , ইমামের সাথে এক স্থানে একত্রিত না হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। যখন নিরুপায় হয়ে তিনি একই স্থানে ইমামের সাথে অবতরণ করলেন তখন ইমাম তাঁর নিকট লোক পাঠালেন এবং তাঁকে আহ্বান জানালেন। ইমামের প্রেরিত লোকটি যখন তাঁর নিকট গেলেন তখন তিনি আহার করছিলেন। তিনি তাঁকে আহ্বান করাতে তাঁর সাথিরা চমকে উঠল। তবে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডেকে বললেন :‘
যুহাইর ! রাসূলের (সা.) নাতি তোমাকে আহ্বান করছেন আর তুমি গড়িমসি করছ ?!’
যুহাইর দেখা করে ফিরে এলেন। তাঁর চেহারার অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল ! তিনি তাঁর সাথিদেরকে বললেন :“
তোমাদের সাথে এটিই আমার শেষ সাক্ষাৎ !”
তাঁর স্ত্রীকে বললেন :“
তুমি তোমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে মিলিত হও ।”
অতঃপর তিনি তাঁর সাথিদেরকে কোনো একটি যুদ্ধের ঘটনা এবং আশুরার দিবস সম্পর্কে রাসূলের (সা) জনৈক সাহাবী প্রদত্ত সংবাদটি শুনালেন। কারণ তারা সকলেই রাসূলের (সা.) নিকট হতে হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) আন্দোলনের সংবাদটি শুনেছিলেন এবং জানতেন যে , তাঁর আন্দোলনে শাহাদত বিদ্যমান।
অতএব ,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কর্মে বাধা দানের জন্যে ইমামের আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। উপরন্তু এই কাজের মাধ্যমে ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে। তিনি আন্দোলন না করলে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। তিনি তাঁর আন্দোলন দ্বারা তৎকালীন মুসলমান ও আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :
১। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কর্তব্য।
২। শুধুমাত্র বিজয় অর্জন ও সামরাজ্যের বিস্তৃতির জন্যেই জিহাদ নয়।
তবে“
আমাকে ছেড়ে দাও , আমি ফিরে যাব ”
এই কথার সাথে“
শাহাদত সম্পর্কে তাঁর পূর্ব জ্ঞান ” কিভাবে খাপ খায় ? এর উত্তর এই যে , বনী উমাইয়্যা বংশের প্রতি চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করা ইমামের (আ.) কর্তব্য ছিল। কারবালা পর্যন্ত তাঁর আসার মাধ্যমে কতকগুলি কাজ সম্পাদিত হয়েছিল অর্থাৎ তৎকালীন দুনিয়া উপলব্ধি করেছিল যে , ইয়াযীদের নিকট আলীর পুত্র হুসাইন (আ.) বাইআত করেন নি। আর এখন যে , তিনি ফিরে যেতে চাচ্ছেন তবুও ইয়াযীদের হাতে বাইআত করেন নি। শুরু হতে শেষ পর্যন্ত এই ছিল ইমামের বক্তব্য। কারবালা প্রান্তরেও তিনি বলেন :
“ তোমরা যখন গ্রহণ করছ না এবং নিজ প্রতিশ্রুতির উপরও অটল নও তখন দু’
টির যে কোনো একটিকে গ্রহণ কর , হয় মদীনায় ফিরে যেতে দাও নতুবা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে দাও ।”
এর মাধ্যমেও তিনি চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যাতে তারা না বলে যে , আমরা নিরুপায় হয়েই তাঁকে হত্যা করেছি ! এই কাজটি অতীতের চেয়ে অধিক মাত্রায় তাদের অত্যাচারের মুখোশকে খুলে দিয়েছে। ইমাম (আ.) জানতেন যে , এরা বিরত হবে না। আর সেই জন্যেই তিনি এই কাজের মাধ্যমে চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তিনি রাজক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ইরাক হতে ফিরে আসতে চাওয়ার বিষয়টিও প্রমাণ করে না যে , তিনি পুনরায় আন্দোলন করবেন না। যেহেতু তিনি বাইআত করেন নি এবং করতেনও না সেহেতু তিনি স্বাধীন ছিলেন। ফিরে যাওয়ার পর পুনরায় প্রচেষ্টা করতেন এবং অপর একটি আন্দোলনের পটভূমি রচনা করতেন। সুতরাং যে কোন অবস্থায়ই তাঁকে আন্দোলন করতে হত ।
হ্যাঁ , যদি তিনি বাইআত করতেন তবে আর কোন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ থাকত না এবং আত্মসমর্পণ করা তাঁর আবশ্যক হয়ে যেত। কিন্তু ইমাম (আ.) পূর্ণ স্পষ্টতার সাথে বলেন :“
আমি বাইআত করব না!”
যাতে করে খিলাফত কর্তৃপক্ষের সমস্যা বলবৎ থাকে। এমনকি যদি আমরা ধরেও নেই যে , তারা ইমামকে (আ.) ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিত তবুও সেইখানেই তাঁর আন্দোলন তাঁর কিছু উদ্দেশ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। কেননা তিনি তাদেরকে বলেন :“
আমি ইয়াযীদের নিকট বাইআত করব না। তোমরা বলেছিলে এবং লিখেছিলে :‘
আমাদের নিকট আসুন , আমরা আপনার সহযোগী হব !’
আমি এসেছি। এখন তোমরা যদি আমাকে ফিরে যেতে না দাও তবুও আমি বাইআত করব না !”
৩। প্রশ্ন :
আপনার বক্তব্যের আলোকে , আমরা কি মুসলমানদের শিক্ষাপ্রক্ষণকেও ইমাম হুসাইনের (আ.) বিপ্লবের ফল হিসেবে গণ্য করব ?
উত্তর :
হ্যাঁ , এটি ইমামের (আ.) বিপ্লবের অন্যতম ফল ছিল অর্থাৎ নির্ভেজাল ও খাঁটি ইসলাম , মুহাম্মদের (সা.) খাঁটি ইসলামকে পরিচয় করানো। যেমন বসরার যুদ্ধে যখন হযরত আয়িশার সৈন্যবাহিনীর উপর হযরত আলীর (আ.) সৈন্যবাহিনী বিজয় লাভ করল তখন পূর্ববর্তী খলীফাদের অনুসৃত নীতির উপর ভিত্তি করে তাদের ধারণা ছিল এই যে , বসরা তাদের অধিকারভুক্ত হওয়ার পর বিরোধীদের সমস্ত অর্থ সম্পদ ও যথাসর্বস্ব তাদের জন্যে বৈধ গণ্য হবে। এমনকি তাদের নারী ও শিশুদেরকেও বন্দী এবং তাদের মাঝে ভাগ বণ্টন করা হবে। ঠিক আবু বকরের যুগে সংঘটিত যুদ্ধগুলির ন্যায় হবে যেগুলিতে বিরোধী দলের অর্থ সম্পদগুলি তারা গ্রহণ করে এবং তাদের নারীদেরকে বন্দী করে। কিন্তু ইমাম (আ.) এই কাজে বাধা দান করেন এবং বলেন :“
এরা মুসলমান এবং ইসলামের ভিত্তির উপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সৈন্যদের নিকট হতে যেই সব গনিমত তোমরা পেয়েছ সেইগুলিই তোমাদের সম্পদ। আর তাদের অর্থ সম্পদ , নারী ও শিশুদের উপর তোমাদের কোনরূপ অধিকার নেই ।”
কিন্তু ইমামের (আ.) এই পদক্ষেপ ও বক্তব্য সৈন্যদের মাঝে সাদরে গৃহীত হল না। অনেকেই গোলযোগ করা আরম্ভ করল এবং বলল :“
আপনি ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করলেন না ! এইটি কিরূপ সিদ্ধান্ত যে , তাদের রক্তপাত করা আমাদের জন্যে বৈধ অথচ তাদের অর্থ সম্পদ ও নারীরা আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ ?!”
তিনি বললেন :“
এরা ইসলামের আইন অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন করেছেন ইত্যাদি ।”
এতে যখন তারা সন্তুষ্ট হল না তখন ইমাম (আ.) অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন এবং বললেন :“
খুব ভাল কথা , যখন তোমরা গ্রহণ করছ না এবং নিজেদের অংশ চাচ্ছ , তাহলে তোমাদের মাঝে কোন্ ব্যক্তি‘
উম্মুল মু’
মিনীন হযরত আয়িশাকে ’ নিজের অংশ হিসেবে গ্রহণ করবে ? যদি নারীদেরকে তোমরা বন্দিনী করতে চাও তবে তিনি তাদের নেত্রী , তাঁকে প্রথম বন্দী কর !”
এর মাধ্যমে গোলযোগ সৃষ্টিকারীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে ও ইমামের (আ.) আদেশের নিকট মাথা নত করে এবং এর মাধ্যমে ধর্মীয় বিধানাবলির কিয়দংশ শিক্ষা গ্রহণ করে।
অন্যান্য যুদ্ধেও পূর্ববর্তী খলিফাদের অনুসৃত নীতির প্রতিফলন দেখা যায় যেমন মুয়াবিয়া বলতেন :‘
যেখানেই তোমরা প্রবেশ করবে সেখানেই হত্যা করবে এবং তাদের অর্থ সম্পদগুলি লুটতরাজ করবে ইত্যাদি। ’ কিন্তু ইমাম (আ.) তাঁর সৈন্যবাহিনীকে বলতেন :“
যেখানেই তোমরা প্রবেশ কর , শুধুমাত্র তখনই সেখানকার পানপাত্র হতে তোমাদের জীব জন্তুগুলিকে পানি পান করাও যখন তারা তাদের পশুদের পানি পান করানো সম্পন্ন করেছে , কারও অর্থ সম্পদ নিবে না এবং কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নিজের সাথে নিয়ে যাবে না। যদি কোনো জিনিসের প্রয়োজন হয় তবে তা ভাড়া নিবে এবং তার ভাড়ার অর্থ প্রদান করবে ।”
এই সব কারণেও ইমামের (আ.) সৈন্যরা অনেক ক্ষেত্রে ইমামের আহ্বানে সাড়া দিতনা। কারণ তার মাঝে দুনিয়া ছিল না। তারা এমন ধরনের জিহাদ কামনা করত যার সাথে দুনিয়া থাকবে। তারা পথ হারিয়ে ফেলেছিল। ইমাম হুসাইনের(আ.) আন্দোলনের অন্যতম ফলাফল এই ছিল যে , তা মুসলমানদেরকে সঠিক জিহাদের পথ দেখিয়েছিল।
৪। প্রশ্ন :
আপনার আলোচনা থেকে বোঝা যায় ইমাম হুসাইনের শাহাদত ও আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটানো এবং এটি একটি পর্যায়ক্রমিক এবং দীর্ঘ মেয়াদী কাজ , স্বল্প মেয়াদী ও তড়িৎ অনুভব যোগ্য কোন কাজ নয়। আমরা কি ঠিক বুঝেছি ?
উত্তর :
হ্যাঁ , তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল ইসলামের পুনর্জাগরণ। যদি ইমাম (আ.) বাহ্যিক ভাবে বিজয়ীও হতেন এবং তার নিকট বাইআত করতেন তবে ইসলাম পুনর্জীবিত হত না ! কেন ? এই জন্যে যে , ইমাম হুসাইন (আ.) যে শাসন প্রতিষ্ঠা করতেন , তা অবশ্যই তাঁর পিতা হযরত আলীর (আ.) প্রতিষ্ঠিত শাসনের চেয়ে সুদৃঢ় হত না।
ইমাম আলী (আ.) যা চেয়েছেন তাই কি তিনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন ? তিনি স্বয়ং বলেন :“
যে বিধানগুলিকে তারা (পূর্ববর্তী খলিফারা) পরিবর্তন করে দিয়েছে আমি সেগুলিকে ইসলামী সমাজে ফিরিয়ে আনতে চাই ।”
তিনি আরও বলেন :“
আমি বলেছিলাম যে , জামাআতবদ্ধ হয়ে নফল নামায আদায় করো না , এইরূপ করা ঠিক নয় ! আমার সৈন্যদের মাঝ হতে‘
ওয়া সুন্নাতা , ওয়া সুন্নাতা উমার ’ এর ধ্বনি উচ্চারিত হল !”
(চিন্তা করে দেখুন ! ইমামের সৈন্যরা ইমামের সাথে কিরূপ আচরণ করছে ?) তারা বলল :‘
আলী আমাদেরকে জামাআতবদ্ধ হয়ে মুস্তাহাব নামায আদায় করতে বারণ করছেন। ’ আলী (আ.) বলেন :“
সৈন্যদের মাঝে গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে আমি তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেই ।”
অতএব , যদি ইমাম হুসাইন (আ.) খলীফাও হতেন তবুও নিশ্চিত যে , তিনি মুয়াবিয়ার ক্ষমতাকে পরিবর্তন করতে পারতেন না। কারণ খিলাফতের প্রচলিত শিক্ষায় প্রশিক্ষিত জনগণ এই বিষয়গুলিকে বুঝতে পারত না এবং খলীফাদের নিয়মের যে কোনো পরিবর্তনকে তারা ইসলামের পরিবর্তন বলে গণ্য করত।
অন্যতম ভুল এই যে , লোকেরা বলে :‘
ইমাম হুসাইনের (আ.) প্রতি পত্র লেখকরা শিয়া ছিল এবং পরবর্তীতে সেই পত্র প্রেরকরাই অর্থাৎ শিয়ারাই তাঁর সাথে বিরোধিতা করে। ’ না , তারা শিয়া ছিল না বরং খুলাফা মতাদর্শের অনুসারী ছিল। যেমন হযরত আমীরুল মু’
মিনীন (আ.) স্বয়ং , তাঁর নিকট বাইআত কারীদের সম্পর্কে খুৎবায় বলেন :“
যদি ইসলামের বিধানগুলিকে পূর্বের মত করে সমাজে ফিরিয়ে আনতে চাই তবে যারা আমার ইমামতকে কুরআন ও রাসূলের সুন্নাত থেকে গ্রহণ করেছে তাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত , আমার অন্য কোনো সাহায্যকারী অবশিষ্ট থাকবে না ।”
অর্থাৎ যারা ইমামের ইমামতকে কুরআন ও সুন্নাহ্ হতে গ্রহণ করেছিলেন তারা সংখ্যায় অল্প ছিলেন। আর পূর্ববর্তী খলীফারা যে সব বিধানকে পরিবর্তন করেছিলেন , ইমাম সেগুলিকে ইসলামী সমাজে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। কারণ ইসলামের মূল কাঠামো হচ্ছে বিধি বিধান ও আকীদাসমূহ , শুধুমাত্র নাম নয়। যারা ইমাম আলী(আ.) এর নিকট বাইআত করেছিলেন তাদের অধিকাংশের মস্তিষ্কে এইরূপ চিন্তা ভাবনা ছিল যে , অন্যান্য খলীফাদের ন্যায় আলীও (আ.) একজন খলীফা। আর এই কারণে ইমাম (আ.) বলছেন :“
আমার সাথে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। তবে তারা ব্যতীত , যারা আমার ইমামতকে কুরআন ও সুন্নাহ্ হতে গ্রহণ করেছেন ।”
তারা সংখ্যায় স্বল্প ছিলেন। অন্যরা নিজ খেয়াল খুশিমত এইরূপ ধারণা করছিল যে , ইমাম (আ.) তাদের বাইআতের মাধ্যমে আমীর ও শাসক নির্বাচিত হয়েছেন।
সুতরাং ইমাম হুসাইনকে (আ.) পত্র প্রেরণকারী ও আহ্বানকারীদের অধিকাংশই খুলাফা মতাদর্শের অনুসারী ছিল এবং তাদের মাঝে খুব কম সংখ্যকই শিয়া ছিলেন। হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) সম্পর্কেও তাদের হুবহু এই ধারণা ও চিন্তা ভাবনাই ছিল। তাদের মস্তিষ্কে এটা ছিল না যে , ইমাম (আ.) হচ্ছেন নিষ্পাপ , আল্লাহর পক্ষ হতে তিনি মনোনীত ইমাম এবং তিনি যা কিছু বলেন তার আনুগত্য করা আবশ্যক ! মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তারা ইমামকে (আ.) খিলাফতের জন্যে শ্রেয় ও অধিক উপযুক্ত জ্ঞান করছিল অর্থাৎ ইমামকে ইয়াযীদের চেয়ে ভাল মনে করছিল ! আর যখন ইমামের (আ.) বাইআত প্রতিষ্ঠিত হল না এবং তাদের ধারণা মত ইমাম (আ.) তাদের বাইআতের দ্বারা খলীফা হলেন না বরং তার পরিবর্তে ইবনে যিয়াদ ও ইয়াযীদের বাইআত প্রতিষ্ঠিত হল এবং ইয়াযীদ খলীফা হল। সুতরাং তাদের ধারণা অনুযায়ী ইমাম হুসাইনের(আ.)ও উচিত ইয়াযীদের হাতে বাইআত করা ও তার আনুগত্য করা। এক্ষেত্রে তারা এদু’
য়ের মাঝে পারস্পরিক বৈপরীত্যও দেখে নি ! বাইআত , খলীফা হওয়া এবং খলীফার আনুগত্য করা ; শাইখাইনের (প্রথম দু’
খলীফার) প্রবর্তিত একটি আদর্শ যা অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সা.) সুন্নতের উপরও প্রাধান্য পেয়েছে !
হ্যাঁ , ইসলামী বিশ্বে এই বক্রতাসমূহ ও বক্র চিন্তা ভাবনাসমূহই ইমামকে (আ.) বিদ্রোহ করতে বাধ্য করেছে , যার ফলে তিনি ইয়াযীদের হাতে বাইআত না করে প্রাণ বিসর্জন দেন ! তা ছিল বিশেষ ও ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রাণ বিসর্জন ! যাতে করে জনগণ জেগে উঠে এবং তথাকথিত খিলাফতের পবিত্রতার অলীক ধারণা ভঙ্গ হয় এবং এর মর্যাদার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণিত হয়। আহলে বাইতের (আ.) অন্য ইমামগণ ইসলাম এবং তার বিধি বিধান ও আকীদাসমূহকে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ পান। মুহাম্মদী (সা.) খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলামকে ইসলামী সমাজে ফিরিয়ে আনার অনুকূল পরিবেশ পান।
ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্।