১ ইসলাম
পূর্ব
আরবের
সামাজিক
অবস্থা
ইসলাম পূর্ব আরব উপদ্বীপে বিশেষ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল । গোত্র ও শ্রেণী ভিত্তিক ঐ সমাজের লোকেরা মরুভূমি অতিক্রমকারী কাফেলা সমূহের উপর আক্রমণ ও লুটতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তবে বিশেষ কিছু শহরে সীমিত চাষাবাদ ছিল এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে তাদের জীবন পরিচালিত হত। তাদের কোনো প্রকারের প্রশাসন ছিল না । সভ্যতা ও সংস্কৃতি হতে তারা দূরে ছিল। বিভিন্ন গোত্র ও কাফেলার উপর আক্রমণের সময় একে অপরকে বন্দী করে উকায বাজারের ন্যায় মক্কার আশপাশের বাজারগুলিতে এবং অন্যান্য জায়গাতেও বিক্রি করত। আর এইভাবে জীবিকা নির্বাহ করত !
মক্কায় রাসূলের (সা.) আগমনকে আরবদের গৌরবের বিষয় জ্ঞান করে (!) এমন ধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনাসম্পন্ন কিছু আরবের সাথে একবার কথা বলছিলাম ! তাদেরকে বললাম :“
প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা ডাক্তারকে সেই জায়গাতেই প্রেরণ করেন যেখানে রোগী থাকে। মহান আল্লাহ্ও মক্কায় রাসূলকে (সা.) এই কারণেই প্রেরণ করেছিলেন যে , তৎকালীন পৃথিবীতে মক্কার অধিবাসীদের অপেক্ষা অধিক রোগাক্রান্ত আর কেউ ছিল না ।”
এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে‘
যাইদ ইবনে হারিছা ’ র গল্পটি।
যাইদ ইবনে হারিছার ঘটনা
যাইদ ইবনে হারিছা , শৈশবকালে আত্মীয় স্বজনকে দেখার উদ্দেশ্যে তার মায়ের সাথে অপর এক গোত্রে গেলে , লুণ্ঠনকারীর দল তাদের উপর আক্রমণ করে এবং সে পালাতে না পারায় বন্দী হয় ও উকাযের বাজারে তাকে বিক্রয় করা হয়। খাদীজার কর্মচারী তাকে ক্রয় করেন এবং খাদীজা তাকে উপহার হিসেবে রাসূলকে দেন। তিনিও (সা.) তাকে মুক্ত করে দেন এবং তারপর সে যখন রাসূলকে (সা.) পরিত্যাগ করতঃ নিজ পিতা ও চাচার সাথে নিজ গোত্রে ফিরে যেতে সম্মত হল না তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) কা’
বার নিকটে এবং জনগণের মাঝে ঘোষণা দিলেন যে , যাইদ তাঁর পালিত পুত্র।
যাইদের ঘটনাটি ইসলাম পূর্ব আরবের জনগণের সাধারণ অবস্থার একটি দৃষ্টান্ত ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর এই জনগণের অধিকাংশই হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয়ে যায়। মক্কা ও মদীনা আলোর কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এমন এক অবস্থায় উপনীত হয় যে , এক আনসার যুবক বদর যুদ্ধে রাসূলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বলে :“
হে আল্লাহর রাসূল ! যে ব্যক্তি এই দলের সাথে যুদ্ধ করবে ও মারা যাবে তার পুরস্কার কী ?”
উত্তরে তিনি বলেনঃ“
বেহেশ্ত ।”
সেই যুবক বললেন :“
বাহ্ বাহ্ ! আমার এবং বেহেশ্তের মাঝে শুধুমাত্র এই খোরমাগুলিই ব্যবধান যা আমি খাচ্ছি !”
সেগুলিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়। হ্যাঁ , তখন যুদ্ধ ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালীন সুখের জন্যে। ইসলামের আলো , কুরআন ও রাসূল (সা.) তাদেরকে পরিবর্তিত করেন। কিন্তু অনুতাপ এই যে , অল্প সময়ের মধ্যেই , রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের সাথে সাথে তাদের অনেকেই ইসলামের আলোকে অন্ধকারে রূপান্তরিত করে এবং তাঁর মিশনকে এমন জায়গায় পৌঁছায় যে , শহীদগণের সেনাপতির বিদ্রোহ এবং তাঁর হৃদয় বিদারক শাহাদত ব্যতীত ইসলামের পুনর্জীবন সম্ভব ছিল না।
২. ইমাম হুসাইনের (আ.) বিপ্লবের পূর্বে মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা
পবিত্র কুরআনে কতিপয় সাহাবীর চিত্র
প্রথমে কুরআনুল কারীমের ভাষায় মুসলমানদের ব্যবহারিক চিত্রকে বর্ণনা করব যাতে করে তৎকালীন সমাজের আত্মিক ও নৈতিক অবস্থা এবং পরবর্তী বংশধরের উপর তার যে প্রভাব পড়েছে তার পূর্ণ পরিচিতির মাধ্যমে ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে আমরা ভালভাবে বুঝতে পারি।
ক .অপবাদ ও কুৎসা রটনা
বিশেষ একটি দল যারা রাসূল (সা.) এর পরিবারের উপর অপবাদ আরোপ করে এবং তারপর তা প্রচার করে , কুরআনুল কারীম তাদেরকে“
উসবাতুন মিনকুম ” অর্থাৎ তোমাদের মাঝ হতে শক্তিশালী একটি দল বলে উল্লেখ করে বলেছে:
)
إِنَّ الَّذِينَ جَاءُوا بِالْإِفْكِ عُصْبَةٌ مِّنكُمْ لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم(
“ নিশ্চয় যারা সেই বৃহৎ অপবাদ রটনা করেছে তারা ছিল তোমাদের মাঝের শক্তিশালী একটি দল। তা তোমরা নিজেদের জন্য ক্ষতিকর ভেব না ।”
উম্মুল মু’
মিনীন আয়িশা ’ র বর্ণনা মতে ইফ্কের ঘটনাটি তাঁরই সাথে জড়িত।
তবে অপর একটি বর্ণনা মতে“
মারিয়া কিব্তীয়ার ” সাথে জড়িত।
কিন্তু যাই হোক , ঘটনা যার ব্যাপারেই হোক , রাসূল (সা.) এর পরিবারের উপর অপবাদ আরোপ ! (আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি !) তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের উপর আঘাত হানা হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে যে , এই ধরনের সুসংগঠিত শক্তিশালী দল , যারা আল্লাহর রাসূলের (সা.) পরিবারের প্রতি অপবাদ আরোপ ও কুৎসা রটনা করে , তারা কী মিথ্যা হাদীছকে আল্লাহর রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করবে না এবং জাল ও বানোয়াট হাদীছ বর্ণনা করবে না ?
খ .ব্যবসা বাণিজ্য ও খেলাধুলা
পবিত্র কুরআন সূরা জুমু’
আয় একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছে যা রাসূলের যুগে তিনি জুমু’
আর নামাযে খুৎবাদানরত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। ঘটনাটি খুলাফা (সুন্নী) মতাদর্শের সমস্ত তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন :
)
وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِندَ اللَّـهِ خَيْرٌ مِّنَ اللَّـهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللَّـهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ(
আর যখন তারা কোনো ব্যবসা কিংবা চিত্তবিনোদন ও ক্রীড়া কৌতুক দেখে তখন তারা তোমাকে (রাসূল) দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে দিয়ে তার দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে যায় ! বল , যা কিছু আল্লাহর নিকট আছে তা ক্রীড়া কৌতুক ও ব্যবসা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। মহান আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা ।”
ঘটনাটি নিম্নরূপ
রাসূল আকরাম (সা.) জুমু’
আর নামাযের খুৎবা দানরত অবস্থায় ছিলেন , এমন সময় একটি বাণিজ্য কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করে এবং ঢাক ঢোল বাজিয়ে জনগণকে পণ্য ক্রয়ের জন্যে আহ্বান করে। মদীনার লোকেরা রাসূলকে দণ্ডায়মান অবস্থায় পরিত্যাগ করতঃ বাণিজ্য কাফেলার দিকে ছুটে যায় , যাতে পণ্য ক্রয় এবং বিনোদন করার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে না থাকে। আর মুসল্লীদের মধ্য হতে নারী পুরুষ মিলে মাত্র বিশজন লোক অবশিষ্ট থাকে ! এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে ,পবিত্র এ আয়াতের উপর ভিত্তি করে এই ধরনের লোকেরা যারা আল্লাহর রাসূলের বক্তব্য শ্রবণ এবং জুমু’
আর নামায অপেক্ষা ব্যবসা বাণিজ্য ও চিত্তবিনোদনকে অগ্রাধিকার দেয় , তাদের উপর কি আস্থা ও বিশ্বাস রাখা যেতে পারে ? শুধুমাত্র রাসূলের সাহাবী হওয়ার কারণেই কি এমন ধরনের লোকদের নিকট হতে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের সুন্নতকে গ্রহণ করা যায় ? সেও আবার কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের সবার নিকট হতেই ?! যেমন কতিপয় মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গি এমনই !
গ .মুনাফিকী ও কপটতা
সূরা তওবায় মহান আল্লাহ্ এমন ধরনের মুনাফিকদের সম্পর্কে সংবাদ দিচ্ছেন যে , শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্ই তাদেরকে চিনেন ; এই মুনাফিকরা মদীনার চতুষ্পার্শ্বে এবং স্বয়ং মদীনার অভ্যন্তরেও রয়েছে। তারা কপটতার চর্চা করে এবং এক্ষেত্রে তারা অভিজ্ঞ । মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
)
وَمِمَّنْ حَوْلَكُم مِّنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٍ(
“ মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ , তারা কপটতায় সিদ্ধহস্ত। তুমি তাদেরকে জান না ; আমরা তাদেরকে জানি। আমরা তাদেরকে অচিরেই দুইবার শাস্তি দিব এবং অতঃপর তারা প্রত্যাবর্তিত হবে মহাশাস্তির দিকে !”
(সূরা তওবা , আয়াত নং:১০১)
চিন্তা করছেন কী ! অতি সংগোপনে ও সিদ্ধহস্তে মুনাফিকী করা ! এমন ধরনের মুনাফিক যে , কুরআনের বর্ণনা অনুসারে রাসূল আকরামও (সা.) তাদেরকে চিনেন না !
এরা আবার রাসূলের চারদিকের লোকদেরই অংশ বিশেষ ! তারাও সুন্নী মতাদর্শে সাহাবা হিসেবে আখ্যায়িত। আর (কুল্লুহুম ’ ঊদূল) সকলেই ন্যায়পরায়ণ হিসেবে পরিচিত হয়েছে ! শুধুমাত্র এই কারণেই যে , একবার হলেও তো রাসূলকে দেখেছে !
ঘ. রাসূল আকরাম(সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্র
সুন্নী ইতিহাস গ্রন্থ গুলিতে এসেছে : আল্লাহর রাসূল (সা.) তাবুকের অভিযান হতে সিপাহীদের নিয়ে ফিরে আসার সময় , পথিমধ্যে একটি উপত্যকায় পৌঁছলে মুনাফিকদের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারেন যে , তারা তাকে হত্যায় গভীর সংকল্পবদ্ধ। এই কারণে , সিপাহীরা উপত্যকাটির ভিতরে প্রবেশ করার উপক্রম হলে , রাসূল (সা.) গিরিপথের সম্মুখভাগে এগিয়ে গিয়ে যাত্রায় বিরতি দেন এবং আম্মার ও হুযায়ফাকে তাঁর সঙ্গে আসতে বলেন। আম্মার উটের লাগাম ধরে সামনে টানতে থাকেন আর হুযায়ফা উটটির পিছন হতে চালনা করেন। পথিমধ্যে মুনাফিকদের কন্ঠ শুনতে পান যে , তারা তাঁদেরকে অবরোধ করে ফেলেছে এবং রাসূলের উটটি এতে চমকে উঠলে হুজায়ফা ও আম্মার সেইটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন , আর তারা মুখমণ্ডলে নেকাব পরিহিত থাকলেও হযরত হুযায়ফা তাদের বাহন দেখে অনেককেই সনাক্ত করতে পারেন। মুনাফিকরা এমন অবস্থা দেখে সেইখান হতে পলায়ন করে। রাসূল (সা.) বলেন :“
তোমরা কি জান , তারা কেন এসেছিল এবং কি চাচ্ছিল ?”
তাঁরা উত্তর দিলেন :“
হে আল্লাহর রাসূল ! আমরা তা জানি না !”
তিনি বললেন :“
আমাকে এই গিরিপথ হতে নিচে ফেলে দেয়ার জন্যে এরা ষড়যন্ত্র করে ছিল !”
সাহাবীগণ সবিনয়ে জানতে চাইলেনঃ“
তাদেরকে হত্যা করার জন্যে আপনি কি আদেশ দিবেন না ?”
তিনি বললেনঃ“
আমি এতে সন্তুষ্ট নই যে , লোকেরা বলুক : মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সাহাবাদের রক্তে নিজের হাতকে রঞ্জিত করেছেন !”
অতঃপর , আম্মার ও হুযায়ফার নিকট তিনি তাদের নামগুলি বললেন এবং তাদের উভয়কে বললেনঃ“
তোমরা এটিকে গোপন রেখ !”
লেখক বলেন :“
আমি আজ পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থের উপর গবেষণা করে তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনকে সনাক্ত করতে পেরেছি , সেই ব্যক্তি হচ্ছে“
আবু মূসা আশ্আরী ।”
আহলে বাইত (আ.) মতাদর্শের অনুসারীদের গ্রন্থসমূহে এসেছে : এই ষড়যন্ত্রটি“
আকাবায়ে হারশাতে ” ঘটেছিল এবং এইটি গাদীরে খুমের ঘটনার পরে সংঘটিত হয়েছিল , এই মতটি অধিকতর বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। কারণ বিষয়টি ছিল হযরত আলীকে ইমামতের দায়িত্বে মনোনীত করা নিয়ে। তবে যাই হোক এবং যে কোনো বিষয় সম্পর্কিত হোক , সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে , তারা ছিল রাসূলের সাহাবা এবং তাদের তাঁকে হত্যা করার গভীর সংকল্প ছিল। তাদের সংখ্যা বিশ জনের কিছু বেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে , তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনকেই সনাক্ত করতে পেরেছি , সে হচ্ছে আবু মূসা আশ্আরী।
ঙ. রাসূলের মুমূর্ষু অবস্থা ও উসামার সৈন্য
রাসূল (সঃ) মুমূর্ষু অবস্থায়ও ফেৎনা নিরসন এবং শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী সাহাবীদের অভ্যুত্থানের পথ রোধর জন্যে একটি পরিকল্পনা করেন। তিনি উসামার বাহিনীতে যোগদানের আদেশদানের মাধ্যমে সবাইকে মদীনার বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন । উসামা শহীদ যাইদ ইবনে হারিছার পুত্র এবং আঠার বছরের যুবক ছিলেন। উসামাকে সেনাপতি হিসেবে নির্বাচন করতঃ যুবক ও বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে আদেশ দেন যে , তারা সবাই যেন তার সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। সকলকে উসামার নেতৃত্বে মদীনা হতে যাত্রা করতে বলেন । এই সেনাবাহিনীতে হযরত আবু বকর , উমর , আবু উবাইদা জাররাহ , আব্দুর রহমান ইবনে আউফ , সা’
দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস , সা’
দ ইবনে উবাদা ’ র মত ব্যক্তিগণ এবং আরও প্রথিতযশা ও খ্যাতনামা সাহাবীগণ ছিলেন। তারা প্রথমতঃ ছিদ্র অন্বেষণকারীর পরিচয় দেন এবং বলেন :“
আঠার বছর বয়সের একজন যুবককে আমাদের নেতা মনোনীত করেছেন ?”
আর এই কথা বলার পাশাপাশি যাওয়া থেকেও বিরত থাকেন! রাসূল আকরাম (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করে বলেন:“
লা’
আনাল্লাহু মান্ তাখাল্লাফা’
আন্ জায়শি উসামাহ্ ।”
“
যারা উসামার সেনাবাহিনীতে যোগদান করা হতে বিরত থাকবে আল্লাহ্ তাদের প্রতি লা’
নত করুন !”
উসামার সেনাবাহিনী যাত্রা করে মদীনা হতে কয়েক কিলোমিটার দূরে জারাফ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। আর ঐ অবস্থায় রাসূলের অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করে এবং এই সংবাদ সেনা শিবিরে পৌঁছিলে মুহাজির ও আনসারদের শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মদীনায় ফিরে আসেন। ফজরের সময় বাড়ীর দরজার সামনে হযরত বিলাল এসে“
আস্ সালাহ্ , আস্ সালাহ্ , ইয়া রাসূলাল্লাহ্ !”
বলে আওয়াজ দেন , এই অবস্থায় রাসূল (সা.) যেহেতু হযরত আলীর (আ.) হাঁটুর উপর মাথা রেখে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে ছিলেন সেহেতু এই অবস্থাটিকে উম্মুল মু’
মিনীন আয়িশা সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং বিলালকে বলেন :“
রাসূল বলেছেন , আবু বকরকে আমার স্থানে নামায পড়াতে বলো !”
আবু বকর মসজিদে গিয়ে রাসূলের স্থানে নামায আদায় করতে দাঁড়ালে রাসূলের জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি আবু বকরের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তখন তিনি বলেন :“
আমাকে উঠাও ! আমাকে উঠাও !”
অতঃপর ওযু করেন। সহীহ্ বোখারীর বর্ণনা অনুসারে , তিনি পথ চলতে পারছিলেন না , তাঁর পা দু’
খানা মাটিতে ঘর্ষিত হচ্ছিল এই অবস্থায় তিনি দু’
জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে গমন করেন এবং আবু বকরের নামাযকে ভঙ্গ করে তিনি বসা অবস্থায় নামায পড়ান। নামাযের পর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করেন এবং সেই দিনই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
চ. ইন্তেকালের সময় এবং“
হাসবুনা কিতাবুল্লাহ্”
নামায সমাপ্ত করে রাসূল (সা.) বাড়ীতে ফিরে আসেন আর শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগণ তাঁর চারিদিকে সমবেত হন। বাহ্যতঃ নামাযের ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে আবু বকর লজ্জিত হওয়ার কারণে অনুমতি নিয়ে সানাহ্ ’ তে তার বাড়ীতে চলে যান। তবে উমর ইবনুল খাত্তাব তার বিশেষ দল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। সহীহ্ বোখারীর বর্ণনা অনুসারে রাসূল (সা.) বলেনঃ“
হালুম্মা আকতুবু লাকুম কিতাবান্ লান্ তাযিল্লু বা ’ দাহ্ ” অর্থাৎ এসো ! তোমাদের জন্যে এমন কিছু লিখে দিব যে , এরপর তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না।
তারা যেহেতু জানতেন যে , রাসূল (সা.) কি লিখবেন , তার জন্যে তারা প্রতিক্রিয়া দেখালেন। হযরত উমর বললেনঃ“
হাসবুনা কিতাবুল্লাহ্ ” আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্যে যথেষ্ট !”
রাসূলের একজন স্ত্রী , বাহ্যতঃ যয়নব বিনতে জাহ্হাশ হবেন , তিনি বললেনঃ“
আপনারা দেখেন , রাসূল কি চাচ্ছেন ! তিনি কি বলছেন , আপনারা কি তা শুনছেন না ?”
হযরত উমর বললেনঃ“
আন্তুন্না সাওয়াহিবু ইউসুফা ।”
তোমরা ইউসুফের আসক্তা । রাসূলের অবস্থা যদি ভাল হয় তবে তাঁর কলার চেপে ধর এবং খরচা চাও । আর যদি তিনি অসুস্থ থাকেন তবে কান্না কাটি করো !”
রাসূল তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন এবং যখন তাঁর আহ্বানে কেউ সাড়া দিতে যাচ্ছিল তখন হযরত উমর বললেনঃ“
ইন্নার রাজুলা লাইয়াহ্জুরু ” অর্থাৎ এই লোকটি ভুল বকছেন ! (সুব্হানাল্লাহ্ !)
সহীহ্ বোখারী , মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে এই কথাটি কে বলেছেন উল্লেখ করা হয়নি। তবে স্পষ্ট যে , দ্বিতীয় খলীফা ব্যতীত অপর কেউ এই ধরনের ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস রাখত না ! পরিশেষে অপর একদল লোক বললেন :“
হে আল্লাহর রাসূল ! আমরা কি নিয়ে আসব ?”
তিনি প্রতি উত্তরে বললেন :“
না , এরপর আর কি নিয়ে আসবে ?”
অর্থাৎ যদি তারা আনতেন এবং রাসূল (সা.) লিখতেনও তবুও শেষে তারা বলত :“
রাসূল (সা.) ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন এবং ভুল বকছিলেন !”
আর এইটি রাসূলের (সা.) অপর বক্তব্যগুলিও সন্দেহপূর্ণ ও দুর্বল প্রতিপন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াত। এই কারণে তিনি বললেন :“
আমার নিকট হতে চলে যাও , আমার নিকটে গণ্ডগোল করা সঙ্গত নয় !”
অবশেষে , রাসূল (সা.) হযরত আলীর (আ:) হাঁটুর উপর মাথা রাখা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আল্লাহর রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের সাথে সাথে মদীনার আনসারগণ ক্ষমতাকে হস্তহত করার লক্ষ্যে সকীফা’
য় সমবেত হন! লক্ষ্য করুন! যদি কোনো এলাকার মসজিদের একজন ইমাম সাহেব ইন্তেকাল করেন তবে লোকজন সমবেত হয়ে তার জানাযা , গোসল , কাফন ও দাফনের জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করেন। আর তার অপেক্ষা উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন কোন ব্যক্তি , যেমন মারজায়ে তাক্বলীদ (যে আলেম ও ফকীহকে শরীয়তের বিধি বিধানের ক্ষেত্রে অন্যরা অনুসরণ করে) হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখানে আল্লাহর রাসূলের পবিত্র (সা.) দেহ মোবারককে মাটির উপর রেখে দিয়ে স্বীয় আকাঙ্খা পূরণে রত হন !
সকীফাতে আনসারগণ সমবেত হন এবং অসুস্থ সা’
দ ইবনে উবাদাহ্ খাযরাজীর হাতে বাইআত করার উদ্দেশ্যে সেখানে তাকে নিয়ে যান । কিন্তু আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের দীর্ঘ দিনের প্রতিযোগিতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং পারস্পরিক শত্রুতার ক্ষেত্রে জাহেলী সাম্প্রদায়িকতা ও গোত্রীয় প্রবণতা জেগে উঠার ফলে আউস গোত্রটি সা’
দের ক্ষমতা গ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আনসারগণের বিপক্ষীয় দল অর্থাৎ কুরাইশী মুহাজিরগণও অতি দ্রুত মদীনার বাইরে থেকে আবু বকরকে এনে তাদের সাথে মিলিত হন এবং সুকৌশলে উমর , আবু উবাইদাহ্ জাররাহ এবং আরও কতিপয় মুহাজির যারা খিলাফতকে কুক্ষিগত করার চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন খাযরাজীদের বিপক্ষের কতিপয় আনসারের সহযোগিতায় আবু বকরের হাতে বাইআত করেন এবং তারপর আবু বকরের হাতে বাইআত গ্রহণের জন্যে জনগণকে বাধ্য করেন। অতঃপর মসজিদ অভিমুখে গমন করেন এবং পথিমধ্যে যাকেই পান তারই হাত ধরে আবু বকরের হাতে বাইআত করান।
অপরপক্ষে , রাসূলের (সা.) চাচা হযরত আব্বাস আমীরুল মু’
মিনীন আলীকে বললেন :“
ভাতিজা ! তুমি তোমার হাত বাড়াও , আমি বাইআত করি তাহলে লোকেরা বলবে যে , রাসূলের চাচা তাঁর ভাতিজার হাতে বাইআত করেছেন এবং অপর কেউ তোমার (উপযুক্ততার) ব্যাপারে মতভেদ করবে না !”
ইমাম বললেন :“
...রাসূলের কাফন দাফনের ব্যবস্থা করাই আমাদের উচিত , এটিই এখন আমাদের কাজ এবং এটিই যথেষ্ট !”
যারা রাসূলের কাফন ও দাফনের কাজের জন্যে অবশিষ্ট ছিলেন তারা হলেন আব্বাস , ইবনে আব্বাস , ইমাম আলী (আ.) সহ মোট পাঁচজন !
সারকথা , ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেন নি এবং শুধুমাত্র রাসূলের গোসল ও কাফনের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। অতঃপর তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন এবং অপর যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও আল্লাহর রাসূলের উপর জানাযার নামায আদায় করেন। তারপর , সোমবার কিংবা মঙ্গলবারের আসরের সময় হতে বুধবারের রাত অর্থাৎ রাসূলের দেহ মোবারককে দাফন করা পর্যন্ত সবাই দলে দলে আসতে থাকেন এবং রাসূলের জানাযার নামায আদায় করতে থাকেন। কারণ সবার উপর এই জানাযার নামায ওয়াজিব ছিল ; অন্যদিকে তখন খিলাফতের জবরদখলের কাজের সমাপ্তি ঘটছিল এবং রাসূলের সাহাবীগণ খিলাফতকে তাদের নিজেদের কাঙ্খিত পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন ও সঠিক পথ হতে বিচ্যুত করলেন।
৩ আবু
বকরের
কঠোর
হস্তের
শাসন
ও
রূঢ়
রাজনীতি
ক) ফাতিমার (আ.) গৃহে অবস্থানগ্রহণকারী বিরোধীদের সাথে আচরণ
ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের বাইআত না করা এবং হযরত ফাতিমার (আ.) গৃহে তাঁদের অবস্থান গ্রহণ সম্পর্কিত হাদীছটি মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং জীবনচরিত , ইতিহাস , সহীহ্ ও মুসনাদ হাদীসগ্রন্থ , সাহিত্য , কালামশাস্ত্র , রিজালশাস্ত্র এবং অন্যান্য সকল গ্রন্থে এসেছে।
উমর ইবনুল খাত্তাব বলেন :“
আমাদেরকে খবর দেয়া হল যে , হযরত আলী , যুবাইর এবং অন্যান্যরা যাঁরা তাঁদের সাথে রয়েছেন বাইআত না করে ফাতিমার (আ.) গৃহে সমবেত হয়েছেন ।”
অপর একটি বর্ণনায় এসেছেঃ“
আবু বকর , উমরকে আলীর (আ.) সন্ধানে প্রেরণ করেন এবং বলেন : যে কোনো প্রকারে হোক তাঁকে আমার নিকটে নিয়ে এস !”
উমর ইমাম আলী (আ.) এর নিকট আসেন এবং উভয়ের মাঝে বাক্য বিনিময়ের মাঝে ইমাম তাকে বলেন :“
যেই দুধের কিয়দংশ তোমার ভাগ তা ভালভাবে দোহন করো ! আল্লাহর শপথ ! তোমার আজকের লালসা , তোমার আগামী দিনের ক্ষেত্র রচনার জন্যে !”
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন :“
উমর প্রজ্বলিত আগুন নিয়ে হযরত ফাতিমার (আ:) বাড়ীর দরজায় আসেন ! ফাতিমা (আ.) তাকে বলেন :‘
হে খাত্তাবের পুত্র ! আমার গৃহে অগ্নিসংযোগের জন্যে তুমি এসেছ ?’
তিনি বললেন :‘
হ্যাঁ , হয় আগুন লাগাব আর না হয় অন্যান্যদের মত তোমরাও বাইআত কর !’
অর্থাৎ খলীফার হাতে বাইআত করা হচ্ছে অগ্রগণ্য , এমনকি নিষ্পাপ ও পবিত্র আহলে বাইত এবং যাঁদের শানে তাত্বহীরের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাঁদের চাইতেও অগ্রগণ্য ! রাসূল আকরাম (সা.) নামাযের সময় তাঁদের বাড়ীর দরজায় দাঁড়াতেন এবং বলতেন :
)
السلام علیکم یا اهل البیت: إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(
“ আস্ সালামু’
আলাইকুম ইয়া আহলাল বাইত: হে আহলে বাইত ! মহান আল্লাহ্ তোমাদের থেকে সকল ধরনের অপবিত্রতাকে দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান ।”
উমর এই গৃহে আগুন লাগাতে উদ্যত হন কেন ? এই উদ্দেশ্যে যে , কেউ যাতে আবু বকরের খেলাফতের সাথে বিরোধিতা করার সাহস করতে না পারে । লৌহ শাসনের এ নীতি এমন যে , কোনো রকমের সীমারেখা চিনে না ! এমন রাজনীতি মুয়াবিয়ার ন্যায় রাজনীতিবিদদের জন্যে পথকে সুগম করে দেয় এবং ফলে এ থেকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত না হতেই‘
ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার ’ মত শাসক ক্ষমতায় আসে যে আল্লাহর রাসূলের শহর মদীনায় তার অনৈসলামিক ও ধর্মদ্রোহী কর্মের প্রতিবাদকারীদের দমনের জন্য সৈন্য প্রেরণ করে যে সৈন্যরা সাহাবী ও তাবেয়ীদের হত্যা ও বিশ হাজার কুমারী মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানী করে। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার অব্যবহিত পরে সংঘটিত হাররা নামে প্রসিদ্ধ এ ঘটনার ফলে সহস্র শিশু জন্মগ্রহণ করে যাদের পিতৃ পরিচয় ছিল না !! হ্যাঁ , ফাতিমার (আ:) গৃহের সম্মানহানীর মাধ্যমে পবিত্র মক্কা ও মদীনার সম্মানহানীর পথ উম্মুক্ত করা হয় এবং কা’
বায় অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করার জন্য‘
ইয়াযীদ ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের ’ পথ সুগম হয় এবং ইসলামের সমস্ত সুমহান মূল্যবোধের উপর কুরাইশী খিলাফত প্রাধান্য পায় ! অতএব , ইসলামের মান সম্মান খর্ব করার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল সকীফাতে ! সকীফাই মুয়াবিয়ার নির্মাতা , ইয়াযীদকে প্রতিপালন করেছে এবং হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের জন্ম দিয়েছে ! আহলে বাইতের বিরুদ্ধে লৌহ কঠিন দমন নীতি এবং ফাতিমা যাহরা (আ.) এর গৃহদ্বারে অগ্নিসংযোগের রাজনীতিই কারবালার সৃষ্টি করেছিল !
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন :“
আবু বকর মৃত্যুর সময় বলতেন , হায় ! ফাতিমার বাড়ীর সম্মানকে যদি রক্ষা করতাম এবং সেটিকে যদি বেগানা লোকদের সম্মুখে উন্মুক্ত না করতাম , এমনকি যদি তাঁরা যুদ্ধের জন্যেও সেইখানে একত্রিত হয়ে থাকতেন !”
ইয়াকুবীর বর্ণনায় এসেছে যে , আবু বকর বলতেনঃ“
হায় ! আল্লাহর রাসূলের কন্যা ফাতিমার বাড়ীতে যদি অনুসন্ধান না চালাতাম এবং লোকজনকে সেইখানে প্রবেশ না করাতাম , এমনকি যুদ্ধের জন্যেও যদি তা বন্ধ করা হয়ে থাকে !
ফাতিমা যাহরার (আ.) বাড়ীতে প্রবেশকারী কতিপয় ব্যক্তির নাম , ঐতিহাসিকগণ নিম্নরূপ উল্লেখ করেছেনঃ
১. উমর ইবনুল খাত্তাব , ২. খালিদ ইবনে ওয়ালীদ , ৩. আব্দুর রহমান ইবনে আউফ , ৪. ছাবিত ইবনে ক্বায়িস শাম্মাস , ৫. যিয়াদ ইবনে লাবীদ , ৬. মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা , ৭. যায়িদ ইবনে ছাবিত , ৮. সালামাহ্ ইবনে সালামাহ্ ইবনে ওয়াক্কাশ , ৯. সালামাহ্ ইবনে আসলাম , ১০. উসাইদ ইবনে হুযাইর।
ফাতিমার (আ.) বাড়ীতে কিভাবে প্রবেশ করে
তাবারী বলেনঃ“
উমর ইবনুল খাত্তাব‘
আলীর ’ গৃহের নিকট আসেন , সেই গৃহে তালহা , যুবাইর এবং মুহাজিরদের কতিপয় লোক জমা হয়ে ছিলেন। যুবাইর কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে বেরিয়ে আসেন কিন্তু তাঁর পা কেঁপে উঠে। মাটিতে হোঁচট খান। তাঁর হাত থেকে তরবারিখানা মাটিতে পড়ে যায়। আগতরা সাথে সাথে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাঁকে বন্দী করে ।”
আবু বকর জওহারী বলেন :“
আলী (আ.) বলছিলেন ,‘
আমি আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রাসূলের ভাই ’ এ অবস্থায়ই তাঁকে আবু বকরের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তারা তাঁকে বলছিলেনঃ‘
বাইআত করো !’
তিনি বলেনঃ‘
এই বিষয়ে তোমাদের অপেক্ষা আমিই শ্রেয় ! তোমাদের হাতে বাইআত করব না বরং তোমরাই আমার হাতে বাইআত কর ! আল্লাহর রাসূলের সাথে আত্মীয়তার যুক্তি উপস্থাপন করে তোমরা খিলাফতকে আনসারদের কব্জা থেকে বের করে এনেছো এবং আনসারগণ তোমাদের যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে শাসনক্ষমতাকে তোমাদের নিকট অর্পণ করেছে। তোমরা যে যুক্তি উপস্থাপন করেছো , আমিও তা উপস্থাপন করতঃ বলব , যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে আমাদের ব্যাপারে ন্যায়বিচার করো ! আনসারগণ তোমাদের জন্যে যা স্বীকৃতি প্রদান করেছে তা আমাদের জন্যে তোমরা স্বীকৃতি প্রদান করো ! আর তা না হলে , তোমরা জেনে শুনে অন্যায় করবে এবং তার দায় দায়িত্ব নিজ কাঁধে বহন করবে !’
উমর বলেন :‘
আপনি বাইআত না করা পর্যন্ত আপনাকে মুক্ত করা হবে না !’
আলী তাকে বললেন :‘
হে উমর ! আজ আবু বকরের শাসনক্ষমতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করো তাহলে আগামী দিন তা তোমার নিকট ফিরে আসবে ! না , আল্লাহর কসম ! তোমার বক্তব্য গ্রহণ করব না এবং তার হাতে বাইআত করব না !’
আবু বকর বললেন :‘
আমার নিকট যদি বাইআত না করেন তবে আপনাকে আমি বাধ্য করব না।’
সালিম ইবনে কাইস বলেনঃ“
সালমান ফারসীকে জিজ্ঞাসা করলাম যে , ফাতিমার (আ.) বিনা অনুমতিতে কী তারা তাঁর বাড়ীতে প্রবেশ করেছিলেন ? সালমান বলেন : আল্লাহর কসম ! হ্যাঁ , অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছিলেন এবং তখন তাঁর মাথায় চাদর ছিল না ! তিনি চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন : হে পিতা ! হে আল্লাহর রাসূল ! কবরে তোমার চক্ষুদ্বয় এখনও প্রশান্ত হয়নি অথচ আবু বকর ও উমর কি অন্যায়েই না রত হয়েছে ! আর এইগুলি উচ্চৈঃস্বরে তিনি বলছিলেন ।”
হ্যাঁ , তারা এতদূর পর্যন্ত দুরাচার করেছিলেন যে , রাসুলের কন্যা ফাতিমার (আ.) পাঁজর ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং তার গর্ভপাত ঘটেছিল যার ফলে তার গর্ভস্থ শিশু মুহ্সিন মৃত্যুবরণ করেছিল । তিনি নিজেও অন্তিম শয্যায় শায়িত হয়েছিলেন ! আর সেই অবস্থাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন এবং বিশ্বজগতের প্রতিপালক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারকের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন !
হ্যাঁ , এই সব সকীফা হতেই হয়েছিল ; তারা ফাতিমার গৃহের সম্মানহানী করে তাঁর বাড়ীতে প্রবেশ করে । ইয়াযীদও কাবা গৃহ ও আল্লাহর রাসূলের শহরের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে সেইখানে সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং গণহত্যা করে ও আল্লাহর ঘরের উপর পাথর বর্ষণ করে । ফাতিমার বাড়ীর মর্যাদা হানীর মাধ্যমে এ ধারার সূত্রপাত হয় এবং তা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কা’
বাকে গুঁড়িয়ে দেয় , আগুন লাগায় , চেঙ্গিজরা ইসলামী দেশগুলির উপর আক্রমণ করে , ক্রুসেডাররা (খ্রীষ্টান ধর্মযোদ্ধারা) মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালায় । আর আজকে ইসলামের লেবাসধারী কথিত মুসলিমরা(জংগী সংগঠন) মুসলিম নিধনে নেমেছে ।
এরা সকলেই সকীফার বৈঠক , সাহাবাদের জীবনধারা এবং আবু বকরের কর্মপদ্ধতি হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছে ! অদ্ভুত ব্যাপার এই যে ,পরবর্তীতে এই ধরনের আচরণকে ইসলামের সুন্নত হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ছয়সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ হযরত আলীর প্রতি আহ্বান জানায় যে , তিনি যেন আল্লাহর কিতাব , রাসূলের সুন্নত এবং শাইখাঈনের (আবু বকর ও উমর) আদর্শ অনুযায়ী আমল করেন ! প্রকৃতই ইসলামের নীতিবোধ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল ! যে ধারার রাজনীতি হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) বাড়ীর দরজায় আগুন লাগায় ; হযরত আলী (আ.) কী তদনুযায়ী আমল করতে পারেন এবং সেইটিকে কী সত্যায়ন করতে পারেন ?! আলীর পুত্র হুসাইন (আ.) কি ইসলামের মূলোৎপাটনকারী এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে নীরব থাকতে পারেন ?!
হ্যাঁ , বেহেশ্তবাসী যুবকদের সর্দার (নেতা) এই সৈন্যদের দ্বারাই নিহত হন , ফাতিমার বাড়ীতে হামলাকারী সৈন্য , সকীফার সৈন্য এবং কুরাইশী খিলাফতের সৈন্যদের দ্বারা !!
খ. আহলে বাইতের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ ও ফাদাক বাজেয়াপ্তকরণ
কয়েকদিন পর ক্ষমতার ভিত্তিগুলি সুদৃঢ় এবং সার্বিক অবস্থার উপর শাসকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল তখন তারা পরামর্শ করে হাশিমী বংশ বিশেষতঃ আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের সদস্যদের অবরোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে , অতি সূক্ষ্ম নীলনকশার মাধ্যমে তাঁদের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করে এবং তারই প্রারম্ভিকা হিসেবে‘
ফাদাক ’ , যেটি রাসূল আকরাম (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় হযরত ফাতিমাকে (আ.) দান করেছিলেন , সেইটিকে বাজেয়াপ্ত করে। ঘটনাটির বিশদ বিবরণ নিম্নরূপ :
খয়বর বিজয় ও ইহুদীদের বিভিন্ন দুর্গ উন্মুক্ত হওয়ার পর , সেগুলিতে পুঞ্জীভূত বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদ দ্বারা রাসূল (সা.) ও সমস্ত মুসলমান অর্থ সম্পদশালী হন। কারণ , রাসূলের অংশ‘
খুমস ’ পৃথক করার পর যুদ্ধের যাবতীয় গনিমত তাঁদের মাঝে বণ্টিত হয়। অবশ্য , কতিপয় দুর্গ যেহেতু যুদ্ধ ব্যতীতই হস্তগত হয়েছিল তাই আল্লাহর নির্দেশে তা আল্লাহর রাসূলের ইচ্ছাধীনে দেয়া হয়।
তার পূর্বেও যখন মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরত করেন তখন মদীনার চারিদিকে পানিতে প্লাবিত হত না এমন কিছু ভূমি তাঁকে উপহার দেয়া হয় এবং শহরের বিস্তৃতি ঘটার পাশাপাশি তার মূল্যও বৃদ্ধি পায়। মুখাইরিক নামক একজন ইহুদী আলেম যিনি রাসূলের মদীনায় প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন , কুবা অঞ্চলে রাসূলের উপস্থিতির খবর শোনার সাথে সাথে তাঁর নিকট গমন করেন এবং আসমানী কিতাবসমূহে রাসূলের যে গুণাবলী দেখেছিলেন সেগুলি মিলিয়ে দেখার সাথে সাথে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবীর সাহায্যের জন্যে ইহুদীগোত্র বনী কুরাইযার প্রতি আহ্বান রাখেন ; কিন্তু তারা শনিবারে যুদ্ধ করা যাবে না এই অজুহাত দেখিয়ে তাকে সাহায্য করা হতে বিরত থাকে । যা হোক , মুখাইরিক ওহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং শাহাদত বরণ করেন। যেহেতু তিনি বনী কুরাইযা গোত্রের ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন তাই তিনি ওসিয়ত করেন ,“
যদি আমি শহীদ হই তবে আমার সাতটি কৃষিবাগান রাসূলের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে ।”
সারকথা , প্রাথমিক পর্যায়ের চরম ও প্রাণ ওষ্ঠাগত দরিদ্রতার পর মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের হাতে যুদ্ধের গনিমতের এক পঞ্চমাংশ , ফাই , আনফাল এবং সাফায়া (বিনা যুদ্ধে হস্তগত সম্পদ)সহ অন্য যে সকল সম্পদ এসেছিল এবং সেইসাথে রাসূলের উদ্দেশ্যে প্রেরিত অজস্র উপঢৌকন তাদেরকে সম্পদশালী করেছিল। রাসূলও (সা.) নিজ অংশ এবং যা কিছু তাঁর অধীনে ছিল সেগুলিকে , মুসলমানগণ বিশেষতঃ যেই সব মুহাজির মক্কায় তাঁদের যথাসর্বস্ব অর্থাৎ ধন সম্পদ , বাসস্থান সকল কিছু ত্যাগ করে এসেছিলেন তাঁদের মাঝে বণ্টন করে দেন । আবু বকর , উমর , আয়িশা প্রমুখের ন্যায় ব্যক্তিগণকে তাঁদের নিজ নিজ অবস্থা অনুযায়ী একটি করে অংশ দান করেছিলেন। যেহেতু ফাতিমাকে (আ.) কিছুই দেন নি তাই অত্র আয়াতটি অবতীর্ণ হয় :
)
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ(
অর্থাৎ নিকট আত্মীয়গণের হক প্রদান করেন !
ক্ষেত্রে হযরত খাদীজার (আ.) অবদানের প্রতিদানস্বরূপ একটি অংশ ছিল। তিনি মক্কার সেরা বিত্তশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর সমস্ত অর্থ সম্পদ ইসলামের পথে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন , যার ফলে ইসলাম তার সম্মানের সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়েছিল। এখন তিনি পৃথিবীতে নেই তবে মুসলমানদের মাঝে তাঁর একমাত্র উত্তরসূরী ছিলেন হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) । সুতরাং তাঁর সীমাহীন দানের স্বল্প হলেও প্রতিদান দেয়া উচিত এবং তাঁর হক আদায় করা কর্তব্য। এই কারণে রাসূল (সা.) আল্লাহর আদেশে‘
ফাদাক ’ বাগানটি হযরত ফাতিমাকে (আ.) প্রদান করেন। ফাতিমা (আ.) সেইটিকে নিজ সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করতঃ তাতে কর্মচারী ও কর্মী নিয়োগ করেন।
এখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা নবাগত শাসকগোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে , রাসূলের আহলে বাইতকে জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিকূল অবস্থা ও অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে ফেলতে হবে , তাহলে প্রথমতঃ এই পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণকে তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে। দ্বিতীয়তঃ তাঁদেরকে নিজ সরকার ও প্রশাসনের প্রতি মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল বানানো যাবে। ফলে‘
রাসূল (সা.) কোনো সম্পদ রেখে যান না ” এই অজুহাত দেখিয়ে ফাদাক বাগানটিকে ফাতিমার (আ.) নিকট হতে ছিনিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অন্তর্ভূক্ত করেন ।
অতঃপর হযরত ফাতিমা (আ.) নিজ দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে রুখে দাঁড়ান , অভিযোগ পেশ করেন এবং তাদের সাথে বিতর্ক করেন। আবু বকর নিজ বর্ণিত একটি হাদীছ দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে তাঁর অধিকার দেয়া হতে বিরত থাকেন। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ
গ. রাসূলুল্লাহর উত্তরাধিকারী সম্পদ , ফাতিমার অভিযোগ ও আবু বকরের উত্তর
আল্লাহর রাসূলের (সা.) ইন্তেকাল এবং সকীফার ঘটনার পর আবু বকর ও উমর প্রথমেই রাসূলের রেখে যাওয়া সমস্ত কৃষিভূমিকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন। রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় অন্যান্য মুসলমানদেরকে যে সব জমি দান করেছিলেন , তারা উভয়ে (প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা) সেই জমিগুলির বিষয়ে কোন প্রতিবাদ এবং আপত্তিই করেন নি। কিন্তু ফাদাক যেটি রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায়ই নিজ কন্যা হযরত ফাতিমাকে (আ.) দান করেছিলেন সেটিকে বাজেয়াপ্ত করে নিজ অধীনে নিয়ে নেন। হযরত ফাতিমাকে (আ.) এই ব্যাপারে তাঁর পিতা আল্লাহর রাসূলের উত্তরাধিকার প্রমাণে বিতর্ক করতে বাধ্য করেন ।
দ্বিতীয় খলীফা উমর হতে বর্ণিত , তিনি বলেনঃ“
যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) পৃথিবী হতে বিদায় গ্রহণ করেন তখন আমি এবং আবু বকর উভয়ে মিলে আলীর নিকট গিয়ে বললাম ,রাসূলের (সা.) উত্তরাধিকার সম্পত্তি এবং তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি ?”
তিনি বললেন :“
আমরা জনগণের মাঝে অধিকারের ক্ষেত্রে রাসূলের সর্বাধিক নিকটের ।”
উমর বলেন : আমি বললাম ,“
খয়বর ভূমি কি হবে ?”
তিনি বললেনঃ“
খয়বর ভূমিও অনুরূপ ।”
আমি বল্লাম:“
ফাদাক ভূমি কি হবে ?”
তিনি বললেন ,“
ফাদাক ভূমিও অনুরূপ ।”
আমি বল্লাম:“
আল্লাহর শপথ ! আপনি এমন পর্যায়ে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন যে :যেন করাত দিয়ে আমাদের ঘাড় কেটে ফেলবেন ! না , এমনটি হতে দিব না !”
আবু বকর ও উমর কর্তৃক‘
ফাদাক ’ আত্মসাৎ করার প্রকৃত ঘটনা এবং হযরত ফাতিমা (আ.) কর্তৃক তা ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন সম্পর্কিত বিষয়টি সহীহ্ বোখারী , মুসলিম , মুসনাদে আহমাদ , সুনানে আবী দাউদ , নাসাঈ , তাবাকাতে ইবনে সা’
দ এবং সুন্নী মাযহাবের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে কোথাও সংক্ষিপ্ত , আবার কোথাও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবু বকরের সাথে তাঁর বিতর্ক ও আপত্তিমূলক সর্বশেষ বৈঠকটির ঘটনা এরূপ :
“ যখন হযরত ফাতিমা (আ.) তাঁর যাবতীয় দলীল প্রমাণ ও সাক্ষ্য উপস্থাপন করেন এবং আবু বকর সেগুলিকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন ও আল্লাহর রাসূলের দানকৃত সম্পদের কোনো অংশ এবং তাঁর উত্তরাধিকার সম্পত্তি ফাতিমাকে ফিরিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকেন । তখন ফাতিমা যাহরা (আ.) এই বিতর্কটিকে মুসলমানদের সম্মুখে তুলে ধরা সঙ্গত মনে করেন এবং তাঁর পিতার সাহাবীদের নিকট হতে সাহায্য কামনা করেন। হাদীছবিদগণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুসারে যেমন আবু বকর জওহারীর‘
সকীফা’
নামক গ্রন্থ হতে ইবনে আবিল হাদীদের বর্ণনা অনুসারে এবং‘
বালাগাতুন্ নিসা’
গ্রন্থে এসেছে যে , ফাতিমা (আ.) মসজিদে নববীতে যান ।”
জওহারী বলেনঃ“
যখন ফাতিমা (আ.) বুঝতে পারলেন যে , আবু বকর তাঁকে ফাদাক ফিরিয়ে দিবেন না , তখন তিনি মস্তকাবরণ ও চাদর পরেন এবং কয়েকজন নিকটাত্মীয় ও বনী হাশিম বংশের নারীকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদ অভিমুখে যাত্রা করেন। আর আল্লাহর রাসূলের (সা.) ন্যায় পদক্ষেপ ফেলে আবু বকর ও তার সভাসদদের নিকট উপস্থিত হন এবং পর্দার অন্তরালে দাঁড়ান। অতঃপর হৃদয় বিদারক কান্না ও পীড়াদায়ক ভাবে দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে লোকজনকে বিলাপ করতে বাধ্য করেন এবং সভার পরিবেশকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেন এবং তারপর অল্পক্ষণ নীরব থাকেন , যাতে কান্নার রোল থেমে যায় ও সবাই শান্ত হয় । অতঃপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি আদায় করেন এবং আল্লাহর রাসূলের উপর দরুদ প্রেরণ করে বলেন :
“ আমি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা ! আমি আপনাদের অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছিঃ
)
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَاعَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيم(
“ নিশ্চয় তোমাদের মাঝ হতে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্যে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের হেদায়াতকামী , মু’
মিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু ।”
এখন যদি তোমরা তাঁর আত্মীয়তা সম্পর্কে জানতে চাও তবে দেখ যে , তিনি আমার পিতা , তোমাদের পিতা নন। তিনি আমার চাচাত ভায়ের ভ্রাতা , তোমাদের ভ্রাতা নন !”
বক্তব্যের এক স্থানে বলেনঃ এখন তোমরা ধারণা করছ যে , আমরা উত্তরাধিকার পাব না ?!
)
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُون(
“ তারা কি জাহিলিয়াতের ফয়সালা কামনা করে ? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কে অধিকতর উত্তম ফয়সালাকারী ?”
হে আবু কুহাফার পুত্র ! পবিত্র কোরআন অনুযায়ী তুমি তোমার পিতার উত্তরাধিকার পাবে আর আমার পিতার উত্তরাধিকার আমি কি পাব না ?! এইটি সত্য যে ,তুমি এক আশ্চর্য ও কুৎসিত বিষয আনয়ন করছ এবং এক বড় অপবাদ আরোপ করেছো ! এই অপমান ও লজ্জাকে ভালভাবে মনে রেখ ! কারণ কিয়ামত দিবসে তুমি তার মুখোমুখি হবে ! আহ্ ! মহান আল্লাহ্ কি উত্তম বিচারক ! মুহাম্মদ (সা.) কি উত্তম প্রতিনিধি ও নিরাপত্তাদানকারী ! হ্যাঁ , আমাদের প্রতিশ্রুত দিন হচ্ছে কিয়ামত , বাতিলপন্থীরা সেইদিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে !”
অতঃপর তিনি নিজ পিতার কবরের অভিমুখে ফিরে তাকান এবং কাতরস্বরে বলেন :“
হে পিতা ! তোমার ইহ্ধাম ত্যাগের পর কি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং কত বিপদই না এসেছে , যদি তুমি থাকতে তবে এতটা প্রকট হত না ! আমরা বৃষ্টিবঞ্চিত পিপাসার্ত জমিনের ন্যায় তোমাকে হারিয়েছি আর তোমার জাতি উল্টে গেছে , তাদেরকে দেখ এবং তাদের অবস্থা থেকে পৃথক হয়ে যেও না ! হায় ! তোমার পরেই যদি আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হতাম !”
বর্ণনাকারী বলেনঃ ফাতিমা (আ.) এমন ভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন যে , লোকজন এতটা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল এবং ক্রন্দন করেছিল যে , তৎপূর্বে সেদিন পর্যন্ত তার কোনো নজীর দেখা যায় নি !”
অতঃপর তিনি আনসারগণের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলেনঃ“
হে তীক্ষ্ণ থাবা বিশিষ্ট জ্ঞানীরা ! হে দ্বীনের বাহুরা ! হে ইসলামের সাহায্যকারীরা ! তোমরা আমার সাহায্যের ব্যাপারে কেন অবহেলা করছ ? তোমরা আমার সহায়তার ব্যাপারে কেন শিথিলতা দেখাচ্ছ ? আমার অধিকারের ব্যাপারে কেন উপেক্ষা করছ ? আমার উপর কৃত অত্যাচারের ব্যাপারে কেন তোমরা তন্দ্রাচ্ছন্ন ?
তিনি কি রাসূল ছিলেন না , যিনি বলতেন :‘
মানুষের সম্মান , তাঁর সন্তান সন্ততির সম্মান রক্ষার মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে ?’
তোমরা কত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গেলে এবং কত দ্রুত বিচ্যুতির শিকার হলে ! পৃথিবী হতে রাসূলের (সা.) বিদায়ের সাথে সাথে কী তাঁর দ্বীনকেও তোমরা মৃত্যুর মুখে ফেলবে ? হ্যাঁ , আমার জীবনের শপথ! তাঁর মৃত্যু চরম বেদনাদায়ক একটি ঘটনা যার শোক ছিল সর্ব বিস্তৃত , তার অনুপস্থিতি অতি গভীর ফাটলের সৃষ্টি করেছে যার ক্ষতিপূরণ অসম্ভব , তাঁর মৃত্যু জমিনকে অন্ধকার , পাহাড়গুলিকে দুর্বল এবং প্রত্যাশা সমূহকে হতাশায় পরিণত করেছে ! মর্যাদার আবরণগুলিকে ছিঁড়ে দিয়েছে এবং নিরাপত্তার সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে ! এই পরীক্ষাই ছিল যে সম্পর্কে মহান আল্লাহর কিতাব তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে তোমাদেরকে অবগত করে বলেছেন :
)
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَىٰ أَعْقَابِكُمْ وَمَن يَنقَلِبْ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللَّـهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّـهُ الشَّاكِرِينَ(
“ মুহাম্মদ (সা.) শুধু আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ব্যতীত আর কিছুই ছিলেন না , তাঁর পূর্বেও অপর প্রেরিত পুরুষগণ ছিলেন , তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তবে কি তোমরা অতীত জীবনে ফিরে যাবে ? যে কেউ তার অতীত জীবনে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না ; আর মহান আল্লাহ্ অতিসত্তর কৃতজ্ঞতা আদায়কারীদের পুরস্কার দেবেন ।”
হে নিদ্রাচ্ছন্ন লোকেরা ! তোমরা জেগে ওঠ ! তোমাদের সম্মুখে আমার পিতার উত্তরাধিকার নষ্ট হয়ে গেল ! আমার আহ্বান তোমাদের নিকট পৌঁছেছে , আমার কন্ঠ তোমরা শ্রবণ করছ , তোমাদের শক্তি সামর্থ্য আছে এবং গৃহ তোমাদের গৃহ ! তোমরা আল্লাহর নির্বাচিত লোক এবং তাদের মাঝে সর্বোত্তম , তোমরা (ধর্মের কারণে) আরবদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলে , বিপদে ভয় পাওনি এবং সমস্যা সত্ত্বেও তোমরা লড়াই করেছ ফলে ইসলামের যাঁতাকল তোমাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে , তার দুধের ষ্ফুটন শুরু হয়েছে , যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হয়েছে , প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা স্তিমিত হয়েছে , গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা মিটে গিয়েছে এবং দ্বীনের অবকাঠামো সুদৃঢ় হয়েছে ; এইসব অগ্রগতির পর এখন কি তোমরা পিছপা হবে ?! আর সেই সব কঠোরতা অবলম্বনের পর তোমরা কি এখন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে ? আর সেই সব বীরত্ব ও সাহসিকতার পর এমন একটি দলকে তোমরা ভয় পাবে“
যারা নিজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং তোমাদের দ্বীনকে তিরস্কারের বস্তু হিসেবে গণ্য করেছে ?! কাফির নেতাদের সাথে যুদ্ধ কর , কারণ তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী দলের অন্তর্গত নয় , সম্ভবতঃ তারা বিরত হবে ।”
সতর্ক থেক ! আমি এমন দেখছি যে , তোমরা স্বস্তিকামী , সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী হয়ে গেছ ! দ্বীন হতে যা কিছু অনুধাবন করেছিলে তা তোমরা অস্বীকার করেছ এবং যেই জিনিসকে তোমরা সুস্বাদু জেনেছিলে তাকে বমন করেছ !
)
إِن تَكْفُرُوا أَنتُمْ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّـهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ(
“ যদি তোমরা এবং জমিনের বুকে যারা আছে , তারা সকলেই কাফির হয়ে যায় , তবে জেনে রেখ যে , মহান আল্লাহ্ অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত ।”
(সূরা ইব্রাহীম : ৮)
জেনে রেখ ! আমি তোমাদের সাথে পূর্ণ জ্ঞান ও অবগতিসহ কথা বলছি : অমনোযোগিতা , স্থবিরতা জড়তা , ভীতি এবং দুর্বল বিশ্বাস তোমাদেরকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে অতএব , তোমাদের মর্যাদার হানী হোক ,সেটিকে তোমাদের নিজেদের সফরের শেষ সম্বল বানাও এবং সত্যের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর , শান্তিতে থাক , লজ্জা ও অপমানকে আশ্রয় দাও এবং অপমানের পোশাক পরিধান কর , আর আল্লাহর আগুনের সাথে আঁতাত কর , এমন প্রজ্বলিত আগুন যা অন্তরসমূহকে বেষ্টন করবে ! তোমরা যা কিছু করছ তা আল্লাহর সম্মুখে রয়েছে !
)
وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ(
“ যারা অত্যাচার করেছে তারা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে যে , কোন স্থানে তারা প্রবেশ করবে !”
এ কথা স্পষ্ট যে , অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এক সরকার যার শীর্ষে ছিলেন আবু বকর যিনি নিজেকে এই ধরনের ঘটনার জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন এরূপ অবস্থায় তিনি অবশ্যই মোলায়েম , নমনীয় ও জনগণের পছন্দমাফিক ভাষায় হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) কথার উত্তর দিবেন , তাই তিনি বলেন :“
হে সর্বোত্তমা নারী ! হে সর্বোত্তম পিতার কন্যা ! আল্লাহর শপথ , আমি আল্লাহর রাসূলের (সা.) সিদ্ধান্তের সীমা অতিক্রম করি নি এবং তাঁর আদর্শের বিপরীত আমল করিনি ; জাতির নেতা কখনও নিজ জাতিকে মিথ্যা বলেন না ! আপনি বাক অলঙ্কার ও কঠোরতার সাথে আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং আমাদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন , মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে ও আপনাকে ক্ষমা করুন ! আমি আল্লাহর রাসূলের যুদ্ধাস্ত্র , বাহন ও জুতা জোড়া আলীকে প্রদান করেছি কিন্তু সেইগুলি ছাড়া , আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি :
“ ইন্না মা’
আশিরাল্ আম্বিয়ায়ি লা নূরাছু যাহাবান্ ওয়া লা ফিয্যাতান্ ওয়া লা আরযান্ ওয়া লা’
আক্বারান্ ওয়া লা দারান্ ওয়া লাকিন্না নূরাছুল ঈমানা ওয়াল্ হিতমাতা ওয়াল ইলমা ওয়াস্ সুন্নাহ্ ।”
“ আমরা নবীরা সোনা , রূপা , ভূমি , বাগান ও ঘর বাড়ী উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাই না। বরং আমরা উত্তরাধিকার হিসেবে ঈমান , প্রজ্ঞা , জ্ঞান ও সুন্নত রেখে যাই ।”
অতএব , আমি নির্দেশ মতই আমল করেছি এবং তাঁর কল্যাণ কামনা করছি। আমার সাফল্য আল্লাহ্ প্রদত্ত , তাঁর উপর ভরসা করতঃ তাঁর নিকটই ফিরে যাব ।”
ফাতিমা (আ.) বলেন :“
তুমি কি ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করেছ এবং সেইটিকে পিছনে ফেলে দিয়েছ ? কিন্তু মহান আল্লাহ্ এইটা কি বলেন নি:
)
وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُود(
অর্থাৎ দাউদের নিকট হতে সুলায়মান (আ.) উত্তরাধিকার পান !”
সম্মানিত মহান আল্লাহ্ কি ইয়াহ্ইয়া ও যাকারিয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেন নি :
)
فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوب(
“ (রাব্বি) হাব্লী মিল্লাদুনকা ওয়ালিয়্যান ইয়ারিছুনী ওয়া ইয়ারিছু মিন্ আলি ইয়া’
কূব ।”
“ প্রভু হে ! তোমার নিকট হতে আমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি দান কর , যিনি আমার ও ইয়াকুবের উত্তরসূরি হবেন ।”
আরও তিনি বলেন :
)
يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْن(
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে , এক পুত্রের উত্তরাধিকার সম্পত্তি হবে দুই কন্যার অংশের সমান।
তিনি আরও বলেনঃ
)
إِنْ تَرَكَ خَيْرًا الْوَصِيَّةُ لِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ بِالْمَعْرُوفِ حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِين(
অর্থাৎ যদি কেউ কোনো কল্যাণ (ধন সম্পত্তি) রেখে যান তবে ন্যায়ানুগ প্রথা মত তার পিতা মাতা ও আত্মীয় স্বজনের জন্যে ওসিয়ত করার বিধান তাদেরকে দেয়া হল। এইটি মুত্তাকীদের জন্যে একটি কর্তব্য ।”
তোমরা ধারণা করেছ , আমি আমার পিতার কোনো রকমের অধিকার ও সম্পত্তি পাব না ? আমার ও আমার পিতার মাঝে কি আত্মীয়তা নেই ? মহান আল্লাহ্ কুরআনের কোনো আয়াতে তোমাদেরকে কি কোনো বিশেষত্ব দান করেছেন এবং তাঁর রাসূলকে তা হতে বঞ্চিত করেছেন ? অথবা তোমরা বলবে : আমার এবং আমার পিতার ধর্ম ভিন্ন ধরনের , ফলে আমি সম্পত্তি পাব না ?! আমি এবং আমার পিতা কী একই জাতির অন্তর্ভুক্ত নই ?! সম্ভবতঃ তোমরা কুরআনের সাধারণ ও বিশেষ বিধান সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলের (সা.) চেয়ে বেশী জান !!
)
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ(
“ আফা হুকমাল্ জাহিলিয়্যাতি ইয়াব্গুন ?”
অর্থাৎ তবে কি তারা জাহিলী যুগের বিধি বিধান কামনা করে ?!”
সত্যিই , এর চেয়ে দৃঢ় দলিল প্রমাণ ও যুক্তি সম্ভব নয়। কিন্তু কি লাভ হবে , হযরত যাহরা (আ.) এর বক্তব্যগুলির শুধুমাত্র একটি উত্তর ছিল : আমি আবু বকর আল্লাহর রাসূলের নিকট শুনেছি যে , আমাদের নবীগণের নিকট হতে কোনো উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাওয়া যায় না ; শুধু এতটুকুই ! এ কথা আমি নিজে শুনেছি !!
আশ্চর্য লাগে এই জন্যে যে , এটিকে অনেকে আবু বকরের ফযিলত হিসেবে গণ্য করেছে ! অর্থাৎ লিখা হয়েছে যে , আবু বকর সেই একক পুরুষ যিনি এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ! এই হাদীছটি আবু বকর ব্যতীত অপর কেউ আল্লাহর রাসূলের নিকট হতে শুনেন নি !! এমনকি উম্মুল মু’
মিনীন আয়িশাও বলেছেন :“
এই বিষয়টি আমার পিতা ব্যতীত অপর কারও নিকট হতে শুনি নি !”
আবু বকরের
হাদীছটির
মূল্যায়ন
১. আমরা জানি যে , এই কথার উপর জনগণ ঐকমত্য (ইজমা) পোষণ করেছেন যে , এই হাদীছটি শুধুমাত্র আবু বকর বর্ণনা করেছেন। হযরত ফাতিমা যাহরাও (আ.) তার বিপরীতে বলেন :“
তোমরা ইচ্ছাকৃত আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করতঃ তাকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করেছো !”
কেননা মহান আল্লাহ্ বলেছেন :“
দাউদের নিকট হতে সুলায়মান উত্তরাধিকার সম্পত্তি পান এবং যাকারিয়া আল্লাহর নিকট উত্তরাধিকারী কামনা করেন ।”
মহান আল্লাহ্ তাঁর কিতাবে উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে অপরের চেয়ে আত্মীয় স্বজনদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। উত্তরাধিকার সম্পত্তি সম্পর্কে আরও একাধিক আয়াত বর্ণিত হয়েছে।
২. আমরা জানি যে , ইসলামের আহ্কাম , যেগুলি উপযুক্ত বয়সে উপনীত (শরীয়তের দৃষ্টিতে বয়োপ্রাপ্ত) ব্যক্তিদের জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয় , সেইগুলির প্রচারিত হওয়া উচিত এবং যাদের উপর ঐ বিধান প্রযোজ্য তাদের নিকট পৌঁছানো প্রয়োজন , তাহলেই তা পালন করতে পারবে । নামায , রোযা , হজ্ব , জিহাদ , খোমস , যাকাত এবং অন্যান্য বিষয় প্রচার ও বর্ণনা হওয়ার পর উপযুক্ত বয়সে উপনীত ব্যক্তিদের উপর ওয়াজিব হয়ে গেছে। এখন কিরূপে সম্ভব হতে পারে যে , রাসূল (সা.) যে বিধানটির মূল শ্রোতা ও প্রকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত ফাতিমা (আ.) , সেইটি শুধুমাত্র আবু বকরকে বলবেন ?!
৩. হাদীছ শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে সহীহ্ ও অসহীহ্ হাদীছসমূহের মূল্যায়ন ও পরিচিতির জন্যে কতকগুলি নির্দিষ্ট মাপকাঠি রয়েছে , তন্মধ্যে একটি হচ্ছে কুরআনের সাথে হাদীছের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করা বা না করা। আমরা‘
মা’
আলিমুল মাদ্রাসাতাঈন’
নামক পুস্তকের তৃতীয় খণ্ডে সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছি। রাসূল (সা.) হতে আমাদের নিকট একটি হাদীছ পৌঁছেছে ; তাতে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে , তিনি‘
মিনাতে ’ ভাষণ দান কালে বলেনঃ“
আয়্যুহান্নাসু ! মা জাআকুম্ ’ আন্নী ইউওয়াফিকু কিতাবাল্লাহি ফাআনা কুল্তুহু ওয়া মা জাআকুম্ ইউখালিফু কিতাবাল্লাহি ফালাম্ আকুল্হু ।”
অর্থাৎ হে লোকেরা ! আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকটে যা কিছু পৌঁছেছে এবং আল্লাহর কিতাবের সাথে অভিন্ন হয় , তা আমি বলেছি। পক্ষান্তরে , তোমাদের নিকট যা কিছু পৌঁছেছে এবং আল্লাহর কিতাবের পরিপন্থী হয় , তা আমি বলি নি ।”
অতএব , হাদীছ শাস্ত্রের দৃষ্টিতেও বিষয়টি স্পষ্ট ! হাদীছটির সনদে শুধুমাত্র একক ব্যক্তি রয়েছে অর্থাৎ কেবলমাত্র শাসক হওয়ার দাবীদার আবু বকর থেকে বর্ণিত এবং হাদীছটির মূলভাষ্যও কুরআনের বিভিন্ন অকাট্য ভাষ্যের বিপরীত। কিন্তু কি করা যেতে পারে , যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের (সা.) স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির পদকে অবৈধভাবে দখল করতে কোনো শঙ্কাবোধ করেনি , সেই ব্যক্তি অপর অকাট্য ভাষ্যের সাথেও বিপরীত মত পোষণ করতে কোনো দ্বিধা করবে না ।
আনসারগণ কেন নীরব ছিলেন ?
বর্ণিত হয়েছে যে , আমীরুল মু’
মিনীন আলী হযরত ফাতিমা(আ.) এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে সাথে নিয়ে স্বীয় অধিকার আদায় এবং ইসলামকে তার প্রকৃত মানদণ্ডের উপর ফিরিয়ে আনার জন্যে আনসারদের প্রত্যেকের বাড়ীতে গিয়ে তাদের সাহায্য কামনা করেন। হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) ভাষণেও লক্ষ্য করেছি যে , তিনি কিভাবে আনসারগণকে সম্বোধন ও তাদেরকে তিরস্কার করেছেন। তাদের নিকট তিনি আবেদন জানান যে , তাঁর অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তারা যেন তাঁকে সাহায্য করেন ,এতদসত্ত্বেও মদীনার আনসারগণ নীরব থাকেন এবং কোনরূপ ভূমিকাই পালন করেননি । কেন ? উত্তর এই যে , আনসারগণ বলতেন :
“ আমরা আবু বকরের নিকট বাইআত করেছি এবং বাইআত ভঙ্গ করা আমাদের জন্যে বৈধ নয় ! হায় ! যদি আপনারা সকীফাতে থাকতেন আর এই কথাগুলি বলতেন তবে আমরা আপনাদের নিকট বাইআত করতাম !”
এইটি এই জন্যে যে , আরবরা যখনই কারো হাতে বাইআত করত এবং প্রতিশ্রুতি দিত তখনই নিহত হওয়া পর্যন্ত নিজ প্রতিশ্রুতির উপর দাঁড়িয়ে থাকত। হযরত ফাতিমা যাহরাও (আ.) বলেনঃ“
আলী সেই কাজটিই করেছেন যেইটি তাঁর করা উচিত ছিল ।”
অর্থাৎ রাসূলের জানাযাকে পরিত্যাগ করতঃ সকীফাতে যাননি ।“
তোমাদের হিসাব নিকাশ আল্লাহর নিকট রয়েছে !”
এখানেও যদি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ভাবা হয় তাহলে প্রতীয়মান হয় যে , ইসলামের বিধি বিধানের উপর জাহিলী যুগের প্রথা অগ্রারাধিকার পেয়েছে। প্রতিশ্রুতির উপর অনড় থাকা এবং বাইআতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা অবশ্যই পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য কাজ তবে শর্ত হল এই যে , তা হতে হবে সত্য পথে এবং বাতিল হতে দূরে থাকতে হবে। ইসলামে অপরের আনুগত্য করা বন্ধন ও শর্তহীন নয়। উদাহরণ স্বরূপ , ইসলামে সন্তানের জন্যে পিতার আনুগত্য করা এবং স্ত্রীর জন্যে স্বামীর আনুগত্য করা আবশ্যক , তবে ইসলামের নীতি বিরোধী ও অবৈধ বিষয়ে তাদের আনুগত্য করা নিষেধ। যদি কোনো পিতা নিজ সন্তানকে চুরি করার জন্যে এবং নরহত্যার জন্যে বাধ্য করে অথবা কোনো পুরুষ নিজ স্ত্রীকে অবৈধ কাজের প্রতি আদেশ দেয় , তবে সেই সব ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা নিষেধ। এইটি ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। এই ব্যাপারে মুসলমানগণ ঐকমত্য পোষণ করেন এবং হাদীছে এসেছে :“
লা ত্বা ’ আতা লি মাখ্লূক্বিন্ ফী মা’
সিয়াতিল্ খালিক্বি ।”
“
সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অমান্য করে সৃষ্টিজীবের আনুগত্য করা নিষেধ ।”
কিন্তু কি করা যেতে পারে ! জ্ঞানহীনতা ও আরবগোত্রবাদ ইসলামের উপর অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং তাই আনসারগণ বলছেন :“
আমরা বাইআতের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতির উপর অনড় রয়েছি ।”
অতএব , আল্লাহর রাসূলের উপরও মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে। এই কারণে যাহরা (আ.) আবু বকরকে বলেনঃ“
লাক্বাদ জি ’ তা শাইআন্ ফারিয়্যান ।”
“
সত্যিই , তুমি বিস্ময়কর ও কুৎসিত অপবাদ আরোপ করেছো !”
অযৌক্তিক এবং নিষিদ্ধ আনুগত্য , সত্য আনুগত্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে !
ঘ. মালিক ইবনে নুয়াইরাকে হত্যা
মালিক ইবনে নুয়াইরা তামীমী , জাহিলী যুগে তামীম গোত্রের অন্যতম অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর , রাসূল আকরাম (সা.) তাঁকে নিজ প্রতিনিধি ও সাদ্কা (জাকাত) সংগ্রহের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। যখন রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেন তখন তিনি শরয়ী সাদ্কাগুলিকে তার নিজ নিজ মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেন এবং নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন :
“ আমি বললাম , তোমাদের মালসমূহ ফিরিয়ে নাও এবং ভবিষ্যতের জন্যে চিন্তিত হবে না। এই ধর্মের জন্যে যদি কেউ পুনরায় উত্থিত হন তবে তার আনুগত্য করতঃ আমরা বলব , প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মুহাম্মদের ধর্ম ।”
তারীখে তাবারী , শরহে ইবনে আবিল হাদীদ , কানযুল উম্মাল , তারীখে আবিল ফিদা , ওয়াফিয়াতুল আ’
ইয়ান ইত্যাদি গ্রন্থে ঘটনাটির সারসংক্ষেপ এইরূপে এসেছে :“
খালিদ ইবনে ওয়ালীদ সৈন্যবাহিনীসহ‘
যেরার ইবনে আযুরকে ’ মালিকের গোত্রের নিকট প্রেরণ করে। সেই সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত আবু কাতাদাহ্ বলেন :‘
আমাদের বাহিনী রাত্রিতে তাদেরকে অবরোধ করে এবং এতে ভয় পাওয়ার কারণে মালিকের গোত্রের লোকেরা সমর সজ্জায় সজ্জিত হয় ও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
আমরা তাদেরকে বল্লাম :‘
আমরা মুসলমান !’
তারা বলল :‘
আমরাও মুসলমান !’
আমাদের সেনাপতি বলল :‘
তাহলে কেন তোমরা যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়েছো ?’
তারা বলল :‘
তোমরা কেন তোমাদের সঙ্গে অস্ত্র শস্ত্র এনেছো ?’
আমরা বললাম:‘
যদি তোমরা সত্য বলে থাক এবং মুসলমান হও তবে তোমাদের অস্ত্র শস্ত্রগুলি মাটিতে রেখে দাও !’
তারা মাটিতে অস্ত্র শস্ত্রগুলি রেখে দেয়। তারপর আমরা নামায আদায় করি এবং তারাও নামায আদায় করে ।”
ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন :“
যখন তারা যুদ্ধাস্ত্রগুলি মাটিতে রেখে দেন তখন তাদের সকলকে বন্দী করে খালিদের নিকট আনা হয়। মালিক ইবনে নুওয়াইরা কথোপকথনের জন্যে খালিদের নিকট আসেন। মালিকের সুদর্শনা স্ত্রীও তার সাথে আসেন। তার স্ত্রীর উপর খালিদের দৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে মালিককে সে বলে :“
আল্লাহর কসম ! পুনরায় তুমি তোমার গোত্রের লোকদের নিকট ফিরে যাবার সুযোগ পাবে না !”
খালিদ দাবি করল যে , মালিক ইবনে নুওয়াইরা ধর্মত্যাগী (মুর্তাদ) হয়ে গেছেন। মালিক সেই দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বলছিলেন :“
আমি যেইভাবে মুসলমান ছিলাম সেইভাবেই আছি !”
খালিদের সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত আবু কাতাদাহ্ ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরও মালিকের এই কথাগুলিকে সত্য বলে সাক্ষ্য দিলেন ।”
মালিক বললেন :“
আমাদেরকে আবু বকরের নিকট প্রেরণ কর , যেন তিনি নিজে আমাদের বিচার করেন !”
খালিদ বলল :“
আমি যদি তোমাকে ক্ষমা করি তবে আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা করবেন না !”
অতঃপর যুরারকে মালিকের মস্তক উচ্ছেদ করার জন্যে আদেশ দিল ! মালিক তার স্ত্রীর প্রতি হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে খালিদকে বললেন :“
এই মহিলাই আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল !”
খালিদ বলল :“
বরং আল্লাহ্ তোমাকে হত্যা করল ! কারণ তুমি ইসলাম হতে ফিরে গেছ !”
মালিক বলল্লেন :“
আমি মুসলমান এবং ইসলামের প্রতি অনড় রয়েছি !”
মালিক যখন বলছিলেন , আমি মুসলমান তখন খালিদ তাকে হত্যা করে তার মাথা কেটে খাবার পাত্রে রাখে এবং সেই রাতেই তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় ! একজন কবি এইরূপ বলেন:
সাবধান ! সেই লুণ্ঠিত গোত্রটিকে বল :“
মালিকের পর এই কালোরাত্রি অতি দীর্ঘ হবে !”
মালিকের স্ত্রীর প্রতি প্রণয়াসক্ত খালিদ কাপুরুষের ন্যায় তাকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীর সাথে স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে! আর পরের দিনই সে অসহায় ও মস্তকবিহীন ঐ ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে (আনুষ্ঠানিকভাবে) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়!
ইয়াকুবী লিখেছেন :“
আবু কাতাদাহ্ এই অবস্থা দেখে আবু বকরের নিকট গমন করেন এবং ঘটনার বর্ণনা প্রদান করে বলেন : আল্লাহর কসম ! এর পর থেকে খালিদের সেনাপতিত্বে আর যাব না , মালিক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও খালিদ তাকে হত্যা করেছে ।”
অপর বর্ণনায় এসেছে যে , উমর আবু বকরকে বললেন :“
খালিদ একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করেছে ! তাকে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা উচিত !”
আবু বকর বললেনঃ“
আমি তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করব না ! কারণ সে ইজতিহাদ করেছে এবং নিজ ইজতিহাদে ভুল করেছে !”
উমর বলল্লেন :“
অন্ততঃপক্ষে তাকে দায়িত্ব হতে অপসারণ করেন !”
আবু বকর বলল্লেন :“
যেই তরবারিকে আল্লাহ্ নিজে কোষমুক্ত করেছেন , আমি তাকে কোষবদ্ধ করতে পারব না !”
মালিকের ভাই মুতাম্মীম ইবনে নুওয়াইরা সেই যুগের অন্যতম কবি ছিলেন । একবার তিনি মদীনায় আসেন এবং আবু বকরের সাথে ফজরের নামায আদায় করার পর দাঁড়িয়ে স্বীয় ধনুকের উপর ভর দিয়ে তার ভাই মালিকের হন্তাকে সম্বোধন করে এইরূপ বলেন :“
হে আযূরের পৌত্র ! তুমি কি জান , তাঁবুর অন্তরালে কি ধরণের সৎলোকের মস্তক উচ্ছেদ করেছো ?! তুমি আল্লাহর নামে তাকে নিরাপত্তা দিয়েছো এবং তারপর খিয়ানত করেছো ! পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমাকে নিরাপত্তা দিতেন তবে আদৌ খিয়ানত করতেন না !”
খুলাফা (সুন্নী) মতাদর্শের কিতাবসমূহে বর্ণিত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এবং মালিক ইবনে নুওয়াইরার ঘটনাটির সারসংক্ষেপ হলো এই। আহলে বাইত (আ.) মতাদর্শের কিতাবসমূহে এই গল্পটির বর্ণনা নিম্নরূপে এসেছে :
আহলে বাইত (আ.) মতাদর্শের অনুসারীদের কিতাব সমূহে মালিকের ঘটনা
বিহারুল আনওয়ারে এসেছে :“
আল্লাহর রাসূল (সা:) যখন ইন্তেকাল করেন তখন মালিক ইবনে নুওয়াইরার সাথে বনী তামীম গোত্রের লোকেরা মদীনায় আসেন। মালিক , আল্লাহর রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির অনুসন্ধান করেন। কারণ , জুমু’
আর দিনে রাসূলের মিম্বরের উপর তিনি আবু বকরকে খুৎবা দিতে দেখে জিজ্ঞেস করেন :‘
রাসূলের ওয়াসী (প্রতিনিধি) , যাঁর আনুগত্য করার জন্যে আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি কোথায় ?’
লোকেরা বলল :’
হে বেদুইন ! এখানে নতুন ঘটনার অবতারণা হয়েছে এবং এমন এক নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছে যে সম্পর্কে তুমি অনবগত !’
মালিক বলল্লেন :‘
না , আল্লাহর কসম ! কোনো নতুনত্বের অবতারণা হয় নি বরং তোমরা আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি খিয়ানত(বিশ্বাসঘাতকতা) করেছো !’
অতঃপর আবু বকরের দিকে ফিরে বলেন :“
কে তোমাকে এই মিম্বরের উপর আরোহণ করিয়েছে এবং আল্লাহর রাসূলের ওয়াসীকে তা হতে দূরে সরিয়েছে ?’
আবু বকর এইরূপ দেখে বলেন :‘
প্রস্রাবকারী এই বেদুইনকে আল্লাহর রাসূলের মসজিদ হতে বের করে দাও ! উমরের দাস কুনফুয এবং খালিদ ইবনে ওয়ালীদ উঠে দাঁড়ায় ও তাকে প্রহার করে বের করে দেয়। আবু বকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার পর খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে ডেকে পাঠান এবং বলেন :’
তুমি দেখলে , জন সম্মুখে কি বলল ? আমি তার থেকে নিরাপদ নই !’
খালিদ রওনা হয় , বাহ্যিকভাবে তাকে নিরাপত্তা দেয় কিন্তু কাপুরুষের ন্যায় তাকে হত্যা করে আর সেই রাতেই তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে ।”
ঙ. কান্দা অঞ্চলের লোকজনকে হত্যা ও বন্দী
যিয়াদ ইবনে লাবীদ , আল্লাহর রাসূলের পক্ষ হতে কান্দা ও হাযরা মাউত অঞ্চলের গভর্ণর ছিলেন। রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের পর আবু বকর তাকে জনগণের নিকট হতে বাইআত গ্রহণের জন্যে এবং তাদের মালের যাকাত সংগ্রহের জন্যে আদেশ প্রদান করেন। যিয়াদও তাই করেন এবং এক পর্যায়ে‘
বনী যাহল ’ গোত্রের নিকট উপস্থিত হন এবং তাদের নিকট হতে আবু বকরের জন্যে বাইআত গ্রহণ করতে চান।
এই গোত্রের‘
হারিছ ইবনে মুয়াবিয়া’
নামক একজন গোত্রপতি যিয়াদকে বলেন :“
তুমি আমাদেরকে এমন একজন লোকের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে বলছো , যার আনুগত্যের ব্যাপারে রাসূলের পক্ষ হতে আমাদের নিকট কোনো আদেশ আসে নি !”
যিয়াদ বলেন :“
সত্যিই বলেছো , তার ব্যাপারে কোনো আদেশ ও প্রতিশ্রুতি নেই তবে আমরা অর্থাৎ মদীনার লোকেরা তাকে নির্বাচন করেছি ।”
হারিছ বলেন :“
বল , আমরা জানতে চাই যে , রাসূলের আহলে বাইতকে ক্ষমতা হতে কেন তোমরা বঞ্চিত করলে ? অথচ , তাঁরা এর জন্যে সর্বাধিক উপযুক্ত ছিলেন। আর মহান আল্লাহ্ বলেন:‘
ওয়া উলুল্ আরহামি বা ’ যুহুম্ আউলা বিবা ’ যিন্ ফী কিতাবিল্লাহি। ’ অর্থাৎ আত্মীয়গণ আল্লাহর বিধানে একে অন্যের চেয়ে অধিক হকদার ।”
এই বক্তব্যগুলি হতে জানা যায় যে , আল্লাহর এই বান্দা , রাসূলের হাদীছসমূহ শ্রবণ করে নি। গাদীরে খুমের ঘটনা এবং ইমাম আলীর নিয়োগের ব্যাপারেও অনবগত রয়েছে। কিন্তু তার জানা এই আয়াতটি থেকে তিনি এরূপ বুঝেছেন যে , রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি অবশ্যই তাঁর বংশের ও আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত হবেন এবং এই জন্যে তার উপর ভিত্তি করে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
যিয়াদ বলল:“
মুহাজির ও আনসারগণ তোমার থেকে নিজেদের বিষয়ে অধিক জ্ঞাত !”
হারিছ বললেনঃ“
না , আল্লাহর কসম ! তোমরা এই মর্যাদার অধিকারীকে উপেক্ষা করেছো এবং তাঁদের ব্যাপারে তোমরা হিংসা করেছো ; আদৌ এমন হতে পারে না যে , রাসূল (সা.) পৃথিবী হতে চলে যাবেন আর কাউকেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করবেন না !”
অন্যান্যরাও তাকে সত্যায়ন করলেন ।
যাই হোক , যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। যিয়াদ ইবনে লাবীদ‘
আবু বকরের ’ নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল। আবু বকর চার হাজার সৈন্যের একটি দলকে তার সাহায্যের জন্যে প্রেরণ করলেন। যিয়াদ এই গোত্রগুলির উপর রাত্রিতে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে তাদের মাঝে কতক লোককে হত্যা করল এবং অবশিষ্ট দেরকে অর্থাৎ তাদের স্ত্রী , সন্তান সকলকে সম্পদসহ বন্দী করল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে , ঐতিহাসিকগণ সর্বত্র এদেরকেই ধর্মত্যাগী এবং আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করতঃ লিখেছেন :“
মুসলমানরা তাদের সমস্ত ধন সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করেন !”
অথচ তারা সকলেই মুসলমান ছিলেন এবং শুধুমাত্র রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি ও আবু বকরের নিকট বাইআত গ্রহণের বিষয়ে তাদের আপত্তি ও প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তাদের কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয় নি এবং তাদের সবাইকে ধর্মত্যাগী ও দ্বীন হতে বহির্ভূত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ।”
অনুরূপ আরেকটি ঘটনা এই যে , খলীফার নিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা‘
রাবা ’ এলাকার অধিবাসিদের আত্মীয় স্বজন নিহত হওয়ার কারণে , তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং সেখান হতে গভর্ণরকে বিতাড়িত করে। আবু বকর‘
ইকরামা ইবনে আবী জাহলকে ’ লিখেন :“
পূর্ব দায়িত্বের স্থলে‘
রাবা ’ এলাকার লোকজনের নিকট গমন কর এবং তাদের সাথে যথোপযুক্ত ব্যবহার কর। কাজের শেষে , তাদের বন্দীদেরকে আমার নিকট প্রেরণ কর এবং তুমি‘
যিয়াদ ইবনে লাবীদের ’ সাথে মিলিত হও !”
ইকরামা গমন করতঃ তাদেরকে অবরোধ করে।‘
রাবা ’ এলাকার লোকেরা প্রস্তাব দেন :“
আমরা তোমাদের মতামত গ্রহণ করব ! এস , আমরা সন্ধি করি ! আমরা যাকাত প্রদান করব এবং বাইআত করব !”
তারা উত্তরে শুনতে পান :“
তোমাদেরকে এইভাবে গ্রহণ করতে পারি যে , তোমরা নিম্নোক্ত শর্তগুলি গ্রহণ করবে:
১। তোমরা স্বীকার করবে যে , তোমরা নিজেরা বাতিলপন্থী এবং আমরা সত্যপন্থী।
২। তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা জাহান্নামে এবং আমাদের নিহত ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবে।
৩। তোমাদের আত্মসমর্পণের পর , আমরা যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে তোমাদের সাথে আচরণ করব ।”
‘ রাবা ’ এলাকার নিরুপায় লোকজন শর্তগুলি গ্রহণ করলেন এবং প্রাক্তন গভর্ণর হুযায়ফা , যাকে তারা বের করে দিয়েছিলেন , সে বলল:“
যদি তোমরা সত্যই বলে থাক তবে যুদ্ধাস্ত্র ব্যতীত সকলে শহরের বাইরে এসো !”
তারা তাই করল। ইকরামা দুর্গে প্রবেশ করল এবং তাদের মাঝে অভিজাত ও মহান ব্যক্তিগণকে হত্যা করল , তাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে বন্দী করল , তাদের ধন সম্পদগুলিকে বাজেয়াপ্ত করল এবং সবগুলিকে আবু বকরের নিকট প্রেরণ করল।
আবু বকরের সিদ্ধান্ত ছিল , তাদের পুরুষগণকে হত্যা করবেন এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরকে সৈন্যদের মাঝে বিতরণ করবেন। কিন্তু হয়রত উমর বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন এবং বলেলন :“
এরা মুসলমান এবং আল্লাহর কসম খাচ্ছে যে , তারা ইসলাম ধর্ম হতে ফিরে যায় নি। অতএব , তাদেরকে মেরে ফেলা অনুচিত ।”
আবু বকর তাদেরকে হত্যা করা হতে বিরত থাকলেন কিন্তু তাদেরকে মদীনায় বন্দী করে রাখলেন এবং তার মৃত্যুর পর হযরত উমর তাদেরকে মুক্ত করে দেন।‘
উমরের আরব জাতীয়তাবোধ তীব্র ছিল এবং আবু বকরের মৃত্যুর পর আরবের সমস্ত বন্দীকে তিনি মুক্ত করে দেন। ’
অতএব , বিষয়টি ধর্মত্যাগ ও ধর্ম হতে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত নয় বরং এই ঘটনাগুলি এবং‘
মালিক ইবনে নুওয়াইরার ’ ঘটনা হতে যা জানা যায় তা হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি , রাসূলের ওসিয়ত এবং জাতির নেতৃত্বদান ছিল মূল বিষয়। শাসকগোষ্ঠী প্রতিবাদী কন্ঠ স্তব্ধ করার জন্যে এবং গোলযোগ দমন করার জন্যে কঠোরতার রাজনীতি অবলম্বন করে এবং‘
ধর্মত্যাগীর ’ লেবেল লাগিয়ে তাদের সকলকে হত্যা করে নিজ পথ হতে কাঁটা দূরীভূত করেছেন।
আবু বকরের ওসিয়ত
আবু বকরের শাসনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল। তিনি তার নিজ বন্ধুদের জন্যে পথকে সুগম করার পর মৃত্যুশয্যায় উছমানকে আহ্বান করেন এবং বলেন :“
লিখ ! বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম , এইটি একটি অসিয়তনামা যার মাধ্যমে আব্দুল্লাহ ইবনে উছমান (আবু বকর) মুসলমানদেরকে আদেশ দিচ্ছেন। অতঃপর ।”
এই অবস্থায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লে উছমান নিজে থেকেই লিখেন :“
আমি তোমাদের উপর আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উমর ইবনে খাত্তাবকে মনোনীত করলাম ।”
আবু বকরের জ্ঞান ফিরে এল এবং তিনি বলেলন :“
কি লিখেছ পড় দেখি !”
উছমান যা লিখেছিলেন তা পড়লেন। আবু বকর তকবীর ধ্বনি দেয়ার মাধ্যমে নিজ সন্তুষ্টি ব্যক্ত করলেন এবং বলেলন :“
তুমি ভয় করেছো যে , আমি মারা যাব আর লোকজন বিভেদে লিপ্ত হয়ে পড়বে ?”
উছমান বলেলন :“
হ্যাঁ ।”
আবু বকর বলেলন :“
আল্লাহ্ তোমাকে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ হতে উত্তম পুরস্কার দান করেন !”
অতঃপর ওসিয়ত নামা সমাপ্ত করেন এবং জনগণের নিকট তা পাঠ করে শুনানোর জন্যে আদেশ দেন।
আমি বলব :“
সত্যিই ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে তারা কি করেছিলেন ! যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) উম্মতের মধ্যে বিভেদের কথা চিন্তা করে তাদের জন্যে অসিয়তনামা লিখতে চান , তখন তারা তাঁর নিষ্পাপত্বের ঐশী মর্যাদার সাথে বেআদবী করে প্রলাপ বকার অপবাদ আরোপ করে বলেন :“
রাসূলের রোগ যন্ত্রণা তীব্রতা লাভ করেছে এবং“
ইন্নার রাজুলা লাইয়াহ্জুরু ” অর্থাৎ এই লোকটি প্রলাপ বকছেন !“
হাসবুনা কিতাবুল্লাহ্ ” অর্থাৎ আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্যে যথেষ্ট ! কিন্তু যখন আবু বকর নিজ অসিয়তনামা অসমাপ্ত রেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তখন তার দীর্ঘদিনের বন্ধুরা , পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সেটিকে পূর্ণ করেন !“
মা লাকুম্ কাইফা তাহ্কুমূন ? তোমাদের কি হয়েছে , কিরূপ বিচার করছ ?!”
ইসলামের সূচনালগ্নের ইতিহাসের একাংশ উপস্থাপনের মাধ্যমে , এখন আমাদের নিকট তার সামান্য অংশ প্রকাশিত হয়েছে। আমীরুল মু’
মিনীন আলী (আ.) এর হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী ভাষণ , বিষয়টিকে আমাদের নিকট গ্রহণ যোগ্য ও উপলব্ধি সহজতর করে দিচ্ছে :
“ জেনে রাখ ! আল্লাহর কসম , আবু কুহাফার পুত্র খিলাফতের পোশাককে এমন অবস্থায় পরিধান করেছেন যখন তিনি জানেন যে , খিলাফত ও আল্লাহর রাসূলের স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে আমার স্থান , ঠিক যাঁতার কেন্দ্রীয় পাথরের ন্যায়। যখন আমার অধিকারকে হরণ হতে দেখলাম এমন অবস্থায় ধৈর্য ধারণে বাধ্য হলাম যে ,আমার চোখে কাঁটা এবং আমার কণ্ঠ হাড় বিদ্ধ ছিল ।। এইভাবে প্রথমজন (আবু বকর) তার পথের শেষ প্রান্তে পৌছালেন এবং তা খাত্তাবের পুত্রকে উৎকোচ দিলেন ! কি বিস্ময়কর ব্যাপার ! তার জীবদ্দশায় যা ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলতেন মৃত্যুর সময় তা অপরকে প্রদান করলেন। আহ্ ! তিনি কিরূপ লোভাতুর ও দৃঢ়ভাবে তা দোহন করেছেন !”
৪ । উমরের
খিলাফত
ও
ইসলামে
বিকৃতির
প্রসার
সমস্ত মতাদর্শের উপর ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে এই যে , ইসলাম শ্রেণী শাসন ও শ্রেণীবৈষম্যের অবসান ঘটিয়েছে এবং সমতা ও ভ্রাতৃত্বের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। পবিত্র কুরআন বলছে :“
ইয়া আয়্যুহান্নাসু ইন্না খালাক্বনাকুম্ মিন্ যাকারিন্ ওয়া উনছা ওয়া জা’
আলনাকুম শু ’ ঊবান্ ওয়া ক্বাবায়িলা লিতা ’ আরাফূ ইন্না আকরামাকুম্ ’ ইন্দাল্লাহি আত্ক্বাকুম ইন্নাল্লাহা ’ আলীমুন্ খাবীর ।”
অর্থাৎ হে মানুষ ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। নিশ্চয় , তোমাদের মাঝে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যেই ব্যক্তি সর্বাধিক খোদাভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও সব কিছুর খবর রাখেন ।”
আমরা জানি , ইসলামের আবির্ভাব ও প্রসারের পূর্বে তৎকালীন পৃথিবীর বিদ্যমান সকল দেশেই রূপগত পার্থক্যছাড়া শ্রেণীশাসন চালু ছিল। ইরানে এক রকমের , রোমে আরেক রকমের , ভারত ও চীনে ভিন্ন রকমের , আর আরব উপদ্বীপ তখন সভ্যতা ও রাষ্ট্রীয়শাসন হতে বঞ্চিত থাকায় তাদের গোত্রসমূহে শ্রেণীভিত্তিক শাসন বলবৎ ছিল এবং তারা গোত্রপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত হত ।
ইসলাম বলে : তোমরা সকলে এক পিতা মাতা হতে উদ্ভূত। আর তোমাদের বিভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে শুধু এই জন্যে যে , যাতে করে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। আল্লাহর নিকট সেই অধিক প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ যে সর্বাপেক্ষা খোদাভীরু।
ইসলাম ও ইসলামী আহ্বান“
হে লোক সকল ” সম্বোধন দ্বারা শুরু ও প্রচার লাভ করেছে । অর্থাৎ সমস্ত মানবকে সম্বোধন করেছে এবং সবাইকে একই শ্রেণীতে স্থান দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় খলীফা তার খিলাফতের সূচনায় নিজ ইজতিহাদের দ্বারা ইসলামের মাঝেও শ্রেণীবৈষম্য আবিষ্কার করেন , কিরূপে ?