আল্লাহর রাসূলের (সা.) নাতির শাহাদত
আবু মাখনাফ , সাকআব ইবনে যুবাইরের সূত্রে হামিদ ইবনে মুসলিম হতে বর্ণনা করেছেন :“
ইমাম হুসাইনের (আ.) শরীরে পশমের একটি জুব্বা ছিল এবং মাথার উপর ছিল একটি পাগড়ি। তিনি নিজের দাড়িসমূহকে রাঙিয়ে ছিলেন। শাহাদতের পূর্বে তিনি পদব্রজে ছিলেন কিন্তু সাহসী বীরের ন্যায় এবং পূর্ণ দক্ষতার সাথে লড়ছিলেন। তিনি অশ্বারোহী শত্রুদের প্রতি হামলা করছিলেন ।”
আমি নিজে শুনেছি , তিনি তাদের সম্বোধন করে বলছিলেন:“
আমাকে হত্যা করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছো এবং জনগণকে সেই কাজের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করছো ?! আল্লাহর শপথ ! অন্যান্য যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা অপেক্ষা , আমাকে হত্যা করার জন্যে মহান আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অধিক রাগান্বিত হবেন। আমি আশা রাখি যে , মহান আল্লাহ্ আমাকে তোমাদের লাঞ্ছনা ও অপমানের বিপরীতে সম্মানিত করবেন। যতখানি তোমরা চিন্তাও করতে পার না ততখানি মহান আল্লাহ্ তোমাদের নিকট থেকে আমার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
আল্লাহর শপথ ! জেনে রাখ যে , আমাকে হত্যা করলে মহান আল্লাহ্ তোমাদের উপর অত্যন্ত কঠোর হবেন , তোমাদের রক্ত ঝরবে , এতেও যথেষ্ট নয় বরং তোমাদের প্রতি তিনি কয়েকগুণ বেশি পীড়াদায়ক শাস্তি ধার্য করবেন ।”
হামিদ ইবনে মুসলিম বলেন : ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হচ্ছিল , এই সময়ে কেউ তাঁকে হত্যা করতে চাইলে , হত্যা করতে পারত। কিন্তু তারা অপেক্ষা করছিল যে , অপর কেউ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটির পদক্ষেপ গ্রহণ করুক যাতে করে তারা নিজেদেরকে এই গুরুতর অপরাধ থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। ঠিক এই অবস্থায় শিমর (শিমার) চিৎকার দিয়ে উঠে :“
তোমাদের প্রতি অভিসম্পাত ! কিসের অপেক্ষায় রয়েছো , তোমাদের মায়েরা তোমাদের জন্য বিলাপ করুক ?!! এই লোকটির কাজ সমাপ্ত কর এবং তাঁকে হত্যা কর !”
শিমারের ফরিয়াদের কারণে কুফার লোকেরা চারদিক হতে তাঁর উপর আক্রমণ করে। শুরাইক তামীমী তার তরবারি দ্বারা ইমামের বাম হাতের উপর একটি আঘাত করে। অপর একজন তাঁর কাঁধের উপর একটি আঘাত করে , যার ফলে ইমাম (আ.) কয়েকবার দাঁড়ান এবং মুখ থুবড়ে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা এই অবস্থায় তাঁর নিকট হতে দূরে সরে যায়।
যখন ইমাম একবার দাঁড়াচ্ছিলেন আবার মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন আমর নাখ্য়ীর নাতি সিনান ইবনে আনাস তার বর্শা দ্বারা তাঁর উপর মারাত্মক একটি আঘাত হানে। ইমাম সেই আঘাতের ফলে লুটিয়ে পড়েন।‘
খাওলা ইবনে ইয়াযীদ আসবাহীর ’ দিকে মুখ ফিরিয়ে সিনান বলে“
তাঁর দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন কর !”
খাওলা , ইমামের দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করার জন্যে সামনে অগ্রসর হলো কিন্তু দুর্বলতা ও আড়ষ্টতা যেন তার সমগ্র অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করলো এবং সে কাঁপতে শুরু করল। সিনান ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে খাওলাকে উদ্দেশ্য করে বলল :“
আল্লাহ্ তোমার বাহু দু’
টিকে ভেঙ্গে ফেলুক এবং তোমার হাত দু’
খানিকে অকেজো করে দিক !”
অতঃপর সে নিজেই সামনে অগ্রসর হয়ে নিষ্পাপ সেই ইমামের মাথাটিকে তাঁর পবিত্র শরীর হতে বিচ্ছিন্ন করে। তারপর সেই পবিত্র মাথাটিকে খাওলার নিকট অর্পণ করে ।”
ইমাম সাদীকের (আ.) উদ্ধৃতি দিয়ে আবু মাখনাফ বলেনঃ“
শাহাদতকালে হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শরীরে ৩৩টি বর্শার আঘাত এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছিল !”
ইমামের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে সিনান ইবনে আনাস , ইবনে সা’
দের অপর সৈন্যদেরকে তাঁর (আ.) নিকটবর্তী হওয়া থেকে কঠিনভাবে বাধা দিচ্ছিল , এই আশঙ্কায় যে , হয়তো বা অপর কেউ তার আগেই ইমামের দেহ হতে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে দেয় ! স্বীয় বাসনা চরিতার্থ করা হলে সে , ইমামের পবিত্র মাথাটিকে খাওলার নিকট অর্পণ করে।
খলীফার সৈন্যরা রাসূলের সন্তানের শরীরের পোশাকগুলি লুণ্ঠন করছে
আবু মাখনাফ বলেন : ইমামের দেহকে তারা বিবস্ত্র করে এবং যা কিছু তাঁর শরীরে ছিল তা লুট করে। বাহর ইবনে কা’
ব তাঁর জামা এবং কায়েস ইবনে আশ্আছ তাঁর রেশমী আবাটি ছিনিয়ে নেয়। এইরূপ একটি ধৃষ্টতার জন্য সে‘
কাতীফা কায়েস ’ (লুটকারী কায়েস) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আসওয়াদ নামের বনী আওদ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাঁর জুতাগুলি ছিনিয়ে নেয় এবং বনী নাহ্শাল ইবনে দারিম গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাঁর তরবারিখানা নেয়। পরবর্তীতে সেই তরবারিখানা হাবীব ইবনে বুদাইলের পরিবারের হাতে পড়ে।
অতঃপর সৈন্যরা পোশাক আষাক , অলঙ্কারাদি এবং উটগুলি লুট করা শুরু করে। পরিশেষে তারা ইমাম হুসাইনের (আ.) অন্দরমহল অর্থাৎ নারিগণ এবং তাদের আসবাবপত্র ও সাজ সরঞ্জামের দিকে ধাবিত হয়। এমনকি তারা নারিদের মস্তকাবরণ ও তাঁদের চাদরগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিল !
সর্বশেষ শহীদ
যুহাইর ইবনে আব্দুর রাহমান খাছ্আমী হতে বর্ণিত হয়েছে : সুওয়াইদ ইবনে আমর ইবনে আবিল মাতা নামের ইমামের একজন সাথি মারাত্মতভাবে আহত হয়ে নিহতদের মাঝে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলেন। ইমামের শাহাদতের পর কিছুটা তাঁর চেতনা ফিরে আসে এবং তিনি লোকদের বলতে শুনেন:”
হুসাইন নিহত হয়েছেন !”
এই ধ্বনিটি তাঁকে জাগ্রত করে তোলে। তাঁর তরবারিখানা লুট করে নেয়ার কারণে , তিনি নিজের সঙ্গে রাখা চাকু দ্বারা কুফার লোকদের প্রতি আক্রমণ শুরু করেন এবং কিছু সময় ব্যাপী তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। পরিশেষে উরওয়াহ্ ইবনে বাত্বার তাগলিবী এবং যায়িদ ইবনে রিক্বাদ জাম্বী ’ র হাতে নিহত হন ও শহীদগণের কাতারে শামিল হন।
হামিদ ইবনে মুসলিম হতে বর্ণনা করা হয়েছে :“
আমি লুটকারী সৈন্যদের সঙ্গে ইমামের (আ.) তাঁবুগুলিতে প্রবেশ করলাম এবং আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী অর্থাৎ আলী আসগরের
নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই অবস্থায় শিমার ইবনে যিল জাওশান তার পদাতিক লোকদের সাথে এই কথা বলাবলি করছিল :‘
এই রুগ্ন ব্যক্তিটিকে কি হত্যা করব , না করব না ?’
আমি উপস্থিত হয়ে তাদেরকে সম্বোধন করে বললাম : সুবহানাল্লাহ্ ! তাহলে কি তোমরা কিশোরকেও হত্যা করবে ? এই রুগীটি একজন কিশোর ছাড়া বেশী কিছু নয়। আমি এই কথার দ্বারা , যারাই তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হচ্ছিল তাদেরই পথ রোধ করছিলাম এবং সামনে অগ্রসর হতে দিচ্ছিলাম না। পরিশেষে উমর ইবনে সা’
দ সেখানে উপস্থিত হয় এবং চিৎকার করে বলে :‘
এই নারিদের তাঁবুতে প্রবেশ করার কারও অধিকার নেই এবং এই রুগ্ন যুবকটিকে কোনোরূপ কষ্ট দিতে পারবে না ; উপরন্তু যারা তাদের কোনো সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে তারা যেন সেইগুলি তাঁদের নিকট ফিরিয়ে দেয় !’
কিন্তু আল্লাহর শপথ ! তার কথায় কেউ কান দিল না এবং লুণ্ঠনকৃত মাল পত্রের কোনো কিছুই ফিরিয়ে দিল না !”
ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন :“
উত্তম কাজ করেছো। কসম খাচ্ছি যে , মহান আল্লাহ্ তোমার কথার দ্বারা তাদের কুকর্ম ও যাতনাকে আমা হতে দূরীভূত করেছেন ।”
হুসাইনের (আ.) হন্তা পুরস্কার চায় !
বর্ণনাকারী বলেন :“
ইমাম হুসাইনের নিহত হওয়ার পর , কুফার সৈন্যদের কয়েকজন লোক সিনান ইবনে আনাসকে বলে:‘
আলী ও আল্লাহর রাসূলের কন্যা ফাতিমার সন্তান হুসাইনকে তুমি হত্যা করেছো এবং আরবের সর্বাধিক অবাধ্য ব্যক্তি যিনি এই ক্ষমতাসীন সরকারের কব্জা থেকে ক্ষমতাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে ওঁৎ পেতে বসে ছিলেন তাঁকে তুমি পরাজিত করেছো। এখনই সময় তুমি তোমার অধিনায়কদের নিকট যাও এবং তাদের নিকট হতে পুরস্কার চাও। তুমি তাদের জন্যে যে কাজ করেছো ও হুসাইনকে হত্যা করে তাদের যে উপকার করেছো , তার জন্যে তারা যদি তাদের যাবতীয় ধন সম্পদও তোমাকে দান করে তবুও তা তোমার কাজের প্রতিদান হবে না !
সিনান একদিকে যেমন একজন সাহসী পুরুষ অপরদিকে তেমনি বোকা ও বিকৃত মস্তিষ্ক ছিল , তাদের কথায় সে প্রভাবিত হল। তখন সে নিজ ঘোড়ায় আরোহণ করে সরাসরি উমর ইবনে সা’
দের তাঁবুর দিকে ছুটল এবং সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সমস্ত শক্তি দ্বারা চিৎকার দিয়ে বলল :
“
আউকির রিকাবিয়া ফিযযাতান্ ওয়া যাহাবা আনা ক্বাতালতুল মালেকাল্ মুহাজ্জাবা
ক্বাতালতু খাইরান্নাসি উম্মান্ ওয়া আবা ওয়া খাইরুহুম্ ইয্ ইয়ানসিবূনা নাসাবা ।”
অর্থাৎ আমি একজন মহৎপ্রাণ বাদশাহকে হত্যা করেছি , এই সুসংবাদের জন্য তোমরা আমার বাহনকে স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা ভরে দাও ! আমি পিতা মাতার দিক থেকে সর্বোত্তম মানুষকে হত্যা করেছি , তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি বংশ কৌলীন্যের দিক হতে তাদের সর্বোত্তম !
সিনানের আওয়াজ , কবিতা ও বীরত্বগাঁথা শুনে উমর ইবনে সা’
দ তাকে সম্বোধন করে বলে :“
আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে , তুমি একজন পাগল!”
তারপর সেই উপস্থিত জনতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল :“
ওকে ভিতরে আনো !”
সিনান যখন উমর ইবনে সা’
দের তাঁবুতে পা রাখল তখন সে তার নিজের হাতের লাঠি দ্বারা তাকে আঘাত করে বলল : এই পাগল ! তুমি এই ধরনের কথাবার্তা বলছো ? আল্লাহর শপথ! তোমার এই কথাগুলো যদি ইবনে যিয়াদ শুনে তবে তোমার শিরোচ্ছেদ করবে !”
উকবাহ মুক্তি পেল এবং‘
মারকা’
বন্দী হলো
ইমরুল কায়িসের কন্যা ও সাকীনার মাতা রুবাবের মুক্ত দাস উকবাহ্ ইবনে সাম্আনকে লোকেরা বন্দী করে উমর ইবনে সা’
দের নিকট নিয়ে যায়। উমর তাকে জিজ্ঞাসা করল:‘
তুমি কি কর ?’
উকবাহ্ উত্তর দিলেন :‘
আমি একজন কৃতদাস !’
এই উত্তরের সাথে সাথে উমর তাঁর উপর হতে হাত গুটিয়ে নেয় এবং তাঁকে ছেড়ে দিল। বলল : সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। তিনি ও মারক্বা ইবনে ছামামা আসাদী ব্যতীত ইমামের অপর কোনো সাথিই জীবন রক্ষা করতে পারেননি ।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারক্বা ’ তাঁর সমস্ত তীরকে শত্রুর বক্ষে বসিয়েছিলেন এবং তাঁর ধনুকে আর কোনো তীর অবশিষ্ট ছিল না। তিনি কুচক্রী শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছিলেন , এমন সময়ে তাঁরই কয়েকজন নিকটাত্মীয় তাঁর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল যে , তুমি যুদ্ধ থেকে বিরত হও ; আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দান করব। এই কথায় মারক্বা ’ তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। পরিশেষে উমর ইবনে সা’
দ তাঁদেরকে ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যায় এবং তাদের ঘটনা ও মারক্বা ’ কে দেয়া তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে ইবনে যিয়াদের নিকট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ইবনে যিয়াদও মারক্বা ’ কে হত্যা না করে , যুরারা অঞ্চলে নির্বাসিত করে।
ফাতিমা(আ.) এর নিহত সন্তানের উপর ঘোড়া ছুটানো হয়েছে
ইমাম নিহত হলে , উমর ইবনে সা’
দ তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল যে , নিহত ইমামের পবিত্র দেহের উপর ঘোড়া চালাতে আগ্রহীরা যেন এগিয়ে আসে !
সেই সৈন্যদের মাঝ হতে দশজন লোক সামনে এগিয়ে আসলো। তাদের মাঝে আলকামা ইবনে সালামা’
র বংশের‘
ইসহাক ইবনে হায়াত হাযরামী ও আহবাশ ইবনে মুরছেদকে ’ দেখা যাচ্ছিল। বর্ণনাকারী বলেন :“
প্রথমজন ইমামের শরীর হতে পরিধেয় বস্ত্র খুলে নেয়ার ফলে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়। আর ইবনে মুরছেদ সেই ঘটনার অব্যবহিত পরেই কোনো এক যুদ্ধে , অজানা একটি তীর এসে তার বক্ষ ভেদ করে এবং তাকে জাহান্নামে প্রেরণ করে ।”
যা হোক , এই দশজন নিকৃষ্ট ব্যক্তি (আল্লাহ্ ও রাসূলের সামনে লজ্জাবোধ করল না) তাদের নিজ নিজ ঘোড়াগুলিকে হুসাইনের (আ.) মৃতদেহের উপর দিয়ে ছুটালো এবং তাঁর পিঠ ও পাঁজরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল !
মদীনায় ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্যে শোক পালনকারীরা
১। উম্মে সালমা
সুনানে তিরমিযী , সিয়ারে আ’
লামিন্ নুবালা , রিয়াযুন্নাযরা , তারীখে ইবনে কাছীর , তারীখুল খামীছ এবং অন্যান্য সূত্রে সালমা’
র বরাত দিয়ে এসেছে :“
একদা আমি উম্মে সালমা’
র খিদমতে উপস্থিত হলাম এবং তাঁকে ক্রন্দনরত দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম , আপনি কেন ক্রন্দন করছেন ? তিনি উত্তর দিলেন , আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি স্বপ্নে শোকার্ত দেখলাম , তাঁর মাথা ও মুখমণ্ডলে মাটি লেগে ছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রাসূল ! আপনার এ কি অবস্থা ? তিনি উত্তরে বললেন , এই কিছুক্ষণ পূর্বেই হুসাইনকে নিহত হতে দেখলাম !”
ইয়াকুবী স্বীয় ইতিহাসে লিখেন : ইমাম হুসাইনের (আ.) শোকে মদীনায় সর্বপ্রথম যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় তা ছিল রাসূলের স্ত্রী উম্মে সালমা’
র গৃহ হতে। তার কারণ ছিল এই যে , রাসুল‘
উম্মে সালমা’
কে একটি বোতলে কিছু মাটি প্রদান করে বলেন যে , জিব্রাঈল (আ.) আমাকে অবগত করলেন , হুসাইনকে আমার উম্মতের এক দল লোক হত্যা করবে। তারপর তিনি বলেন :“
তুমি যখনই দেখবে যে , এই মাটি টুকু টাট্কা রক্তে রূপান্তরিত হয়েছে তখনই জেনো যে , হুসাইন নিহত হয়েছেন ।”
সেই মাটি টুকু তখন থেকে উম্মে সালমা’
র নিকট ছিল , ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের সময় নিকটবর্তী হলে সেই মহিয়সী নারী সার্বক্ষণিক সেই মাটির দিকে চেয়ে থাকতেন এবং যখন তিনি দেখলেন যে , সেই মাটি টুকু টাট্কা রক্তে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তখন তিনি“
ওয়া হুসাইনা ” ও“
ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ্ ” বলে চিৎকার করে ক্রন্দন শুরু করলেন। মদীনার নারীরা উম্মে সালমা’
র আর্তনাদ শুনে মদীনার প্রতিটি কোণায় কোণায় শোকের রোল তুললেন এবং এক সময়ে হুসাইনের শোকে মদীনা শহরে এক বিরাট শোরগোল শুরু হল যা ইতিপূর্বে কোনো দিন শুনা যায় নি ।”
২। ইবনে আব্বাস
আহমাদ ইবনে হাম্বালের মুসনাদ ও ফাযায়েল গ্রন্থে , ত্বাবরানী ’ র মো ’ জামে কাবীর গ্রন্থে , মুস্তাদরাকে হাকিমে , রিয়াযুন্নাযরা গ্রন্থে এবং অন্যান্য সূত্রে আম্মার ইবনে আবী আম্মারের ভাষ্যে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হয়েছে যে , তিনি বলেন“
দিনের মধ্যাহ্নভাগে ঘুমন্ত অবস্থায় আল্লাহর রাসূলকে (সা.) স্বপ্নে দেখলাম। তিনি ধুলা বালি মাখা এবং এলোমেলো চুলসহ খুবই বিমর্ষ অবস্থায় ছিলেন। তাঁর হাতে রক্তে পূর্ণ একটি বোতল ছিল ! তাঁকে সম্বোধন করে আমি বললাম :“
হে আল্লাহর রাসূল , আপনার জন্যে আমার পিতা মাতা উৎসর্গিত হোক ! আপনার হাতে এটি কি ? তিনি বললেন : এটি ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের রক্ত , এটি আমি আজই উঠিয়েছি ।”
আম্মার বলেন:“
আমি সেই দিবসটিকে (যে দিনটির প্রতি ইবনে আব্বাস ইশারা করেছিলেন) অনুসন্ধান করে দেখলাম , সেই দিবসেই হুসাইন শহীদ হয়েছেন ।”
তারীখে ইবনে আসাকির ও ইবনে কাছীরে , জিদ্আনের পৌত্র‘
আলী ইবনে যাইদে ’ র ’ বরাত দিয়ে এসেছে :“
ইবনে আব্বাস ঘুম হতে জেগে উঠেন এবং পুনরায় শুতে গিয়ে বলেন , আল্লাহর শপথ ! হুসাইন নিহত হয়েছেন ! তাঁর একজন সাথি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : কোথা থেকে তুমি এইরূপ কথা বার্তা বলছ ? তিনি বললেন : স্বপ্নে রাসূলকে রক্তে পূর্ণ একটি বোতলসহ দেখলাম। তিনি আমাকে বললেন : তুমি জান , আমার উম্মতরা আমার পরে কি করেছে ?! তারা হুসাইনকে হত্যা করেছে এবং এই হচ্ছে তাঁর ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের রক্ত , আল্লাহর নিকট নিয়ে যাচ্ছি !”
তারা সেই দিন ও সেই সময়কে লিখে রাখেন। চব্বিশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর মদীনায় সংবাদ আসে যে , সেই দিন ও সেই সময়ই হুসাইন (আ.) নিহত হয়েছেন।
৩। অপর অপরিচিত ব্যক্তি
তাবারী ও অন্যান্যরা আমর ইবনে ইকরামা’
র উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : যেই দিন হুসাইন নিহত হন সেই দিনই সকালে আমাদের জনৈক মাওয়ালী (দাস) মদীনায় সংবাদ দিলেন যে ,সে গতকাল কোনো এক ব্যক্তির চিৎকার শুনেছেন ; তিনি হুসাইনের শোকে এই কবিতা পাঠ করছিলেন :
“
আয়্যুহাল্ ক্বাতিলূনা জাহলান্ হুসাইনা উব্শিরূ বিল্’
আযাবি ওয়াত্তানকীলি ;
কুল্লু আহলিস্ সামায়ি ইয়াদ্’
ঊ’
আলাইকুম্ মিন্ নাবিয়্যিন্ ওয়া মালায়িকিন্ ওয়া ক্বাবীলি ;
ক্বাদ্ লু’
ইন্তুম্’
আলা লিসানি ইবনি দাঊদা ওয়া মূসা ওয়া হামিলিল্ ইঞ্জীলি ।”
অর্থাৎ হে সেই লোকেরা , যারা হুসাইনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছো , শাস্তি ও শিক্ষণীয় কানমলা খাওয়ার অপেক্ষা কর। নবী , ফেরেশ্তা ও অন্যান্যরা সহ আসমানের সমস্ত অধিবাসী তোমাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করছেন। তোমরা হযরত সুলায়মান , মূসা ও ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত।
এই পংক্তিগুলি , কিছুটা মতভেদ সহ উম্মে সালমা এবং অন্যান্যদের নিকট থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা একজন অদৃশ্য লোকের মুখ থেকে সেই পংক্তিগুলি শুনেছেন কিন্তু তাঁকে স্বয়ং দেখেন নি। তিনি হুসাইনের মৃত্যুতে এই কবিতাটি পাঠ করছিলেন ।”