কুফায় মুহাম্মদের (সা.) বংশের বন্দিগণ
ইমাম হুসাইনের (আ.) বাহাত্তর জন সঙ্গী শহীদ হন এবং তাঁদের শাহাদতের একদিন পর , ইমাম ও তাঁর সাথিদের পবিত্র মৃতদেহগুলি , গাযেরিয়ার অধিবাসী বনী আসাদ গোত্রের লোকদের দ্বারা সমাহিত হয়।
যে দিন ইমাম (আ.) নিহত হন সেই দিনই তাঁর পবিত্র মাথাটিকে খাওলা ইবনে ইয়াযীদ এবং হামিদ ইবনে মুসলিম আযদীর সাথে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের জন্যে কুফাতে প্রেরণ করা হয়। খাওলা কুফাতে প্রবেশের পর‘
দারুল ইমারাত ’ প্রাসাদে (গভর্ণরের বাসভবন) রওনা করে কিন্তু দরজা বন্ধ দেখে সরাসরি তার নিজের বাড়ীতে যায় এবং পবিত্র মাথাটিকে তার বাড়ীতে একটি বড় পাত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখে।
অতি প্রত্যুষে খাওলা সেই মাথাটিকে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যায়। উমর ইবনে সা’
দ সেই দিন এবং পরের দিন বিলম্ব করে। অতঃপর হামিদ ইবনে বুকাইর আহমারীকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্যে ঘণ্টাধ্বনি বাজাতে আদেশ দেয়। কুফার সৈন্যরা কুফার উদ্দেশ্যে রওনা করে। এই যাত্রায় ইমাম হুসাইনের (আ.) কন্যাগণ , ভগ্নীগণ , তাঁর শিশুরা এবং অত্যন্ত অসুস্থ আলী ইবনিল হুসাইনকে (আ.) তাদের সাথে নিয়ে যায়।
ছৌল কুররাহ ইবনে কায়িস তামীমী ’ র উদ্ধৃতি দিয়ে তাবারী বলেন :“
যখন হুসাইন , তাঁর আত্মীয় স্বজন ও তাঁর সন্তান সন্ততির রক্তে ভেজা লাশগুলির পাশ দিয়ে হুসাইনের পরিবারের নারীদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমি স্বয়ং দেখেছি , তাঁরা বিলাপ ও আহাজারী করছিলেন এবং মাথা ও মুখমণ্ডলে চাপড়াচ্ছিলেন ।”
কায়িসের ছেলে বলেন :“
আমার স্মৃতি হতে যেসব বিষয় মুছে যাবে না , তার মধ্যে একটি হচ্ছে ফাতিমার কন্যা যয়নবের কথাগুলি ! তিনি তাঁর নিহত ভাই হুসাইনের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে বলছিলেন :
“ ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! সাল্লা ’ আলাইকা মালাইকাতুস্ সামায়ি , হাযা হুসাইনুন্ বিল্ আ’
রা য়ি !! মারমালুন্ বিদ্দিমা য়ি মাক্বত্বাউ ’ আল্ আ’
যা য়ি , ইয়া মুহাম্মাদাহ্ ! ওয়া বানাতুকা সাবায়া ওয়া যুররিয়্যাতুকা মুক্বাত্তালাতান্ তাসফী ’ আলাইহাস্ সাবা ।”
কুররাহ বলেন :“
আল্লাহর শপথ ! যয়নব তাঁর এই বক্তব্যগুলি দ্বারা তাঁর সমস্ত বন্ধু ও শত্রুকে কাঁদিয়ে ছিলেন ।”
তাবারী বলেন :অপর বাহাত্তর জন শহীদের বিচ্ছিন্ন মাথাগুলিকে শিমার ইবনে যিল জাওশান , কায়িস ইবনে আশ্আছ , আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং উযরাহ্ ইবনে কায়িসের মাধ্যমে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট প্রেরণ করা হয়।
ফুতূহে ইবনে আ’
ছিম , মাকতালে খাওয়ারেযমী এবং অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে :“
উমর ইবনে সা’
দের সৈন্যরা রাসূলের পরিবারকে (তাঁর সন্তান সন্ততি) কারবালা হতে বন্দী হিসেবে বেঁধে কুফার অভিমুখে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়। বন্দিদের কাফেলা যখন কুফায় উপস্থিত হয় তখন কুফার লোকেরা সে দৃশ্য দেখার জন্যে বেরিয়ে আসে এবং তাঁদের অবস্থা দেখে করুণাসিক্ত হয় ও প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা চিৎকার করে কান্না ও বিলাপ করে।
আলী ইবনিল হুসাইন কঠিন অসুস্থ ছিলেন এবং শক্ত জিঞ্জির ও শিকল দ্বারা বাঁধা ছিলেন আর অসুস্থতা তাঁকে এমন অবস্থায় উপনীত করেছিল যে , তাঁর জীবনের শেষ নিশ্বাস ব্যতীত অন্য কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তিনি কুফাবাসীদের এরূপ অস্থিরতা ও কান্না দেখে বলেন :“
এরা যে আমাদের বিপদে এরূপ ক্রন্দন ও আর্তনাদ করছে তাহলে আমাদের হত্যাকারী কারা ?!”
কুফার অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য
ইবনে আ’
ছাম তার ইতিহাস গ্রন্থে বশীর ইবনে হাযীম আসাদী ’ র উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : যয়নবকে (আলীর কন্যা) সেইদিন প্রথম দেখেছিলাম , তাঁর পূর্বে তাঁর মত বাগ্মী অন্য কোনো পর্দানশীন নারীকে দেখিনি। মনে হচ্ছিল , তিনি যেন আমীরুল মু’
মিনীন আলী ইবনে আবী তালিবের ভাষায় কথা বলছিলেন এবং ইমামের বাণীগুলিই যেন তাঁর মুখ থেকে উৎসারিত হচ্ছিল।
সূচনায় তিনি স্বয়ং লোকজনকে চুপ করতে আদেশ দেন। তাঁর ইশারার সাথে সাথে লোকজন নীরব হয়ে যায় এবং চতুষ্পদ জন্তুগুলির ঘণ্টাধ্বনিও থেমে যায়। অতঃপর তিনি বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন :
“ আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। অতঃপর আমার পিতা মুহাম্মদ , আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর পবিত্র ও মনোনীত বংশধরগণের উপর দরুদ প্রেরণ করছি। অতঃপর হে কুফার লোক সকল ! হে প্রতারক , ধোকাবাজ ও বিশ্বাসঘাতক জনতা ! তোমরা এখন ক্রন্দন করছ ?! তোমাদের চক্ষুগুলো কখনই যেন কান্না হতে বিরত না হয়! তোমাদের অশ্রুধারা যেন না শুকায় এবং তোমাদের বিলাপ ও আর্তনাদ যেন শান্ত না হয়! তোমরা ঠিক সেই নারীর ন্যায় , যে সুদৃঢ় করার পর নিজ হাতে তা বিচ্ছিন্ন করে! তোমরা ঠিক তাদের ন্যায় যারা নিজ শপথ ও প্রতিশ্রুতিগুলিকে প্রতারণা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উপাদানে পরিণত করেছে! লোকেরা তোমাদের নিকট হতে দম্ভোক্তি , আত্মপ্রশংসা , প্রতারণা ও শত্রুতা ব্যতীত আর কি আশা করতে পারে ? তোমরা ক্রীতদাসীদের ন্যায় তোষামোদ কর এবং শত্রুদের ন্যায় প্রতারণার দিকে ধাবিত হও। তোমরা কোনো নালার ধারে গজিয়ে উঠা আগাছা স্বরূপ , অথবা কোনো চুনামাটির অংশ যা দ্বারা কোনো কবরকে পূরণ করা হয়। তবে জেনে রেখ যে , স্বীয় ভবিষ্যতের জন্য কিরূপ মন্দ উপঢৌকন আল্লাহর সমীপে প্রেরণ করেছ আর তা হচ্ছে মহান আল্লাহর ক্রোধ ও চিরস্থায়ী পাকড়াও।
এখন ক্রন্দন ও শোক প্রকাশ করছো ?! হ্যাঁ ,আল্লাহর শপথ , বেশী কাঁদো ও অল্প হাঁসো ; কারণ নিজেদের জন্যে এমন লজ্জা ও অপমানকে প্রস্তুত করেছো যে , তা কোনো দিন মুছে যাবার নয়। আর কিভাবে নিজেদের সত্তাকে শেষ নবীর সন্তান হত্যার অপবিত্রতা হতে পবিত্র করবে ! কারণ তিনি ছিলেন বেহেশ্তি যুবকদের নেতা , পবিত্র লোকদের আশ্রয়দাতা ,তোমাদের বিপদের আশ্রয়স্থল , তোমাদের জন্য উজ্জ্বলতম দলীল ও সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং তোমাদের কণ্ঠের ভাষা ! মাথায় কি ধরনের অপরিপক্ক ধারণা লালন করছ ! তোমাদের উপর মৃত্যু ও ধ্বংস নেমে আসুক ! তোমাদের আকাঙ্খাগুলি নিরাশায় পরিণত হয়েছে এবং তোমাদের প্রচেষ্টাগুলি তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেনি! তোমাদের হাতগুলি মুণ্ডিত হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি শ্রুতিগুলি তোমাদের ক্ষতির কারণ হয়েছে। তোমরা আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের রোষানলে পতিত হয়েছো এবং তোমাদের উপর লজ্জা ও চরম দুরবস্থা ধার্য হয়েছে। হে কুফার জনতা ! তোমাদের ধ্বংস হোক !! তোমরা কি জান যে , আল্লাহর রাসূলের কোন কলিজাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছো , তাঁর কোন রক্ত ঝরিয়েছো , তাঁর কোন আবৃত সত্তার আবরণ অন্যায়ভাবে হরণ করেছো এবং কোন ধরনের মর্যাদার পর্দা উন্মোচন করেছো ?!
এমন এক আশ্চর্য ও বড় কর্মে (অপরাধে) লিপ্ত হয়েছো যে ,তার আতঙ্কে আসমানসমূহ ফেটে যাওয়ার উপক্রম , জমিন তার মুখ খুলে দেয়ার উপক্রম এবং পর্বতমালা বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম ! এমন এক কাজ করেছো যে , তা এতটা কঠিন ও বড় , বন্ধুর , জটিল ও মন্দ যে জমিন ও সমস্ত আসমানের বিশালতার অনুরূপ ! তোমরা কি হতবাক হবে যদি এই বিপদের কারণে আসমানসমূহ রক্ত বর্ষণ করে ? নিশ্চিত যে , তোমাদের আজাবের অপর স্থানটি হবে যথেষ্ট লজ্জাকর এবং কঠিনতর , আর তোমাদের আর্তনাদে কেউ সাড়া দিবে না !
অতএব , যে সুযোগ পেয়েছো তাতে এত অধিক আনন্দিত ও অসচেতন হয়ো না ! কারণ , এই বিষয়ে মহান আল্লাহর কোনো তাড়া নেই এবং প্রতিশোধ গ্রহণের সময়কাল বিলম্বিত হওয়াতে তিনি ভয় পান না। হ্যাঁ , কখনও এইরূপ নয় এবং তোমাদের আল্লাহ্ তোমাদের (শাস্তি দানের) জন্য ওঁৎ পেতে আছেন ।”
বশীর বলেন :“
আল্লাহর শপথ ! আমি সেইদিন লোকজনকে চরম দুর্দশাগ্রস্ত ও দিশাহারা এবং নেশাগ্রস্তদের ন্যায় উদ্দেশ্য ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় দেখেছি। তারা ক্রন্দন করছিল , গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিল , অনিচ্ছায় চিৎকার করছিল , অতীত ক্রিয়াকলাপের জন্য আক্ষেপ ও অনুতাপ করছিল এবং অনুতাপে আঙ্গুল কামড়াচ্ছিল। কুফার একজন বৃদ্ধ লোককে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এমন করুণভাবে কাঁদতে দেখলাম যে তার চোখের পানিতে তার দাড়িগুলি ভিজে গিয়েছিল এবং সে বলছিল :
“ আমার পিতা মাতা আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক ! আপনি সত্য বলেছেন। আপনাদের বৃদ্ধ ব্যক্তিগণ সর্বোত্তম বৃদ্ধ , আপনাদের যুবকগণ সর্বোত্তম যুবক , আপনাদের নারিগণ সর্বোত্তম নারী এবং আপনাদের বংশ সর্বোত্তম বংশ ; অপমান ও পরাজয় আপনাদের কখনও স্পর্শ করতে পারে না ।”
ফাতিমা সুগরার
বক্তব্য
মুছীরুল আহযান এবং লুহুফে এসেছে যে , ফাতিমা সুগরা (ইমাম হুসাইনের কন্যা)ও বক্তব্য রাখেন এবং বলেন : সমগ্র বালুকারাশি , কাঁকর এবং আসমান ও জমিনের ওজনের সমপরিমাণ আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি , তাঁর প্রতি গভীর বিশ্বাস রাখি এবং তাঁর উপর পূর্ণ আস্থা নিয়ে ঘোষণা করছি যে , আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও প্রেরিত পুরুষ। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , এই রাসূলেরই সন্তানকে ফোরাত নদীর ধারে , কোনো অন্যায় ও অপরাধ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে , অথচ তিনি কাউকে হত্যাও করেন নি কিংবা‘
কিসাস ’ হিসেবেও তাঁকে হত্যা করা হয় নি !
হে আল্লাহ্ ! তোমার প্রতি কোনরূপ মিথ্যা আরোপ করা হতে অথবা তোমার রাসূলকে যে আদেশ দিয়েছিলে তার বিপরীতে স্বরচিত কোনো কিছু বলা হতে তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে এই মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন যে , তিনি যেন স্বীয় প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি আলী ইবনে আবী তালিবের জন্যে জনগণের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন । তিনি সেই ওয়াসী যাঁকে আল্লাহর অন্যতম‘
মসজিদে ’ এবং মুসলমান নামধারীদের সামনে হত্যা করা হয়েছে । যেরূপভাবে গতকাল তাঁর সন্তানকে শহীদ করা হয়েছে। তাদের উপর ধ্বংস নেমে আসুক ! যারা তাঁর জীবিত থাকা অবধি তাঁর থেকে কোনো অন্যায়কে দূর করেনি এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হতে কোনো অত্যাচারকে প্রতিরোধ করে নি। যদ্দপি না তুমি (আল্লাহ) সে সুখ্যাতি , প্রশংসিত অভ্যাস , পরিচ্ছন্ন মেজাজ এবং উত্তম নীতিমালা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে নিজের পানে আহ্বান করলে। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তোমার পথে কোনো নিন্দুকের নিন্দাবাদের ব্যাপারে ভীত ছিলেন না। পৃথিবী হতে বিমুখ ছিলেন এবং তোমার পথে প্রচেষ্টাকারী ও মুজাহিদ ছিলেন। এটিই হেতু ছিল ,যার জন্যে তুমি তাঁকে তোমার সরলপথের প্রতি পথ প্রদর্শন করেছো।
অতঃপর , হে কুফার লোকেরা ! হে ধোকাবাজ , প্রতারক ও স্বেচ্ছাচারী লোকেরা ! আমরা এমন এক পরিবার যে , মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তোমাদের জন্যে এবং তোমাদেরকে আমাদের জন্যে পরীক্ষার উপকরণ বানালেন। আমরা এই পরীক্ষা হতে পবিত্র ও সম্মানের সাথে বেরিয়ে এসেছি , আমাদের পরীক্ষাকে তিনি উত্তমরূপে গ্রহণ করেছেন , তাঁর জ্ঞানকে আমাদের মাঝে তিনি আমানত হিসেবে দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের তা বুঝার ক্ষমতা দান করেছেন। এই কারণেই আমরা তাঁর জ্ঞানের ধনাগার। তিনি নিজ মহানুভবতায় আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে আমাদেরকে প্রকাশ্যভাবে সমস্ত সৃষ্টির উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।
কিন্তু তোমরা আমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে , আমাদেরকে হত্যা করা বৈধ মনে করলে এবং আমাদের ধন সম্পত্তিকে লুণ্ঠন করা বৈধ গণ্য করলে। ঠিক যেন আমরা বিধর্মী তুর্কীদের সন্তান এবং কাবুলের বন্দী। তোমরা আমাদের যে রক্ত ঝরিয়েছো এবং আমাদের ধন সম্পত্তি লুণ্ঠনে যে হাত প্রসারিত করেছো তার মাধ্যমে নিজেকে আনন্দ ও খুশির শুভ সংবাদ দিওনা । কারণ আল্লাহর আজাব তোমাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে , তার ক্রোধ অবতীর্ণ হয়েছে এবং অত্যাচারীদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত ও লানত !
হে কুফার অধিবাসীরা , তোমাদের মৃত্যু হোক ! আল্লাহর রাসূলের (সা.) নিকট তোমাদের কি পাওনা ছিল অথবা তাঁর নিকট কোন রক্তপণ কামনা করছ যে , নিজেদের ঘৃণা ও ঈর্ষাকে তাঁর ভাই আলী ইবনে আবী তালিব , আমার দাদা এবং তাঁর পরিবারের মাথার উপর উজাড় করলে এবং তোমাদের কবিরা তাদের বীরত্বগাঁথা এইভাবে গেয়েছে :
“ আমরা আলী ও তাঁর সন্তান সন্ততিকে নিজ ধারাল তলোয়ার এবং বর্শার ফলক দ্বারা হত্যা করেছি !!
তাঁদের নারীদেরকে বিধর্মী তুর্কী নারীদের ন্যায় বন্দী করেছি এবং কত সুন্দরভাবে তাঁদের সাথে যুদ্ধ করেছি ও মুখোমুখি হয়েছি !!”
হে মিথ্যা রচয়িতা , তোমার মুখে ছাই পড়ুক ! তুমি এমন ধরনের লোককে হত্যা করা বৈধ জ্ঞান করেছো যে , মহান আল্লাহ্ নিজ কিতাবে তাঁদেরকে পাক ও পবিত্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং যে কোনো রকমের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে তাঁদের থেকে দূর করেছেন ! অতএব , তোমার নিজের রাগে তুমি মর এবং তোমার পিতার ন্যায় তুমিও কুকুর সদৃশ মাটিতে তোমার ঠোঁট ঘর্ষণ কর ! কেননা , যেমন কর্ম তেমন ফল। যে সম্মান মহান আল্লাহ্ আমাদের জন্যে নির্ধারিত করেছেন , তার জন্যে তোমরা হিংসা করলে ! এইটি আল্লাহর করুণা যে , তিনি যাকে চাইবেন তাকে তা দান করবেন।“
ওয়া মান্ লাম্ ইয়াজ্ ’ আলিল্লাহু লাহু নূরান্ ফামা লাহু মিন্ নূর ”“
আর যাকে আল্লাহ্ নূর (জ্যোতি) দেন নি তার কোনো নূর রইবে না ।”
এই কথাগুলো শুনে লোকেরা তীব্রভাবে আর্তনাদ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং বলে :“
যথেষ্ট হয়েছে হে পবিত্র ব্যক্তিগণের কন্যা , আপনি আমাদের অন্তরসমূহে আগুন জ্বালিয়েছেন এবং আপনার বক্তব্য মাধ্যমে আমাদের পা হতে মাথা পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছেন ।”
তাদের এই কথাগুলি শুনে তিনিও নীরব হয়ে যান।
উম্মে কুলছুমের
বক্তব্য
বর্ণনাকারী বলেন : আমীরুল মু’
মিনীন আলীর (আ.) কন্যা উম্মে কুলছুম , যখন বক্তব্য রাখতে উঠেন তখন তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল এবং তীব্রভাবে ক্রন্দন করছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন :“
হে কুফার জনতা ! তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত থেকো , তোমরা কি করেছো ?! হুসাইনের সাথে খিয়ানত করেছো , তাঁকে নিঃসঙ্গভাবে ত্যাগ করেছো , তাঁকে হত্যা করেছো , যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করেছো এবং তাঁর পরিবারের নারীদেরকে বন্দিনী করেছো !! তোমাদের মুনাফার লয় হোক এবং তোমাদের মৃত্যু ঘটুক ! কিছু জান কি , নিজেদের মাথার উপর কি বিপদই না এনেছো এবং কত বড় অপরাধে জড়িয়েছো ? কি পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছো , কি মারাত্মক কাজে হাত দিয়েছো এবং কোন্ ধন সম্পত্তিকে লুণ্ঠন করেছো ? আল্লাহর রাসূলের (সা.) পর সর্বোত্তম ব্যক্তিকে হত্যা করেছো , এই অবস্থা সত্ত্বেও আল্লাহর দল বিজয়ী রয়েছে এবং শয়তানের দল পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। তারপর এই কবিতাটি পাঠ করেন :
“
ক্বাতালতুম্ আখী সাবরান্ ফাওয়াইলুন্ লিউম্মিকুম , সাতুজযাওনা নারান্ হাররুহা ইয়াতাওয়াক্কাদু ।
সাফাকতুম্ দামান্ হাররামাল্লাহু সাফাকাহা , ওয়া হাররামাহা আল্ কুরআনু ছুম্মা মুহাম্মাদু ।
আলা ফাব্শিরূ বিন্নারি ইন্নাকুম্ গাদা , লাফী সাক্বারিন্ হাক্কান্ ইয়াক্বীনান্ তুখাল্লাদূ ।
ওয়া ইন্নী লাআব্কী ফী হায়াতী’
আলা আখী ,‘
আলা খাইরিম্ মাম্ বা’
দিন্নাবিয়্যী সাইউলাদু ।
বিদাম্’
য়িন্ গাযীরিন্ মুস্তাহাল্লিন্ মুকাফ্কাফি ,‘
আলাল্ খাদ্দি মিন্নী যায়িবান্ লাইসা ইয়াজমুদু ।”
অর্থাৎ আমার নির্যাতিত ভাইকে কঠিনতম দুরবস্থায় হত্যা করেছো। তোমাদের উপর ধ্বংস নেমে আসুক , শীঘ্রই তোমরা অগ্নিদগ্ধ হবে এবং তা কঠিন দগ্ধকারী। এমন এক রক্ত ঝরিয়েছো যা , আল্লাহ্ নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং কুরআন ও মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং তাকে সম্মানিত জ্ঞান করেছেন। অতএব , অবগত থেকো এবং তোমাদের প্রতি দোযখের আগুনের সুসংবাদ , সে আগুন নিঃসন্দেহে আগামী দিন এবং সদাসর্বদার জন্যে জাহান্নামে তোমাদেরকে পাকড়াও করবে। আমিও জীবনব্যাপী আমার ভ্রাতার জন্যে ক্রন্দন করব ; এমন সর্বোত্তম ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন করব যিনি আল্লাহর রাসূলের (সা.) পর পৃথিবীতে এসেছিলেন। বিরতিহীন অশ্রু যা প্লাবনের ন্যায় আমার চক্ষুদ্বয় হতে আমার গণ্ডদেশে প্রবাহিত , তা কোনো দিনই শেষ হবে না !”
এ বক্তব্য শুনে লোকজন আর্তনাদ শুরু করে এবং শেকের বিলাপ ও কান্নার রোল ধ্বনিত হল ।”
ইবনে যিয়াদের সম্মুখে আল্লাহর মনোনীত বংশধর
তাবারী স্বীয় সূত্রে হামিদ ইবনে মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন :“
উমর ইবনে সা’
দ আমাকে কাছে ডাকে তার পরিবারের নিকট তার বিজয়ের সুসংবাদ ও সুস্থ থাকার খবর পৌঁছাতে আদেশ দেয়। আমি কুফায় প্রবেশ করি এবং নিজ দায়িত্ব পালন করি। অতঃপর অবস্থা দেখার জন্যে ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে গমন করি। কারণ , বন্দীগণকে সেইখানে নিয়ে যাবার কথা ছিল এবং সমস্ত লোকজন সেইখানে সমবেত হয়েছিল।
গভর্ণরের প্রাসাদে প্রবেশের পর যিয়াদের পুত্র ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তার সম্মুখে রেখে চিন্তায় নিমগ্ন এবং হাতের লাঠি দ্বারা তাঁর (আ.) ঠোঁট ও সম্মুখের দাঁতগুলিতে আঘাত করছে। কিছু সময় ধরে সে এই কাজটি অব্যাহত রাখল। যায়িদ ইবনে আরকাম সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং ঘটনাটি দেখছিলেন। তিনি তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন :
‘ তোমার হাতের লাঠিটি এই ঠোঁট ও দাঁতসমূহ থেকে সরিয়ে নাও , আল্লাহর কসম ! আমি একাধিকবার আল্লাহর রাসূলকে (সা.) এই ঠোঁট ও দাঁতগুলিতে চুম্বন করতে দেখেছি। ’
অতঃপর তাঁর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুর বন্যা প্রবাহিত হয় এবং তীব্রভাবে ও উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকে বলে :‘
মহান আল্লাহ্ তোমার চক্ষুগুলিকে যেন সবসময় কান্নারত রাখেন। আল্লাহর কসম ! তুমি যদি অচল , নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন বৃদ্ধ মানুষ না হতে তবে তোমার গর্দানকে উড়িয়ে দিতাম !’
ইবনে যিয়াদের এইরূপ বক্তব্য শুনে যায়িদ ইবনে আরকাম উঠে দাঁড়ান এবং সভা ত্যাগ করেন ।”
বর্ণনাকারী বলেন :“
যখন যায়িদ ইবনে আরকাম বের হলেন তখন লোকেরা বলল : আল্লাহর কসম ! যায়িদ বের হবার সময় এমন একটি কথা বলেছেন যে , যদি তা ইবনে যিয়াদের কানে পৌঁছত তবে নিঃসন্দেহে তাঁকে হত্যা করত ।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম:“
তাহলে যায়িদ এমন কি বলেছেন ?”
তারা বলল :“
যায়িদ ইবনে আরকাম যখন আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন বলছিলেন , এক দাস অপরের বান্দাকে দাসে পরিণত করেছে যেন মনে করেছে সমস্ত মানুষ তার দাস ! হে আরবের লোকেরা ! এরপর হতে তোমরা মূল্যহীন দাসের অধিক বিবেচিত হবে না! ফাতিমার সন্তানকে হত্যা করলে এবং মারজানার সন্তানকে নিজেদের উপর শাসক বানালে যেন সে তোমাদের নির্বাচিত ব্যক্তিগণকে হত্যা করে এবং তোমাদের বিনয়ী ব্যক্তিদেরকে নিজেদের দাসে পরিণত করে! তোমরা এইরূপ নীচতা ও লজ্জাকে মেনে নিয়েছো ; নীচ ও সম্মানের অযোগ্য ব্যক্তিদের উপর মৃত্যু নেমে আসুক !”
বর্ণনাকারী বলেন :“
যখন ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তাঁর সন্তান , ভগ্নী ও অন্যান্য নারিগণের সাথে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের নিকট নিয়ে যাওয়া হল তখন ফাতিমার (আ.) কন্যা যয়নব তাঁর সর্বাধিক মূল্যহীন জামাটি পরিধান করলেন যাতে তাঁকে চিনা না যায় , আর তাঁর দাসীগণ তাঁকে বেষ্টন করল। তিনি রাজ প্রাসাদে প্রবেশের পর একটি কোণায় বসলেন। উবাইদুল্লাহ্ তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করল:‘
তুমি এমন কে যে , আমার আদেশ ছাড়াই বসে গেলে ?’
যয়নব কোনোরূপ উত্তর দিলেন না। উবাইদুল্লাহ্ তিনবার তার প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করলে তাঁর জনৈকা দাসী বললেন :“
ইনি ফাতিমার কন্যা যয়নব !”
উবাইদুল্লাহ্ এই উত্তর শুনে তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল :‘
সেই আল্লাহর প্রশংসা , যিনি তোমাদেরকে অপমানিত করেছেন , তোমাদেরকে ধ্বংস করেছেন এবং তোমাদের দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন ।”
যয়নব (আ.) বললেন :“
কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর , যিনি আমাদেরকে তাঁর রাসূল হযরত মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। যে কোনো প্রকারের অপবিত্রতা হতে সর্বোত্তম অবয়বে পাক ও পবিত্র করেছেন এবং তুমি যা বললে সেই রূপ নয়। বরং পাপাচারীরাই অপমানিত হবে এবং চরিত্রহীন ও অন্যায়কারীরাই মিথ্যা বলে ।”
উবাইদুল্লাহ্ বলল:‘
তোমার পরিবারের সাথে আল্লাহর ক্রিয়াকলাপকে কিরূপ দেখলে ?’
তিনি বললেন:“
মহান আল্লাহ্ শাহাদতকে তাঁদের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন এবং তাঁরাও গর্বিতভাবে নিজ আত্মোৎসর্গের ভূমিতে পা রেখেছেন। খুব শীঘ্রই মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে একে অপরের সামনে দণ্ডায়মান করবেন , যেন তাঁর নিকটে ন্যায়বিচার প্রার্থনা এবং দলীল প্রমাণ উপস্থাপন কর ।”
বর্ণনাকারী বলেন : এতে উবাইদুল্লাহ্ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করতে শুরু করলে আমর ইবনে হারিছ তাকে বলল :‘
মহান আল্লাহ্ আমীরকে দীর্ঘজীবি করুন ! তিনি হলেন নারী , নারিদের কথার প্রতি পুরুষদের কোনোরূপ গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়। তাঁদেরকে বক্তব্যের মাঝে নিন্দা ও তিরস্কার করাও ঠিক নয়। ’ ইবনে যিয়াদ যয়নবের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল‘
মহান আল্লাহ্ , আমার ভিতরের অস্বস্তি ও অন্তরদাহকে তোমার পরিবারের একগুঁয়ে মহান ব্যক্তিগণের হত্যার দ্বারা শান্তি ও পরিত্রাণ দিয়েছেন !”
যয়নব তার কথায় প্রচণ্ড ক্রন্দন করতে করতে বললেন :“
হ্যাঁ , আমার প্রাণের কসম , আমার নেতাকে হত্যা করেছো , আমার পরিবারের মূলোৎপাটন করেছ , আমার জীবনের ডালপালাগুলিকে কেটে দিয়েছো এবং আমার শিকড়কে উপড়িয়ে ফেলেছো। যা করেছো , তা যদি তোমার প্রশান্তির কারণ হয় তবে নিঃসন্দেহে সেই প্রশান্তিকে স্মৃতিতে ধরে রেখ !”
ইবনে যিয়াদ যয়নবকে ইশারা করে বলল‘
ছন্দ ও ঝঙ্কারপূর্ণ কথা বলছ ।”
অতঃপর , তাঁকে সম্বোধন করে , এরূপ বলে :“
আমার নিজ জীবনের শপথ ! তোমার পিতাও কবি ছিলেন এবং ছান্দিকরূপে কথাবার্তা বলতেন ।”
যয়নব উত্তর দিলেন :“
ছন্দ ও ঝঙ্কারের সাথে নারিদের কি সম্পর্ক ? আমি এইরূপ অবস্থায় ঝঙ্কার ও অন্তঃমিল দিয়ে কথা বলছি না বরং যা কিছু বললাম তা আমার বুকের ভিতরের জ্বালা ছিল ।”
হামিদ ইবনে মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে তাবারী বলেন :“
আমি ইবনে যিয়াদের নিকট দাঁড়িয়ে ছিলাম , এমন সময়ে আলী ইবনে হুসাইনকে (আ.) তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যিয়াদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করল :‘
তোমার নাম কি ?’
ইমাম সাজ্জাদ বললেন :‘
আমি হুসাইনের পুত্র আলী। ’ ইবনে যিয়াদ বলল :‘
তাহলে কি হুসাইনের পুত্র আলীকে মহান আল্লাহ্ হত্যা করেন নি ?!’
ইমাম নীরব থাকলেন। ইবনে যিয়াদ পুনরায় বলল :‘
কেন কথা বলছ না ?’
ইমাম বললেন :‘
আমার একজন ভাই ছিলেন , তাঁরও নাম ছিল আলী এবং লোকেরা তাঁকে হত্যা করেছে ।”
ইবনে যিয়াদ বলল :‘
মহান আল্লাহ্ তাকে হত্যা করেছেন !’
ইমাম নীরব রইলেন। ইবনে যিয়াদ পুনরায় জিজ্ঞাসা করল :‘
কেন কথা বলছ না ?’
তিনি উত্তর দিলেন :‘
মহান আল্লাহ্ , মৃত্যুর সময় আত্মাগুলিকে গ্রহণ করেন এবং মহান আল্লাহর আদেশ ব্যতীত কেউই মারা যান না। ’ ইবনে যিয়াদ এই উত্তর শুনে রেগে চিৎকার করে বলে :‘
মহান আল্লাহর শপথ ! তুমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত। ’ অতঃপর চিৎকার করে বলে : তাকে নিয়ে গিয়ে গর্দান উড়িয়ে দাও !’
ইমাম জিজ্ঞেস করলেন :‘
তখন এই নারিগণের দেখাশুনা কে করবে ?’
ইবনে যিয়াদের এই কথা শুনে যয়নব (আ) তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আলী ইবনে হুসাইনের সম্মুখে দাঁড়ান এবং বলেন :“
হে যিয়াদের পুত্র ! আমাদের জীবনের উপর হতে হাত উঠিয়ে নাও , আমাদের যতটা রক্ত ঝরিয়েছো তাই যথেষ্ট ; তুমি কি আমাদের কাউকে অবশিষ্ট রেখেছো ?”
তারপর তিনি তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রের কাঁধে হাত রাখেন এবং বলেন :“
যদি তোমার ঈমান থাকে তাহলে তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি যে , তুমি যদি তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হও তবে তাঁর সাথে আমাকেও হত্যা কর !”
হুসাইনের (আ.) পুত্র আলীও চিৎকার করে বলেন :“
হে যিয়াদের পুত্র ! এদের সাথে যদি তোমার আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে তবে একজন চরিত্রবান পুরুষকে এদের সাথি কর , যিনি ইসলামের আইন অনুসারে এদের সঙ্গী হবেন ।”
বর্ণনাকারী বলেন :“
যিয়াদের পুত্র কিছু সময় ধরে হযরত যয়নবকে কথার মাধ্যমে ক্ষত বিক্ষত করে , অতঃপর জনগণের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে বলে :‘
রক্তের টান দেখে আমি আশ্চর্য বোধ করছি ! আল্লাহর কসম ! আমার ধারণা হচ্ছে যে , যদি তাঁকে হত্যার পদক্ষেপ নেই তবে তিনি কামনা করবেন যে , তাঁকেও যেন তাঁর সাথে হত্যা করি। ’ অতঃপর , সে বলল :‘
এই যুবকের উপর হতে হাত গুটিয়ে নাও !’
তারপর আলী ইবনে হুসাইনকে সম্বোধন করে সে বলে :‘
তুমি এই নারিদের সাথে থাকো !”
হামিদ ইবনে মুসলিম বলেন : উবাইদুল্লাহ্ যখন প্রাসাদে প্রবেশ করে এবং লোকজনও সেইখানে সমবেত হয় তখন জামাআতের সাথে নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে হাজির হতে আদেশ দেয়। লোকেরা কুফার বড় মসজিদে সমবেত হয় এবং সেই নিজে মিম্বরের উপর দণ্ডায়মান হয়ে বলে :
‘ সেই আল্লাহর প্রশংসা , যিনি সত্য ও সত্যপন্থীদেরকে জয়ী করেছেন ; আমীরুল মু’
মিনীন ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়াকে এবং তার দলকে বিজয়ী করেছেন আর মিথ্যুক হুসাইন ইবনে আলী ও তাঁর দলকে হত্যা করেছেন। ’
ইবনে যিয়াদ তখনও তার বক্তব্য শেষ করে নি ,‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আফীফ আযদী গামেদী ’ নামক বনী ওয়ালীবা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি এবং হযরত আলীর (কাররামুল্লাহ্ ওয়াজহাহু) জনৈক অনুসারী ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ান। তিনি জঙ্গে জামালে তাঁর একটি চক্ষু হারিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় চক্ষুটি জঙ্গে সিফ্ফীনে হারিয়েছিলেন। তাঁর মাথায় একটি আঘাত এবং তাঁর ভ্রুর উপর অপর একটি আঘাত লাগার কারণেই তিনি তাঁর চক্ষুদ্বয় হারিয়েছিলেন । আব্দুল্লাহ্ সর্বদা কুফার বড় মসজিদটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং রাত্রিতে সেই স্থান ত্যাগ করতেন। ইবনে যিয়াদের বক্তব্য শুনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আফীফ হুঙ্কার ছেড়ে বলেন : হে মারজানার পুত্র ! তুমি মিথ্যুক , তোমার বাবা মিথ্যুক আর যে তোমাকে জনগণের উপর শাসক বানিয়েছে সেও মিথ্যুক এবং তার বাবাও !
হে মারজানার পুত্র ! রাসূলের সন্তানকে হত্যা করেছো আর পবিত্র ব্যক্তিগণের অনুসরণের কথা বলছো ?! ইবনে যিয়াদ তাঁর এইরূপ বক্তব্য শুনা মাত্রই হুঙ্কার দিয়ে উঠে :
‘ তাকে ধরো !’
তার দরবারের প্রহরারত সৈন্য এবং জল্লাদরা তাঁকে আটক করে। আব্দুল্লাহ্ আযদী গোত্রের লোকদের সম্বোধন করে চিৎকার করে বলেন :“
হে সৎকর্মশীল !”
‘
আব্দুর রাহমান ইবনে মাখনাফ আযদী ’ সেইখানে বসে ছিল ; সে তড়িৎ আব্দুল্লাহ্ ইবনে আফীফকে সম্বোধন করে বলল :“
তোমার আত্মীয় স্বজনদের জন্য দুর্ভাগ্য! অন্যদের নিকট সাহায্য কামনা করছো ?! তুমি তোমার এই বক্তব্য দ্বারা নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছো এবং তোমার সমস্ত পরিবারকেও মৃত্যুর মুখে ফেলেছো !”
বর্ণনাকারী বলেন :“
সেই সময়ে আযদ গোত্রের সাতশত জন যোদ্ধা কুফায় উপস্থিত ছিলেন।‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আফীফের সাহায্যের আহ্বান শুনে সেই গোত্রের একদল যুবক উঠে দাঁড়ায় এবং আব্দুল্লাহকে ইবনে যিয়াদের জল্লাদদের থাবা হতে ছিনিয়ে আনে এবং তাঁকে কড়া পাহারা দিয়ে তাঁর বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয় এবং তাঁর আত্মীয় স্বজনদের হাতে অর্পণ করে। কিন্তু রাত্রিতে সুযোগ বুঝে ইবনে যিয়াদ কতিপয় লোককে প্রেরণ করে ও তাঁকে আটক করে হত্যার আদেশ দেয়। অতঃপর তাঁর মৃতদেহটিকে কুফার‘
সাবখা ’ এলাকায় ঝুলিয়ে রাখতে আদেশ প্রদান করে ।”