সিরিয়ায় আলে মুহাম্মদের (সা.) বন্দিগণ
আল্লাহর রাসূলের (সা.) বংশধরগণকে দামেশক শহরে নিয়ে যাওয়া হল এবং তাঁদেরকে অমুসলিম বন্দিদের রাখার স্থানে , মসজিদের প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে রাখা হল। এই অবস্থায় একজন বৃদ্ধলোক সামনে আসে এবং তাঁদের সন্নিকটে এসে বলে:‘
সেই সত্য আল্লাহর প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে হত্যা করেছেন , তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করেছেন এবং জনগণকে তোমাদের কর্তৃত্ব ও যন্ত্রণা হতে নিরাপত্তা দান করেছেন আর আমীরুল মু’
মিনীনকে তোমাদের উপর আধিপত্য দান করেছেন !’
ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) তাকে বলেন :“
হে বৃদ্ধ ! আপনি কি কুরআন পড়েছেন ?”
॥ সে বলে :“
হ্যাঁ , পড়েছি ।”
তিনি বলেন :“
এই আয়াতটি নিশ্চয় জানেন যে , মহান আল্লাহ্ বলেছেন : বল , আমি এই রিসালতের জন্যে , আমার অতি নিকট আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ও বন্ধুত্ব ব্যতীত তোমাদের নিকট অন্য কোনো বিনিময় কামনা করি না ।”
বৃদ্ধ লোকটি বলে :‘
হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি। ’ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন :“
এই আয়াতে নিকট আত্মীয়ের অর্থ আমরাই !”
অতঃপর তিনি বলেন :“
সূরা বনী ইস্রাঈলের এই আয়াতটি কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : নিকট আত্মীয়দের হক প্রদান কর ।”
বৃদ্ধলোকটি বলে :“
হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।”
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন :“
আমরাই হচ্ছি নিকট আত্মীয় , হে বৃদ্ধ ! এই আয়াতটিও কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : সাবধান থেক এবং জেনে রেখ , যা কিছু তোমাদের হস্তগত হয় তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ , আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর নিকট আত্মীয়দের জন্যে ।”
)
বৃদ্ধলোকটি বলে :“
হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।”
ইমাম সাজ্জাদ বলেন :“
হে বৃদ্ধ , নিকট আত্মীয় হচ্ছি আমরাই। এই আয়াতটিও নিশ্চয় পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : হে আহলে বাইত! নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান ।”
বৃদ্ধলোকটি বলে :‘
হ্যাঁ , এটিও তো পড়েছি। ’ ইমাম (আ.) বলেন :‘
আমরাই সেই আহলে বাইত। পবিত্র আল্লাহ আমাদেরকে আয়াতে তাত্বহীরের মাধ্যমে বিশেষত্ব দান করেছেন। ’
বর্ণনাকারী বলেন :“
বৃদ্ধলোকটি কিছু সময় নীরব , বিস্মিত ও অনুতপ্ত হয়ে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর , আসমানের দিকে মাথা উঁচু করে বলেন : হে আল্লাহ্ ! আমি যে কথাগুলি বলেছি এবং এই ব্যক্তিবর্গের সাথে শত্রুতামূলক যে আচরণ করেছি তার জন্যে তওবা করছি ও তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও আলে মুহাম্মদের (সা.) প্রতি শত্রুতা পোষণকারীরা , জ্বিন ইনসান যে কেউই হোক , আমি তাদের থেকে বিমুখতা প্রকাশ করছি এবং তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি ।”
ইয়াযীদের দরবারে আহলে বাইতের (আ.) প্রবেশ
ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া খিলাফত মসনদে বসার পর সিরিয়ার সম্মানিত লোকদেরকে ডাকে এবং তাদেরকে তার পাশে স্থান দেয়। অতঃপর , আলী ইবনে হুসাইন (আ.) , ইমাম হুসাইনের (আ.) বংশের নারীগণ ও শিশুদেরকে তার নিকটে আনতে আদেশ দেয় , এই অবস্থায় আল্লাহর রাসূলের (সা.) কচি শিশুদেরকে রশি দিয়ে একে অপরের সাথে বেঁধে রেখেছিল এবং লোকেরা সে দৃশ্য দেখছিল ।”
ইমাম হুসাইনের পবিত্র মস্তকটি যখন আহলে বাইতের (আ.) সদস্যগণ এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের মাথার সাথে ইয়াযীদের সামনে রাখা হয় তখন ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আ.) ইয়াযীদকে বলেন:“
তুমি কি আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবে ?”
ইয়াযীদ বলে:“
বল , তবে বাজে কথা বলবে না !”
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন :“
আমি এমন এক স্থানে দণ্ডায়মান হয়েছি যে , প্রলাপ বকা এবং অর্থহীন কথাবার্তা বলা আমার মত লোকের জন্যে শোভা পায় না। হে ইয়াযীদ ! আল্লাহর রাসূলের (সা.) সম্পর্কে কি উপলব্ধি করছ , যদি তিনি আমাদেরকে জিঞ্জির ও শিকলে বাঁধা এ অবস্থায় দেখেন ?”
ইয়াযীদ তার চতুষ্পার্শ্বস্থ লোকদেরকে বলে :“
তার হতে শিকলগুলি খুলে নাও !”
ইয়াযীদের প্রতি ইহুদী এক পণ্ডিতের অভিযোগ
উক্ত সভায় একজন ইহুদী পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন , তিনি জিজ্ঞেস করেন :‘
হে আমীরুল মু’
মিনীন! এই যুবকটি কে ?’
ইয়াযীদ বলে :‘
এই মাথার অধিকারী ব্যক্তিটি হল তার পিতা !’
ইহুদী বলেন :‘
হে আমীরুল মু’
মিনীন ! এটি কার মাথা ?’
ইয়াযীদ বলে :‘
আবু তালিবের পুত্র আলী , তার পুত্র হুসাইন , এটি তারই মাথা। ’ ইহুদী বলেন :‘
তাঁর মাতা কে ?’
ইয়াযীদ বলে :‘
রাসূলের কন্যা ফাতিমা। ’ ইহুদী পণ্ডিত বিস্ময়ের সাথে বলেন:‘
সুবহানাল্লাহ! ইনি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান ! তাঁর ইন্তেকালের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই (এত দ্রুত) তোমরা তাঁকে হত্যা করলে ?! তাঁর সন্তানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে স্বীয় রাসূলের জন্যে তোমরা কত মন্দ স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি! আল্লাহর কসম ! মূসা ইবনে ইমরান যদি তাঁর বংশের কোনো ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে রেখে যেতেন তবে আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত তাঁরই উপাসনা করতাম ! তোমরা এমন লোক যে , এই গতকাল তোমাদের রাসূল তোমাদের মাঝ হতে বিদায় নিয়েছেন , আর তোমরা তাঁর সন্তানের উপর চেপে বসলে এবং তাঁকে হত্যা করলে ! ধিক তোমাদের উপর ! তোমরা কতই না নিকৃষ্ট!”
ইয়াযীদ আদেশ দিল:‘
তার কণ্ঠ রুদ্ধ কর !’
ইহুদী পণ্ডিত বললেন :‘
আমার ব্যাপারে যা মনে কর তাই কর ; আমাকে মার কিংবা হত্যা কর অথবা জীবিত রাখ। আমি তওরাতে এইরূপ দেখেছি যে , যদি কোনো ব্যক্তি কোনো রাসূলের সন্তানকে হত্যা করে তবে সে যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন পরাজিত হবে এবং তার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন !’
সিরিয়ার জনৈক পুরুষ এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশের এক নারীকে দাসী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ
সে সভায় সিরিয়ার অধিবাসীদের মাঝ হতে জনৈক পুরুষ উঠে দাঁড়ায় এবং বলে :‘
হে আমীরুল মু’
মিনীন ! এই মেয়েটিকে (হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমাকে উদ্দেশ্য করে) আমাকে প্রদান করুন , তাকে আমার দাসী হিসেবে গ্রহণ করব। ’ ফাতিমা বলেন :“
আমি কেঁপে উঠি , কাঁদতে শুরু করি এবং ধারণা করি যে , এই কাজটি তাদের জন্যে আইনসিদ্ধ। আমার ফুফু যয়নবের বুকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি , তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন , আর তিনি জানতেন যে , এই কাজটি হওয়ার যোগ্য নয় ।”
যয়নব (আ.) সেই পুরুষটির উত্তরে বলেন :“
আল্লাহর কসম ! তুমি মিথ্যা বলেছো এবং নীচুতার পরিচয় দিয়েছো , এইরূপ বিষয় না তোমার জন্যে ন্যায়সঙ্গত হবে , আর না তার জন্যে ।”
ইয়াযীদ ক্রোধান্বিত হয়ে বলে:‘
আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলছ , এই কাজটি আমার জন্যে আইনসিদ্ধ , আমি যদি সেটি বাস্তবায়ন করতে চাই তবে বাস্তবায়ন করব !’
যয়নব (আ.) বলেন :“
আল্লাহর কসম ! এইরূপ নয় ! মহান আল্লাহ্ এইটিকে তোমার জন্যে আইনসিদ্ধ করেন নি , তবে যদি আমাদের ধর্ম হতে বেরিয়ে যেতে চাও এবং নিজের জন্যে অন্য ধর্মকে বেছে নাও !”
ইয়াযীদের ক্রোধ বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ছাড়িয়ে গিয়েছিল , সে বলল:‘
আমার মত লোকের সাথে এইরূপ বিতর্ক করছ ?’
যারা ধর্ম হতে বেরিয়ে গেছে তারা হল তোমার বাবা ও ভাই !’
যয়নব (আ.) বলেন :“
তুমি , তোমার পিতা এবং তোমার দাদা আল্লাহর দিকে আমার পিতা , ভ্রাতা ও নানার দ্বীনের মাধ্যমে সুপথ প্রাপ্ত হয়েছো ।”
ইয়াযীদ বলে:‘
হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বলছ !’
যয়নব(আ.) বলেন:“
তুমি এখন অধিনায়ক , আধিপত্যশীল এবং পরাভূতকারী তাই অন্যায়ভাবে গালি দিচ্ছ এবং নিজ কর্তৃত্বের শক্তি দেখাচ্ছ ।”
ইমাম হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমা বলেন :“
আল্লাহর শপথ ! মনে হল ইয়াযীদ লজ্জিত হল এবং নীরব হয়ে গেল ।”
সিরিয়ার লোকটি পুনরায় নিজ প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি করে বলে :‘
হে আমীরুল মু’
মিনীন ! এই মেয়েটিকে আমাকে প্রদান করুন ! ইয়াযীদ যেহেতু সুদৃঢ় ও দাঁতভাঙ্গা প্রতি উত্তর পেয়েছিল তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে অতি কর্কশভাবে তাকে বলল :‘
ধ্বংস হও ! আল্লাহ্ তোমাকে অকস্মাৎ এবং দ্রুত মৃত্যু দান করুন !’
মুসলমানদের খলীফার সামনে রাসূল(সা.) এর সন্তানের মাথা
ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটি স্বর্ণের একটি বড় পাত্রে করে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের সামনে রাখা হল। সে একখানা বেতের লাঠি চাইল এবং সেটি দ্বারা সে ইমাম হুসাইনের (আ.) দাঁতগুলির উপর আঘাত করতে লাগল এবং বলল :‘
আবু আব্দিল্লাহর কি চমৎকার দাঁত ছিল !’
এই সময়ে আবু বারযা আসলামী
নামক রাসূলের জনৈক সাহাবী ইয়াযীদকে বলেন :“
তোমার লাঠি দ্বারা কি ইমাম হুসাইনের (আ.) ঠোঁট ও দাঁতে মারছো ?! সাবধান থেক ! তোমার লাঠি দ্বারা হুসাইনের ঠোঁট দু’
টির যে স্থানে আঘাত করছ , আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি অসংখ্যবার সে স্থানে চুমু দিতে এবং চোষণ করতে দেখেছি। ইয়াযীদ ! তুমি কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় উত্থিত হবে যে , তোমার শাফাআতকারী হবে ইবনে যিয়াদ ! আর এই হুসাইন (আ.) কিয়ামত দিবসে আসবেন এবং তাঁর শাফাআতকারী হবেন মুহাম্মদ (সা.) !”
অতঃপর তিনি তাঁর স্থান হতে উঠে দাঁড়ান এবং বেরিয়ে যান।
ইয়াযীদ নিজ কুফরীকে প্রকাশ করছে
ইয়াযীদ , বিজয় ও অহংকারের নেশায় অন্ধ হয়ে ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলির মাধ্যমে উদাহরণ দেয় এবং এইরূপ আবৃত্তি করে :
১। হায় ! বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার বংশের মহান ব্যক্তিরা যদি উপস্থিত থাকত এবং দেখত যে , আমি কি করেছি ,
২। তাহলে মারহাবা বলত , উৎফুল্ল হত এবং বলত :‘
ইয়াযীদ তোমাকে ধন্যবাদ। ’
৩। আমরা এই কওমের মহান ও সর্দার ব্যক্তিগণকে হত্যা করেছি , বদরের দিনের উচিৎ জবাব দিয়েছি (প্রতিশোধ নিয়েছি) এবং সমান সমান হয়েছি। ’
অতঃপর সে এই পংক্তিটি নিজ থেকে যুক্ত করে এবং আবৃত্তি করে :‘
যদি আমি মুহাম্মদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের কৃত কাজের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি উৎবা ’ র বংশ নই !’
‘ তাযকিরায়ে খাওয়াসসিল উম্মা ’ গ্রন্থে এসেছে : সকল বর্ণনাতেই এ বিষয়টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে , ইয়াযীদ যখন হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তার সম্মুখে দেখে তখন সিরিয়ার অধিবাসীদেরকে একত্রিত করে এবং তাদের উপস্থিতিতে তার হাতের লাঠি দ্বারা মাথাটিকে আঘাত করে ও ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলি আবৃত্তি করে , আর নিম্নোক্ত পংক্তি দু’
টি সেইগুলির সাথে যোগ করে :
‘ বনী হাশিম গোত্র রাজত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে খেলা করেছে , না আসমান হতে কোনো সংবাদ এসেছে আর না কোনো ওহী অবতীর্ণ হয়েছে !
যদি আহমদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের যাবতীয় কৃতকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি খিন্দিফ গোত্রের লোক নই !’