ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা16%

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 16 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 28381 / ডাউনলোড: 3930
সাইজ সাইজ সাইজ
ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

ধর্মের পুনর্জাগরণে ইমামগণের ভূমিকা

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

ইমাম হুসাইনের শাহাদতের পর সাহাবা ও তাবেঈনের বিদ্রোহ

মদীনার লোকদের বিদ্রোহ ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার হাতে শপথ

ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের পর , মদীনার লোকেরা আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার ’ পাশে জমা হন এবং তাঁর হাতে শপথ করেন । এমনই শপথ যাতে তারা মৃত্যু বরণ করতে ও নিহত হতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হন ! আব্দুল্লাহ্ তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং বলেন : হে লোক সকল ! আল্লাহকে ভয় কর ! খোদার কসম ! আমরা ইয়াযীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র এই আশঙ্কায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি যে , হয়ত বিদ্রোহ না করলে আসমান হতে আমাদের উপর পাথর বর্ষণ করা হবে ! ইয়াযীদ এমনই এক ব্যক্তি , যে তার পিতার শয্যা সঙ্গিনী , তার কন্যা ও বোনদের সাথে বিবাহ করছে , মদ পান করছে এবং নামায পরিহার করছে। ’১৩৬

ইবনে যুবাইরও মক্কায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন , ইয়াযীদকে খিলাফতচ্যুত করেন এবং মদীনার বেশীর ভাগ লোকই তাঁর অনুসরণ করেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুতী ’ ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালা এবং মদীনার লোকেরা মসজিদে তাঁর নিকট একত্রিত হন।

সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর বলেন : আমি আমার পাগড়িটিকে যেইভাবে মাথা হতে সরিয়ে নিচ্ছি ঠিক সেইভাবে খিলাফত হতে ইয়াযীদকে অপসারণ করছি। ’ অতঃপর তিনি তাঁর পাগড়িটিকে মাথা হতে তুলে বলেন : আমি এমন এক সময় এই কথাগুলি বলছি যখন ইয়াযীদ আমাকে মূল্যবান কিছু উপহার দিয়েছে , তবে সে আল্লাহর শত্রুএবং সদা সর্বদা মদ পান করে নেশাগ্রস্ত থাকে। ’

অপর একজন বলেন : আমি আমার পা হতে জুতা খোলার মত করে ইয়াযীদকে খিলাফতচ্যুত করছি। ’ অন্য আরেকজন বলেন : শরীর হতে শার্ট খোলার ন্যায় আমি তাকে খিলাফতচ্যুত করছি। ’ অন্য একজন বলেন : আমি আমার পা হতে জুতা জোড়া খোলার ন্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। ’ বিভিন্ন লোকজনের পাগড়ি , জুতা এবং নাগরায় স্তুপ আকার ধারণ করে ! সকলে তার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং তাকে পদচ্যুত করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।

বনী উমাইয়্যাদেরকে বিতাড়িত করার জন্যে মদীনার লোকেরা সমাবেশ করেন এবং তাদের নিকট এই মর্মে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে , তারা মদীনার অধিবাসীদের বিপক্ষে খলীফার সৈন্যদেরকে সহযোগিতা করবেন না এবং ইয়াযীদের সৈন্যদেরকে মদীনায় প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করবেন। আর যদি সৈন্যদেরকে প্রতিহত করতে না পারেন তবে তারা নিজেরা সৈন্যদের সাথে মদীনায় ফিরে যাওয়া হতে বিরত থাকবেন।

বনী উমাইয়্যাদের নারী ও শিশুদেরকে ইমাম সাজ্জাদ আশ্রয় দিলেন

এই সময়ে , উমাইয়্যা বংশের মারওয়ান আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরের ’ নিকট গমন পূর্বক বলে : হে আবু আব্দির রাহমান ! তুমি তো দেখতে পাচ্ছ যে , এই লোকেরা আমাদের কর্তৃত্ব গুটিয়ে নিতে বাধ্য করেছে এবং আমাদেরকে বিতাড়িত করেছে। তুমি আমাদের নারী ও শিশুদেরকে আশ্রয় দাও। ’

আব্দুল্লাহ্ বলেন : তোমাদের ও তাদের কোন পক্ষের সাথেই আমাদের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই । মারওয়ান উঠে দাঁড়ায় এবং বলে : এই চরিত্র ও আচরণকে আল্লাহ্ অপছন্দ করুন ! অতঃপর সে , হুসাইনের পুত্র আলীর (আ.) নিকট আসে এবং তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে ইমামের (আ.) নিকট আবেদন করে। ইমাম (আ.) তাই করেন এবং উম্মে আবান নামে উছমানের কন্যা ও মারওয়ানের স্ত্রী , আব্দুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ নামক তার দুই পুত্রসহ তাদেরকে আশ্রয় প্রদান করেন।১৩৭

তাবারী ও ইবনে আছীর লিখেছেন : মদীনার লোকেরা যখন ইয়াযীদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বনী উমাইয়্যাদেরকে বিতাড়িত করেন তখন মারওয়ান ইবনে হাকাম আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরের ’ সঙ্গে এই মর্মে আবেদন করে যে , তিনি যেন তার পরিবারকে তাঁর নিজের নিকট আশ্রয় দেন ; কিন্তু তিনি তার আবেদনটি মঞ্জুর করলেন না। মারওয়ান হুসাইনের পুত্র আলীর ’ সঙ্গে আলাপ করে এবং বলে : হে আবুল হাসান ! আমি আপনার আত্মীয় এবং আত্মীয়তার অধিকার রাখি , আমার পরিবারটি আপনার পরিবারের পাশে থাকুক ? ইমাম (আ.) বলেন : ঠিক আছে , এতে কোনো বাধা নেই। ’ মারওয়ান নিজ পরিবারকে ইমামের (আ.) সমীপে প্রেরণ করে। ইমাম (আ.) নিজ পরিবার ও মারওয়ানের পরিবারকে মদীনার বাইরে ইয়াম্বু ’ নামক স্থানে নিয়ে যান এবং সেইখানে তাঁরা বসবাস শুরু করেন । ১৩৮

ইয়াযীদের নিকট বনী উমাইয়্যাদের সাহায্য প্রার্থনা ও মদীনায় সৈন্য সমাবেশ

বনী উমাইয়্যারা এইরূপ অবস্থা দেখে ইয়াযীদের নিকট পত্র লিখে এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উক্ববার ’ নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে মক্কা ও মদীনায় প্রেরণ করে এবং ইবনে যুবাইরের ’ উদ্দেশ্যে লিখে :

“ আসমানে তোমার খোদাকে আহ্বান কর। কারণ তোমার বিরুদ্ধে আমি আক্ক ও আশ্আর ’ গোত্রের যোদ্ধা ব্যক্তিদেরকে প্রেরণ করলাম। সৈন্য পৌঁছার পূর্বেই নিজ জীবনের নিরাপত্তার জন্যে কোনো উপায় অন্বেষণ কর ! ১৩৯

মদীনায় ইয়াযীদের সৈন্যের প্রবেশ

ইয়াযীদের সৈন্য মদীনায় উপস্থিত হলে এক কঠিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদীনাবাসীগণ পরাজিত হন। খলীফার সেনাবাহিনী প্রধান মুসলিম ইবনে উকবাহ্ ’ তিনদিন যাবৎ মদীনা নগরকে তার সৈন্যদের জন্য বৈধ ঘোষণা করে যাতে তারা লোকজনকে হত্যা করে এবং তাদের ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে !১৪০

বৈধ করে দেয়া দিনগুলিতে আল্লাহর রাসূলের (সা.) তিনজন সাহাবী সহ মদীনার সাতশ ’ জন কুরআনের হাফেয নিহত হন !১৪১

সেই দিনগুলির হত্যাযজ্ঞতা এমন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে , ধারণা হচ্ছিল , মদীনাবাসীদের কেউই অবশিষ্ট থাকবে না ! বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত দিনগুলিতে সহস্র নারী , গর্ভ ধারণ করেন ! অপর একটি বর্ণনায় এসেছে যে ,নিহত ব্যক্তিগণের মাঝে সাতশ ’ জন শুধু শীর্ষস্থানীয় মুহাজির , আনসার ও তাঁদের মুক্তিদানকারী ব্যক্তিগণ ছিলেন ; আর তাঁদের ছাড়াও সহস্র পুরুষ নিহত হন।১৪২

ইয়াযীদের জন্যে মদীনার লোকদের নিকট হতে বাইআত গ্রহণ

ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে : মুসলিম ইবনে উক্ববাহ বাইআত করার জন্যে লোক জনকে আহ্বান করে। সে এই মর্মে বাইআত গ্রহণ করে যে , তারা মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য স্বীকার করছে এবং সে তার ইচ্ছামত তাদের জান , মাল ও পরিবারকে ব্যবহার করতে পারবে। ’১৪৩

মদীনার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল তারা এই মর্মে বাইআত গ্রহণ করল যে , তারা ইয়াযীদের দাস ও গোলাম ! শুধুমাত্র হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) বাইয়াত করলেন না। তিনি মদীনাবাসীদের সাথে যোগ দেন নি। আর আলী ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের মামারা খলীফার সেনাবাহিনীতে ছিল এবং মদীনাবাসীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা হতে তাঁকে বিরত রেখেছিল। এ ছাড়া যারাই তার বাইআতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাদের সকলকেই হত্যা করেছিল।১৪৪

মক্কাভিমুখে ইয়াযীদের সৈন্যের যাত্রা ও তার সেনা প্রধানের মুনাজাত

‘ মুসলিম ইবনে উকবাহ্ ’ মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ , তাদেরকে হত্যা এবং তাদের ধন সম্পদ আত্মসাৎ করার পর সৈন্যদের সাথে মক্কাভিমুখে যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে যখন তার নিজের মাধ্যে মৃত্যুর আলামত দেখতে পেল তখন সে তার পরবর্তী সেনাপতির হাতে সৈন্যদের দায়িত্বভার অর্পণ করে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে বলে : হে আল্লাহ্ ! আমি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ ’ র ’ সাক্ষ্য দেয়ার পর হতে আমার নিজের আখিরাতের জন্যে এমন কোনো কাজই করি নি যা মদীনাবাসীদের হত্যার চেয়ে আমার নিকট প্রিয় ! আর এই কাজ করার পর যদি আমি জাহান্নামে গমন করি তবে প্রতীয়মান হয় যে , আমি হতভাগ্য ! অতঃপর সে মারা যায়।১৪৫

খলীফার সৈন্যরা কাবায় আগুন জ্বালায়

মুসলিম ইবনে উকবার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হুসাইন ইবনে নুমাইর ’ মক্কায় এসে মক্কা অবরোধ করে এবং অগ্নি ও পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্র দ্বারা কাবাগৃহের উপর পাথর বর্ষণ করে এবং কাপড় , কেরোসিন ও আগুন জ্বালানোর বিভিন্ন জিনিস দ্বারা কা বা ঘরে আগুন জ্বালায় ও ধ্বংস করে।১৪৬

তার এ ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বলা হয়েছে : ইবনে নুমাইর এমন এক অন্যায় কাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল যার মাধ্যমে মাকাম ও মুসাল্লা দু টিই ভষ্মীভূত হয় । ১৪৭

যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে কখনও কখনও উভয় দলই যুদ্ধে বিরতি দিলে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমাইর এবং খতীব ইবনে যুবাইর কা বা ঘরের ছাদের উপর গিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছিল : হে সিরিয়াবাসী ! এটি আল্লাহর হারাম শরীফ। এমন এক হারাম যেটি জাহিলিয়্যাতের যুগেও মানুষের জন্যে আশ্রয়স্থল ছিল এবং পশুপাখিও এইখানে নিরাপদ ছিল। হে সিরিয়াবাসী ! আল্লাহকে ভয় কর ।

অপরদিকে সিরিয়াবাসীরা চিৎকার বলছিল : আনুগত্য কর ! খলীফার আনুগত্য কর !! আক্রমণ কর ! আক্রমণ কর !! রাত না আসতেই কাজ সম্পন্ন কর ! কা বা ঘরে আগুন লাগা পর্যন্ত তারা এই আক্রমণ অব্যাহত রাখল। সিরিয়ার লোকেরা এইরূপ অবস্থা দেখে বলছিল : কা বা ঘরের মর্য়দা ও খলীফার আনুগত্য একত্রিত হয়েছে ও পরস্পরে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। অতঃপর খলীফার আনুগত্য , কা বা ঘরের মর্যাদার উপর বিজয় লাভ করল ! ১৪৮

কা বার অগ্নিকাণ্ডে , আগুনের প্রচণ্ড শিখায় কা বা ঘরের পর্দা , ছাদ এবং হযরত ইসমাঈলের (আ.) জীবনের বিনিময় স্বরূপ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দুম্বার দু টি শিং যা কা বা ঘরের দেয়ালে ঝুলানো ছিল , সব কিছু পুড়ে যায়।১৪৯

ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ তার সৈন্যদের নিকট পৌঁছা পর্যন্ত কা বা ঘরের অবরোধ অব্যাহত থাকে।

দুই পবিত্র হারামে বিদ্রোহের অবসান এবং অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহ শুরু

মক্কা ও মদীনার উত্তেজনার অবসানের পর , অন্যান্য শহরে বিভিন্ন আন্দোলন ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। যেমন ইয়া লা ছারাতিল হুসাইন এর শ্লোগান সহ কুফা নগরীতে ৬৫ হিজরীতে তাওয়্যাবীনের ’ আন্দোলন। তাঁরা আইনুল ওয়ারদা ’ নামক স্থানে খলীফার সৈন্যদের বিপক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন। তারপর , ৬৬ হিজরীতে কুফা নগরীতে মুখ্তারের ’ আন্দোলন। তিনি ইমাম হুসাইনের (আ.) হন্তাদেরকে হত্যা করার জন্যে আন্দোলনের ডাক দেন এবং তিনি সেই অত্যাচারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করেন। তাঁদের পরে আলাভীদের আন্দোলন। যেমন শহীদ যায়িদ ও তাঁর পুত্র ইয়াহ্ইয়ার আন্দোলন।১৫০ আর সর্বশেষে আব্বাসীয়দের আন্দোলন। তারা আলে মুহাম্মাদের (সা.) দিকে আহ্বানের শ্লোগান দিয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং উমাইয়্যাদের র্খিলাফতকে উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফতকে এই শ্লোগানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করে।১৫১

বিপ্লবীরা খিলাফতকে দুর্বল করে দেয় এবং ইমামগণ (আ.) ইসলামের বিধানসমূহকে পুনর্বহাল করেন

একদিকে ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের ফলে বিপ্লবীদের দ্বারা সৃষ্ট এই সব উত্তেজনা , আন্দোলন ও বিপ্লবসমূহ এবং অপরদিকে আহলে বাইতের ইমামগণের (আ.) গৃহীত পদক্ষেপের কারণে ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের সুবাদে ইমামগণ (আ.) , আল্লাহর রাসূলগণের নেতা এবং তাঁদের নানা রাসূল (স.) এর ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শরীয়তকে পুনরায় বহাল করার সুযোগ পান এবং ইসলামী বিধানসমূহকে প্রচার ও প্রসার করার জন্যে তাঁদের শিক্ষালয়কে প্রতিষ্ঠা করেন (এই সম্পর্কে পরে বর্ণিত হবে) ।

হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) অভ্যুত্থানের ফলাফল ও অবদানসমূহ

মুয়াবিয়া , সিরিয়ার উপর চল্লিশ বছর যাবৎ শাসনক্ষমতা পরিচালনাকালে , সিরিয়াবাসীকে ইচ্ছামত ইসলাম হতে বিচ্ছিন্ন করে প্রশিক্ষিত করতে সমর্থ হয়। রাসূলের (সা.) সাহাবীগণও এই ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন নি। মুয়াবিয়া এমন ধরনের কাজ করতে সমর্থ হয় যে , তার ফলে আমীরুল মু মিনীন আলী (আ.) নব্বই হাজার যোদ্ধা সহও সিরিয়ায় পৌঁছিতে পারেন নি এবং সিরিয়া জয় করতে পারেন নি। কিন্তু হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদা নিজের ও তাঁর সহযোগিদের বিচ্ছিন্ন শির দ্বারা সিরিয়া জয় করেন এবং সিরিয়া আন্দোলিত হয় ! রাসূলের (সা.) সন্তান সন্ততিকে বন্দী করার পরও অতিব সম্মানের সাথে মদীনায় ফেরত পাঠাতে ইয়াযীদ বাধ্য হয়।

ইসলামী দেশের প্রত্যেক প্রান্তে লোকেরা জেগে উঠে। মদীনায় সর্বপ্রথম বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শুরু হয় যেটিকে হাররার ঘটনা ’ বলা হয়। দ্বিতীয় বিদ্রোহটি মক্কায় হয়। তৃতীয় বিদ্রোহ , তাওয়াবীনের বিদ্রোহ ও সংগ্রাম এবং এতে চার হাজার লোক অংশ নিয়েছিল। এর পরে মুখ্তারের বিদ্রোহ্। সারকথা , একের পর এক আন্দোলনের সংঘটিত হয় এবং এর ফলে বনি উমাইয়্যাদের খিলাফতের পতন ঘটে।

হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এই যে , খিলাফতের তথাকথিত পবিত্রতার ধারণা ক্ষুন্ন হয়। মুসলমানরা ধারণা করত যে , খলীফার আনুগত্য করাটাই হচ্ছে ধর্ম । তারা রাসূলের (সা.) চেয়ে খলীফাদের অধিক সম্মানের অধিকারী জ্ঞান করত , তাদের এই ধারণাকে বাতিল ও ভ্রান্ত প্রমাণ করে। এই পবিত্রতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে , আব্দুল মালিকের যুগে হাজ্জাজ তার একটি বক্তব্যে বলে: আ খালীফাতু আহাদিকুম আক্বরাবু ’ ইনদাহু আম্ রাসূলুহু ? অর্থাৎ তোমাদের খলীফা ও প্রতিনিধি তোমাদের নিকট অধিক প্রিয়ভাজন , না তোমাদের রাসূল ?১৫২ এই বক্তব্য দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল এই যে , রাসূল (সা.) আল্লাহর পক্ষ হতে ওহীর একজন বাহক ছিলেন মাত্র। পক্ষান্তরে আব্দুল মালিক হচ্ছে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি।

পুনরায় বলে : কতদিন যাবৎ একটি কবর ও পচে যাওয়া অস্থিগুলির চারপাশে ঘুরবে ? ১৫৩ এ কথার দ্বারা রাসূলের (সা.) মর্যাদাকে অস্বীকার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। অতঃপর সে তার অবাধ্যতাকে এই পর্যায়ে উন্নীত করে যে , মক্কার হজ্জ ও আল্লাহর ঘরের চারপাশে তাওয়াফ করার পরিবর্তে আদেশ দেয় যে , সিরিয়াবাসীরা বাইতুল মুক্বাদ্দাসে যাবে , ইহরাম বাঁধবে এবং বাইতুল মুক্বাদ্দাসের ভিতরে , শিলাখণ্ডের চারদিকে তাওয়াফ করবে। অতঃপর ইহরাম হতে মুক্ত হবে।১৫৪

খলীফা মতাদর্শের অনুসারী মুসলমানদের এই দলের বিপরীতে , হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শাহাদতের কারণে অপর একদল মুসলমান জেগে উঠেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণের (আ.) নিকট হতে প্রকৃত ইসলামকে ধারণ করেন। যেমন খুলাফা মতাদর্শের অনুসারীরা বিশ্বাস করত যে , ওয়াসিয়া কুরসিয়্যুহুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরয্ । ১৫৫ এই আয়াতাংশের অর্থ এই যে , আল্লাহর দেহ রয়েছে এবং তিনি কুরসীর (চেয়ার) উপর বসে রয়েছেন। ’ উক্ত কুরসীটি বস্তু সত্তার অধিকারী এবং আল্লাহর দেহ , কুরসীর চারদিকে চারহাত করে অতিরিক্ত প্রসারিত রয়েছে।১৫৬ এই অর্থের স্থলে আহলে বাইতের ইমামগণ (আ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে , কুরসীর অর্থ আল্লাহর জ্ঞান। আল্লাহর জ্ঞান আসমান ও জমিনকে বেষ্টন করে রেখেছে।১৫৭ সুতরাং হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শাহাদতের ফলে এবং আহলে বাইতের ইমামগণের চেষ্টা সাধনার বিনিময়ে ইসলামের আক্বীদা বিশ্বাস ও বিধি বিধান সমাজে পুনরায় ফিরে আসে।

হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শাহাদতের অপর অবদান এই যে , সেই সময় পর্যন্ত খুলাফা মতাদর্শে ইসলামের বিধান ছিল খিলাফতের অধীন। ইয়াযীদের খিলাফতের সময় থেকে ধর্ম হতে খিলাফত পৃথক হয়ে যায়।

ইয়াযীদের পূর্ব পর্যন্ত খলীফা যা কিছু বলত তাই ইসলামের বিধান হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) শাহাদতের পর , খলীফা মতাদর্শের আলিমরা যেমন মালিক ইবনে আনাস ও আবু হানীফা প্রমুখ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হন। অর্থাৎ খলীফা মতাদর্শে ইসলামের আলিমরা খিলাফত হতে পৃথক হয়ে যায় এবং সেইদিন থেকে ধর্ম হতে রাজনীতি পৃথক হয়। অবশ্য , সেইরূপ খিলাফত ও শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হতে ধর্মের পৃথক হওয়া আবশ্যক ছিল। তবে আহলে বাইতের ইমামগণ (আ.) খলীফা হলে তাঁরা নিষ্পাপ বিধায় যা কিছু বলবেন ও আমল করবেন তাই ধর্মীয় বিধান বলে গণ্য হবে। আর আহলে বাইতের ইমামগণের পর , নীতিবান ফকীহর (ফকীহে আদেল) দায়িত্ব হল ইসলামী সরকার গঠন করা। এমনটি নয় যে , মুসলমানরা যে কোনো জালিম ও অত্যাচারী ব্যক্তির হাতে বাইআত করলেই সে মুসলমানদের অভিভাবক হবে ও তার আনুগত্য করা ওয়াজিব হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ হবে না।

পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের নিকট হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) আন্দোলনের আহ্বান হচ্ছে এই যে , যখনই কোনো শাসক অত্যাচারী হবে এবং রাসূলের (সা.) সুন্নতের বিপরীত আমল করবে তখনই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) পর হতে আজ পর্যন্ত যে কোনো আন্দোলনই হয়েছে , তার পিছনে তাঁর শাহাদতের অবদান রয়েছে।

ইমাম খোমেনী (রহ.) যে আন্দোলন করেছিলেন এবং শিয়ারা তাঁর পতাকা তলে তাগুতের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন , সেইটিও ছিল হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) আন্দোলনের ফল। ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ’ প্রতিষ্ঠিত হত না , যদি অত্যাচারী ও খোদাদ্রোহিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত শিয়া জনগণের হুসাইনী প্রশিক্ষণের অবদান না থাকত।

ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিস্থাপক ও রাহবার স্বয়ং হযরত সায়্যিদুশ্ শুহাদার (আ.) আন্দোলনকে ব্যবহার করেছেন। এই মূলধন শিয়াদের সমাজে বিদ্যমান ছিল। কোনো ব্যক্তির অধীনে মূল্যবান কোনো মূলধন থাকলে যেমনটি হয় , ইমাম খোমেনী (রহঃ) তেমনভাবে সেই মূলধনকে কাজে লাগিয়েছেন । চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে , রণাঙ্গনে গমন করাটাও ছিল এই আদর্শের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিয়াদের শাহাদত কামনার ফল স্বরূপ। ইরানী জনগণের আন্দোলন ও ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা , অন্যান্য ইসলামী দেশে অপর মুসলমানদের জেগে উঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিরিয়ায় আলে মুহাম্মদের (সা.) বন্দিগণ

আল্লাহর রাসূলের (সা.) বংশধরগণকে দামেশক শহরে নিয়ে যাওয়া হল এবং তাঁদেরকে অমুসলিম বন্দিদের রাখার স্থানে , মসজিদের প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে রাখা হল। এই অবস্থায় একজন বৃদ্ধলোক সামনে আসে এবং তাঁদের সন্নিকটে এসে বলে: সেই সত্য আল্লাহর প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে হত্যা করেছেন , তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করেছেন এবং জনগণকে তোমাদের কর্তৃত্ব ও যন্ত্রণা হতে নিরাপত্তা দান করেছেন আর আমীরুল মু মিনীনকে তোমাদের উপর আধিপত্য দান করেছেন !

ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) তাকে বলেন : হে বৃদ্ধ ! আপনি কি কুরআন পড়েছেন ? ॥ সে বলে : হ্যাঁ , পড়েছি । তিনি বলেন : এই আয়াতটি নিশ্চয় জানেন যে , মহান আল্লাহ্ বলেছেন : বল , আমি এই রিসালতের জন্যে , আমার অতি নিকট আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ও বন্ধুত্ব ব্যতীত তোমাদের নিকট অন্য কোনো বিনিময় কামনা করি না । ১২১

বৃদ্ধ লোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি। ’ ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : এই আয়াতে নিকট আত্মীয়ের অর্থ আমরাই ! অতঃপর তিনি বলেন : সূরা বনী ইস্রাঈলের এই আয়াতটি কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : নিকট আত্মীয়দের হক প্রদান কর । ১২২

বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : আমরাই হচ্ছি নিকট আত্মীয় , হে বৃদ্ধ ! এই আয়াতটিও কি পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : সাবধান থেক এবং জেনে রেখ , যা কিছু তোমাদের হস্তগত হয় তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ , আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর নিকট আত্মীয়দের জন্যে । ১২৩ )

বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এই আয়াতটি তো পড়েছি ।

ইমাম সাজ্জাদ বলেন : হে বৃদ্ধ , নিকট আত্মীয় হচ্ছি আমরাই। এই আয়াতটিও নিশ্চয় পড়েছেন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন : হে আহলে বাইত! নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান । ১২৪ বৃদ্ধলোকটি বলে : হ্যাঁ , এটিও তো পড়েছি। ’ ইমাম (আ.) বলেন : আমরাই সেই আহলে বাইত। পবিত্র আল্লাহ আমাদেরকে আয়াতে তাত্বহীরের মাধ্যমে বিশেষত্ব দান করেছেন। ’

বর্ণনাকারী বলেন : বৃদ্ধলোকটি কিছু সময় নীরব , বিস্মিত ও অনুতপ্ত হয়ে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকেন। অতঃপর , আসমানের দিকে মাথা উঁচু করে বলেন : হে আল্লাহ্ ! আমি যে কথাগুলি বলেছি এবং এই ব্যক্তিবর্গের সাথে শত্রুতামূলক যে আচরণ করেছি তার জন্যে তওবা করছি ও তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করছি। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও আলে মুহাম্মদের (সা.) প্রতি শত্রুতা পোষণকারীরা , জ্বিন ইনসান যে কেউই হোক , আমি তাদের থেকে বিমুখতা প্রকাশ করছি এবং তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি । ১২৫

ইয়াযীদের দরবারে আহলে বাইতের (আ.) প্রবেশ

ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া খিলাফত মসনদে বসার পর সিরিয়ার সম্মানিত লোকদেরকে ডাকে এবং তাদেরকে তার পাশে স্থান দেয়। অতঃপর , আলী ইবনে হুসাইন (আ.) , ইমাম হুসাইনের (আ.) বংশের নারীগণ ও শিশুদেরকে তার নিকটে আনতে আদেশ দেয় , এই অবস্থায় আল্লাহর রাসূলের (সা.) কচি শিশুদেরকে রশি দিয়ে একে অপরের সাথে বেঁধে রেখেছিল এবং লোকেরা সে দৃশ্য দেখছিল । ১২৬

ইমাম হুসাইনের পবিত্র মস্তকটি যখন আহলে বাইতের (আ.) সদস্যগণ এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীদের মাথার সাথে ইয়াযীদের সামনে রাখা হয় তখন ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আ.) ইয়াযীদকে বলেন: তুমি কি আমাকে কথা বলার অনুমতি দিবে ? ইয়াযীদ বলে: বল , তবে বাজে কথা বলবে না ! ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন : আমি এমন এক স্থানে দণ্ডায়মান হয়েছি যে , প্রলাপ বকা এবং অর্থহীন কথাবার্তা বলা আমার মত লোকের জন্যে শোভা পায় না। হে ইয়াযীদ ! আল্লাহর রাসূলের (সা.) সম্পর্কে কি উপলব্ধি করছ , যদি তিনি আমাদেরকে জিঞ্জির ও শিকলে বাঁধা এ অবস্থায় দেখেন ? ইয়াযীদ তার চতুষ্পার্শ্বস্থ লোকদেরকে বলে : তার হতে শিকলগুলি খুলে নাও ! ১২৭

ইয়াযীদের প্রতি ইহুদী এক পণ্ডিতের অভিযোগ

উক্ত সভায় একজন ইহুদী পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন , তিনি জিজ্ঞেস করেন : হে আমীরুল মু মিনীন! এই যুবকটি কে ? ইয়াযীদ বলে : এই মাথার অধিকারী ব্যক্তিটি হল তার পিতা ! ইহুদী বলেন : হে আমীরুল মু মিনীন ! এটি কার মাথা ? ইয়াযীদ বলে : আবু তালিবের পুত্র আলী , তার পুত্র হুসাইন , এটি তারই মাথা। ’ ইহুদী বলেন : তাঁর মাতা কে ? ইয়াযীদ বলে : রাসূলের কন্যা ফাতিমা। ’ ইহুদী পণ্ডিত বিস্ময়ের সাথে বলেন: সুবহানাল্লাহ! ইনি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান ! তাঁর ইন্তেকালের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই (এত দ্রুত) তোমরা তাঁকে হত্যা করলে ?! তাঁর সন্তানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে স্বীয় রাসূলের জন্যে তোমরা কত মন্দ স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি! আল্লাহর কসম ! মূসা ইবনে ইমরান যদি তাঁর বংশের কোনো ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে রেখে যেতেন তবে আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত তাঁরই উপাসনা করতাম ! তোমরা এমন লোক যে , এই গতকাল তোমাদের রাসূল তোমাদের মাঝ হতে বিদায় নিয়েছেন , আর তোমরা তাঁর সন্তানের উপর চেপে বসলে এবং তাঁকে হত্যা করলে ! ধিক তোমাদের উপর ! তোমরা কতই না নিকৃষ্ট! ১২৮

ইয়াযীদ আদেশ দিল: তার কণ্ঠ রুদ্ধ কর ! ইহুদী পণ্ডিত বললেন : আমার ব্যাপারে যা মনে কর তাই কর ; আমাকে মার কিংবা হত্যা কর অথবা জীবিত রাখ। আমি তওরাতে এইরূপ দেখেছি যে , যদি কোনো ব্যক্তি কোনো রাসূলের সন্তানকে হত্যা করে তবে সে যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন পরাজিত হবে এবং তার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন !

সিরিয়ার জনৈক পুরুষ এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) বংশের এক নারীকে দাসী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ

সে সভায় সিরিয়ার অধিবাসীদের মাঝ হতে জনৈক পুরুষ উঠে দাঁড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন ! এই মেয়েটিকে (হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমাকে উদ্দেশ্য করে) আমাকে প্রদান করুন , তাকে আমার দাসী হিসেবে গ্রহণ করব। ’ ফাতিমা বলেন : আমি কেঁপে উঠি , কাঁদতে শুরু করি এবং ধারণা করি যে , এই কাজটি তাদের জন্যে আইনসিদ্ধ। আমার ফুফু যয়নবের বুকে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি , তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন , আর তিনি জানতেন যে , এই কাজটি হওয়ার যোগ্য নয় । যয়নব (আ.) সেই পুরুষটির উত্তরে বলেন : আল্লাহর কসম ! তুমি মিথ্যা বলেছো এবং নীচুতার পরিচয় দিয়েছো , এইরূপ বিষয় না তোমার জন্যে ন্যায়সঙ্গত হবে , আর না তার জন্যে ।

ইয়াযীদ ক্রোধান্বিত হয়ে বলে: আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলছ , এই কাজটি আমার জন্যে আইনসিদ্ধ , আমি যদি সেটি বাস্তবায়ন করতে চাই তবে বাস্তবায়ন করব ! যয়নব (আ.) বলেন : আল্লাহর কসম ! এইরূপ নয় ! মহান আল্লাহ্ এইটিকে তোমার জন্যে আইনসিদ্ধ করেন নি , তবে যদি আমাদের ধর্ম হতে বেরিয়ে যেতে চাও এবং নিজের জন্যে অন্য ধর্মকে বেছে নাও ! ইয়াযীদের ক্রোধ বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ছাড়িয়ে গিয়েছিল , সে বলল: আমার মত লোকের সাথে এইরূপ বিতর্ক করছ ? যারা ধর্ম হতে বেরিয়ে গেছে তারা হল তোমার বাবা ও ভাই ! যয়নব (আ.) বলেন : তুমি , তোমার পিতা এবং তোমার দাদা আল্লাহর দিকে আমার পিতা , ভ্রাতা ও নানার দ্বীনের মাধ্যমে সুপথ প্রাপ্ত হয়েছো । ইয়াযীদ বলে: হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বলছ ! যয়নব(আ.) বলেন: তুমি এখন অধিনায়ক , আধিপত্যশীল এবং পরাভূতকারী তাই অন্যায়ভাবে গালি দিচ্ছ এবং নিজ কর্তৃত্বের শক্তি দেখাচ্ছ ।

ইমাম হুসাইনের (আ.) কন্যা ফাতিমা বলেন : আল্লাহর শপথ ! মনে হল ইয়াযীদ লজ্জিত হল এবং নীরব হয়ে গেল । সিরিয়ার লোকটি পুনরায় নিজ প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি করে বলে : হে আমীরুল মু মিনীন ! এই মেয়েটিকে আমাকে প্রদান করুন ! ইয়াযীদ যেহেতু সুদৃঢ় ও দাঁতভাঙ্গা প্রতি উত্তর পেয়েছিল তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে অতি কর্কশভাবে তাকে বলল : ধ্বংস হও ! আল্লাহ্ তোমাকে অকস্মাৎ এবং দ্রুত মৃত্যু দান করুন ! ১২৯

মুসলমানদের খলীফার সামনে রাসূল(সা.) এর সন্তানের মাথা

ইমাম হুসাইনের (আ.) মাথাটি স্বর্ণের একটি বড় পাত্রে করে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের সামনে রাখা হল। সে একখানা বেতের লাঠি চাইল এবং সেটি দ্বারা সে ইমাম হুসাইনের (আ.) দাঁতগুলির উপর আঘাত করতে লাগল এবং বলল : আবু আব্দিল্লাহর কি চমৎকার দাঁত ছিল !

এই সময়ে আবু বারযা আসলামী১৩০ নামক রাসূলের জনৈক সাহাবী ইয়াযীদকে বলেন : তোমার লাঠি দ্বারা কি ইমাম হুসাইনের (আ.) ঠোঁট ও দাঁতে মারছো ?! সাবধান থেক ! তোমার লাঠি দ্বারা হুসাইনের ঠোঁট দু টির যে স্থানে আঘাত করছ , আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি অসংখ্যবার সে স্থানে চুমু দিতে এবং চোষণ করতে দেখেছি। ইয়াযীদ ! তুমি কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় উত্থিত হবে যে , তোমার শাফাআতকারী হবে ইবনে যিয়াদ ! আর এই হুসাইন (আ.) কিয়ামত দিবসে আসবেন এবং তাঁর শাফাআতকারী হবেন মুহাম্মদ (সা.) ! অতঃপর তিনি তাঁর স্থান হতে উঠে দাঁড়ান এবং বেরিয়ে যান।১৩১

ইয়াযীদ নিজ কুফরীকে প্রকাশ করছে

ইয়াযীদ , বিজয় ও অহংকারের নেশায় অন্ধ হয়ে ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলির মাধ্যমে উদাহরণ দেয় এবং এইরূপ আবৃত্তি করে :

১। হায় ! বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার বংশের মহান ব্যক্তিরা যদি উপস্থিত থাকত এবং দেখত যে , আমি কি করেছি ,

২। তাহলে মারহাবা বলত , উৎফুল্ল হত এবং বলত : ইয়াযীদ তোমাকে ধন্যবাদ। ’

৩। আমরা এই কওমের মহান ও সর্দার ব্যক্তিগণকে হত্যা করেছি , বদরের দিনের উচিৎ জবাব দিয়েছি (প্রতিশোধ নিয়েছি) এবং সমান সমান হয়েছি। ’

অতঃপর সে এই পংক্তিটি নিজ থেকে যুক্ত করে এবং আবৃত্তি করে : যদি আমি মুহাম্মদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের কৃত কাজের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি উৎবা ’ র বংশ নই !

‘ তাযকিরায়ে খাওয়াসসিল উম্মা ’ গ্রন্থে এসেছে : সকল বর্ণনাতেই এ বিষয়টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে , ইয়াযীদ যখন হুসাইনের (আ.) মাথাটিকে তার সম্মুখে দেখে তখন সিরিয়ার অধিবাসীদেরকে একত্রিত করে এবং তাদের উপস্থিতিতে তার হাতের লাঠি দ্বারা মাথাটিকে আঘাত করে ও ইবনে যেবা ’ রীর কবিতার পংক্তিগুলি আবৃত্তি করে , আর নিম্নোক্ত পংক্তি দু টি সেইগুলির সাথে যোগ করে :

‘ বনী হাশিম গোত্র রাজত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে খেলা করেছে , না আসমান হতে কোনো সংবাদ এসেছে আর না কোনো ওহী অবতীর্ণ হয়েছে !

যদি আহমদের সন্তান সন্ততি এবং তাদের যাবতীয় কৃতকর্মের প্রতিশোধ গ্রহণ না করি তবে আমি খিন্দিফ গোত্রের লোক নই ! ১৩২


8

9

10

11

12