ইমাম হুসাইনের
শাহাদতের
পর
সাহাবা
ও
তাবেঈনের
বিদ্রোহ
মদীনার লোকদের বিদ্রোহ ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার হাতে শপথ
ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের পর , মদীনার লোকেরা‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালার ’ পাশে জমা হন এবং তাঁর হাতে শপথ করেন । এমনই শপথ যাতে তারা মৃত্যু বরণ করতে ও নিহত হতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হন ! আব্দুল্লাহ্ তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং বলেন :‘
হে লোক সকল ! আল্লাহকে ভয় কর ! খোদার কসম ! আমরা ইয়াযীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র এই আশঙ্কায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি যে , হয়ত বিদ্রোহ না করলে আসমান হতে আমাদের উপর পাথর বর্ষণ করা হবে ! ইয়াযীদ এমনই এক ব্যক্তি , যে তার পিতার শয্যা সঙ্গিনী , তার কন্যা ও বোনদের সাথে বিবাহ করছে , মদ পান করছে এবং নামায পরিহার করছে। ’
ইবনে যুবাইরও মক্কায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন , ইয়াযীদকে খিলাফতচ্যুত করেন এবং মদীনার বেশীর ভাগ লোকই তাঁর অনুসরণ করেন।‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুতী ’ ও আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানযালা’
এবং মদীনার লোকেরা মসজিদে তাঁর নিকট একত্রিত হন।
সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর বলেন :‘
আমি আমার পাগড়িটিকে যেইভাবে মাথা হতে সরিয়ে নিচ্ছি ঠিক সেইভাবে খিলাফত হতে ইয়াযীদকে অপসারণ করছি। ’ অতঃপর তিনি তাঁর পাগড়িটিকে মাথা হতে তুলে বলেন :‘
আমি এমন এক সময় এই কথাগুলি বলছি যখন ইয়াযীদ আমাকে মূল্যবান কিছু উপহার দিয়েছে , তবে সে আল্লাহর শত্রুএবং সদা সর্বদা মদ পান করে নেশাগ্রস্ত থাকে। ’
অপর একজন বলেন :‘
আমি আমার পা হতে জুতা খোলার মত করে ইয়াযীদকে খিলাফতচ্যুত করছি। ’ অন্য আরেকজন বলেন :‘
শরীর হতে শার্ট খোলার ন্যায় আমি তাকে খিলাফতচ্যুত করছি। ’ অন্য একজন বলেন :‘
আমি আমার পা হতে জুতা জোড়া খোলার ন্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। ’ বিভিন্ন লোকজনের পাগড়ি , জুতা এবং নাগরায় স্তুপ আকার ধারণ করে ! সকলে তার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং তাকে পদচ্যুত করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।
বনী উমাইয়্যাদেরকে বিতাড়িত করার জন্যে মদীনার লোকেরা সমাবেশ করেন এবং তাদের নিকট এই মর্মে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে , তারা মদীনার অধিবাসীদের বিপক্ষে খলীফার সৈন্যদেরকে সহযোগিতা করবেন না এবং ইয়াযীদের সৈন্যদেরকে মদীনায় প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করবেন। আর যদি সৈন্যদেরকে প্রতিহত করতে না পারেন তবে তারা নিজেরা সৈন্যদের সাথে মদীনায় ফিরে যাওয়া হতে বিরত থাকবেন।
বনী উমাইয়্যাদের নারী ও শিশুদেরকে ইমাম সাজ্জাদ আশ্রয় দিলেন
এই সময়ে , উমাইয়্যা বংশের মারওয়ান‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরের ’ নিকট গমন পূর্বক বলে :‘
হে আবু আব্দির রাহমান ! তুমি তো দেখতে পাচ্ছ যে , এই লোকেরা আমাদের কর্তৃত্ব গুটিয়ে নিতে বাধ্য করেছে এবং আমাদেরকে বিতাড়িত করেছে। তুমি আমাদের নারী ও শিশুদেরকে আশ্রয় দাও। ’
আব্দুল্লাহ্ বলেন :“
তোমাদের ও তাদের কোন পক্ষের সাথেই আমাদের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই ।”
মারওয়ান উঠে দাঁড়ায় এবং বলে :‘
এই চরিত্র ও আচরণকে আল্লাহ্ অপছন্দ করুন !’
অতঃপর সে , হুসাইনের পুত্র আলীর (আ.) নিকট আসে এবং তার পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে ইমামের (আ.) নিকট আবেদন করে। ইমাম (আ.) তাই করেন এবং উম্মে আবান নামে উছমানের কন্যা ও মারওয়ানের স্ত্রী , আব্দুল্লাহ্ ও মুহাম্মদ নামক তার দুই পুত্রসহ তাদেরকে আশ্রয় প্রদান করেন।
তাবারী ও ইবনে আছীর লিখেছেন :“
মদীনার লোকেরা যখন ইয়াযীদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বনী উমাইয়্যাদেরকে বিতাড়িত করেন তখন মারওয়ান ইবনে হাকাম‘
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরের ’ সঙ্গে এই মর্মে আবেদন করে যে , তিনি যেন তার পরিবারকে তাঁর নিজের নিকট আশ্রয় দেন ; কিন্তু তিনি তার আবেদনটি মঞ্জুর করলেন না। মারওয়ান‘
হুসাইনের পুত্র আলীর ’ সঙ্গে আলাপ করে এবং বলে :‘
হে আবুল হাসান ! আমি আপনার আত্মীয় এবং আত্মীয়তার অধিকার রাখি , আমার পরিবারটি আপনার পরিবারের পাশে থাকুক ?’
ইমাম (আ.) বলেন :‘
ঠিক আছে , এতে কোনো বাধা নেই। ’ মারওয়ান নিজ পরিবারকে ইমামের (আ.) সমীপে প্রেরণ করে। ইমাম (আ.) নিজ পরিবার ও মারওয়ানের পরিবারকে মদীনার বাইরে‘
ইয়াম্বু ’ নামক স্থানে নিয়ে যান এবং সেইখানে তাঁরা বসবাস শুরু করেন ।”
ইয়াযীদের নিকট বনী উমাইয়্যাদের সাহায্য প্রার্থনা ও মদীনায় সৈন্য সমাবেশ
বনী উমাইয়্যারা এইরূপ অবস্থা দেখে ইয়াযীদের নিকট পত্র লিখে এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। ইয়াযীদ‘
মুসলিম ইবনে উক্ববার ’ নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে মক্কা ও মদীনায় প্রেরণ করে এবং‘
ইবনে যুবাইরের ’ উদ্দেশ্যে লিখে :
“ আসমানে তোমার খোদাকে আহ্বান কর। কারণ তোমার বিরুদ্ধে আমি‘
আক্ক ও আশ্আর ’ গোত্রের যোদ্ধা ব্যক্তিদেরকে প্রেরণ করলাম। সৈন্য পৌঁছার পূর্বেই নিজ জীবনের নিরাপত্তার জন্যে কোনো উপায় অন্বেষণ কর !”
মদীনায় ইয়াযীদের সৈন্যের প্রবেশ
ইয়াযীদের সৈন্য মদীনায় উপস্থিত হলে এক কঠিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদীনাবাসীগণ পরাজিত হন। খলীফার সেনাবাহিনী প্রধান‘
মুসলিম ইবনে উকবাহ্ ’ তিনদিন যাবৎ মদীনা নগরকে তার সৈন্যদের জন্য বৈধ ঘোষণা করে যাতে তারা লোকজনকে হত্যা করে এবং তাদের ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে !
বৈধ করে দেয়া দিনগুলিতে আল্লাহর রাসূলের (সা.) তিনজন সাহাবী সহ মদীনার সাতশ ’ জন কুরআনের হাফেয নিহত হন !
সেই দিনগুলির হত্যাযজ্ঞতা এমন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে , ধারণা হচ্ছিল , মদীনাবাসীদের কেউই অবশিষ্ট থাকবে না ! বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত দিনগুলিতে সহস্র নারী , গর্ভ ধারণ করেন ! অপর একটি বর্ণনায় এসেছে যে ,নিহত ব্যক্তিগণের মাঝে সাতশ ’ জন শুধু শীর্ষস্থানীয় মুহাজির , আনসার ও তাঁদের মুক্তিদানকারী ব্যক্তিগণ ছিলেন ; আর তাঁদের ছাড়াও সহস্র পুরুষ নিহত হন।
ইয়াযীদের জন্যে মদীনার লোকদের নিকট হতে বাইআত গ্রহণ
ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে : মুসলিম ইবনে উক্ববাহ বাইআত করার জন্যে লোক জনকে আহ্বান করে। সে এই মর্মে বাইআত গ্রহণ করে যে , তারা মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য স্বীকার করছে এবং সে তার ইচ্ছামত তাদের জান , মাল ও পরিবারকে ব্যবহার করতে পারবে। ’
মদীনার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল তারা এই মর্মে বাইআত গ্রহণ করল যে , তারা ইয়াযীদের দাস ও গোলাম ! শুধুমাত্র হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) বাইয়াত করলেন না। তিনি মদীনাবাসীদের সাথে যোগ দেন নি। আর আলী ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের মামারা খলীফার সেনাবাহিনীতে ছিল এবং মদীনাবাসীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা হতে তাঁকে বিরত রেখেছিল। এ ছাড়া যারাই তার বাইআতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাদের সকলকেই হত্যা করেছিল।
মক্কাভিমুখে ইয়াযীদের সৈন্যের যাত্রা ও তার সেনা প্রধানের মুনাজাত
‘ মুসলিম ইবনে উকবাহ্ ’ মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ , তাদেরকে হত্যা এবং তাদের ধন সম্পদ আত্মসাৎ করার পর সৈন্যদের সাথে মক্কাভিমুখে যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে যখন তার নিজের মাধ্যে মৃত্যুর আলামত দেখতে পেল তখন সে তার পরবর্তী সেনাপতির হাতে সৈন্যদের দায়িত্বভার অর্পণ করে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে বলে :“
হে আল্লাহ্ ! আমি‘
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ ’ র ’ সাক্ষ্য দেয়ার পর হতে আমার নিজের আখিরাতের জন্যে এমন কোনো কাজই করি নি যা মদীনাবাসীদের হত্যার চেয়ে আমার নিকট প্রিয় ! আর এই কাজ করার পর যদি আমি জাহান্নামে গমন করি তবে প্রতীয়মান হয় যে , আমি হতভাগ্য !’
অতঃপর সে মারা যায়।
খলীফার সৈন্যরা কাবায় আগুন জ্বালায়
মুসলিম ইবনে উকবার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত‘
হুসাইন ইবনে নুমাইর ’ মক্কায় এসে মক্কা অবরোধ করে এবং অগ্নি ও পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্র দ্বারা কাবাগৃহের উপর পাথর বর্ষণ করে এবং কাপড় , কেরোসিন ও আগুন জ্বালানোর বিভিন্ন জিনিস দ্বারা কা’
বা ঘরে আগুন জ্বালায় ও ধ্বংস করে।
তার এ ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বলা হয়েছে :‘
ইবনে নুমাইর এমন এক অন্যায় কাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল যার মাধ্যমে মাকাম ও মুসাল্লা দু’
টিই ভষ্মীভূত হয় ।’
যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে কখনও কখনও উভয় দলই যুদ্ধে বিরতি দিলে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমাইর এবং খতীব ইবনে যুবাইর কা’
বা ঘরের ছাদের উপর গিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছিল :“
হে সিরিয়াবাসী ! এটি আল্লাহর হারাম শরীফ। এমন এক হারাম যেটি জাহিলিয়্যাতের যুগেও মানুষের জন্যে আশ্রয়স্থল ছিল এবং পশুপাখিও এইখানে নিরাপদ ছিল। হে সিরিয়াবাসী ! আল্লাহকে ভয় কর ।”
অপরদিকে সিরিয়াবাসীরা চিৎকার বলছিল :‘
আনুগত্য কর ! খলীফার আনুগত্য কর !! আক্রমণ কর ! আক্রমণ কর !! রাত না আসতেই কাজ সম্পন্ন কর !’
কা’
বা ঘরে আগুন লাগা পর্যন্ত তারা এই আক্রমণ অব্যাহত রাখল। সিরিয়ার লোকেরা এইরূপ অবস্থা দেখে বলছিল :“
কা’
বা ঘরের মর্য়দা ও খলীফার আনুগত্য একত্রিত হয়েছে ও পরস্পরে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। অতঃপর খলীফার আনুগত্য , কা’
বা ঘরের মর্যাদার উপর বিজয় লাভ করল !”
কা’
বার অগ্নিকাণ্ডে , আগুনের প্রচণ্ড শিখায় কা’
বা ঘরের পর্দা , ছাদ এবং হযরত ইসমাঈলের (আ.) জীবনের বিনিময় স্বরূপ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দুম্বার দু’
টি শিং যা কা’
বা ঘরের দেয়ালে ঝুলানো ছিল , সব কিছু পুড়ে যায়।
ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ তার সৈন্যদের নিকট পৌঁছা পর্যন্ত কা’
বা ঘরের অবরোধ অব্যাহত থাকে।
দুই পবিত্র হারামে বিদ্রোহের অবসান এবং অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহ শুরু
মক্কা ও মদীনার উত্তেজনার অবসানের পর , অন্যান্য শহরে বিভিন্ন আন্দোলন ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। যেমন‘
ইয়া লা ছারাতিল হুসাইন’
এর শ্লোগান সহ কুফা নগরীতে ৬৫ হিজরীতে‘
তাওয়্যাবীনের ’ আন্দোলন। তাঁরা‘
আইনুল ওয়ারদা ’ নামক স্থানে খলীফার সৈন্যদের বিপক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন। তারপর , ৬৬ হিজরীতে কুফা নগরীতে‘
মুখ্তারের ’ আন্দোলন। তিনি‘
ইমাম হুসাইনের (আ.)’
হন্তাদেরকে হত্যা করার জন্যে আন্দোলনের ডাক দেন এবং তিনি সেই অত্যাচারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করেন। তাঁদের পরে আলাভীদের আন্দোলন। যেমন শহীদ যায়িদ ও তাঁর পুত্র ইয়াহ্ইয়ার আন্দোলন।
আর সর্বশেষে আব্বাসীয়দের আন্দোলন। তারা আলে মুহাম্মাদের (সা.) দিকে আহ্বানের শ্লোগান দিয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং উমাইয়্যাদের র্খিলাফতকে উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফতকে এই শ্লোগানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করে।
বিপ্লবীরা খিলাফতকে দুর্বল করে দেয় এবং ইমামগণ (আ.) ইসলামের বিধানসমূহকে পুনর্বহাল করেন
একদিকে ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের ফলে বিপ্লবীদের দ্বারা সৃষ্ট এই সব উত্তেজনা , আন্দোলন ও বিপ্লবসমূহ এবং অপরদিকে আহলে বাইতের ইমামগণের (আ.) গৃহীত পদক্ষেপের কারণে ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদতের সুবাদে ইমামগণ (আ.) , আল্লাহর রাসূলগণের নেতা এবং তাঁদের নানা রাসূল (স.) এর ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শরীয়তকে পুনরায় বহাল করার সুযোগ পান এবং ইসলামী বিধানসমূহকে প্রচার ও প্রসার করার জন্যে তাঁদের শিক্ষালয়কে প্রতিষ্ঠা করেন (এই সম্পর্কে পরে বর্ণিত হবে) ।