বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্0%

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্ লেখক:
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 24399
ডাউনলোড: 4307

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 18 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 24399 / ডাউনলোড: 4307
সাইজ সাইজ সাইজ
বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

বিচারবুদ্ধি ও কোরআনের দৃষ্টিতে ‘আালামে বারযাখ্

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মৃত্যুপারের জীবন সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য চিরন্তন। এ ঔৎসুক্যের পরিপূর্ণ নিবৃত্তি জীবদ্দশায় সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় জেনেও মানুষ কখনোই এ বিষয়ে জানার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মে যেমন বিভিন্ন ধারণা দেয়া হয়েছে, তেমনি এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা তথ্য ও কল্পনা। তাই এ ব্যাপারে সম্ভব সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক ধারণার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই অনুভূত হয়ে আসছে।

ইসলামী মতে, সাধারণভাবে মৃত্যুপরবর্তী সময়ের দু’টি পর্যায় রয়েছে : মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময় এবং পুনরুত্থান পরবর্তী সময় অর্থাৎ শেষ বিচার ও তদ্পরবর্তী জান্নাতী বা জাহান্নামী অনন্ত জীবন। পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং বেহেশত বা দোযখ বাস তথা আখেরাতের ওপর ঈমান পোষণ ইসলামের মৌলিক চৈন্তিক ভিত্তি (উছূলে ‘আক্বাএদ্)-এর অন্যতম। এ কারণে এ সম্পর্কে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বক্তব্য রয়েছে।

নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয় ও তার কর্মক্ষমতা

আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি যে , ঐশী ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণাধীনে ও অনুমতিক্রমে আালামে বারযাখে অবস্থিত নাফ্স্ বস্তুজগতের অধিবাসীদেরকে দেখতে পায় ও তাদের কথা শুনতে পায়। এর সপক্ষে আমরা প্রমাণও উপস্থাপন করেছি। এ থেকে বস্তুদেহের সাহায্য ছাড়াও যে নাফ্স্ শুনতে ও দেখতে পারে এটাই প্রমাণিত হয়।

এর মানে হচ্ছে , শারীরিক ইন্দ্রিয়নিচয় ছাড়াও নাফসের স্বতন্ত্র ও অবস্তুগত ইন্দ্রিয়নিচয় রয়েছে। আর ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তির জীবিত অবস্থায়ই , এমনকি কেবল স্বপ্নে নয় , জাগ্রত অবস্থায়ও , নাফ্স্ তার এ সব ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বস্তুজাগতিক তথ্য অবগত হতে পারে। এ ব্যাপারে অনেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ , কেউ জাগ্রত অবস্থায় সহসাই তার দৃষ্টির অন্তরালবর্তী কোনো ঘটনা হুবহু সম্মুখে সংঘটিত ঘটনার ন্যায় সুস্পষ্টভাবে দেখতে পারে এবং পরে তা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। অন্যদিকে স্বপ্নে দেখা ঘটনা - যা স্বপ্নে দেখার আগে ঘটে নি - ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর পরই বা অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে দেখার দৃষ্টান্ত বহু পাওয়া যায়। অবশ্য অনেকে স্বপ্নে প্রতীকী আকারে ভবিষ্যত ঘটনা দেখতে পায় এবং অনেকে হুবহু দেখতে পায়।

এছাড়া ঘুমের সময় মানুষের শারীরিক ইন্দ্রিয়নিচয় নিষ্ক্রিয় থাকা সত্ত্বেও মানুষ স্বপ্নে পঞ্চেন্দ্রিয়ের হুবহু অভিজ্ঞতা লাভ করে , এমনকি তা তার শরীরের ওপরও প্রতিক্রিয়া করে। এটাও নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয়ের প্রমাণ বহন করে। বস্তুবাদীরা - যারা আল্লাহ্ তা আলার ও বস্তু-উর্ধ নাফসের অস্তিত্ব স্বীকার করে না - স্বপ্নকে মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বলে দাবী করে থাকে। তাদের মতে , ব্যক্তি জাগ্রত অবস্থায় যা কল্পনা করে স্বপ্নে তা-ই দেখে থাকে। এটা যে , পুরোপুরি ভিত্তিহীন সে ব্যাপারে যে কারোই অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। কারণ , মানুষ অনেক সময়ই এমন স্বপ্ন দেখে যা সে কোনোদিনই কল্পনা করে নি। তার চেয়েও বড় কথা , বস্তু-উর্ধ নাফ্স্ না থাকলে বস্তুগত মস্তিষ্কের পক্ষে কোনো কিছু কল্পনা করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ , বস্তুধর্ম অনুযায়ী মস্তিষ্কে কেবল তা-ই ধরা পড়বে যা বাস্তবে সংঘটিত হয়েছে ; যা আদৌ ঘটে নি তা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হতে বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। কেবল বস্তু-উর্ধ সৃজনশীল নাফ্স্ই কল্পনা করতে পারে এবং সে এ ধরনের কল্পসৃষ্টি আঞ্জাম দিলে কেবল তখনি তা মস্তিষ্কের তথ্যভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে পারে।

আবার অনেক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানীর মতে , মানুষের অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতীকী রূপ ধরে স্বপ্নে দেখা দেয়। এ দাবী অধিকতর ভিত্তিহীন। কারণ , অপূর্ণ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে যদি আমরা এক ধরনের কল্পচিত্র বলে ধরে নেই (যদিও ওপরে উল্লেখ করেছি যে , তা নাফসের কাজ , মস্তিষ্কের কাজ নয়) তো স্বপ্নে সে কল্পচিত্র হুবহু ধরা পড়তে পারে ; তা প্রতীকী রূপ ধারণ করার কোনো কারণ নেই।

অবশ্য যারা স্বপ্নের তাৎপর্য সম্পর্কে লিখেছেন তাঁদের লেখার কিছু অংশ কোনো কোনো ধর্মীয় সূত্র থেকে নেয়া এবং বেশীর ভাগই বহু লোকের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে গৃহীত উপসংহার ; এ সব তাৎপর্যের সব কিছু সঠিক প্রমাণিত না হলেও কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সব সময়ই সঠিক হতে দেখা যায়। যেমন : স্বপ্নে কুকুর দেখলে তা শত্রুর প্রতীক এবং কুকুরে কামড়াতে দেখলে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রতীক , অন্যদিকে সাপ হচ্ছে কুটিল ও হিংসুক শ্রত্রুর প্রতীক এবং সাপে কামড়াতে দেখলে এ ধরনের শত্রুর পক্ষ থেকে হিংস্র শত্রুতা চরিতার্থকরণের প্রতীক , আগুন শান্তির প্রতীক , কিন্তু আগুন ঘরে লাগতে দেখলে ঝগড়া-বিবাদ ও অশান্তির প্রতীক , স্বচ্ছ পানি শান্তির প্রতীক , ঘোলা পানি দুর্যোগ ও সমস্যায় পড়ার প্রতীক , ধোঁয়া দুর্যোগ ও বিপদের প্রতীক , ইত্যাদি। এগুলোর সবই ভবিষ্যত সংক্রান্ত ; বস্তুগত মস্তিষ্ক এগুলো জানবে কী করে এবং তার চেয়েও বড় কথা , এগুলোকে প্রতীকী রূপ দেবে কীভাবে ? প্রতীকী রূপ প্রদান তো বস্তুধর্মের আওতা বহির্ভূত।

অবশ্য স্বপ্নে নাফ্স্ এগুলোকে প্রতীকী রূপে দেখলেও স্বয়ং নাফ্স্ এগুলোকে প্রতীকী রূপ প্রদান করেছে এটা মনে করা ঠিক হবে না। বরং স্বপ্নলোক যেহেতু আলামে বারযাখেরই একটি অংশ সেহেতু সে জগতে প্রতিষ্ঠিত নিয়মাবলীর অধীনেই এগুলো প্রতীকী রূপে প্রতিভাত হয় এবং নাফ্স্ সেগুলোকে এভাবেই দেখে থাকে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , হাশরের মাঠে লোকেরা তাদের ভিতরের ব্যক্তিসত্তা (নাফ্স্)-এর স্বরূপে উত্থিত হবে ; বিভিন্ন ইসলামী সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী খারাপ লোকেরা সেখানে কুকুর , শুকর , গাধা , সাপ ইত্যাদির চেহারা নিয়ে উত্থিত হবে , কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে চেনা যাবে যে , তারা অমুক অমুক ব্যক্তি। কোরআন মজীদে এ সম্পর্কে আভাস দেয়া হয়েছে ; এরশাদ হয়েছে :

) وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى. قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا. قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى(

“ আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণকে (বা কোরআনকে) পাশ কাটিয়ে যায় অবশ্যই তার জীবন হবে দুর্বিষহ এবং ক্বিয়ামতের দিনে আমি তাকে অন্ধরূপে সমাবেশস্থলে উত্থিত করবো। তখন সে বলবে : হে আমার রব! আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলোম , তাহলে কেন আমাকে অন্ধরূপে উত্থিত করেছো ? তখন তিনি (আল্লাহ্) বলবেন : এটাই (যথোপযুক্ত) , কারণ , তোমার নিকট আমার আয়াত সমূহ এসেছিলো , কিন্তু তুমি তা (ইচ্ছাকৃতভাবে) বিস্মৃত হয়েছিলে (উপেক্ষা করেছিলে) , তাই এভাবেই আজকের দিনে তুমি বিস্মৃতিকবলিত হয়েছো (অনুগ্রহ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছো) । ” (সূরাহ্ ত্বা-হা : ১২৪-১২৬)

প্রকৃত পক্ষে পার্থিব জীবনে থাকাকালেই যে ব্যক্তি তার নাফসের দৃষ্টিশক্তিকে সত্যদর্শনের ক্ষেত্রে অন্ধ করে ফেলেছিলো ক্বিয়ামতের দিনে তাকে সেরূপেই উত্থিত করা হবে। কারণ , সেখানে তার পার্থিব জীবনের বস্তুনিচয় দর্শনের ক্ষমতার কোনো গুরুত্ব থাকবে না। এদের অবস্থা রঙ-কানা চর্মচক্ষুর অধিকারী ব্যক্তির ন্যায় - যে বিশেষ কোনো রঙ ও সে রঙের বস্তুনিচয় দেখতে পায় না। এভাবে যারা স্বীয় নাফসের সত্যদর্শনক্ষমতা বিনষ্ট করে ফেলেছে তাদের সম্পর্কেই অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلا(

“ আর যে ব্যক্তি এখানে (এ দুনিয়ার বুকে) অন্ধ (সত্যদর্শনের ক্ষেত্রে যার নাফসের দর্শনক্ষমতা বিলুপ্ত) অতঃপর আখেরাতেও সে হবে অন্ধ ; বস্তুতঃ পথের বিচারে সে চরমভাবে ভ্রষ্ট। ” (সূরাহ্ আল্-ইসরা ’ / বানী ইসরাঈল্ : ৭২)

এ অন্ধত্ব যে চর্মচক্ষুর অন্ধত্ব নয় তা বলাই বাহুল্য। কারণ , দুনিয়ার বুকে যদি কারো চর্মচক্ষু অন্ধ হয় তো তা তার অপরাধ নয় , বরং এ ধরনের ব্যক্তি ঈমানদার ও নেককার হলে সে অবশ্যই বেহেশতে যাবে এবং সেখানে সে চক্ষুষ্মান হবে - এটাই আল্লাহ্ তা আলার ইনছ্বাফের দাবী।

অন্যত্র নাফসের চক্ষু-কর্ণের বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ; এরশাদ হয়েছে :

) وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُونَ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تُسْمِعُ الصُّمَّ وَلَوْ كَانُوا لا يَعْقِلُونَ. وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْظُرُ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تَهْدِي الْعُمْيَ وَلَوْ كَانُوا لا يُبْصِرُونَ(

“ (হে রাসূল!) তাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা আপনার কথা শোনে ; কিন্তু আপনি কি বধিরকে শোনাতে পারবেন যখন তারা বিচারবুদ্ধি কাজে লাগায় না ? আর তাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে ; কিন্তু আপনি কি অন্ধকে পথ দেখাতে পারবেন যখন তারা (অন্তর্চক্ষুর দ্বারা) দেখে না ? (সূরাহ্ ইউনুস্ : ৪২-৪৩)

এ থেকেই সুস্পষ্ট যে , হাশরের মাঠে অনেক লোকের কুকুর , শুকর , গাধা ইত্যাদি রূপে উত্থিত হওয়ার ধারণা পুরোপুরি সঠিক। কারণ , সেখানে সকলেই নিজ নিজ নাফসের স্বরূপে উত্থিত হবে। আর যেহেতু আলামে বারযাখ্ হচ্ছে আখেরাতের জীবনের একটি নমুনা মাত্র সেহেতু এতে সন্দেহ নেই যে , সেখানেও নাফ্স্ সমূহ স্বরূপে অবস্থান করছে যদিও তা সত্ত্বেও সে জগতের অবস্থা যারা দেখতে পান তাঁদের পক্ষে পার্থিব জীবনে যে জন যে ব্যক্তি ছিলো তা চিনতে কোনো রকম অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। অন্যদিকে স্বপ্নলোক যেহেতু আালামে বারযাখেরই একটি অংশ সেহেতু সেখানে পার্থিব জগতের মানুষদের নাফসের কর্মতৎপরতা তাদের ভিতরের রূপ সহকারে ধরা পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই সেখানে শত্রু কুকুর বা সাপরূপে এবং তার আক্রমণপরিকল্পনা কামড়রূপে ধরা পড়ে।

এখন প্রশ্ন হলো , আলামে বারযাখের অধিবাসীদের (নাফসের) অবস্তুগত ইন্দ্রিয়নিচয়ের কার্যক্ষমতা কতোখানি , বিশেষ করে এগুলোর দ্বারা তাদের পক্ষে বস্তুজগতের তথ্যাদি লাভ করা কতোখানি সম্ভব ?

এ ব্যাপারে আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে , আলামে বারযাখ্ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার নিয়ন্ত্রণাধীন বিশেষ ব্যবস্থাধীন একটি জগত। সুতরাং , পার্থিব জগতের অধিবাসীদের পক্ষে পার্থিব জগতে বস্তুগত বাধামুক্ত পরিবেশে স্বীয় শারীরিক ইন্দ্রিয়নিচয়কে যেরূপ স্বাধীনভাবে কাজে লাগানো সম্ভব আলামে বারযাখের অধিবাসীদের পক্ষে স্বীয় নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয়কে পার্থিব জগতের তথ্যাদি লাভের ক্ষেত্রে তো দূরের কথা , ঐ জগতের অবস্থা সম্বন্ধেও অনুরূপ স্বাধীনভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং কেউ কেবল ততোখানিই স্বীয় (নাফসের) ইন্দিয়নিচয়কে ব্যবহার করতে পারে যতোখানি কাজে লাগানোর জন্য ঐ বিশেষ ব্যবস্থাধীনে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছে বা হবে। এ সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেই আমাদেরকে আলামে বারযাখে নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয়ের কার্যক্ষমতার আওতা ও মাত্রা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে।

‘ আলামে বারযাখে অবস্থানরত নাফ্স্ সমূহের যে সব ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক একান্তভাবে কেবল পুরষ্কার ও শাস্তি ভোগ করার সাথে (অর্থাৎ নাসিকা , জিহবা ও ত্বক্) সেগুলোর সাথে আমাদের পার্থিব জগতের কোনোই সম্পর্ক থাকার কথা নয়। আমাদের জগতের সাথে সম্পর্ক আছে কেবল তাদের শ্রবণ ও দর্শন ক্ষমতা এবং কথা বলার ক্ষমতার সাথে (শর্তাধীনে- যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে) । তাই এটাই হচ্ছে আমাদের আলোচ্য বিষয়।

যেহেতু আলামে বারযাখ্ একটি ভিন্ন মাত্রার জগত সেহেতু সেখানে অবস্থানরত স্বয়ং নাফসের ক্ষেত্রে এবং তার শ্রবণ , দর্শন ও বাচন ক্ষমতার ক্ষেত্রে আমাদের পার্থিব জগতের বাধাসমূহ , বিশেষ করে স্থানগত দূরত্ব সেখানে কার্যকর হবার কথা নয়। তাই অনুমতিপ্রাপ্ত নাফ্স্ সমূহের পক্ষে বিশ্বের যে কোনো জায়গাকে বা ব্যক্তিকে দেখা , যে কোনো কথা ও শব্দ শোনা এবং যে কোনো কথা বলার জন্য অনুমতি থাকলেই তার পক্ষে তা দেখা ও শোনা এবং কথা বলা সম্ভবপর। আর যেহেতু তারা ভিন্ন মাত্রার জগতের অধিবাসী এবং নাফসের ইন্দ্রয়নিচয় মাত্রাগত দিক থেকেও বস্তুদেহের ইন্দ্রিয়নিচয়ের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত সেহেতু এ ক্ষেত্রে অনুমতিলাভ সাপেক্ষে কোনো নাফসের পক্ষে একই সময় অনেকের কথা শোনা ও অনেককে দেখা এবং অনেকের কাছাকাছি হওয়া ও অনেকের কাছে স্বীয় মনোভাব পৌঁছানো সম্ভবপর।

হাশরের দিনে আল্লাহ্ তা আলা কাফের ব্যক্তিদেরকে সম্বোধন করে বলবেন :

) لَقَدْ كُنْتَ فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنْكَ غِطَاءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ(

“ এ (দিন) সম্পর্কে তো তুমি উদাসীন ছিলে। তাই আজ আমি তোমার থেকে পর্দা সরিয়ে নিয়েছি , সুতরাং তোমার দর্শনক্ষমতা আজ সীমাবদ্ধতামুক্ত। ” (সূরাহ্ ক্বাফ্ : ২২)

এর মানে এ নয় যে , কেবল কাফের ব্যক্তিদের দর্শনক্ষমতা সীমাবদ্ধতামুক্ত হবে , বরং সেটি হচ্ছে এমন জগত যেখানে কারো দর্শনক্ষমতাই সীমাবদ্ধতার অধিকারী হবে না। আর সীমাবদ্ধতামুক্ত হবার মানে এ নয় যে , ব্যক্তি কেবল নিজের অতীত জীবনের সব কিছু দেখতে পাবে , বরং আক্ষরিক অর্থেই অতীত ও বর্তমান (অর্থাৎ তখনকার বর্তমান) এবং ভিতর-বাহিরের সব কিছু দেখতে পাবে। সুতরাং এ থেকে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া চলে যে , তখন মানুষ বস্তুদেহের অধিকারী হবে বটে তবে তা হবে এমন বস্তুদেহ যার ইন্দ্রিয়নিচয় পার্থিব জীবনের ইন্দ্রিয়নিচয়ের সীমাবদ্ধতার ন্যায় সীমাবদ্ধতার অধিকারী হবে না , বরং সে বস্তুদেহে নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয় হুবহু কার্যকর থাকবে।

আর যেহেতু আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আখেরাতের জগতের অবস্তুগত প্রতিচ্ছবি সেহেতু শর্তাধীনে সেখানেও নাফসের ইন্দ্রিয়নিচয় সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এবং অনুমোদিত ক্ষেত্রে , বিশেষ করে পার্থিব জগতের সাথে অনুমোদিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার দর্শন ও শ্রবণ শক্তি পুরাপুরি কার্যকর। আর ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , আালামে বারযাখে নাফ্স্ সমূহ স্বরূপে অবস্থান করছে এবং হাশরের মাঠে স্বরূপে (বস্তুদেহ ধারণ করে) উত্থিত হবে এবং সকলে সকলকে স্বরূপে দেখতে পাবে সেহেতু সীমাবদ্ধতাহীন দর্শন ও শ্রবণ ক্ষমতার দাবী হচ্ছে এই যে , আলামে বারযাখের অধিবাসীরা বস্তুজগতের অধিবাসীদেরকে দেখতে পেলে ও তাদের কথা শুনতে পেলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাফসের স্বরূপ সহকারে দেখতে পায় এবং তাদের কথার পিছনে নিহিত তাদের অন্তরের অবস্থা সহকারে শুনতে পায়। অর্থাৎ তারা বস্তুলোকবাসী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে শুধু বাহ্যিক তথ্যাদি লাভ করে না , বরং তার পিছনে নিহিত প্রকৃত সত্যও জ্ঞাত হয়। উদাহরণস্বরূপ , কেউ যদি মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে তো মৃত ব্যক্তির নাফ্স্ কেবল তার বিলাপ শুনতে পায় না এবং কেবল তাকে বিলাপরত দেখতে পায় না , বরং তার বিলাপ আন্তরিক , নাকি কপট তা-ও দেখতে ও শুনতে পায়। ধরা যাক , কেউ কপটভাবে বিলাপ করছে , কিন্তু আসলে সে ঐ ব্যক্তির মৃত্যুতে খুশী হয়েছে , এ ক্ষেত্রে হয়তো মৃত ব্যক্তির নাফ্স্ তাকে আনন্দে অট্টহাস্য করতে দেখে এবং তার কপট বেদনার্ত ক্রন্দসী চেহারাকে অট্টহাসিরত ক্রুর হায়েনার চেহারা রূপে দেখতে পারে। কারণ , আলামে বারযাখে বস্তুলোকবাসীদের আন্তরিকতা ও কপটতা এবং অন্য সমস্ত রকমের মানসিক অবস্থা অবস্তুগত মূর্ত রূপ ধারণ করে।