আালামে বারযাখ্
ও
‘
আালামে মিছাল্
দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণ মৃত ব্যক্তিদের দেহাতীত সত্তার জগত‘
আালামে বারযাখ্ ছাড়াও আরো একটি বারযাখী জগতের কথা বলেছেন। একে তাঁরা‘
আালামে মিছাল্ বা বারযাখে মিছালী বলে উল্লেখ করেছেন।
‘ আারেফ্কুল শিরোমণি হযরত শায়খ্ মুহীউদ্দীন ইব্নুল্‘
আরাবী (রহ্.) বলেছেন যে ,“
বারযাখ্ ” পরিভাষাটি দু’
টি অর্থে ব্যবহৃত হয় : একটি হচ্ছে তা-ই পার্থিব দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর রূহ্ (নাফ্স্) সমূহকে যেখানে রাখা হয় ; এটা ঐ বারযাখ্ থেকে স্বতন্ত্র - যা মুজাররাদ্ রূহ্ সমূহ ও বস্তুগত শরীর সমূহের মাঝামাঝি। (شرح فصص محی الدين ابن العربی، ص ٣٢
)
উল্লেখ্য , দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণ বস্তুসম্পর্কহীন স্বাধীন আত্মিক সত্তাসমূহকে (যেগুলো বস্তুদেহে উদ্ভূত নয়) মুজাররাদ্ (مجرد
) বা বস্তুসম্পর্কহীন সত্তা বলে থাকেন , যেমন : ফেরেশতাগণ। এ ধরনের সত্তাকে রূহে মুজাররাদ্-ও বলা হয়। এ ধরনের সত্তাসমূহের জগতকে‘
আালামে মুজাররাদ্ (عالم مجرد
- অবস্তুগত সত্তার জগত) বা‘
আালামে আরওয়াহ্ (عالم ارواح
- রূহের জগত) বলা হয়। এ জগতের ও তার অধিবাসীদের জন্য কোনো স্থানের প্রয়োজন হয় না অর্থাৎ তাদের অবস্থানের জন্য কোনো বস্তু সরিয়ে দিয়ে তার স্থান দখলের প্রয়োজন হয় না।
দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণের মতে , এই‘
আালামে মুজাররাদ্ ও বস্তুজগতের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত আরেকটি জগত রয়েছে ; এ জগতের নাম‘
আালামে মিছাল্ বা‘
আালামে বারযাখ্ বা বারযাখে মিছালী। এ জগতের সৃষ্টিনিচয় বস্তুগত সৃষ্টিও নয় , আবার পুরোপুরি মুজাররাদ্ও নয় , বরং এতদুভয়ের মাঝামাঝি ধরনের তথা এক ধরনের সূক্ষ্ম উপাদানে সৃষ্ট।
মৃত্যর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতকে দু’
টি কারণে‘
আালামে বারযাখ্ বলা হয়। প্রথমতঃ এ কারণে যে , তা মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাঝামাঝি জগত তথা পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের মাঝামাঝি জগত , দ্বিতীয়তঃ সেখানে মানুষের নাফ্স্ বস্তুদেহবিহীন কিন্তু মিছালী শরীর (জিসমে মিছালী) সহ অবস্থান করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আসলেই কি , তাঁরা যেমন বলেছেন , উপরোল্লিখিত‘
আালামে মিছাল ও মৃত ব্যক্তিদের নাফসের জগত অর্থাৎ‘
আালামে বারযাখ্ স্বতন্ত্র , নাকি অভিন্ন ?
বলা বাহুল্য যে , বস্তুজগতে জীবিত মানুষ জাগ্রত অবস্থায়ও সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন গতিবিধির অধিকারী নয় , বরং প্রাকৃতিক , আইনগত , বস্তুগত , বিশেষতঃ আর্থিক এবং সামাজিক ও নৈতিক বাধা তার গতিবিধি ও তৎপরতাকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত করে।‘
আলামে বারযাখে অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী জগতে নাফ্স্ সমূহের গতিবিধি ঐ জগতের জন্য নির্ধারিত বিশেষ বিধিবিধানের আওতায় ফেরশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য নবী-রাসূলগণ (‘
আঃ) সহ আল্লাহ্ তা‘
আলার খাছ্ব্ বান্দাহ্গণ যে ঐ জগতে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার স্বাধীনতা ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক এবং পাপিষ্ঠরা যে বলতে গেলে কোনোই স্বাধীনতা লাভ করবে না এতেও সন্দেহ নেই। অন্য ব্যক্তিরা তাদের অবস্থা অনুযায়ী স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতার অধিকারী হবে - এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।
অন্যদিকে দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণ যে‘
আালামে মিছাল্-এর কথা বলেছেন সে জগতও নিঃসন্দেহে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জগত হতে পারে না। বরং তা-ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি , নৈতিকতা , অতিপ্রাকৃতিক বিধি-বিধান ও ফেরেশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জগত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে যে , এ দু’
টি জগত কি বিভিন্ন , নাকি অভিন্ন ?
আল্লাহ্ তা‘
আলা কোরআন মজীদে মৃত ও ঘুমন্ত উভয় ধরনের লোকদের নাফসকে অধিগ্রহণ করেন (يتوفّی
) বলে উল্লেখ করেছেন এবং এ জন্য অভিন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে , তিনি ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে ফিরিয়ে দেন এবং মৃত ব্যক্তির নাফসকে ফিরিয়ে দেন না। এ ক্ষেত্রে উভয়ের অধিগ্রহণের জন্য অভিন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহারের কারণে এটা ধরে নেয়া অযৌক্তিক হবে না যে , উভয় ব্যক্তির নাফসকে অভিন্ন জগতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একেই অধিগ্রহণ করা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটাই স্বাভাবিক যে , উভয় ধরনের নাফসকে একই জগতের ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাখা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মানুষ স্বপ্নে জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের মানুষের সাক্ষাৎ পায় কীভাবে ?
মৃত ব্যক্তিদের নাফ্স্ ফেরেশতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত‘
আালামে বারযাখে রাখা হয় এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। এমতাবস্থায় মৃত ও ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে অভিন্ন জগতে নেয়া না হলে জীবিত ব্যক্তিদের নাফসের পক্ষে মৃত ব্যক্তিদেরকে দেখা সম্ভব হতে পারে না। কারণ , দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণ বর্ণিত সূক্ষ্ম সৃষ্টির জগত বা‘
আালামে মিছাল্ স্বতন্ত্র হলে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে সেখানে নিয়ে রাখা হলে সেখানে তাকে যদি মৃত ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করাতে হয় তাহলে মৃত ব্যক্তির নাফসকে‘
আালামে বারযাখ্ থেকে কথিত‘
আালামে মিছালে নিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। কিন্তু বিচারবুদ্ধি এটাকে সঠিক বলে মানতে পারে না। কারণ , তাহলে‘
আালামে বারযাখের সীমান্ত তথা সীমাবদ্ধতার প্রাচীর (যদিও অবস্তুগত) লঙ্ঘিত হবে। বরং ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফসকে মৃত ব্যক্তিদের নাফসের জগতেরই একটি অংশে নিয়ে গেলে এ সীমারেখা ও সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘিত হয় না।
এখানে একটি নতুন প্রশ্নের উদয় হতে পারে , তা হচ্ছে , মানুষ স্বপ্নে শুধু মৃত লোকদেরকেই দেখতে পায় না , বরং অন্য জীবিত লোকদেরকেও দেখতে পায় এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলে ও অন্য ধরনের আন্তঃক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু হতে পারে যে , যে ব্যক্তিকে সে স্বপ্নে দেখেছে সে ব্যক্তি ঐ সময় জাগ্রত ছিলো অথবা ঘুমিয়ে থাকলেও সে হুবহু একই রকম স্বপ্ন দেখে নি। এর মানে দাঁড়ায় , নিঃসন্দেহে ঐ ব্যক্তির নাফ্স্ তখন‘
আালামে বারযাখে বা‘
আালামে মিছালে যায় নি , বা গেলেও প্রথমোক্ত ব্যক্তির নাফসের সাথে মুখোমুখি হয় নি। তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি স্বপ্নে কী করে তাকে দেখতে পায় ?
দার্শনিক ও‘
আারেফ্গণের পক্ষ থেকে এর জবাবে যে সব সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য জবাব হচ্ছে এই যে ,‘
আালামে মিছালে বস্তুজগতের প্রাণশীল ও নিষ্প্রাণ নির্বিশেষে সকল সৃষ্টিরই সদৃশ রূপ (صورت مثالی
) রয়েছে এবং সেখানে তাদের তৎপরতাও রয়েছে। আর সে তৎপরতা কেবল স্বপ্নযোগেই ঘটে না , বরং জাগ্রত অবস্থায় ব্যক্তির মধ্যে যে সব চিন্তা-চেতনা দেখা দেয় এবং সে সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে যে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা পোষণ করে , তেমনি সে যা কিছু কল্পনা করে তার সব কিছুই‘
আালামে মিছালে অবস্তুগত মূর্ত রূপ লাভ করে তথা তৎপরতায় পরিণত হয় , যদিও ব্যক্তি নিজে সে সম্পর্কে বুঝতে পারে না। অন্যদিকে ঘুমন্ত ব্যক্তির নাফ্স্ যেমন জাগ্রত অবস্থায় যে সব চিন্তা ও কল্পনা করতো এবং যে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা পোষণ করতো সেগুলোও‘
আালামে মিছালে অবস্তুগত মূর্ত রূপ লাভ করে তথা তৎপরতায় পরিণত হয়। ব্যক্তির নাফ্স্ ঘুমের মধ্যে প্রধানতঃ নিজের এবং সেই সাথে অন্যদের কতক চিন্তা-কল্পনা , আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনার অবস্তুগত মূর্ত রূপের মুখোমুখি হয় ও তা পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়া উপস্থিতভাবেও সে সেখানে কতক তৎপরতা চালায়। অতঃপর তার নাফ্স্ মিছালী দেহ সহকারে , মতান্তরে মিছালী দেহ থেকে বের হয়ে , বস্তুদেহে ফিরে আসে। আর তখনই সে জাগ্রত হয়।
[উল্লেখ্য ,‘
আারেফ্গণের দৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে অস্তিত্বলোককে এক বিবেচনায় তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে : (১)عالم لاهت
-‘
আালামে লাহূত্ বা আল্লাহ্ তা‘
আলার নিজ সত্তার রহস্যলোক - যা জানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। (২)عالم ناسوت
-‘
আালামে নাসূত্ বা বস্তুজগত। (৩)عالم ملکوت
-‘
আালামে মালাকূত বা অবস্তুলোক।
‘ আালামে মালাকূত্ আবার তিন ভাগে বিভক্ত : (ক)ملکوت اعلی
- মালাকূতে আ ‘ লা বা উচ্চতর অবস্তুলোক ; ফেরেশতাগণ সহ সকল বস্তুসম্পর্কহীন নাফ্স্ ও রূহ্ এ জগতের অন্তর্ভুক্ত। (খ)ملکوت سفلی
- মালাকূতে সুফলা বা নিম্ন স্তরের মালাকূত্ ; মানুষের চিন্তা , কল্পনা ও পরিকল্পনা এ স্তরের অন্তর্ভুক্ত। (গ)ملکوت وسطی
- মালাকূতে উসত্বা বা মধ্যবর্তী মালাকূত্ ; বস্তুগত অস্তিত্বের কাছাকাছি সূক্ষ্ম অস্তিত্বসমূহ এ জগতের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে কোরআন মজীদের আয়াতে প্রতিটি জিনিসেরই মালাকূত্ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
)
فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ(
“ অতএব , পরম প্রমুক্ত তিনি (আল্লাহ্) যার হাতে রয়েছে প্রতিটি জিনিসের (شَيْءٍ
) মালাকূত্ এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনরত। ” (সূরাহ্ ইয়া-সীন্ : ৮৩)
বস্তুতঃ অন্য কোনো নিদর্শন না থাকলেشَيْءٍ
বলতে বস্তুগত সৃষ্টিকে বুঝায় - তা তাতে প্রাণ থাকুক বা না-ই থাকুক। অতএব , বস্তুলোকের প্রাণশীল ও প্রাণহীন নির্বিশেষে প্রতিটি সৃষ্টিরই মালাকূত্ রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ মালাকূত্ কী ? তা কি‘
আলামে মিছালস্থ সৃদৃশ আকৃতি (صورت مثالی
) এবং তা-ই কি নাফ্স্ ? কারণ , আমরা যে সব সৃষ্টিকে নিষ্প্রাণ মনে করি কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে সেগুলোরও প্রাণ আছে তা আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি।]
অনুরূপভাবে , কোনো কোনো মতে , পার্থিব জগতে মানুষ যে সব ভালো-মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনা ও কাজকর্ম করে এবং যে সব ভালো-মন্দ কথা বলে তা অবস্তুগত মূর্ত রূপ (صورت مثالی
) ধারণ করে‘
আালামে মিছালে এবং বস্তুগত বা উচ্চতর রূপ (صورت اعلی
) নিয়ে‘
আালামে আখেরাতে মওজূদ হতে থাকে। যেমন : অনেক ভালো চিন্তা-পরিকল্পনা , কথা ও কাজ তার জন্য প্রাসাদ , স্নিগ্ধ হাওয়া , সুপেয় পানি , সুস্বাদু খাবার , ফলবান বৃক্ষ , ফুলের গাছ , পাখীর সুর ইত্যাদিতে পরিণত হয় এবং তার বস্তুগত মূর্ত রূপ‘
আালামে আখেরাতে ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ‘
আালামে মিছালে বা‘
আালামে বারযাখে স্থানলাভ করে। তেমনি তার অনেক মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনা , কথা ও কাজ আগুন , কঠিন শৈত্য , সাপ-বিচ্ছু , নোংরা ও অপবিত্র বস্তু ইত্যাদিতে পরিণত হয় এবং তার বস্তুগত মূর্ত রূপ‘
আালামে আখেরাতে ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ‘
আালামে মিছালে বা‘
আালামে বারযাখে স্থানলাভ করে। তেমনি অন্য লোকেরা তার জন্য ভালো বা মন্দ যে সব চিন্তা বা পরিকল্পনা করে তা-ও প্রতীকীভাবে বস্তুগত ও অবস্তুগত মূর্ত রূপ ধারণ করে যথাক্রমে‘
আালামে আখেরাতে ও‘
আালামে বারযাখে বা‘
আালামে মিছালে স্থিতিলাভ করে।
এ কারণেই ব্যক্তি স্বপ্নে যে সব সুখকর অভিজ্ঞতা লাভ করে তা প্রধানতঃ তার নিজের সুকর্ম ও সুচিন্তা-পরিকল্পনার অথবা অন্যরা তার জন্য যে সুচিন্তা-পরিকল্পনা করে তার অবস্তুগত মূর্ত রূপ। অন্যদিকে সে স্বপ্নে যে সব অসুখকর বা কষ্টকর অভিজ্ঞতা লাভ করে তা প্রধানতঃ তার নিজের মন্দ কর্ম ও মন্দ চিন্তা-পরিকল্পনার অথবা অন্যরা তার জন্য যে মন্দ ও ক্ষতিকর চিন্তা-পরিকল্পনা করে তার অবস্তুগত মূর্ত রূপ। (এখানে‘
প্রধানতঃ ’ বলার কারণ এই যে , ক্ষেত্রবিশেষে এর বাইরে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছার অবস্তুগত মূর্ত রূপও অন্তর্ভুক্ত থাকে।)
স্বপ্নলোকে সুখ-শান্তি , ভোগ-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট একটি বিতর্কাতীত ব্যাপার। এ সময় মানুষের বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকলেও সে পুরোপুরি পঞ্চেন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়। বস্তুতঃ স্বপ্নলোকে সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং জাগ্রত অবস্থার সুখ-দুঃখের অনুভূতিতে কোনোই পার্থক্য নেই। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্বপ্নে সুখ-দুঃখের অনুভূতি এমনই তীব্র হতে পারে যে , এর ফলে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে এবং এ ধরনের ঘটনা একান্ত বিরল হলেও ঘটতে দেখা যায়। এমতাবস্থায় মৃত ব্যক্তিদের নাফসকে অনুরূপ বা মাত্রাগতভাবে তার চেয়েও তীব্রতর অনুভূতি প্রদান করে পুরষ্কার ও শাস্তি আস্বাদন করানোর বিষয়টি কেবল কোরআন মজীদের আয়াতের আলোকেই নয় , বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতেও অনস্বীকার্য।
সুতরাং‘
আালামে বারযাখে নে ‘ আমত্ ও শাস্তি যাকে যা-ই ভোগ করানো হোক না কেন , তা প্রকৃতই ভোগ বৈ নয়। তবে তাতে বস্তু থাকে না , কিন্তু বস্তুমধ্যস্থ প্রকৃত ভোগোপকরণ সমূহের (ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই) সবই থাকে। অর্থাৎ তাতে বর্ণ , গন্ধ , স্বাদ , শ্রবণ , দর্শন ও স্পর্শ সবই থাকে। তবে‘
আালামে বারযাখে খাদ্যদ্রব্যজাত পুষ্টি ও শক্তি নাফ্স্ বা জিসমে মিছালীর জন্য অপরিহার্য বলে মনে হয় না।
অবশ্য বস্তুবিহীন নিরঙ্কুশ স্বাদ এবং তা-ও নে ‘ আমত্ সমূহের আকার-আকৃতি সহ সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে একটি দুর্বল উপমা (مثال ناقص
) থেকে বিষয়টি বুঝতে পারা সহজ হতে পারে। তা হচ্ছে , আমরা বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন বস্তু দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু এর বাইরেও শুধু রং পাওয়া যায় - যা অন্য বস্তুকে আশ্রয়কৃত রং নয় , বরং শুধুই রং।
বারযাখী জীবনের স্বরূপ
আসলে মৃত্যুপরবর্তী‘
আালামে বারযাখের প্রকৃত অবস্থা কেমন ? এ প্রশ্নের জবাব জানার আগ্রহ সকলেরই। কিন্তু এ প্রশ্নের নিশ্চিত জবাব প্রদান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ , এ জগতের নিশ্চিত অভিজ্ঞতা সহকারে কোনো ব্যক্তিই ফিরে আসে না এবং তার বর্ণনা দেয় না। এমনকি আল্লাহ্ তা‘
আলা কোনো কারণে যদি কাউকে পুনরায় পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে দেন - ঠিক যেভাবে হযরত‘
উযাইর্ (‘
আঃ)কে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন - তো সে ক্ষেত্রেও তার পক্ষে‘
আালামে বারযাখের অবস্থা বর্ণনা করা সম্ভব হবে না।
যেহেতু আল্লাহ্ তা‘
আলা চান যে , মানুষ‘
আখেরাত্ ও‘
আালামে বারযাখের ব্যাপারে কোনোরূপ ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়াই কেবল বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)-এর সাহায্যে পর্যালোচনা করে সত্যে উপনীত হয়ে ঈমান পোষণ করুক , সেহেতু এটাই স্বাভাবিক যে , কাউকে মৃত্যুর পরে পুনরায় পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে দিলে তার‘
আালামে বারযাখের স্মৃতিগুলোকে অবচেতনে পাঠিয়ে দেয়া হবে - যার ফলে ব্যক্তির মনেই হবে না যে , সে মারা গিয়েছিলো , বরং মনে হবে যে , সে ঘুমিয়ে ছিলো বা সংজ্ঞাহারা হয়ে ছিলো। এ কারণেই‘
উযাইর্ (‘
আঃ)কে আল্লাহ্ তা‘
আলার প্রশ্ন ও তাঁর জবাব থেকে সুস্পষ্ট যে ,‘
উযাইর্ (‘
আঃ) বুঝতেই পারেন নি যে , তিনি মারা গিয়েছিলেন।
আল্লাহ্ তা‘
আলা হযরত‘
উযাইর্ (‘
আঃ)কে যে প্রশ্ন করেন তাতে সরাসরি তাঁর মৃত অবস্থার কথা উল্লেখ করেন নি , বরং জিজ্ঞেস করেন :كَمْ لَبِثْتَ
-“
কতোদিন (এভাবে/ মৃত) ছিলে ?”
জবাবে‘
উযাইর্ (‘
আঃ) বলেন :لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ
-“
একদিন বা একদিনের অংশবিশেষ (এভাবে/ ঘুমিয়ে) ছিলাম। ” আর তাই আল্লাহ্ তা‘
আলা তাঁর গাধাটির জরাজীর্ণ অস্থিসমূহ দেখিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দেন যে , তিনি অনেক দিন (একশ ’ বছর) মৃত অবস্থায় ছিলেন। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২৫৯)
যা-ই হোক , যেহেতু‘
আালামে বারযাখ্ নাফসের জগত বা সূক্ষ্ম শরীর সহ নাফসের জগত সেহেতু অনেকে মনে করেন যে , এ জগতের রূপ খুবই হাল্কা দৃশ্য সম্বলিত অর্থাৎ প্রায় অদৃশ্য।
কিন্তু এ মত সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ , স্বপ্নে আমরা যা কিছু দেখি তা‘
প্রায় অদৃশ্য ’ নয় , বরং সুস্পষ্ট। আর ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , স্বপ্নলোক‘
আালামে বারযাখেরই একটি অংশ , সুতরাং স্বপ্নলোকের দৃশ্যাবলী যেহেতু সুস্পষ্ট সেহেতু‘
আালামে বারযাখের দৃশ্যাবলীও অবশ্যই সুস্পষ্ট। তবে আমরা যেহেতু‘
আালামে বারযাখের অবস্থা অবলোকন করার মতো যোগ্যতা ও অনুমতির অধিকারী নেই সেহেতু সে জগত আমাদের কাছে অদৃশ্য , কিন্তু যারা তা অবলোকন করার মতো যোগ্যতা ও অনুমতির অধিকারী তাঁদের কাছে তা অদৃশ্য নয়।
অনেক ইসলামী মনীষী‘
আালামে বারযাখকে আয়নায় পতিত দৃশ্যের সাথে তুলনা করেছেন - যাতে সুস্পষ্টতার কোনোই কমতি নেই , কিন্তু তাতে বস্তু নেই ; বস্তু ছাড়া সব কিছুই আছে। এ তুলনাটি সঠিক বলে মনে হয়।
অনেক ইসলামী মনীষীর মতে , সুস্পষ্টতার বিচারে‘
আালামে বারযাখ্ পার্থিব জীবনের চেয়ে উন্নততর। তাঁদের মতে ,‘
আালামে বারযাখের তুলনায় পার্থিব জগত হচ্ছে নিদ্রাতুল্য। কারণ , পার্থিব জীবনে মানুষের জ্ঞানচক্ষুর কার্যক্ষমতা বিভিন্ন কারণে সীমিত হয়ে পড়ে , কিন্তু‘
আালামে বারযাখে এ ধরনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। পার্থিব জীবনে নিদ্রা , তন্দ্রা , ক্লান্তি ও বিস্মৃতি আছে , কিন্তু‘
আালামে বারযাখে তা নেই। তাছাড়া মানুষ পার্থিব জীবনে‘
আালামে বারযাখের জ্ঞান রাখে না , কিন্তু‘
আালামে বারযাখের জীবনে মানুষ স্বীয় অতীত জীবন , বর্তমান‘
আালামে বারযাখ্ ও বর্তমান বস্তুজগত সম্বন্ধে অবগত থাকে। (অবশ্য ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে ,‘
আালামে বারযাখের অধিবাসীরা স্বীয় অতীত ব্যতীত পার্থিব জীবন সম্পর্কে কতোখানি জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে তা নির্ভর করে তাদেরকে প্রদত্ত সুযোগ বা অনুমতির ওপর।)
বস্তুতঃ একজন নিদ্রিত ব্যক্তি ও একজন জাগ্রত ব্যক্তির মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য এই যে , জাগ্রত ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে জানতে পারে , কিন্তু নিদ্রিত ব্যক্তি তা পারে না। তাই‘
আালামে বারযাখের জীবনে যেহেতু পার্থিব জীবনের তুলনায় জ্ঞানের পরিধি বেশী থাকে সেহেতু পারস্পরিক তুলনায় পার্থিব জগতের মোকাবিলায়‘
আালামে বারযাখের জীবনকে ঘুমন্ত ব্যক্তির তুলনায় জাগ্রত ব্যক্তির অবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
অনুরূপভাবে পুনরুত্থানপরবর্তী জীবনে মানুষের জ্ঞানচক্ষু পুরোপুরি উন্মীলিত হয়ে যাবে। তখন কারো কাছে অজানা বলে কিছু থাকবে না। অর্থাৎ‘
আালামে বারযাখের তুলনায় সে জীবনে জ্ঞানের পরিধি হবে আরো বেশী। এ কারণে হাশরের জীবন হবে পূর্ণ জাগ্রত জীবন এবং সে তুলনায়‘
আালামে বারযাখের জীবন হচ্ছে নিদ্রিত অবস্থা। ফলে মৃত্যুর পরে ব্যক্তির এরূপ মনে হওয়া স্বাভাবিক যে , সে পার্থিব জীবনে আসলে ঘুমিয়ে ছিলো এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সে নিদ্রিত অবস্থা থেকে জেগে উঠেছে। তেমনি পুনরুত্থানের পর তার মনে হবে যে , সে‘
আালামে বারযাখে নিদ্রিত ছিলো ; পুনরুত্থানের মাধ্যমে সে নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে।
এ তুলনাটি আরেকভাবেও করা হয়েছে।‘
আালামে বারযাখের জীবনের তুলনায় পার্থিব জীবন মৃত অবস্থার সমতুল্য। অর্থাৎ‘
আালামে বারযাখের জীবনে ব্যক্তির মনে হয় যে , পার্থিব জীবনে আসলে সে মৃত ছিলো এবং পার্থিব পরিভাষায় যাকে মৃত্যু বলা হয় তার মাধ্যমে সে কার্যতঃ জীবন লাভ করেছে। আর পুনরুত্থানের পর‘
আালামে বারযাখের জীবন সম্পর্কেও তার অনুরূপ অনুভূতি হবে।
যারা তিন জীবনের (পার্থিব , বারযাখী ও আখেরাতের) মধ্যে এভাবে তুলনা করেছেন তাঁদের মতে , কোরআন মজীদের কোনো কোনো আয়াত্ থেকে তাঁদের এ মতের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন পাওয়া যায়।
বিশেষ করে আখেরাতের জীবন যে পার্থিব জীবনের তুলনায় সীমাহীনভাবে ব্যাপকতর ও গভীরতর এবং স্থায়ী জীবন কোরআন মজীদে তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
)
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ(
“ আর এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ নয়: নিঃসন্দেহে পরকালের আবাসস্থল হচ্ছে প্রাণশীল ; যদি তারা জানতো!”
(সূরাহ্ আল্-‘
আনকাবূত্ : ৬৪)
ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , পার্থিব জীবনে আমরা আমাদের আবাসস্থলে ও বস্তুগত উপায়-উপকরণে প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করি না , কিন্তু আখেরাতের জীবনে অজ্ঞতার পর্দা ছিন্ন হয়ে যাবে , তখন আমরা সব কিছুতেই প্রাণের অস্তিত্ব দেখতে পাবো। অতএব , দেখা যাচ্ছে যে , আখেরাতের জীবন্ত জগতের তুলনায় এ পার্থিব জগত একটি মৃতপুরীর সমতুল্য বৈ নয়।
তাঁদের মতে , অন্য এক আয়াত থেকে তিনটি জীবনের অস্তিত্বের ধারণার প্রতি সমর্থন মিলে। এরশাদ হয়েছে :
)
قَالُوا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَى خُرُوجٍ مِنْ سَبِيلٍ(
“ (শেষ বিচারের দিনে) তারা (কাফেররা) বলবে : হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে দুই বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দুই বার জীবিত করেছেন। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের গুনাহ্ সমূহ স্বীকার করছি ; অতঃপর (আমাদের জন্য) নিষ্ক্রান্তির কোনো পথ আছে কি ?”
(সূরাহ্ আল্-গ্বাফির্/ আল্-মু ’ মিন্ : ১১)
তাঁদের মতে , এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে , এখানে দুই বার মৃত্যু বলতে পার্থিব জীবনের মৃত্যু তথা‘
আালামে বারযাখে স্থানান্তর এবং‘
আালামে বারযাখের জীবনের মৃত্যু তথা আখেরাতে প্রবেশ বুঝানো হয়েছে , তেমনি মৃত্যুর পরে জীবিতকরণ বলতে যথাক্রমে পার্থিব জীবনের মৃত্যুর পরে‘
আালামে বারযাখের জীবন দান এবং‘
আালামে বারযাখের জীবনের অবসান ঘটিয়ে আখেরাতে নতুন জীবন দান বুঝানো হয়েছে।
তবে অনেকের মতে , আত্মিক দৃষ্টিতে তথা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের দৃষ্টিতে , প্রথম বার মৃত্যুদান বলতে জ্ঞানবিহীন অবস্থায় পার্থিব জীবনে প্রেরণ ও প্রথম বার জীবিতকরণ বলতে পার্থিব দেহের মৃত্যুর মাধ্যমে‘
আালামে বারযাখের জীবন প্রদান এবং দ্বিতীয় বার মৃত্যু বলতে‘
আালামে বারযাখের জীবন প্রদান ও দ্বিতীয় বার জীবিতকরণ বলতে আখেরাতে পুনর্জীবিতকরণ বুঝানো হয়েছে।
এ দু’
টি মত অনুযায়ী , এখানে দুই বার মত্যুর কথা উল্লেখ থেকে আরো একটি সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে , তা হচ্ছে , ক্বিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের সময় প্রথমে পার্থিব জগতকে ধ্বংস করে দেয়া হবে এবং এরপর‘
আালামে বারযাখ্ সহ নাফসের জগতসমূহকেও ধ্বংস করে দেয়া হবে। তখন মিছালী দেহ সহ নাফ্স্ (ব্যক্তিসত্তা) সমূহও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ , কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
)
لا إِلَهَ إِلا هُوَ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلا وَجْهَهُ(
“ তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ্ নেই ; তাঁর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। ” (সূরাহ্ আল্-ক্বাছ্বাছ্ব্ : ৮৮)
তাঁরা মনে করেন যে , ফেরেশতাদেরও মৃত্যু হবে। এমনকি এরূপ বর্ণনাও রয়েছে যে , সবশেষে‘
আযরা ‘ ঈল্ (‘
আঃ) তাঁর নিজের জান ক্ববয্ করবেন। এর মানে হচ্ছে , ফেরেশতাদেরও মৃত্যু হবে। আর যেহেতু‘
আালামে বারযাখের নিয়ন্ত্রণ , ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন সন্দেহাতীতভাবেই ফেরেশতাদের হাতে সেহেতু ফেরেশতাদের অবর্তমানে‘
আালামে বারযাখের অস্তিত্ব টিকে থাকা বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হয়। অতএব , এমতাবস্থায়‘
আালামে বারযাখের ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অনিবার্য। অর্থাৎ এ ঘটনা হবে‘
আালামে বারযাখে অবস্থানরত নাফ্স্ বা ব্যক্তিসত্তাদের জন্য পরিপূর্ণ মৃত্যু। অতঃপর একমাত্র মহান‘
আল্লাহ্ রাব্বুল্‘
আালামীনের সত্তা ছাড়া আর কিছুই ও কেউই থাকবে না।
অবশ্য অনেকে মনে করেন যে , ইতিপূর্বেকার আয়াতে উল্লিখিত দুই বার মৃত্যু ও দুই বার জীবন প্রসঙ্গটি সর্বজনীন নয় , বরং এটা হচ্ছে সেই সীমিত সংখ্যক কাফেরদের কথা যাদের পার্থিব জীবনের মৃত্যুর পর হযরত ইমাম মাহ্দী (‘
আঃ) আত্মপ্রকাশের পর তাদেরকে জীবিত করবেন ও শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং ক্বিয়ামতের ধ্বংসের বিষয়টি পার্থিব জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট ,‘
আালামে বারযাখ্ বা‘
আালামে মিছালের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং ফেরেশেতাদেরও মৃত্যু হবে না।
তাঁদের মতে , ওপরের আয়াতেشَيْء
-এর ধ্বংসশীলতার কথা বলা হয়েছে , আরشَيْء
বলতে বস্তুগত অস্তিত্বকে বুঝানো হয় , সুতরাং ফেরেশতামণ্ডলী ও‘
আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হওয়ার কথা বুঝানো হয় নি। অন্য মত অনুযায়ী , যেহেতু আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল , সেহেতু ফেরেশতারা ও ‘ আালামে বারযাখ্ও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথমোক্ত মত অনুযায়ী , এখানে কা ’ রা ধ্বংস হবে তা-ই বুঝানো উদ্দেশ্য এবং আল্লাহ্ যে অবিনশ্বর তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে ; এর বাইরে আর কী কী ধ্বংস হবে না তা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে বিবেচিত হয় নি ; আর আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী এ ধরনের প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। তাই ফেরেশতা ,‘
আালামে বারযাখ্ ও আরো যতো অবস্তুগত সৃষ্টি আছে তার কথা উহ্য রাখা হয়েছে।
এছাড়া লোকদেরকে তাদের ক্ববর থেকে হাশরের মাঠে উত্থিত করা হবে। এরশাদ হয়েছে :
)
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُمْ مِنَ الأجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُونَ. قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا(
“ আর শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে এবং তখন তারা তাদের ক্ববরসমূহ থেকে তাদের রবের পানে ছুটে আসবে। তখন তারা বলবে : হায় দুর্ভাগ্য আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করলো!”
(সূরাহ্ ইয়া-সীন্ : ৫১-৫২)
বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদে ক্ববর বলতে মাটির ক্ববরকে বুঝানো হয় নি , কারণ , সকলের মাটির ক্ববর হয় না। তাছাড়া এ পৃথিবী যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন মাটির ক্ববর সমূহের আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব , এখানে ক্ববর থেকে রবের পানে ছুটে যাওয়া বলতে সরাসরি‘
আালামে বারযাখ্ থেকে নবসৃষ্ট পৃথিবীর বুকে উত্থিত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং কাফেররা যে দুই বার মৃত্যু ও দুই বার জীবন দানের কথা বলবে তা কেবল সেই কাফেরদের সাথে সংশ্লিষ্ট ও তাদের কথা হবার সম্ভাবনাই বেশী যাদেরকে হযরত ইমাম মাহ্দী (‘
আঃ) জীবিত করে শাস্তি প্রদান করবেন।
আরো একটি কারণে এ মতটিই সঠিক বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , ক্বিয়ামত সংঘটিত হলে তখন বস্তুজগত ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সেই সাথে মানুষ সহ এর ওপরকার সকল প্রাণী নিহত হবে। একই সাথে যদি‘
আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হয়ে যায় এবং ফেরেশতারাও মৃত্যুবরণ করে তাহলে বস্তুজগত ধ্বংসের সময় যারা মারা যাবে তাদের বারযাখী জীবন হবে না এবং সে জীবনের শাস্তি ও পুরষ্কারও তারা পাবে না এবং ক্ববর অর্থাৎ‘
আালামে বারযাখ্ থেকে হাশরের মাঠে উত্থিত হওয়ার বিষয়টিও তাদের বেলা কার্যকর হবে না। কিন্তু কোরআন মজীদে সকলেরই ক্ববর থেকে হাশরের মাঠে উঠে আসার কথা বলা হয়েছে ; এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রমের কথা বলা হয় নি। এ থেকেও উপসংহারে আসতে হয় যে , ক্বিয়ামতে কেবল বস্তুজগত ধ্বংস হবে ও তার প্রাণীকুল নিহত হবে ;‘
আালামে বারযাখ্ ধ্বংস হবে না এবং ফেরেশতা সহ আল্লাহ্ তা‘
আলার অবস্তুগত সৃষ্টিসমূহ মৃত্যুবরণ করবে না।
‘ আালামে বারযাখকে‘
আালামে মিছাল্ বা সদৃশ জগত কেন বলা হয় - এ সম্পর্কে অনেক ইসলামী মনীষীর মত হচ্ছে এই যে ,‘
আালামে বারযাখের একই সাথে পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বলেই একে‘
আালামে মিছাল্ বলেও অভিহিত করা হয়।
বস্তুতঃ আখেরাতের জগত বহুলাংশেই পার্থিব জীবনের অনুরূপ। আখেরাতের জীবন হবে দেহ ও নাফসের সমন্বিত জীবন ; ঠিক পৃথিবীর জীবনের মতোই। তবে আখেরাতের জীবন হবে চিরস্থায়ী এবং তা হবে পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের ফলাফল লাভের জীবন। তাছাড়া সেখানে কোনো সত্য গোপন থাকবে না এবং সেখানে নৈতিক ফলাফলের পরিপূর্ণ প্রতিফলনের পথে সামান্যতম বাধাও থাকবে না। কিন্তু গঠনপ্রকৃতির দিক থেকে আখেরাতের জগত পার্থিব জগতের অনুরূপ হবে।
অন্যদিকে‘
আালামে বারযাখ্ একটি পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রার জগত অর্থাৎ অবস্তুগত জগত। কিন্তু সেখানকার সব কিছু আকার-আকৃতির দিক থেকে পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ জগত , তবে তা অবস্তুগত। সুখ-দুঃখ ও উপায়-উপকরণের দিক থেকেও সে জগত পার্থিব জগত ও আখেরাতের জগতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ , যদিও বস্তুগত নয়। এছাড়া‘
আালামে বারযাখে নৈতিক বিধানের ফলাফল থেকে বেঁচে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই , ঠিক আখেরাতের জগতের ন্যায়ই। তেমনি পার্থিব জগতে যে জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতা আছে‘
আালামে বারযাখে তা ঘুচে যাবে এবং এদিক থেকে তার আখেরাতের জীবনের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে , যদিও আখেরাতের জীবনের ন্যায় তা পরিপূর্ণ জ্ঞানের জগত নয়। তাছাড়া আখেরাতের জীবনে যেমন পার্থিব জীবনের আমল অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের বেহেশত ও দোযখ রয়েছে তেমনি‘
আালামে বারযাখের জীবনেও বিভিন্ন ধরনের মানুষের জন্য বিভিন্ন স্তরের পুরষ্কার ও শাস্তি তথা বিভিন্ন স্তরের বারযাখী বেহেশত ও দোযখ রয়েছে।
এ সকল দিক বিবেচনা করেই‘
আালামে বারযাখকে‘
আালামে মিছাল্ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী ,‘
আালামে বারযাখের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , মানুষের পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ গুণ-বৈশিষ্ট্য ও আমল সমূহ বিভিন্ন ধরনের রূপক মূর্ত রূপ ধারণ করে‘
আালামে বারযাখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাফসের সঙ্গীরূপে তার সাথে অবস্থান করে তার সুখ-দুঃখের কারণ হবে। যেমন : দুনিয়ার বুকে যার স্বভাব ছিলো নিষ্ঠুর , কুটিল ও হিংস্র সাপের স্বভাব তার এ স্বভাব বিষধর সাপরূপে‘
আালামে বারযাখে তার সাথী হবে এবং তাকে দংশন করতে থাকবে। বলা বাহুল্য যে , সে সাপ বস্তুগত দেহের অধিকারী হবে না , বরং ঐ ব্যক্তির নাফসের ন্যায়ই অবস্তুগত দেহের অধিকারী হবে। অন্যদিকে , বিভিন্ন সূত্রের হাদীছ অনুযায়ী , দুনিয়ার জীবনে যারা নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত্ করেন , কোরআনকে ভালোবাসেন , কোরআনের হুকুম পালন করে চলেন ও কোরআনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা-সাধনা করেন‘
আালামে বারযাখে কোরআন অবস্তুগত মূর্ত রূপ ধারণ করে , কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী , একজন সুদর্শন যুবক রূপে , অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে তাঁকে সাহচর্য দেবে এবং তাঁর বারযাখী জীবনকে আনন্দঘন করে রাখবে - যাতে তিনি একাকিত্ব বোধ না করেন। (অবশ্য বস্তুবাদীরা এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে , কিন্তু আল্লাহ্ তা‘
আলা চাইলে তাঁর পক্ষে এটা করা খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার।)
এছাড়া বারযাখী জীবনে নাফ্স্ তার পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের স্মৃতিসমূহ থেকে সুখ-দুঃখ বোধ করে। অবশ্য পার্থিব জীবনেও মানুষ এভাবে অতীত স্মৃতির স্মরণে প্রীত বা ক্লেশ বোধ করে। তবে পার্থিব জীবনে মানুষ তার অনেক স্মৃতি একেবারেই ভুলে যায় ; আদৌ মনে করতে পারে না এবং অন্যান্য স্মৃতি সময়ের ব্যবধানে ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে , ফলে তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়াও ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসে। কিন্তু‘
আালামে বারযাখে তার সমস্ত স্মৃতিই চলমান ঘটনাবলীর ন্যায় সুস্পষ্টরূপে তার স্মরণ হবে। ফলে তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়াও পার্থিব জীবনে অতীত স্মৃতিচারণের তুলনায় অনেক বেশী হবে , বরং ঐ সব ঘটনা সংঘটিত হবার সময়কার অনুভূতির ন্যায় তীব্র অনুভূতি হবে। তবে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে যে সব পাপকর্মের মধ্যে সুখ ও আনন্দ লাভ করেছিলো সেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় যেহেতু বারযাখী জীবনে তার জন্য বহু শাস্তির উপকরণ তৈরী হয়ে গিয়েছে সেহেতু সে ঐ সব স্মৃতি থেকে চরম আত্মপীড়ন অনুভব করবে ও সে জন্য আফসোস্ করবে। অন্যদিকে পার্থিব জীবনে সে সত্য ও ন্যায়ের পথে যে সব কষ্ট ও যুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছে সেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় বারযাখী জীবনে তার জন্য বিভিন্ন নে ‘ আমত তৈরী হয়ে যাবার কারণে ঐ সব স্মৃতি থেকে সে অপার্থিব পরমানন্দ অনুভব করবে।
মানুষ যে তার পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মসমূহ ঘটমান অবস্থায় আখেরাতের জীবনে দেখতে পাবে কোরআন মজীদে তা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
)
يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتًا لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ. فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ. وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ(
“ সেদিন (শেষ বিচারের দিনে) লোকেরা দলে দলে বহির্গত হবে যাতে তাদেরকে তাদের আমল সমূহ দেখানো হয়। সুতরাং যে অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে তা সে দেখতে পাবে এবং যে অণু পরিমান মন্দ কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। ” (সূরাহ্ আয্-যিলযাল্ : ৬-৮)
এ থেকে মনে হয় যে , শেষ বিচারের মাঠে লোকেরা তাদের ভালো-মন্দ আমল সমূহ সবাক চলচ্চিত্রের ন্যায় দেখতে পাবে। আর এটা আজ অকাট্য বৈজ্ঞানিক সত্য যে , মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষেই তার সারা জীবনের , এমনকি তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জেনেটিক কোড আকারে লিপিবদ্ধ আছে। অসম্ভব নয় যে , তা তার শরীরের অধিকতর ক্ষুদ্র অংশে অর্থাৎ প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পর্যন্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে , যদিও বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তা চিহ্নিত করার ও তাকে সবাক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন নি , কেবল বড় বড় বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।
যা-ই হোক , তা শুধু কোষেই রেকর্ডকৃত থাক বা অণু-পরমাণুতেও লিপিবদ্ধ থাক , আল্লাহ্ তা‘
আলা যেহেতু মানুষের আমলকে কোড আকারে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করেছেন সেহেতু সে কোডকে সবাক চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করা তাঁর জন্য খুবই সহজসাধ্য। সম্ভবতঃ ফেরেশতাদের লিখিত আমলনামার সত্যায়নের লক্ষ্যে এ সবাক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। কারণ , নইলে নাস্তিক , কাফের ও পাপাচারী লোকেরা হয়তো ফেরেশতাদের ওপর মিথ্যা লেখার অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে।
আর যেহেতু‘
আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আখেরাতের জীবনের প্রতিচ্ছবি সেহেতু এটাই স্বাভাবিক যে , সেখানেও লোকেরা তাদের সারা জীবনের কাজকর্ম সবাক চলচ্চিত্রের ন্যায় দেখতে পাবে। অবশ্য সেখানে যদি এভাবে আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদর্শন করা না-ও হয় এবং নাফসগুলো কেবল তাদের অতীত জীবনকে স্মরণ করে , তো সে ক্ষেত্রে তাদের সে স্মৃতি হবে চলমান ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণের ন্যায় জ্বলজ্বলে এবং তার সুখকর ও কষ্টকর প্রতিক্রিয়া যে পার্থিব জীবনের অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার তুলনায় অনেক বেশী তীব্র হবে তাতে সন্দেহ নেই।