‘
আালামে বারযাখ্
প্রসঙ্গ
ও
তার
পটভূমি
তাওহীদ ও নবুওয়াতের পাশাপাশি আখেরাত্ বা মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন ও পার্থিব জীবনের ভালো-মন্দ কর্মের প্রতিদানের ধারণা ইসলামের তিনটি মূলনীতির অন্যতম। তবে মানুষের জীবনে প্রভাবের বিচারে আখেরাতের ধারণাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ , আখেরাতের ধারণা গ্রহণ না করলে তাওহীদ ও নবুওয়াতের ধারণার বাস্তব জীবনে কোনো প্রভাবই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সে ক্ষেত্রে তাওহীদ ও নবুওয়াতের ধারণা স্রেফ একটি তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয়ে পর্যবসিত হতে বাধ্য।
মুসলমানদের মধ্যে আখেরাত্ সংক্রান্ত বিস্তারিত ধারণায় খুটিনাটি মতপার্থক্য থাকলেও , বিশেষ করে কোরআন মজীদের বহু আয়াতে এ সম্বন্ধে উল্লেখ থাকায় এ সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা ও এর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সম্বন্ধে সকলেই অভিন্ন মত পোষণ করে থাকে। তা হচ্ছে , আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছায় এক সময় গোটা সৃষ্টিলোক ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং ঐ সময় জীবিত প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টিই মৃত্যুবরণ করবে। এরপর আল্লাহ্ তা‘
আলার ইচ্ছায় এক নতুন জগত সৃষ্টি হবে। তখন সৃষ্টির শুরু থেকে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে আগত ও আগতব্য সকল প্রাণশীল সৃষ্টিকেই দেহধারী করে পুনর্জীবিত করা হবে। অতঃপর ইহজীবনে তারা যা কিছু করেছে তার ভালো-মন্দ বিচার করে পুরষ্কার ও শাস্তি প্রদান করা হবে।
কিন্তু ক্বিয়ামত্ সংঘটিত হতে এখনো বাকী আছে। ঠিক কী পরিমাণ সময় বাকী আছে তা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা ব্যতীত কারো জানা নেই ; হতে পারে তা কয়েক বছর , হতে পারে কয়েক কোটি বছর। তবে এটা সুস্পষ্ট যে , যারা অনেক আগেই মৃতুবরণ করেছে তারা এখন শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে এবং যারা এখন মৃত্যুবরণ করছে ও পরে মৃত্যুবরণ করবে তাদেরকেও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী সময়টা তাদের কী অবস্থায় কাটছে ও কাটবে - এ ব্যাপারে মানুষের ঔৎসুক্যের কোনো সীমা নেই।
আমাদের বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে প্রচলিত সাধারণ‘
আক্বীদাহ্ এই যে , মৃত্যুর পরে যখন একজন মানুষকে ক্ববর দেয়া হয় তখন দু’
জন ফেরেশতা এসে তাকে ঈমান ও‘
আক্বীদাহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করে এবং গুনাহ্গার লোকেরা সে সব প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে না বিধায় তাদেরকে ক্ববরে শস্তি দেয়া হয়। এরপর ভালো লোকদের আত্মাকে‘
ইল্লীন্ (সমুন্নত ধাম) নামক উত্তম স্থানে আরামে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় এবং গুনাহ্গারদের আত্মাকে সীজ্জীন্ (কারাগার) নামক এক কষ্টকর অবস্থায় রাখা হয় ; পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত তারা এ অবস্থায়ই থাকবে। অবশ্য কিছু কিছু বই-পুস্তকে মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগতকে‘
আালামে বারযাখ্ বলে উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় বটে - যার নামকরণ অবশ্যই সঠিক , কিন্তু এ জগতের অবস্থা সম্বন্ধে উপরোক্ত সওয়াল্-জবাব ও ক্ববর আযাব ছাড়া আর কোনো কিছুর উল্লেখ তেমন একটা দেখা যায় না।
এ বিষয়ে আমাদের দেশে প্রচলিত দ্বীনী বই-পুস্তকে ও ওয়ায্ মাহ্ফিলে মৃত্যুপরবর্তী জগত প্রসঙ্গে স্ববিরোধিতাও দেখা যায়। কারণ , অনেক সময় ক্ববরের সওয়াল-জবাবের পর পরই গুনাহ্গারদের জন্য ক্ববর আযাব ও এরপর দ্বীনদারদের জন্য‘
ঈল্লীন্ ও গুনাহ্গারদের জন্য সিজ্জীনের কথা বলা হয়। আবার অনেক সময় গুনাহ্গারদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী আযাবের কথা এবং নেককারদের আত্মাকে কোনোরূপ পুরষ্কার না দিয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় রেখে দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ক্ববরের জগতে অর্থাৎ‘
আালামে বারযাখে যে সুখ-শান্তি আছে সে সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা করা হয় না। এছাড়া দো ‘ আ ও দান-ছ্বাদাক্বাহ্ থেকে ছ্বাওয়াব্ পাওয়ার আশায় আত্মাদের স্বজনদের কাছে এসে ঘোরাফেরার কথাও বলা হয়।
মোদ্দা কথা , এ বিষয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণায় কোনো একক ও সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুপস্থিত এবং এতে অস্পষ্টতা , বিক্ষিপ্ততা ও স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। তবে“
ক্ববর আযাব্ ” একটি সর্বজনীন ও বহুলপরিচিত পরিভাষা। যেহেতু এ বিষয়ে যারা আলোচনা করেন তাঁদের আলোচনার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হয় মানুষকে ভয় দেখিয়ে গুনাহ্ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করা , সেহেতু এতদসংক্রান্ত লেখা ও ওয়ায্-নছ্বীহতের শতকরা পঁচানব্বই ভাগই“
ক্ববর আযাব ” সংক্রান্ত।
এছাড়া একদিকে যেমন‘
আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জগতের প্রকৃত অবস্থা তথা সেখানকার সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে যেমন অস্পষ্টতা ও বিতর্ক রয়েছে , তেমনি সাম্প্রতিক কালে ইসলাম-বিশেষজ্ঞ হবার দাবীদার কোনো কোনো লোকের পক্ষ থেকে এরূপ একটি জগতের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে অর্থাৎ তাঁরা আত্মার অস্তিত্ব ও শেষ বিচারের বিষয়টি স্বীকার করলেও‘
আালামে বারযাখ্ বা ক্ববরের জীবনের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন।
এদের মতে , মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়টা ঘুমের মতো। অর্থাৎ মৃতদের আত্মা কোটি কোটি বছর ঘুমের মতো অবস্থায় কাটিয়ে দেবে , এরপর তারা দেহধারী হয়ে পুনরুত্থিত হবে। তাঁরা মৃত্যুর পরে ও পুনরুত্থানের আগে মৃতদের নাফ্স্-এর (প্রচলিত কথায় আত্মার) জন্য কোনোরূপ আনন্দ-বিষাদ , ভালো-মন্দ বা পুরষ্কার ও শাস্তির ধারণা মেনে নিতে রাযী নন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করেন যে , ব্যক্তি পাপ-পুণ্য যা-ই করে থাকুক না কেন , বিচারের আগে তাদের শাস্তি বা পুরষ্কার লাভের (অল্প মাত্রায় হলেও) ধারণা অযৌক্তিক।
বিষয়টি এখানেই শেষ নয় , সাম্প্রতিক কালে এ ব্যাপারে দৃশ্যতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ধরনের কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ভ্রমাত্মক এমন ধরনের প্রচারণাও চালানো হয়েছে এবং প্রচারমাধ্যমের বদৌলতে তা বহু মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে - যা অনেকের মনে সংশয় ও চৈন্তিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে থাকতে পারে।
অবশ্য আলমে বারযাখ্ অস্বীকারকারীদেরকে একতরফাভাবে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। কারণ , ইসলামের দৃষ্টিতে‘
আালামে বারযাখ্ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পেশ না করা এবং ক্ববরের জীবনের অবস্থা সংক্রান্ত প্রচলিত ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদসংক্রান্ত বই-পুস্তকে সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত বক্তব্যের পরিবর্তে এলোমেলো ও অগভীর বক্তব্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাশীল লোকদের মনে এ ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করবে - এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে ঐ সব ওয়ায্-নছ্বীহত্ ও এতদ্সংক্রান্ত বই-পুস্তকে‘
আক্বল্ ও কোরআন মজীদের দলীল - যা অকাট্য দলীল - কদাচিৎ ব্যবহার করা হয় এবং যে সব হাদীছ উদ্ধৃত করা হয় সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা পরীক্ষা করা হয় না। এছাড়া কোরআন-হাদীছ বহির্ভূত এমন অনেক কিচ্ছা-কাহিনী জুড়ে দেয়া হয় যেগুলো প্রামাণ্য নয় এবং দলীল হিসেবে যেগুলোর কোনোই গ্রহণযোগ্যতা নেই। ফলে এ ধরনের দুর্বল উপস্থাপনা মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কেই দুর্বল হিসেবে প্রতিপন্ন করে।
কিন্তু কোনো প্রতিপাদ্য বিষয়কে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হলেই যে , মূল বিষয়টি বাত্বিল বলে গণ্য হবে এমন কোনো কথা নয়। বরং কোনো বিষয়কে (মূল বিষয়কে , বিস্তারিত বক্তব্যকে নয়) গ্রহণ ও বর্জন উভয় ক্ষেত্রেই অকাট্য দলীল-প্রমাণ অপরিহার্য। তাই মৃত্যুপরবর্তী ও পুনরুত্থানপূর্ববর্তী জগতের সুখ-দুঃখের বিষয়টিকেও কেবল অকাট্য দলীল-প্রমাণের আলোকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে।
এখানে আলোচ্য বিষয়টিকে দুই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে : মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং বিশেষভাবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে , যেহেতু বিষয়টি জীবিত মানুষদের অভিজ্ঞতার জগতের বহির্ভূত একটি বিষয় সেহেতু এ ব্যাপারে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। আর সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি যেমন সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়া অপরিহার্য হবে না তেমনি তা অকাট্যভাবে বাত্বিল বা বর্জনীয় বলেও গণ্য করা যাবে না। কারণ , কোনো বিষয়ে অকাট্য জ্ঞানে উপনীত হতে না পারার মানে কখনোই মূল জ্ঞাতব্য অজ্ঞেয় বিষয়টির অনস্তিত্ব নয়। অন্যদিকে বিষয়টি জীবিত মানুষদের অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিধায় এ ব্যাপারে ইসলামী সূত্রসমূহের অকাট্য ফয়ছ্বালা মেনে নেয়া মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য। তবে কোনো ফয়ছ্বালা কেবল তখনই ইসলামী ফয়ছ্বালা হিসেবে পরিগণিত হবে যখন তা অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রমাণের জন্য অবশ্যই যে কোনো ধরনের দুর্বল , বিতর্কিত ও সংশয়মূলক দলীলের (তাকে যদি ছ্বহীহ্ বলে‘
দাবী ’ করা হয়েও থাকে) আশ্রয়গ্রহণ পরিহার করতে হবে। কারণ , কোনো সঠিক বিষয় প্রমাণের ক্ষেত্রে দুর্বল , বিতর্কিত ও সংশয়মূলক দলীলের আশ্রয়গ্রহণ মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতাকেই সংশয়াপন্ন করে তোলে , এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাকে প্রত্যাখ্যাত করে তোলে। তাই এ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রমাণের বেলায় কেবল অকাট্য ইসলামী জ্ঞানসূত্র অর্থাৎ‘
আক্বল্ ও কোরআন মজীদ এবং এ দুই মানদণ্ডের বিচারে অকাট্য প্রমাণিত সূত্রের আশ্রয় নেয়া যাবে ; এর বহির্ভূত অন্য যে কোনো দলীল থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। অবশ্য যে সব ক্ষেত্রে , প্রধানতঃ শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে , ফয়ছ্বালায় উপনীত হওয়ার জন্য অকাট্য দলীল পাওয়া যায় না সে সব ক্ষেত্রে কেবল‘
সম্ভাব্য জবাব ’ হিসেবে অন্যান্য সূত্রের বক্তব্যকে বিচারবুদ্ধি (‘
আক্বল্)-এর আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করা যেতে পারে।