ইসলামের প্রথম মুসলমান
নিঃসন্দেহে আলীই (আ.) প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ও রাসূল (সা.)-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত আলোচনা শুরু করার পূর্বে দু’টি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী বলে মনে করছি।
(ক) ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে আলী (আ.) ও অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্যকে পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য মুসলমানগণ এমন অবস্থায় ঈমান এনেছে যে, ইতিপূর্বে বছরের পর বছর ধরে মূর্তি পূজা করেছে। কিন্তু আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) এমন অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন যে, কখনোই কোন অমুসলিমদের উপাসনালয়ে যাননি এবং কখনোই মূর্তি পূজাও করেননি। যদি তাকে প্রথম মুসলমান বলি তাহলে সেই অর্থেই তিনি প্রথম মুসলমান যে অর্থে হযরত ইব্রাহিম (আ.) বলেছিলেনঃ “আমি প্রথম মুসলমান” ।(হাবীবুস সাঈর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১১।) যদি বলি তিনি প্রথম মু’মিন তাহলে সেই অর্থেই প্রথম মু’মিন যে অর্থে হযরত মুসা(আ.) বলেছিলেনঃ “আমিই প্রথম মু’মিন” ।(সূরা-মায়িদা, আয়াত-৬৭) যদি বলি যে আলী (আ.) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাহলে সেই অর্থে যে অর্থে কোরআনে কারীম ইব্রাহিম (আ.) সম্পর্কে বলেছেঃ “স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমার প্রভূ বলেছিল যে, ইসলাম গ্রহণ কর, সে বলেছিল- “আমি বিশ্ব প্রতিপালকের অনুগত হলাম”।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭০, অধ্যায়-১১, হাদীস-৩৭) আর যদি বলি তিনি ঈমান এনেছেন তাহলে সে অর্থে যে অর্থে রাসূল (সা.) সম্পর্কে কোরআনে এসেছে যে, “রাসূল (সা.) বিশ্বাস করেন ঐ সকল বিষয়ের উপর যে সকল বিষয় তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে” ।(মানাকিব ইবনে মাগাজেলী, পৃষ্ঠা-১৬।)
(খ) ঈমান কোন কিছুর প্রতি আসক্তি ও বিশ্বাস স্থাপন, এ অর্থে বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম এবং ঈমানের তীব্রতার এ ভিন্নতাই মানুষকে পবিত্র সত্তার নিকটতম ও দূর হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে ।
আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি ঈমান ও ধর্মীয় সত্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিলেন শীর্ষস্থানে । তিনি স্বয়ং বলেছেনঃ “আল্লাহর শপথ, যদি বিশ্বের সকল গোপন আবরনসমূহ অপসারিত হয় তাহলেও আমার বিশ্বাসে কিছু বৃদ্ধি পাবে না (কোন পরিবর্তন ঘঠবে না)।”(সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৬ এবং তারিখে দামেশক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৫, হাদীস- ৫৪৭)
রাসূল (সা.) তার ঈমান বা বিশ্বাস সম্পর্কে বলেছেনঃ যদি আলীর ঈমান বা বিশ্বাস এক পাল্লায় রাখা হয় আর সমস্ত আসমান ও জমিনকে অন্য পাল্লায় রাখা হয় তাহলেও আলীর ঈমানের পাল্লাটিই বেশী ভারী হবে।(কানজুল উম্মাল, ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৪-১০৫, হাদীস-৩৬৩৪০-৩৬৩৪৪ ও পৃষ্ঠা-১৩৩, হাদীস-৩৬৪২০)
এমন কি যদি উক্ত দু’টি বিষয় ব্যতিরেকেও আলীকে (আ.) অন্যান্য সাধারণ মুসলমানের মতই মনে করি তারপরও তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ যেদিন রাসূল (সা.) তার নবুয়্যত ঘোষণা করেছেন, ঠিক সেদিনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেছেনঃ রাসূল (সা.) সোমবার দিনে নবুয়্যত ঘোষণা করেন। আর আলী (আ.) মঙ্গলবার দিন তার সাথে নামাজ আদায় করেন। অথবা তার প্রতি ঈমান আনেন(কানজুল উম্মাল, ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৮, হাদীস-৩৬৪৩৭। ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩, অধ্যায়-১২, হাদীস-৩৯) এবং ঐ দিনই যখন নবুয়্যত ঘোষণা করলেন সেদিন প্রথম যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনার ও সহায়তা করার ঘোষণা দেন তিনি হলেন হযরত আলী (আ.) যদিও তিনি ছিলেন উপস্থিত জনতার মাঝে বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে ছোট।(সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৬ ও মাজমাউল জাওয়ায়েদ, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৪-১০৮) কারণ, তাঁর বয়স তখনও দশ বছর অতিক্রান্ত হয়নি।(সকল খুতবার উৎস হচ্ছে- আল-গাদীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০-১১, নাওয়ারুল উসূল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৩, মো’জামে কাবির তিবরানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৬, হাদীস- ৪৯৭১, নজুলুল আবরার, পৃষ্ঠা-৫১) তিনি স্বয়ং নিজেই বলেছেনঃ আমিই সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেছি, আর তা এমন অবস্থায় যখন আমি অপ্রাপ্ত বয়স্কৃ তরুন ছিলাম।(মানাকিব ইবনে মাগাজেলী, পৃষ্ঠা-১৯, হাদীস-২৪ এবং ফারায়েদুস সিমতাঈন)
ইসলামে তার প্রথম ঈমান আনয়নকারীর মর্যাদা এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, আহলে সুন্নাতের অনেক আলেম ও ঐতিহাসিকগণ বলেছেনঃ তার প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হওয়ার বাপারে সকলেই ঐকমত্য।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৩, অধ্যায়-১২, হাদীস-৩৯-৪০)
রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবী ও তাবেঈনরাও তার এই মর্যাদার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আল্লামা আমিনী (র.) সাহাবী, তাবেঈন ও আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতদের মধ্যে ৫১ জন (একান্না জন) ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন যারা এই মর্যাদার কথা বর্ণনা করেছেন ও ১৫ জন (পনের জন) ইসলামের প্রাথমিক যুগের কবি’র নাম উল্লেখ করেছেন যারা স্বীয় কবিতায় তার এই মর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন।(তারিখে রওজাহুস সাফা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৪১, আশারায়ে মোবাশশারা, পৃষ্ঠা-১৬৪, হামিদীয়া লাই্রব্রেরী (বাংলায় অনূদিত))
এছাড়াও রাসূল (সা.)-এর অনেক হাদীসে আলীকে (আ.) প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি (সা.) বলেছেনঃ প্রথম যে ব্যক্তি হাউজে কাউসারে এসে আমার পাশে দাড়াবে সে ঐ ব্যক্তি যে সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ আলী ইবনে আবী তালিব।(তারিখে হাবিবুস সাঈর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১১)
তিনি আরো বলেনঃ প্রথম যে ব্যক্তি আমার সাথে নামাজ আদায় করেছে সে হচ্ছে আলী।(ই’লামলু ওয়ারা বি ই’লামিল হুদা, পৃষ্ঠা-১৩৩)
অপর এক বর্ণনায় এসেছেঃ সাত বছর ধরে আলী ব্যতীত কেউ আমার সাথে নামাজ আদায় করেনি এবং তখন ফেরেশতাগণ আমাদের দু’জনের উপরই দরুদ পড়তেন।(আল-গাদীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৭০; মোহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী রচিত “আল-বেলায়াহ” গ্রন্থ হতে সংগৃহিত ও মানাকেবে আলী ইবনে আবী তালিব রচনায় আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাবারী যিনি খালিলী নামে প্রসিদ্ধ)
মাসউদী তার “ইসবাতুল ওসীয়াহ” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি (আলী) নবুয়্যত ঘোষণার দু’বছর পূর্ব হতে রাসূল (সা.)-এর সাথে নামাজ আদায় করতেন।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৫, অধ্যায়-৯, হাদীস-৩১-৩২, পৃষ্ঠা-৭১, অধ্যায়-১১, হাদীস-৩৮, আশারায়ে মোবাশাশারা, পৃষ্ঠা-১৬৪, হামিদীয়া লাই্রব্রেরী (বাংলায় অনূদিত)) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বিভিন্ন ধরনের বর্ণনায় এই অর্থই অধিকাংশ ব্যক্তি গ্রহণ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কিছু প্রসিদ্ধ বিবরণ তুলে ধরছিঃ
১. প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
২. প্রথম ব্যক্তি যিনি ঈমান এনেছেন।
৩. প্রথম ব্যক্তি যিনি নামাজ আদায় করেছেন।
৪. সে-ই ইসলামে আমার উম্মতের মধ্যে অগ্রগামী।
৫. সে-ই প্রথম ঈমান আনয়নকারী ও সে-ই প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী।
তিনি নিজেই উক্ত বিষয়ে বহুবার বলেছেনঃ আমিই প্রথম ব্যক্তি যে রাসূল (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছি।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬, অধ্যায়-১২, হাদীস-৪৩ ও মানাকিবুল ইমাম আমিরুল মু’মিনীন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪২, হাদীস-৫২৯ এবং নাজমে দারুস সিমতাঈন, পৃষ্ঠা- ১১২।)
আরো বলেছেনঃ আমিই সর্ব প্রথম রাসূল (সা.)-এর সাথে নামাজ আদায় করেছি।(মানাকিবুল ইমাম আমিরুল মু’মিনীন (আঃ), ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৯, হাদীস-৮৬৪)
নাহজুল বালাগা’র একটি খুতবাতে বর্ণিত হয়েছেঃ
আমি সর্বদা তার সাথেই ছিলাম, তা সফরকালে হউক বা ঘরেই হউক। এমনভাবে তার সাথে ছিলাম যেমনভাবে উষ্ট্রী শাবক তার মায়ের সাথে থাকে তিনি প্রতিদিন তার কার্যাদি সম্পাদনের সময় আমাকে সেগুলোর অনুসরণ করতে বলতেন। প্রত্যেক বছর তিনি হেরা পাহাড়ের গুহায় ধ্যান মগ্ন হতেন আর আমি তাকে প্রত্যক্ষ করতাম, আমি ব্যতীত অন্য কেউ তাকে দেখতে পেত না। সে সময় একটি বাড়িতে, যেখানে রাসূল (সা.) ও খাদিজা (রা.) ব্যতীত কেউ ছিল না, কোন পরিবারও তখন পর্যন্ত মুসলমান হয়নি, তখন আমি তাদের মাঝে ছিলাম তৃতীয় জন। ওহী ও নবুয়্যতের দ্বীপ্তিকে অবলোকন করতাম আর নবুয়্যতের সুঘ্রাণকে করতাম অনুভব।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৫, অধ্যায়-১২, হাদীস-৪১ ও মানাকিবুল ইমাম আমিরুল মু’মিনীন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৯, হাদীস-৮৬৪।)
তিনি আরো বলেনঃ যখন এই উম্মতের কোন ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করেনি, তখনও আমি সাত বছর যাবৎ রাসূল (সা.)-এর পাশে থেকে আল্লাহর ইবাদত করেছি।(নাজমে দাররুস সিমতাঈন, পৃষ্ঠা-১১২ এবং ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬, অধ্যায়-১২, হাদীস-৪২)